আহলেহাদীস জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৯,১০ম কিস্তি)
মূল (উর্দূ) : মাওলানা আবু যায়েদ যমীর
ভারতের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম।
অনুবাদ : তানযীলুর রহমান
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
ধারণা-৯ভারতের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম।
অনুবাদ : তানযীলুর রহমান
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
আহলেহাদীছরা জঙ্গীবাদের শিক্ষা দেয় :
ইসলামী দাওয়াহর উন্নতি-অগ্রগতি এবং বিশ্বপরিমন্ডলে ইসলাম গ্রহণের স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কোথাও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আবার কোথাও মিশনারী প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে ইসলামের উপর এ অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে যে, ইসলাম সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী ধর্ম। প্রত্যেকে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আজকে সারা পৃথিবীতে মিডিয়া, কতিপয় ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সস্তা রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে এই অন্যায় ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে।
মাযহাবী গোঁড়ামিতে নিমজ্জিত কোন কোন মূর্খ মুসলমানকে এই মিথ্যা প্রপাগান্ডার মাধ্যমে আখের গোছানোর জন্য এই তত্ত্বকে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে এটা একটা অত্যন্ত সস্তা ও কার্যকরী অস্ত্রে পরিণত হয়েছে যে, একটি এলাকায় কোন আহলেহাদীছ কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দাওয়াত দিতে শুরু করলে তাদের দাওয়াতকে প্রতিহত করার জন্য যেকোন উপায়ে তার উপর জঙ্গীবাদের অপবাদ দেওয়ার হীন চেষ্টা করা হয় এবং তাকে পুলিশের মাধ্যমে হয়রানি করা হয়। আর মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা হয়।
১. আহলেহাদীছদের নিকটে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা নিন্দনীয় কাজ : না ইসলাম সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার শিক্ষা দেয়, আর না তার প্রকৃত অনুসারী আহলেহাদীছরা তা শিক্ষা দেয়। ইসলামে ফাসাদ সৃষ্টি করা একটি নিষিদ্ধ কাজ। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِيْنَ ‘আর পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদের পসন্দ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৭)।
আহলেহাদীছদের নিকটে কেবল পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তার করা নিন্দনীয় কাজ তা নয়, বরং তা কামনা করা এবং সেজন্যে কোন উপায় অবলম্বন করাও এক জঘন্য কাজ।
২. অমুসলিমদের সাথেও উত্তম ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা উচিত :
ইসলামী শিক্ষার আলোকে আহলেহাদীছদের নিকটে মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সদাচরণ পাওয়ার হকদার, এমনকি সে অমুসলিম হ’লেও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَا يَنْهَاكُمُ اللهُ عَنِ الَّذِيْنَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّيْنِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ- ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন’ (মুমতাহিনাহ ৬০/৮)।
জানা গেল যে, কারো কেবল অমুসলিম হওয়া তাকে সদাচরণ ও ইনছাফ থেকে বঞ্চিত করে না।
৩. আহলেহাদীছদের নিকটে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হারাম :ইসলামে জীবনের (চাই তা মুসলিম বা অমুসলিম যারই হোক) গুরুত্ব কতটুকু তা বুঝার জন্য কুরআন মাজীদের একটি আয়াত পাঠ করাই যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا- ‘এ কারণেই আমরা বনু ইস্রাঈলের উপর বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি যে, যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদাহ ৫/৩২)।
কুরআন মাজীদের এ আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করার সমতুল্য এবং একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানবতার জীবন বাঁচানোর সমতুল্য।
