Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামাতে দ্বীন! [ ১ম পর্ব ]

নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিট করুন
-------------------------------------------------------------------
প্রারাম্ভিকা,
পাকিস্তানের মাওলানা আবুল আ‘লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খৃষ্টাব্দ) ১৯৪১ সালের ২৬ আগষ্ট উক্ত দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইন্ডিয়ার অন্ধ্র প্রদেশের আওরঙ্গবাদ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। অবশ্য ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের লাহোরে চলে যান এবং সেখানেই বাকী জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি ‘ইক্বামতে দ্বীনের’ এমন ব্যাখ্যা দান করেন, যা ইতিপূর্বে কেউ দেননি। উক্ত দলের কতিপয় দাবী হল,

(ক) ‘দ্বীন’ অর্থ হুকুমত বা রাষ্ট্রক্ষমতা। তাই ‘ইক্বামতে দ্বীন’ বলতে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন কায়েম করা।
(খ) রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব অন্যথা সম্ভব নয়
(গ) রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ছাড়া ঐ ইসলাম ইসলামই নয়।
(ঘ) প্রত্যেক নবী-রাসূল সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
আরো বলা হয়েছে, তাঁরা শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে দ্বীন ক্বায়েমের কাজ করেছেন। উক্ত বক্তব্যগুলো বিভ্রান্তিকর। ক্ষমতার লালসা থেকেই উক্ত দর্শনের জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে নবী-রাসূলগণকে এর সাথে জড়িয়ে তাঁদের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে।

(এক) ‘ইক্বামতে দ্বীন’ অর্থ হুকুমত বা রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করাঃ

মাওলানা আবুল আ‘লা মওদূদী দ্বীন সম্পর্কে বলেন,
‘দ্বীন আসলে হুকুমতের নাম। শরী‘আত হল ঐ হুকুমতের সংবিধান। আর ইবাদত হল ঐ আইন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’। [দলীলঃ আবুল আ‘লা মওদূদী, খুত্ববাত (উর্দু) (দিল্লী : মারকাযী মাকতাবা ইসলাম, ১৯৮৭), পৃষ্ঠা ৩২০; প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি, (২য় সংস্করণ ২০১৬) পৃষ্ঠা ১৬।]
.

উক্ত দাবীকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য পবিত্র কুরআনের ৪২ নম্বর সূরা সূরা শূরার ১৩ নং আয়াতের দ্বারা আলোচনার মাধ্যমে তিনি হুকুমত বা রাষ্ট্র কায়েম করা বুঝাতে চেয়েছেন। যেমন তিনি এক জায়গায় বলেন, ‘নবী-রসূলগণ আলাইহিমুস সালাম এ দু’টি কাজ করতেই আদিষ্ট ছিলেন। তাঁদের প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, যেখানে এই দীন কায়েম নেই সেখানে তা কায়েম করা। আর দ্বিতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল যেখানে তা কায়েম হবে কিংবা পূর্ব থেকেই কায়েম আছে সেখানে তা কায়েম রাখা।

অন্যত্র তিনি ভুল ধরে বলেন, ‘তারা ধরে নিয়েছে যে, এ দীন অর্থ নিশ্চয়ই শরীআতের আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান নয়, এর অর্থ শুধু তাওহীদ, আখেরাত, কিতাব ও নবুওয়াতকে মানা এবং আল্লাহ্‌র ইবাদাত করা। কিংবা বড় জোর তার মধ্যে শরীয়তের সেই সব বড় বড় নৈতিক নীতিমালাও অন্তর্ভুক্ত যা সমস্ত দীনের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু এটি একটি অপরিপক্ক মত’। [দলীলঃ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, অনুবাদ : মাওলানা মুজাম্মিল হক, তাফহীমুল কুরআন (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, অক্টোবর-১৯৯৭), ১৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০-৬১, ৪২ নম্বর সূরা সূরা আল শূরার ১৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।]
.

অন্যদিকে তিনি ছালাত (নামায), ছিয়াম (রোজা) সম্পর্কে বলেন,
‘আসলে ছওম (রোজা), ছালাত (নামায), হজ্জ, যাকাত এবং যিকির তাসবীহ মানুষকে উক্ত ‘বড় ইবাদত’ অর্থাৎ ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতকারী ‘ট্রেনিং কোর্স’ মাত্র। [দলীলঃ আবুল আ‘লা মওদূদী, তাফহীমাত (উর্দু) (দিল্লী : মারকাযী মাকতবা ইসলামী’ জানুয়ারী, ১৯৭৯), ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৯।]

.

