Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

ভ্রান্তির বেড়াজালে দা‘ওয়াত ও দু‘আত


▌ভ্রান্তির বেড়াজালে দা‘ওয়াত ও দু‘আত [‘আক্বীদাহ ও মানহাজ গোপনের স্বরূপ উন্মোচন]
. সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ‘লার জন্য। যিনি বলেছেন “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের (সালাফদের) পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে দগ্ধ করব জাহান্নামে, কত মন্দই না সে আবাস!” [সূরাহ নিসা: ১১৫]

অসংখ্য সলাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নাবী ও রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রতি, যিনি বলেছেন, “লোকদের কী হলো যে, তারা এমন শর্তারোপ করে, যা আল্লাহর বিধানে নেই। আল্লাহর বিধানে যে শর্তের উল্লেখ নেই, তা বাতিল বলে গণ্য হবে, শত শর্ত হলেও। আল্লাহর ফায়সালাই সবচেয়ে সঠিক এবং আল্লাহর শর্তই সর্বাধিক সুদৃঢ়।” [স্বহীহ্ বুখারী, হা/২১৬৮]

প্রারম্ভিকা:

ইদানীং বাঙালি সালাফী ভাইদের মধ্যে ‘আক্বীদাহ ও মানহাজগত সচেতনতা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও এটি শুরুলগ্ন মাত্র, তবুও তা আমাদের জন্য অভাবনীয় আনন্দের বিষয়। এই সচেতনতা তৈরির ফলে কতিপয় দা‘ঈর প্রকৃতত্ব প্রকাশিত হচ্ছে, উন্মোচিত হচ্ছে তাদের স্বরূপ। কারণ অনেক দা‘ঈ সালাফী সেজে বসে আছেন, যদিও তারা প্রকৃত সালাফী নন। ফলে আমাদের সচেতন ভাইয়েরা তাঁদেরকে ‘আক্বীদাহ ও মানহাজ বিষয়ক প্রশ্ন করছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের ‘আক্বীদাহ ও মানহাজ স্পষ্ট করছেন না।

অধুনা একজন জনপ্রিয় বক্তাকে তাঁর ‘আক্বীদাহ ও মানহাজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি ধোঁয়াশাপূর্ণ উত্তর দিয়ে বিষয়টি অস্পষ্ট করে তোলেন এবং ‘আক্বীদাহ ও মানহাজের বিষয়কে অগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ। আমরা প্রথমে ‘আক্বীদাহর গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব। তারপর আলোচ্য বক্তা সাহেবের বক্তব্যটির পর্যালোচনা এবং মানহাজ স্পষ্টকরণের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব। আর আল্লাহই তাওফীক্বদাতা।
.
আক্বীদাহ'র গুরুত্ব:

আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলূকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পেশ করে আক্বীদাহ বা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই। ইহা এমন এক ভিত্তি, যাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার সার্বিক জীবন পরিচালনার গতিপথ নির্ধারণ করে। আক্বীদাহ বা বিশ্বাস যার বিশুদ্ধ নয় তার সম্পূর্ণ জীবনটাই বৃথা। কারণ মানব জীবনের মূল চাবিকাঠি হল তার আক্বীদাহ বা বিশ্বাস; যার আলোকে মানুষ তার সকল কর্ম সম্পাদন করে থাকে। ইহা এমন এক অতুলনীয় শক্তি, যার উপর ভর করে নিজের জীবনটুকু বিলিয়ে দিতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না।
.
প্রিয় পাঠক, আপনি কি সালাফদের অনুসরণ করতে চান? তো দেখুন, সালাফরা কী শিখেছেন সবার আগে। আসুন দেখি, কোন বিষয়টাকে তাঁরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। সাহাবী জুনদুব ইবনু আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
َكُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ـ صلى الله عليه وسلم ـ وَنَحْنُ فِتْيَانٌ حَزَاوِرَةٌ فَتَعَلَّمْنَا الإِيمَانَ قَبْلَ أَنْ نَتَعَلَّمَ الْقُرْآنَ ثُمَّ تَعَلَّمْنَا الْقُرْآنَ فَازْدَدْنَا بِهِ إِيمَانًا.
“আমরা নাবী ﷺ এর সাথে ছিলাম। আমরা ছিলাম শক্তিশালী এবং সক্ষম যুবক। আমরা কুরআন শেখার পূর্বে ঈমান শিখেছি, অতঃপর কুরআন শিখেছি এবং তার দ্বারা আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে।”
📚[[ইবনু মাজাহ, হা/৬১; সনদ: সহীহ]

