বিষয়বস্ত্ত : সূরাটিতে দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এক- মাপে ও ওযনে কমবেশী করার পরিণতি এবং দুই- ইল্লিয়ীন ও সিজ্জীনে নেককার ও বদকারদের আমলনামা সংরক্ষিত হওয়া। প্রথম দু’টিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বড় যুলুম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শেষোক্ত বিষয়টি বর্ণনার মাধ্যমে বান্দাকে সাবধান করা হয়েছে যে, তার ভাল-মন্দ সকল কর্ম লিপিবদ্ধ হচ্ছে এবং তা বিশেষ স্থানে সংরক্ষিত হচ্ছে। শানে নুযূল : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় পদার্পণ করেন, তখন মদীনাবাসীগণ ছিল মাপে ও ওযনে কম-বেশী করায় সিদ্ধহস্ত (كانوا من أخبثِ الناس كيلاً)। তখন আল্লাহপাক وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْن নাযিল করেন। ফলে তারা বিরত হয় এবং মাপ ও ওযনে সততা অবলম্বন করে’। তিনি বলেন, فهم من أَوْفَى الناس كيلاً إلى يومهم هذا ‘তারা এখন পর্যন্ত মাপ ও ওযনের সততায় সবার চাইতে সেরা’।[1] তাফসীর : (১) وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ ‘দুর্ভোগ মাপে কম দানকারীদের জন্য’। আরবী বাকরীতি অনুযায়ী وَيْلٌ অর্থ দুর্ভোগ বা ধ্বংস। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَيْلٌ لِمَنْ يُحَدِّثُ يَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ- ‘দুর্ভোগ ঐ ব্যক্তির জন্য যে কথা বলার সময় মিথ্যা বলে, যাতে লোকেরা হাসে। তার জন্য দুর্ভোগ, তার জন্য দুর্ভোগ’।[2] তবে এখানে وَيْلٌ-এর সাথে يَوْمَئِذٍ যোগ হওয়ায় এর অর্থ হবে ‘জাহান্নাম’। কেননা ক্বিয়ামতের দিন দুর্ভোগের একমাত্র পরিণাম হ’ল জাহান্নাম। মাপ ও ওযনে ইচ্ছাকৃতভাবে কম-বেশী করে যারা, এটাই হবে তাদের পরকালীন পুরস্কার। মূলতঃ এই পাপেই বিগত যুগে হযরত শো‘আয়েব (আঃ)-এর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে (হূদ ১১/৮৪-৯৪)। ঐ ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি হওয়া এ যুগে মোটেই অসম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন, وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيْزَانَ بِالْقِسْطِ لاَ نُكَلِّفُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا ‘তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেই না’ (আন‘আম ৬/১৫২)। তিনি আরও বলেন, وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُواْ بِالقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيْمِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً- ‘তোমরা মেপে দেয়ার সময় মাপ পূর্ণ করে দাও এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওযন করো। এটাই উত্তম ও পরিণামের দিক দিয়ে শুভ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَأَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلاَ تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ- ‘তোমরা যথার্থ ওযন প্রতিষ্ঠা কর এবং ওযনে কম দিয়ো না’ (রহমান ৫৫/৯)। التَّطْفِيْفُ অর্থ البخس فى المكيال والميزان ‘মাপে ও ওযনে কম করা’। এটা দু’ভাবে হ’তে পারে। ১- নেয়ার সময় বেশী নেয়া এবং ২- দেয়ার সময় কম দেওয়া। পরের আয়াতেই এভাবে ব্যাখ্যা এসেছে। التطفيف এর মাদ্দাহ হ’ল الطفيف যার অর্থ الخفيف أو القليل ‘হালকা বা নগণ্য’। মাপ ও ওযনে কম-বেশীর দ্বারা চুরির মাধ্যমে সামান্য কিছু অর্জিত হয় বলে এখানে হীনকর অর্থে শব্দটি আনা হয়েছে। এই কম-বেশী করাটা কেবল মাপ ও ওযনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি ইবাদত ও মু‘আমালাতের সকল ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, ‘বলা হয়ে থাকে যে, لكل شئٍ وفاءٌ وةطفيفٌ وقال آخرون: حةى فى الوضوء والصلاة- ‘প্রত্যেক বস্ত্তর পূর্ণমাত্রা ও হরাসমাত্রা রয়েছে’। অন্যেরা বলেন, এমনকি ওযূ ও ছালাতের মধ্যেও। এরপর তিনি হযরত ওমর (রাঃ)-এর বক্তব্য থেকে দলীল পেশ করেন যে, একদা ওমর (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে আছরের জামা‘আতে হাযির হতে না দেখে বলেন, طَفَّفْتَ ‘তুমি কম পেয়েছ’।[3]অর্থাৎ তুমি নেকী কম পেয়েছ। এমনিভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও বান্দার প্রাপ্য হক আদায়ে কম-বেশী করে, সেও এই আয়াতে বর্ণিত ধমকির অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাকে مُطَفِّفٌ বা ‘কমকারী’ বলা হবে। (২)الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ ‘যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেয়’। এখানে عَلَى النَّاسِ অর্থ ফার্রা, যাজ্জাজ, ইবনু কাছীর প্রমুখ বলেছেন من الناس ‘লোকদের থেকে’। ইবনু জারীর বলেছেন عند الناس ‘লোকদের নিকট’। দু’টিরই মর্ম কাছাকাছি। অর্থাৎ إذا اكتالوا من الناس استوفوا عليهم وافيًا وزائدًا ‘যখন তারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেয়, তখন পুরোপুরি বা বেশী করে নেয়’। (৩) وَإِذَا كَالُوهُمْ أَو وَّزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ ‘এবং যখন লোকদের মেপে দেয়, বা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়’। অর্থ كالوا لهم أو وزنوالهم ‘তাদের জন্য মেপে দেয় অথবা ওযন করে দেয়’। যেমন বলা হয়,نَصَحْتُكَ অর্থ نَصَحْتُ لَكَ ‘আমি তোমাকে উপদেশ দিয়েছি’। এক্ষণে আয়াতের মর্ম দাঁড়ালো, وإذا كالوا للناس او وزنوا لهم ينقصونهم فى حقهم الواجب لهم ‘আর যখন তারা লোকদের মেপে দেয় বা ওযন করে দেয়, তখন তাদের প্রাপ্য ওয়াজিব হক থেকে কম করে দেয়’। মাপে ও ওযনে কমদানকারীদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তির দুঃসংবাদ শুনানোর কারণ হ’তে পারে দু’টি। ১- ঐ ব্যক্তি গোপনে অন্যের মাল চুরি করে ও তার প্রাপ্য হক নষ্ট করে। ২- ঐ ব্যক্তি আল্লাহর দেওয়া অমূল্য জ্ঞান-সম্পদকে লোভরূপী শয়তানের গোলাম বানায়। জ্ঞান ও বিবেক হ’ল মানুষের প্রতি আল্লাহর দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নে‘মত। আর এজন্যেই মানুষ আশরাফুল মাখলূক্বাত বা সৃষ্টির সেরা। মানুষ যখন তার এই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-সম্পদকে নিকৃষ্ট কাজে ব্যবহার করে, তখন তার জন্য কঠিনতম শাস্তি প্রাপ্য হয়ে যায়। আর সেই শাস্তির কথাই প্রথম আয়াতে শুনানো হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, خَمْسٌ بِخَمْسٍ: مَا نَقَضَ قَوْمٌ الْعَهْدَ إِلاَّ سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوَّهُمْ وَمَا حَكَمُوْا بِغَيْرِ مَا أَنْزَلَ اللهُ إِلاَّ فَشَا فِيْهِمُ الْفَقْرُ وَمَا ظَهَرَتْ فِيْهِمُ الْفَاحِشَةُ إِلاَّ فَشَا فِيْهِمُ الْمَوْتُ (أَوْ إِلاَّ ظَهَرَ فِيْهِمُ الطَّاعُوْنُ) وَلاَ طَفَّفُوا الْمِكْيَالَ إِلاَّ مُنِعُوا النَّبَاتَ وَاُخِذُوْا بِالسِّنِيْنَ، وَلاَ مَنَعُوا الزَّكَاةَ إِلاَّ حُبِسَ عَنْهُمُ الْمَطَرَ، أخرجه الديلمى وخرجه البزار بمعناه و مالك من حديث ابن عمر- ‘পাঁচটি বস্ত্ত পাঁচটি বস্ত্তর কারণে হয়ে থাকে। এক- কোন কওম চুক্তিভঙ্গ করলে আল্লাহ তাদের উপরে তাদের শত্রুকে বিজয়ী করে দেন। দুই- কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বাইরের বিধান দিয়ে দেশ শাসন করলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। তিন- কোন সম্পদ্রায়ের মধ্যে অশ্লীল কাজ বিস্তৃত হ’লে তাদের মধ্যে মৃত্যু অর্থাৎ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। চার- কেউ মাপে বা ওযনে কম দিলে তাদের জন্য খাদ্য-শস্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। পাঁচ- কেউ যাকাত দেওয়া বন্ধ করলে তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়’।[4] ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত অনুরূপ আরেকটি হাদীছে এসেছে (১) যে জাতির মধ্যে খেয়ানত অর্থাৎ আত্মসাতের ব্যাধি আধিক্য লাভ করে, সে জাতির অন্তরে আল্লাহ শত্রুর ভয় নিক্ষেপ করেন (২) যে জাতির মধ্যে যেনা-ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, সে জাতির মধ্যে মৃত্যুহার বেড়ে যায় (৩) যে জাতি মাপে ও ওযনে কম দেয়, তাদের রিযিক উঠিয়ে নেওয়া হয়। (৪) যে জাতি অন্যায় বিচার করে, তাদের মধ্যে খুন-খারাবি ব্যাপক হয় (৫) যে জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তাদের উপর শত্রুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়’।