👉📖পরিভাষায় সালাফ’ কারা? 🔰
পূর্বে উক্ত হয়েছে, সলফের অর্থ হল, সেই ব্যক্তি, যে বয়স ও মর্যাদায় আপনার অগ্রগামী হয়েছে। এক্ষণে আমরা এই শব্দের পারিভাষিক অর্থ পেশ করব। মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে বলেছেন,
وَالسَّابِقُونَ
الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ
رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا
الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“আর যেসব মুহাজির ও আনসার (ঈমান আনয়নে) অগ্রবর্তী এবং প্রথম, আর যেসব লোক সরল অন্তরে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য এমন। উদ্যানসমূহ প্রস্তুত করে রেখেছেন, যার তলদেশে নদীমালা প্রবাহিত; যার মধ্যে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে, এ হল বিরাট সফলতা।” (তাওবাহঃ ১০০)।
সহীহায়নে)[১] ইবনে মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
خَيْرُ
النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ
يَجِيءُ أَقْوَامٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِينَهُ، وَيَمِينُهُ شَهَادَتَهُ
“সর্বোত্তম যুগ হল আমার (সাহাবীদের) শতাব্দী। অতঃপর তৎপরবর্তী (তাবেয়ীদের) শতাব্দী। অতঃপর তৎপরবর্তী (তাবেতাবেয়ীনদের) শতাব্দী। অতঃপর এমন সম্প্রদায়ের আগমন ঘটবে, যাদের একজনের কসমের আগে সাক্ষি হবে, আবার সাক্ষির আগে কসম। হবে।” (শব্দাবলী বুখারীর)
সহীহ মুসলিম (২৫৩৬নং)এ আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, কোন লোকেরা সর্বশ্রেষ্ঠ? উত্তরে তিনি বললেন, “আমি যে শতাব্দীতে আছি (তার লোকেরা)। অতঃপর দ্বিতীয়, অতঃপর তৃতীয়।”
এ বিষয়ে একাধিক হাদীস রয়েছে। বলা বাহুল্য, সূরা তাওবার উল্লিখিত আয়াত এবং উপর্যুক্ত হাদীস সাহাবাগণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পর তারাই ছিলেন উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আর এ কথায় কোন সন্দেহ ও সংশয় নেই যে, তারাই হলেন মর্যাদা, ইলম ও ঈমানে আমাদের অগ্রগামী ‘সলফ।
👉📖* কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন🔰
আর তা হল এই যে, ইবনে মাসউদ, আয়েশা ও অন্যান্যের হাদীসে যে সময়কালের নির্দিষ্টীকরণ এসেছে, তা কি সলফের পারিভাষিক অর্থ নির্ধারণে যথেষ্ট? 📖
অন্য কথায়, প্রত্যেক সেই ব্যক্তি, যিনি উক্ত বকতময় সময়কালে জীবনধারণ করেছেন, তিনিই কি অনুসরণীয় সলফে সালেহ গণ্য হবেন?
