কুরবানীর পশুতে ভাগে শরীক হওয়া-০২

কুরবানীর পশুতে ভাগে শরীক হওয়া-০১

আমরা এই প্রবন্ধে শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব এর ‘মাসায়েলে কুরবানী ও আক্বীক্বা’ বইটিতে কুরবানীর পশুতে শরীক হওয়া বা ভাগা সম্পর্কিত বিষয়ে যে বিতর্কের অবতারণা করা হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রকৃত সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করব, ওয়ামা তাওফিক্বী ইল্লা বিল্লাহ।
ইসলামি বিধি-বিধান কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভরশীল। এই দুই উৎসের বিরোধী বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাতিল। তবে কখনো কখনো মনীষী বিশেষের ভুল ইজতিহাদ মুসলিম সর্বসাধারণকে সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্ধের মধ্যে ফেলে দেয়। তখন শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি বিশেষের ভুল-ত্রুটিগুলো তাঁর সমমনা বা আরো উচ্চতর মনীষীদের উপস্থাপনা দ্বারা বিশ্লেষণ করাটা জরুরি হয়ে যায়। এমনই একটি ভুল ইজতিহাদি মাসআলার আমরা পর্যালোচনা করব। মাসআলাটি হল ‘কুরবানীর পশুতে ভাগা বা শরীক হওয়া’। কেননা যাঁরা ‘মুক্বীমের পক্ষে কুরবানীর পশুতে ভাগা বা শরীকানার’ বিষয়টি অস্বীকার করছেন, তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে তাঁদের উদ্ভাবিত আলোচনাটি পূর্ববর্তী আলেমদের থেকে পাওয়া যায় না। যেমন, তাঁরা লিখেছেনঃ
ক) জমহুর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদঈর ন্যায় কুরবানীতেও শরীক হওয়া চলবে। (মাসায়েলে কুরবানীঃ পৃষ্ঠা-১৮; পরবর্তী ‘লেখকের বক্তব্য – ৮’ দ্র:)
খ) বিগত বিদ্বানগণের যুগে সম্ভবতঃ মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নি। (মাসায়েলে কুরবানীঃ পৃষ্ঠা-১৯; পরবর্তী ‘লেখকের বক্তব্য – ১৫’ দ্র:)
অর্থাৎ গবেষণাটি লেখকের ব্যক্তিগত। এরসাথে পূর্ববর্তী আলেমদের ইলম ও সাক্ষ্য-প্রমাণের সম্পর্ক নেই। অথচ ইলমের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী সালাফদের সঠিক সাক্ষ্যের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত তথ্য। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
اِلاَّ مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ
“তবে তারা ছাড়া যারা ‘ইলমের ভিত্তিতে সত্যের সাক্ষ্য দেয়।” [সূরা যুখরুফ : আয়াত-৮৬]
আর উক্ত সত্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে জেনে নেয়াটাও আমাদের দায়িত্ব হিসেবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ ـ بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ
“যদি জানা না থাকে তাহলে জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও, সুস্পষ্ট প্রমাণ ও কিতাব দ্বারা।” [সূরা নহল : আয়াত-৪৩ ও ৪৪]
