মহিলা ও পুরুষের সালাত কি কোন পার্থক্য আছে?
রাসূল (ছাঃ) এর সালাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল একথা ভাববার কোন অবকাশ নেই। পুরুষ ও মহিলা সালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পর্থক্য নেই। সতর বা পর্দার যে বিষয়টি মেয়েদের সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন নামায শিক্ষা বইতে এসেছে তা মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ পর্দার মধ্যে সালাত আদায়ের নির্দেশই যথেষ্ট। এতে নতুন করে যুক্তি পেশ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের মধ্যে যঈফ ও জাল হাদীসের অনুকরণে সালাত চালু থাকার কারণে এবং বিভিন্ন মাযহাব পন্থীর গোড়ামীর কারণে বিভিন্ন নিয়ম চালু হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমাদের সমাজের মহিলারা কিংবা পুরুষেরা মনে করে, তাদের সালাত আলাদা। কিন্তু বাস্তবে পুরুষ মহিলাদের সালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পার্থক্য নেই এবং এ ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়নি
সালাত আদায় করার জন্য নারী পুরুষ কারোর জন্য স্বতন্ত্র নিয়ম করা হয়নি। জিবরাঈল (আঃ) মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ক্রমে দুই দফায় রাসূল (সাঃ)-কে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নিয়ম পদ্ধতি ইমামতি করে বাস্তবভাবে শিখিয়ে গেছেন। এ সময় জিবরাঈল (আঃ) নারীদের সালাতের জন্য আলাদা কোন নিয়ম পদ্ধতির বর্ণনা দেন নাই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষের জন্য এ নমুনা শিখানো হয়েছে। আল্লাহর নিয়ম পদ্ধতিতে কখনও কোন পার্থক্য দেখা যাবে না। এ মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর আপনি আল্লাহর নিয়ম-রীতিতে কখনও কোন পরিবর্তন পাবেন না।” [সূরা-আহযাব : আয়াত-৬২]
(নারী-পুরুষ উভয় জাতির) উম্মতকে সম্বোধন করে রাসূল(ছাঃ) বলেছেন,“তোমরা সেইরুপ সালাত আদায় কর, যেইরুপ আমাকে করতে দেখেছ”। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৯)। উল্লেখ্য হাদীসটি উম্মে দারদা(রাঃ)থেকে বর্ণিত আছে।তিনি একজন ফকীহাও ছিলেন।
আলাদাভাবে বলা হয়নি। সুতরাং যে আদেশ শরীয়ত পুরুষদেরকে করেছে, সে আদেশ নারীদেরকেও করেছে। এবং যে সাধারণ আদেশ মহিলাদের তাও পুরুষদের ক্ষেত্রে পালনীয়- যদি বিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার দলীল না থাকে। যেমন, “যারা সতী মহিলাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর চারজন স্বাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের জন্য শাস্তি হল ৮০ কোড়া- ---। (কুরআন-২৪/৪)।
পরন্ত যদি কেউ কোন সৎ পুরুষকে অনুরুপ অপবাদ দেয়, তবে তার জন্য একই শাস্তি প্রযোজ্য। সুতরাং মহিলারাও তাদের সালাতে পুরুষদের মতই হাত তুলবে। পিঠ লম্বা করে রুকু করবে, তাশাহুদেও সেইরুপ বসবে, যেরুপ পুরুষরা বসে।
