Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

সূরা তারেক (মাক্কী)সূরা ৮৬,(রাত্রিতে আগমনকারী)

নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিট করুন https://rasikulindia.blogspot.com/ ইসলামিক বই

সূরা তারেক
(রাত্রিতে আগমনকারী)
সূরা বালাদ-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৮৬, আয়াত ১৭, শব্দ ৬১, বর্ণ ২৪৯।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) শপথ আকাশের ও রাত্রিতে আগমনকারীর।
وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ
(২) তুমি কি জানো রাত্রিতে আগমনকারী কি?
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ
(৩) তা হ’ল উজ্জ্বল নক্ষত্র।
النَّجْمُ الثَّاقِبُ
(৪) নিশ্চয়ই প্রত্যেকের উপরে হেফাযতকারী রয়েছে।
إِنْ كُلُّ نَفْسٍ لَمَّا عَلَيْهَا حَافِظٌ
(৫) অতএব মানুষের দেখা উচিত সে কোন্ বস্ত্ত হ’তে সৃষ্ট হয়েছে।
فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ
(৬) সে সৃষ্ট হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি হ’তে।
خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ
(৭) যা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও বুকের মধ্যস্থল হ’তে।

يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ
(৮) নিশ্চয় তিনি তাকে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম।
إِنَّهُ عَلَى رَجْعِهِ لَقَادِرٌ
(৯) যেদিন গোপন বিষয়াদি পরীক্ষিত হবে
يَوْمَ تُبْلَى السَّرَائِرُ
(১০) সেদিন তার কোন শক্তি থাকবে না বা কোন সাহায্যকারী থাকবে না।
فَمَا لَهُ مِنْ قُوَّةٍ وَلَا نَاصِرٍ
(১১) শপথ বর্ষণশীল আকাশের
وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الرَّجْعِ
(১২) এবং বিদারণশীল পৃথিবীর।
وَالْأَرْضِ ذَاتِ الصَّدْعِ
(১৩) নিশ্চয়ই এ কুরআন সিদ্ধান্তকারী বাণী
إِنَّهُ لَقَوْلٌ فَصْلٌ
(১৪) এবং এটি কোন বৃথাবাক্য নয়।
وَمَا هُوَ بِالْهَزْلِ
(১৫) নিশ্চয় তারা দারুণভাবে চক্রান্ত করে।
إِنَّهُمْ يَكِيدُونَ كَيْدًا
(১৬) আর আমিও যথাযথ কৌশল করি।
وَأَكِيدُ كَيْدًا
(১৭) অতএব অবিশ্বাসীদের সুযোগ দাও, ওদের অবকাশ দাও কিছু দিনের জন্য।                          
فَمَهِّلِ الْكَافِرِينَ أَمْهِلْهُمْ رُوَيْدًا
গুরুত্ব :
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, একদিন মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) মহল্লার মসজিদে মাগরিবের অথবা এশার জামা‘আতে ইমামতির সময় সূরা বাক্বারাহ অথবা সূরা নিসা তেলাওয়াত করেন। এতে অভিযোগ এলে রাসূল (ছাঃ) তাকে ডেকে বলেন,أَفَتَّانٌ يَا مُعَاذُ؟ أَمَا كَانَ يَكْفِيْكَ أَنْ تَقْرَأ وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ، وَالشَّمْشِ وَضُحَاهَا وَنَحْوَ هَذَا؟ ‘হে মু‘আয তুমি কি ফিৎনাকারী? সূরা তারেক, শামস বা অনুরূপ কোন সূরা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়’? [1]
বিষয়বস্ত্ত :
সূরাটি ছোট হ’লেও এতে রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের সমাহার। যেমন আকাশের সৌন্দর্য বর্ণনা, নক্ষত্ররাজির আগমন-নির্গমন, ফেরেশতামন্ডলীর তত্ত্বাবধানকার্য, মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টির কৌশল, ক্বিয়ামতের দিন মানুষের জওয়াবদিহিতার হুঁশিয়ারি, সত্য ও মিথ্যার মানদন্ড হিসাবে কুরআনের গুরুত্ব বর্ণনা এবং অবিশ্বাসীদের যাবতীয় কৌশল যে অবশেষে ব্যর্থ হবে, তার বর্ণনা।
তাফসীর :
(১-৩) وَالسَّمَآءِ وَالطَّارِقِ، وَمَا أَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ، النَّجْمُ الثَّاقِبُ- ‘শপথ আকাশের ও রাত্রিতে আগমনকারীর’। ‘তুমি কি জানো রাত্রিতে আগমনকারী কি?’ ‘তা হ’ল উজ্জ্বল নক্ষত্র’।
