আহলেহাদীস জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৮ম কিস্তি)
মূল (উর্দূ) : মাওলানা আবু যায়েদ যমীর
ভারতের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম।
অনুবাদ : তানযীলুর রহমান
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
ভুল ধারণা-৮ :ভারতের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম।
অনুবাদ : তানযীলুর রহমান
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
আহলেহাদীছগণ উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত (ইজমায়ে উম্মত) মানেন না :
আহলেহাদীছদেরকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টায় একথাও বলা হয় যে, আহলেহাদীছরা উম্মতের ইজমা বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে মানেন না। কিন্তু সাধারণত এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্যকারীরা ইজমা-এর সংজ্ঞাই জানেন না। কখনো তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ইজমা আখ্যা দেন। আবার কখনো সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলিত আমলকে ইজমা বলেন। কোন কোন ইজমার দাবী তো শুধু দাবীই হয়ে থাকে। যখন বাস্তবে তাহক্বীক্ব করা হয়, তখন স্বয়ং সালাফ বা পূর্বসূরীদের মাঝে এ ব্যাপারে মতানৈক্য পাওয়া যায়। এমনকি খোদ ইজমার দাবীদারদের জামা‘আতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গও এ ধরনের ইজমার প্রতিবাদ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
১. আহলেহাদীছদের নিকটে প্রমাণিত ইজমা সত্য :
বাস্তবতা এই যে, কুরআন ও সুন্নাহ্র পরে খোদ ইজমাও আহলেহাদীছদের নিকট দলীল ও শারঈ প্রমাণ। কিন্তু শর্ত এই যে, সেই ইজমা যেন স্রেফ ধারণা বা নিছক দাবী না হয়। বরং তা যেন একটি প্রমাণিত ইজমা হয়।
আলেহাদীছদের নিকটে ইজমায়ে উম্মত স্বয়ং একটি দলীল। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের পথের বিরোধিতা করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا- ‘সুপথ স্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলে, আমরা তাকে ঐদিকেই ফিরিয়ে দেই যেদিকে সে যেতে চায় এবং তাকে আমরা জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। আর সেটা হ’ল নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল’ (নিসা ৪/১১৫)।
… রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ تَعَالَى لَا يَجْمَعُ أُمَّتِيْ عَلَى ضَلَالَةٍ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতকে ভ্রষ্টতার উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না’।[1] অর্থাৎ এমনটা হ’তে পারে না যে, সমগ্র উম্মত একটি ভুল কথাকে ঠিক মনে করতে শুরু করবে।[2]…
২. অনেক ইজমার দাবীর বাস্তবতা স্রেফ ধারণা হয়ে থাকে :
আহলেহাদীছগণ ইজমা মানেন। কিন্তু ইজমার সব দাবী কী বিনা দলীলে বা তাহক্বীক্ব ছাড়াই মেনে নেওয়া যায়? না, যায় না প্রকৃত ব্যাপার হ’ল এই যে, বহু লেখক ও বক্তা কোন কোন মাসআলায় ইজমার দাবী করে থাকেন। কিন্তু যখন প্রকৃতপক্ষে তাহক্বীক্ব করা হয় তখন সেসব মাসআলায় বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। সেকারণ ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন,مَنِ ادَّعَى الْاِجْمَاعَ فَهُوَ كَذِبٌ لَعَلَّ النَّاسَ قَد اخْتَلَفُوْا- ‘যে ইজমার দাবী করে সে মিথ্যুক। কারণ সম্ভবত মানুষেরা সে ব্যাপারে মতভেদ করেছে’।[3]
আর একথা জানা যে, একজন মুজতাহিদও যদি সেই ঐক্যমত থেকে পৃথক থাকেন তাহ’লে ইজমা কায়েম হয় না। মতভেদের সময় ফায়ছালা কম বা বেশী ভিত্তিতে নয়। বরং কুরআন ও সুন্নাহ্র অনুকূলে হওয়ার ভিত্তিতে করা হয়। এজন্য কোন বিতর্কিত মাসআলায় কোন কোন আলেমের স্বীয় অবস্থানকে প্রমাণ করার জন্য শুধু ইজমার দাবী করাটা মাকড়শার জালের চেয়ে বেশী মর্যাদা রাখে না।
