বিটির প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী কারাবন্দি থেকেই নির্দেশনা পৌঁছে দিচ্ছেন

বিটির প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী কারাবন্দি থেকেই নির্দেশনা পৌঁছে দিচ্ছেন


এবিটি জঙ্গিরা জামিনে: রানা- ফারাবী কোথায়?

প্রতি শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি মসজিদ ঘিরে আনসারুল্লাহ টিমের সদস্যরা জুমার খুতবা রেকর্ড করে থাকে। বৃহস্পতিবার ড. অভিজিৎ রায় খুনের পরদিন কোনো জুমার খুতবার রেকর্ড হয়নি ওই সব মসজিদে।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ভয়ংকর সাত জঙ্গি জামিনে রয়েছে। এবিটির প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী কারাবন্দি থেকেই নির্দেশনা পৌঁছে দিচ্ছেন। আর এ নির্দেশনা মূলত যার কাছে আসছে তিনি হলেন রেজওয়ানুল আজাদ রানা।
প্রাথমিকভাবে রানা ও ফারাবীকে কেন্দ্র করে তদন্ত কাজ এগুচ্ছে বলে জানা যায়। অনেক আগে থেকেই আত্মগোপনে আছেন রানা কিন্তু ফারাবী শফিউর রহমান ২৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে অনলাইনে আসছেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ধারণা করছে নিজের আইডিতে না আসলেও ভিন্ন ভিন্ন আইডিতে যোগাযোগের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ফারাবী।
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী ডা. রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। রাত ১০টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অভিজিৎ। বন্যা এখন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত বলে জানান চিকিৎসক। বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এ দম্পতি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন। অভিজিৎ ও তার স্ত্রী দু'জনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
এবিটি নিয়ে কাজ করা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অনুসন্ধান ও তদন্ত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, কিছু জঙ্গি জামিনের পর একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তারা আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান চলছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার পর। ওই হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা জড়িত ছিল। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হন নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ, মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক, এহসান রেজা ওরফে রুম্মান, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ ও নাফিস ইমতিয়াজ। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে ধর্মের অবমাননা করে ব্লগে লেখালেখির কারণে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত বড় ভাই রেদোয়ানুল আল আজাদ ওরফে রানার পরিকল্পনায় ও নেতৃত্বে তারা রাজীবকে হত্যা করেন বলে স্বীকার করেন।
ব্লগার রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীকে ২০১৩ সালের আগস্টে গ্রেফতার করে। তাকে বরগুনা থেকে ৩১ জন অনুসারীসহ গ্রেফতার করা হয়। তিনি প্রথম ২০০৪ সালে রাজধানীর হাজারীবাগে রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি) নামে একটি এনজিও’র অফিসের আড়ালে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করেন। ওই সময় জসীম উদ্দিনের কাছ থেকে তাদের পরবর্তী টার্গেটের অন্তত ৩০ জনের একটি তালিকা তখন উদ্ধার করে গোয়েন্দারা। ওই তালিকায় এক নম্বরে নাম ছিল অভিজিতের।
এদিকে জসীম উদ্দিন গ্রেফতার হওয়ার পর ফারাবি শফিউর রহমান আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দয়িত্ব নেন। ২০১৪ সালের মার্চে এই ফারাবী অনলাইনে বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান রকমারি ডটকমকে অভিজিৎ রায়ের বই না বিক্রি করার হুমকি দেয়। একই সঙ্গে তাদের ওয়েবসাইট থেকে অভিজিৎ রায়ের বই তুলে নেয়ার জন্য বলে। হুমকির মুখে প্রতিষ্ঠানটি ওই সময় তাদের ওয়েবসাইট থেকে অভিজিৎ রায়ের বই তুলে নিতে বাধ্য হয়। ফারাবী ফেসবুক পোস্টেও বেশ কয়েকদফা অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ফারাবী ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার থাবা বাবা ওরফে আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন। ওই ঘটনার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন। মূলত অনলাইন থেকে মুক্তমনার লেখকের তালিকা ও তথ্য দেওয়ার কাজ করতেন ফারাবী।
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ইয়েমেনে আল কায়দাবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয় এফবিআইয়ের তালিকাভুক্ত জঙ্গি মাইনুদ্দীন শরীফ, তেহজীব করিম ও রেজওয়ান শরীফ। পশ্চিমা গোয়েন্দারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পর তারা একই কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। গোয়েন্দারা জানান, তেহজীব করিমের ভাই রাজীব করিমকে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারের বিমান উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয়। রাজীব করিম জেএমবির শুরুর দিকে যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে গোয়েন্দা পুলিশ এবিটির যে কয়জনকে গ্রেফতার করেছিল রেজওয়ান শরীফ তাদের অন্যতম।