এখানে وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ বলে ‘আকাশ ও নক্ষত্ররাজি’ পরপর দু’টি বিষয়ে শপথ করা হয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, وَالسَّمَاءِ وَمَا يَطْرُقُ فِيْهَا ‘আকাশ ও সেখানে যা রাত্রিতে আগমন করে’। মাওয়ার্দী বলেন, اَلطَّارِقُ -এর মূল হ’ল الطَّرْقُ যার অর্থ الدَّقُّ ‘ধাক্কানো, খটখটানো’। সেখান থেকে হয়েছে اَلْمِطْرَقَةُ ‘হাতুড়ি’। আভিধানিক অর্থে দিনে বা রাতে যেকোন সময়ের আগন্তুককে ‘তারেক’ বলা যায়। কেননা তিনি এলে দরজায় করাঘাত করেন। তবে আরবরা প্রত্যেক রাত্রির আগমুতককে ‘তারেক’ বলে থাকে (কুরতুবী)। আল্লাহ এখানে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন النَّجْمُ الثَّاقِبُ অর্থাৎ ‘উজ্জ্বল তারকা’ বলে। কেননা তা রাতের আকাশে আগমন করে ও উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়।
الثَّاقِبُ এর মূল الثقب ‘ছিদ্র’। এখানে الثاقب বিশেষণ এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে كأنه يثقُب الظلامَ بضوئه فينفُذ فيه ‘যেন সে তার আলো দ্বারা অন্ধকার ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়’। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيْحَ،  ‘আমরা দুনিয়ার আকাশকে সুসজ্জিত করেছি অসংখ্য দীপালীর মাধ্যমে’ (মুল্ক ৬৭/৫)
السَّمَاءُ এসেছে سَمُوٌّ থেকে। سَمَا يَسْمُوْ سَمْوًا অর্থ উঁচু হওয়া। যেমন বলা হয় سما اليه بصرى ‘তার দিকে আমার দৃষ্টি পড়ল’। সেখান থেকে السَّمَاءُ অর্থ ‘আকাশ’। যা উচ্চে অবস্থিত। আকাশের সীমানা ও উচ্চতার কোন সীমা-সরহদ নেই। সীমাহীন নীলাকাশের সৌন্দর্য হ’ল তারকারাজি। যা আমরা চর্মচক্ষুতে দেখতে পাই। এগুলি আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি। নক্ষত্ররাজি কেবল আলো দেয় না, এরা রাতের অন্ধকারে আমাদের পথ দেখায়। আল্লাহ বলেন, وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُوْنَ ‘তারকারাজির মাধ্যমে লোকেরা পথ খুঁজে পায়’ (নাহল ১৬/১৬)। তারকারাজির সংখ্যারও কোন শেষ নেই। এমন বহু নক্ষত্র রয়েছে, যাদের আলো লক্ষ লক্ষ বছর পরেও পৃথিবীতে এসে পৌঁছবে কি-না সন্দেহ। মানুষের তুলনায় এসব সৃষ্টির বিশালতা বুঝানোর জন্যই আল্লাহ এখানে আকাশ ও তারকারাজির শপথ করেছেন।
الطَّارِقُ  الثَّاقِبُ শব্দ দু’টি একবচন হ’লেও এখানে إسم جنس বা জাতিবোধক বিশেষ্য হয়েছে। অর্থাৎ রাত্রির উজ্জ্বল তারকারাজি।
(৪) إِنْ كُلُّ نَفْسٍ لَّمَّا عَلَيْهَا حَافِظٌ ‘প্রত্যেকের উপরে হেফাযতকারী রয়েছে’।
এটি পূর্বের তিনটি আয়াতে বর্ণিত শপথের জওয়াব। আল্লাহপাক এখানে আকাশ ও নক্ষত্ররাজির শপথ করে বলছেন যে, প্রত্যেকের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। এই ফেরেশতা তাকে প্রতি মুহূর্তে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। তার দুনিয়াবী জীবনের ও দৈহিক স্বাস্থ্যের শৃংখলা বিধান করে। তার দেহের রক্ত চলাচল, হযমশক্তি, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি, নিদ্রা ও চিন্তাশক্তি প্রভৃতি ঠিক রাখে। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে ফেরেশতামন্ডলী নিযুক্ত রয়েছে। যারা তাকে সর্বদা বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে। তবে যেটা তাক্বদীরে পূর্ব নির্ধারিত থাকে, সেটা এসেই যায়।
إِنْ ‘না’ বোধক (نافية) হয়েছে। অর্থ مَا كُلُّ نَفْسٍ ‘এমন কোন প্রাণী নেই’। لَمَّا তাশদীদযুক্ত অথবা তাশদীদমুক্ত (لَمَا) দু’ভাবেই পড়া যায়। প্রথমটির অর্থ হবে ما كل نفس إلا عليها حافظ‘এমন কোন প্রাণী নেই, যার উপরে তত্ত্বাবধায়ক নেই’। এ সময়مَا  ‘না’ বোধক (نافية)হবে। আর দ্বিতীয়টা পড়লে অর্থ হবে كل نفس لَعليها حافظ ‘প্রত্যেক প্রাণীর উপরে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক রয়েছে’। এ সময় مَا অতিরিক্ত (زائدة) হবে এবং لَ নিশ্চয়তাবোধক (لام تأكيد)হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِيْنَ، كِرَامًا كَاتِبِينَ، يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের উপর রয়েছে তত্ত্বাবধায়কগণ’। ‘সম্মানিত লেখকবর্গ’। ‘তোমরা যা কর সবই তারা অবগত হন’ (ইনফিত্বার ৮২/১০-১২)। তিনি বলেন, إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ، مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ ‘মনে রেখ, দু’জন গ্রহণকারী ফেরেশতা ডাইনে ও বামে বসে সর্বক্ষণ কর্ম লিপিবদ্ধ করে’। ‘এভাবে মানুষ যে কথাই মুখে উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য সদা তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৭-১৮)। মূলতঃ হেফাযতকারী হ’লেন আল্লাহ। তিনি হেফাযত না করলে এ দুনিয়ায় কেউ চলতে পারত না। আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতা ছাড়াও মানুষের জ্ঞান ও বিবেক হ’তে পারে সেই তত্ত্বাবধায়ক। যা মানুষকে সর্বদা ভাল ও মন্দ পথ দেখিয়ে থাকে। যাকে হাদীছে وَاعِظُ الله‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে উপদেশদাতা’ বলা হয়েছে।