আর সত্যিকার আলেমগণ মিথ্যা সাক্ষ্য ও তথ্য প্রদান করেন না। কেননা তাঁরাই আল্লাহ তাআলার প্রতি সত্যিকারের ভয় রাখেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই নিম্নরূপ স্বীকৃতি উল্লেখ করা হয়েছেঃ
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاء
“নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে থেকে আলেমগণই তাকে ভয় করে।” [সূরা ফাতির : আয়াত-২৮]
পূর্বোক্ত আয়াতগুলোর দাবীর ভিত্তিতে কুরআন ও সহীহ হাদীসের সঠিক বুঝ উদ্ধার করা সম্ভব। কেননা ব্যক্তিবিশেষের পক্ষ থেকে যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা ব্যাপক সংখ্যক প্রজ্ঞাসম্পন্ন আলেমের সত্য-সাক্ষ্যভিত্তিক ঐকমত্যের মধ্যে হওয়াটা অসম্ভব। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءتْ مَصِيراً
“আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা কত মন্দ আবাস।” [সূরা নিসা : আয়াত-১১৫]
এ মর্মে রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
إنَّ اللَّهَ لا يجمعُ أمَّتي على ضلالةٍ ويدُ اللَّهِ على الجماعةِ
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এই উম্মাতকে গোমরাহির উপর একত্রিত করবেন না। আর আল্লাহর হাত জামাআতের উপর।”
[মুস্তাদরাকে হাকিম ১/১১৬ পৃ: হা/৩৯৯; শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। কিন্তু তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীসটির সনদকে যঈফ বলেছেন (বিস্তারিত : আযওয়াউল মাসাবিহ শরহে মিশকাতুল মাসাবিহ ১/২৩৪ পৃ:)। শায়েখ আলবানী (রহ) হাদীসটিকে অন্যান্য সাক্ষ্যে ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন (সহীহুল জামে হা/১৮৪৮)]
আমাদের পরবর্তী পর্যালোচনাতে পূর্বোক্ত আয়াত ও হাদীসের দাবীগুলো নীতিমালা হিসেবে অনুসৃত হবে।
জ্ঞাতব্যঃ এই পর্যালোচনাটির মাধ্যমে লেখক, গবেষক, সংগঠন বা তাদের অনুসারীদের হেয় করার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। কেবল তাদের পক্ষ থেকে প্রচারিত বই/পুস্তিকার উপস্থাপিত তথ্যগুলো হুবহু উদ্ধৃতির বিশ্লেষণ করা উদ্দেশ্য। যেন আলেম ও সর্বসাধারণের পক্ষে তুলনামূলক পর্যালোচনাটির প্রকৃত চিত্র সুস্পষ্ট হয়। আমরা এক্ষেত্রে সম্মানিত গবেষক বা লেখকের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি। তবে তাঁর বা তাঁদের উপস্থাপনাটি ‘লেখক’ শিরোনামে এবং আমাদের পর্যালোচনা ‘বিশ্লেষণ’ শিরোনামে উল্লেখ করা হবে।

মুক্বীম অবস্থায় পরিবারের বাইরের লোকদের (জামাআতবদ্ধভাবে) শরীক করা

লেখকের বক্তব্য-০১ঃ
লেখক তাঁর বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠা থেকে শরীক বা ভাগে কুরবানীর বিপক্ষে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। যার শুরু হয়েছে ‘নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হতে একটি পশুই যথেষ্ট’ শিরোনামে, যা নিম্নরূপঃ
