প্রশ্ন: যুক্তরাজ্যের যেসব মুসলমান খ্রিস্টমাস (বড়দিন) এর মৌসুমে খ্রিস্টমাসের দিন অথবা এরপরে নিজেদের বাড়ীতে তাদের মুসলিম পরিবারের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করে তাদেরকে আপনারা কি উপদেশ দিবেন। যেমন- তুর্কি মোরগের রোস্ট তৈরি করা, খ্রিস্টমাস কেন্দ্রিক অন্যান্য নৈশ খাবারের আয়োজন করা। বেলুন ও কাগুজে ফুল দিয়ে নিজেদের বাড়ীঘর সজ্জিত করা। গোপন সান্তা প্রথা পালন করা। সেটা এ রকম- প্রত্যেক আত্মীয় গোপনে উপস্থিত কারো জন্য বিশেষ একটা উপহার নির্বাচন করবে। যার জন্য উপহারটি কেনা হয়েছে তাকে দেয়ার জন্য উপহারটি অনুষ্ঠানে নিয়ে আসবে; কিন্তু তাকে জানাবে না যে, সে কে? (সান্তাক্লজের ব্যাপারে আজগুবি বিশ্বাস অপনোদন করতে গিয়ে গোপন সান্তা প্রথাটি অমুসলিমদের মধ্যে যারা খ্রিস্টমাস পালন করে তাদের মাঝে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।) এই কাজটি কি হালাল; নাকি হারাম? যদি এ ধরণের অনুষ্ঠানে মুসলমান ছাড়া (আত্মীয়স্বজন ছাড়া) অন্য কেউ হাজির না হয়?
উত্তর
আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য)। যে উৎসবের কথা আপনি উল্লেখ করেছেন এটা হারাম তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু এর মধ্যে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। এটা সবার জানা আছে যে, মুসলমানদের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ছাড়া আর কোন উৎসব নেই। সপ্তাহের ঈদের দিন হচ্ছে শুক্রবার। এর বাইরে অন্য কোন ঈদ-উৎসব নিষিদ্ধ। এর বাইরে যে কোন উৎসব হয় বিদআতের মধ্যে পড়বে; যদি আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তির আশায় সেটা পালন করা হয়; যেমন-ঈদে মিলাদুন্নবী। অথবা কাফেরদের সাথে সাদৃশ্যের পর্যায়ে পড়বে; যদি প্রথা হিসেবে সেটা পালন করা হয়; আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নয়। কারণ এ ধরণের বিদআতি উৎসব চালু করা আহলে কিতাবদের কর্ম; যাদের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য আমরা আদিষ্ট হয়েছি। যদি এই উৎসব-ই তাদের উৎসব হয় তখন হুকুম কেমন হবে! এ মৌসুমে বেলুন দিয়ে ঘর সাজানো কাফেরদের উৎসব পালনে প্রকাশ্য অংশগ্রহণ করার নামান্তর। মুসলমানদের উচিত নয়- এ দিবসগুলো উদযাপন করা, এ উপলক্ষে ঘরবাড়ী সাজ-সজ্জা করা বা খাবার-দাবার প্রস্তুত করা। মুসলমানদের এগুলো করা মানে কাফেরদের উৎসবে অংশ গ্রহণ করা। কাফেরদের উৎসবে অংশগ্রহণ করা হারাম- এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: মুসলমানদের জন্য হারাম কাফেরদের উৎসব উপলক্ষে সমবেত হওয়া, তাদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করা, উপহার বিনিময় করা, মিষ্টি বিতরণ করা, খাবার বিতরণ করা অথবা কর্মস্থল থেকে ছুটি কাটানো ইত্যাদি। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে উক্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।” শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) তাঁর “ইকতিদাউস সিরাতিল মুসতাকিম মুখালিফাতু আসহাবিল জাহিম” গ্রন্থে বলেন: তাদের উৎসবের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণের অনিবার্য ফলাফল হলো- অসত্যের অনুসরণ সত্ত্বেও তাদের অন্তরাত্মাকে খুশি করা। এটাকে তারা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এবং দুর্বল ঈমানদারকে ভাগিয়ে নেয়ার জন্য প্রলুব্ধ হতে পারে।”[সমাপ্ত] যে ব্যক্তি এগুলোতে অংশ নিল সেটা সৌজন্যের খাতিরে হোক, সম্পর্কের কারণে হোক, লজ্জায় পড়ে হোক অথবা অন্য যে কোন কারণে হোক না কেন সে গুনার কাজ করল। কারণ এটি আল্লাহর দ্বীনের ক্ষেত্রে আপোষ; এতে কাফেরদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং তাদের ধর্মীয় গৌরব উজ্জীবিত হয়” [শাইখ উছাইমীনের ফতোয়াসমগ্র, ৩/৪৪] শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি জবাব আছে। সেটা হচ্ছে- তাঁকে এমন মুসলমানদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যারা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নওরোজ উৎসবে খাবার তৈরী করে; ইপিপফানি, যীশুর জন্মদিন, পবিত্র বৃহষ্পতিবার (Maundy Thursday), পবিত্র শনিবার (Holy Saturday) ইত্যাদি দিবস পালন করে; যারা খ্রিস্টানদের কাছে এমন জিনিসপত্র বিক্রি করে যেগুলো তারা উৎসব পালনে ব্যবহার করে। মুসলমানদের জন্য এসব করা কি জায়েয? নাকি নাজায়েয? তিনি জবাবে বলেন: আলহামদু লিল্লাহ। মুসলমানদের জন্য তাদের উৎসবের কোনকিছুতে সাদৃশ্য গ্রহণ করা জায়েয নয়। না, তাদের খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে, না পোশাকে, না গোসলে, না অগ্নি প্রজ্বলনে, না প্রাত্যহিক কাজকর্ম বা ইবাদত থেকে অবকাশ নেয়ার ক্ষেত্রে, কোন ক্ষেত্রেই নয়। তেমনি ভোজ-অনুষ্ঠান করা, উপহার বিনিময় করা, তাদের উৎসবের