মসজিদে নববীতে নারী পুরুষ সকলে রাসূল(ছাঃ) এর (ইমামতি) পিছনে একই নিয়মে সালাত ও জুম’আ আদায় করেছেন। (বুখারী, মিশকাত হা/৯৪৮, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৯)।
উম্মে দারদা (রাঃ) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন। (আত-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ১/৩৫৫ পৃঃ, ফাৎহুল বারী ২/৩৫৫)।
মহিলাদের জন্য পুরুষদের ন্যায় মুস্তাহাব আর তা হলো, ডান পা খাড়া করে রাখবে এবং বাম পা বিছিয়ে রাখবে। এটা ইমাম নাসাঈ, ইমাম আবূ হানীফা এবং ইমাম মালিক (রহঃ) এর উক্তি। (আইনী ৩য় খন্ড ১৬৫ পৃষ্ঠা)।
ইবরাহীম নাখয়ী (রঃ) বলেন, ‘সালাতে মহিলারা ঐরুপ করবে, যেরুপ পুরুষরা করে থাকে। (ইবনু আবী শাইবাহ, সিসান ১৮৯ পৃঃ)।
এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, সালাতের মধ্যকার ফরয ও সুন্নাত সমূহ মুসলিম নারী ও পুরুষ সকলে একই নিয়মে আদায় করতে হবে। (মির’আত ৩/৫৯ পৃঃ; ফিকহুস সুন্নাহ ১/১০৯; নায়লুল আওত্বার ৩/১৯)।
মহিলারা পুরুষদের মত একই নিয়মে সালাত আদায় করবে।
(ইবনে আবি শাইবা ১/৭৫/২, সিফাতু সালাতুন্নবী ১৮৯ পৃঃ)।
আর মহিলাদের জড়োসড়ো হয়ে সিজদাহ করার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।(সিযঃ ২৬৫২ নং)।
আলবানী বলেন,‘পুরুষ ও মহিলাদের সালাতের পার্থক্য সম্পর্কে আমি একটিও সহীহ হাদীস জানি না। এটা ব্যক্তি রায় ও ইজতিহাদ মাত্র। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫০০ এর আলোচনা দ্রঃ)
বেগানা পুরুষ আশে পাশে থাকলে কির’আত পাঠের ক্ষেত্রে (জেহরী সলাতে) মহিলা সশব্দে কুরআন পড়বে না। তবে না থাকলে পড়তে হবে। (আল মারআতুল মুসলিমাহ ৩/৩০৪)।
সু নিদৃষ্ট সহীহ দলীলের ভিত্তিতে মহিলা ও পুরুষের সালাত কিছু পার্থক্য?
ক.মহিলারা মহিলা জাম‘আতে ইমামতি করলে প্রথম কাতারের মাঝখানে দাড়াবে।‘আম্মার দুহনী হতে বর্ণিত, তিনি তার বংশের জনৈক মহিলা যার নাম হুজায়রাহ হতে বর্ণনা করেন,তিনি উম্মে সালামা হতে বর্ণনা করেন। উম্মে সালামা(রাঃ) তাদের ইমামতি করতেন এবংতাদের মাঝ বরাবর দাঁড়াতেন।
(সুনানুল কুবরা হা/৫৫৬৩;আয়নুল মা‘বুদ ২খন্ড ২১২পৃঃ)।
খ.সালাতে ইমামের ভুল স্মরণ করাবার জন্য ডান হাত দ্বারা বাম হাতে মেরে আওয়াজ দিয়ে স্মরণ করাবে। (বুখারি হা/১২০৩)
গ.মহিলারা পুরুষের কাতারে একা থাকলেও একাই দাড়াতে হবে। ( বুখারি হা/৭২৭,৩৮০)।
ঘ.মহিলাদের আপাদমস্তক না ঢাকলে সালাত কবুল হবেনা।
(আবু দাউদ হা/৬৪১,তিরমিযী হা/৩৭৭)
ঙ.মহিলারা পুরুষদের ইমামতি করতে পারবেনা।( বুখারি হা/৭২৭)।
চ. মহিলাদের পায়ের গোড়ালি ঢেকে রাখবে।
(আবু দাউদ হা/৬৩৭,মিশকাত হা/৪৩৩১)।
ছ. জাম‘আতে সালাত আদায় কালীন পুরুষদের মাথা উঠানোর পর মহিলারা মাথা উঠাবে। সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,“তহবন্দ -------খাটো ---হে নারী সমাজ। পুরুষরা তাদের মাথা উত্তোলন না করা পর্যন্ত তোমরা সাজদা হতে তোমাদের মাথা উত্তোলন করবে না।’(মুসলিম ১/১৮২পৃঃ হা/৬৬৫)
মহিলা ও পুরুষের সালাত পার্থক্যের কতিপয় বর্ণণা ?