প্রিয় ভাই, আপনি দেখলেন, সাহাবীগণ সবার আগে ‘আক্বীদাহ শিখেছেন, এমনকি ক্বুরআন শেখার আগে তাঁরা ‘আক্বীদাহ শিখেছেন।
.
আপনার জেনে রাখা জরুরী যে, ভিত্তি স্থাপন ব্যতীত কোন বিল্ডিং বানানো যেমন অসম্ভব, তেমনি বিশুদ্ধ আক্বীদাহ ব্যতীত নিজেকে মুসলিম দাবী করাও অসম্ভব কেননা মানবজাতির যাবতীয় পথভ্রষ্টতার মূলে রয়েছে তার মৌলিক আক্বীদাহ থেকে বিচ্যুত হওয়া। তাই প্রতিটি কথা ও কর্ম যদি বিশুদ্ধ আক্বীদাহ বা বিশ্বাস থেকে নির্গত না হয় তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। এ প্রসঙ্গে উস্তাযুল আলিম, আশ শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
معلومٌ بالأدلة الشرعية من الكتاب والسنة أن الأعمال والأقوال إنما تصح وتقبل إذا صدرت عن عقيدة صحيحة فإن كانت العقيدة غير صحيحة بطل ما يتفرع عنها من أعمال وأقوال.
“কিতাব ও সুন্নাহ’র শার‘ঈ দলিলসমূহের মাধ্যমে এটা সুবিদিত যে, যাবতীয় আমল এবং কথা কেবল তখনই বিশুদ্ধ ও গ্রহণীয় হয়, যখন তা সহীহ (বিশুদ্ধ) আক্বীদাহ থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু আক্বীদাহ যদি অশুদ্ধ হয়, তাহলে যাবতীয় আমল ও কথা বাতিল হয়ে যায়।”
📚[মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যাআহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৩]
.
অতএব আক্বীদাই ইসলামের মৌলিক বিষয়; যার শুদ্ধতার উপর আমল নির্ভরশীল।
.
ইসলামে প্রবেশের একমাত্র মাধ্যম হ’ল আক্বীদাহ ছহীহ হওয়া। কারণ ইসলামের মৌলিক বিষয় হ’ল আক্বীদাহ। আক্বীদাহ বা বিশ্বাসই মানুষকে পথভ্রষ্ট করে এমনকি ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আক্বীদাহগত বিচ্যুতির কারণেই একজন মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়ে নিজ হাতে বানানো মূর্তির পূজা করে, তাকেই পরকালে নাজাতের অসীলা মনে করে, তার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী নিজ সন্তান হ’লেও তাকে হত্যা করার মত ঘৃণিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একথা সুবিদিত যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা মানব জাতির সার্বিক জীবন পরিচালনার যাবতীয় বিধি-বিধান নাযিল করে একমাত্র তারই অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আর তা অনুসরণের ক্ষেত্রে পরস্পরে দলাদলী বা বিচ্ছিন্ন হ’তে নিষেধ করেছেন। আর এই নির্দেশ আক্বীদাহগত ঐক্যের নির্দেশ। এই নির্দেশ পালনের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত মুসলিম হয় এবং পরকালে জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে প্ররিত্রাণ লাভ করে ও জান্নাতের অফুরন্ত নে‘আমত লাভের পথ সুগম করে। পক্ষান্তরে উক্ত নিষেধ অমান্য করে ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী হওয়ার মাধ্যমে মানুষ ইহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, রাফেযী, খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা বিভিন্ন ভ্রান্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মত থেকে বঞ্চিত হয় এবং জাহান্নামের কঠিন আযাব গ্রহণের পথ সুগম করে।
.
আমরা যারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করি, একই কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায় করি, তারাও আজ শতধাবিভক্ত। নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করেও ‘ওয়াহদাতুল উজূদ’-এর মত ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী হওয়ার মাধ্যমে নিজেরাই আল্লাহ বনে যাই; আল ইয়াযু বিল্লাহ। কেউবা মুহাম্মাদ (ছাঃ)- কে আল্লাহ বলি, আবার কেউ আলী (রাঃ)- কে আল্লাহ বলি। এ সমস্ত ভ্রান্ত আক্বীদাহ তাদের মৌখিক স্বীকৃতির অসারতা প্রমাণ করে। তাইতো বিশুদ্ধ আক্বীদাহ'র গুরুত্ত্বারোপ করে এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফ্বাকীহ, আশ শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ ইবনু ফাউযান আল ফাউযান হা’ফিযাহুল্লাহ বলেছেন, "কোন ব্যক্তি যদি বলে আমাদের জন্য ঈমানই যথেষ্ঠ, আক্বিদাহর উপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এটা পরস্পর বিরোধী একটা কথা। কোন ব্যক্তির ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান হবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না তার আক্বিদাহ বিশুদ্ধ হচ্ছে। যার আক্বিদাহ বিশুদ্ধ নয় তার ঈমান নেই এবং তার দ্বীনও সঠিক নয়।”
গৃহীত:
📚[ফাতাওয়া আস-সিয়াসাহ আশ-শা’রীয়াহ, প্রশ্ন-১]
.
তিনি [ হাফিয্বাহুল্লাহ ] আরো বলেছেন,
"ইসলামী দাওয়াত ও তাবলীগে তাওহীদ একটা স্থায়ী বিষয়। একমাত্র মুনাফেক ও কাফেররাই তাওহীদের দাওয়াতকে অপ্রয়োজনীয় বা না-বোঝার মতো মনে করে, আল্লাহু মুস্তাআন।”
গৃহীত:
📚[সালাফী মানহাজের উপর অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্ন এবং উত্তর:. ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা ]