ক) মা আয়েশা (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন … অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লেন,
بسمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تقبَّلْ من مُحمَّدٍ وآلِ محمَّدٍ ومن أمَّةِ محمَّدٍ
‘আল্লাহ নামে (কুরবানী করছি), হে আল্লাহ! তুমি এটি কবুল কর মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে, তার পরিবারের পক্ষ হ’তে ও তার উম্মতের পক্ষ হ’তে’। এরপর উক্ত দুম্বা দ্বারা কুরবানী করলেন। [মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৪]
[মাসায়েলে কুরবানী… (নভেম্বর ২০০৯) পৃ: ১৫,]
বিশ্লেষণ-০১ঃ
উল্লিখিত বর্ণনাটিতে (১) নবী (সা) নিজের, (২) তাঁর পরিবার ও (৩) তাঁর উম্মাতের পক্ষ থেকে একটি দুম্বা কুরবানীর প্রমাণ পাওয়া গেল। যা থেকে বুঝা যায়, একটি দুম্বাতে নবী (সা) নিজের পরিবার ছাড়া উম্মাতকেও শরীক করেছেন। অর্থাৎ মুক্বীম অবস্থায় একটি দুম্বাতে পরিবার ছাড়া অন্যান্য মুসলিমদেরকে শরীক করানোর দলিল রয়েছে। অথচ লেখক এই হাদীসটি থেকে দলিল নিয়েছেন “নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে”। অন্য বর্ণনাতে নবী (সা) এর কুরবানীর দু‘আটি হলঃ
بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ هَذَا عَنِّى وَعَمَّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمَّتِى
“বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, (ইয়া আল্লাহ!) এটি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মাতের মধ্যে যারা যহহা(কুরবানী) করতে পারে নি তাদের পক্ষ থেকে।”
[ আবূ দাউদ باب فِى الشَّاةِ يُضَحَّى بِهَا عَنْ جَمَاعَةٍ (অনুচ্ছেদ : একটি জামা‘আত বা দলের পক্ষ থেকে একটি বকরী যহহা(কুরবানী) করা) আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত আবূ দাউদ হা/২৮১০)। কেননা হাদীসটির সমর্থনে সহীহ মুসলিমের পূর্বোক্ত হাদীসটিই যথেষ্ট।]
অর্থাৎ হাদীসটির অংশবিশেষ ‘জামাআতের পক্ষ থেকে’ এর দাবীকে ত্যাগ করা হয়েছে। যা ইমাম আবূদাউদ নবী (সা) এর দু‘আর আলোকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন।
যদি বলা হয়, উম্মাতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা নবী (সা) এর সাথে খাস (সুনির্দিষ্ট)। সেক্ষেত্রে আমরা বলব, এই হাদীসটিতে গরু বা উটের বর্ণনা নেই, বরং একটি দুম্বার বর্ণনা এসেছে। এজন্যে ভাগে কুরবানীর আলোচনাও নেই। কেবল সওয়াবের ক্ষেত্রে নবী (সা) উম্মাতকে একটি দুম্বাতে শরীক করেছেন। সর্বোপরি হাদীসটিতে মুক্বীম অবস্থায় একটি দুম্বাতে নিজের পরিবার ছাড়া মুসলিমদেরকে শরীক করার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুক্বীম অবস্থায় বকরী সংক্রান্ত উক্ত হাদীসটিতে গরু বা উটে ভাগে কুরবানীর কোন বিরোধিতা নেই। তবে বকরীতে মুসলিমদেরকে শরীক করানোর মর্ম দ্বারা গরু বা উটের ক্ষেত্রে শরীক করাটাও জায়েয হয়। এ পর্যায়ে উট বা গরুর অন্যান্য হাদীসগুলো শরীকানা কুরবানীর ব্যাখ্যা হিসাবে গণ্য। (আলোচনা ও প্রমাণ সামনে আসবে, ইনঁশাআল্লাহ)