[2] রয়েছে নফসে লাউয়ামাহ (বিবেক), যা মানুষকে সর্বদা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করে ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। রয়েছে নফসে মুত্বমাইন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা), যা সর্বদা মানুষকে সাধুতা ও আল্লাহভীতির প্রেরণা যোগায়।
আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতারা তাকে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক করে ও বিপদাপদ থেকে হেফাযত করে। আল্লাহ বলেন, لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُوْنَهُ مِنْ أَمْرِ اللهِ ‘তার জন্য সম্মুখ থেকে ও পিছন থেকে অনুসরণকারী ফেরেশতারা রয়েছে। যারা তাকে হেফাযত করে আল্লাহর হুকুমে’ (রা‘দ ১৩/১১)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ হ’লেন মূল তত্ত্বাবধায়ক। যেমন তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের তত্ত্বাবধানকারী’ (নিসা ৪/১) وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ رَقِيبًا ‘এবং তিনি সকল বস্ত্তর উপর তত্ত্বাবধায়ক’ (আহযাব ৩৩/৫২)। অতএব فَاللهُ خَيْرٌ حَافِظًا ‘আল্লাহ হ’লেন সর্বোত্তম তত্ত্বাবধায়ক’ (ইউসুফ ১২/৬৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ফেরেশতাদের দু’টি দল রাত্রি ও দিনে বান্দার হেফাযতের জন্য নিযুক্ত রয়েছে। উভয় দল ফজর ও আছরের ছালাতের সময় একত্রিত হয় এবং একে অপরের নিকট দায়িত্ব বদল করে’।[3]
কা‘ব আল-আহবার বলেন, যদি আল্লাহ ফেরেশতা নিয়োগ করে তোমাদের পাহারার ব্যবস্থা না করতেন, তাহ’লে শয়তান জিনেরা তোমাদের উঠিয়ে নিয়ে যেত’ (তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা রা‘দ ১১)। অবশ্য যখন আল্লাহ কোন বান্দাকে কষ্টে নিক্ষেপ করেন, তখন এই রক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যেমন একদিন হযরত আলী (রাঃ) একাকী ছালাত আদায় করছিলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে বলল, আপনি পাহারা নিযুক্ত করুন। জবাবে আলী (রাঃ) বললেন, প্রত্যেক মানুষের সাথে দু’জন করে ফেরেশতা থাকে, যারা তাকে হেফাযত করে। فإذا جاء الْقَدَرُ خَلَّيَا بينه وبينه ‘কিন্তু যখন তাক্বদীর এসে যায়, তখন তারা সরে যায়’ (তাফসীর ইবনু কাছীর, রা‘দ ১১)
অবশ্য এর অর্থ এটা নয় যে, বান্দা তার বাহ্যিক হেফাযতের জন্য কোন ব্যবস্থা নিবে না। বরং বান্দাকে সে নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন (আনফাল ৮/৬০) এবং রাসূল (ছাঃ) নিজের উম্মতের জন্য সে ব্যবস্থা নিয়েছেন। বস্ত্ততঃ নবীজীবনের সকল যুদ্ধ ও জিহাদ দ্বীন ও দ্বীনদারদের হেফাযতের জন্যই হয়েছিল।
উপরের আলোচনায় বুঝা যায় যে, আয়াতে বর্ণিত حَافِظٌ বা তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতা একবচন হ’লেও তার অর্থ হবে ফেরেশতামন্ডলী।
আল্লাহ বলেন, قُلْ مَنْ يَكْلَؤُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ مِنَ الرَّحْمَنِ بَلْ هُمْ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهِمْ مُعْرِضُوْنَ، أَمْ لَهُمْ آلِهَةٌ تَمْنَعُهُمْ مِنْ دُوْنِنَا لاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ نَصْرَ أَنْفُسِهِمْ وَلاَ هُمْ مِنَّا يُصْحَبُوْنَ- ‘তুমি বলে দাও, ‘রহমান’-এর পরিবর্তে কে তোমাদের রক্ষা করে থাকে রাত্রিতে ও দিনে? বরং তারা তাদের প্রতিপালকের স্মরণ হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে’। ‘তবে কি আমরা ব্যতীত তাদের আর কোন উপাস্য আছে যারা তাদেরকে রক্ষা করতে পারে? তারা তো নিজেদেরকেই সাহায্য করতে পারে না। আর আমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না’ (আম্বিয়া ২১/৪২-৪৩)