অতএব ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রধান মাধ্যম হ’ল, ছহীহ বা বিশুদ্ধ আক্বীদাহ, যা পরকালীন মুক্তির সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী হাতিয়ার।
.
বক্তা সাহেবের বক্তব্য:

গত কয়েকদিন আগে একজন জৈনক বক্তাকে প্রশ্ন করা হল, "শাইখ! আপনার মানহাজ নিয়ে অনেকেই (বিভিন্ন) প্রশ্ন করেন, আপনি শুধু ফযিলতের ওয়াজ করেন, আক্বীদাহ'র উপর আপনার লেকচার অনেক কম"!
[ উল্লেখ্য যে, এখানে প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য ছিল উক্ত বক্তার আক্বীদাহ, মানহাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ]

জবাবে বক্তা সাহেব বলেন, " অনেকেই আমার উপর অবিচার করেন! আপনি সামান্য হলেও সুবিচার করেছেন! আক্বীদাহ'র উপর উলামায়ে কেরামের বহু আলোচনা রয়েছে তাই আমি এই ট্রপিকে আলোচনা করিনা! বরং আক্বীদাহ'র যে বিষয়গুলি নিয়ে কেউ আলোচনা করেন নি, সেগুলো করার চেস্টা করি! যেমন: বাউলদের আক্বীদাহ , হিজবুত তাওহীদ ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আক্বীদাহ'র বহুল আলোচিত বিষয়গুলি নয় বরং 'কম আলোচিত অথবা কেউ আলোচনা করেন নি' এমন বিষয়গুলি আলোচনা করি। [মুলভাব সংক্ষেপিত ]
লিংকঃ https://m.youtube.com/watch?v=pzHgPAmdMC0&feature=share