৪. আহলেহাদীছদের নিকটে কাফেরের উপরেও যুলুম করা বৈধ নয় : জীবনের সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে এই মূলনীতি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, কাউকে হত্যা করা তো দূরের কথা কোন অমুসলিমকে কষ্ট দেওয়াও ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ। কোন ব্যক্তির মুসলমান হওয়া তাকে এ অধিকার দেয় না যে, সে কোন অমুসলিমের সাথে বাড়াবাড়ি করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اتَّقُوا دَعْوَةَ الْمَظْلُوْمِ وَإِنْ كَانَ كَافِراً فَإِنَّهُ لَيْسَ دُوْنَهَا حِجَابٌ ‘মাযলূম ব্যক্তির বদদো‘আ থেকে বেঁচে থাক, যদিও সে কাফের হয়। কারণ তার দো‘আ ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না’।[1]
এ হাদীছ থেকে একথা একেবারেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যুলুম যুলুমই, যার সাথেই তা করা হোক না কেন। একজন অমুসলিম ব্যক্তির সাথেও বাড়াবাড়ি করা একজন মুসলমানকে আল্লাহর শাস্তি লাভের হকদার বানিয়ে দেয়।
উক্ত আয়াত সমূহ ও হাদীছগুলিতে যে সত্য বিধৃত হয়েছে আহলেহাদীছগণ তারই প্রবক্তা ও প্রচারক। এখানে একথা লক্ষ্যণীয় যে, সব দ্বীন-ধর্মের অনুসারী এবং প্রত্যেক মাসলাক ও মাযহাবের অনুসারীদের মাঝে এমন ব্যক্তিরাও থাকে, যারা সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিনষ্ট করে দেয়। সেকারণ কোন এক শ্রেণীকে সমাজে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার দোষে অভিযুক্ত করা ন্যায় ও ইনছাফকে হত্যা করার নামান্তর। আবার দায়িত্বশীল নয় এমন ব্যক্তির কোন তৎপরতার কারণে কোন জামা‘আতের সবাইকে অপরাধী মনে করা ঠিক তেমনি, যেমন কোন এক ব্যক্তির ভুলের কারণে তার পুরো পরিবারকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদেরকে ফাঁসী দেওয়া। চাই তারা তার কর্মকান্ডের খন্ডন ও সংশোধনে লেগে থাকুক না কেন।
আর এটি যুলুম, বেইনছাফী ও অপবাদ আরোপ করার নিকৃষ্টতর রূপ। নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,إِنَّ أَعْظَمَ النَّاسِ فِرْيَةً لَرَجُلٌ هَاجَى رَجُلاً فَهَجَا الْقَبِيلَةَ بِأَسْرِهَا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে বড় মিথ্যা অপবাদ আরোপকারী সে ব্যক্তি, যে কারো কুৎসা রটনা করার সময় পুরো গোত্রের কুৎসা রটনা করে’।[2]
ভুল ধারণা-১০ :
আহলেহাদীছরা মুসলমানদের উপর কুফরীর ফৎওয়া দেয় :কাউকে কাফের আখ্যায়িত করা এবং তার উপর কুফরীর ফৎওয়া আরোপ করাকে ‘তাকফীর’ বলা হয়। ‘তাকফীর’ বা কাফির আখ্যায়িত করা একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও দায়িত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কোন কোন ক্ষেত্রে এটি যরূরী হয়ে যায়, কিন্তু এটা এত স্পর্শকাতর ব্যাপার যে, এতে ব্যক্তিগত অসন্তুষ্টি অথবা বেপরওয়া ও অজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রদত্ত ফায়ছালা স্বয়ং কাফের প্রতিপন্নকারী ব্যক্তিকে আল্লাহর নিকটে অপরাধী বানিয়ে দেয়।
১. আহলেহাদীছদের নিকটে তদন্ত ব্যতীত কারো উপরে কুফরীর ফৎওয়া দেওয়া হারাম : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,أَيُّمَا رَجُلٍ قَالَ لأَخِيهِ يَا كَافِرُ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে কাফের বলবে, তাদের দু’জনের কোন একজনের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে’।[3]
ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এভাবে এসেছে,إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ وَإِلاَّ رَجَعَتْ عَلَيْهِ ‘যদি সে ব্যক্তি সত্যিই এরকম হয় তাহ’লে ঠিক আছে, অন্যথা একথা যে কাফের বলবে তার উপর বর্তাবে’।[4]
ইবনু হিববানের বর্ণনায় এ শব্দগুলি এসেছে যে, إِنْ كَانَ كَافِرًا وَإِلاَّ كَفَرَ بِتَكْفِيْرِهِ- ‘যদি সে প্রকৃতই কাফের হয় তাহ’লে ঠিক আছে, অন্যথা কাফের প্রতিপন্নকারী ব্যক্তি কাফের বলার কারণে কুফরী করল’।[5]
জানা গেল যে, যদি ফায়ছালা সত্যের উপর ভিত্তিশীল হয় তাহ’লে কাফের প্রতিপন্নকারী ব্যক্তি দায়মুক্ত হ’ল, কিন্তু যদি ব্যাপারটা এর উল্টো হয় তাহ’লে অন্যকে কাফের আখ্যা দেওয়া তার নিজেরই কুফরীর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একজন মানুষ কোন সময় অজ্ঞতাবশত এমন কাজ করে বসে যদিও সেটা কুফরী বা শিরক হয়ে যায়, কিন্তু স্রেফ অজ্ঞতার কারণেই তা হয়। সে কুফর ও শিরককে হালাল মনে করে করে না; বরং কাজটি যে কুফরী বা শিরকী কাজ তা সে আদতে জানেই না। এমতাবস্থায় আলেমের দায়িত্ব হ’ল তাকে কাফের আখ্যায়িত করা নয়; বরং শিক্ষা দেওয়া। এর প্রমাণ স্বয়ং নবী করীম (ছাঃ)-এর একটি ঘটনা থেকে পাওয়া যায়।