(৫) فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ ‘অতএব মানুষের দেখা উচিত সে কোন্ বস্ত্ত হ’তে সৃষ্ট হয়েছে’।
فَلْيَنْظُرِ এখানে امر غائب معروف হয়েছে। অর্থ ‘দেখা উচিৎ’। এখানে نظر অর্থ চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা নয়, বরং জ্ঞানচক্ষু দিয়ে দেখা। অর্থাৎ ‘চিন্তা-গবেষণা করা’।
এখানে فاء এসেছে উহ্য প্রশ্নের জওয়াব হিসাবে। অর্থাৎ إن ارتاب مرتاب في كل نفس من الأنفس عليها رقيب، فلينظر- ‘যদি কোন সন্দেহবাদী সন্দেহ করে এব্যাপারে যে, প্রত্যেক প্রাণীর উপরে তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত রয়েছে, তাহ’লে সে দেখুক নিজের সৃষ্টিকে’ (ক্বাসেমী)। বস্ত্ততঃ এটি হ’ল পূর্ববর্তী শপথের উপর প্রমাণস্বরূপ এবং তাকীদের উপর তাকীদ স্বরূপ।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে মানুষের সৃষ্টিকৌশল বর্ণিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে মানুষকে তার নিজের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করার আহবান জানানো হয়েছে। যাতে সে নিজের তুচ্ছতা ও সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বড়ত্ব ও সৃষ্টিজগতের উপর তাঁর তত্ত্বাবধান উপলব্ধি করতে পারে।
আল্লাহ বলেন, মানুষের চিন্তা করা উচিত তার নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে। কিসের দ্বারা ও কিভাবে সে জীবন পেয়েছে ও দুনিয়াতে এসেছে। কেননা ইতিপূর্বে সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিলনা (দাহর ৭৬/১)
(৬) خُلِقَ مِنْ مَّاءٍ دَافِقٍ ‘সে সৃষ্ট হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি হ’তে।
دَافِقٍ অর্থ المندفق بشدة قوته ‘সবেগে নির্গত’। সেখান থেকে مَّاءٍ دَافِقٍ অর্থ ماء مصبوب فى الرحم‘মাতৃগর্ভে স্থিত পানি’। অর্থাৎ পিতা ও মাতার মিলিত শুক্রবিন্দু। দু’টি মিলে একটি বিন্দু হওয়ায় مَّاءٍ دَافِقٍ একবচন হয়েছে। অন্য আয়াতে একে نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ বা ‘মিশ্র শুক্রবিন্দু’ বলা হয়েছে (দাহর ৭৬/২)।
আল্লাহ বলেন, তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে যা তার মায়ের গর্ভে স্থিত থাকে। পিতা ও মাতা উভয়ের পানি সেখানে জমা হয়ে একটি পানি বিন্দু অর্থাৎ মিশ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, পিতা ও মাতা উভয়ের মিলিত একটি পানি বিন্দুই হ’ল মানব সৃষ্টির উৎস। যা মায়ের গর্ভে স্থিতি লাভ করে এবং সেখানে পুষ্ট হয়ে সাধারণত ৯ মাস ১০ দিন পরে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুর রূপ ধারণ করে। মাটিতে বীজ বপন করার পর প্রয়োজনীয় তাপ, চাপ ও খাদ্য যোগানোর মাধ্যমে যেমন তা নির্ধারিত সময়ে অংকুর হিসাবে উদ্গত হয় ও পরে বীজ অনুযায়ী বিভিন্ন উদ্ভিদে পরিণত হয়। পিতার শুক্রাণু তেমনি বীজ হিসাবে মায়ের ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে সেখানে প্রয়োজনীয় তাপ, চাপ ও খাদ্য যোগানের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। অতঃপর পূর্ণাঙ্গ মানব শিশু হিসাবে দুনিয়াতে ভূমিষ্ঠ হয়। সেকারণ সন্তান তার পিতা ও মাতা উভয়ের রং, রূপ ও স্বভাব কমবেশী প্রাপ্ত হয়।
(৭) يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ ‘যা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও বুকের মধ্যস্থল হ’তে’।
الصُّلْب অর্থ মেরুদন্ড বা পিঠ। এটি দু’ভাবে পড়া হয়েছে- الصُّلْب  الصُّلُب তবে এর আরো দু’টি পাঠ রয়েছে الصَلَب  الصَالب (قالب -এর ওযনে)। التَّرَائِبِ একবচনে التَّرِيْبَةُ অর্থ عظام الصدر ‘নারী ও পুরুষের বুকের উপর দিককার হাড্ডি’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এর অর্থ موضع القلادة ‘মেয়েদের কণ্ঠহারের স্থান’।
