বইঃ- আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া থেকে নেওয়াঃ-- ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর সংক্ষিপ্ত জীবনী ----
নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়
আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সত্য দ্বীনসহ যুগে যুগে
অগণিত নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। নির্ভেজাল তাওহীদই ছিল নবী-রাসূলদের দ্বীনের মূল
বিষয়। পৃথিবীর মানুষেরা এই তাওহীদকে যখনই ভুলে গেছে, তখনই তা
পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন নতুন নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আগমণ করেন
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর দাওয়াতের মূল বিষয়ও
ছিল এই তাওহীদ। মক্কায় অবস্থান করে একটানা ১৩ বছর তিনি তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন।
অতঃপর মদীনায় হিজরত করে তাওহীদের দাওয়াত অব্যাহত রেখেছেন। উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ
সন্তানগণ তাঁর এই দাওয়াত গ্রহণ করলো এবং তারা তাঁর সাহায্য করলো। আল্লাহ তাআলা
অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করলেন। আরব উপদ্বীপসহ পৃথিবীর সর্বত্রই এই
দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে গেল। তাওহীদের মাধ্যমে তারা সমগ্র জাতির উপর যে গৌরব, সম্মান, শক্তি, প্রতিপত্তি এবং
প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে মুসলিমগণ দুর্বল হয়ে পড়ে।
মুসলিমদের শক্তির মূলভিত্তি এই নির্ভেজাল তাওহীদের উপর শির্ক ও কুসংস্কারের
আবর্জনা পড়ে যাওয়াই মুসলিমদের বিপর্যস্তের প্রধান ও মূল কারণ।
ইসলামের এই মূলভিত্তি নির্ভেজাল তাওহীদ থেকে যখনই মুসলিম জাতি দূরে চলে
গেছে, দ্বীনি লেবাসে বিভিন্ন সময় শির্ক, বিদআত, কুসংস্কার ও বিজাতীয়
আচার-আচরণ মুসলিমদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, তখনই নির্ভেজাল
তাওহীদের দিকে জাতিকে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং সকল প্রকার আবর্জনা থেকে তাওহীদকে
পরিস্কার ও পরিশুদ্ধ করার জন্য ইসলামের স্বর্ণযুগের পরে আল্লাহ তাআলা বহু মর্দে
মুজাহিদ প্রেরণ করেছেন। তারা পথহারা জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে এনেছেন, তাওহীদের দাওয়াতকে
পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং দ্বীনকে সকল প্রকার শির্ক-বিদআত থেকে সংস্কার ও সংশোধন
করেছেন। তাদেরই ধারাবাহিকতায় হিজরী সপ্তম ও অষ্টম শতকে আগমণ করেন বিপ্লবী সংস্কারক
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। বহু প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি
মোকাবেলা করে এবং জেল-যুলুম সহ্য করে তাওহীদ পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে তিনি যে
অতুলনীয় অবদান ও খেদমত রেখে গেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত
মুসলিম জাতির জন্য তা দিশারী হয়ে থাকবে। তাঁর বরকতময় জীবনী, দাওয়াত ও সংস্কারের
সকল দিক উল্লেখ করতে গেলে বড় মাপের একটি গ্রন্থ রচনা করা দরকার। তাই আমরা স্বল্প
পরিসরে শাইখের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, জীবনী ও সংস্কার আন্দোলনের কিছু দিক
এখানে উল্লেখ করেছি।
নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়:
তিনি হলেন আবুল আববাস তকীউদ্দীন শাইখুল ইসলাম ইমাম আহমাদ বিন আব্দুল হালীম
বিন আব্দুস সালাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। ৬৬১ হিজরী সালের ১০ রবীউল আওয়াল
মাসে তিনি বর্তমান সিরিয়ার হারান এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল হালীম
ইবনে তাইমীয়া এবং দাদা আবুল বারাকাত মাজদুদ্দীন আব্দুস্ সালাম বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ ও
হাম্বলী ফিকাহবিদ ছিলেন। সে হিসাবে তিনি এমন একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যার সকল সদস্যই
ছিলেন আলেম ও দ্বীনদার। আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে শিশুকালেই তিনি ইলম
অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। উল্লেখ্য যে, আলেমদের প্রসিদ্ধ মত
অনুযায়ী তাইমীয়া ছিলেন শাইখের নানী। তিনি ওয়াজ-নসীহত ও ভাষণ-বক্তৃতা দানে খুবই
পারদর্শী ছিলেন।
শৈশবকাল ও প্রাথমিক শিক্ষা
ইমামের বয়স যখন সাত বছর, তখন মুসলিম অঞ্চলগুলো তাতারীদের
আক্রমণের শিকার হয়। শাইখের জন্মস্থান হারান এলাকা তাতারীদের আক্রমণের কবলে পড়লে
মানুষ জানের ভয়ে সবকিছু পানির দামে বিক্রি করে পালাচ্ছিল। এই ভীতি ও আতঙ্কের দিনে
ইমামের পরিবারবর্গও দেশ ত্যাগের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন। তারা প্রয়োজনীয় সবকিছু
ফেলে দিয়ে শুধু পারিবারিক লাইব্রেরীর বই-পুস্তকগুলো গাড়ী বোঝাই করলেন। শুধু
কিতাবেই কয়েকটি গাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে গেল। গাড়ীগুলো টানার জন্য প্রয়োজনীয় ঘোড়া ও
গাধাও ছিলনা। তাই গাধার পাশাপাশি পরিবারের যুবক সদস্যদেরও মাঝে মাঝে কিতাবের গাড়ী
টানতে হতো।
দামেস্কে পৌঁছার পর তথাকার লোকেরা শাইখের পরিবারকে অভ্যর্থনা জানালো।
দামেস্কবাসীরা শাইখের পিতা ও দাদার জ্ঞান ও পান্ডিত্যের খ্যাতির কথা আগে থেকেই
অবহিত ছিল। পিতা আব্দুল হালীম দামেস্কের বড় মসজিদ জামে উমুবীতে দারস দেয়ার দায়িত্ব
লাভ করলেন। শীঘ্রই তাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলো।
কিশোর ইবনে তাইমীয়া অল্প সময়ের মধ্যেই কুরআন মজীদ মুখস্ত করে হাদীছ, ফিক্হ ও আরবী ভাষা
চর্চায় মশগুল হলেন। সেই সাথে তিনি পিতার সাথে বিভিন্ন ইলমী মজলিসে শরীক হতে
লাগলেন।]
ইমামের মেধা ও
স্মরণশক্তি
ইমামের খান্দানের সবাই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু তাদের তুলনায় ইমামের স্মরণ
শক্তি ছিল অসাধারণ। শিশুকাল থেকে তাঁর অসাধারণ স্মরণশক্তি শিক্ষকদের অবাক করে
দিয়েছিল। দামেস্কের লোকদের মুখে মুখে তাঁর স্মরণশক্তির কথা আলোচনা হতো।
একদা আলেপ্পো নগরীর একজন বিখ্যাত আলেম দামেস্কে আসেন। তিনি কিশোর ইবনে
তাইমীয়ার স্মরণশক্তির কথা লোকমুখে আগেই শুনেছিলেন। ইমামের স্মরণশক্তি পরীক্ষা করার
জন্য তিনি একটি দর্জির দোকানে বসে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে একদল ছেলেকে আসতে দেখা
গেলো। দর্জি ইঙ্গিতের মাধ্যমে ইমামকে দেখিয়ে দিল। তিনি ইমামকে ডাকলেন। ইমামের
খাতায় হাদীছের তের-চৌদ্দটি মতন লিখে দিয়ে বললেন, পড়ো। কিশোর ইমাম
ইবনে তাইমীয়া গভীর মনোযোগের সাথে হাদীছগুলো একবার পড়লেন। তিনি এবার খাতা উঠিয়ে
নিয়ে বললেন, মুখস্ত শুনিয়ে দাও। ইবনে তাইমীয়া তা
মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন। এবার একগাদা সনদ লিখে দিয়ে পড়তে বললেন। পড়া হলে মুখস্ত বলতে
বললেন। ইমাম সনদগুলোও মুখস্ত বললেন। শাইখ এতে অবাক হয়ে বললেন, বড় হয়ে এই ছেলে
অসাধ্য সাধন করবে।
ইমামের জ্ঞান অর্জন
ও চর্চা
ইমাম ইবনে তাইমীয়া মাত্র সাত বছর বয়সে শিক্ষালয়ে প্রবেশ করেন এবং মাত্র
বাইশ বছর বয়সে তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার পরিপূর্ণ করে তুলেন। কুরআন, হাদীছ, ফিকাহ এবং উসূলের
সাথে সাথে তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি দুই
শতাধিক উস্তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। কুরআনের তাফসীরের প্রতি তাঁর আকর্ষণ
ছিল সবচেয়ে বেশী। যেসব উস্তাদদের কাছ থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে ইবনে
কুদামা, ইবনে আসাকেরের নাম বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য।