🎤* উত্তরঃ🕋✅
মোটেই না। যেহেতু সময়ের অগ্রগামিতা সলফ নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। সুতরাং এর সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আরোপ আবশ্যক।
আর তা হল এই যে, তার (আকীদাহ ও আমল) কিতাব, সুন্নাহ ও সাহাবাগণের বুঝ অনুযায়ী হবে।
বলা বাহুল্য, আমরা দেখতে পাই, সুন্নাহর ইমামগণ উক্ত পরিভাষায় শর্তারোপ করে বলেন, সলফে সালেহ। এর মাধ্যমে সলফে ত্বালেহ (মন্দ) মানুষ বের হয়ে যায়, যারা সমসাময়িককালে জীবনধারণ করেছে, কিন্তু সাহাবাগণের বুঝ, কর্মপদ্ধতি ও মতাদর্শের অনুসারী ছিল না।
কথায় আছে, বাস্তব উত্তম সাক্ষী। কাদারিয়্যাহ ফির্কা সাহাবাগণের একটি জামাআত থাকাকালে প্রকাশ লাভ করেছে। এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) এর হাদীস ও তার উক্ত ফির্কা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা সুপ্রসিদ্ধ। আর তা সহীহ মুসলিমের (ভূমিকার পর) প্রথম হাদীস।
তদনুরূপ বিদ্রোহী খাওয়ারিজ ফির্কা আলী ও অন্যান্য সাহাবাগণ (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করেছে। উক্ত ফির্কা আবির্ভূত হয়েছিল সাহাবাগণের সামনে। যাদের সাথে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) প্রসিদ্ধ মুনাযারা (তকালোচনা) করেছিলেন, যা হাকেম তার মুস্তাদরাক গ্রন্থে এবং অন্যান্যগণ[২] সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। খাওয়ারিজরা যে ভ্রষ্টতায় ছিল, তার প্রমাণ দিয়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাদেরকে বলেছিলেন, “তোমরা লক্ষ্য কর, তোমাদের দলে তাঁদের। (অর্থাৎ সাহাবাদের) কোন একজনও নেই। আর সেটাই ছিল তাদের ভ্রষ্টতা বর্ণনার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ।
🕋✅বুঝা গেল, সময়ের অগ্রগামিতা কোন মানুষের ‘সলফে সালেহ’ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় (১/১৬)তে আলী বিন শাক্বীক (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন মুবারককে লোকেদের সামনে বলতে শুনেছি, আমর বিন সাবেতের হাদীস বর্জন কর। কারণ সে সলফকে গালি দিত।
আমি বলি, এখানে ‘সলফ’ বলতে উদ্দেশ্য কেবল সাহাবাগণ, অন্য কেউ নন।
পরিভাষায় সালাফিয়াহর অর্থ একাধিক উলামা বর্ণনা করেছেন। যেমন আহলুস সুন্নাহর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহু ওয়া রায্বিয়া আনহু) তার প্রসিদ্ধ পুস্তিকা উসূলুস সুন্নাহ’তে বলেছেন, ‘আমাদের নিকট সুন্নাহর মৌলিক নীতি হল, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবাগণ যে বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং তাদের অনুগমন করা।
আল্লামাহ সাফারীনী (রাহিমাহুল্লাহ) লাওয়ামিউল আনওয়ার’ (১/২০)এ বলেছেন, 'সলফদের মযহাব বলতে উদ্দেশ্য হল, যে আদর্শের উপর সাহাবায়ে কিরাম , নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারী প্রধান প্রধান তাবেঈনগণ, তাদের অনুসারী তাবে তাবেঈনগণ, দ্বীনের সেই ইমামগণ, যাদের ইমাম হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষি দেওয়া হয়েছে, দ্বীনে তাদের বিশাল মর্যাদা বিদিত হয়েছে এবং তাঁদের বাণীকে সলফ থেকে খলকগণের বর্ণনা-সূত্রে মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে।
তারা নয়, যাদেরকে বিদআতী আখ্যায়িত করা হয়েছে অথবা যারা অসন্তোষজনক খেতাব নিয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছে। যেমন খাওয়ারিজ, রাওয়াফিয, ক্বাদারিয়্যাহ, মুরজিআহ, জাবারিয়্যাহ, জাহমিয়্যাহ, মুতাযিলাহ, কারামিয়্যাহ প্রভৃতি।