আয়াতে مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ বলতে পিতা ও মাতা প্রত্যেকের পিঠ ও বুকের মধ্য হ’তে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কেননা দেহের সকল প্রধান অঙ্গের অবস্থান মূলত পিঠ ও বুকের মধ্যেই থাকে। দেহের কেন্দ্রবিন্দু হ’ল মস্তিষ্ক। আর তার প্রতিনিধি হিসাবে মেরুদন্ডের হাড্ডির মধ্যে লুক্কায়িত স্নায়ুকান্ড তার শাখা-প্রশাখা ও শিরা-উপশিরার মাধ্যমে মস্তিষ্কের হুকুম সারা দেহে সঞ্চালিত করে।
‘যা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও বুকের মধ্যস্থল হ’তে’- একথার মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য নিহিত আছে। তা এই যে, জন্ম পূর্ববর্তী অবস্থায় অর্থাৎ শিশুর দেহ গঠনের স্তরে তার অন্ডকোষ বা ডিম্বাশয় মেরুদন্ড ও বুকের পাঁজরের হাড্ডির মাঝে বিকশিত হওয়া শুরু করে। পরবর্তীতে এগুলো নীচে নেমে গেলেও তাদের রক্ত সঞ্চালন পূর্বের স্থান থেকেই হয়।
(৮) إِنَّهُ عَلَى رَجْعِهِ لَقَادِرٌ ‘নিশ্চয় তিনি তাকে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম’। এর অর্থ দু’টি হ’তে পারে। এক- মুজাহিদ, ইকরিমা প্রমুখ বলেন, এর অর্থ স্খলিত পানিকে আল্লাহ পূর্বের স্থানে ফেরত নিতে পারেন’। অর্থাৎ পানি স্খলিত হ’লেও তাতে কোন সন্তান জন্মাবে না। ইবনু যায়েদ বলেন, অথবা শত চেষ্টায়ও পানি স্খলিত হবে না। যেটা বৃদ্ধ বয়সে সাধারণত হয়ে থাকে।
দুই- ইবনু আববাস, ক্বাতাদাহ প্রমুখ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে মৃত্যুর পরে আখেরাতে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম। ইবনু জারীর একথা সমর্থন করেন এবং কুরতুবী এটাকেই শক্তিশালী বলেছেন। কেননা পরবর্তী আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত রয়েছে।
(৯-১০) يَوْمَ تُبْلَى السَّرَائِرُ، فَمَا لَهُ مِنْ قُوَّةٍ وَّلاَ نَاصِرٍ ‘যেদিন গোপন বিষয়াদি পরীক্ষিত হবে’। ‘সেদিন তার কোন শক্তি থাকবে না বা কোন সাহায্যকারী থাকবে না’। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন যখন তার সকল গোপন কর্ম প্রকাশিত হবে এবং সবকিছু পরীক্ষিত হবে, সেদিন তার নিজের কোন ক্ষমতা থাকবে না বা অন্য কাউকে সে সাহায্যকারী পাবে না। ভিতর ও বাহির সবদিক দিয়ে সে দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়বে। সে আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পাবেনা। মানুষ সাধারণতঃ দু’টি শক্তি নিয়ে দুনিয়ায় চলাফেরা করে। এক- নিজের দৈহিক ও মানসিক শক্তি। দুই- অন্যের সহযোগিতার শক্তি। ক্বিয়ামতের দিন তার কোন শক্তিই অবশিষ্ট থাকবে না।
এখানে تُبْلَى অর্থ تَظْهر او تُخْتبر ‘প্রকাশিত হবে’ অথবা ‘পরীক্ষিত হবে’। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يُرْفَعُ لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ عِنْدَ اسْتِهِ يُقَالُ هَذِهِ غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক খেয়ানতকারীর জন্য তার পিছনের কটিদেশে একটি ঝান্ডা উড়ানো হবে এবং বলা হবে, এটি অমুকের পুত্র অমুকের খেয়ানতের নিদর্শন’।[4] এভাবে তার গোপন কর্ম প্রকাশিত হয়ে যাবে। এ হাদীছ দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেককে তার পিতার নামসহ ডাকা হবে। অতএব প্রত্যেকের সুন্দর নাম রাখা উচিত। অন্য হাদীছে এসেছে, জান্নাতী ও জাহান্নামীদের নামের রেজিষ্টারে তাদের স্ব স্ব পিতা ও গোত্রের নাম লিপিবদ্ধ থাকবে।[5]
এখানে ‘গোপন বিষয়াদি প্রকাশিত হবে’ বলে মুনাফিক ও চক্রান্তকারীদের মনের মধ্যে লুক্কায়িত কপটতা সমূহ প্রকাশিত হবে বুঝানো হয়েছে। নইলে বাহ্যিক ছালাত-ছিয়ামে সকলেই সমান। যেমন বকর বিন আব্দুল্লাহ আল-মুযানী বলেন,ما فضلكم أبو بكر بكثرة صيام ولا صلاة ، ولكن بشيء وقر في صدره ‘আবুবকর অন্যদের চাইতে ছালাত-ছিয়ামে অগ্রগামী নন। বরং অন্যদের চাইতে তিনি অগ্রণী হ’লেন তাঁর হৃদয়ে স্থিত ঈমানের কারণে’ (হাকীম তিরমিযী, নাওয়াদের)। অতএব প্রত্যেকের উচিত কর্মজগত সুন্দর করার সাথে সাথে অন্তরজগতকে পরিচ্ছন্ন করা এবং নিজেকে যাবতীয় কপটতার কালিমা হ’তে মুক্ত করা।
(১১-১২) وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الرَّجْعِ، وَالْأَرْضِ ذَاتِ الصَّدْعِ ‘শপথ বর্ষণশীল আকাশের’। ‘এবং বিদারণশীল পৃথিবীর’।