[5] (৪-৫) أَلاَ يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُم مَّبْعُوثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ ‘তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে?’। ‘সেই মহা দিবসে’। অর্থাৎ তারা কি ক্বিয়ামতের দিনকে ভয় পায় না এবং তারা কি এটা বিশ্বাস করে না যে, তাদেরকে একদিন এমন এক মহান সত্তার সম্মুখে দন্ডায়মান হ’তে হবে, যিনি তার প্রতিপালক এবং যিনি তার ভিতর-বাহির সবকিছুর খবর রাখেন। এখানে أَلاَ يَظُنُّ ‘তারা কি ধারণা করে না’? কথাটি إنكار وتعجب তথা অস্বীকার ও বিস্ময়বোধক হিসাবে এসেছে। এখানে ظن বা ধারণা অর্থ يقين বা বিশ্বাস। কেননা তারা যদি ক্বিয়ামতে সত্যিকারের দৃঢ় বিশ্বাসী হ’ত, তাহ’লে কখনোই মাপ ও ওযনে কম দেওয়ার মত নিকৃষ্টতম পাপ তারা করতে পারত না। উমাইয়া বংশের দোর্দন্ড প্রতাপ খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান (৬৫-৮৬/৬৮৫-৭০৫ খৃঃ) বলেন, তার সম্মুখে একদিন জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, আপনি কি সূরা মুত্বাফফেফীন পড়েছেন? সেখানে আল্লাহ কি কঠিন ধমকি দিয়েছেন? আপনি যে মুসলমানদের মাল-সম্পদ বিনা মাপে ও বিনা ওযনে নিয়ে থাকেন فما ظنك بنفسك‘এবিষয়ে আপনার নিজের ব্যাপারে কি ধারণা?’ (কুরতুবী)। বেদুঈনের এই বক্তব্যে যেমন খলীফার বিরুদ্ধে ইনকার ও বিস্ময় ফুঠে উঠেছে, অত্র আয়াতেও তেমনি মাপ ও ওযনে কম দানকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ইনকার ও বিস্ময় ফুঠে উঠেছে। উক্ত ঘটনার মধ্যে আধুনিক যুগের রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনেতাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের শুধু নয়, তৎকালীন সময়ে সমগ্র বিশ্বের অন্যতম মহাশক্তিধর রাষ্ট্রনেতার মুখের উপর একজন সাধারণ বেদুঈন যদি এরূপ কঠোর বাক্য বিনা দ্বিধায় প্রয়োগ করতে পারে এবং খলীফা যদি তা বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করতে পারেন ও বিনা দ্বিধায় তা অন্যকে বলতে পারেন, তাহ’লে আজকের বিশ্বের তথাকথিত গণতন্ত্রী ও উদারনৈতিক রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনেতাগণ হক কথা বরদাশত করতে পারেন না কেন? এইসব গণতন্ত্রীদের কাছে যাওয়া দূরে থাক, তাদের সাথে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ কি কোন মযলূমের বা কোন দুর্বলের আছে? অথচ ভারতবর্ষের বাদশাহ জাহাঙ্গীরের মত শাসক (১৬০৫-২৭ খৃঃ) সেযুগে তাঁর বাসকক্ষ হ’তে প্রাসাদের বহিরাঙ্গন পর্যন্ত শিকল টাঙিয়ে রাখতেন। যাতে রাতে-দিনে যখন খুশী যেকোন নাগরিক শিকল নাড়া দিয়ে ঘণ্টা বাজালে তিনি জানতে পারেন ও তার সমস্যার কথা তিনি শুনতে পারেন। বাদশাহ আওরঙ্গযেব আলমগীর (১০৬৮-১১১৮/১৬৫৮-১৭০৭ খৃঃ) জানতে পারলেন যে, তার এক গরীব ব্রাহ্মণ প্রজার সুন্দরী মেয়েকে তার এক সেনাপতি যবরদস্তি বিয়ে করতে চায়। আলমগীর উক্ত বিয়ের আগের রাতে ছদ্মবেশে একাকী উক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ীতে আত্মগোপন করে থাকেন ও সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দেন। পরদিন সকালে বিয়ে করতে আসা বরের সম্মুখে উলঙ্গ তরবারি হাতে যমদূতের মত হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। রাজধানী দিল্লী থেকে বহু দূরে পাঞ্জাবের অজ পাড়াগাঁয়ে এই হিন্দুপল্লীতে স্বয়ং বাদশাহকে দেখে ভয়ে ও আতংকে সেনাপতি সেখানে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই ঘটনায় ঐ এলাকার হিন্দু জনসাধারণ বাদশাহকে দেবতা জ্ঞান করে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ে এবং এলাকার নাম পাল্টে ‘আলমগীরগঞ্জ’ রাখে। যে কক্ষে তিনি ইবাদতে কাটান, সে কক্ষে আজও কেউ জুতা পায়ে প্রবেশ করে না। কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণকে বুকে জড়িয়ে ধরে সম্রাট সেদিন বলেছিলেন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। আল্লাহ সকল ক্ষমতার মালিক।[6] এটা ছিল কুরআনের বরকত। কেননা কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতা আল্লাহর দান। আর উক্ত ক্ষমতায় আসীন কোন মুসলমান কখনোই কোন নাগরিকের অধিকার হরণ বা ক্ষুন্ন করতে পারেন না। তিনি তার কোন নাগরিককে কখনোই তার ‘গোলাম’ (كُوْنُوْا عِبَادًا لِّىْ) ভাবতে পারেন না। বরং তাকে সব সময় ‘আল্লাহ্ওয়ালা’ (رَبَّانِيِّيْنَ) হয়ে থাকতে হয় (আলে ইমরান ৩/৭৯)। বাদশাহগণ যদি আল্লাহভীরু হয়ে প্রজার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারেন, তাহ’লে ব্যবসায়ীগণ কেন ক্রেতাসাধারণের প্রাপ্য হক আদায় করতে পারেন না? তারা কি ভাবেন না যে, তাদেরকে একদিন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াতে হবে? যেদিন মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তাদের হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ ও দেহচর্ম সাক্ষ্য প্রদান করবে। সেদিন অবস্থাটা কেমন হবে? (ইয়াসীন ৩৬/৬৫; হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২১)। (৬) يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘যেদিন মানুষ দন্ডায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’। এখানে يومَ শব্দের শেষাক্ষর যবরযুক্ত হয়েছে উহ্য ক্রিয়ার কর্ম (مفعول به) হিসাবে। মূলে ছিল يُبعثون يومَ يقومُ الناسُ। তবে পূর্বের আয়াত لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ থেকে بدل হওয়াটাও সিদ্ধ আছে। তখন يَوْمَ শব্দটি مبنى হবে এবং শেষাক্ষরে যের-এর পরিবর্তে যবর হবে (منصوب بنزع خافض) , যেটা এখন হয়েছে। সূরার শুরু থেকে এপর্যন্ত এসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর ক্বিরাআত বন্ধ হয়ে যেত এবং তিনি ক্রন্দন করতেন (কুরতুবী)। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, حَتَّى يَغِيبَ أَحَدُهُمْ فِى رَشْحِهِ إِلَى أَنْصَافِ أُذُنَيْهِ ক্বিয়ামতের দিন ঘামে কারু কারু কানের অর্ধেক পর্যন্ত ডুবে যাবে’।[7] মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আল-কিন্দী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ أُدْنِيَتِ الشَّمْسُ مِنَ الْعِبَادِ حَتَّى تَكُوْنَ قِيْدَ مِيْلٍ أَوْ مِيْلَيْنِ قَالَ: فَتَصْهَرُهُمُ الشَّمْسُ فَيَكُوْنُوْنَ فِى الْعَرَقِ بِقَدْرِ أَعْمَالِهِمْ فَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى كَعْبَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى حَقْوَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يُلْجِمُهُ الْعَرَقُ إِلْجَامًا- ‘ঐদিন সূর্য এক মাইল বা দু’মাইল মাথার উপরে চলে আসবে। অতঃপর সূর্যতাপে তাদের দেহ গলে যাবে। তাতে পাপের পরিমাণ অনুযায়ী কারু হাঁটু পর্যন্ত, কারু কোমর পর্যন্ত, কারু পায়ের টাখনু পর্যন্ত, কারু বুক পর্যন্ত ঘামে ডুবে যাবে।[8] যেমন ব্যাঙ পানিতে হাবুডুবু খায়। এছাড়া তাদের পানীয় হবে দেহনিঃসৃত রক্ত ও পুঁজ..’ (হা-ক্কাহ ৬৯/৩৬)। এদেরকে আল্লাহ তাঁর শত্রু হিসাবে অভিহিত করে বলেন, وَيَوْمَ يُحْشَرُ أَعْدَاءُ اللهِ إِلَى النَّارِ فَهُمْ يُوْزَعُوْنَ ‘যেদিন আল্লাহর শত্রুদের জাহান্নাম অভিমুখে সমবেত করা হবে, সেদিন তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বিভিন্ন দলে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/১৯)। উল্লেখ্য যে, ক্বিয়ামতের একটি দিন হবে দুনিয়ার পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান (মা‘আরেজ ৭০/৪)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহ এটা কাফিরদের উপর করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন চিরস্থায়ী আযাবের জন্য’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। কুরতুবী বলেন, আরবরা কঠিন দিনগুলিকে দীর্ঘ এবং আনন্দের দিনগুলিকে সংক্ষিপ্ত বলে থাকে’ (কুরতুবী, মা‘আরেজ ৭০/৪)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ مِقْدَارَ نِصْفِ يَوْمٍ مِنْ خَمْسِيْنَ أَلْفِ سَنَةٍ يُهَوَّنُ ذَلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ كَتَدَلِّي الشَّمْسِ لِلْغُرُوبِ إِلَى أَنْ تَغْرُبَ ‘মানুষ সেদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে। যে দিনটি হবে ৫০ হাযার বছরের অর্ধেকের সমান। যা মুমিনদের উপর সহজ করা হবে এমনভাবে যে, অস্তায়মান সূর্য যেমন অস্ত যায়’।