৩. প্রবক্তার আধিক্য আহলেহাদীছদের নিকট দলীল নয় :
কোন কোন আলেম বিশেষ করে সাধারণ আলেম নিজের ধারণা অনুপাতে সংখ্যাধিক্যকে ইজমা মনে করে অন্যদেরকে নিজের মতে মানানোর জন্য যিদ করতে থাকেন। অথচ ইজমা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও হয় না। বরং স্রেফ আঞ্চলিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়ে থাকে।
বাস্তবতা এই যে, একজন মানুষ তার পসন্দনীয় বিষয়কে সাব্যস্ত করতে যখন উঠেপড়ে লাগে, তখন সে ভিত্তিহীন বিষয় সমূহকে সত্য এবং ধারণাকে দলীল আখ্যা দিতে শুরু করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।
বুঝা গেল যে, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা সর্বদা হকের উপরে থাকে’ এটি কোন কুরআনী নিয়ম নয়। বরং কুরআন তো স্বয়ং এমন লোকদের নিন্দা করছে যারা এ ধরনের মূলনীতিকে আপন করে নিয়েছে। এরূপ মূলনীতি মানুষের বিপথগামী হওয়ার নিশ্চিত কারণ হ’তে পারে। কেননা হকপন্থী কখনো বেশী আবার কখনো কম হয়ে থাকে। বরং সাধারণত হকের অনুসারীরা কমই হয়ে থাকে। ফুযায়ল বিন ইয়ায (রহঃ) বলেন, لَا تَسْتَوْحِشْ طُرُقَ الْهُدَى لِقِلَّةِ أَهْلِهَا، وَلَا تَغْتَرَّ بِكَثْرَةِ الْهَالِكِينَ- ‘তুমি হেদায়াতের রাস্তায় চলমান লোকের সংখ্যা নগণ্য দেখে হতাশাগ্রস্থ হবে না এবং ধ্বংসপ্রাপ্তদের সংখ্যাধিক্যতার ধোঁকায় পড়বে না’।[4] সেকারণ সংখ্যাধিক্যের অনুসরণ করা মানুষের জন্য বড় ধোঁকাও হ’তে পারে। কারণ ধ্বংসপ্রাপ্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ’তে পারে। একটি হাদীছ থেকে এ কথা আরো সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
৪. অধিকাংশ মানুষ ভুলের উপর থাকতে পারে :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,بَدَأَ الْإِسْلَامُ غَرِيبًا، وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا، فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য’।[5] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, فَقِيلَ: مَنِ الْغُرَبَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: أُنَاسٌ صَالِحُونَ، فِي أُنَاسِ سُوءٍ كَثِيرٍ، مَنْ يَعْصِيهِمْ أَكْثَرُ مِمَّنْ يُطِيعُهُمْ- ‘জিজ্ঞেস
করা হ’ল, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! অল্পসংখ্যক কারা? তিনি বললেন, অনেক মন্দ লোকের মধ্যে এরা কিছু সৎ মানুষ হবে। তাদের কথা মান্যকারীর তুলনায় বিরুদ্ধাচরণকারীদের সংখ্যা
বেশী হবে’।[6]
এ হাদীছ থেকে শেষ যামানার অবস্থা সম্পর্কে জানা গেল যে, পরবর্তী যুগে হকপন্থীদের সংখ্যা কম হবে এবং বাতিলপন্থীদের সংখ্যা বেশী হবে। হকপন্থীদের কথা মান্যকারী মানুষ কম হবে এবং বিরোধিতাকারীদের সংখ্যা বেশী হবে।
যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতাকেই হক মনে করে তাদের নিকট প্রশ্ন হ’ল, হকপন্থীদের স্বল্পতা কি সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে দেয়? না, হক হকই থাকে। চাই মান্যকারী কম হোক বা বেশী। এজন্য শুধুমাত্র মানুষের সংখ্যাকে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যের মানদন্ড নির্ধারণ করা নিজেদেরকে এবং অন্য মানুষদেরকে গোমরাহীর মধ্যে নিপতিত করার সুনিশ্চিত মাধ্যম। [চলবে]
[1]. তিরমিযী হা/২১৬৭; ছহীহুল জামে হা/১৮৪৮।
[2]. এর অর্থ ছাহাবীগণের ইজমা। যেমন কুরআন সংকলন ও অন্যান্য।
[3]. মাসায়েলে ইমাম আহমাদ, পৃঃ ৪৩৮-৩৯, মাসআলা নং ১৫৮৭।
[4]. আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ১/২৬।
[5]. মুসলিম হা/২০৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[6]. আহমাদ হা/৬৬৫০; ছহীহুল জামে হা/৩৯২১; ছহীহাহ হা/১৬১৯
0 Comments