আলোচ্য আয়াতে আসমান ও যমীনের যে দু’টি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির জন্য রয়েছে চিন্তার অফুরন্ত খোরাক। এর মধ্যে যেমন রয়েছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি কৌশলের বর্ণনা, তেমনি রয়েছে প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রাণীকুলের জন্য খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার এক অপূর্ব পালন কৌশলের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الرَّجْعِ অর্থ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন, বৃষ্টি। ইবনু যায়েদ বলেছেন, গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন-বিবর্তন। দু’টি অর্থই সঠিক। কেননা الرَّجْعِ অর্থ পরপর আসা। বৃষ্টি প্রতিবছর বারবার আসে এবং বৃষ্টি একটার পর একটা আসে। অনরূপভাবে সূর্য ও চন্দ্র একটার পর একটা আসে। وَالْأَرْضِ ذَاتِ الصَّدْعِ ‘শপথ বিদারণশীল পৃথিবীর’। الصَّدْعِ অর্থ الشقফেটে যাওয়া, বিদীর্ণ হওয়া। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا ‘অতঃপর আমরা যমীনকে বিদীর্ণ করি সুন্দরভাবে’ (আবাসা ৮০/২৬)। মাটি ফেটে বীজের অংকুরোদ্গম হয়। অতঃপর তা ফুলে-ফলে সুশোভিত পূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হয়।
আকাশ ও নক্ষত্ররাজির সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক অতীব নিবিড়। সূর্যের তাপ পানিতে পড়ে তা বাষ্পাকারে উত্থিত হয়। অতঃপর পরিচ্ছন্ন বৃষ্টি আকারে বায়ু দ্বারা চালিত হয়ে তা আল্লাহর হুকুমে যথাস্থানে পরিমাণ মত বর্ষিত হয়। সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর মাধ্যমে নাইট্রোজেন নিক্ষিপ্ত হয়ে ভূমিকে উর্বর করে। অতঃপর দিনের বেলায় সূর্যের তাপ ও রাতের বেলায় চন্দ্রের মায়াবী আলোর পেলব স্পর্শে ভূমি থেকে উদ্গত হয় নানাবিধ উদ্ভিদ ও গাছ-গাছালী। যা মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে পরিবেশিত হয়। এইভাবে নক্ষত্ররাজির আবর্তন-বিবর্তন, আলো ও উত্তাপ দান, বায়ু প্রবাহের আগমন-নির্গমন, বৃষ্টিবর্ষণ এবং যমীন থেকে উদ্ভিদ ও খাদ্যের যোগান দানের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতিপালন ও পরিপাটি সাধন করেন ও সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেন। আর সবকিছুই আল্লাহ করেন পরিমাণমত। তিনি বলেন, إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ ‘আমরা সবকিছু সৃষ্টি করেছি পরিমাণমত’ (ক্বামার ৫৪/৪৯)। তিনি আরো বলেন, وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ ‘আর সকল বস্ত্তই তার নিকটে রয়েছে পরিমাণমত’ (রা‘দ ১৩/৮)। যদি না মানুষ নিজের হঠকারিতা বশে তাতে ব্যত্যয় ঘটায় এবং নিজের ক্ষতি নিজে ডেকে আনে। মনে রাখা আবশ্যক যে, নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে কোন কিছুই এক্সিডেন্টের সৃষ্টি নয়। বরং সবকিছুই তাঁর পরিকল্পনা মতে ও তাঁর জ্ঞাতসারেই হয়ে থাকে। যেমন তিনি বলেন, وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلاَّ عِنْدَنَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّلُهُ إِلاَّ بِقَدَرٍ مَعْلُوْمٍ ‘আমাদেরই কাছে রয়েছে সবকিছুর ভান্ডার এবং আমরা সবকিছু জ্ঞাত পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি’ (হিজর ১৫/২১)
মায়ের গর্ভে পিতার শুক্রাণু নিক্ষেপের ফলে যেমন সন্তান জন্মলাভ করে, তেমনি আকাশ থেকে ভূমিতে বৃষ্টি বর্ষণের ফলে উদ্ভিদরাজি ও শস্যাদি উৎপন্ন হয়। এজন্যই বলা হয়েছে, وَفِي السَّمَآءِ رِزْقُكُمْ وَمَا تُوْعَدُوْنَ ‘আর আকাশে রয়েছে তোমাদের রিযিক এবং প্রতিশ্রুত সবকিছু’ (যারিয়াত ৫১/২২)। আকাশ ও পৃথিবীর শপথ করে আল্লাহ আমাদের নিকটে তাঁর সৃষ্টিকৌশল ও পালনকৌশল যেমন বর্ণনা করেছেন, তেমনি আমাদেরকে তাঁর প্রদত্ত নে‘মতরাজি সন্ধান করে তা ভোগ করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। বিজ্ঞানীরা এদিকে যত মনোযোগ দিবেন ততই মুগ্ধ ও বিমোহিত হবেন এবং অবশ্যই অবনত    মস্তকে আল্লাহকে স্বীকার করবেন ও তাঁর বিধানসমূহ মানতে উদ্বুদ্ধ হবেন। কুরআনের বাহক মুসলিম তরুণ বিজ্ঞানীরা এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন কি?
