Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

প্রশ্ন: সফর অবস্থায় কুরবানী করার বিধান কি? ১৪ তম পর্ব

 

প্রশ্ন: সফর অবস্থায় কুরবানী করার বিধান কি?

কোন হাজী হজ্জে গেলে তার উপর কি নিজ বাসস্থানেও কুরবানী করা ওয়াজিব হবে?

▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬

উত্তর: কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং বিশেষ ধরনের ইবাদত। অধিক বিশুদ্ধ মতে কুরবানী করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ।

যা ‘সুন্নাতে ইব্রাহীমী’ হিসাবে পরিচিত। কোন ব্যক্তির সামর্থ্য থাকলে মুক্বিমের ন্যায় সফরেও কুরবানী করতে পারে।

সফরে কুরবানীকে হালকা করণার্থে একটি গরুতে সাতজনে কুরবানী করা যায়। মুসাফির সফরে থাকাকালীন কুরবানী দেয়ার মত অর্থ থাকলে সে কুরবানীর সুন্নাত পালনের চেষ্টা করবে।

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধির সফরে ছিলাম।

(এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হলে) একটি গরুতে সাতজন ও একটি উটে সাতজন শরীক হয়ে কুরবানী করি।’ (সহীহ মুসলিম, হা/১৩১৮; মিশকাত, হা/২৬৩৬)।

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস(রাঃ) বলেন,(ক) ‘আমরা রাসূলুল্লাহ()-এর সাথে এক সফরে সাথী ছিলাম।

এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাত জনে একটি গরু ও দশ জনে একটি উটে শরীক হলাম।’(তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনু মাজাহ,মিশকাত,হা/১৪৬৯, সনদ সহীহ)। সম্ভবতঃ তাঁরা কোন শহরে অবস্থান করছিলেন, যেখানে ঈদুল আযহা উপস্থিত হয় (মিরক্বাত)।

ইতিপূর্বে ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সফরেও আমরা রাসূল ()-এর সাথে একইভাবে প্রতি সাত জনে একটি উট ও গরু কুরবানী করি।' (সহীহ মুসলিম হা/১৩১৮)

 সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়। যাতে গরু বা উটের ন্যায় বড় পশু যবেহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বন্টন সহজ হয়।

জমহূর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদ্ঈর ন্যায় কুরবানীতেও শরীক হওয়া চলবে।(মির‘আত ২/৩৫৫ পৃ.; ঐ, ৫/৮৪ পৃষ্ঠা)

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল () হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এর অধিক) দাঁড়ানো অবস্থায় ‘নহর’ করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দু’টি সুন্দর শিংওয়ালা ‘খাসি’ কুরবানী করেছেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ () তাঁর সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি গরু কুরবানী করেন। (বুখারী মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ, ১/২৩১ পৃ. ; আলবানী-সহীহ আবু দাঊদ হা/১৫৩৯)

উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, সফরে থাকাবস্থাতেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাথীগণ সাতজন শরীক হয়ে কুরবানী করেছেন, কিন্তু তা বর্জন করেননি।

ইমাম ইবনু হাযম(মৃ. ৪৫৬ হি.) বলেন, কুরবানীর ব্যাপারে মুক্বীম ও মুসাফিরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীসের বিপরীতে যদি কেউ আমল করে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।

কারণ কুরবানী করা সুন্নাত, আর এ সুন্নাত থেকে বিরত থাকা বৈধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বিরত থাকার হাদীস না পাওয়া যাবে।

(ইমাম আলী ইবনে আহমাদ ইবনে হাযম, আল-মুহাল্লা মুনীরিয়্যাহ (মিসরী ছাপা, ১৩৪৯ হি.), ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৫)

ইমাম নাযীর হুসাইন দেহলভী (মৃ. ১৯০২ খ্রি.) বলেন, কুরবানী দেয়া ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া ব্যক্তির সাথে, মুক্বীম হওয়ার এবং মুসাফির না হওয়ার শর্তের ব্যাপারে হাদীসে কোন দলীল পাওয়া যায় না।

বরং মুসাফিরের কুরবানী করার ব্যপারে হাদীসে ফিক্বহের বিপরীতে দলীল পাওয়া যায়।

যেমন; ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হি.) মুসাফিরের কুরবানী করার ব্যাপারে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এবং ঐ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি হাদীস ও উল্লেখ করেছেন যে,

 রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা সফরে কুরবানী করেছিলেন। (ইমাম সৈয়দ নাযীর হুসাইন দেহলভী, ফাতাওয়া নাবীবিয়্যাহ (দিল্লী ছাপা, তাবি), ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫৩)

উল্লেখ্য যে, চার মাযহাব মধ্যে শুধুমাত্র হানাফী ফিক্বহের ফাৎওয়া হলো- মুসাফিরের উপর কুরবানী নেই এবং যার উপর যাকাত ফরয নয়, তার উপরেও কুরবানী নেই।

 প্রমাণ স্বরূপ ‘আল-হিদায়াহ’ গ্রন্থে হাদীস পেশ করা হয়েছে যে, আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মুসাফির অবস্থায় কুরবানী করেননি।

আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে যে, ফক্বীর ও মুসাফিরের উপর কুরবানী নেই।(আল-হিদায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৪৫)।

কিন্তু তাদের উক্ত দাবী সঠিক নয়।

কারণ, কুরবানী করার জন্য যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদ থাকা যেমন বাধ্যতামূলক নয়, তেমনি এটি যাকাত ফরয হওয়ার সাথে সম্পর্কিত নয়। কুরবানীর বিষয়টি সামর্থ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। যার সামর্থ্য আছে সেই কুরবানী করবে।

🔹কোন হাজী হজ্জে গেলে তার উপর কি নিজ বাসস্থানেও কুরবানী করা ওয়াজিব হবে?