নবী (সা) নিজের উম্মাতকে কুরবানীর সওয়াবের ক্ষেত্রে শরীক করার জন্য এতটা আগ্রহী ছিলেন যে, এজন্যে তিনি কুরবানীর পশু দান বা বণ্টনও করতেন।
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ قَالَ قَسَمَ النَّبِيُّ ﷺ بَيْنَ أَصْحَابِهِ ضَحَايَا فَصَارَتْ لِعُقْبَةَ جَذَعَةٌ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ صَارَتْ لِي جَذَعَةٌ قَالَ ضَحِّ بِهَا
“উকবা ইবনে আমির যুহানী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী (সা) তাঁর সাহাবীদের মধ্যে কতগুলো কুরবানীর পশু বণ্টন করলেন। তখন ‘উকবা (রা) এর ভাগে পড়ল একটি বকরীর বাচ্চা। ‘উকবা (রা) বলেন, তখন আমি বললামঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! আমার ভাগে এসেছে একটি বকরীর বাচ্চা। তিনি বললেনঃ সেটাই কুরবানী করে নাও।”
[সহীহ বুখারী, কিতাবুল আযাহী بَاب قِسْمَةِ الْإِمَامِ الْأَضَاحِيَّ بَيْنَ النَّاسِ (অনুচ্ছেদ : ইমাম কর্তৃক জনগণের মধ্যে কুরবানীর পশু বণ্টন); অনুরূপ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মিশকাত (এমদা) ৩/১৩৭২ নং]
অর্থাৎ নবী (সা) এর উদ্যোগ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, তিনি উম্মাতকে নানাভাবে কুরবানীর সওয়াবে শরীক করার চেষ্টা করতেন। সেটা যেমন কুরবানীর পশু বণ্টনের মধ্যে দিয়েও উম্মাতকে কুরবানীর সওয়াবে শরীক করার বৈধতা দিয়েছেন। তেমনি তিনি নিজের কুরবানীতে দু‘আর মধ্যে উম্মাতকে শরীক করেছেন। একারণেই ইমাম আবূ দাউদ অনুচ্ছেদ লিখেছেন এভাবেঃ باب فِى الشَّاةِ يُضَحَّى بِهَا عَنْ جَمَاعَةٍ “অনুচ্ছেদ : জামা‘আতের পক্ষ থেকে একটি বকরী কুরবানী”। সুতরাং আমাদেরও চিন্তা করা উচিৎ কিভাবে উম্মাতকে কুরবানীর সওয়াবে নবী (সা) এর দেয়া পদ্ধতিতে শরীক করানো যায়, হোক না সেটা বকরীর ন্যায় ছোট্ট একটি মাত্র পশু।
আনাস (রা) বর্ণনা করেনঃ
وَنَحَرَ النَّبِيُّ ﷺ بِيَدِهِ سَبْعَ بُدْنٍ قِيَامًا وَضَحَّى بِالْمَدِينَةِ كَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ
“(হজ্জে) নবী (সা) সাতটি বুদনা (উট) নহর করেন আর মদীনাতে হৃষ্টপুষ্ট শিং বিশিষ্ট দু’টি মেষ যহহা (কুরবানী) করেন।”
[সহীহ বুখারী, কিতাবুল হুজ্জ باب النحر البدن قائمة]।
এক্ষেত্রে সাহাবীগণ নবী (সা) কে অনুসরণ করেছেন মর্মে প্রমাণ আছে। যেমন, আনাস (রা) থেকে বর্ণিতঃ
أنّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ كان يُضَحَّي بِكَبْشَيْنِ قال أنس: وأنا أُضحَّي بِكَبْشَيْنِ
“নবী (সা) দু’টি দুম্বা কুরবানী করতেন। আনাস (রা) বলেন, আমিও দু’টি দুম্বা কুরবানী করি।”
[নাসায়ী, কিতাবুল আযহা باب الكبش ; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত নাসায়ী হা/৪৩৭৫)। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও নবী (সা) কর্তৃক দু’টি দম্বা কুরবানীর বর্ণনা আছে (মিশকাত ৩/১৩৯৯)]
