আল্লাহ্ যা জানেন ফেরেশতাগণও তা জানে না
"আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না।" -(সূরা বাকারাহ, আয়াত: ৩০)
ﺧﻠﻴﻔﺖ শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে পরস্পরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া। কোন কোন মুফাসসিরগণ বলেন যে, খলীফা শব্দ দ্বারা শুধুমাত্র হযরত আদম (আ:) কে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা বিবেচ্য বিষয়। তাফসীরে রাযী প্রভৃতি কিতাবের মধ্যে এই মতভেদ বর্ণনা রয়েছে। বাহ্যত: জানা যাচ্ছে যে, ভাবার্থ এটা নয়। এর প্রমাণতো ফেরেশতাগণের উক্তিই: "তারা ফাসাদ করবে ও রক্তারক্তি করবে।" এটা স্পষ্ট কথা যে, তারা এটা হযরত আদম (আ:) এর সন্তানদের সম্পর্কে বলেছিলেন- খাস করে তাঁর সম্পর্কে নয়।
এটা মনে রাখা দরকার যে, ফেরেশতাদের এই আয়াত প্রতিবাদমূলক ছিলো না বা তাঁরা যে এটা বনী আদমের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে বলেছিলেন তাও নয়। ফেরেশতাদের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ঘোষণা করা হয়েছে: "যে কথার অনুমতি নেই, তাতে তাঁরা মুখ খুলে না।" বরং সঠিক ভাবার্থ এই যে তাদে এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য ছিলো শুধুমাত্র এর হিকমত ও এর রহস্য প্রকাশ করাবার, যা তাদের বোধশক্তির উর্ধে ছিলো।
মহান আল্লাহ্ তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, তারা দুনিয়ার ঝগড়া-বিবাদ, কাটাকাটি, মারামারি ইত্যাদি করবে এই জ্ঞান তাঁর রয়েছে তথাপি তাদেরকে সৃষ্টি করার মধ্যে যে নিপুণতা ও দূরদর্শিতা রয়েছে তা একমাত্র তিনিই জানেন। তিনি জানেন যে, তাদের মধ্যে নবী-রাসূল; সত্যবাদী, শহীদ, আল্লাহর নৈকট্য লাভ কারী, আলেম খোদাভীরু প্রভৃতি মহা মানবদের জন্ম লাভ ঘটবে, যারা তাঁর নির্দেশাবলী যথারীতি মান্য করবে এবং তারা তাঁর বার্তাবাহকদের ডাকে সাড়া দিবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন যে, যখন হযরত আদম (আ:) এর সৃষ্টিকার্য আরম্ভ হয় তখন ফেরেশতাগণ বলেছিলেন "আমাদের অপেক্ষা বেশী মর্যাদা সম্পন্ন ও বিদ্বান মাখলুক সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব।" এর কারণে তাদের উপর আল্লাহর পরীক্ষা এসে যায় এবং কোন সৃষ্টি জীবই পরীক্ষা হতে নিস্তার পায়নি। যমীন ও আসমানের উপরেও পরীক্ষা এসেছিল এবং ওরা সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করেছিল।
ইমাম কুরতবী (রহ.) প্রভৃতি মনীষীগণ এই আয়াত হতে দলীল গ্রহণ করেছেন যে, খলীফা নির্ধারণ করা ওয়াজিব। তিনি মতবিরোধ মীমাংসা করবেন, ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দেবেন, অত্যাচারী হতে অত্যাচারিত ব্যক্তির প্রতিশোধ নিবেন, 'হুদুদ' কায়েম করবেন, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে জনগণকে বিরত রাখবেন ইত্যাদি বড় কাজগুলো যার সমাধান ইমাম ছাড়া হতে পারেনা। এসব কাজ ওয়াজিব এবং এগুলো ইমাম ছাড়া পুরো হতে পারে না, আর যা ছাড়া কোন ওয়াজিব পুরো হয় না ওটাও ওয়াজিব। সুতরাং খলীফা নির্ধারণ করা ওয়াজিব সাব্যস্ত হলো।
ইমাম শাফি'ই (রহ:) পরিষ্কার ভাষায় এর ফয়সালা করেছেন। এ বায়আত গ্রহণের সময় সাক্ষীদের উপস্থিতি ওয়াজিব কি না এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, এটা শর্ত। আবার কারও মতে শর্ত বটে, কিন্তু দু'জন সাক্ষীই যথেষ্ট।
ইমাম হওয়ার জন্য পুরুষ লোক হওয়া, আযাদ হওয়া, বালিগ হওয়া, বিবেক সম্পন্ন হওয়া, মুসলিম হওয়া, সুবিচারক হওয়া, ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হওয়া, চক্ষু বিশিষ্ট হওয়া, সুস্থ ও সঠিক অঙ্গ বিশিষ্ট হওয়া, সাধারণ অভিমত সম্পর্কে অবিজ্ঞ হওয়া এবং কুরায়েশী হওয়া ওয়াজিব।
ইমাম যদি ফাসিক হয়ে যায় তবে তাকে পদচ্যুত করা উচিত কি না এ বিষয়ে মতভেদ আছে। সঠিক মত এই যে, তাকে পদচ্যুত করা হবে না। কেননা হাদীসে আছে যে, রসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন, "যে পর্যন্ত না তোমরা এমন খোলাখুলি কুফরী লক্ষ্য করবে, যার কুফরী হওয়ার প্রকাশ্য দলীল আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের নিকট বিদ্যমান থাকে।
ভূ-পৃষ্টে একাধিক ইমাম একই সময়ে হতে পারে না। রসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: "যখন তোমাদের মধ্যে কোন কাজ সম্মিলিতভাবে হতে যাচ্ছে এমন সময় কেউ যদি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে তবে তাকে হত্যা করে যাও, সে যে কেউই হোক না কেন।" জমহুরের এটাই মাযহাব এবং বহু গুরুজন এর উপর ইজমা নকল করেছেন। যাদের মধ্যে ইমামুল হারামাইনও (রহ:) একজন।
ইমামুল হারামাইন তাঁর শিক্ষক আবু ইসহাক হতে বর্ণনা করেছেন যে, একই সময়ে দুই বা ততোধিক ইমাম নিযুক্ত করা তখনই জায়েজ হয়, যখন মুসলিমদের সম্রাজ্য খুবই প্রশস্ত হয় এবং চতুর্দিকে বিস্তার লাভ করে ও দু'জন ইমামের মধ্যে কয়েকটি দেশ ব্যবধান থাকে।
তথ্যসূত্র:
- তাফসীর ইবনে কাছীর
0 Comments