সূরা নছর
(সাহায্য)
সূরা তওবাহর পরে মদীনায় অবতীর্ণ
কুরআনের সর্বশেষ সূরা।
সূরা ১১০, আয়াত ৩, শব্দ ১৯, বর্ণ ৭৯।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও (মক্কা) বিজয় |
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ
|
(২) এবং তুমি মানুষকে দেখছ তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে (ইসলামে) প্রবেশ করছে |
وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا
|
(৩) তখন তুমি তোমার পালনকর্তার প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তাঁর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী। |
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا
|
বিষয়বস্ত্ত :
মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গোত্রীয় প্রতিনিধিদল মদীনায় আসতে থাকে এবং দলে দলে মানুষ মুসলমান হতে থাকে, সেকথা বলা হয়েছে প্রথম দু’টি আয়াতে। অতঃপর উক্ত অনুগ্রহ লাভের শুকরিয়া স্বরূপ রাসূলের উচিত আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করা এবং বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করা, একথাগুলি বলা হয়েছে তৃতীয় অর্থাৎ শেষ আয়াতে।
গুরুত্ব :
(১) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) একবার ওবায়দুল্লাহ বিন ওৎবা (রাঃ)-কে বলেন, কুরআনের কোন সূরাটি সবশেষে নাযিল হয়েছে জানো কি? ওবায়দুল্লাহ বললেন, জানি, সূরা নছর। ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ’।[1]
(২) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, সূরাটি বিদায় হজ্জে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী সময়ে মিনায় নাযিল হয়। অতঃপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন’ (বায়হাক্বী ৫/১৫২, হা/৯৪৬৪)।
(৩) ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় মিনাতে অত্র সূরাটি নাযিল হয়। অতঃপর একই সময়ে নাযিল হয় ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার সেই বিখ্যাত আয়াতটি اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْناً، ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য আমি ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। এটা ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৮০ দিন পূর্বের ঘটনা। অতঃপর মৃত্যুর ৫০দিন পূর্বে নাযিল হয় কালালাহর বিখ্যাত আয়াতটি (নিসা ৪/১৭৬)। অতঃপর মৃত্যুর ৩৫ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা তওবাহর সর্বশেষ দু’টি আয়াত-
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ، فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ-
‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট যার উপরে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু’। ‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও যে, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। তিনি মহান আরশের অধিপতি’ (তওবাহ ৯/১২৮-১২৯)। অতঃপর মৃত্যুর ২১ দিন মতান্তরে ৭ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা বাক্বারাহর ২৮১ আয়াতটি-
وَاتَّقُواْ يَوْماً تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ-
‘আর তোমরা ভয় কর ঐ দিনকে, যেদিন তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মফল পুরোপুরি পাবে। আর তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১; কুরতুবী, সূরা নছর)।
উপরের আলোচনায় একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সূরা নছর কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণাংগ সূরা হিসাবে বিদায় হজ্জের সময় নাযিল হয়েছে। এরপরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আয়াত নাযিল হলেও কোন পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়নি।
(৪) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদিন ওমর (রাঃ) জ্যেষ্ঠ বদরী ছাহাবীদের মজলিসে আমাকে ডেকে বসালেন। এতে অনেকে সংকোচ বোধ করেন। প্রবীণতম ছাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) বলেন, أتسأله ولنا بنون مثله ‘আপনি ওকে জিজ্ঞেস করবেন? অথচ ওর বয়সের ছেলেরা আমাদের ঘরে রয়েছে’। ওমর (রাঃ) বললেন, সত্বর জানতে পারবেন’। অতঃপর তিনি সবাইকে সূরা নছরের তাৎপর্য জিজ্ঞেস করলেন। তখন সকলে প্রায় একই জওয়াব দিলেন যে, ‘এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যখন বিজয় লাভ হবে, তখন যেন তিনি তওবা-ইস্তেগফার করেন’। এবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, إِنَّمَا هُوَ أَجَلُ رَسُوْل ِاللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعْلَمَهُ إِيَّاهُ-‘এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূলের মৃত্যু ঘনিয়ে আসার খবর দিয়েছেন’। অতঃপর বললাম, إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ ‘যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ অর্থ فذلك علامة موتك ‘এটাতে আপনার মৃত্যুর আলামত এসে গেছে’। অতঃপর فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ ‘এক্ষণে তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর ও তওবা-ইস্তেগফার কর’।