.বক্তব্যের পর্যালোচনা:

সচেতন পাঠকগণ, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন প্রশ্নের সাথে বক্তার উত্তর সামাজস্যপূর্ণ নয় বরং তিনি কৌশলে নিজের মানহাজ আড়াল করেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে! কেননা প্রশ্নকর্তা প্রথমে বক্তার মানহাজ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, অত:পর আক্বীদাহ বিষয়ক বিস্তর লেকচার কেন নেই তা জানতে চেয়েছেন!

একথা দিনের আলোর মত সত্য যে, উক্ত বক্তা আক্বীদাহ' বিষয়ক বিস্তর আলোচনা করেন না, তাই তিনি বাউলদের আক্বীদাহ এবং হিজবুত তাওহীদের আক্বীদাহ নিয়ে বিষয়টি তুলে এনেছেন। অথচ প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের মর্মাথ ছিল আক্বীদাহ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জাম'আত নিয়ে! কেননা একজন বক্তা সালাফদের অনুসারী কিনা সেটা জানা যায় আহলে সুন্নাহ'র আক্বীদাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে বক্তব্য পেশ করার মাধ্যমে। আল্লাহর ছিফাত,তাকলিদে শাকসী, উসুল আল হাদিস,উসুল আল ফিক্বহ,মিনহাজুস সুন্নাহ, উসুল আদ্ব-দ্বীন,আক্বিদাতু আহালে সুন্নাহ ওয়াল জাম'আহ এসকল বিষয়ে বক্তার অবস্থানের প্রেক্ষিতে তার মানহাজ সম্পর্কে আওয়াম [ জনসাধারণ] ওয়াকিবহাল হতে পারেন।

বাউলদের আক্বীদাহ কিংবা হিজবুত তাওহীদকে রদ করার উপর ডিফেন্ড করে বক্তার আক্বীদাহ, মানহাজ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্বব নয় ! কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন! যেমন ধরূন, দেওয়ানবাগীকে সব ঘরানার আলিমরাই রদ করেছে তাতে করে রদকারী আহলে সুন্নাহর অনুসারী হয়ে গেছেন সেটা ভাবার কোন অবকাশ কি আছে? বেরলভি'দের মাথার তাজ চরমপন্থী এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীও কাদিয়ানীদের রদ করেছে, তাই বলে কি আমরা বলতে পারি এই লোক সুন্নাহর অনুসারী!? কখনোই নয়!

যেহেতু কাদিয়ানী, শিয়া, বাউল সম্প্রদায় কিংবা হিজব আশ শায়াতীন'দের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মোত্তাফ্বাক! অতএব, শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায়না, ঠিক তেমনি এসব চলচাতুরী করে আবেগী এবং ঘুমন্ত কাঙ্গালদের তাক লাগানো যায় কিন্তু সীমান্ত প্রহরীদের নয়।
.

দ্বিতীয়ত্ব, বক্তা সাহেব একটি খোঁড়াযুক্তি দাড় করিয়ে বলেন, "আলিমগন আক্বীদাহ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন তাই আমি করিনা" !