একটানা সাত থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত জ্ঞান লাভের পর শিক্ষকতা ও জ্ঞান
বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাইশ বছর বয়সে উপনীত হলে তার পিতা আব্দুল হালীম
ইবনে তাইমীয়া মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন দামেস্কের সর্ববৃহৎ দারুল হাদীছের
প্রধান মুহাদ্দিছ। আব্দুল হালীমের মৃত্যুর পর এই পদটি শুণ্য হয়ে যায়। সুযোগ্য
পুত্র ইমাম ইবনে তাইমীয়া সেই পদ পূরণ করেন। তাঁর দারসে যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ও
আলেমগণ উপস্থিত হতে শুরু করেন। যুবক আলেমের জ্ঞান ও পান্ডিত্য সবাইকে মুগ্ধ ও
চমৎকৃত করে। কিছু দিন পরেই দামেস্কের প্রধান মসজিদ জামে উমুবীতে তিনি পিতার স্থানে
কুরআনের তাফসীর করার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর জন্য বিশেষভাবে মিম্বার তৈরী করা
হয়। প্রতি সপ্তাহেই তাঁর তাফসীরের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ছাত্রের সংখ্যাও বাড়তে
থাকে। কুরআনের তাফসীরের সাথে সাথে সমকালীন সব সমস্যার কুরআনিক সমাধান বর্ণনা
করতেন।
তাঁর হাতে তৈরী হয় যুগশ্রেষ্ঠ অসংখ্য আলেম। তাদের মধ্য হতে স্বনামধন্য লেখক
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম ইবনে কাছীর এবং ইমাম যাহাবীর নাম
সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।
ইমামের মাজহাব
তিনি যেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তার সকলেই ছিলেন
আলেম। তারা ফিক্হের ক্ষেত্রে হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে
তিনি নির্দিষ্ট কোন মাজহাবের তাকলীদ করতেন না। কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের অনুসরণ
করতেন, সুন্নাতের সাহায্য করতেন এবং সালাফী
নীতি গ্রহণ করতেন। সুন্নাত ও সালাফী নীতির পক্ষে তিনি এমন এমন যুক্তি-প্রমাণ পেশ
করতেন, যা তাঁর পূর্বে অন্য কেউ পেশ করার
সাহসিকতা প্রদর্শন করতেন না।
সত্য প্রকাশে ইমামের
সাহসিকতা
তাতারীদের আক্রমণের খবর যখন সিরিয়ায় পৌছল, তখন সিরিয়ার বিভিন্ন
শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তাতারীদের ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে মুসলিমগণ আগেই অবহিত ছিল। তাই
তাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আশপাশের সকল এলাকা ছেড়ে লোকেরা রাজধানী দামেস্কের
দিকে চলে আসতে লাগল। দামেস্কের লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল। এই ভয়াবহ
পরিস্থিতিতে খবর আসলো যে, মিশরের বাদশাহ প্রচুর সেনাবাহিনীসহ
দামেস্কের মুসলিমদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসছেন। এই খবর শুনে নগরীতে প্রাণের সাড়া
জাগল। মুসলিমগণ নতুন উদ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে লাগল।
৬৯৯ হিজরীর ২৭ রবীউল আওয়াল মাসে তাতারী সম্রাট কাজানের সাথে মিশরের
সুলতানের সংঘর্ষ হলো। অনেক চেষ্টা করেও এবং অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেও
মুসলিমরা শেষ রক্ষা করতে পারলোনা। মুসলিমরা হেরে গেল। মিশরের সুলতান পরাজিত
সেনাবাহিনী নিয়ে কায়রোর পথে রওয়ানা হলেন।
এবার দামেস্কবাসীরা পড়লো মহাসংকটে। তাতারী সম্রাট সেনাদলসহ এবার বিজয়ী বেশে
নগরে প্রবেশ করবে। তাতারী বিভীষিকার কথা চিন্তা করে বড় বড় আলেম ও নেতৃস্থানীয়
লোকেরা শহর ত্যাগ করতে লাগল। এর আগেই শহরের বিচারক, পরিচিত আলেম-উলামা, সরকারী অফিসার, বড় বড় ব্যবসায়ী
এমনকি দামেস্কের গভর্ণর নিজের শহরের মায়া ত্যাগ করে মিশরের পথে পাড়ি জমালেন।
জনগণের এক অংশও তাতারীদের হত্যাকান্ডের ভয়ে দামেস্ক ছেড়ে দিল। এখন কেবল সাধারণ
জনগণের একটি অংশই দামেস্কে রয়ে গেল।
এদিকে কাজানের সেনাদল দামেস্কে প্রবেশের সময় ঘনিয়ে আসছিল। এই ভয়ানক
পরিস্থিতিতে ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং শহরের নেতৃস্থানীয় লোকেরা বসে একটা সিদ্বান্ত
গ্রহণ করলেন। তারা সিদ্বান্ত নিলেন, ইমাম ইবনে তাইমীয়ার
নেতৃত্বে নগরবাসীদের একটি প্রতিনিধি দল কাজানের নিকট যাবে। তারা নগরবাসীদের জন্য
শান্তি ও নিরাপত্তার একটি ফরমান লিখে আনবে।
এ উদ্দেশ্যে তাতারী সম্রাট কাজানের সামনে দলবল নিয়ে উপস্থিত হলেন ইসলামের
অগ্রদূত ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। কাজানের সম্মুখে ইমাম কুরআন-হাদীছের
উদ্ধৃতি দিয়ে ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে এবং যুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভাষণ
দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নির্ভয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং কাজানের কাছাকাছি হচ্ছিলেন।
তাঁর আওয়াজ ধীরে ধীরে উঁচু ও গুরুগম্ভীর হচ্ছিল। কুরআনের আয়াত ও হাদীছ শুনাতে
শুনাতে তিনি কাজানের নিকটে, আরো নিকটে চলে যাচ্ছিলেন। আশ্চর্যের
ব্যাপার হলো পরাক্রমশালী কাজান এতে মোটেই বিরক্তিবোধ করছিলেন না। বরং তিনি কান
লাগিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। ইতিমধ্যেই কাজান ইমামের ভাষণে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে
গেলেন। ইমামের ভাষণ কাজানকে অনুবাদ করে শুনানো হলে তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এই আলেমটি কে? আমি এমন সাহসী ও দৃঢ়
সংকল্প লোক আজকের পূর্বে আর কখনো দেখিনি। ইতিপূর্বে আমাকে অন্য কেউ এমন প্রভাবিত
করতে পারেনি।
লোকেরা ইবনে তাইমীয়া সম্পর্কে কাজানকে জানালো এবং ইমামের ইলম ও কার্যাবলী
সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলো।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া কাজানকে সেদিন বলেছিলেন, হে কাজান! আপনি
নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করেন। আমি জানতে পেরেছি, আপনার সাথে রয়েছেন
কাযী, শাইখ, মুআয্যিন এবং
ইমামগণ। এসব সত্ত্বেও আপনি মুসলিমদের উপর আক্রমণ করেছেন, তাদেরকে হত্যা
করেছেন, তাদের নারীদেরকে বন্দী করেছেন এবং
মুসলিমদের মালামাল লুণ্ঠন করেছেন। অথচ আপনার পিতা ও দাদা কাফের হওয়া সত্ত্বেও এ
ধরণের কাজ করতে ইতস্ততঃ করতেন। তারা নিজেদের ওয়াদা-অঙ্গীকার পালন করেছেন। আর আপনি
ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আপনি আল্লাহর বান্দাদের উপর মারাত্মক যুলুম করেছেন।
সে সময় ইমামের সাথে ছিলেন প্রধান বিচারপতি নাজমুদ্দীন আবুল আববাস। তিনি
লিখেছেন, ইবনে তাইমীয়া যখন কাজানের সাথে কথা শেষ
করলেন, তখন তাঁর ও সাথীদের সামনে খাবার রাখা
হলো। সবাই খেতে লাগলেন। কিন্তু ইমাম হাত গুটিয়ে নিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি
দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, এ খাবার হালাল নয়। কারণ গরীব মুসলিমদের
থেকে লুট করা ছাগল ও ভেড়ার গোশত সংগ্রহ করা হয়েছে এবং মযলুম মানুষের কাছ থেকে জোর
করে কাঠ সংগ্রহ করে তা পাকানো হয়েছে।
অতঃপর কাজান ইমামকে দুআ করার আবেদন করলেন। ইমাম দু’আ করতে লাগলেন। দু’আতে
তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এই যুদ্ধের পিছনে কাজানের
উদ্দেশ্য যদি হয় তোমার দ্বীনকে সাহায্য করা, তোমার কালেমাকে
বুলন্দ করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা, তাহলে তুমি তাঁকে
সাহায্য করো। আর যদি দুনিয়ার রাজত্ব লাভ এবং লোভ-লালসা চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য
হয়ে থাকে, তাহলে তুমিই তাকে ধ্বংস করো। আশ্চর্যের
বিষয় হলো ইমাম দুআ’ করছিলেন, আর কাযান আমীন আমীন বলে যাচ্ছিলেন।
কাযী আবুল আববাস নাজমুদ্দীন বলেন, ইমাম যখন কাযানের
সামনে বক্তৃতা করছিলেন, তখন আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম
এবং নিজেদের জামা-কাপড় গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। কি জানি কখন ইমামের উপর জল্লাদের তরবারী
ঝলসে উঠবে এবং তার রক্তে আমাদের বস্ত্র
রঞ্জিত হবে। কাযী নিযাম উদ্দীন আরো বলেন, কাযানের দরবার থেকে
বের হয়ে এসে আমরা ইমামকে বললাম, আমরা আপনার সাথে যাবোনা। আপনি তো
আমাদেরকে প্রায় মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আপনার কারণে আমাদের উপর বিরাট
মসীবত চলে আসার উপক্রম হয়েছিল। ইমাম তখন ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, বরং আমিই তোমাদের
সাথে যাবোনা। অতঃপর আমরা সকলেই তাঁকে রেখে চলে আসলাম। ইমাম একাই রওয়ানা দিলেন।
রওয়ানা দেয়ার সময় কাযান আবার দুআ করার আবেদন করলেন। ইমাম পূর্বের দুআর পুনরাবৃত্তি
করলেন।
ইমামকে একাকী চলতে দেখে স্বয়ং কাযান একদল সৈন্য পাঠিয়ে ইমামের নিরাপত্তার
ব্যবস্থা করলেন। ইমামের একাকীত্বের খবর শুনে শহরের একদল লোক বের হয়ে এসে ইমামকে
সঙ্গ দেয়ার কথাও জানা যায়। কাযী নাজমুদ্দীন আবুল আববাস বলেন, ইমাম নিরাপদে
দামেস্কে ফিরে এলেন। ঐদিকে আমাদের অবস্থা এতই শোচনীয় হলো যে, রাস্তায় একদল লুটেরা
বাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করলো এবং সর্বস্ব খুইয়ে নিল। আমরা একদম উলঙ্গ হয়ে শহরে
ফিরলাম।
অত্যন্ত মর্যাদার সাথে ইমাম তাতারীর দরবার থেকে ফিরে আসলেন এবং নগরবাসীর
জন্য নিরাপত্তার পরোয়ানা লিখিয়ে আনলেন। তাতারীরা যাদেরকে বন্দী করেছিল, তাদেরকেও ছাড়িয়ে
আনলেন। তাতারীদের বর্বরতার কাহিনী তিনি যেমন শুনেছিলেন, তেমনি নিজ চোখেও
তাদের তান্ডব দেখেছিলেন। তারপরও তিনি একটুও বিচলিত হননি। তাতারী সম্রাটের মুখোমুখি
হয়ে কথা বলতে এবং তাতারী সেনাদের মধ্যে অবাধে চলাফেরা করতে তিনি একটুও ভীতি অনুভব
করেন নি। তিনি বলতেন, যার অন্তরে রোগ আছে সেই কেবল আল্লাহ
ছাড়া অন্যকে ভয় করতে পারে।
জিহাদের ময়দানে ইমাম
আল্লাহর দ্বীনকে সকল প্রকার কুসংস্কার-আবর্জনা ও শির্ক-বিদআত হতে পরিস্কার
করার জন্য শাইখ যেমন আমরণ কলম ও জবান দ্বারা জিহাদ করেছেন, ঠিক তেমনি শাইখুল
ইসলাম তাতারীদের বিরুদ্ধে সসস্ত্র সংগ্রাম করে ময়দানে বিশেষ বীরত্বের পরিচয়
দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অস্তীত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে তাতারীদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে
পড়ার জন্য মুসলিমদেরকে তিনি যেমন উৎসাহ দিয়েছেন, তেমনি নিজেও ময়দানে
নেমে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ইতিপূর্বে সম্রাট কাযানের নিকট প্রবেশ করে তিনি যে
ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তার সাহসিকতা দেখে উপস্থিত সকলেই
মুগ্ধ হয়েছিল। ৭০২ হিজরী সালের রামাযান মাসে তাতারীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার শাকহব
নামক অঞ্চলে যেই যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে তিনি মুজাহিদদের কাতারের
সর্বাগ্রে ছিলেন। আল্লাহ তাআলা এই যুদ্ধে তাতারীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকে বিজয় দান
করেন। এমনি আরো অনেক যুদ্ধেই তিনি বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। মিশরের সুলতান যখন
তাতারীদের হাতে দেশ সমর্পন করে দিতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি সুলতানকে
ধমক দিয়েছিলেন। জিহাদের প্রতি মুসলিমদেরকে উৎসাহ প্রদান এবং নিজে ময়দানে অবতীর্ণ
হওয়ার ফলে মুসলিমদের অন্তর থেকে তাতারী আতঙ্ক দূরিভূত করে। আল্লাহর দ্বীনের প্রতি
মুসলিমদের অবহেলার কারণে তাদের কপালে যেই দুর্দশা নেমে এসেছিল, কুরআন ও সুন্নাহর পথ
বর্জন করার ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে যে দুর্বলতা ও বিপর্যয়ের কবলে পড়েছিল, ইমাম ইবনে তাইমীয়ার
সংস্কার ও জিহাদী আন্দোলনে মুসলিমরা নতুন করে জেগে উঠেছিল।
মুসলিমগণ নতুন করে জিহাদী চেতনা ফিরে পায়। তাতারীরা ইসলামী সাম্রাজ্যের মূল
কেন্দ্র বাগদাদ দখল করে খলীফাকে যবাই করে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্তে রাজপথ
রক্তাক্ত করে তাতারীরা যেভাবে একের পর এক অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সিরিয়ার দামেস্ক
এবং মিশরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন ইবনে তাইমীয়া মুসলিমদেরকে সুসংগঠিত
করে সিরিয়া ও মিশরের দিকে তাতারীদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে না দিলে মুসলিমদের
ভাগ্যাকাশ কেমন হতো, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
অন্যায় ও অপকর্ম নির্মূলে ইবনে তাইমীয়া
তাতারীরা দামেস্ক ছেড়ে চলে যাওয়ার পর শহরে প্রকাশ্যে মদ পানসহ নানা অপকর্ম
ব্যাপকতা লাভ করে। কারণ তখন সিরিয়া এক সরকারী নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। তাই ইমাম ইবনে
তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ একদল ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে শহরে প্রদক্ষিণ করতে
লাগলেন এবং মদের দোকানগুলোতে ঢুকে পড়েন। মদের পেয়ালা ও কুঁজো ভেঙ্গে ফেলতে লাগলেন
এবং দোকানের মদ নালায় ঢেলে দিলেন। অন্যায় ও অপকর্মের আস্তানায় প্রবেশ করে লোকদেরকে
উপদেশ দিতেন, ইসলামের নির্দেশ বুঝাতেন এবং তাওবা
করাতেন। প্রয়োজনে শাস্তিও দিতেন। ইমামের অভিযানে সারা দামেস্ক শহর পুনরায় দ্বীনি
পরিবেশ ফিরে পেল।
ভ্রান্ত তাসাউফের কবল থেকে ইসলামী আকীদাহর সংস্কারে ইবনে তাইমীয়া
সাহাবী ও তাবেঈদের যুগ থেকে খালেস ইসলামী তাসাউফের একটি ধারা চলে আসছিল।
এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনই ছিল এর একমাত্র
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। কিন্তু পরবর্তীতে এর কর্মধারায় নানা আবর্জনা এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে
গেল যে, মুসলিমদের এক বিরাট গোষ্ঠিও এই আবর্জনা
ধোয়া পানি পান করেই আত্মতৃপ্তি লাভ করতে লাগল। হিজরী অষ্টম শতকে এসে সুফীবাদ এক
গোমরাহী ও ভ্রান্ত মতবাদে পরিণত হয়। তাসাউফের লেবাস ধরে নির্ভেজাল ইসলামী আকীদাহর
বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রীক দর্শন, সর্বেশ্বরবাদ, অদ্বৈত্ববাদ
ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আবর্জনা মিশ্রিত সুফীবাদের দাবীদাররা ইলমকে
যাহেরী-বাতেনীতে বিভক্ত করতে থাকে, একজনের বক্ষদেশ থেকে
অন্যজনের বক্ষদেশে জ্ঞানের গোপন বিস্তার হয় বলে প্রচার করতে থাকে এবং কামেল
পীর-মুরশিদ ও আল্লাহর প্রেমে পাগল ভক্তের জন্য শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার
প্রয়োজন নেই ইত্যাদি ভ্রান্ত চিন্তা-বিশ্বাস তাসাউফের নামে মুসলিমদের বিরাট এক
অংশের উপর চেপে বসে।
আল্লাহর অলী ও তাঁর নেক বান্দাদের ব্যাপারে অমুসলিমদের ন্যায় মুসলিমরাও বাড়াবাড়ি শুরু করে। তাদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে এবং নিজেদের দিলের মাকসুদ পূরা করতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেমগণও অলীদের কবরে ধরণা দিত।
ইসলামের নামে এই সব জাহেলীয়াতের অন্ধকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করে খালেস তাওহীদের দিকে মুসলিমদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন একজন মর্দে মুজাহিদের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাওহীদ ও শির্কের পার্থক্য সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে অবগত, জাহেলীয়াতের সকল চেহারা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে যিনি ওয়াকিফহাল এবং যিনি জাহেলীয়াতের মূলোৎপাটন করে মুসলিমদের জন্য সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবী ও তাবেঈদের আমল থেকে নির্ভেজাল আকীদাহ ও আমল তুলে ধরবেন। এই গুরু দায়িত্বটি পালন করার জন্য হিজরী অষ্টম শতকে আল্লাহ তাআলা ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহকে চয়ন করেন। তিনি মুসলিমদের সামনে ইসলামের পরিচ্ছন্ন আকীদাহ্ বিশ্বাস তুলে ধরেন এবং সকল প্রকার শির্ক-বিদআত থেকে ইসলামকে পরিশুদ্ধ করেন।
