কুরআনে নূর বলতে কি বোঝানো হয়েছে? আসলে নূর শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা কি?

আরবী ভাষায় ‘নূর’ (نور) শব্দের অর্থ আলো, আলোকচ্ছটা, উজ্জ্বলতা (light, ray of light, brightness) ইত্যাদি। আরবী, বাংলা ও সকল ভাষাতেই নূর, আলো বা লাইট যেমন জড় ‘আলো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক আলো বা পথ প্রদর্শকের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কুরতুবী বলেন, ‘‘আরবী ভাষায় নূর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য আলো বা জ্যোতিকে বলা হয়। অনুরূপভাবে রূপকার্থে সকল সঠিক ও আলোকজ্জ্বল অর্থকে ‘নূর’ বলা হয়। বলা হয়, অমূকের কথার মধ্যে নূর রয়েছে। অমুক ব্যক্তি দেশের নূর, যূগের সূর্য বা যুগের চাঁদ...।’’[1]

নূর মুহাম্মাদী বিষয়টি বর্তমান মুসলিম সমাজে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে বিতর্ক ও হানাহানির অন্যতম বিষয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নূরের তৈরি বলে বিশ্বাস করা অনেক দীনদার আলিম ও মুমিনের দৃষ্টিতে ঈমানের অন্যতম শর্ত। যারা তা বিশ্বাস করেন না তাঁদেরকে তাঁরা কাফির বা কাফিরের ন্যায় বিভ্রান্ত ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দুশমন বলে গণ্য করেন। এর বিপরীতে অন্য অনেক আলিম ও দীনদার মুমিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নূরের তৈরি বলে মনে করাকে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেন। বিশেষত, তাঁকে মহান আল্লাহর ‘যাত’ অর্থাৎ সত্ত্বার নূর অথবা সিফাত অর্থাৎ বিশেষণের নূর-এর অংশ বলে বিশ্বাস করাকে তারা শিরক বলে গণ্য করেন। এ বিষয়ক হাদীসগুলি আলোচনার পূর্বে নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:

(১) ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ নূর দ্বারা সৃষ্ট’- এরূপ কোনো কথা কুরআন কারীমে নেই। কুরআনের কোনো কোনো আয়াতে ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, নূর বলতে মুহাম্মাদ ﷺ- কে বুঝানো হয়েছে। বিষয়টি আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

(২) ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ নূর দ্বারা সৃষ্ট’- এ অর্থে প্রচলিত কিছু হাদীস আমরা আলোচনা করব। তবে লক্ষণীয় যে, মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলিতে এ বিষয়ে একটি হাদীসও পাওয়া যায় না। সুপ্রসিদ্ধ সিহাহ-সিত্তা, মুসনাদ আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ শাফিয়ী, মুসনাদ আহমাদ ইত্যাদি প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলির মধ্যে এ বিষয়ে কোনো হাদীসই পাওয়া যায় না।

(৩) রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কিত যে কোনো একটি হাদীস অনেক হাদীস গ্রন্থে সংকলিত। বিশেষত ঈমান-আকীদা ও দীনের প্রয়োজনীয় হাদীসগুলো মূলত সকল গ্রন্থেই সংকলিত। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রাকৃতিক কর্ম, পারিবারিক সম্পর্ক বা তাঁর জীবনের অতি সামান্য বিষয়ের একটি হাদীস আমরা সিহাহ-সিত্তা সহ প্রায় সকল গ্রন্থে দেখতে পাই। অথচ নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক কোনো হাদীস এ সকল গ্রন্থের একটি গ্রন্থেও পাওয়া যায় না।

(৪) হাদীস সংকলকগণ হাদীস গ্রন্থগুলিতে ঈমান, আকীদা, শারীয়াহ, আহকাম, পরিবার, প্রকৃতি ইত্যাদি সকল বিষয়ের শিরোনাম দিয়ে অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন। ‘নূর মুহাম্মাদ’ বিষয়ক একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ বা অনুচ্ছেদ কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই।

(৫) উম্মাতের ইমাম ও বুজুর্গগণ আকীদা ও ফিকহের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি তাদের গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রসিদ্ধ তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, চার ইমাম-সহ ইসলামের প্রথম অর্ধ-সহস্র বৎসরের মধ্যে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমাম ও বুজুর্গগণ রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলিতে ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। শুধু ৪র্থ/৫ম হিজরী শতক থেকে শীয়াগণের গ্রন্থে ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক বক্তব্য পাওয়া যায়।

(৬) শীয়াগণের মধ্যে প্রকাশিত নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক বক্তব্যগুলি ৬ষ্ঠ-৭ম হিজরী শতক থেকে সাধারণ মুসলিম আলিমগণের মধ্যেও প্রচারিত হতে থাকে। পরবর্তী ৫০০ বৎসর এ বিষয়ক হাদীসগুলি ‘ফযীলত’ বিষয়ক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। শীয়াগণ ছাড়া অন্য কেউ একে আকীদার অন্তর্ভূক্ত করেন নি।

(৭) ইমাম আযম আবূ হানীফা-সহ প্রসিদ্ধ চার ইমাম থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় হাজার বৎসর যাবৎ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ আকীদা বিষয়ে অগণিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। আকীদার খুটিনাটি অতি সামান্য বিষয়ও তারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু ‘মুহাম্মাদ ﷺ নূরের তৈরি’ বলে বিশ্বাস করাকে আকীদার বিষয় বলে কেউ উল্লেখ করেন নি।