বিভিন্ন সালাত শিক্ষা বইয়ে পুরুষ ও মহিলাদের সালাতের মাঝে অনেক পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। কিছু দলীলও পেশ করেছেন। হাদীস বিদ্বানগনের বিশ্লেষন ও যাচাই বাছাই করলে দেখা যায় সে গুলো জাল ও যঈফ। পুরুষও মহিলার সালাতের পার্থেক্যের ব্যাপারে যে সমস্ত বর্ণনা গুলো পেশ করা হয় তার কয়েকটি নিম্নরুপঃ
১.ইয়াযিদ ইবনু আবী হাবীব বলেন, দু’জন মহিলা সালাত রত অবস্থায় রাসূল(ছাঃ) তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, সিজদাহর সময় তোমরা শরীরের কিছু অংশ মাটির সাথে ঠেকিয়ে দাও। কারন মহিলাদের সিজদাহ পুরুষের মত নয়। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৫)
হাদীসটি যঈফ। (সিলসিলা যইফাহ হা/২৬৫২)।
বশ্লেষণ ঃ উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী নিজেই বলেছেন, এই বিষয়ে দুইটি মারফূ’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু কোনটিই নির্ভরযোগ্য নয়। (বায়হাক্বী, মা’রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১০৫০)
আবূ দাউদ মিরাসালে এই মুরসাল বর্ণনাটি আছে তাও উক্ত সনদে ‘ইয়াযীদ বিন আবী হাবিব’ যঈফ রাবী। ‘মুরসাল’ বর্ণনা অগ্রহনযোগ্য । কারন যে সনদের শেষ ভাগে তাবেঈর পরের ব্যক্তি অর্থাৎ সাহাবীকে উহ্য রেখে তাবেঈ বলবেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, এরুপ সনদের হাদীসকে মুরসাল বলা হয়। (এর সমর্থনে কোন মারফু অথবা মাওকুফ হাদীস না থাকলে এরুপ বর্ণনা গ্রহনযোগ্য নয়)। তার পরও বর্ণনার সনদটি যঈফ। অতএব বর্ণনাটি আমলের প্রশ্নই ওঠে না।
একজন তাবেঈ রাসূল (ছাঃ) এর সঙ্গে কোন সাহাবার সুত্র ছাড়া তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন।
(তাবেঈ তারাই, যারা রাসূল (ছাঃ) কে দেখেননি তবে সাহাবাদের থেকে হাদীস শিখেছেন এবং সহচর)।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন মহিলা যখন সালাতে বসবে তখন সে তার এক উরুর সাথে অন্য উরু লাগিয়ে রাখবে এবং যখন সে সিজদাহ দিবে তখন তার পেট দুই উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে যেন তা তার জন্য পর্দা স্বরুপ হয়। আর তখন আল্লাহতা‘আলা তা লক্ষ্য করেন এবং ফেরেশতাদেরকে ডেকে বলেন, তোমাদেরকে সাক্ষী রাখছি, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৪ ; ‘নবীজীর নামায’ ৩৩৭-৩৩৮ পৃষ্ঠা)।
বিশ্লেষনঃ উক্ত বর্ণনা যঈফ ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে নিজেই যঈফ বলেছেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছেন। (সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৪ এর আলোচনা)।
মাওলানা আব্দুল মালেক বায়হাক্বী থেকে বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন কিন্তু বর্ণনাটি যে যঈফ তা উল্লেখ করেননি। যঈফ বর্ণনা দ্বারা দ্বীনি আমলের মূল (বিধান) দলীল সাব্যস্ত হয় না।