আল্লাহর অলী ও তাঁর নেক বান্দাদের ব্যাপারে অমুসলিমদের ন্যায় মুসলিমরাও বাড়াবাড়ি শুরু করে। তাদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে এবং নিজেদের দিলের মাকসুদ পূরা করতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেমগণও অলীদের কবরে ধরণা দিত।
ইসলামের নামে এই সব জাহেলীয়াতের অন্ধকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করে খালেস তাওহীদের দিকে মুসলিমদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন একজন মর্দে মুজাহিদের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাওহীদ ও শির্কের পার্থক্য সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে অবগত, জাহেলীয়াতের সকল চেহারা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে যিনি ওয়াকিফহাল এবং যিনি জাহেলীয়াতের মূলোৎপাটন করে মুসলিমদের জন্য সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবী ও তাবেঈদের আমল থেকে নির্ভেজাল আকীদাহ ও আমল তুলে ধরবেন। এই গুরু দায়িত্বটি পালন করার জন্য হিজরী অষ্টম শতকে আল্লাহ তাআলা ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহকে চয়ন করেন। তিনি মুসলিমদের সামনে ইসলামের পরিচ্ছন্ন আকীদাহ্ বিশ্বাস তুলে ধরেন এবং সকল প্রকার শির্ক-বিদআত থেকে ইসলামকে পরিশুদ্ধ করেন।
ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
অষ্টম হিজরী শতকে দু’টি দার্শনিক মতবাদ মুসলিম সুফী ও দার্শনিকদের মধ্যে
প্রবল হয়ে উঠে। ইমাম ইবনে তাইমীয়াকে এ ভ্রান্ত মতবাদ দু’টির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম
করতে হয়। একটি হলো ওয়াহদাতুল উজুদ এবং অন্যটি হুলুল ও ইত্তেহাদ। আমাদের ভারতবর্ষের
দার্শনিক পরিভাষায় এ মতবাদ দু’টিকে বলা হয় অদ্বৈতবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ। পরবর্তীকালে
ভারতীয় উপমহাদেশের সুফীদের মধ্যেও এ মতবাদ দু’টি প্রবেশ করে। আনন্দের বিষয় হলো, মুজাদ্দেদ আলফেসানী
এই মতবাদ দু’টির বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে অতি দুঃখের সাথে
বলতে হয় যে, ভারতবর্ষের সুফীদের মধ্যে আজও এই মতবাদ
দু’টির উপস্থিতি প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়।
এখন পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, আসলে এই মতবাদ দু’টির ব্যাখ্যা কী? ইমাম ইবনে তাইমীয়া এই মতবাদ দু’টির প্রধান প্রবক্তা মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, অস্তিত্ব মাত্র একটি। সৃষ্টির অস্তিত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব। (নাউযুবিল্লাহ) তারা স্রষ্টা ও সৃষ্টি, -এ দু'টো পৃথক সত্তা হিসাবে তারা স্বীকার করেনা। বরং তাদের মতে স্রষ্টাই হলো সৃষ্টি আর সৃষ্টিই হলো স্রষ্টা। তাদের মতে বনী ইসরাঈলের যারা বাছুর পূজা করেছিল, তারা আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। তারা আরো বলে, ফেরাউনের ‘‘আনা রাববুকুমুল আ’লা’’ অর্থাৎ আমি তোমাদের মহান প্রভু, -এই দাবীতে সত্যবাদী ছিল। ইবনে আরাবী নূহ আলাইহিস সাল্লামের সমালোচনা করে বলে যে, তার কাওমের লোকেরা মূর্তি পূজার মাধ্যমে আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। আর তাঁর সময়ের মহাপ্লাবন ছিল মারেফতে ইলাহীর প্লাবন। এ প্লাবনে তারা ডুবে গিয়েছিল।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মতবাদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করাকে তাতারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
সৃষ্টি এবং স্রষ্টা কখনই এক হতে পারে না। আমরা মস্তিস্কের মধ্যে যা কল্পনা করি তার সবগুলোর অস্তিত্ব মস্তিস্কের বাইরে খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মাথায় দশহাত বিশিষ্ট এবং তিন মুখ বিশিষ্ট মানুষের কল্পনা জাগতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবে এই ধরণের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। মস্তিস্কের বাইরে যেসব বস্ত্তর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, তা মূলতঃ দুই প্রকার। (১) সৃষ্টি ও (২) স্রষ্টা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যা এমনিতেই হয়ে গেছে। প্রত্যেক জিনিষের একজন উদ্ভাবক ও কারিগর রয়েছে। তাদের উভয়ের স্বভাব এবং বৈশিষ্ট এক ও অভিন্ন নয়। বরং কম্পিউটারের বৈশিষ্ট এবং যে উহা তৈরী করেছে, তার স্বভাব ও বৈশিষ্ট একরকম নয়। মহান আল্লাহ স্বীয় জ্ঞান, কুদরত এবং ইচ্ছা দ্বারা এই আসমান-যমীন ও এতোদুভয়ের মধ্যকার সকল বস্ত্ত তৈরী করেছেন। সুতরাং তিনি এবং তাঁর তৈরী মাখলুক এক হয় কিভাবে? তাঁর সুউচ্চ সিফাত এবং সৃষ্টির সাধারণ স্বভাব ও বৈশিষ্ট এক রকম হয় কিভাবে?
আল্লাহ্ ব্যতীত বাকী সকল বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
এখন পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, আসলে এই মতবাদ দু’টির ব্যাখ্যা কী? ইমাম ইবনে তাইমীয়া এই মতবাদ দু’টির প্রধান প্রবক্তা মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, অস্তিত্ব মাত্র একটি। সৃষ্টির অস্তিত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব। (নাউযুবিল্লাহ) তারা স্রষ্টা ও সৃষ্টি, -এ দু'টো পৃথক সত্তা হিসাবে তারা স্বীকার করেনা। বরং তাদের মতে স্রষ্টাই হলো সৃষ্টি আর সৃষ্টিই হলো স্রষ্টা। তাদের মতে বনী ইসরাঈলের যারা বাছুর পূজা করেছিল, তারা আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। তারা আরো বলে, ফেরাউনের ‘‘আনা রাববুকুমুল আ’লা’’ অর্থাৎ আমি তোমাদের মহান প্রভু, -এই দাবীতে সত্যবাদী ছিল। ইবনে আরাবী নূহ আলাইহিস সাল্লামের সমালোচনা করে বলে যে, তার কাওমের লোকেরা মূর্তি পূজার মাধ্যমে আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। আর তাঁর সময়ের মহাপ্লাবন ছিল মারেফতে ইলাহীর প্লাবন। এ প্লাবনে তারা ডুবে গিয়েছিল।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মতবাদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করাকে তাতারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
সৃষ্টি এবং স্রষ্টা কখনই এক হতে পারে না। আমরা মস্তিস্কের মধ্যে যা কল্পনা করি তার সবগুলোর অস্তিত্ব মস্তিস্কের বাইরে খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মাথায় দশহাত বিশিষ্ট এবং তিন মুখ বিশিষ্ট মানুষের কল্পনা জাগতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবে এই ধরণের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। মস্তিস্কের বাইরে যেসব বস্ত্তর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, তা মূলতঃ দুই প্রকার। (১) সৃষ্টি ও (২) স্রষ্টা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যা এমনিতেই হয়ে গেছে। প্রত্যেক জিনিষের একজন উদ্ভাবক ও কারিগর রয়েছে। তাদের উভয়ের স্বভাব এবং বৈশিষ্ট এক ও অভিন্ন নয়। বরং কম্পিউটারের বৈশিষ্ট এবং যে উহা তৈরী করেছে, তার স্বভাব ও বৈশিষ্ট একরকম নয়। মহান আল্লাহ স্বীয় জ্ঞান, কুদরত এবং ইচ্ছা দ্বারা এই আসমান-যমীন ও এতোদুভয়ের মধ্যকার সকল বস্ত্ত তৈরী করেছেন। সুতরাং তিনি এবং তাঁর তৈরী মাখলুক এক হয় কিভাবে? তাঁর সুউচ্চ সিফাত এবং সৃষ্টির সাধারণ স্বভাব ও বৈশিষ্ট এক রকম হয় কিভাবে?