পর্যালোচনাঃ

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি পূর্বসুরী সালাফী বিদ্বানগণের পথ অনুসরণ করেননি। কারণ পূর্বসূরী সকল মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরাম ইক্বামতে দ্বীন অর্থ করেছেন ‘তাওহীদ কায়েম করা’। যেমন প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী (মৃতঃ ৪০৬ হিজরী) বলেন,

‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর’ অর্থ হলঃ আল্লাহ্‌র তাওহীদ ও তাঁর আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া রাসূলগণের উপরে, কিতাব সমূহের উপরে, ক্বিয়ামাত দিবসের উপরে এবং একজন মানুষকে মুসলিম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব বিষয় প্রয়োজন, সবকিছুর উপরে ঈমান আনয়ন কর’। অতঃপর তিনি পৃথিবীর নবী-রাসূলগণের ইক্বামতে দ্বীনের রূপরেখা উল্লেখ করেছেন,

‘অর্থাৎ দ্বীনের মূলনীতি সমূহ, শরী‘আত যাতে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেনি। আর তা তাওহীদ, ছালাত (নামায), যাকাত, ছিয়াম (রোজা), হজ্জ এবং সৎ আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভ করা; যা অন্তরে উদিত হয় তার দ্বারা নৈকট্য হাসিল করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে তার দিকে রুজু করা। সত্যবাদিতা, অঙ্গীকার পূরণ করা, আমানত ফেরত দেয়া, আত্মীয় সম্পর্ক অটুট রাখা। এছাড়া কুফুরী, হত্যা, যেনা এবং সৃষ্টিকে যেকোনভাবে কষ্ট দেয়া হারাম মনে করা। অনুরূপ যেকোনভাবে প্রাণীর উপর অত্যাচার করা, নিকৃষ্ট কাজে প্রবৃত্ত হওয়া এবং যে সমস্ত কর্ম মনুষ্যত্ব নষ্ট করে, সেগুলোকে হারাম মনে করা। এগুলো সবই শরী‘আত, একই দ্বীন এবং একই মিল্লাতভুক্ত। নবীগণের মুখে এগুলো পৃথকভাবে বর্ণিত হয়নি; যদিও তাঁদের সংখ্যা অনেক ছিল। আর এটাই আল্লাহ্‌র কথা ‘আপনারা দ্বীন কায়েম করুন; এর মধ্য বিভেদ সৃষ্টি করবেন না। [দলীলঃ তাফসীরে কুরতুবী ১৬/১০-১১ পৃষ্ঠা। আবুল কাসেম মাহমূদ বিন ওমর আয-যামাখশারী আল-খাওয়ারেযমী, আল-কাশশাফ আন হাক্বাইক্বিত তানযীল ওয়া উয়ূনিল আক্বাবিল ফী উজূহিত তা’বীল (বৈরুত : দারু ইহইয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, তাবি), ৪/২১৯ পৃষ্ঠা]।
.

এভাবেই পূর্বের সকল মুফাসসির দ্বীন কায়েম অর্থ করেছেন ‘তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা’। কিন্তু মওদূদী ছাহেব তা গ্রহণ করেননি; বরং সমালোচনা করেছেন এবং শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন কায়েমকেই ‘ইক্বামতে দ্বীন’ বলে উল্লেখ করেছেন।

উক্ত দাবীর মূল কথা হল, ‘রাজনীতিই ধর্ম’, যা আধুনিক বিজাতীয় মতবাদ সমূহের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ শতকের মাঝামাঝিতে জন্ম হয়েছে। মূলতঃ চরমপন্থী মতবাদ নতুন আঙ্গিকে চালু হয়েছে। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে যেকোনভাবে ‘রাষ্ট্রক্ষমতা’ দখল করাই মূল টার্গেট। তাই উক্ত দলের অনুসারীরা সর্বাগ্রে রাষ্ট্র কায়েম করাকেই ‘বড় ইবাদত’ মনে করে থাকে। এটা অর্জন ব্যতীত শরী‘আত বা ইবাদত বলতে যে কিছুই নেই, সেটাও তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকে।

[ চলবে ]

Post a Comment

0 Comments