আমাদের (উস্তায) শায়খ আল্লামা মুহাম্মাদ আমান (রাহিমাহুল্লাহু ওয়া গাফারা লাহ) তার বিশাল গ্রন্থ ‘আস-স্বিফাতুল ইলাহিয়্যাহ ফী স্বাওইল কিতাবি অস্-সুন্নাহ’ (৫৭পৃঃ)তে বলেছেন, 'যখন সালাফ শব্দ বলা হয়, তখন পরিভাষায় আমাদের উদ্দেশ্য হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবাগণ, যারা তার যুগে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর নিকট থেকে এই দ্বীনকে তার মুখ্য ও গৌণ সকল বিষয়ে তরতাজা রূপে সরাসরি গ্রহণ করেছেন। যেমন এই পরিভাষায় প্রবিষ্ট হবেন তাবেঈনগণ, যারা দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তাদের ইলমের উত্তরসূরি হয়েছেন। যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষ্য ও প্রশংসার অন্তর্ভুক্ত, যাতে তিনি তাদেরকে শ্রেষ্ঠ মানব’ বলে অভিহিত করেছেন। (এরপর লেখক উপযুক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।) যেমন পরিভাষায় শামিল তাবে তাবেঈনগণও।
🕋✅
‘সালাফ’ একটি পারিভাষাগত শব্দ। আর এই পরিভাষা তখন প্রকাশ ও প্রসিদ্ধি লাভ করল, যখন দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহে কালামিয়্যাহ ফির্কাগুলির মাঝে মতভেদ ও কলহ প্রকাশ ও চলমান হল এবং সকলেই সালাফের প্রতি সম্পর্ক জোড়ার প্রচেষ্টা চালাতে লাগল। (সবাই নিজেকে সালাফী বলে দাবী করতে লাগল।) প্রচার করতে লাগল যে, যে মতাদর্শে সে বিশ্বাসী আছে, সেটাই হল সেই মতাদর্শ, যার উপর সাহাবাগণ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
সুতরাং এই পরিস্থিতিতে এমন কিছু মৌলনীতি, মূলসূত্র বা নিয়মকায়েদা প্রকাশ পাওয়া প্রয়োজন, যার চিহ্ন হবে সুস্পষ্ট এবং সালাফী অভিমুখে সুদৃঢ়। যাতে যে সকল ব্যক্তি তাদের অনুগমন করতে চায় এবং তাদের পদ্ধতি অনুসারে পথ চলতে চায়, তাদের নিকট বিষয়টি তালগোল পেকে না যায়।
অন্যস্থলে তিনি বলেছেন, বিগত আলোচনায় স্পষ্ট হল যে, সালাফিয়াহর ব্যবহারিক অর্থ একটি পরিভাষায় পরিণত হয়েছে, যা সেই তরীকাকে বলা হয়, যা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের অগ্রণী দল (সাহাবা)দের এবং তাঁদের, যারা ইলম অর্জনে, তার বোঝার ক্ষেত্রে, তার প্রতি দাওয়াতী প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাদের অনুগমন করেন। সুতরাং তার অর্থ কোন নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটা বোঝা আবশ্যক যে, তা হল মানব-জীবন চলা-অবধি চলমান অর্থ। আর এটাও বোঝা আবশ্যক যে, ফিকাহ নাজিয়াহ’ (পরকালে পরিত্রাণ লাভকারী দল) কেবল হাদীস ও সুন্নাহ উলামাদের মাঝে সীমাবদ্ধ এবং তারাই হলেন এই মানহাজ (মতাদর্শ)এর অধিকারী। যে ফিকাহ কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে, যা নবী -এর হাদীস থেকে উপলব্ধি করা যায়। তিনি বলেছেন,
ولا
تزال طائفة من أمتي منصورين على الحق لا يضرهم من خذلهم حتى يأتي أمر الله
🕋✅
“আমার উম্মতের মধ্যে এক দল চিরকাল হক (সত্যের উপর সাহায্যপ্রাপ্ত (বিজয়ী) থাকবে, আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্বমুহূর্ত) আসা পর্যন্ত, যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।”
আমি (লেখক) বলি, (শায়খ রাহিমাহুল্লাহ) যে হাদীস উল্লেখ করেছেন, তা বুখারী-মুসলিমে মুআবিয়া (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত।
বলা বাহুল্য, বিগত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, সালাফের পারিভাষিক অর্থ হল, সাহাবা ও তাবেঈনগণ এবং তারাও, যারা কিয়ামত পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুগমন করবেন, তাঁদের তরীকায় চলমান থাকবেন এবং তাদের পদাঙ্কানুসরণ করবেন।
0 Comments