(১৩-১৪) إِنَّهُ لَقَوْلٌ فَصْلٌ، وَمَا هُوَ بِالْهَزْلِ ‘নিশ্চয়ই এ কুরআন সিদ্ধান্তকারী বাণী’। ‘এবং এটি কোন বৃথাবাক্য নয়’।
الفَصْلُ মাছদার যা اسم فاعل অর্থে এসেছে। যার অর্থ الفاصل بين الحق والباطل ‘সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী’। الْهَزْلِ যা ضِدُّ الْجِدِّ ‘সত্যের বিপরীত’ অর্থাৎ বৃথা বাক্য।
আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর কসম করে বলছেন, নিশ্চয়ই কুরআন সত্য ও মিথ্যার ফায়ছালাকারী। আর এটা কোন বৃথাবাক্য নয়। যারা কুরআনকে এড়িয়ে চলতে চায় এবং নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে চায়, মূলতঃ তারাই কুরআনী সত্যকে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে অগ্রাহ্য করে থাকে। কুরআনের বিরুদ্ধে যত কথাই তারা বলুক, সবই বাজে কথা মাত্র। কুরআনে কোন বাহুল্য কথা নেই। কুরআনের প্রতিটি শব্দ, বাক্য ও বর্ণ বিপুল জ্ঞান ও অর্থ সম্ভারে পূর্ণ। আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقاً وَّعَدْلاً ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ’ (আন‘আম ৬/১১৫)
কুরআন পাঠের সময় চিন্তাশীল পাঠককে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, এর প্রতিটি বাক্য সত্য ও চূড়ান্ত। এর প্রতিটি বর্ণ ও বর্ণনার স্টাইল অনন্য ও অচিন্তনীয় এবং তা চিরন্তন কল্যাণের ইঙ্গিতবাহী। বান্দাকে তার গভীরে ডুব দিয়ে তা বের করে আনতে হবে হাদীছের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী। কেননা কুরআনের ব্যাখ্যা হ’ল হাদীছ এবং কুরআনের কোন বর্ণই অনর্থক বা অহেতুক নয়।
উল্লেখ্য যে, সূরার শুরুতে আকাশের ও উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির শপথ করা হয়েছে। অতঃপর এখানে পুনরায় আকাশ ও পৃথিবীর শপথ করে বলা হচ্ছে যে, ‘কুরআন হ’ল সিদ্ধান্তকারী বাণী’। দুই শপথের মধ্যে সামঞ্জস্য সম্ভবতঃ এই যে, (আল্লাহ সর্বাধিক অবগত) প্রথম শপথে উজ্জ্বল নক্ষত্রের কথা বলা হয়েছে, যা প্রয়োজনে শয়তানের প্রতি নিক্ষেপ করা হয়, যারা ‘অহি’ চুরি করতে চায়। যার মাধ্যমে কুরআনকে হেফাযত করা হয়। দ্বিতীয় শপথে বর্ষণশীল আকাশের কথা বলা হয়েছে, যার দ্বারা মৃত যমীনকে জীবন্ত করা হয়। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, কুরআন হ’ল জীবন সদৃশ। যা মানুষের মৃত হৃদয়কে জীবিত করে। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا ‘আর এভাবেই আমরা তোমার নিকট ‘অহি’ করেছি রূহ (কুরআন) আমাদের নির্দেশক্রমে’ (শূরা ৪২/৫২)। এখানে কুরআনকে ‘রূহ’ বলা হয়েছে (ইবনু কাছীর)। নিঃসন্দেহে কুরআন মানবজাতির জন্য রূহ সদৃশ।
(১৫-১৬) إِنَّهُمْ يَكِيْدُوْنَ كَيْداً، وَأَكِيْدُ كَيْداً ‘নিশ্চয় তারা দারুণভাবে চক্রান্ত করে’। ‘আর আমিও যথাযথ কৌশল করি’।
الكَيْدُ অর্থ الْمَكْرُ ধোঁকা, প্রতারণা, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র। এই অর্থ বান্দার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আল্লাহর ক্ষেত্রে নয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে অর্থ হবে جزاء كيدهم ‘তাদের চক্রান্তের বদলা’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ আল্লাহর কৌশল হ’ল শত্রুদের যথাযথ বদলা দেওয়া।
মক্কায় কাফির-মুশরিকরা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও অকথ্য নির্যাতন করেছিল, অত্র আয়াতে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللهُ وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ ‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন কাফিররা (মক্কায় দারুন নাদওয়াতে বসে) তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তোমাকে বন্দী করার বা হত্যা করার বা বহিষ্কার করার জন্য। বস্ত্ততঃ তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহ কৌশল করেন। আর আল্লাহ হ’লেন সেরা কৌশলী’ (আনফাল ৮/৩০)