আল্লাহ্ ব্যতীত বাকী সকল বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ﴾
‘‘আল্লাহই আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মাঝখানে যা কিছু
আছে সব সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে এবং এরপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন তিনি ছাড়া তোমাদের কোন
সাহায্যকারী নেই এবং নেই তার সামনে সুপারিশকারী, তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা?’’ (সূরা সাজদাহ: ৪)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
‘‘তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। কিরূপে আল্লাহর পুত্র হতে পারে, অথচ তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি যাবতীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব বস্তু সম্পর্কে সুবিজ্ঞ। (সূরা আনআম: ১০১)
বাস্তব কথা হচ্ছে, অস্তিত্ব একটি নয়; বরং দু’টি। একটি স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব, আরেকটি সৃষ্টির অস্তিত্ব।
কুরআন ও সহীহ হাদীছে দিবালোকের মত পরিস্কার করে বলা আছে যে, মহান আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত, তার সুউচ্চ গুণাবলী সৃষ্টি জীবের গুণাগুণ, স্বভাব ও বৈশিষ্ট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সাথে মিশ্রিত নন, কোন সৃষ্টির ভিতরে নন; যেমন সুফীরা ধারণা করে থাকে। বরং তিনি সৃষ্টির বহু উপরে, সকল সৃষ্টি তার নীচে, তিনি আসমানের উপরে, আরশের উপর সমুন্নত। উপরে থাকাই আল্লাহর সত্তাগত সিফাত বা বিশেষণ।
﴿بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
‘‘তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। কিরূপে আল্লাহর পুত্র হতে পারে, অথচ তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি যাবতীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব বস্তু সম্পর্কে সুবিজ্ঞ। (সূরা আনআম: ১০১)
বাস্তব কথা হচ্ছে, অস্তিত্ব একটি নয়; বরং দু’টি। একটি স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব, আরেকটি সৃষ্টির অস্তিত্ব।
কুরআন ও সহীহ হাদীছে দিবালোকের মত পরিস্কার করে বলা আছে যে, মহান আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত, তার সুউচ্চ গুণাবলী সৃষ্টি জীবের গুণাগুণ, স্বভাব ও বৈশিষ্ট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সাথে মিশ্রিত নন, কোন সৃষ্টির ভিতরে নন; যেমন সুফীরা ধারণা করে থাকে। বরং তিনি সৃষ্টির বহু উপরে, সকল সৃষ্টি তার নীচে, তিনি আসমানের উপরে, আরশের উপর সমুন্নত। উপরে থাকাই আল্লাহর সত্তাগত সিফাত বা বিশেষণ।
দর্শন ও কালাম
শাস্ত্রের প্রতিবাদ, কুরআন-সুন্নাহর
আলোকে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং সমস্ত গায়েবী বিষয়ের উপস্থাপন
কুরআন ও সুন্নাহ্য় আল্লাহর সত্তা, তাঁর অতি সুন্দর নাম
ও সুউচ্চ গুণাবলী, ফেরেশতা, আখেরাত ইত্যাদি
গায়েবী বিষয়কে যে সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে, তা ইসলামের গৌরবময়
যুগে মুসলিমদের বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
থেকে তারা বিষয়গুলো শুনে তা সহজভাবেই বুঝে নিয়েছেন এবং বিশ্বাস করেছেন। আর এ
বিষয়গুলো বোধশক্তি ও যুক্তির মাধ্যমে বুঝার কোন সুযোগ নেই। অহীর উপর নির্ভর করা
ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। সেই সাথে গায়েবী বিষয়গুলো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির সাথে
সাংঘর্ষিক নয়।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন গ্রীক দর্শনের কিতাবাদি আরবীতে অনুবাদ করা হলো, তখন থেকেই ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারের উপর গ্রীক দর্শনের প্রভাব পড়তে থাকে। আববাসী খেলাফতকালে সরকারীভাবে এ কাজে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ফলে মুসলিমদের লাইব্রেরীগুলো গ্রীক দর্শনের কিতাবে ভরপুর হয়ে যায়। মুসলিম বিদ্বানগণের গ্রীক দর্শনের দিকে ঝুকে পড়ে। ইসলামী আকীদাহর উপরও গ্রীক দর্শনের প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, তাঁর কার্যাবলী, সৃষ্টির সূচনা ও সমাপ্তি, পরিণাম, কিয়ামত, হাশর-নশর, মানুষের আমলের ফলাফল এবং এ ধরণের অন্যান্য গায়েবী বিষয়গুলো জানার জন্য কুরআন-সুন্নাহর পথ ছাড়া আর কোন পথ নেই। চিন্তা-ভাবনা, আন্দাজ-অনুমান করে এ বিষয়গুলো জানা অসম্ভব। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর ধারে কাছে পৌঁছানো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে মানুষের কোন অভিজ্ঞতাও নেই। এসব চোখেও দেখা যায়না। কুরআন সুস্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, ليس كمثله شيئ وهو السميع البصير ‘‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। কাজেই এ বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম দার্শনিকরা কুরআন ও সুন্নাহর সহজ সরল উক্তিগুলো বাদ দিয়ে গায়েবী বিষয়গুলোর দার্শনিক ও বুদ্ধিভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করে। তাদের জবাব দেয়ার জন্য আরেক শ্রেণীর মুসলিম আলেম দাঁড়িয়ে যান। তারাও দার্শনিকদের জবাবে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে থাকেন। কিন্তু তাদের উপস্থাপিত যুক্তি-তর্ক দার্শনিকদের জবাবে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাদের যুক্তিগুলো ছিল দুর্বল। এগুলো সংশয় দূর করার বদলে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এমনসব জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যার জবাব কালামশাস্ত্রবিদগণ খুজেঁ না পেয়ে তারা নিজেরাই সংশয়ে পড়েছে।
ইমাম রাযী শেষ বয়সে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, তিনি ইলেম কালাম দার্শন শাস্ত্রের উপর অনেক চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেছেন। শেষে তিনি এ সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এর ফলে রোগীর রোগ নিরাময় হওয়ার চেয়ে আরো বৃদ্ধি পায়, এবং পিপাসার্তের পিপাসা মোটেই নিবারণ হয়না। তিনি বলেন, কুরআন-সুন্নাহর পদ্ধতিই আমি নিকটতর পেয়েছি।
আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর সত্তা ও গুনাবলী সম্পর্কে কালাম শাস্ত্রবিদ ও মুসলিম দার্শনিকগণ যে বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছেন, ইমাম ইবনে তাইমীয়া তাতে মোটেই সন্তুষ্টি ছিলেন না। কারণ তার মোকাবেলায় কুরআন-সুন্নাহর যুক্তি-প্রমাণ অনেক সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ, দ্ব্যর্থহীন ও হৃদয়গ্রাহী। তাই ইমাম ইবনে তাইমীয়া আল্লাহর সত্তা ও গুনাবলী এবং ঈমানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মুসলিমদের উপর যা আবশ্যক, কুরআন-সুন্নাহর দলীলের আলোকে তিনি অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন। এসব বিষয়ে তিনি একাধিক মূল্যবান কিতাব রচনা করেছেন এবং দার্শনিক কালামীদের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। ওয়াসেতীয়া, তাদমুরীয়া এবং হামুবীয়া এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন গ্রীক দর্শনের কিতাবাদি আরবীতে অনুবাদ করা হলো, তখন থেকেই ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারের উপর গ্রীক দর্শনের প্রভাব পড়তে থাকে। আববাসী খেলাফতকালে সরকারীভাবে এ কাজে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ফলে মুসলিমদের লাইব্রেরীগুলো গ্রীক দর্শনের কিতাবে ভরপুর হয়ে যায়। মুসলিম বিদ্বানগণের গ্রীক দর্শনের দিকে ঝুকে পড়ে। ইসলামী আকীদাহর উপরও গ্রীক দর্শনের প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, তাঁর কার্যাবলী, সৃষ্টির সূচনা ও সমাপ্তি, পরিণাম, কিয়ামত, হাশর-নশর, মানুষের আমলের ফলাফল এবং এ ধরণের অন্যান্য গায়েবী বিষয়গুলো জানার জন্য কুরআন-সুন্নাহর পথ ছাড়া আর কোন পথ নেই। চিন্তা-ভাবনা, আন্দাজ-অনুমান করে এ বিষয়গুলো জানা অসম্ভব। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর ধারে কাছে পৌঁছানো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে মানুষের কোন অভিজ্ঞতাও নেই। এসব চোখেও দেখা যায়না। কুরআন সুস্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, ليس كمثله شيئ وهو السميع البصير ‘‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। কাজেই এ বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম দার্শনিকরা কুরআন ও সুন্নাহর সহজ সরল উক্তিগুলো বাদ দিয়ে গায়েবী বিষয়গুলোর দার্শনিক ও বুদ্ধিভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করে। তাদের জবাব দেয়ার জন্য আরেক শ্রেণীর মুসলিম আলেম দাঁড়িয়ে যান। তারাও দার্শনিকদের জবাবে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে থাকেন। কিন্তু তাদের উপস্থাপিত যুক্তি-তর্ক দার্শনিকদের জবাবে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাদের যুক্তিগুলো ছিল দুর্বল। এগুলো সংশয় দূর করার বদলে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এমনসব জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যার জবাব কালামশাস্ত্রবিদগণ খুজেঁ না পেয়ে তারা নিজেরাই সংশয়ে পড়েছে।
ইমাম রাযী শেষ বয়সে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, তিনি ইলেম কালাম দার্শন শাস্ত্রের উপর অনেক চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেছেন। শেষে তিনি এ সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এর ফলে রোগীর রোগ নিরাময় হওয়ার চেয়ে আরো বৃদ্ধি পায়, এবং পিপাসার্তের পিপাসা মোটেই নিবারণ হয়না। তিনি বলেন, কুরআন-সুন্নাহর পদ্ধতিই আমি নিকটতর পেয়েছি।
আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর সত্তা ও গুনাবলী সম্পর্কে কালাম শাস্ত্রবিদ ও মুসলিম দার্শনিকগণ যে বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছেন, ইমাম ইবনে তাইমীয়া তাতে মোটেই সন্তুষ্টি ছিলেন না। কারণ তার মোকাবেলায় কুরআন-সুন্নাহর যুক্তি-প্রমাণ অনেক সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ, দ্ব্যর্থহীন ও হৃদয়গ্রাহী। তাই ইমাম ইবনে তাইমীয়া আল্লাহর সত্তা ও গুনাবলী এবং ঈমানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মুসলিমদের উপর যা আবশ্যক, কুরআন-সুন্নাহর দলীলের আলোকে তিনি অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন। এসব বিষয়ে তিনি একাধিক মূল্যবান কিতাব রচনা করেছেন এবং দার্শনিক কালামীদের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। ওয়াসেতীয়া, তাদমুরীয়া এবং হামুবীয়া এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইমামের কারাবরণ
যুগে যুগে যারা সত্য দ্বীনের খেদমতে নিজেদের জীবন ও যৌবন ব্যয় করেছেন, তাদের কেউই
যুলুম-নির্যাতন থেকে রেহাই পান নি। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার ক্ষেত্রেও তার
ব্যতিক্রম হয়নি। ইসলামের নামে প্রচলিত ভ্রান্ত মতবাদের কঠোর প্রতিবাদ করার কারণে
স্বার্থবাদী ও বিদ্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন। সর্বেশ্বর ও অদ্বৈতবাদীদের
লোকেরা তাদের মতবাদ প্রচার করার সাথে সাথে প্রকাশ্যে মদ পান এবং সমস্ত হারাম কাজেই
লিপ্ত হতো। কারণ তাদের মতানুযায়ী অস্তিত্ব যখন মাত্র একটি তখন হালাল হারামের
পার্থক্য থাকবে কেন? শরীয়তেরই বাধ্যবাধকতা থাকবে কেন? তাদেরকে যখন বলা হলো
এই বক্তব্য তো কুরআন-হাদীছের বিরোধী, তখন তারা বলল, কুরআন-হাদীছের
দলীলের মাধ্যমে নয়; বরং কাশফের মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য
প্রমাণিত। মোটকথা কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা, অলী-আওলীয়াদের উসীলা
ধরা, তিন তালাকের মাসআলাসহ আরো অনেক কারণে
ইমাম ইবনে তাইমিয়া হিংসুকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। কুচক্রীরা তাঁর বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। এক পর্যায়ে তারা সরকারের সহায়তা লাভে সমর্থ হয়। মিশরের
তদানীন্তন শাসককে তারা ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। আর তখন সিরিয়া ও মিশর ছিল
একই রাষ্ট্রভূক্ত। রাজধানী ছিল মিশরের কায়রোতে। সিরিয়া ছিল মিশরের অন্তর্ভূক্ত
একটি প্রদেশ। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা সহজেই সরকারকে প্রভাবিত করে ফেলে। তাদের
প্ররোচনার ফলে শাহী ফরমানের মাধ্যমে ইমামকে কায়রোতে চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। ২২
রামাযান জুমআর দিন তিনি মিশরে পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছে কেল্লার জামে মসজিদে নামায
পড়ার পর তিনি আলোচনা শুরু করতে চান। কিন্তু তাঁর কিছু কিছু আকীদাহ-চিন্তা ইসলাম
বিরোধী হওয়ার অভিযোগে তাকে কথা বলার অনুমতি না দিয়ে জনতাকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে
দেয়া হয়। অতঃপর কাযী ইবনে মাখলুফের নির্দেশে তাঁকে কেল্লার বরুজে কয়েকদিন আটক
রাখার পর ঈদের রাতে মিশরের বিখ্যাত জুব কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
তাঁর কারাবরণের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ইতিহাসের কিতাবসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি বিভিন্ন মেয়াদে ২১বার কারা বরণ করেছেন। যতবারই তাঁর উপর চাপ প্রয়োগ করে অন্যায় স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই তিনি সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। শর্তসাপেক্ষ কারাগার থেকে বের হওয়ার সুযোগ তিনি একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছেন।
জেলখানার ভিতরে তিনি দেখলেন কয়েদীরা নিজেদের মন ভুলাবার ও সময় কাটানোর জন্য আজে বাজে কাজ করছে। তাদের একদল তাস খেলছে। আরেকদল দাবা খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছে। নামাযের দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। খেলার ঝোকে নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে। ইমাম এতে আপত্তি জানালেন, তাদেরকে নামাযের প্রতি আহবান জানালেন এবং আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশগুলো তাদের সামনে তুলে ধরলেন। তাদের পাপকাজগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার উপদেশ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই জেলখানার মধ্যে দ্বীনি ইলমের এমন চর্চা শুরু হয়ে গেল যে, সমগ্র জেলখানাটি একটি মাদরাসায় পরিণত হলো। অবস্থা এমন হলো অনেক কয়েদী মুক্তির ঘোষনা শুনেও আরো কিছুদিন শাইখের সংস্পর্শে থেকে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলো।
মূলতঃ সুফীদের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা, কবর ও মাযারের উদ্দেশ্যে সফর করা, তালাকের মাসআলা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি মাসআলা নিয়ে ইমামের সাথে বিরোধীদের দ্বন্ধের কারণেই তাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।
তাঁর কারাবরণের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ইতিহাসের কিতাবসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি বিভিন্ন মেয়াদে ২১বার কারা বরণ করেছেন। যতবারই তাঁর উপর চাপ প্রয়োগ করে অন্যায় স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই তিনি সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। শর্তসাপেক্ষ কারাগার থেকে বের হওয়ার সুযোগ তিনি একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছেন।
জেলখানার ভিতরে তিনি দেখলেন কয়েদীরা নিজেদের মন ভুলাবার ও সময় কাটানোর জন্য আজে বাজে কাজ করছে। তাদের একদল তাস খেলছে। আরেকদল দাবা খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছে। নামাযের দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। খেলার ঝোকে নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে। ইমাম এতে আপত্তি জানালেন, তাদেরকে নামাযের প্রতি আহবান জানালেন এবং আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশগুলো তাদের সামনে তুলে ধরলেন। তাদের পাপকাজগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার উপদেশ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই জেলখানার মধ্যে দ্বীনি ইলমের এমন চর্চা শুরু হয়ে গেল যে, সমগ্র জেলখানাটি একটি মাদরাসায় পরিণত হলো। অবস্থা এমন হলো অনেক কয়েদী মুক্তির ঘোষনা শুনেও আরো কিছুদিন শাইখের সংস্পর্শে থেকে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলো।
মূলতঃ সুফীদের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা, কবর ও মাযারের উদ্দেশ্যে সফর করা, তালাকের মাসআলা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি মাসআলা নিয়ে ইমামের সাথে বিরোধীদের দ্বন্ধের কারণেই তাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।
কারাগারে থেকেও ইমামের কর্মতৎপরতা
সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকে যারা নিজেদের জীবনের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ
করেছেন, তারা দুনিয়ার কোন বাধাকে বাধা মনে করেন
না। অনুকূল-প্রতিকূল যে কোন পরিবেশেই তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
অনুকূল পরিবেশের আশায় তারা কাজ ও প্রোগ্রাম স্থগিত রেখে চুপচাপ বসে থাকেন না।
দামেস্কের কারাগারে ইমাম ইবনে তাইমীয়া একই পন্থা অবলম্বন করলেন। এবাদত-বন্দেগী ও
কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি তিনি কলমযুদ্ধ অব্যাহত রাখলেন। বিশেষ করে নিজের লেখা
বইগুলোতে দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিতে থাকলেন। জেলখানার ভিতরে তিনি যা লিখতেন এবং
লোকদের প্রশ্নের যেসব জবাব দিতেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই কারাগারের দেয়াল ভেদ
করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তো। আস্তে আস্তে জেলের পরিবেশ তাঁর কাছে স্বাভাবিক হয়ে
উঠলো। তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছিলেন অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে। এক সময় তার কাছ থেকে
দোয়াত-কলম, খাতাপত্র ও বই-পুস্তক ছিনিয়ে নেয়া হলো।
এগুলো ছিনিয়ে নেয়ার পর জেলখানার ভিতর থেকে ছেড়া কাগজ সংগ্রহ করে কয়লা দিয়ে তার
উপরই লিখা শুরু করলেন। এতেই বেশ কয়েকটি পুস্তিকা লিখা হয়ে গেল।
ইমামের
উপর মিথ্যারোপ
ইমামের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ছিল, তার সবগুলোই ছিল
মিথ্যা ও বানোয়াট। সমকালীন স্বার্থান্বেষী মহল, এক শ্রেণীর সুফী
সম্প্রদায়, কালামশাস্ত্রবিদ এবং বিদআতীরা শত্রুতার
বশবতী হয়ে মনের জ্বালা মেটানোর জন্য এবং পার্থিব ফায়দা হাসিল করার জন্যই
অভিযোগগুলো করেছিল। হকপন্থীদের বিরুদ্ধে বাতিলপন্থীদের মিথ্যা অভিযোগ নতুন কিছু
নয়। আজও চলছে সেই ধারাবাহিকতা। কিন্তু বিরোধী ও বিদআতীরা তাঁর উপর যেসব মিথ্যারোপ
করেছে, তার মধ্যে আশ্চর্যজনক হলো বিখ্যাত
পর্যটক ইবনে বতুতার মিথ্যাচার। তিনি লিখেছেন, আমি ৭২৬ হিজরীর
রামাযান মাসের নয় তারিখ বৃহস্পতিবার দিন দামেস্ক শহরে পৌঁছলাম। তখন দামেস্ক শহরে
হাম্বলী আলেমদের মধ্যে তকীউদ্দীন ইবনে তাইমীয়া ছিলেন অন্যতম। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে
কথা বলতেন, তবে তার মস্তিস্কে কিছু সমস্যা ছিল!!