গোয়েন্দারা বলছেন, পাকিস্তানে পলাতক জঙ্গি ইজাজ হোসেন ও আত্মগোপনে থাকা রেজওয়ানুল আজাদ রানা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশনের দায়িত্বে রয়েছে। আর গ্রেফতারকৃত রেজওয়ান শরীফ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ইয়েমেনেও গ্রেফতার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের দায়ে কারাদণ্ড পাওয়া বাংলাদেশী যুবক কাজী রেজয়ানুল হক নাফিস এবং ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হয়ে ২০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত রাজীব শরীফ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। এ ছাড়া নাইমুল হাসান পাকিস্তানে পলাতক জঙ্গি ইজাজ হোসেনের ভাই। এদের চলাফেরা একই সূত্রে গাঁথা। তারা সবাই মুফতি জসিমের শিষ্য ছিল।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের যে সাতজন জামিনে রয়েছেন তাদের মধ্যে জুন্নুন সিকদার নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকলেও পরে তিনি দাওয়াতি কার্যক্রম প্রচারের উদ্দেশ্যে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে ভর্তি হন। রেজওয়ান শরীফ জসিম উদ্দিন রাহমানীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নাইম আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কম্পিউটারসংক্রান্ত টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে থাকেন। সাইফুল, জাহিদ ও আলী আজাদ জসিম উদ্দিনের ওয়েবসাইটে তার বক্তব্য ও ছবি আপলোড ইত্যাদি কাজ করে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসা ও ধানমণ্ডির একটি মসজিদে জুমার খুতবায় ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় ও লেখা পোস্ট করে এমন ব্লগারদের হত্যার ফতোয়া দিতেন। আর তাদের হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব মনে করে কিলিং মিশনে অংশ নিতেন আনসারুল্লাহর সদস্যরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, এবিটিতে কয়েকটি ভাগ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়েও তারা কাজ করে। এরা এবিটির প্রধান মুফতি জসিমের লেখা বই পড়ে ও তার বয়ান এবং খুতবা শুনে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের খুন করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এর আগে ব্লগার রাজীবকে যারা খুন করেছিল তারা ছিল সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
তারাও জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, জসিমের কাছ থেকেই তারা এসব ব্লগারকে হত্যায় উৎসাহ পান। রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৩ সালের মার্চ মাসে গ্রেফতার হন নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ। সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হন সাদমান ইয়াছির মাহমুদ। এরা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তাদের স্বীকারোক্তিতে রাজীব হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজওয়ানুল আজাদ রানার নাম আসে।
গোয়েন্দারা বলছেন, এবিটিতে খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে কাজ করে রানা। এই রানাকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। শারীরিকভাবে তাকে কোথাও পাওয়া না গেলেও গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত তদন্তে তার অবস্থানের সম্ভাব্য এলাকাগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, এবিটিতে খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে কাজ করে রেজওয়ানুল আজাদ রানা। এই রানাকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, রানা ২০১৩ সালের রাজীব খুনের পর আত্মগোপনে চলে যান পাকিস্তানে। সেখান থেকে আবার আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এবিটিতে রানা সবার বড় ভাই বলে পরিচিত।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে সাদমানকে গ্রেফতারের আগের মাসে গোয়েন্দারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের যে নয় সদস্যকে গ্রেফতার করে তাদের মধ্যে সাতজন জামিনে রয়েছে। এদের মধ্যে জুন্নুন সিকদার স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন বলে দাবি করা হয়। বাকিদের বিষয়ে খোঁজ-খবর শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।
এবিটি নিয়ে কাজ করা ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম দেশের রাজনীতিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কর্মকাণ্ড চালায়। তারা ইনটেল ও এক্সিকিউশন গ্রুপে কাজ করে। এদের স্লিপার সেল বা সুপ্ত সেল নামে নতুন একটি শাখার তথ্য পাওয়া গেছে। এ সেলটি বিভিন্ন এলাকাকেন্দ্রিক। তাদের নেতৃত্বেও রয়েছেন রানা।
এবিটি নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরীর, ইসলামিক স্টেটসহ অন্য উগ্রপন্থীদের জঙ্গিরা একই সূত্রে গাঁথা। এসব জঙ্গিই অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজীব, ইমাম মাহাদীর কথিত সেনাপতি লুৎফর রহমান, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, ও বুয়েটের ছাত্র দীপকে হত্যা করে। এবিটির গণমাধ্যম শাখার প্রধান মোরশেদ আলম ও অনুবাদক অর্ণবকে গ্রেফতারের পর তথ্য দেয় যে তারা শুধু ব্লগ ঘেঁটে ধর্মের প্রতি কটাক্ষকারীদের তালিকা করত।
এ তালিকা তারা পাঠাত অপারেশন টিমের কাছে। আর পাকিস্তান থেকে সব পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশে থাকা রানা পাকিস্তানের ইজাজের সঙ্গে পরামর্শ করে। হত্যাকাণ্ডের অপারেশনাল টিমে নবীর ওরফে নবীন, সায়েম ও আবদুল্লাহ নামেও তিনজন আছে।
জামিনে থাকা এক জঙ্গিকে অনুসরণ করা গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি মসজিদ ঘিরে আনসারুল্লাহ টিমের সদস্যরা জুমার খুতবা রেকর্ড করে থাকে। বৃহস্পতিবার ড. অভিজিৎ রায় খুনের পরদিন কোনো জুমার খুতবার রেকর্ড হয়নি ওই সব মসজিদে। আগামী শুক্রবার যাতে নিয়মিত খুতবা রেকর্ড হয় তা বহাল রাখতে বলা হয়। মূলত আনসারুল্লাহ জুমার খুতবা ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড করে পোস্ট করে থাকে। http://sahih-akida.simplesite.com/…/%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A…

এবিটি জঙ্গিরা জামিনে: রানা- ফারাবী কোথায়?