সৌজন্যে বেচাবিক্রি করা, শিশুদেরকে তাদের উৎসবের খেলায় যেতে দেওয়া, সাজ-সজ্জা প্রকাশ করা ইত্যাদি কোনটি জায়েয নয়। মোদ্দাকথা, অর্থাৎ তাদের উৎসবের দিনকে কোন প্রকারে বিশেষত্ব দেয়া মুসলমানদের জন্য জায়েয নয়। বরং মুসলমানদের নিকট সে দিনটিও অন্য দিনগুলোর ন্যায়। মুসলমানগণ তাদের উৎসবের কোন বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে না। আর প্রশ্নে যে বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে- এ বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। বরং কোন কোন আলেমের মতে, এগুলো যারা করে তারা কাফের; যেহেতু এগুলো করার মধ্যে কুফরি নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অপর একদল আলেম বলেন: “যে ব্যক্তি তাদের উৎসবের দিন কোন পশু জবাই করল সে যেন শুকর জবাই করল।” আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বলেন: “যে ব্যক্তি বিধর্মী দেশের অনুসরণ করে, তাদের নওরোজ বা মেহেরজান পালন করে, তাদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে এবং মৃত্যু অবধি এর উপর থাকে তার হাশর তাদের সাথে হবে”। সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে সাবেত আদ-দাহহাক থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় এক ব্যক্তি ‘বুআনা’ নামক স্থানে (মক্কার নিকটবর্তী) একটি উট জবাই করার মানত করেছিল। এরপর সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটএসে বলল: আমি ‘বুআনা’ নামক স্থানে একটি উট জবাই করার মানত করেছি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: সেখানে কি জাহেলী যামানায় কোন মূর্তি ছিল; যে মূর্তির পূজা করা হত? সে লোক বলল: না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: সেখানে কি কোন জাহেলী উৎসব পালন হত? সে বলল: না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তাহলে তোমার মানত পূর্ণ কর। পাপঘনিষ্ট মানত পূর্ণ করতে হয় না; বনি আদমের সামর্থ্যে যা নেই সে মানত পূর্ণ করতে হয় না।”এখানে দেখা যাচ্ছে মানত পূর্ণ করা ফরজ হওয়া সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ততক্ষণ পর্যন্ত সে লোককে মানত পূর্ণ করার অনুমতি দেননি যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁকে অবহিত করা হয়েছে যে, সেখানে কাফেরদের কোন উৎসব পালিত হত না। তিনি আরও বলেছেন: “পাপঘনিষ্ট মানত পূর্ণ করতে হয় না”। যদি যে স্থানে কাফেরদের উৎসব হত সে স্থানে পশু জবাই করাটাই পাপ হয় তাহলে সরাসরি তাদের উৎসবে অংশগ্রহণ করা কোন পর্যায়ের পাপ? বরং খলিফা উমর (রাঃ), সাহাবায়ে কেরাম ও শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ তাদের (কাফেরদের) উপর শর্তারোপ করেছিলেন যে, মুসলমান দেশে তারা প্রকাশ্যে তাদের উৎসব পালন করতে পারবে না। তারা গোপনে তাদের ঘরবাড়ীতে সেটা পালন করবে। অতএব, মুসলমানেরা নিজেরা প্রকাশ্যে এসব পালন করাটা কেমন হতে পারে? এমনকি উমর (রাঃ) বলেছিলেন: বিধর্মীদের ভাষা শিখবে না। মুশরিকদের উৎসবের দিন তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশ করবে না। কারণ তখন তাদের উপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি অবতীর্ণ হতে থাকে।” আর প্রবেশকারীর উদ্দেশ্য যদি হয় প্রদর্শনী বা এ জাতীয় কিছু সেটাও নিষিদ্ধ। কারণ তাদের উপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাযিল হয়। অতএব, যে ব্যক্তি এমন কিছু করে যা তাদের ধর্মের নিদর্শন, যা করার কারণে তাদের উপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাযিল হয় তার ব্যাপারটি কেমন হতে পারে?
সলফে সালেহীন একাধিক আলেম আল্লাহর বাণী: “এবং যারা الزور এ উপস্থিত থাকে না।”[সূরা ফুরক্বান, আয়াত: ৭২] সম্পর্কে বলেছেন: এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে- “বিধর্মীদের উৎসব”। কিছু না-করে শুধু উপস্থিত থাকার ব্যাপারে এটি বলা হয়েছে, তাহলে বিধর্মীদের নিজস্ব খাস কাজগুলো যদি করা হয় তাহলে এর বিধান কী হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে মুসনাদ ও সুনানসমূহে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদের দলভুক্ত।” অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, “যে ব্যক্তি বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”। হাদিসটির সনদ জায়্যিদ (ভাল)। যদি সাধারণ অভ্যাসের ক্ষেত্রে তাদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণের বিধান এটা হয় তাহলে তাদের বিশেষ বিশেষ বিষয়ে সাদৃশ্য গ্রহণের বিধান কেমন হবে?... [সমাপ্ত] [আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (২/৪৮৭), মাজমুউল ফাতাওয়া (২৫/৩২৯)।আরও জানতে দেখুন প্রশ্ন নং- 13642। আল্লাহই ভাল জানেন।
সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
0 Comments