দামেস্কবাসীরা তাঁকে খুব সম্মান করতো। তিনি জামে উমুবীর মিম্বারে লোকদেরকে উপদেশ
দিতেন। পরের দিন (জুমআর দিন) আমি মসজিদে গিয়ে দেখি, তিনি আলোচনা করছেন।
সেদিন তাঁর আলোচনার মধ্যে এইও ছিল যে, তিনি বলে যাচ্ছিলেন,إن الله ينزل إلى سماء الدنيا كنزولي هذا ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ
তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন আমার এই নামার মতই’’। এই কথা বলে তিনি মিম্বারের
সিঁড়িসমূহের একটি সিঁড়িতে নেমে আসলেন। তখন মালেকী মাজহাবের ফকীহ ইবনে যাহরা তার
বিরোধীতা করলেন। এতে জনগণ উত্তেজিত হয়ে মালেকী ফকীহকে প্রচুর মারপিট করলো।
মারপিটের কারণে ফকীহর মাথার পাগড়ী পড়ে গেল......। এই ছিল ইবনে বতুতার মিথ্যাচার।
ইবনে বতুতার এই কথা যে মিথ্যা, তার প্রমাণ হলো, সে উল্লেখ করেছে, ৭২৬ হিজরীর রামাযান মাসের নয় তারিখে দামেস্কে প্রবেশ করল। ঐতিহাসিকদের ঐক্যমতে শাইখুল ইসলাম তখন দামেস্কের কারাগারে বন্ধী ছিলেন। নির্ভরযোগ্য আলেমগণ উল্লেখ করেছেন, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া ৭২৬ হিজরীর শাবান মাসে কারাগারে প্রবেশ করেছেন। আর ৭২৮ হিজরী সালের যুলকাদ মাসে লাশ হয়ে সেখান থেকে বের হয়েছেন। (দেখুনঃ তাবাকাতুল হানাবেলা, বেদায়া ওয়ান নেহায়া ইত্যাদি)
প্রিয় পাঠক বৃন্দ! লক্ষ্য করুন এই মিথ্যুকের প্রতি। সে বলছে যে, রামাযান মাসের কোন এক জুমআর দিন ইমামকে জামে উমুবীর মিম্বারে আলোচনা করতে দেখল। এখন প্রশ্ন হলো জামে উমুবীর মিম্বার কি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল? বিশাল জামে উমুবী কি উপস্থিত সকল মানুষসহ কারাগারে প্রবেশ করেছিল? যাতে করে ইমাম সেখানে ভাষণ দিতে পারেন?
এখন কথা হলো, যারা বলে ইমাম ইবনে তাইমীয়া আল্লাহর সিফাতকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনা করেছেন এবং তিনি ছিলেন মুশাবেবহা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত তারা কি ইবনে বতুতার সেই মিথ্যা তথ্যের উপর নির্ভর করেছে?
আসল কথা হলো ইমাম কখনোই আল্লাহর কোন সিফাতকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনা করেন নি; বরং তিনি মুশাবেবহাসহ অন্যান্য সকল বাতিল ফির্কার জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। তার লেখনীগুলোই এর উজ্জল প্রমাণ। তিনি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করেছেন এবং বলেছেন তাঁর সুউচ্চ সিফাতগুলো সৃষ্টির সিফাতের মত নয়। দুনিয়ার আকাশে তাঁর নেমে আসা মাখলুকের নামার মত নয়। তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে যেভাবে নেমে আসা শোভনীয়, তিনি সেভাবেই নেমে আসেন। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহ। আকীদাহ আল ওয়াসেতীয়ার বহু স্থানে তিনি এই মূলনীতিটি সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’।
ইবনে বতুতার এই কথা যে মিথ্যা, তার প্রমাণ হলো, সে উল্লেখ করেছে, ৭২৬ হিজরীর রামাযান মাসের নয় তারিখে দামেস্কে প্রবেশ করল। ঐতিহাসিকদের ঐক্যমতে শাইখুল ইসলাম তখন দামেস্কের কারাগারে বন্ধী ছিলেন। নির্ভরযোগ্য আলেমগণ উল্লেখ করেছেন, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া ৭২৬ হিজরীর শাবান মাসে কারাগারে প্রবেশ করেছেন। আর ৭২৮ হিজরী সালের যুলকাদ মাসে লাশ হয়ে সেখান থেকে বের হয়েছেন। (দেখুনঃ তাবাকাতুল হানাবেলা, বেদায়া ওয়ান নেহায়া ইত্যাদি)
প্রিয় পাঠক বৃন্দ! লক্ষ্য করুন এই মিথ্যুকের প্রতি। সে বলছে যে, রামাযান মাসের কোন এক জুমআর দিন ইমামকে জামে উমুবীর মিম্বারে আলোচনা করতে দেখল। এখন প্রশ্ন হলো জামে উমুবীর মিম্বার কি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল? বিশাল জামে উমুবী কি উপস্থিত সকল মানুষসহ কারাগারে প্রবেশ করেছিল? যাতে করে ইমাম সেখানে ভাষণ দিতে পারেন?
এখন কথা হলো, যারা বলে ইমাম ইবনে তাইমীয়া আল্লাহর সিফাতকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনা করেছেন এবং তিনি ছিলেন মুশাবেবহা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত তারা কি ইবনে বতুতার সেই মিথ্যা তথ্যের উপর নির্ভর করেছে?