এ ব্যাখ্যা শোনার পর ওমর (রাঃ) বললেন, تَلُوْمُوْنِىْ عَلَيْهِ؟ وَاللهِ مَا أَعْلَمُ مِنْهَا إِلاَّ مَا تَعْلَمُ-‘আপনারা আমাকে এই ছেলের ব্যাপারে তিরষ্কার করছিলেন? আল্লাহর কসম! হে ইবনে আববাস! তুমি যা বলেছ, এর বাইরে আমি এর অর্থ অন্য কিছুই জানিনা’।[2] এজন্য এ সূরাকে সূরা তাওদী‘ (التوديع) বা ‘বিদায় দানকারী’ সূরা বলা হয় (কুরতুবী)। কেননা এ সূরার মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর চির বিদায়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
তাফসীর :
(১) إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ ‘যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও (মক্কা) বিজয়’। ‘আল্লাহর সাহায্য’ বলতে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধসমূহে আল্লাহর সাহায্য। যেমন বদর, ওহোদ, খন্দক, খায়বার প্রভৃতি যুদ্ধে। অতঃপর ‘বিজয়’ অর্থ ‘মক্কা বিজয়’ যা ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার সকালে সংঘটিত হয়েছিল। এখানে عطف الخاص على العام হয়েছে। অর্থাৎ সকল সাহায্য, বিশেষ করে মক্কা বিজয়। যেমন বলা হয়েছে, تَنَزَّلُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوحُ فِيْهَا‘(ক্বদরের রাত্রিতে) নাযিল হয় ফেরেশতামন্ডলী ও জিব্রীল’ (ক্বদর ৯৭/৪)। এর মাধ্যমে মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে।
ইমাম কুরতুবী বলেন, এখানে إِذَا অর্থ قَدْ অর্থাৎ جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ قَدْ ‘অবশ্যই এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ (কুরতুবী)। কেননা সূরা নছর নাযিল হয়েছে মক্কা বিজয়ের প্রায় সোয়া দু’বছর পরে ১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের সম্ভবত ১২ তারিখে মিনায় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী সময়ে। সেকারণ إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ এরূপ অর্থ করা ঠিক হবে না।[3] তাছাড়া إِذَا হ’ল تحقيق বা নিশ্চয়তাবোধক অব্যয়, যা إِنْ -এর বিপরীত। কেননা إِنْ হ’ল সন্দেহ বা অনিশ্চয়তাবোধক অব্যয় (তানতাভী)।
إِذَا সাধারণত শর্তের অর্থ দেয়, যা ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হয়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ ‘যখন তুমি সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও’।[4]কিন্তু إِذَا ‘নিশ্চয়তা’ অর্থেও আসে, যা নিশ্চিতভাবে ঘটে গেছে ও ঘটছে। যেমন মসজিদে নববীতে জুম‘আর খুৎবারত অবস্থায় দেহিইয়াহ বিন খলীফা (তখন অমুসলিম ছিলেন) তবলা বাজাতে বাজাতে তার ব্যবসায়িক মালামাল নিয়ে মদীনায় উপস্থিত হন। তাতে আববাস ও ওমর (রাঃ) সহ মাত্র ১২ জন বাদে সব মুছল্লী দ্রুত বেরিয়ে যান। সে উপলক্ষে আয়াত নাযিল হয়, وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوْا إِلَيْهَا وَتَرَكُوْكَ قَائِمًا ‘আর যখন তারা ব্যবসা বা খেল-তামাশা দেখল, তখন তারা তোমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে গেল’।[5]এখানে إِذَا ভবিষ্যৎ অর্থে নয় বরং বর্তমান ও নিশ্চিত অর্থে এসেছে।
(২) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجاً ‘এবং তুমি মানুষকে দেখছ তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে (ইসলামে) প্রবেশ করছে’।
মক্কা বিজয়ের পরের বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরীকে ইতিহাসে عام الوفود ‘প্রতিনিধি দলসমূহের আগমনের বছর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐ সময় আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দলে দলে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করছিল। আব্দুল ক্বায়েস গোত্র, ছাক্বীফ গোত্র, ইয়ামন, হামাদান, নাজরান, তাঈ, আশ‘আরী ও সর্বশেষ নাখ্ঈ গোত্রের প্রতিনিধিদল সহ জীবনীকারগণ ৭০-এর অধিক প্রতিনিধিদলের বর্ণনা দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পরে দলে দলে ইসলাম কবুলের অন্যতম কারণ ছিল বিশ্বাসগত। কারণ লোকেরা তখন বলতে থাকলো, যে হারাম শরীফকে আল্লাহ্ হস্তীওয়ালাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই হারামের তত্ত্বাবধায়ক তার কওমের উপর যখন মুহাম্মাদ জয়লাভ করেছেন, তখন তিনি অবশ্যই সত্য নবী (إِنْ ظَهَرَ عَلَي قَوْمِهِ فَهُوَ نَبِىٌّ صَادِقٌ)।[6]