২. কর্ম ও কর্তার উপর বিধান জারী করা পৃথক বিষয় : আবূ ওয়াকিদ আল-লায়ছী বলেন,خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى حُنَيْنٍ، وَنَحْنُ حَدِيثُو عَهْدٍ بِكُفْرٍ، وَكَانُوا أَسْلَمُوا يَوْمَ الْفَتْحِ، قَالَ: فَمَرَرْنَا بِشَجَرَةٍ، فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ، وَكَانَ لِلْكُفَّارِ سِدْرَةٌ يَعْكِفُونَ حَوْلَهَا، وَيُعَلِّقُونَ بِهَا أَسْلِحَتَهُمْ يَدْعُونَهَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ، فَلَمَّا قُلْنَا ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: اللهُ أَكْبَرُ وَقُلْتُمْ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ كَمَا قَالَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ لِمُوسَى: {اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ، قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ}، لَتَرْكَبُنَّ سُنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে হুনাইনের যুদ্ধে বের হ’লাম। তখন আমাদের কুফরীর যামানা খুব নিকটে ছিল। (রাবী বলেন যে,) তারা মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি বলেন, একটা গাছের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের জন্য একটি ‘যাতে আনওয়াত্ব’ দিন, যেমন ওদের ‘যাতে আনওয়াত্ব’ রয়েছে। মূলতঃ কাফেরদের একটা কুল গাছ ছিল, যার পাশে তারা একত্রিত হ’ত এবং (যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য এতে) তাদের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। তারা এটাকে ‘যাতে আনওয়াত্ব’ নামে অভিহিত করত। (ছাহাবী বলেন,) যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একথা বললাম, তখন তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার, ঐ সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন রয়েছে, এটিতো সেরূপ কথা যেরূপ মূসা (আঃ)-কে বনু ইসরাঈল বলেছিল,اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ، قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ ‘আমাদের জন্য একটি উপাস্য দিন, যেমন তাদের (মুশরিকদের) বহু উপাস্য রয়েছে। এর উত্তরে মূসা (আঃ) তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা মূর্খ সম্প্রদায়’। (এরপর তিনি বললেন,) তোমরা তোমাদের পূর্বের লোকদের রীতি-নীতি অবশ্যই অবলম্বন করবে।[6]
এই ঘটনায় চিন্তার বিষয় এই যে, নবী করীম (ছাঃ) তাদের যাতে আনওয়াত্বের আবেদনকে বণী ইসরাঈলের বাতিল মা‘বূদের আবেদনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলেছেন। কিন্তু যেহেতু সেসব লোক সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী ছিল এবং তারা অনেক বিষয় জানত না, সেজন্য তিনি তাদেরকে কাফের বলেননি; বরং তাদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করে খোলাছা করে দিয়েছেন যে, তাদের কাজটি কত মারাত্মক। এজন্য অজ্ঞতাবশত কুফরী বাক্য প্রয়োগকারী ব্যক্তিকে কাফের আখ্যায়িত করার পরিবর্তে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত।
৩. আহলেহাদীছদের নিকট অপরাধী সেই ব্যক্তি, যে হক প্রকাশিত হওয়ার পরেও হককে প্রত্যাখ্যান করে :
কোন কোন সময় তাহক্বীক্ব অথবা বুঝের ভুলের কারণে কোন আলেমের পক্ষ থেকেও এমন কোন কথা বা কাজ সংঘটিত হয়ে যায়, যেটাকে কুফরী আখ্যায়িত করা যায়, কিন্তু স্বয়ং সেই ব্যক্তির উপর এই বিধান জারী করা যায় না। বরং সেটাকে ভুল আখ্যায়িত করা হয়। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,وَأَمَّا “التَّكْفِيرُ”: فَالصَّوَابُ أَنَّهُ مَنِ اجْتَهَدَ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَصَدَ الْحَقَّ فَأَخْطَأَ: لَمْ يُكَفَّرْ؛ بَلْ يُغْفَرُ لَهُ خَطَؤُهُ. وَمَنْ تَبَيَّنَ لَهُ مَا جَاءَ بِهِ الرَّسُوْلُ فَشَاقَّ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَاتَّبَعَ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ: فَهُوَ كَافِرٌ. وَمَنْ اتَّبَعَ هَوَاهُ وَقَصَّرَ فِي طَلَبِ الْحَقِّ وَتَكَلَّمَ بِلَا عِلْمٍ: فَهُوَ عَاصٍ مُذْنِبٌ- ‘কাফের আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে সঠিক মত এই যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর কেউ হক অন্বেষণে ইজতিহাদ করতে গিয়ে ভুল-ত্রুটি করলে তাকে কাফের আখ্যায়িত করা যাবে না। বরং তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে যার নিকটে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক আনীত বিধান প্রকাশিত হয়ে যায় এবং হেদায়াত প্রকাশ হওয়ার পরেও সে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মুমিনদের পথের পরিবর্তে অন্য পথ অবলম্বন করে সে কাফের। আর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির পূজা করে, হক্ব অন্বেষণে অবহেলা করে এবং না জেনে কথা বলে সে অবাধ্য, পাপী’ (কাফের নয়)।[7]
বুঝা গেল যে, হক প্রকাশিত হওয়ার পর তা প্রত্যাখ্যান করা মানুষকে কাফেরে পরিণত করে। এমন ব্যক্তির কুফরী স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও বিশেষ করে যখন সে তার এ কুফরী চিন্তা-ধারাকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রচর করবে, তখন তাকে মুসলমান বলা দ্বীনী আবেগের দুর্বলতা এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় শিথিলতার ফল। এটা বুঝার জন্য মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর ব্যাপারটা একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এজন্য একথা মন-মগজে প্রোথিত করা দরকার যে, কোন মানুষের কাছে দলীল-প্রমাণ না পৌঁছার কারণে যদি হক গোপন থেকে যায় অথবা দলীলগুলো বুঝতে ভুল করার কারণে তার সিদ্ধান্ত কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহ’লে তার সামনে সত্য বিষয়টাকে তুলে ধরার পরিবর্তে তার উপর কুফরীর ফৎওয়া প্রয়োগ করা কল্যাণকামিতার দাবী এবং দূরদৃষ্টি, দয়া ও করুণাগুণের পরিপন্থী।
কাফের আখ্যায়িত করার ব্যাপারে আহলেহাদীছদের এটাই নীতি। কিন্তু অনেক মানুষ এসব বিষয় বুঝার জন্য আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা অথবা এ বিষয়ে বিদ্যমান বই-পুস্তকের দিকে প্রত্যাবর্তন করে না বিধায় তারা ভুল বুঝের মধ্যে নিপতিত হন। আসলে যখন কোন আমলের ব্যাপারে কিছু মানুষ আহলেহাদীছদের নিকট থেকে শুনে যে, এরূপ কাজ করা শিরক বা কুফরী তখন সে তৎক্ষণাৎ মনে করে যে, এসব কাজ যারা করে তাদের প্রত্যেককে আহলেহাদীছরা কাফের আখ্যায়িত করে। অথচ ব্যাপারটি তা নয়। আহলেহাদীছদের নিকটে অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত ব্যক্তির ব্যাপারটি জেনে বুঝে হককে প্রত্যাখ্যানকারী ব্যক্তি থেকে ভিন্ন।
শেষ কথা :
তাহক্বীক্ব বা প্রকৃত সত্য উদঘাটন, ন্যায়নীতি ও ইনছাফ জ্ঞান ও কীর্তির দিক থেকে সর্বোচ্চ গুণাবলী। যারা কোন দল বা গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত তারা যদি দলীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে নির্ভেজাল জ্ঞানগত চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে আহলেহাদীছদের নীতি ও আদর্শকে বুঝার চেষ্টা করেন তাহ’লে তাদের নিকটে সম্পূর্ণরূপে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ নীতি কিতাব ও সুন্নাহর দলীল সমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি চক্ষু বন্ধ করে এবং কর্ণকুহরে আঙ্গুল প্রবিষ্ট করে ফায়ছালা করার জন্য বসেন তাহ’লে এমন ব্যক্তির নিকট থেকে কি হক ও ইনছাফ আশা করা যায়?
মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে জ্ঞান ও ইনছাফের সাথে ফায়ছালা করার তেŠফীক দিন এবং আমাদের জ্ঞানে দূরদৃষ্টি এবং ঈমান ও আমলে অবিচলতা দান করুন! আর আমাদেরকে আমৃত্যু ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপরে অটল রাখুন।- আমীন!
[1]. আহমাদ হা/১২৫৭১, ছহীহুল জামে‘ হা/১১৯, হাসান।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৩৭৬১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৫৬৯, ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৬১০৪; মুসলিম হা/৯১।
[4]. মুসলিম হা/৯২।
[5]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/২৪৮; ছহীহ তারগীব হা/২৭৭৫।
[6]. আহমাদ হা/২১৯৪৭; তিরমিযী হা/২১৮০; যিলালুল জান্নাহ হা/৭৬।
[7]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১২/১৮০।
0 Comments