আসল কথা হলো ইমাম কখনোই আল্লাহর কোন সিফাতকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনা করেন নি; বরং তিনি মুশাবেবহাসহ অন্যান্য সকল বাতিল ফির্কার জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। তার লেখনীগুলোই এর উজ্জল প্রমাণ। তিনি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করেছেন এবং বলেছেন তাঁর সুউচ্চ সিফাতগুলো সৃষ্টির সিফাতের মত নয়। দুনিয়ার আকাশে তাঁর নেমে আসা মাখলুকের নামার মত নয়। তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে যেভাবে নেমে আসা শোভনীয়, তিনি সেভাবেই নেমে আসেন। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহ। আকীদাহ আল ওয়াসেতীয়ার বহু স্থানে তিনি এই মূলনীতিটি সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’।
ইমামের সুবিশাল ইলমী খেদমত
ইমাম ইবনে তাইমীয়ার স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি
স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করেই লিখতেন। জেলখানায় ঢুকিয়েও যখন তাঁকে লেখালেখি থেকে
বিরত রাখা সম্ভব হলোনা, তখন তাঁর নিকট থেকে
দোয়াত-কলম ও বই-পুস্তক ছিনিয়ে নেয়া হলো। বই-পুস্তক ছিনিয়ে নেয়ার পর তিনি
স্মরণশক্তির উপর ভিত্তি করেই লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থাদির
সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব। নিম্নে আমরা তাঁর কয়েকটি বহুল প্রসিদ্ধ কিতাবের
নাম উল্লেখ করছি।
(১) মাজমুআয়ে ফাতাওয়া ইবনে তাইমীয়া, এটি শাইখের সর্ববৃহৎ সংকলন, সৌদি আরব সরকার ৩৭ খন্ডে এটিকে ছাপিয়েছে,
(২) আল আকীদাতুল ওয়াসেতীয়া,
(৩) আলফুরকানু বাইনা আওলিয়াইর রাহমান ওয়া আওলিয়াইশ শাইতান,
(৪) আলকালিমুত তাইয়্যিব,
(৫) মিনহাজুস সুন্নাহ আন্ নবুবীয়াহ,
(৬) যিয়ারাতুল কুবুর,
(৭) শরহুল উমদাহ,
(৮) আল জাওয়াবুস সহীহ,
(৯) রিসালাতুদ তাদমুরীয়াহ,
(১০) রিসালাতুল হামবীয়া,
(১১) মুকাদ্দিমাহ ফীত্ তাফসীর,
(১২) ইক্তেযাউস্ সিরাতিল মুস্তাকীম,
(১৩) আর্ রাদ্দু আলা ইবনে আরাবী
(১৪) আস্ সিয়াসা আশ্ শারঈয়াহ এবং
(১৫) আলউবুদীয়াহ।
এতদ্ব্যতীত দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আরো অনেক মূল্যবান কিতাব রয়েছে। সেগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে পাঠকদেরকে মাকতাবা শামেলার দ্বারস্থ হওয়ার অনুরোধ করা হলো।
(২) আল আকীদাতুল ওয়াসেতীয়া,
(৩) আলফুরকানু বাইনা আওলিয়াইর রাহমান ওয়া আওলিয়াইশ শাইতান,
(৪) আলকালিমুত তাইয়্যিব,
(৫) মিনহাজুস সুন্নাহ আন্ নবুবীয়াহ,
(৬) যিয়ারাতুল কুবুর,
(৭) শরহুল উমদাহ,
(৮) আল জাওয়াবুস সহীহ,
(৯) রিসালাতুদ তাদমুরীয়াহ,
(১০) রিসালাতুল হামবীয়া,
(১১) মুকাদ্দিমাহ ফীত্ তাফসীর,
(১২) ইক্তেযাউস্ সিরাতিল মুস্তাকীম,
(১৩) আর্ রাদ্দু আলা ইবনে আরাবী
(১৪) আস্ সিয়াসা আশ্ শারঈয়াহ এবং
(১৫) আলউবুদীয়াহ।
এতদ্ব্যতীত দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আরো অনেক মূল্যবান কিতাব রয়েছে। সেগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে পাঠকদেরকে মাকতাবা শামেলার দ্বারস্থ হওয়ার অনুরোধ করা হলো।
পরলোকের পথে যাত্রা
ইমামের বয়স শেষ হয়ে আসছিল। এমন সময় একদিন দামেস্কের গভর্ণর কারাগারে ইমামকে
দেখতে আসলেন। গভর্ণর তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন। জবাবে ইমাম বললেনঃ আমি আপনাকে ক্ষমা
করে দিয়েছি। আমি তাদেরকেও ক্ষমা করে দিয়েছি, যারা আমার সাথে
শত্রুতা পোষণ করেছে। সুলতানের বিরুদ্ধেও আমার কোন অভিযোগ নেই। কারণ তিনি স্বেচ্ছায়
নয়; বরং উলামায়ে কেরামের ফতোয়ার কারণেই
আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। কিন্তু আমি ঐসব লোকদেরকে ক্ষমা করতে পারিনা, যারা আল্লাহ ও
রাসূলের শত্রু। সত্য দ্বীনের প্রতি আক্রোশের কারণে যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
করেছে এবং আমাকে কারারুদ্ধ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে।
৭২৮ হিজরীর ২২ যুলকাদ মাসে ৬৭ বছর বয়সে উপনীত হয়ে দামেস্কের কারাগারে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এ সময় তাঁর কাছেই ছিলেন। দুর্গের মুআয্যিন মসজিদের মিনারে উঠে ইমামের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যে শহরের সমস্ত মসজিদে অলিতে-গলিতে, রাজপথে এবং সর্বত্রই ইমামের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলো। শেষবারের মত ইমামকে দেখার জন্য দুর্গের পথে জনতার ঢল নামলো। দুর্গের দরজা খুলে দেয়া হলো। গোসলের পর তাঁর জানাযা শহরের বৃহত্তম মসজিদ জামে উমুবীতে আনা হয়। জামে উমুবী এবং রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্বে আর কোথাও এত বড় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়নি।
সালাফদের মানহাজের পক্ষে দীর্ঘ সংগ্রাম, যুক্তি-তর্ক, লেখালেখি, ফতোয়া দান, শিক্ষকতা, দাওয়াত এবং আল্লাহর রাস্তায় সর্বোত্তম জিহাদ করে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এভাবেই চলে গেলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। দ্বীনের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পার্থিব জীবনের স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ পান নি। এমনকি বিবাহ করার সুযোগও পান নি।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর চরিত্র, বৈশিষ্ট এবং দ্বীনের পথে তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা আমাদের আজকের আলেম সমাজকে সজাগ করবে, প্রেরণা যোগাবে, -এতে কোন সন্দেহ নেই। দ্বীনের ব্যাপারে যাতে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়, -এজন্য তিনি নিজের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশ বিসর্জন দেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন সয়ে যেতে প্রস্ত্তত হন, দ্বীনের উপর কোন প্রকার যুলুম বরদাশত করতে তিনি মুহূর্তকালের জন্যও প্রস্ত্তত হননি।
হে আল্লাহ! তোমার দ্বীনের এই অতন্ত্র প্রহরী, সেবক ও মর্দে মুজাহিদ আমাদের প্রাণের শাইখকে তোমার রহমতের প্রশস্ত দ্বারা ঢেকে নাও, তোমার সুবিশাল জান্নাতে তাঁর ঠাই করে দাও এবং নবী, সিদ্দীক, শুহাদা ও সালেহীনদের সংশ্রবে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান করে দাও। আমাদেরকেও তাদের সাথে কবুল করে নাও। আমীন
৭২৮ হিজরীর ২২ যুলকাদ মাসে ৬৭ বছর বয়সে উপনীত হয়ে দামেস্কের কারাগারে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এ সময় তাঁর কাছেই ছিলেন। দুর্গের মুআয্যিন মসজিদের মিনারে উঠে ইমামের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যে শহরের সমস্ত মসজিদে অলিতে-গলিতে, রাজপথে এবং সর্বত্রই ইমামের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলো। শেষবারের মত ইমামকে দেখার জন্য দুর্গের পথে জনতার ঢল নামলো। দুর্গের দরজা খুলে দেয়া হলো। গোসলের পর তাঁর জানাযা শহরের বৃহত্তম মসজিদ জামে উমুবীতে আনা হয়। জামে উমুবী এবং রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্বে আর কোথাও এত বড় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়নি।
সালাফদের মানহাজের পক্ষে দীর্ঘ সংগ্রাম, যুক্তি-তর্ক, লেখালেখি, ফতোয়া দান, শিক্ষকতা, দাওয়াত এবং আল্লাহর রাস্তায় সর্বোত্তম জিহাদ করে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এভাবেই চলে গেলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। দ্বীনের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পার্থিব জীবনের স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ পান নি। এমনকি বিবাহ করার সুযোগও পান নি।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর চরিত্র, বৈশিষ্ট এবং দ্বীনের পথে তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা আমাদের আজকের আলেম সমাজকে সজাগ করবে, প্রেরণা যোগাবে, -এতে কোন সন্দেহ নেই। দ্বীনের ব্যাপারে যাতে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়, -এজন্য তিনি নিজের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশ বিসর্জন দেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন সয়ে যেতে প্রস্ত্তত হন, দ্বীনের উপর কোন প্রকার যুলুম বরদাশত করতে তিনি মুহূর্তকালের জন্যও প্রস্ত্তত হননি।
হে আল্লাহ! তোমার দ্বীনের এই অতন্ত্র প্রহরী, সেবক ও মর্দে মুজাহিদ আমাদের প্রাণের শাইখকে তোমার রহমতের প্রশস্ত দ্বারা ঢেকে নাও, তোমার সুবিশাল জান্নাতে তাঁর ঠাই করে দাও এবং নবী, সিদ্দীক, শুহাদা ও সালেহীনদের সংশ্রবে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান করে দাও। আমাদেরকেও তাদের সাথে কবুল করে নাও। আমীন
0 Comments