ইমাম আহমাদের মাসায়েল গ্রন্থে ইবনে উমার থেকে নিজ স্ত্রীদের এক পায়ের উপর অন্য পা আড়াআড়ি করে বসার আদেশ সূচক যে বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে এই সনদের মধ্যে ‘আবদল্লাহ বিন উমরী ’নামক রাবী যঈফ।
৩. ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি একদা রাসূল (ছাঃ) এর নিকট আসলাম। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, এটা হল ওয়ায়েল বিন হুজর। সে তোমাদের কাছে উৎসাহে বা ভীতির কারণে আসেনি; বরং আল্লাহ ও তার রাসূল(ছাঃ) এর ভালোবাসার কারণে এসেছে। ... ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন
তিনি আমাকে বললেন, তুমি যখন সালাত আদায় করবে তখন তোমার দুই হাত কান বরাবর উঠাবে। আর মহিলা মুছল্লী তার হাত বুক বরাবর উঠাবে।
(ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১৭৪৯৭; নবিজীর নামাজ, ৩৭৯ পৃষ্ঠা)।
বর্ণনাটি নিতান্তই যঈফ মূলতঃ এর সনদে মায়মুনাহ বিনতে হুজর এবং উম্মু ইয়াহইয়া বিনতে আব্দুল জ্জাব্বার নামে দুই জন অপরিচিত রাবী আছে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫০০)।
নবিজীর নামাজ পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮৮ তে উক্ত মর্মে সাহাবী ও তাবেঈর নামে আরো কতিপয় বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সবই মুনকার ও ভিত্তিহীন। সে গুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপ করার কোন প্রয়োজন নেই।(জাল হাদিসের কবলে রাসূলুলাহ(ছাঃ) এর ছালাত পৃ-২১৬)।
মেয়েদের সালাত ভিন্ন হওয়ার ব্যাপারে গোড়ামী পন্থীদের কোন সুনির্দিষ্ট সহীহ দলীল নেই। মেয়েদের জড়োসড়ো হয়ে দাড়ানো থেকে সিজদাহ পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই ইমাম কুদুরী (র.) মাযহাবের মত প্রকাশ করতে যেয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন এটা তাদের সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (আল হেদায়া প্রথম খন্ড পৃঃ৮৫-৮৭)।
এছাড়া জাল হাদীস গুলোকে হাসান বলে ভিত্তিহীন কিছু কল্প কাহিনী ও কয়েকটি জাল যঈফ হাদীস সহ আমাদের দেশে মেডইন ইরাক,কুফা,পাকিস্থান,ভারত ইত্যাদি হাদীস পেশ করা হয়েছে বিভিন্ন নামাজ শিক্ষা বইতে এ সম্বন্ধে বিভিন্ন মন্তব্যও পাওয়া যায় যা আমলে অযোগ্য,সহীহ হাদীস বিরোধী
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন যে ব্যক্তি সালাতে নিজের উভয় পা(এক সঙ্গে) মিলিয়ে দাড়ালো সে সুন্নাতের বিরোধিতা করলো।
(নাসাঈ হা/ ৮৯৫ ইঃ ফাঃ)।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) এ রকম চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় মাটিতে দু’হাত বিছিয়ে সিজদাহ করতে নিষেধ করেছেন।
(মুসলিম, আবু দাউদ হা/৭৮৩)।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেছেন, ---- তোমাদের কেউ যেন সিজদাহ দেওয়ার সময় দু‘হাত বিছিয়ে না দেয়, যেমন কুকুর বিছিয়ে দেয়। (বুখারী হা/৮২২, তাওহীদ প্রকাশনী, ইঃ ফাঃ ৭৮৪)।
প্রশ্ন-নারী-ও-পুরুষের-সালাতে-কি-কোন-পার্থক্য-আছে কি?