এখন প্রশ্ন, নবী (সা) কিভাবে দু’টি দুম্বা কুরবানী করতেন? বিভিন্ন হাদীসের সম্মিলিত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়, এই দু’টি দুম্বা কুরবানী ছিল, নবী (সা) এর নিজের, তাঁর পরিবারে ও উম্মাতের পক্ষ থেকে।
[বিস্তারিত : মিশকাত (এমদা) ৩/১৩৬৯, ১৩৭০ ও ১৩৭৭ দ্র:]
সুস্পষ্ট হল, সাহাবীগণ নবী (সা) এর দু’টি বকরী কুরবানীর সুন্নাত অব্যাহত রেখেছিলেন। যারা আমলটি মানসুখ বা নবী (সা) এর জন্য সুনির্দিষ্ট বলেছেন, তাদের জবাবে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত “পরিবার ও উম্মাতের পক্ষ থেকে কুরবানীর হাদীসটির” ব্যাখ্যায় ইমাম নববীর (রহ) বক্তব্য নিম্নরূপঃ
واستدل بهذا من جوز تضحية الرجل عنه وعن أهل بيته واشتراكهم معه في الثواب وهو مذهبنا ومذهب الجمهور وكرهه الثوري وأبو حنيفة وأصحابه وزعم الطحاوي أن هذا الحديث منسوخ أو مخصوص وغلطه العلماء في ذلك فان النسخ والتخصيص لا يثبتان بمجرد الدعوى
“এই হাদীসটি থেকে দলিল নেয়া হয় যে, ব্যক্তির জন্য এটা জায়েয আযহিয়্যাতে তার পক্ষ থেকে ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে করবে। এতে তাদেরকে সওয়াবের মধ্যে শরীক করবে। এটা আমাদের মাযহাব ও জমহুরের মাযহাব। কিন্তু ইমাম সওরী, আবূ হানিফা ও তাঁর শিষ্যরা মাকরুহ বলেছেন। আর ইমাম তাহাবী (রহ) ধারণা করেছেন এই হাদীসটি মানসুখ (রহিত) কিংবা [নবী (সা) এর জন্য] মাখসুস (সুনির্দিষ্ট)। এই ব্যাপারে আলেমদের ভুল হয়েছে। কেননা আমলটি রহিত ও সুনির্দিষ্ট হওয়ার দাবী সর্বসম্মত নয়।” (শরহে মুসলিম নববী ১৩/১২৮ পৃ:)
যদি কেউ “উম্মাতের পক্ষ থেকে” বাক্যটিকে নবীর জন্য নির্দিষ্ট বলেন, তার জবাবেও উপরোক্ত উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। তর্কের খাতিরে তাদের দাবী মেনে নিলেও সমস্যা নেই। এর জবাব “পরিবারের পক্ষ থেকে” বাক্যের মধ্যে রয়েছে। কেননা হজ্জের হাদীর ক্ষেত্রে বকরী বা দুম্বা কেবল একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রমাণিত। কুরবানীদাতার পরিবার ও মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে প্রমাণিত নয়। তাছাড়া আলোচ্য বইটির লেখকের মতামতও (পৃ: ১৬ ‘ঘ’ নং) পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন একটি বকরী/দুম্বাই যথেষ্ট। আবূ দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আওনুল মা‘বুদে’ বলা হয়েছেঃ
قال الحافظ الخطابي في المعالم قوله من محمد وآل محمد ومن أمة محمد فيه دليل على أن الشاة الواحدة تجزئ عن الرجل وعن أهله وإن كثرو
“হাফেয খাত্তাবী (রহ) তাঁর ‘আল-মু‘আলিমে’ বলেছেন, নবী (সা) এর উক্তি ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে’ বাক্যটিতে একজন ব্যক্তি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি বকরী জায়েয হওয়ার দলিল রয়েছে, যদিও তারা অনেক সংখ্যক হয়।” (আওনুল মা‘বুদ باب في الشاة يضحي بها عن جماعة)