[9] পক্ষান্তরে সৎ ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِيْنُ مَعَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী ক্বিয়ামতের দিন নবী, ছিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবে’।[10] তিনি বলেন, التُّجَّارُ يُحْشَرُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فُجَّاراً إِلاَّ مَنِ اتَّقَى وَبَرَّ وَصَدَقَ ‘ব্যবসায়ীরা ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে পাপাচারী হিসাবে। কেবল সেইসব ব্যবসায়ী ব্যতীত, যারা আল্লাহভীরু, সৎকর্মশীল ও সত্যবাদী’।[11] ক্বিয়ামতের দিন তাদের কোন ভয় নেই। যেমন আল্লাহ বলেন, اللهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ‘আল্লাহ হ’লেন মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর দিকে নিয়ে যান’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)। এতে বুঝা যায় যে, প্রকৃত মুমিনরাই আল্লাহর অলী বা বন্ধু। অতঃপর তিনি বলেন, أَلاَ إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ‘মনে রেখ, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। দুর্ভাগ্য অত্র আয়াতটি এখন বিভিন্ন পীরের মাযারে বড় বড় হরফে শোভা পাচ্ছে। এর দ্বারা ভক্তদের বুঝানো হচ্ছে যে, পীর ছাহেব মরেন নি। বরং তিনি কবরে জীবিত আছেন। তিনি প্রার্থীদের প্রার্থনা শ্রবণ করেন ও তাদের ভাল-মন্দ করার ক্ষমতা রাখেন। অথচ এগুলি পরিষ্কারভাবে শিরক। আর যেখানে শিরকের মত মহাপাপ হয় এবং যেসব পীরেরা ভক্তদের এসব আক্বীদা শিখিয়ে থাকেন, তারা কিভাবে আউলিয়া বা আল্লাহর বন্ধু হন? বরং তারাতো শয়তানের বন্ধু। এক্ষণে আল্লাহর বন্ধু কারা? এর ব্যাখায় পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ آمَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُوْنَ- ‘যারা ঈমান আনে এবং পাপ থেকে বিরত হয়’ (ইউনুস ১০/৬৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَتَفَرَّقُوْنَ، َأَمَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَهُمْ فِيْ رَوْضَةٍ يُحْبَرُوْنَ-‘যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে’। ‘অতঃপর যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তারা জান্নাতে সমাদৃত হবে’ (রূম ৩০/১৪-১৫)। অতএব সৎ ব্যবসায়ী মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধু। পক্ষান্তরে যারা অসৎ ব্যবসায়ী, তারা আল্লাহর শত্রু। (৭-৯) كَلاَّ إِنَّ كِتَابَ الفُجَّارِ لَفِيْ سِجِّيْنٍ، وَمَا أَدْرَاكَ مَا سِجِّيْنٌ، كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ ‘কখনোই না। নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে থাকবে’। ‘তুমি কি জানো সিজ্জীন কি?’ ‘লিপিবদ্ধ খাতা’। كَلاَّ অস্বীকার ও ধিক্কার সূচক অব্যয় (حرف ردع وزجر)। অর্থাৎ কখনোই না। তবে كَلاَّ অর্থ حقًّا হ’তে পারে। অর্থাৎ পাপাচারীরা মাপে ও ওযনে কম দিয়ে লাভবান হয়েছে বলে যা মনে করে এবং আখেরাতে জওয়াবদিহিতাকে যে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তা কখনোই হবার নয়। বরং সঠিক কথা এই যে, এইসব পাপীদের আমলনামা অবশ্যই সংরক্ষিত হচ্ছে সিজ্জীনে। এই সিজ্জীন হ’ল তাদের কর্মকান্ডের রেকর্ড বুক। তাদের সকল অন্যায় কথা ও কাজের হিসাব যথাযথভাবে সেখানে রক্ষিত হচ্ছে। অতঃপর তার মৃত্যুর সাথে সাথে সেখানে মোহর মেরে দেওয়া হবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তা খোলা হবে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْراً يَّرَهُ، وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَهُ- ‘যে ব্যক্তি এক সরিষাদানা পরিমাণ নেকী করবে, সেটাও সেদিন দেখা হবে এবং যে ব্যক্তি এক সরিষাদানা পরিমাণ দুষ্কর্ম করবে, সেটাও সেদিন দেখা হবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। سِجِّيْنٍ শব্দটি سِجْنٌ থেকে এসেছে। যার অর্থ সংকীর্ণ স্থান বা কয়েদখানা। সিজ্জীন কি এবং কোথায়- এ বিষয়ে ত্বাবারী, বাগাভী প্রমুখ বিদ্বানগণ অনেকগুলি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। যেমন (ক) সেটি হ’ল সাত তবক যমীনের নীচে। সেখানে ইবলীস ও তার সন্তানেরা বসবাস করে। (খ) সিজ্জীন হ’ল সাত তবক যমীনের নীচে একটি কালো পাথরের নাম, যাতে প্রত্যেক কাফেরের নাম লেখা আছে। অবিশ্বাসীদের রূহগুলো সেখানে গিয়ে মিশবে। (গ) সিজ্জীন হ’ল জাহান্নামের একটি কূয়ার নাম ইত্যাদি (কুরতুবী)। এগুলি সবই ইস্রাঈলিয়াত মাত্র। যা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ বিষয়ে একমাত্র ব্যাখ্যা হ’ল সেটাই যা আল্লাহ দিয়েছেন। অর্থাৎ সিজ্জীন হ’ল كِتَابٌ مَرْقُوْمٌ ‘লিপিবদ্ধ খাতা’ বা অবিশ্বাসীদের আমলনামা। তবে ইবনু কাছীর বলেন, এটি হ’ল, كِتَابُ الْفُجَّارِ -এর ব্যাখ্যা। سِجِّيْنٌ -এর ব্যাখ্যা নয়’। যদিও এ ব্যাপারে ইবনু কাছীরের বক্তব্য স্পষ্ট নয়। তাফসীরে কুরতুবীর টীকাকার বলেন, সিজ্জীনের ব্যাখ্যা ‘লিপিবদ্ধ খাতা’ ব্যতীত আর সবই বাতিল।[12]মোদ্দাকথা, পাপাচারীদের আমলনামা সংরক্ষণের স্থান হবে সিজ্জীনে এবং সেখানেই কাফেরদের রূহ সমূহ জমা হবে। (৮) وَمَا أَدْرَاكَ مَا سِجِّيْنٌ ؟ ‘তুমি কি জানো সিজ্জীন কি?’ একথা বলে সিজ্জীনের ভয়ংকর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ক্বিয়ামত সম্পর্কে বলা হয়েছে الْقَارِعَةُ، مَا الْقَارِعَة، وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ ؟ ‘করাঘাতকারী’ ‘করাঘাতকারী কি’? ‘তুমি কি জানো করাঘাতকারী কি?’ (ক্বারে‘আহ ১০১/১-৩)। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ হতে সিজ্জীনে কারু আমল লেখার নির্দেশ হ’লে বুঝতে হবে যে, সে নিশ্চিতভাবে জাহান্নামী। নিঃসন্দেহে তা ভয়ংকর বিষয়। (৯) كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ ‘লিপিবদ্ধ খাতা’। مَرْقُوْمٌ এসেছে رقم থেকে। যার অর্থ লেখা। যাহহাক বলেন, مرقوم -এর অর্থ مختوم অর্থাৎ মোহরাংকিত। জীবনের শেষ অবধি মানুষের আমল লিখিত হয়। অতঃপর মৃত্যুর সাথে সাথে লেখা বন্ধ হয়ে যায় এবং উক্ত খাতা মোহর করে দেয়া হয়। তাতে কোনরূপ কম-বেশী করার সুযোগ থাকে না। অবশ্য তিন প্রকারের ছাদাক্বার নেকী তার আমলনামায় যুক্ত হ’তে থাকে, যে বিষয়ে ছহীহ মুসলিমে স্পষ্ট হাদীছ এসেছে।[13] বস্ত্ততঃ মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার কর্ম হারিয়ে যায় না। বরং পৃথিবীতে এক পার্শ্বে রাত্রির অন্ধকার নেমে এলেও সূর্য তার আলোসহ যেমন পৃথিবীর অপর পার্শ্বে অবস্থান করে। অনুরূপভাবে মানুষের জীবনে মৃত্যুর অন্ধকার নেমে এলেও তার রূহ তার আমলনামাসহ ইল্লিয়ীন অথবা সিজ্জীনে অবস্থান করে আল্লাহর হুকুমে। ক্বিয়ামতের দিন যা বিচারের জন্য পেশ করা হয়। সুবহানাল্লা-হি ওয়াবেহামদিহী, সুবহানাল্লা-হিল ‘আযীম। (১০) وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِيْنَ ‘সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের জন্য’। (১১) الَّذِيْنَ يُكَذِّبُوْنَ بِيَوْمِ الدِّيْنِ ‘যারা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে’। পূর্বোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে যে, মিথ্যারোপকারী তারাই যারা ক্বিয়ামত দিবসকে মিথ্যা মনে করে এবং এটাকে অসম্ভব বিষয় বলে থাকে। يَوْمِ الدِّيْنِ অর্থ يوم الحساب والجزاء والفصل بين العباد ‘হিসাব গ্রহণ, বদলা প্রদান ও বান্দাদের বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়ছালা করার দিন’। এক কথায় ‘বিচার দিবস’। সূরা ফাতিহাতে আল্লাহপাক নিজেকে مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ ‘বিচার দিবসের মালিক’ বলেছেন। (১২) وَمَا يُكَذِّبُ بِهِ إِلاَّ كُلُّ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ ‘অথচ এতে কেউ মিথ্যারোপ করে না, সীমালংঘনকারী পাপিষ্ঠ ব্যতীত’। অর্থ معتدٍ فى أفعاله وأثيمٌ فى أقواله ‘কাজে সীমালংঘনকারী ও কথায় পাপাচারী’। عَدَا يَعْدُوْ عَدْوًاঅর্থ দৌড়ানো, অতিক্রম করা। সেখান থেকে اعتدى অতঃপর معتدى অর্থ সীমালংঘনকারী। আয়াতে مضاف اليه হওয়ার কারণে শেষের ى বিলুপ্ত হয়ে مُعْتَدٍ হয়েছে। অর্থ معتدى عن الحق‘সত্য লংঘনকারী’। আর সীমালংঘনকারী ও পাপাচারী মূলতঃ তারাই হয়ে থাকে, যারা ক্বিয়ামতকে মিথ্যা বলে এবং আখেরাতে জওয়াবদিহিতাকে অস্বীকার করে। অলীদ বিন মুগীরাহ, আবু জাহল প্রমুখ মুশরিক নেতাদের উদ্দেশ্যে এ আয়াত নাযিল হয়। তাদের চরিত্রের প্রধান দু’টি দিক সম্পর্কে مُعْتَدٍ ও أَثِيْمٍ দু’টি শব্দে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। যুগে যুগে সকল অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের চরিত্র প্রায় একই ধরনের। (১৩) إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ ‘যখন তার কাছে আমাদের আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন বলে, এসব পুরাকালের কাহিনী মাত্র’। অর্থাৎ ঐ অবিশ্বাসীর নিকটে যখন আল্লাহর কালাম পাঠ করে শুনানো হয়, তখন সে এগুলি তাচ্ছিল্য করে বলে, ছাড়ো! ওসব হ’ল পুরানো দিনের কাহিনী মাত্র। সে আল্লাহর কালাম সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করে এবং মুখে যা ইচ্ছা তাই বলে। কুরআন সম্পর্কে কাফেরদের এই উক্তি ৯টি সূরায় ৯টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[14] বস্ত্ততঃ এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কাফেরদের দেওয়া ১৫টি অপবাদের অন্যতম। أساطير একবচনে أسطورةবা إسطارة অর্থ উপকথা বা কল্পকাহিনী (কুরতুবী)। এর দ্বারা তারা বুঝাতে চায় যে, কুরআন মুহাম্মাদ-এর বানোয়াট কালাম। এটি আল্লাহর কালাম ও তাঁর ‘অহি’ নয়। (১৪) كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوْبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُوْنَ ‘কখনোই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’। এখানেبَلْ -এর পরে সামান্য সাকতা বা বিরতি রয়েছে। তবে সাকতা করা হৌক বা না হৌক তাতে অর্থের কোন হেরফের হবে না। অর্থাৎ তারা যা বলছে, তা কখনোই নয়। কুরআন কখনোই কোন উপকথা নয়। বরং পাপাচার ও মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হওয়ায় তাদের হৃদয়ে কালিমা জমে গেছে। যেমন লোহার উপরে মরিচা ধরে যায়। মিথ্যার কালিমা তাদেরকে ঈমানের নূর হ’তে বঞ্চিত করেছে। জন্ডিসের রোগী যেমন সবকিছু হলুদ দেখে, সাপে কাটা রোগী যেমন তিতাকে মিঠা বলে, এইসব বস্ত্তবাদী নাস্তিকরা তেমনি মিথ্যাকে সত্য বলে ও সত্যকে মিথ্যা বলে। মরিচা যেমন লোহাকে খেয়ে শেষ করে দেয়, কুফর, নিফাক ও ফাসেকীর কলুষ-কালিমা তেমনি এদের ঈমান গ্রহণের সহজাত যোগ্যতাকে অকেজো করে দেয়। কুরআন নাযিলের সময়কাল হ’তে এযাবত এর ব্যত্যয় ঘটেনি। আল্লাহ বলেন, ــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــْئَتُهُ فَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ- ‘হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করে ও পাপ তাকে পরিবেষ্টন করে রাখে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮১)। এটাই হ’ল অন্তরে মরিচা। وهو الذنب على الذنب حتى يسوِّد القلبَ ‘এটা হ’ল পাপের উপর পাপ, যা অন্তরকে কালিমাচ্ছন্ন করে’। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِى قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ صُقِلَ قَلْبُهُ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ وَهُوَ الرَّانُ الَّذِى ذَكَرَ اللهُ (كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ)- ‘বান্দা যখন কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যখন সে পাপ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নেয় ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে ও তওবা করে, তখন অন্তরের মরিচা ছাফ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে পাপের পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে মরিচা বৃদ্ধি পায়। এমনকি মরিচা তার অন্তরের উপরে জয়লাভ করে (অর্থাৎ সে আর তওবা করে ফিরে আসে না)। এটাই হ’ল সেই মরিচা যে বিষয়ে আল্লাহ (উপরোক্ত আয়াতে) বর্ণনা করেছেন’।[15] হাসান বাছরী বলেন, هو الذنب على الذنب حتى يعمى القلب فيموت- ‘এটি পাপের উপরে পাপ, যা অবশেষে হৃদয়কে অন্ধ করে ফেলে। অতঃপর অন্তর মরে যায়’। একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ প্রমুখ বিদ্বানগণ (ইবনু কাছীর)। رَانَ يَرِيْنُ رَيْنًا رُيُوْنًا অর্থ ‘জয়লাভ করল’। যেমন বলা যে, رانت الخمر على عقله ‘মদ তার জ্ঞানের উপর জয়লাভ করেছে’। ران هواه على قلبه ‘প্রবৃত্তি তার হৃদয়ের উপর বিজয়ী হয়েছে’। যাজ্জাজ বলেন, الرَّين وهو كالصَّدَأ يُغَشِّى القلب كَالْغَيْمِ الرقيق ‘এটি হ’ল মরিচার মত, যা পাতলা মেঘের ন্যায় হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ মরিচা যেমন লোহার উপরে বৃদ্ধি পেয়ে লোহার শক্তি ও ঔজ্জ্বল্যকে বিনষ্ট করে। তেমনিভাবে পাপের কালিমা বৃদ্ধি পেয়ে অন্তরের মধ্যকার ঈমানের জ্যোতিকে ঢেকে ফেলে। যা মুমিনের ভিতর ও বাইরের শক্তি ও সৌন্দর্য বিনষ্ট করে। (১৫) كَلاَّ إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوْبُوْنَ ‘কখনোই না। তারা সেদিন তাদের প্রতিপালকের দর্শন হ’তে বঞ্চিত থাকবে’। كَلاَّ অর্থ لا অর্থাৎ অন্তরে মরিচা ধরার কারণে তারা কখনোই কোন নেকী অর্জন করতে পারে না। ফলে ক্বিয়ামতের দিন তাদের প্রতিপালকের দর্শন হ’তে তারা বঞ্চিত হবে। كَلاَّঅর্থ حقًّا হতে পারে। অর্থাৎ অন্তরে মরিচা ধরার কারণে তারা অবশ্যই ক্বিয়ামতের দিন তাদের প্রভুর দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হবে। حَجَبَ يَحْجُبُ حَجْبًا وحِجَابًا ‘পর্দা করা’। مَحْجُوْبٌ অর্থ ممنوع ‘নিষিদ্ধ’। অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের জন্য ঐদিন আল্লাহর দর্শন লাভ নিষিদ্ধ হবে’। যাজ্জাজ বলেন, ‘এই আয়াতে দলীল রয়েছে যে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখা যাবে। যদি সেটা না হয়, তাহ’লে এই আয়াতের কোন ফায়েদা থাকেনা। আর কাফেরদের মর্যাদারও কোন ঘাটতি বুঝানো যায় না’ (কুরতুবী)। ক্বিয়ামতের দিন সত্যিকারের মুমিনগণ আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখবে। যেভাবে মেঘমুক্ত রাতে পূর্ণিমার চাঁদকে স্পষ্ট দেখা যায়। এ বিষয়ে বহু ছহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[16] যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘লোকেরা জিজ্ঞেস করল, يَا رَسُوْلَ اللهِ، هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم نَعَمْ، هَلْ تُضَارُّوْنَ فِى رُؤْيَةِ الشَّمْسِ بِالظَّهِيْرَةِ ضَوْءٌ لَيْسَ فِيْهَا سَحَابٌ؟ قَالُوا لاَ. قَالَ وَهَلْ تُضَارُّونَ فِى رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ ضَوْءٌ لَيْسَ فِيْهَا سَحَابٌ؟ قَالُوا لاَ. فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ تُضَارُّوْنَ فِى رُؤْيَةِ رَبِّكُمْ إِلاَّ كَمَا تُضَارُّونَ فِى رُؤْيَةِ أَحَدِهِمَا- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে ক্বিয়ামতের দিন দেখতে পাব? জবাবে তিনি বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে মধ্যাহ্ন সূর্য দেখতে কি তোমাদের কোন সমস্যা হয়? লোকেরা বলল, না। তিনি বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে কি তোমদের কোন অসুবিধা হয়? লোকেরা বলল, না। তখন তিনি বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তার কসম করে বলছি, ঐ দু’টিকে দেখতে তোমাদের যদি কিছু সমস্যাও হয়, তবু তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে সেদিন সে সমস্যাটুকুও হবে না’।[17] হযরত ছোহায়েব (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا دَخَلَ أَهْلُ الْجَنَّةِ الْجَنَّةَ يَقُوْلُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى تُرِيدُوْنَ شَيْئًا أَزِيْدُكُمْ فَيَقُوْلُوْنَ أَلَمْ تُبَيِّضْ وُجُوهَنَا أَلَمْ تُدْخِلْنَا الْجَنَّةَ وَتُنَجِّنَا مِنَ النَّارِ؟ قَالَ: فَيَرْفَعُ الْحِجَابَ فَيَنْظُرُوْنَ إِلَى وَجْهِ اللهِ فَمَا أُعْطُوا شَيْئًا أَحَبَّ إِلَيْهِمْ مِنَ النَّظَرِ إِلَى رَبِّهِمْ ثُمَّ تَلاَ (لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ)-‘জান্নাতীগণ জান্নাতে প্রবেশ করার পর আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি আরও কিছু চাও, যা আমি তোমাদেরকে অতিরিক্ত প্রদান করব? তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারাকে উজ্জ্বল করেননি? আপনি কি আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাননি? এবং জাহান্নাম থেকে আমাদের নাজাত দেননি? রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁর নূরের পর্দা উন্মোচন করে দিবেন। তখন তারা আল্লাহর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এভাবে তাদের প্রভুকে চাক্ষুষ দেখার চাইতে প্রিয়তর কোন বস্ত্ত তাদেরকে এযাবৎ দেওয়া হয়নি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) নিম্নের আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ ‘যারা উত্তম কাজ করেছে, তাদের প্রতিদান হ’ল জান্নাত এবং তার চাইতে কিছু অতিরিক্ত’।