রাসূল (ছাঃ) এর সালাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল একথা ভাববার কোন অবকাশ নেই। পুরুষ ও মহিলা সালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পর্থক্য নেই। সতর বা পর্দার যে বিষয়টি মেয়েদের সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন নামায শিক্ষা বইতে এসেছে তা মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ পর্দার মধ্যে সালাত আদায়ের নির্দেশই যথেষ্ট। এতে নতুন করে যুক্তি পেশ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের মধ্যে যঈফ ও জাল হাদীসের অনুকরণে সালাত চালু থাকার কারণে এবং বিভিন্ন মাযহাব পন্থীর গোড়ামীর কারণে বিভিন্ন নিয়ম চালু হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমাদের সমাজের মহিলারা কিংবা পুরুষেরা মনে করে, তাদের সালাত আলাদা। কিন্তু বাস্তবে পুরুষ মহিলাদের সালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পার্থক্য নেই এবং এ ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়নি
সালাত আদায় করার জন্য নারী পুরুষ কারোর জন্য স্বতন্ত্র নিয়ম করা হয়নি। জিবরাঈল (আঃ) মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ক্রমে দুই দফায় রাসূল (সাঃ)-কে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নিয়ম পদ্ধতি ইমামতি করে বাস্তবভাবে শিখিয়ে গেছেন। এ সময় জিবরাঈল (আঃ) নারীদের সালাতের জন্য আলাদা কোন নিয়ম পদ্ধতির বর্ণনা দেন নাই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষের জন্য এ নমুনা শিখানো হয়েছে। আল্লাহর নিয়ম পদ্ধতিতে কখনও কোন পার্থক্য দেখা যাবে না। এ মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর আপনি আল্লাহর নিয়ম-রীতিতে কখনও কোন পরিবর্তন পাবেন না।” [সূরা-আহযাব : আয়াত-৬২]
(নারী-পুরুষ উভয় জাতির) উম্মতকে সম্বোধন করে রাসূল(ছাঃ) বলেছেন,“তোমরা সেইরুপ সালাত আদায় কর, যেইরুপ আমাকে করতে দেখেছ”। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৯)। উল্লেখ্য হাদীসটি উম্মে দারদা(রাঃ)থেকে বর্ণিত আছে।তিনি একজন ফকীহাও ছিলেন।
আলাদাভাবে বলা হয়নি। সুতরাং যে আদেশ শরীয়ত পুরুষদেরকে করেছে, সে আদেশ নারীদেরকেও করেছে। এবং যে সাধারণ আদেশ মহিলাদের তাও পুরুষদের ক্ষেত্রে পালনীয়- যদি বিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার দলীল না থাকে। যেমন, “যারা সতী মহিলাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর চারজন স্বাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের জন্য শাস্তি হল ৮০ কোড়া- ---। (কুরআন-২৪/৪)।
পরন্ত যদি কেউ কোন সৎ পুরুষকে অনুরুপ অপবাদ দেয়, তবে তার জন্য একই শাস্তি প্রযোজ্য। সুতরাং মহিলারাও তাদের সালাতে পুরুষদের মতই হাত তুলবে। পিঠ লম্বা করে রুকু করবে, তাশাহুদেও সেইরুপ বসবে, যেরুপ পুরুষরা বসে।