ইমাম ইবনে হাযম (রহ) লিখেছেনঃ
وَجَائِزٌ أَنْ يَشْتَرِكَ فِي الأُضْحِيَّةِ الْوَاحِدَةِ أَيُّ شَيْءٍ كَانَتْ الْجَمَاعَةُ مِنْ أَهْلِ الْبَيْتِ وَغَيْرِهِمْ وَجَائِزٌ أَنْ يُضَحِّيَ الْوَاحِدُ بِعَدَدٍ مِنْ الأَضَاحِيِّ
“একটি আযহিয়্যাহতে (কুরবানীর পশুতে) শরীক হওয়া জায়েয, যদিও সেটা একটি পরিবারের পক্ষ থেকে জামা‘আত হয় কিংবা অন্যদের পক্ষ থেকে। আবার একজন কুরবানীদাতার পক্ষ থেকে একাধিক কুরবানীও জায়েয।” (মুহাল্লা, কিতাবুল আযহিয়্যাহ مَسْأَلَةٌ يَشْتَرِك فِي الأُضْحِيَّةِ الْوَاحِدَةِ الْجَمَاعَةُ )
প্রমাণিত হল, নিজের কুরবানীর পশুতে মুসলিমদেরকে সর্বাবস্থায় সওয়াবে শরীক করা জায়েয। যদিওবা সেটা একটি বকরী হয়ে থাকে।

হাদীসের তাহক্বীক্ব (যঈফ) : ‘প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী’

লেখকের বক্তব্য-০২ঃ
(খ) বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনম-লীকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (স) এরশাদ করেনঃ
يا أيها الناسُ إنَّ على كلِّ أهلِ بيتٍ في كلِّ عامٍ أُضحيةٌ وعتيرةٌ
‘হে জনগণ! নিশ্চয়ই প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও আতীরাহ’। আবূ দাউদ বলেন, ‘আতীরাহ’ প্রদানের হুকুম পরে রহিত করা হয়।’
[তিরমিযী, আবূ দাউদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/১৪৭৮; মির‘আত হা/১৪৯২, ৫/১১৪-১৫ পৃ:। হাদীসটির সনদ ‘শক্তিশালী’ (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১০/৬ পৃ:); সনদ ‘হাসান’ আলবানী, সহীহ নাসাঈ (বৈরুত : ১৯৮৮) হা/৩৯৪০; সহীহ আবূদাউদ (বৈরুত : ১৯৮৯) হা/২৪২১; সহীহ তিরমিযী (বৈরুত : ১৯৮৮) হা/১২২৫; সহীহ ইবনু মাজাহ (বৈরুত : ১৯৮৯) হা/২৫৩৩। ইমাম তিরমিযী ও বাগাভী বলেন, চারটি সম্মানিত মাসের প্রথম ও পৃথক মাস হিসাবে রজব মাসের সম্মানে লোকেরা যে কুরবানী করতো, তাকে ‘আতীরাহ’ বা ‘রাজীবাহ’ বলা হ’ত (শারহুস সুন্নাহ, বৈরুত : ১৪০৩/১৯৮৩) হা/১২২৮-এর ব্যাখ্যা, ৪/৩৫০ পৃ:; মির‘আত ৫/১১১ পৃ:)। শাওকানী বলেন, প্রতি বছর রজব মাসের প্রথম দশকে যে কুরবানী করা হ’ত, তাকে ‘রাজীবাহ’ বা ‘আতীরাহ’ বলা হয়। ইমাম নবভী বলে, আতীরাহর এই ব্যাখ্যায় সকল বিদ্বান একমত হয়েছেন’ (নায়ল ৬/২৭০ পৃ:)।]

বিশ্লেষণ-২ঃ
হাদীসটি যঈফ। কেননা এর সনদে আবূ রামলাহ নামে একজন বর্ণনাকারী আছেন, তিনি মাজহুল। শায়েখ আলবানী (রহ) তাঁর তাহক্বীক্বকৃত সূনান চারটিতে হাদীসটিকে হাসান/সহীহ বললেও, নিজেরই তাহক্বীক্বকৃত মিশকাতে (১/১৪৭৮ নং) যঈফ হওয়াটাই হক্ব বলেছেন (১/৪৬৫-৬৫, টিকা দ্র;)।