আমরা বলবো হয় বক্তা সাহেব আক্বীদাহ'র গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারেন নি, আর না হয় নিজের আক্বীদাহ, মানহাজ গোপন করার জন্যই এই যুক্তি বেছে নিয়েছেন! আমরা জানি, সকল নবীর দাওয়াত ছিল তাওহীদের দাওয়াত, আরেকটু খোলাসা করে বললে বিশুদ্ধ আক্বীদাহর দাওয়াত। পূর্ববর্তী নবীগন শত শত বছর ধরে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন কিন্তু তাই বলে পরবর্তী নবীদের ক্ষেত্রে তা রহিত হয়ে যায়নি বরং একই দাওয়াত তারাও অমৃত্যু পর্যন্ত দিয়ে গেছেন।
আলিমগন হলেন নবীদের ওয়ারিশ, সুতরাং এই মহান দ্বায়িত্ব তারা কেয়ামতের আগ পর্যন্ত পালন করে যাবেন, এক্ষেত্রে কোন দাঈর একথা বলার সুযোগ নেই যে, অন্যরা আক্বীদাহর দাওয়াত দিচ্ছে সুতরাং আমার দেওয়ার প্রয়োজন নেই! জেনে রাখুন, যে বা যারা উপরিউক্ত খোঁড়া যুক্তি পেশ করে, তারা আসলে নিজেদের আক্বীদাহ,মানহাজ লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা স্বরুপ এসব প্রাগাঢ়বাক্য গুলো ব্যবহার করে!

একজন দ্বীনের খাদেম সর্বপ্রথম কিসের দাওয়াত দিবেন সেই দিকনির্দেশনাও প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দিয়ে গেছেন। মু‘আয (রাঃ)- কে ইয়ামানে প্রেরণকালে তিনি বলেছিলেন,
ﺍﺩْﻋُﻬُﻢْ ﺇِﻟَﻰ ﺷَﻬَﺎﺩَﺓِ ﺃَﻥْ ﻻَ ﺇِﻟَﻪَ ﺇِﻻَّ ﺍﻟﻠﻪُ، ﻭَﺃَﻧِّﻲْ ﺭَﺳُﻮْﻝُ ﺍﻟﻠﻪِ، ﻓَﺈِﻥْ ﻫُﻢْ
ﺃَﻃَﺎﻋُﻮْﺍ ﻟِﺬَﻟِﻚَ ﻓَﺄَﻋْﻠِﻤْﻬُﻢْ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻗَﺪِ ﺍﻓْﺘَﺮَﺽَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺧَﻤْﺲَ ﺻَﻠَﻮَﺍﺕٍ
ﻓِﻲْ ﻛُﻞِّ ﻳَﻮْﻡٍ ﻭَﻟَﻴْﻠَﺔٍ، ﻓَﺈِﻥْ ﻫُﻢْ ﺃَﻃَﺎﻋُﻮْﺍ ﻟِﺬَﻟِﻚَ ﻓَﺄَﻋْﻠِﻤْﻬُﻢْ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ
ﺍﻓْﺘَﺮَﺽَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺻَﺪَﻗَﺔً ﻓِﻲْ ﺃَﻣْﻮَﺍﻟِﻬِﻢْ، ﺗُﺆْﺧَﺬُ ﻣِﻦْ ﺃَﻏْﻨِﻴَﺎﺋِﻬِﻢْ ﻭَﺗُﺮَﺩُّ
ﻋَﻠَﻰ ﻓُﻘَﺮَﺍﺋِﻬِﻢْ -
‘সেখানকার অধিবাসীদেরকে এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তা মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত কর যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত কর যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তাদের সম্পদে ছাদাক্বাহ (যাকাত) ফরয করেছেন। যেটা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গৃহীত হবে আর দরিদ্রের মাঝে বণ্টন করা হবে’।

আলোচ্য হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, সর্বপ্রথম মানুষের আক্বীদাহ সংশোধনের দাওয়াত দিতে হবে। কেননা আক্বীদাই হ’ল ইসলামের মৌলিক বিষয়। আক্বীদাহ সংশোধনের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশের পরেই ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত সহ ইসলামের যাবতীয় বিধান মেনে চলতে হবে। অন্যথা তার ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হবে না।