মসজিদে নববীতে নারী পুরুষ সকলে রাসূল(ছাঃ) এর (ইমামতি) পিছনে একই নিয়মে সালাত ও জুম’আ আদায় করেছেন। (বুখারী, মিশকাত হা/৯৪৮, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৯)।
উম্মে দারদা (রাঃ) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন। (আত-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ১/৩৫৫ পৃঃ, ফাৎহুল বারী ২/৩৫৫)।
মহিলাদের জন্য পুরুষদের ন্যায় মুস্তাহাব আর তা হলো, ডান পা খাড়া করে রাখবে এবং বাম পা বিছিয়ে রাখবে। এটা ইমাম নাসাঈ, ইমাম আবূ হানীফা এবং ইমাম মালিক (রহঃ) এর উক্তি। (আইনী ৩য় খন্ড ১৬৫ পৃষ্ঠা)।
ইবরাহীম নাখয়ী (রঃ) বলেন, ‘সালাতে মহিলারা ঐরুপ করবে, যেরুপ পুরুষরা করে থাকে। (ইবনু আবী শাইবাহ, সিসান ১৮৯ পৃঃ)।
এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, সালাতের মধ্যকার ফরয ও সুন্নাত সমূহ মুসলিম নারী ও পুরুষ সকলে একই নিয়মে আদায় করতে হবে। (মির’আত ৩/৫৯ পৃঃ; ফিকহুস সুন্নাহ ১/১০৯; নায়লুল আওত্বার ৩/১৯)।
মহিলারা পুরুষদের মত একই নিয়মে সালাত আদায় করবে।
(ইবনে আবি শাইবা ১/৭৫/২, সিফাতু সালাতুন্নবী ১৮৯ পৃঃ)।
আর মহিলাদের জড়োসড়ো হয়ে সিজদাহ করার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।(সিযঃ ২৬৫২ নং)।
আলবানী বলেন,‘পুরুষ ও মহিলাদের সালাতের পার্থক্য সম্পর্কে আমি একটিও সহীহ হাদীস জানি না। এটা ব্যক্তি রায় ও ইজতিহাদ মাত্র। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫০০ এর আলোচনা দ্রঃ)
বেগানা পুরুষ আশে পাশে থাকলে কির’আত পাঠের ক্ষেত্রে (জেহরী সলাতে) মহিলা সশব্দে কুরআন পড়বে না। তবে না থাকলে পড়তে হবে। (আল মারআতুল মুসলিমাহ ৩/৩০৪)।
সু নিদৃষ্ট সহীহ দলীলের ভিত্তিতে মহিলা ও পুরুষের সালাত কিছু পার্থক্য?
ক.মহিলারা মহিলা জাম‘আতে ইমামতি করলে প্রথম কাতারের মাঝখানে দাড়াবে।‘আম্মার দুহনী হতে বর্ণিত, তিনি তার বংশের জনৈক মহিলা যার নাম হুজায়রাহ হতে বর্ণনা করেন,তিনি উম্মে সালামা হতে বর্ণনা করেন। উম্মে সালামা(রাঃ) তাদের ইমামতি করতেন এবংতাদের মাঝ বরাবর দাঁড়াতেন।
(সুনানুল কুবরা হা/৫৫৬৩;আয়নুল মা‘বুদ ২খন্ড ২১২পৃঃ)।
খ.সালাতে ইমামের ভুল স্মরণ করাবার জন্য ডান হাত দ্বারা বাম হাতে মেরে আওয়াজ দিয়ে স্মরণ করাবে। (বুখারি হা/১২০৩)
গ.মহিলারা পুরুষের কাতারে একা থাকলেও একাই দাড়াতে হবে। ( বুখারি হা/৭২৭,৩৮০)।
ঘ.মহিলাদের আপাদমস্তক না ঢাকলে সালাত কবুল হবেনা।
(আবু দাউদ হা/৬৪১,তিরমিযী হা/৩৭৭)
ঙ.মহিলারা পুরুষদের ইমামতি করতে পারবেনা।( বুখারি হা/৭২৭)।
চ. মহিলাদের পায়ের গোড়ালি ঢেকে রাখবে।
(আবু দাউদ হা/৬৩৭,মিশকাত হা/৪৩৩১)।
ছ. জাম‘আতে সালাত আদায় কালীন পুরুষদের মাথা উঠানোর পর মহিলারা মাথা উঠাবে। সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,“তহবন্দ -------খাটো ---হে নারী সমাজ। পুরুষরা তাদের মাথা উত্তোলন না করা পর্যন্ত তোমরা সাজদা হতে তোমাদের মাথা উত্তোলন করবে না।’(মুসলিম ১/১৮২পৃঃ হা/৬৬৫)
মহিলা ও পুরুষের সালাত পার্থক্যের কতিপয় বর্ণণা ?