হাদীসটির অপর একটি দিক হল, নবী (স) এর উক্ত বক্তব্যটি আরাফার ময়দানের (আবূ দাউদ, আলোচ্য অনুচ্ছেদ)। লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী বিদায় হজ্জের কিন্তু বিদায় হজ্জের পরে নবী (স) আর কোন কুরবানী করেন নি এবং সেটা বিধি-বিধান চূড়ান্ত হওয়ার শেষাবস্থা। অথচ হাদীসটি থেকে প্রমাণিত হয়, ক) আতীরাহ বিদায় হজ্জের সময় কেবল জায়েযই ছিল না, খ) বরং ঐ মুহূর্তে নবী (স) উম্মাতকে প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের জন্য কুরবানী ও আতীরাহ করার নির্দেশটি দেন !!?? আরো লক্ষণীয় যে, গ) নবী (স) বিদায় হজ্জের পর আর কোন আতীরাহ (রজব মাসের কুরবানী) ও ‘ঈদুল আযহা পান নি। যা হাদীসটির মতনগত ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করে। কেননা আতীরাহ নিষিদ্ধ হওয়ার স্বতন্ত্র হাদীস রয়েছে।
হাফেয ইবনে হাজারের (রহ) বক্তব্যের যে অংশ টীকাতে লেখা হয়েছে তা হলঃ
فيه أخرجه أحمد والاربعة بسند قوي ولا حجة
“হাদীসটি আহমাদ ও চারজন (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, নাসায়ী) শক্তিশালী সনদে বর্ণনা করেছেন, তবে এতে (ওয়াজিব হওয়ার) দলিল নেই (ফতহুল বারী ১০/৪)।
অন্যত্র হাদীসটি বর্ণনার পর ‘ফতহুল বারীতে’ ইবনে হাজারের (রহ) মন্তব্য হলঃ
فقد ضعفه الْخطابِي لكن حسنة الترمذي
“অবশ্য খাত্তাবী হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন, কিন্তু তিরমিযী হাসান বলেছেন (ফতহুল বারী ৯/৫৯৮)।
ইমাম তিরমিযীর (রহ) বক্তব্য এতটুকুই নয়। তিনি (রহ) লিখেছেনঃ
هذا حديث حسن غريب ولا نعرف هذا الحديث إلا من هذا الوجه من حديث ابن عون
“হাদীসটি হাসান-গরীব, আমরা এই হাদীস সম্পর্কে অবগত নই, কেবল আবান থেকে বর্ণিত এই (সনদটির) হাদীস ছাড়া।” (তিরমিযী – কুরবানী অধ্যায়, আলোচ্য হাদীস দ্র:)
এ কারণে মিশকাতে হাদীসটি বর্ণনার পর বলা হয়েছেঃ
وقال الترمذى هذا حديث غريب ضعيف الإسناد
“তিরমিযী বলেছেনঃ হাদীসটি সনদগত দিক থেকে গরীব ও যঈফ” [মিশকাত (এমদা) ৩/১৩৯৩ নং]
মিশকাতের সঙ্কলক যঈফ বলাতে শায়েখ আলবানী (রহ) লিখেছেনঃ
ليس في الترمذى هذا التضعيف ، بل فيه خلاف ، فانه قال : (ا/ ٢٨٦) : حديث حسن غريب ـ ولعل المؤلف لم يقع في نسخته من (السنن) حسن ، بل غريب فقط ، ثم روى ذلك بالْمعنى مفسرأ
“মূলতঃ তিরমিযী হাদীসটি যঈফ সাব্যস্ত করেন নি। বরং তিনি বলেছেন (১/২৮৬) হাদীসটি হাসান গরীব। সম্ভবত সঙ্কলকের (নিকট সংরক্ষিত) সূনানে তিরমিযীর সংস্করণটিতে হাসান শব্দটি ছিল না, বরং গরীব কথাটিতেই শেষ ছিল। অতঃপর লেখক ব্যাখ্যামূলক অর্থে উক্ত মন্তব্যটি করেছেন।”
[আলবানীর তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ১/৪৬৫ পৃ; অতঃপর শায়েখ আমাদের নিম্নোক্ত ‘আওনুল মা‘বুদ’ ও ‘তুহফাতুল আহওয়াযীর’ ব্যাখ্যার প্রায় অনুরূপ ব্যাখ্যা দিয়ে হাদীসটি যঈফ হওয়াটাই হক্ব বলেছেন (তাহ: মিশকাত ১/৪৬৫-৬৬ পৃ:)]