[18] অন্য আয়াতেও এর দলীল এসেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ‘যেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে’। ‘তাদের প্রতিপালকের দিকে তারা তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২২-২৩)। বিশ্বাসে ও কর্মে সর্বাবস্থায় যারা দুনিয়াতে আল্লাহ ও তাঁর নাযিলকৃত বিধানের উপরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেটাই সেদিন তাদের চোখের দীপ্তি হিসাবে প্রতিভাত হবে এবং তার প্রেমাস্পদ আল্লাহকে সামনাসামনি দেখে তার চক্ষু জুড়াবে। কিন্তু যে ব্যক্তি দুনিয়াতে আল্লাহ ও তার বিধানসমূহের ব্যাপারে অবিশ্বাসী বা কপট বিশ্বাসী ছিল কিংবা দুর্বল বিশ্বাসী বা সুবিধাবাদী ছিল, দেখেও না দেখার ভান করেছিল। পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে কিংবা এ যুগে অচল বলে বাতিল করেছিল অথবা নানা অপব্যাখ্যার আড়ালে সত্যকে লুকাতে চেয়েছিল। এসবই সেদিন তাদের চোখের অন্ধত্ব হিসাবে দেখা দিবে। যেটা অন্য আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। যেমন, مَنْ كَانَ فِي هَـذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيْلاً‘যে ব্যক্তি ইহকালে অন্ধ ছিল, সে ব্যক্তি পরকালেও হবে অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৭২)। এখানে ইহকালে অন্ধ বলতে হৃদয়ের অন্ধ বুঝানো হয়েছে, চর্মচক্ষুর অন্ধ নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى- قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا- قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى-‘যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ, তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমরা তাকে ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়’। ‘সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমিতো ছিলাম চক্ষুষ্মান’। ‘তিনি বলবেন, এরূপই। আমাদের আয়াতসমূহ তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। অতএব সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হ’লে’ (ত্বোয়াহা ২০/১২৪-২৬)। বস্ত্ততঃ ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে পারাটাই হবে মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার ও সবচেয়ে বড় আনন্দঘন মুহূর্ত। সেকারণ ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) বলেন, أما والله لو لم يُوْقَنْ محمدَ بنَ ادريسَ أنه يرى ربه فى المعاد لما عبده فى الدنيا- ‘আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস (শাফেঈ)-এর নিকট এটা স্পষ্ট না হ’ত যে, সে তার প্রভুকে আখেরাতে দেখতে পাবে, তাহ’লে সে কখনো দুনিয়াতে তার ইবাদত করতো না’ (কুরতুবী)। উপরোক্ত আলোচনায় এটা বুঝা যায় যে, মুমিনগণ আল্লাহকে ক্বিয়ামতের ময়দানে দেখবে। অতঃপর জান্নাতে গিয়ে পুনরায় দেখবে (ইবনু কাছীর)। ক্বিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ স্বীয় পায়ের নলা বের করে দিয়ে সেখানে সবাইকে সিজদা করতে বলবেন। ঈমানদারগণ সিজদা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু মুনাফিক ও কাফিরগণ ব্যর্থ হবে (ক্বলম ৬৮/৪২-৪৩)। হাসান বাছরী বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ স্বীয় পর্দা খুলে দিবেন, তখন মুমিন ও কাফির সাবই সেদিকে তাকাবে। কিন্তু মুমিনরা দেখবে ও কাফিররা বঞ্চিত হবে’ (ইবনু কাছীর)। উল্লেখ্য যে, মু‘তাযেলী মুফাসসিরগণ আল্লাহ দর্শনে বিশ্বাস করেন না। ফলে তারা অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেন, اى عن كرامته ورحمته ممنوعون ‘তারা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ হ’তে বঞ্চিত হবে’ (কুরতুবী)। এ ব্যাখ্যা কুরআন ও হাদীছের বিরোধী। যা গ্রহণযোগ্য নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে কুরতুবী নিজেই এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা বাতিল (আল-মাগরাবী, আল-মুফাসসিরূন ১/৪৪৫)। তাঁরা দলীল দেন আন‘আম ১০৩ আয়াত দিয়ে।- لاَ تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ (চক্ষুসমূহ তাঁকে পরিবেষ্টন করে না, বরং তিনিই চক্ষুসমূহকে পরিবেষ্টন করেন’ (আন‘আম ৬/১০৩)। অথচ এ আয়াত তাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। কেননা এখানে ‘পরিবেষ্টন’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ‘দর্শন’কে নিষিদ্ধ করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ এর মাধ্যমে দুনিয়াতে চর্মচক্ষু দিয়ে আল্লাহকে দেখা অসম্ভব বুঝানো হয়েছে। যেমন মূসা (আঃ) দেখতে পাননি। কিন্তু আখেরাতের বিষয়টি আলাদা। (১৬-১৭) ثُمَّ إِنَّهُمْ لَصَالُوا الْجَحِيْمِ، ثُمَّ يُقَالُ هَذَا الَّذِيْ كُنتُمْ بِهِ تُكَذِّبُوْنَ ‘অতঃপর তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। ‘অতঃপর তাদের বলা হবে, এটাই তো সেই স্থান, যাতে তোমরা মিথ্যারোপ করতে’। صَلِىَ صَلًى وَصِلًى صَلِيًّا النَّارَ অর্থ احترق بها وفيها ‘আগুনে জ্বলা’। সেখান থেকে اسم فاعل হ’ল صَالٍ বহুবচনে صَالِيُوْنَ অতঃপর ي বিলুপ্ত করে হয়েছে صَالُوْنَ যার উপরে لام تاكيد এসেছে। অতঃপর পরবর্তী শব্দের প্রতি إضافت -এর কারণে نون جمع বিলুপ্ত হয়ে لَصَالُوا الْجَحِيْمِ হয়েছে। অর্থ ‘তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। এখানে إِنَّ ও لَ দু’টি তাকীদপূর্ণ অব্যয় আনা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহকে দেখার মহা সৌভাগ্য হ’তে বঞ্চিত হওয়ার পর তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে এবং সেখান থেকে তারা আর বের হতে পারবে না। আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا الَّذِيْنَ فَسَقُوْا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ كُلَّمَا أَرَادُوْا أَن يَخْرُجُوْا مِنْهَا أُعِيْدُوْا فِيْهَا وَقِيْلَ لَهُمْ ذُوقُوْا عَذَابَ النَّارِ الَّذِيْ كُنتُمْ بِهِ تُكَذِّبُوْنَ- ‘পক্ষান্তরে যারা পাপাচারী, তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে পুনরায় সেখানে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের যে আযাবকে মিথ্যা বলতে তার স্বাদ আস্বাদন কর’ (সাজদাহ ৩২/২০)। এখানে দুই আয়াতে দুই রকম আযাবের কথা এসেছে। এক- জাহান্নামের দৈহিক শাস্তি। দুই- তারা যে মিথ্যারোপ করেছিল, সে বিষয়ে ধিক্কার ও বিদ্রুপের মানসিক শাস্তি। তাদের আযাবের ধরন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُوْدُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُوْداً غَيْرَهَا لِيَذُوقُوا الْعَذَابَ ‘যখন তাদের চামড়াগুলো জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন পুনরায় আমরা তা পাল্টে দেব নতুন চামড়া দিয়ে। যাতে তারা শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে’ (নিসা ৪/৫৬)। দুনিয়াতে যেমন দুষ্টু লোকদের স্তরভেদ থাকে। আখেরাতে তেমনি থাকবে। সেখানে মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে (নিসা ৪/১৪৫)। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, এই আয়াত বা এটির ন্যায় অন্য আয়াত সমূহে আল্লাহ কাফেরদের দু’টি আযাব একত্রে বর্ণনা করেছেন। একটি হ’ল আল্লাহকে দেখতে না পাওয়ার আযাব (عذاب الحجاب) , অন্যটি হ’ল জাহান্নামের আযাব (عذاب النار)। দেখতে না পাওয়ার আযাব হবে তাদের অন্তরে ও আত্মায় এবং দেহের আযাব হবে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে। এর বিপরীত তিনি মুমিনদের জন্য দু’টি পুরস্কার দিবেন। এক- আল্লাহকে দেখার পুরস্কার এবং দুই- জান্নাতে সুখ-সম্ভারের পুরস্কার’ (ক্বাসেমী)। আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত সৌভাগ্যের অধিকারী করুন -আমীন! বদকারদের শাস্তি বর্ণনার পর এক্ষণে নেককারদের আপ্যায়নের বর্ণনা শুরু হচ্ছে (১৮-২৮)।- (১৮-২১)كَلاَّ إِنَّ كِتَابَ الْأَبْرَارِ لَفِيْ عِلِّيِّيْنَ، وَمَا أَدْرَاكَ مَا عِلِّيُّوْنَ، كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ، يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُوْنَ ‘কখনই না। নিশ্চয়ই নেককারগণের আমলনামা থাকবে ইল্লিয়ীনে’। ‘তুমি জানো ইল্লিয়ীন কি?’ ‘লিপিবদ্ধ খাতা’। ‘নৈকট্যশীলগণ তা প্রত্যক্ষ করে’। এটি পূর্বে বর্ণিত كِتَابَ الْفُجَّارِ -এর বিপরীত। ৭ হ’তে ১৭ পর্যন্ত ১১টি আয়াতে বদকার লোকদের পরকালীন শাস্তি বর্ণনার পরে এক্ষণে ১৮ হ’তে ২৮ পর্যন্ত ১১টি আয়াতে নেককার লোকদের পারলৌকিক পুরস্কারের বিবরণ দেয়া হচ্ছে। كَلاَّঅর্থাৎ নেককার ব্যক্তিগণ কখনোই বদকারদের মত নয়। দুনিয়াতে তারা ঈমানের বরকতে উন্নত চরিত্র ও উচ্চ মর্যাদায় আসীন ছিল। আখেরাতেও তাদের আমলনামা সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে থাকবে। عِلِّيِّيْنَ এসেছে علو থেকে। যার অর্থ উচ্চ। যার বিপরীত হ’ল سِجِّيْنٌ যা সর্বনিম্ন স্থানে থাকবে (ইবনু কাছীর)। ফার্রা বলেন, عِلِّيِّيْنَ অর্থ উঁচুর উপরে উঁচু। যা সর্বদা বহুবচন হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। এর কোন এক বা দ্বিবচন নেই। এতে পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ সবক্ষেত্রে বহুবচনের نون جمع আসে। যেমন عشرون، ثلثون বিশ, ত্রিশ ইত্যাদি (কুরতুবী)। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বিষয়টি মূলত মর্যাদাগত। তবে স্থানগতও হ’তে পারে। যেমন ইবনু আববাস, যাহহাক, ক্বাতাদাহ প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইল্লিয়ীন হ’ল সাত আসমানের উপরে আরশের নীচে সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে। যা সকল বস্ত্তর প্রত্যাবর্তন স্থল। আল্লাহর হুকুম ব্যতীত যা অতিক্রম করা যায় না (কুরতুবী)। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَهْلَ الْجَنَّةِ يَتَرَاءَيُوْنَ أَهْلَ الْغُرَفِ مِنْ فَوْقِهِمْ كَمَا يَتَرَاءَيُوْنَ الْكَوْكَبَ الدُّرِّىَّ الْغَابِرَ فِى الأُفُقِ مِنَ الْمَشْرِقِ أَوِ الْمَغْرِبِ، لِتَفَاضُلِ مَا بَيْنَهُمْ- ‘জান্নাতবাসীগণ উপর থেকে পরস্পরের কক্ষ সমূহ দেখতে পাবে বহু দূরে অবস্থিত উজ্জ্বল তারকারাজি ন্যায় পরস্পরের মর্যাদা অনুযায়ী’।[19] এর দ্বারা ইল্লিয়ীন একটি উচ্চ স্থানের নাম বলে প্রমাণিত হয়। (১৯) وَمَا أَدْرَاكَ مَا عِلِّيُّوْنَ ‘তুমি কি জানো ইল্লিয়ীন কি?’ এর দ্বারা ইল্লিয়ীনের উচ্চমর্যাদা বুঝানো হয়েছে। (২০) كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ ‘লিপিবদ্ধ খাতা’। অর্থাৎ এটি লিপিবদ্ধ। যা পরিবর্তনীয় নয়। বিদ্বানগণের মতে এটি ইল্লিয়ীনের ব্যাখ্যা নয়। বরং ঈমানদার বান্দাগণের দফতর, যেখানে তাদের নেক আমলসমূহ লিপিবদ্ধ থাকে (কুরতুবী)। উচ্চমর্যাদার কারণে এই দফতরকে ‘ইল্লিয়ীন’ বলা হয়েছে। (২১) يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُوْنَ ‘নৈকট্যশীলগণ তা প্রত্যক্ষ করে’। এখানে ‘নৈকট্যশীলগণ’ অর্থ ফেরেশতাগণ এবং বান্দাগণ দু’টিই হ’তে পারে। ‘বান্দাগণ’ অর্থ নিলে সেটি ১৮ আয়াতে বর্ণিত الْأَبْرَارِ ‘নেককারগণ’ হ’তে পুনরুক্তি হবে (ক্বাসেমী)। যারা অটুট আনুগত্য ও অধিক ইবাদতের কারণে আল্লাহর নৈকট্যশীল হয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদাকে আল্লাহ উচ্চ করবেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। আর তারা এই আমলনামা দেখবেন আল্লাহর সান্নিধ্যে বসে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ، فِيْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ- ‘নিশ্চয়ই মুত্তাক্বীরা থাকবে জান্নাতে ও নদীতে’। ‘প্রকৃত সম্মানের আসনে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর সান্নিধ্যে’ (ক্বামার ৫৪/৫৪-৫৫)। অর্থাৎ সকল নৈকট্যশীল ফেরেশতা ও নেককার বান্দারা তা দেখবে ও আনন্দ প্রকাশ করবে। দুনিয়াতে যেমন নিকটজনের ভাল কর্মফলে নিকটজনেরা খুশী হয়। আখেরাতে তেমনি ফেরেশতারা নেককার বান্দাদের সুন্দর কর্মফল ও সুন্দর আমলনামা দেখে মহা খুশী হবে। দুনিয়াতে যেমন নেককার মুমিনদের স্তরভেদ থাকে, আখেরাতেও তেমনি থাকবে। তারা তাদের ঈমান, ইলম ও আমল অনুযায়ী জান্নাতের বিভিন্ন স্তরে স্থান পাবেন এবং তাদের আপ্যায়নও সে ধরনের হবে। যারা আল্লাহ প্রদত্ত ইলম ও চিন্তাশক্তিকে আল্লাহ প্রেরিত অহি-র প্রচারক, ব্যাখ্যাকারী ও প্রতিষ্ঠা দানকারী হওয়ার পিছনে সাধ্যমত সবকিছু ব্যয় করেন, তারা নিশ্চয়ই অগ্রবর্তী দলের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর যারা তাদের অনুসারী হবেন ও সাহায্যকারী হবেন, তারা ক্বিয়ামতের দিন দক্ষিণ সারির অন্তর্ভুক্ত হবেন। সর্বোচ্চ মুমিনদের জান্নাতুল ফেরদৌসে রাখা হবে এবং সেখানে তাদের সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করা হবে (কাহফ ১৮/১০৭; ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭-৪০)। (২২) إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই নেককারগণ থাকবে জান্নাতে’। ‘আবরার’ হল ‘ফুজ্জার’-এর বিপরীত এবং ‘নাঈম’ হ’ল ‘জাহীম’-এর বিপরীত। ক্বিয়ামতের দিন আবরার অর্থাৎ নেককার, সত্যবাদী ও আনুগত্যশীল মুমিনগণ নে‘মতপূর্ণ স্থানে থাকবে। আর সেটা হ’ল ‘নাঈম’ বা জান্নাত। যা চিরস্থায়ী নে‘মতে সর্বদা পূর্ণ থাকবে। (২৩) عَلَى الْأَرَائِكِ يَنظُرُوْنَ ‘উচ্চাসনে বসে তারা অবলোকন করবে’। অর্থাৎ তারা মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসে মুগ্ধ নয়নে জান্নাতের নে‘মতসমূহ দেখতে থাকবে। (২৪) تَعْرِفُ فِيْ وُجُوْهِهِمْ نَضْرَةَ النَّعِيْمِ ‘তুমি তাদের চেহারাসমূহে স্বাচ্ছনেদ্যর প্রফুল্লতা দেখতে পাবে’। অর্থাৎ তাদের চেহারায় সর্বদা সজীবতা ও উজ্জ্বলতা দেখতে পাবে। আর এটা হবে তাদের অনন্ত সুখ ও প্রাচুর্যের উৎফুল্লতা। যা সুখী ও সচ্ছল লোকদের মাঝে সচরাচর দেখা যায় এবং যার উজ্জ্বলতা তাদের চেহারায় ফুটে ওঠে। জান্নাতের নে‘মত দু’ধরনের হবে। দৈহিক ও মানসিক। দৈহিক নে‘মত, যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَر، ثم قرأ : فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِىَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমনসব নে‘মতরাজি প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শোনেনি, হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি’। অতঃপর তিনি পাঠ করেন, ‘কেউ জানেনা তাদের জন্য তাদের সৎকর্মের পুরস্কারস্বরূপ চক্ষুশীতলকারী কত নে‘মত লুক্কায়িত রয়েছে’।[20] আর মানসিক শান্তির নে‘মত, যেমন বলা হবে, سَلاَمٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوْهَا خَالِدِيْنَ ‘তোমাদের প্রতি সালাম। তোমরা সুখী হও। আর তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর চিরস্থায়ীভাবে’ (যুমার ৩৯/৭৩)। (২৫) يُسْقَوْنَ مِنْ رَّحِيْقٍ مَّخْتُوْمٍ ‘তাদেরকে মোহরাংকিত বিশুদ্ধ পানীয় পান করানো হবে’। পক্ষান্তরে বদকারদের পানীয় হবে তাদের দেহনিঃসৃত ঘাম ও পুঁজ-রক্ত আর উত্তপ্ত পানি (হা-ক্কাহ ৬৯/৩৬; নাবা ৭৮/২৫)। আর থাকবে তিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত ‘যাক্কূম’ বৃক্ষ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৫২-৫৪) এবং বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত শুকনা ‘যরী‘ ঘাস’। যা তাদের ক্ষুধা দূর করবে না এবং তারা তাতে পুষ্ট হবে না’ (গাশিয়াহ ৮৮/৬-৭)। ইবনু মাস‘ঊদ, ইবনু আববাস, মুজাহিদ, হাসান, ক্বাতাদাহ প্রমুখ বলেন, ‘রাহীক্ব’ হ’ল জান্নাতী শারাবের নাম’। খলীল বলেন, যা হ’ল সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও উত্তম’ (أصفى الخمر وأجودها)। যা পান করলে দুনিয়ার শারাবের মত তাদের শিরঃপীড়া হবে না বা মাথা ঘুরবে না ও তারা মাতালও হবে না (ছাফফাত ৩৭/৪৭; ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/১৯)। বরং তারা স্থায়ী আনন্দ লাভ করবে। (২৬) خِتَامُهُ مِسْكٌ وَفِيْ ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ ‘তার মোহর হবে মিশকের। আর এরূপ বিষয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত’। অর্থাৎ জান্নাতীদের জন্য নির্ধারিত শারাবের মোহর হবে মিশকের যা হ’ল সর্বাপেক্ষা সুগন্ধিময়। ‘আর এরূপ (মূল্যবান ও সর্বোত্তম) বিষয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, لِمِثْلِ هَذَا فَلْيَعْمَلِ الْعَامِلُوْنَ ‘এমন সাফল্যের জন্যই পরিশ্রমীদের পরিশ্রম করা উচিত’ (ছাফফাত ৩৭/৬১)। التَّنَافُس এসেছে النفيس থেকে। যার অর্থ الشئ النفيس ‘সবচেয়ে মূল্যবান বস্ত্ত’। যা পাওয়ার জন্য মানুষ সর্বদা লালায়িত হয়। এক্ষণে আয়াতের মর্ম দাঁড়াচ্ছে, فليرغب الراغبون بالاستباق إلى طاعة الله تعالى ‘এমন বস্ত্তর প্রতি লোভীদের লালায়িত হওয়া উচিৎ আল্লাহর আনুগত্যের কাজে পরস্পরে প্রতিযোগিতা করার মাধ্যমে’ (ক্বাসেমী)। (২৭) وَمِزَاجُهُ مِن تَسْنِيْمٍ ‘আর তাতে মিশ্রণ থাকবে তাসনীমের’। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, مِزَاجُهُ অর্থ خَلْطُهُ ‘মিশ্রণ’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ ‘রাহীক্ব’ শারাবের সঙ্গে ‘তাসনীম’ ঝর্ণার পানীয়ের মিশ্রণ থাকবে। আর ‘তাসনীম’ হ’ল জান্নাতের সর্বোচ্চ ও সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ পানীয়, যা অগ্রবর্তী ও আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্যশীল বান্দাদের একমাত্র পানীয় হবে। যেমন পরের আয়াতেই আল্লাহ বলেন, (২৮) عَيْناً يَّشْرَبُ بِهَا الْمُقَرَّبُوْنَ ‘এটি একটি ঝর্ণা, যা থেকে পান করবে নৈকট্যশীলগণ’। অর্থাৎ ‘তাসনীম’ পানীয়ের ঝর্ণাটি আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্যশীল বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট। তারা কেবল এখান থেকেই পান করবেন। আর مِزَاجُهُ শব্দ থেকে বুঝা যায় যে, দক্ষিণ সারিভুক্ত জান্নাতীদের ‘রাহীক্ব’ পানীয়ের সাথে সর্বোচ্চ পানীয় ‘তাসনীম’-এরও মিশ্রণ থাকবে (يشربها المقربون صِرْفًا وتمزج لاصحاب اليمين مَزَجًا)। যাতে তারাও এর স্বাদ কিছুটা আস্বাদন করতে পারে। ইবনু মাস‘ঊদ, ইবনু আববাস, ক্বাতাদাহ, মাসরূক্ব প্রমুখ একথা বলেন (ইবনু কাছীর)। ‘তাসনীম’ অর্থ উচ্চ। উটের পিটের কুঁজোকে ‘সিনাম’ (سنام) বলা হয় দেহ থেকে উঁচু হওয়ার কারণে। ‘তাসনীম’ হ’ল জান্নাতের সর্বোচ্চ পানীয়। যার ঝর্ণাধারা আল্লাহর আরশের নীচ থেকে জান্নাতসমূহের দিকে প্রবাহিত হয়। সর্বোচ্চ প্রশংসিত পানীয় হওয়ার কারণেই এর নাম হয়েছে ‘তাসনীম’ (কুরতুবী)। উল্লেখ্য যে, এখানে يَشْرَبُ مِنْهَا না বলে يَشْرَبُ بِهَا কেন বলা হ’ল? এর জবাব দু’ভাবে হ’তে পারে। এক- এখানে بِهَا অর্থ مِنْهَا এবং দুই- يَشْرَبُ بِهَا অর্থ يَرْوَى بِهَا ‘পরিতৃপ্ত হবে’। শেষের মর্মটাই উত্তম। কেননা অনেক সময় পানি পান করলেও তৃপ্ত হওয়া যায় না। কিন্তু তৃপ্ত হ’লে পান করাটাও বুঝায়। অতঃপর দুনিয়াতে পাপী ব্যক্তিরা নেককার ব্যক্তিদের সাথে কেমন আচরণ করত এবং পরকালে তার ফলাফল তাদের কেমন হবে, আল্লাহ তার বিবরণ দিচ্ছেন (২৯-৩৬)।- (২৯) إِنَّ الَّذِيْنَ أَجْرَمُوْا كَانُوْا مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا يَضْحَكُوْنَ ‘নিশ্চয়ই যারা পাপী, তারা (দুনিয়ায়) বিশ্বাসীদের উপহাস করত’। অর্থাৎ অঢেল ধন-সম্পদের অধিকারী ও গর্বোদ্ধত এইসব পাপিষ্ঠ মুশরিক নেতারা ঈমানদারগণকে দেখে তাচ্ছিল্য ভরে হাসতো ও উপহাস করতো। ঈমানদার বলতে সে সময় ‘আম্মার, খাববাব, ছোহায়েব, বেলাল প্রমুখ গোলাম ছাহাবীদের বুঝানো হলেও এর অর্থ সকল যুগের সকল ঈমানদার মুসলমানগণ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন যে, আয়াতগুলি মক্কার মুশরিক নেতা অলীদ বিন মুগীরাহ, ওক্ববা ইবনু আবী মু‘আইত্ব, ‘আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন আবদে ইয়াগূছ, ‘আছ বিন হেশাম, আবু জাহ্ল ও নযর ইবনুল হারেছ প্রমুখ সম্পর্কে নাযিল হয় (কুরতুবী)। এইসব নিকৃষ্টতম শত্রুদের আচরণ রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের সাথে কেমন ছিল, তার বাস্তব বাণীচিত্র ফুটে উঠেছে সূরার শেষ পর্যন্ত বর্ণিত আয়াতগুলিতে। যুগে যুগে খালেছ ইসলামী নেতৃবৃন্দের সাথে মুশরিক নেতাদের আচরণ ঠিক অনুরূপ হবে, সেকথাই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কুরআনের খালেছ অনুসারী ঈমানদার নেতৃবৃন্দকে। সাথে সাথে তাদেরকে জান্নাতের বিনিময়ে ধৈর্যধারণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (৩০) وَإِذَا مَرُّواْ بِهِمْ يَتَغَامَزُوْنَ ‘যখন তারা তাদের অতিক্রম করত, তখন তাদের প্রতি চোখ টিপে হাসতো’। অর্থাৎ তাদের যেতে দেখলে এই সব নেতারা তাচ্ছিল্যভরে কটাক্ষ করত’। اَلْغَمْزُ অর্থ الإشارة بالعين أو الجفن والحاجب ‘চোখ, পলক ও ভ্রু দিয়ে ইঙ্গিত করা’ (ক্বাসেমী)। অর্থাৎ চোখ টিপে হাসা ও কটাক্ষ করা। (৩১) وَإِذَا انقَلَبُواْ إِلَى أَهْلِهِمُ انقَلَبُوْا فَكِهِيْنَ ‘আর যখন তারা তাদের পরিবারের কাছে ফিরত, তখন উৎফুল্ল হয়ে ফিরত’। অর্থাৎ তারা কেবল রাস্তাঘাটেই এরূপ আচরণ করতো না, বরং তারা যখন তাদের বাড়ীতে স্ব স্ব পরিবারের কাছে ফিরে যেত, তখনও এই সব গরীব ও দুর্বল মুসলমানদের নিয়ে হাসাহাসি করতো। তারা বিস্ময় প্রকাশ করতো একথা ভেবে যে, এই সব লোকেরা ইসলামের মধ্যে কি পেয়েছে, যার জন্য তারা বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করছে? মারপিট ও অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করছে। কেউ কেউ জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। তথাপি মুহাম্মাদ ও তার দ্বীনকে ছাড়ছে না। দুনিয়ার কোন মায়া-মহববত ও লোভ-লালসা এদেরকে ইসলাম থেকে একচুল নড়াতে পারছে না। (৩২) وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوا إِنَّ هَؤُلاَء لَضَالُّونَ ‘যখন তারা বিশ্বাসীদের দেখত, তখন বলত, নিশ্চয়ই ওরা পথভ্রষ্ট’। অর্থাৎ মুসলমানদের দেখলে তারা বলত যে, এরা সবাই বিভ্রান্ত। কেননা সমাজনেতাদের কাছে প্রকৃত পথ হ’ল সেটাই, যে পথে তারা চলেন বা তাদের বাপ-দাদারা চলেছেন। যেমন ফেরাঊন মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে তার জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, مَا أُرِيْكُمْ إِلاَّ مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيْكُمْ إِلاَّ سَبِيْلَ الرَّشَادِ- ‘আমি যা বুঝি তোমাদেরকে তাই বুঝাই। আর আমি তোমাদের কেবল মঙ্গলের পথই দেখাই’ (মুমিন ৪০/২৯)। আজও ইসলাম বিরোধী নেতাকর্মীরা ইসলামী নেতাকর্মীদেরকে সেকথাই বলে থাকে। তারা সর্বদা উপদেশ খয়রাত করেন ও সবাইকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথিত মূল স্রোতে ফিরে আসতে বলেন। অথচ ওটা তো শয়তানী স্রোত। যেখানে দুনিয়াপূজারীদের ভিড়। এদের ভিড়ে অনেক অদূরদর্শী ইসলামী নেতাও ঢুকে পড়েন এবং অন্যদের পরিশুদ্ধ করার নামে অবশেষে নিজেরাই অশুদ্ধ হয়ে যান। যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, أُولَـئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُاْ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآَخِرَةِ فَلاَ يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلاَ هُمْ يُنْصَرُوْنَ- ‘এরাই হ’ল সেইসব লোক, যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়াবী জীবনকে খরিদ করে নিয়েছে। তাদের উপরে আযাবকে হালকা করা হবে না এবং তাদেরকে কোনরূপ সাহায্য করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৮৬)। ইহুদী-নাছারা ধর্মনেতারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়া খরিদ করতো। মুসলিম ধর্মনেতারাও যে তার অনুসরণ করবে, সে বিষয়ে হাদীছে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ دَخَلُوْا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوهُمْ. قِيْلَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى قَالَ: فَمَنْ؟ ‘অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি-নীতির অনুকরণ করবে বিঘতে-বিঘতে, হাতে-হাতে ঠিক-ঠিকভাবে। বলা হ’ল, তারা কি ইহুদী-নাছারা? রাসূল (ছাঃ) বললেন, নয়তো আবার কারা?’