বস্ত্ততঃ অবিশ্বাসীরা সর্বযুগে রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বিরুদ্ধে মানুষকে নানাবিধ ধোঁকার জালে আবদ্ধ করে থাকে। তারা কুরআনের আলো নিভিয়ে দেবার জন্য এবং কুরআনের প্রচার ও প্রসার বন্ধ করার জন্য নানাবিধ কৌশল করে থাকে। আর আল্লাহ তার যথাযথ কৌশল প্রয়োগ করেন। আর তা হ’ল তাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কুরআনের বিরোধিতা করার সুযোগ দেওয়া এবং যথাসময়ে পাকড়াও করা। যে পাকড়াওয়ের সময়সীমা সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের কোন পূর্ব ধারণা থাকবে না।
আল্লাহ বলেন, يُرِيْدُوْنَ لِيُطْفِؤُوْا نُوْرَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُوْرِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُوْنَ- ‘তারা আল্লাহর জ্যোতি (কুরআন)-কে তাদের মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ তার জ্যোতিকে পূর্ণতা দান করবেন। যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপসন্দ করে’ (ছফ ৬১/৮; তওবা ৯/৩২)। তিনি আরও বলেন, وَالَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِّنْ حَيْثُ لاَ يَعْلَمُوْنَ، وَأُمْلِيْ لَهُمْ إِنَّ كَيْدِيْ مَتِيْنٌ- ‘বস্ত্ততঃ যারা আমাদের আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, আমরা তাদেরকে ক্রমান্বয়ে পাকড়াও করব এমন স্থান থেকে যে, তারা জানতেও পারবে না’। ‘আর আমি তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে আমার কৌশল অতীব সুনিপুণ’ (আ‘রাফ ৭/১৮২-১৮৩; ক্বলম ৬৮/৪৪-৪৫)
(১৭) فَمَهِّلِ الْكَافِرِيْنَ أَمْهِلْهُمْ رُوَيْداً ‘অতএব অবিশ্বাসীদের সুযোগ দাও, ওদের অবকাশ দাও কিছু দিনের জন্য’।
أَمْهِلْهُمْ رُوَيْداً অর্থ أَمْهِلْهُمْ إِمْهَالاً رُوَيْداً ‘ওদেরকে কিছুদিনের জন্য অবকাশ দাও’।أَرْوَدَ يُرْوِدُ إِرْوَادًاথেকে رُوَيْدًا এখানে مصدر مصغَّر হয়েছে। অর্থাৎ إِمْهَالاً رُوَيْداً ‘সামান্য অবকাশ’। যাأَمْهِلْهُمْ -এর نعت বা বিশেষণ হিসাবে এসেছে (কুরতুবী)
অতএব হে রাসূল! কাফেরদের কিছুটা অবকাশ দিন। ওদের দ্রুত ধ্বংসের জন্য প্রার্থনা করবেন না। তাদেরকে কিছুটা সুযোগ দিন এবং দেখুন তাদের উপরে আল্লাহর কি গযব নেমে আসে।
বস্ত্ততঃ কাফেরদের উপরে দুনিয়াবী গযব নেমে এসেছিল প্রথমতঃ মুসলমানদের হাতে বদরের যুদ্ধে। সেদিন রাসূল (ছাঃ)-কে মক্কায় হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ জন নেতার ১১ জনই নিহত হয় এবং তারা সবাই একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হয়। আবু সুফিয়ান সহ বাকী ৩ জন নেতা পরে মুসলমান হন। এছাড়া আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয় আবু লাহাব, তার ছেলে উতায়বা বিন আবু লাহাব, উমাইয়া বিন খালাফ ও তার ভাই উবাই বিন খালাফ সহ আরও অনেকে। অতঃপর এ ঘটনার মাত্র ৬ বছরের মাথায় ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে রাসূল (ছাঃ) বিনা যুদ্ধে মক্কা জয় করে ফিরে আসেন সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে। আল্লাহ বলেন, نُمَتِّعُهُمْ قَلِيْلاً ثُمَّ نَضْطَرُّهُمْ إِلَى عَذَابٍ غَلِيْظٍ ‘আমরা তাদেরকে স্বল্পকালের জন্য ভোগবিলাসের সুযোগ দেব। অতঃপর তাদের বাধ্য করব গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে’ (লোকমান ৩১/২৪)
সারকথা :
আকাশ ও নক্ষত্ররাজির শপথ করে আল্লাহ মানুষের সৃষ্টি ও পরিণতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর কুরআনী সত্যের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের চূড়ান্তভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। সাথে সাথে এর মধ্যে আল্লাহর পথে আহবানকারীদের জন্য সুসংবাদ লুক্কায়িত রয়েছে।


[1]. নাসাঈ হা/৯৮৪, ১১৬৬৪; বুখারী হা/৭০৫; বিস্তারিত দেখুন সূরা ফজরের তাফসীরে, টীকা-২৫১।
[2]. রাযীন, আহমাদ হা/১৭৬৭১, মিশকাত হা/১৯১, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৫৫৫, মুসলিম হা/৬৩২; মিশকাত হা/৬২৬ ‘ছালাতের ফযীলত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৩।
[4]. বুখারী হা/৬১৭৭, মুসলিম হা/১৭৩৬, মিশকাত হা/৩৭২৫ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[5]. তিরমিযী হা/২১৪১; মিশকাত হা/৯৬ ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।


Post a Comment

0 Comments