অর্থাৎ ইবনে হাজারের (রহ) পূর্বোক্ত বক্তব্য চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নয়। এ ব্যাপারে স্পষ্ট সত্য প্রকাশ পেয়েছে আবূ দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আওনুল মা‘বুদে’। এই গ্রন্থে হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম মুনযিরীর (রহ) বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ
قال الخطابي: هذا الْحديث ضعيف الْمخرج وأبو رملة مَجهول وقال أبو بكر الْمعافري حديث مُخنف بن سليم ضعيف لا يَحتج به
“ইমাম খাত্তাবী (রহ) বলেছেনঃ হাদীসটি যঈফ, যা আবূ রামলাহ মাজহুল বর্ণনাকারী থেকে উদ্ধৃত। আর আবূ বকর আল-মা‘আফিরী (রহ) বলেছেনঃ মুখান্নাফ বিন সালীমের হাদীস যঈফ, তার থেকে দলিল নেয়া হয় না।” (আওনুল মা‘বুদ – আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা দ্র:)
তিরমিযীর বিশ্ববিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ তে ইবনে হাজারের (রহ) পূর্বোক্ত উপস্থাপনার পর বলা হয়েছেঃ
قلت: قال الزيلعي في نصب الراية: قال عبد الحق إسناده ضعيف. قال ابن القطان: وعلته الجهل بحال أبي رملة واسمه عامر فإنه لا يعرف إلا بهذا عن ابن عون انتهى. وقال الحافظ في التقريب: عامر أبو رملة شيخ لابن عون لا يعرف من الثالثة
“আমি (‘আব্দুর রহমান মুবারকপুরী) বলছিঃ যায়লাঈ ‘নাসবুর রায়াতে’ বলেছেন, “আব্দুল হক্ব সনদটিকে যঈফ বলেছেন। ইবনুল ক্বত্তান বলেছেনঃ এখানে আবূ রামলাহ’র মাজহুল হাল হওয়ার ত্রুটি আছে, তার নাম ‘আমির। কেননা তাকে চেনা যায় না, কেবল ইবনে আওন থেকে এই বর্ণনা ছাড়া” (বক্তব্য শেষ)। হাফেয ইবনে হাজার (রহ) ‘তাক্বরীবে’ বলেছেন ‘আমির আবূ রামলাহ, যিনি ইবনে ‘আওনের শায়েখ – তিনটি ক্ষেত্রে তাকে চেনা যায় না।” (তুহফাতুল আহওয়াযী, আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা দ্র:)
অর্থাৎ হাদীসটির সনদের দু’জন বর্ণনাকারীর প্রতি আপত্তি আছে। এজন্যে হাদীসটি হাসান নয়, আর সহীহ বা শক্তিশালী হওয়ারতো কোন সুযোগই নেই। অথচ হাদীসটি দ্বারা ‘ঈদুল আযহাতে কুরবানীর একমাত্র অনুমোদিত পদ্ধতির দাবী করা হচ্ছে যে, “পরিবারের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ একটি মাত্র পশু হতে হবে।” যা আলোচ্য বইটির লেখকের প্রধান দলিল ও দাবী। আমরা কিছু পরে জানব, হজ্জের হাদীতে শরীক হওয়ার ন্যায় (‘ঈদুল) আযহাতে উট ও গরুতে শরীক হওয়ার বর্ণনা আছে। এ কারণে ‘পরিবারের পক্ষ থেকে একটি কুরবানী বৈধ’ হলেও, সেটা একমাত্র অনুমোদিত পদ্ধতি নয়। এজন্যে মতন বা মূলবক্তব্যের দিক থেকেও হাদীসটির দাবী ত্রুটিযুক্ত। সর্বোপরি হাদীসটি দ্বারা মু’মিন পরিবারমাত্রই একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কুরবানী ওয়াজিব কিংবা বিধান হওয়া সুনির্দিষ্টভাবে প্রযোজ্য হয় না।
পরবর্তী পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
 লেখকঃ কামাল আহমাদ 
                                                     কপি করলাম-- 
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না।

Post a Comment

0 Comments