বিভিন্ন সালাত শিক্ষা বইয়ে পুরুষ ও মহিলাদের সালাতের মাঝে অনেক পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। কিছু দলীলও পেশ করেছেন। হাদীস বিদ্বানগনের বিশ্লেষন ও যাচাই বাছাই করলে দেখা যায় সে গুলো জাল ও যঈফ। পুরুষও মহিলার সালাতের পার্থেক্যের ব্যাপারে যে সমস্ত বর্ণনা গুলো পেশ করা হয় তার কয়েকটি নিম্নরুপঃ
১.ইয়াযিদ ইবনু আবী হাবীব বলেন, দু’জন মহিলা সালাত রত অবস্থায় রাসূল(ছাঃ) তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, সিজদাহর সময় তোমরা শরীরের কিছু অংশ মাটির সাথে ঠেকিয়ে দাও। কারন মহিলাদের সিজদাহ পুরুষের মত নয়। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৫)
হাদীসটি যঈফ। (সিলসিলা যইফাহ হা/২৬৫২)।
বশ্লেষণ ঃ উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী নিজেই বলেছেন, এই বিষয়ে দুইটি মারফূ’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু কোনটিই নির্ভরযোগ্য নয়। (বায়হাক্বী, মা’রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১০৫০)
আবূ দাউদ মিরাসালে এই মুরসাল বর্ণনাটি আছে তাও উক্ত সনদে ‘ইয়াযীদ বিন আবী হাবিব’ যঈফ রাবী। ‘মুরসাল’ বর্ণনা অগ্রহনযোগ্য । কারন যে সনদের শেষ ভাগে তাবেঈর পরের ব্যক্তি অর্থাৎ সাহাবীকে উহ্য রেখে তাবেঈ বলবেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, এরুপ সনদের হাদীসকে মুরসাল বলা হয়। (এর সমর্থনে কোন মারফু অথবা মাওকুফ হাদীস না থাকলে এরুপ বর্ণনা গ্রহনযোগ্য নয়)। তার পরও বর্ণনার সনদটি যঈফ। অতএব বর্ণনাটি আমলের প্রশ্নই ওঠে না।
একজন তাবেঈ রাসূল (ছাঃ) এর সঙ্গে কোন সাহাবার সুত্র ছাড়া তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন।
(তাবেঈ তারাই, যারা রাসূল (ছাঃ) কে দেখেননি তবে সাহাবাদের থেকে হাদীস শিখেছেন এবং সহচর)।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন মহিলা যখন সালাতে বসবে তখন সে তার এক উরুর সাথে অন্য উরু লাগিয়ে রাখবে এবং যখন সে সিজদাহ দিবে তখন তার পেট দুই উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে যেন তা তার জন্য পর্দা স্বরুপ হয়। আর তখন আল্লাহতা‘আলা তা লক্ষ্য করেন এবং ফেরেশতাদেরকে ডেকে বলেন, তোমাদেরকে সাক্ষী রাখছি, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৪ ; ‘নবীজীর নামায’ ৩৩৭-৩৩৮ পৃষ্ঠা)।
বিশ্লেষনঃ উক্ত বর্ণনা যঈফ ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে নিজেই যঈফ বলেছেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছেন। (সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৪ এর আলোচনা)।
মাওলানা আব্দুল মালেক বায়হাক্বী থেকে বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন কিন্তু বর্ণনাটি যে যঈফ তা উল্লেখ করেননি। যঈফ বর্ণনা দ্বারা দ্বীনি আমলের মূল (বিধান) দলীল সাব্যস্ত হয় না।