ইকরিমা ও মুক্বাতিল বলেন, وَرَأَيْتَ النَّاسَ বলতে ইয়ামনী প্রতিনিধিদলের দিকে (বিশেষভাবে) ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা এদের প্রায় সাতশো লোক মুসলমান হয়ে কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন পাঠ করতে করতে, কেউ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হন। কিন্তু ওমর ও আববাস (রাঃ) কাঁদতে থাকেন।[7] ইকরিমা ইবনু আববাস হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ খুশী হয়ে বলেন, أَتَاكُمْ أَهْلُ الْيَمَنِ، أَضْعَفُ قُلُوْبًا وَأَرَقُّ أَفْئِدَةً، الْفِقْهُ يَمَانٍ، وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ-‘ইয়ামনবাসীরা তোমাদের কাছে এসে গেছে। এদের অন্তর বড়ই দুর্বল, হৃদয় খুবই নরম। বুঝশক্তি ইয়ামনীদের এবং দূরদর্শিতা ইয়ামনীদের’।[8]
অধিকাংশ প্রতিনিধিদলই খুশী মনে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে ইসলাম কবুল করতেন, কেউবা আগেই ইসলাম কবুল করে মদীনায় আসতেন, যাদের দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত আনন্দিত হ’তেন। কিন্তু দূরদর্শী ছাহাবীগণ কেঁদে বুক ভাসাতেন, যেকোন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর আশংকায়।
(৩) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً ‘তখন তুমি তোমার পালনকর্তার প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তাঁর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী’।
অর্থাৎ سَبِّحْهُ تسبيحًا مقرونًا بالحمد ‘তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর’। ‘তাসবীহ’ অর্থ تنزيه الله تعالى عما لا يليق بشأنه ‘আল্লাহর মর্যাদার উপযুক্ত নয়, এমন সব কিছু থেকে তাঁকে পবিত্র করা’। ‘হামদ’ অর্থ الثناء على الله بالكمال مع المحبة والتعظيم ‘ভালবাসা ও সম্মান সহকারে পূর্ণভাবে আল্লাহর প্রশংসা করা’। অত্র আয়াতে পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনাকে একত্রিত করা হয়েছে। এটি হ’ল আল্লাহর প্রথম নির্দেশ। অতঃপর দ্বিতীয় নির্দেশটি হ’ল, ইস্তিগফার কর। ‘ইস্তিগফার’ অর্থ طلب المغفرة ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর ‘মাগফিরাত’ অর্থ ستر الله تعالى على عبده ذنوبه مع مَحْوِهَا والتجاوز عنها ‘পাপ দূরীকরণ ও ক্ষমার মাধ্যমে বান্দার পাপসমূহের উপর আল্লাহর পর্দা আরোপ করা’। বস্ত্ততঃ বান্দার এটাই সবচেয়ে বড় চাওয়া। কেননা বান্দা সর্বদা ভুলকারী। আল্লাহ যদি তাকে দয়া না করেন, তাহ’লে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَنْ يُنَجِّىَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ. قَالُوا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ أَنَا، إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِىَ اللهُ بِرَحْمَتِهِ ‘তোমাদের কেউ তার আমলের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ছাহাবীগণ বললেন, আপনিও নন হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, না। যদি না আল্লাহ আমাকে তাঁর রহমত দ্বারা আবৃত করেন’।[9]
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এর অর্থ فصل حامدا له على ما آتاك من الظفر والفتح وسل الله الغفران‘আল্লাহ তোমাকে যে সফলতা ও বিজয় দান করেছেন, সেজন্য আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর (কুরতুবী)। অর্থাৎ দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে এবং মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। এখন তোমার গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই। অতএব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ কর ও ইস্তিগফার কর। এখানে মক্কা বিজয়কে অধিক গুরুত্ব দেবার কারণ, এটা হ’ল আল্লাহর ঘর। যা ছিল তাওহীদের কেন্দ্রবিন্দু এবং যা ছিল ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর হাতে নির্মিত আল্লাহর ইবাদতগৃহ। অথচ সেটি শিরকের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ আরবরা ভাবত, বায়তুল্লাহর অধিকারীরাই أهل الله বা আল্লাহওয়ালা। যাদেরকে আল্লাহ আবরাহা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। অতএব কা‘বাকে শিরকমুক্ত করা এবং মানুষের ভুল বিশ্বাস ভেঙ্গে দেবার স্বার্থে মক্কা বিজয় খুবই যরূরী ছিল।