তৃতীয়ত, আমি অবাক হই। এসব বক্তা সাহেবের কথা শুনে বড়োই আশ্চর্য হই। কীভাবে একথা বলা যায় যে, ‘আক্বীদাহ বিষয়ক অনেক বক্তব্য রয়েছে, আমার আর সেসব বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই?! আপনি সৌদি আরবের দিকে চেয়ে দেখেন? তাওহীদের দেশ। কবরপূজা হয়? পীর-মুরীদীর ব্যবসা আছে? নাই। তারপরও কীভাবে সেখানের ‘আলিম ও দা‘ঈগণ একের পর এক তাওহীদ ও ‘আক্বীদাহর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন? একের পর এক তাওহীদ ও ‘আক্বীদাহর বই লিখছেন? বাংলা ভাষায় কয়টা ‘আক্বীদাহ ও মানহাজের বইপুস্তকের দারস দিয়ে শেষ করা হয়েছে? বলুন, কয়টা? যাও বা কয়েকটা হয়েছে, তার বেশিরভাগই করেছেন উস্তায মতিউর রহমান মাদানী এবং তাঁর মতো কয়েকজন দা‘ঈ।

একটা তথ্য দিই। অবাক হয়ে যাবেন। তাওহীদের দেশ সৌদি আরবের একজন প্রখ্যাত ‘আলিমে দ্বীন এবং বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ হলেন ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ)। তিনি ইমাম মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দুল ওয়াহহাবের লেখা কিতাবুত তাওহীদের ওপর কতগুলো কাজ করেছেন, জানেন? অবাক হয়ে যাবেন। এই বইয়ের ওপর তাঁর চারটি কাজ আছে। কিতাবুত তাওহীদের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা লিখেছেন, প্রায় চার শতাধিক পৃষ্ঠার বই। কিতাবুত তাওহীদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখেছেন দুই খণ্ডে, প্রায় আট শতাধিক পৃষ্ঠার গ্রন্থ।

কিতাবুত তাওহীদের একটা ব্যাখ্যা লিখেছেন মূল লেখক ইমাম মুহাম্মাদের নাতি ইমাম ‘আব্দুর রহমান বিন হাসান আলুশ শাইখ। ব্যাখ্যা গ্রন্থের নাম ফাতহুল মাজীদ, যা বাংলাদেশের অনেক আহলেহাদীস মাদরাসায় পড়ানো হয়। ইমাম ফাওযান ওই ফাতহুল মাজীদের ব্যাখ্যা করে দারস দিয়েছেন। অনুরূপভাবে ইমাম মুহাম্মাদের নাতি ইমাম ‘আব্দুর রহমান কিতাবুত তাওহীদের আরেকটি ব্যাখ্যা লিখেছেন, যার নাম কুররাতু ‘উয়ূনিল মুওয়াহহিদীন (এটা উস্তায শাহেদ মাদানী অনুবাদ করেছেন, ‘তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি’ শিরোনামে)। ইমাম ফাওযান এই ব্যাখ্যার ওপর টীকা দিয়েছেন। একটা বইয়ের ওপর কয়বার কাজ করছেন একজন ইমাম! বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?! যদিও ইমাম ফাওযানের পূর্বে বহু ‘আলিম বইটির বড়ো বড়ো ব্যাখ্যা লিখে গেছেন, তারপরও তিনি বইটির ব্যাখ্যা করা থেকে পিছপা হননি। কীসের কারণে? ‘আক্বীদাহর গুরুত্বের কারণে।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের উসূলুস সুন্নাহ। ইমাম রাবী‘ আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) এই বইটির ব্যাখ্যা করেছেন। অথচ আরও অনেক ‘আলিম বইটির ব্যাখ্যা করেছেন। ‘আল্লামাহ ‘আব্দুল ‘আযীয রাজিহী, ‘আল্লামাহ সা‘দ আশ-শিসরী, ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ রাসলান-সহ আরও অনেকে বইটির ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা কি একথা বলেছেন যে, আরে অমুক ‘আলিম তো ব্যাখ্যা করেই ফেলেছেন, আমি আর কী করব?! স্মর্তব্য যে, বাংলা ভাষায় এই বইটির ব্যাখ্যা নেই। তো বক্তা সাহেব এই বইটার দারস দিয়ে দিন। কেউ তো দেননি এখন পর্যন্ত। আরও কত বই পড়ে আছে, যেগুলো ‘আক্বীদাহ ও মানহাজ সংক্রান্ত। কেউ দারস দেননি এখনও। যেমন ইমাম বারবাহারীর শারহুস সুন্নাহ। কেউ দারস দেননি, আপনি দিয়ে দিন।