ইমাম আহমাদের মাসায়েল গ্রন্থে ইবনে উমার থেকে নিজ স্ত্রীদের এক পায়ের উপর অন্য পা আড়াআড়ি করে বসার আদেশ সূচক যে বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে এই সনদের মধ্যে ‘আবদল্লাহ বিন উমরী ’নামক রাবী যঈফ।
৩. ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি একদা রাসূল (ছাঃ) এর নিকট আসলাম। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, এটা হল ওয়ায়েল বিন হুজর। সে তোমাদের কাছে উৎসাহে বা ভীতির কারণে আসেনি; বরং আল্লাহ ও তার রাসূল(ছাঃ) এর ভালোবাসার কারণে এসেছে। ... ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন
তিনি আমাকে বললেন, তুমি যখন সালাত আদায় করবে তখন তোমার দুই হাত কান বরাবর উঠাবে। আর মহিলা মুছল্লী তার হাত বুক বরাবর উঠাবে।
(ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১৭৪৯৭; নবিজীর নামাজ, ৩৭৯ পৃষ্ঠা)।
বর্ণনাটি নিতান্তই যঈফ মূলতঃ এর সনদে মায়মুনাহ বিনতে হুজর এবং উম্মু ইয়াহইয়া বিনতে আব্দুল জ্জাব্বার নামে দুই জন অপরিচিত রাবী আছে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫০০)।
নবিজীর নামাজ পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮৮ তে উক্ত মর্মে সাহাবী ও তাবেঈর নামে আরো কতিপয় বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সবই মুনকার ও ভিত্তিহীন। সে গুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপ করার কোন প্রয়োজন নেই।(জাল হাদিসের কবলে রাসূলুলাহ(ছাঃ) এর ছালাত পৃ-২১৬)।
মেয়েদের সালাত ভিন্ন হওয়ার ব্যাপারে গোড়ামী পন্থীদের কোন সুনির্দিষ্ট সহীহ দলীল নেই। মেয়েদের জড়োসড়ো হয়ে দাড়ানো থেকে সিজদাহ পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই ইমাম কুদুরী (র.) মাযহাবের মত প্রকাশ করতে যেয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন এটা তাদের সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (আল হেদায়া প্রথম খন্ড পৃঃ৮৫-৮৭)।
এছাড়া জাল হাদীস গুলোকে হাসান বলে ভিত্তিহীন কিছু কল্প কাহিনী ও কয়েকটি জাল যঈফ হাদীস সহ আমাদের দেশে মেডইন ইরাক,কুফা,পাকিস্থান,ভারত ইত্যাদি হাদীস পেশ করা হয়েছে বিভিন্ন নামাজ শিক্ষা বইতে এ সম্বন্ধে বিভিন্ন মন্তব্যও পাওয়া যায় যা আমলে অযোগ্য,সহীহ হাদীস বিরোধী
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন যে ব্যক্তি সালাতে নিজের উভয় পা(এক সঙ্গে) মিলিয়ে দাড়ালো সে সুন্নাতের বিরোধিতা করলো।
(নাসাঈ হা/ ৮৯৫ ইঃ ফাঃ)।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) এ রকম চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় মাটিতে দু’হাত বিছিয়ে সিজদাহ করতে নিষেধ করেছেন।
(মুসলিম, আবু দাউদ হা/৭৮৩)।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেছেন, ---- তোমাদের কেউ যেন সিজদাহ দেওয়ার সময় দু‘হাত বিছিয়ে না দেয়, যেমন কুকুর বিছিয়ে দেয়। (বুখারী হা/৮২২, তাওহীদ প্রকাশনী, ইঃ ফাঃ ৭৮৪)।
প্রশ্ন-নারী-ও-পুরুষের-সালাতে-কি-কোন-পার্থক্য-আছে কি?
0 Comments