উত্তর: মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তামাত্তু ও কিরান হজ আদায়কারীরা যে উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি পশু বাধ্যতামূলকভাবে জবেহ করে থাকেন তাকে হাদী বলা হয়।

 অনেকে বলে থাকেন এটা হজের কুরবানি, কিন্তু আসলে হজের ক্ষেত্রে এর নাম হলো হাদী। কুরবানি ও হাদী উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কুরবানীর উপলক্ষ্য হলো ঈদ, হাদীর উপলক্ষ্য হজ আর দমের উপলক্ষ্য হলো কাফফারা আদায়।

কুরবানী পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় করা যায়। হাদী শুধুমাত্র হারাম এলাকা তথা মক্কা, মিনা ও মুযদালিফায় করা যাবে।

দম হারামের সীমানার ভিতর আদায় করতে হবে। সুতরাং যাঁরা হজে গিয়েছেন, তাঁরা যদি হজে তামাত্তু বা হজে কিরান করে থাকেন, তাহলে এই ব্যক্তিদের ওপর হাদি জবাই করা ওয়াজিব। তিনি হাদি জবাই করবেন।

এ ক্ষেত্রে তামাত্তু এবং কিরান হজ্বকারী ব্যক্তির পক্ষ থেকে বাড়িতে কোরবানি করার কোনো প্রয়োজন নেই, যেহেতু একই মৌসুমে তিনি আল্লাহর নামে জবাই করে দিয়েছেন।

সুতরাং তাঁর জন্য কোরবানি করা বাধ্যতামূলক নয়। এটাই বিশুদ্ধ বক্তব্য। যদি কেউ করতে চান সেটাও জায়েজ। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৫৪৯)

🔹কোন কারনবশতঃ হজ্জের কুরবানী দিতে না পারলে হাজী কি করবে?

_________________________________________

কোন কারনবশতঃ একজন হাজী হজ্জের কুরবানী দিতে না পারলে তিনি ১০টি সিয়াম রাখবে। ৩ টি হজ্জে, আরাফার দিনের পূর্বে রেখে নেবে এবং বাকী ৭ টি দেশে ফিরে রাখবে। আরাফার দিন রোযা রাখবে না। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ ৩৮ পৃঃ)।

হজ্জের মধ্যে ঐ তিনটি রোযা তাশরীকের দিনগুলোতে ১১, ১২, ১৩ তারিখেও রাখতে পারে। আর এটা ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখা নিষিদ্ধ আইনের ব্যতিক্রম।

তবে আরাফার দিনের পূর্বেই রোযা রেখে নেওয়া উত্তম; যদি তাঁর পূর্ব থেকেই জানা যায় যে, সে কুরবানী দিতে পারবে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/২৯৫-২৯৬)।

 তবে মক্কাবাসী হাজীদের জন্য ঐ কুরবানী নেই। মহান আল্লাহ বলেছেন, “অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে, তখন তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি হজ্জের প্রাক্কালে উমরাহ দ্বারা লাভবান হতে চায়, সে সহজলভ্য কুরবানী করবে।

কিন্তু যদি কেউ কুরবানী না পায় (বা দিতে অক্ষম হয়), তাহলে তাকে হজ্জের সময় তিন দিন এবং গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর সাত দিন---এই পূর্ণ দশ দিন রোযা পালন করতে হবে। এই নিয়ম সেই ব্যক্তির জন্য, যার পরিবার- পরিজন পবিত্র কা’বার নিকটে (মক্কায়)বাস করে না।” (সূরা বাকারাহ; ১৯৬, আব্দুল হামিদ ফাইজি আল মাদানি দ্বীনি প্রশ্নো উত্তর)

সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল;

একজন ব্যক্তি কীভাবে কুরবানী ও হজ্জকে একত্রিত করতে পারে এবং এটি কি নির্ধারিত?

তিনি উত্তর বলেন, হাজী কুরবানী দেয় না,বরং হাদী দেয়। তাই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের সময় কুরবানী দেননি, বরং হাদী দিয়েছেন।

 কিন্তু যদি আমরা ধরে নিই যে, সে নিজে হজ করছে এবং তার পরিবার তার মাতৃভূমিতে আছে। তাহলে সেক্ষেত্রে তার উচিত তার পরিবারকে পশু ক্রয় করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রেখে দেওয়া এবং পরবর্তীতে সেটি দিয়ে কুরবানী করা,তাহলে সে হাদী দেবে এবং তার পরিবার কুরবানী প্রদান করবে,কারণ কুরবানী মক্কা ছাড়া অন্য স্থানে নির্ধারিত।

অপরদিকে হাদী শুধুমাত্র মক্কায় নির্ধারিত। (ইমাম উসাইমীন আল-লিক্বাউশ শাহরী ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৬৬৪৪) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)

❛❛যিলহজ্জ ও কুরবানী সম্পর্কে ধারাবাহিক ২১ পর্বের ১৪ তম পর্ব পূর্বের ১৩ টি পর্ব কমেন্টে দেখুন

আপনাদের দ্বীনি ভাই, জুয়েল মাহমুদ সালাফি

Post a Comment

0 Comments