[21] জাহেলিয়াতের সঙ্গে আপোষকামী ও সুবিধাবাদী লোকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘যারা রাসূলের আদেশের (অর্থাৎ তার আনীত শরী‘আতের) বিরোধিতা করবে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হৌক যে তাদেরকে (দুনিয়ায়) গ্রাস করবে নানাবিধ ফিৎনা এবং (আখেরাতে) পাকড়াও করবে মর্মান্তিক আযাব’ (নূর ২৪/৬৩)। আল্লাহর এ অমোঘ বাণী কি আজকের দুনিয়ায় বাস্তব হয়ে দেখা দেয়নি? আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে পদদলিত করে জনগণের সার্বভৌমত্বের ধোঁকা দিয়ে নেতা-কর্মীদের মনগড়া আইন ও স্বেচ্ছাচারী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মযলূম মানবতা আজ ত্রাহি ত্রাহি করছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, দলাদলি-হানাহানি, যুদ্ধ-সন্ত্রাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলিই তো দুনিয়াপূজারীদের জন্য দুনিয়াবী আযাব। আখেরাতে জাহান্নামের কঠিন আযাব তো এদের জন্য প্রস্ত্তত করাই আছে। আল্লাহ বলেন, وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ‘(জাহান্নামের) কঠিন শাস্তির পূর্বে তাদেরকে আমরা অবশ্যই (দুনিয়াতে) লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো। যাতে তারা ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)। (৩৩) وَماَ أَُرْسَلُوْا عَلَيْهِمْ حَافظيْن ‘অথচ তারা বিশ্বাসীদের উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে প্রেরিত হয়নি’। অর্থাৎ ঐসব সমাজনেতাদেরকে মুমিন-মুসলমানদের তত্ত্বাবধানকারী হিসাবে প্রেরণ করা হয়নি। অথচ বাস্তব কথা এই যে, নেতারা সর্বদা সেটাই মনে করে থাকেন। আর দুর্বলচেতা লোকেরাও নেতাদেরকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমন স্থানে নিয়ে যায় যে, তারা নিজেদেরকে সেভাবেই কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। দুনিয়াদার নেতারা অবশেষে জনগণের ‘রব’-এর আসন দখল করেন অঘোষিতভাবে। যা তাদেরকে উদ্ধত ও অহংকারী করে তোলে। অবশেষে ফেরাঊনের মত আল্লাহর গযবে তারা ধ্বংস হয়ে যায় ও সেই সাথে জনগণও গযবের শিকার হয়। উপরোক্ত আয়াতগুলিতে ইঙ্গিত রয়েছে এবিষয়ে যে, আল্লাহর দ্বীনের সত্যিকারের অনুসারীদের জন্য সর্বদা দু’ধরনের শত্রু থাকবে। একদল থাকবে মূর্খ বিদ্রুপকারী। আরেক দল থাকবে চিন্তাশীল হিংসুক শ্রেণী। এই দুই শ্রেণীর নির্যাতন সহ্য করেই ইসলামের বিজয়ী কাফেলা সর্বদা এগিয়ে চলে জান্নাতের পানে। (৩৪) فَالْيَوْمَ الَّذِيْنَ آمَنُواْ مِنَ الْكُفَّارِ يَضْحَكُوْنَ ‘পক্ষান্তরে আজকের দিনে বিশ্বাসীরা অবিশ্বাসীদের দেখে হাসবে’। কেননা দুনিয়াতে যেসব নেতারা ঈমানদারগণকে বিদ্রুপ করতো এবং নিজেদেরকে সফলকাম ভাবতো, তারাই এখন পর্যুদস্ত হয়ে জাহান্নামের আগুনে জ্বলছে। এ দৃশ্য দেখে তাদের হাসি পাবে। (৩৫) عَلَى الْأَرَائِكِ يَنْظُرُوْنَ ‘উচ্চাসনে বসে তারা অবলোকন করবে’। যেসব দুনিয়াপূজারী নেতা দুর্বল মুমিন-মুসলমানদের সেকেলে ও নস্ট্যালজিক (Nostalgic) বলে গালি দিত, যাদেরকে চেয়ারে বসতে দেওয়া দূরে থাক, দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করতে বাধ্য করা হ’ত। সেইসব অহংকারী লোকেরাই এখন উপুড় মুখে মাটি ঘেঁষে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يُسْحَبُوْنَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوْهِهِمْ ذُوْقُوْا مَسَّ سَقَرَ ‘যেদিন তাদেরকে উপুড়মুখী করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে (এবং বলা হবে,) আগুনের স্বাদ আস্বাদন কর’ (ক্বামার ৫৪/৪৮)। এধরণের শাস্তি যারা পাবে ক্বিয়ামতের দিন তাদের বিচার প্রথম দিকেই করা হবে। তারা হবে প্রথমে ‘লোক দেখানো শহীদ’। অতঃপর ‘দুনিয়াদার আলেম’। অতঃপর ‘কথিত দানবীর’।[22] পক্ষান্তরে নিষ্কাম মুমিন-মুসলমানেরা মহাসম্মানিত উচ্চাসনে বসে ওদের লজ্জাকর শাস্তি অবলোকন করবে। (৩৬) هَلْ ثُوِّبَ الْكُفَّارُ مَا كَانُوا يَفْعَلُوْنَ ‘অবিশ্বাসীরা (দুনিয়ায়) যা করতো, তার প্রতিফল (আজ আখেরাতে) তারা পেয়েছে তো?’ অর্থাৎ আল্লাহ বলবেন, দুনিয়ায় পাপীদের অবিশ্বাস ও বিশ্বাসীদের প্রতি তাচ্ছিল্যের শাস্তি তারা আজ পুরোপুরি পেয়েছে। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল অবিশ্বাসীদের চূড়ান্ত পরিণতি। অহংকারীদের এই পরিণতির কোন ব্যত্যয় দুনিয়াতে নেই। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন! আমীন!! ثُوِّبَ অর্থ اُثِيْبَ وجُوْزِىَ যা এসেছে ثَابَ يَثُوْبُ থেকে, যার অর্থ رَجَعَ প্রত্যাবর্তন করা। এক্ষণে ثواب অর্থ হ’ল, ما يرجع على العبد فى مقابلة عمله ‘আমলের বিনিময়ে বান্দার দিকে যা প্রত্যাবর্তিত হয়’। এটি ভাল ও মন্দ উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় (কুরতুবী)। যেমন ৩য় হিজরীতে ওহোদের যুদ্ধে বিপর্যস্ত মুসলিম সেনারা রাসূল (ছাঃ)-এর আহবানকে উপেক্ষা করে যখন পাহাড়ে উঠে পালাচ্ছিল, তখন তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, فَأَثَابَكُمْ غَمًّا بِغَمٍّ‘আল্লাহ তোমাদের বদলা দিলেন দুঃখের পর দুঃখ’... (আলে ইমরান ৩/১৫৩)। পক্ষান্তরে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহতে হোদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে ওছমান (রাঃ)-কে হত্যার খবর শুনে মক্কার মুশরিক নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নিরস্ত্র ১৪০০ ছাহাবী যখন আল্লাহর উপরে ভরসা করে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে হাত রেখে আনুগত্যের বায়‘আত করেন, তখন খুশী হয়ে আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বলেন, وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا ‘আল্লাহ তাদেরকে বিনিময় দিলেন আসন্ন বিজয়’ (ফাৎহ ৪৮/১৮)। যা পরবর্তীতে ৮ম হিজরীর ১৭ রামাযান মঙ্গলবার সকালে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। আলোচ্য আয়াতে ‘ছওয়াব’ ক্রিয়াটি অবিশ্বাসীদের জন্য ‘মন্দ বদলা’ অর্থে এসেছে। সারকথা : হকদারের প্রাপ্য হক আদায়ে কমতি করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে এবং তাদের ভাল-মন্দ সকল কাজকর্ম যে সুনির্দিষ্ট দফতরে লিপিবদ্ধ হচ্ছে, সে বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে। [1]. নাসাঈ কুবরা হা/১১৬৫৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/২২২৩, সনদ ছহীহ। [2]. আহমাদ হা/২০০৬৭, আবুদাঊদ হা/৪৯৯০, তিরমিযী, নাসাঈ; মিশকাত হা/৪৮৩৪। [3]. কুরতুবী; মুওয়াত্ত্বা হা/২৯ ‘ছালাতের ওয়াক্ত সমূহ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ। [4]. দায়লামী হা/২৯৭৮; ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০৯৯২, সনদ হাসান; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৭৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৪০। [5]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/৫৩৭০ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ৭ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/১০৬-১০৭। [6]. গোলাম আহমাদ মোর্তজা, ইতিহাসের ইতিহাস (ঢাকা, মদীনা পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ ২০০৪) ১৬৬ পৃঃ। [7]. বুখারী হা/৪৯৩৮; মুসলিম হা/২৮৬২। [8]. তিরমিযী হা/২৪২১; মুসলিম হা/২৮৬৪; মিশকাত হা/৫৫৪০ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ-২। [9]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৩৩৩; মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৬০২৫; ছহীহাহ হা/২৮১৭। [10]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৭৯৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৬৭৪; ছহীহাহ হা/৩৪৫৩, ছহীহ তারগীব হা/১৭৮২। [11]. তিরমিযী হা/১২১০, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৯৯; ছহীহাহ হা/৯৯৪, ১৪৫৮। [12]. কুরতুবী হা/৬২৭৩-এর টীকা দ্রষ্টব্য। [13]. উক্ত তিনটি আমল হ’ল, (১) ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ (২) উপকারী ইল্ম ও (৩) সুসন্তানের দো‘আ; মুসলিম হা/১৬৩১ ‘অছিয়ত’ অধ্যায়; মিশকাত হা/২০৩ ‘ইলম’ অধ্যায়। [14]. আন‘আম ৬/২৫; আনফাল ৮/৩১; নাহল ১৬/২৪; মুমিনূন ২৩/৮৩; ফুরক্বান ২৫/৫; নামল ২৭/৬৮; আহক্বাফ ৪৬/১৭; ক্বলম ৬৮/১৫; মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৩। [15]. তিরমিযী হা/৩৩৩৪; নাসাঈ হা/১১৬৫৮; ইবনু মাজাহর বর্ণনায় إن المؤمن এসেছে; ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪; মিশকাত হা/২৩৪২ ‘ইস্তিগফার ও তওবা’ অনুচ্ছেদ, সনদ হাসান। [16]. বুখারী হা/৫৫৪, মুসলিম হা/৬৩৩; মিশকাত হা/৫৬৫৫-৫৬ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘আল্লাহকে দেখা’ অনুচ্ছেদ-৬। [17]. বুখারী হা/৪৫৮১, মুসলিম হা/১৮৩; মিশকাত হা/৫৫৫৫, বঙ্গানুবাদ হা/৫৩২১ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘হিসাব ও মীযান’ অনুচ্ছেদ-৩। [18]. ইউনুস ১০/২৬; মুসলিম হা/১৮১, মিশকাত হা/৫৬৫৬, বঙ্গানুবাদ হা/৫৪৯৩ ‘আল্লাহকে দর্শন’ অনুচ্ছেদ। [19]. মুসলিম হা/২৮৩১; বুখারী হা/৩২৫৬; তিরমিযী হা/৩৬৫৮; ইবনু মাজাহ হা/৯৬। [20]. বুখারী হা/৩২৪৪, মুসলিম হা/২৮২৪ মিশকাত হা/৫৬১২; সাজদাহ ৩২/১৭। [21]. বুখারী হা/৩৪৫৬, মুসলিম হা/২৬৬৯; মিশকাত হা/৫৩৬১ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ৭ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/২৬৪০, আহমাদ, আবূদাঊদ; মিশকাত হা/১৭১-৭২, হাদীছ ছহীহ। [22]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫ ‘ইলম’ অধ্যায়। |
0 Comments