تَوَّابٌ -এর ওযন فَعَّالٌ যা اسم فاعل مبالغة যার দ্বারা কর্তার কর্মে আধিক্য বুঝানো হয়। এটি আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বান্দার ক্ষেত্রে হ’লে অর্থ হবে ‘আল্লাহর প্রতি অধিক তওবাকারী (التائب إلى الله) ’ এবং আল্লাহর ক্ষেত্রে হ’লে অর্থ হবে ‘বান্দার তওবা অধিক কবুলকারী (التائب على العبد) ’। এক্ষণে إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً অর্থ لم يزل عز وجل تواباً على عبده، إذا استغفره ‘আল্লাহ সর্বদা বান্দার তওবা কবুলকারী, যখনই সে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে’।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, সূরা নছর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন কোন ছালাত আদায় করেননি, যেখানে রুকূ ও সিজদায় নিম্নের দো‘আটি পাঠ করেননি, سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ ‘সকল পবিত্রতা তোমার হে আল্লাহ, তুমি আমাদের পালনকর্তা, তোমার জন্যই সকল প্রশংসা, হে আল্লাহ তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।[10]
এতদ্ব্যতীত বুখারী, মুসলিম, আহমাদ প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থে এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বহু দো‘আ বর্ণিত হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর নিকটে নিজের দীনতা প্রকাশ করতেন এবং তাঁকে যে পুরস্কার আল্লাহ দান করেছেন, তার কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপন করতেন।
প্রশ্ন হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর তো আগে-পিছে সব গোনাহ মাফ, এমতাবস্থায় তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার হুকুম দেওয়ার অর্থ কি? এরূপ প্রশ্ন একবার আয়েশা (রাঃ) করলে তার জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا ؟ ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’? [11]
ইমাম কুরতুবী বলেন, الاستغفار تعبُّد يجب إتيانه، لا للمغفرة، بل تعبُّدا ‘ক্ষমা প্রার্থনা হ’ল দাসত্ব প্রকাশ করা, যা আল্লাহর নিকটে পেশ করা ওয়াজিব। ক্ষমার জন্য নয় বরং দাসত্ব প্রকাশের জন্য’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ আল্লাহর প্রতি অধিকহারে বিনয় ও দাসত্ব পেশ করা।
তিনি বলেন, এর মধ্যে তাঁর উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যেন তারা শংকাহীন না হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা ছেড়ে না দেয়। তিনি বলেন, নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও যখন আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন অন্যদের কেমন করা উচিত? (কুরতুবী)।
অন্য হাদীছে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দৈনিক একশো বার তওবা- ইস্তেগফার করতেন ও নিম্নের দো‘আটি পাঠ করতেন-
أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
‘আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে’(আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক এবং আমি তাঁর দিকেই ফিরে যাচ্ছি (বা তওবা করছি)।[12]
সারকথা :
আল্লাহর রহমত লাভের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। অতঃপর আল্লাহর সাহায্য লাভ করলে তাঁর প্রতি অধিকতর অনুগত ও ক্ষমাপ্রার্থী হ’তে হবে।
[1]. মুসলিম হা/৩০২৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[2]. বুখারী হা/৩৬২৭; তিরমিযী হা/৩৩৬২; কুরতুবী হা/৬৫০৯; ইবনু কাছীর।
[3]. যেমন করেছেন মাওলানা মহিউদ্দীন খান, ড. মুজীবুর রহমান, মাওলানা মওদূদী (উর্দু), মাওলানা ছালাহুদ্দীন ইউসুফ (উর্দু ও তার বঙ্গানুবাদ) ও ইফাবা, ঢাকা। তবে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী স্বীয় ইংরেজী তাফসীরে যথার্থ অনুবাদ করেছেন When comes the help of God. যদিও God না বলে Allah বলা উচিৎ ছিল।
[4]. আহমাদ, তিরমিযী হা/২৫১৬, মিশকাত হা/৫৩০২।
[5]. জুম‘আ ৬২/১১; বুখারী হা/৪৮৯৯, মুসলিম, তিরমিযী হা/৩৩১১ প্রভৃতি।
[6]. বুখারী হা/৪৩০২; ‘মাগাযী’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১১২৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ-২৬।
[7]. কুরতুবী ‘ইবনু আববাস’ এবং তানতাভী ‘আববাস’ বলেছেন। সম্ভবত আববাসই সঠিক।
[8]. বুখারী হা/৪৩৯০, মুসলিম হা/৫২; মিশকাত হা/৬২৫৮; কুরতুবী হা/৬৫০৩।
[9]. বুখারী হা/৬৪৬৩; মুসলিম হা/২৮১৬; মিশকাত হা/২৩৭১ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ।
[10]. বুখারী হা/৭৯৪, মুসলিম/৪৮৪; মিশকাত হা/৮৭১; কুরতুবী হা/৬৫০৭।
[11]. বুখারী হা/১১৩০, মুসলিম হা/২৮১৯-২০; মিশকাত হা/১২২০ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।
0 Comments