.

‘ইলম নিতে হবে বিশুদ্ধ মানহাজের ‘আলিমের নিকট থেকে:

যে বক্তা বা দা‘ঈর ‘আক্বীদাহ ও মানহাজ অস্পষ্ট, তার নিকট থেকে ‘ইলম গ্রহণ করা যায় না। ‘ইলম নিতে হলে ব্যক্তির অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিতে হয় এবং যোগ্য ব্যক্তির নিকট থেকে ‘ইলম নিতে হয়। এটা সালাফদের শিক্ষা। প্রখ্যাত তাবি‘ঈ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১১০ হি.] বলেছেন,
ﺇِﻥَّ ﻫَﺬَﺍ ﺍﻟْﻌِﻠْﻢَ ﺩِﻳﻦٌ ﻓَﺎﻧْﻈُﺮُﻭﺍ ﻋَﻤَّﻦْ ﺗَﺄْﺧُﺬُﻭﻥَ ﺩِﻳﻨَﻜُﻢْ.
“নিশ্চয় এ ‘ইলম হলো দ্বীন। কাজেই কার কাছ থেকে তোমরা দ্বীন গ্রহণ করছ তা যাচাই করে নাও।” [সাহীহ মুসলিম, ‘ভূমিকা’; পরিচ্ছেদ- ৫]
.
এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফ্বাকীহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন,
শির্ক এবং তা‘ত্বীল (আল্লাহ’র সিফাতকে অস্বীকার করা) এর মাধ্যমে ‘আক্বীদাহর ক্ষেত্রে বিপথগামী, তাদের নিকট থেকে ‘ইলম গ্রহণ করা জায়েজ নয়। এবং বিদ‘আতী ও ভ্রষ্টদের নিকট থেকে ‘ইলম নেওয়া জায়েজ নেই, যদিও তাদেরকে ‘আলিম নামে অভিহিত করা হয়।
[সাহাব ডট নেটে প্রকাশিত ‘দ্বরূরাতু আখযিল ‘ইলম মিন আহলিহী’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে]
. উপসংহার:
পরিশেষে বলছি, প্রত্যেক দা‘ঈকে তাঁর ‘আক্বীদাহ ও মানহাজগত অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। নতুবা তাঁদের নিকট থেকে ‘ইলম নেওয়া নিরাপদ নয়। শাসকের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান কী, আল্লাহ’র সিফাতের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান কী, বিদ‘আতীদের রদ করা ও সমালোচনা করার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান কী—ইত্যাদি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। অন্যথায় তার নিকট থেকে ‘ইলম নেওয়া নিরাপদ নয়।

আমরা সকল দা‘ঈকে আহ্বান করছি, তাঁরা যেন তাঁদের আক্বীদাহ ও মানহাজগত অবস্থান স্পষ্ট করেন এবং বর্তমান যুগের বিদ‘আতী মতাদর্শের ব্যাপারেও তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেন। আল্লাহ আমাদেরকে এই বিষয়গুলো বোঝার তাওফীক্ব দিন। আমীন, ইয়া রব্বাল ‘আলামীন।
. সংকলন:
এক আল্লাহর গোলাম,
আখতার বিন আমীর।

Post a Comment

0 Comments