(৮) কুরআন-হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, মানুষ মাটির তৈরি। সৃষ্টির উপাদান বলতে মূলত প্রথম সৃষ্টিকেই বুঝানো হয়। এরপর তার বংশধররেরা বংশ-পরম্পরায় সে উপাদান ধারণ করে। কুরআনে আদম (আ)-কে মাটি থেকে সৃষ্টি করার বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ জাগতিক প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। কাউকেই নতুন করে ‘মাটি’ দিয়ে তৈরি করা হয় না। তবে সকল মানুষকেই মাটির তৈরি বলা হয়। আল্লাহ বলেন:

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ

‘‘যখন তোমার রবব ফিরিশতাগণকে বললেন, আমি ‘বাশার’ (মানুষ) সৃষ্টি করছি গন্ধযুক্ত কাদার শুস্ক ঠন্ঠনে মাটি হতে।’’[2]

আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

خُلِقَتِ الْمَلاَئِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ

‘‘ফিরিশতাগণকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, জিনকে সৃষ্টি করা নির্ধুম আগুনের শিখা থেকে, আর আদমকে কী থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা তো তোমাদের বলা হয়েছে।’’[3]

অর্থাৎ শুধু ফিরিশতাগণই নুর থেকে সৃষ্ট; কোনো মানুষ বা জিন নয়।

(৯) কুরআন-হাদীসে বারংবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে ‘বাশার’ বা মানুষ বলা হয়েছে। কুরআন-হাদীসে ‘বাশার’ শব্দ অন্য কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। কুরআন ও হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং অন্যান্য নবী-রাসূলের মানুষ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বারংবার বলা হয়েছে। কাফিরগণ নবীগণের নুবুওয়াত অস্বীকার করত এ কথা বলে যে, ‘তোমরা আমাদের মতই মানুষ’। এর প্রতিবাদে আল্লাহ বারংবার বলেছেন, হ্যাঁ, নবীগণ তোমাদের মতই মানুষ, তবে তাঁরা আল্লাহর ওহীপ্রাপ্ত মানুষ।[4]

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাশারিয়্যাত বা মানুষ হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ

‘‘বলুন, আমি তোমাদের মত মানুষ মাত্র; আমার কাছে ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ।’’[5]

অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلَّا بَشَرًا رَسُولا

‘‘বলুন: সুবহানাল্লাহ! আমি তো একজন মানুষ রাসূল বৈ কিছুই নই।’’[6]

বিভিন্ন হাদীসেও রাসূলুল্লাহ ﷺ বারংবার বলেছেন, আমি মানুষ মাত্র, আমি তোমাদের মতই মানুষ...। কুরআন ও হাদীসের এ সকল বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান যে, মানুষ হিসেবে রাসূলুল্লাহ ﷺ মাটির উপাদান থেকেই সৃষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো, এ সকল বক্তব্যের বিপরীতে কুরআন-হাদীসে অন্য কোনো বক্তব্য দ্বারা কি ব্যতিক্রম কিছু প্রমাণিত হয়? আমরা এখানে বিষয়টি আলোচনা করব।

[1] কুরতুবী, তাফসীর ১২/২৫৬। [2] সূরা (১৫): হিজর: ২৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩৮) সাদ: ৭১ আয়াত। [3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৪, নং ২৯৯৬। [4] সূরা (১১) হূদ: ২৭; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০-১১; সূরা (১৭) ইসরা/বানী ইসরাইল: ৯৩-৯৪; সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩; সূরা (২৩) মুমিনুন: ২৪, ৩৩-৩৪; সূরা (২৬) শুআরা: ১৫৪; ১৮৬; সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ১৫; সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬। [5] সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০ আয়াত এবং সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬ আয়াত। [6] সূরা (১৭) ইসরা/বনী ইসরাঈল: ৯৩।

(ক) আল-কুরআন ও নূর মুহাম্মাদী

মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে নিজেকে ‘নূর’ বলেছেন:

اللهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ ...

‘‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর (জ্যোতি)..... ’’[1]

ইমাম তাবারী বলেন: ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ একথা বলতে আল্লাহ বুঝাচ্ছেন যে, তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যকার সকলের হাদী বা পথ প্রদর্শক। তাঁরই নূরেই তাঁরা সত্যের দিকে সুপথপ্রাপ্ত হয়।... ইবনু আববাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ অর্থ তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অধিবাসীদের হাদী বা পথ-প্রদর্শক।... আনাস থেকে বর্ণিত, আল্লাহ বলছেন, আমার হেদায়াতই আমার নূর...।’’[2]

আল্লাহ বারবার দ্ব্যার্থহীনভাবে কুরআনকে নূর বলেছেন। তিনি বলেন:

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الأُمِّيَّ ... فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَهُ أُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ

‘‘যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক এ উম্মী নবীর...যারা তাঁর উপর ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তাঁর সাথে যে নূর (কুরআন) অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।’’[3]

অন্যত্র কুরআনকে ‘রূহ’ ও ‘নূর’ বলা হয়েছে:

وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْـرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلا الإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا

‘‘এভাবে আমি আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ (আত্মা), আমার নির্দেশ থেকে, আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমি একে (এ রূহ বা আল-কুরআনকে) নূর বানিয়ে দিয়েছি, যা দিয়ে আমি আমার বানদাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পর্থ-নির্দেশ করি...।’’[4]

অন্যত্র মূসা (আ) এর উপর অবর্তীণ তাওরাতকেও নূর বলা হয়েছে:

قُلْ مَنْ أَنْزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَى نُورًا وَهُدًى لِلنَّاسِ

‘‘বলুন, তবে কে নাযিল করেছিল মূসার আনীত কিতাব, যা মানুষের জন্য নূর (আলো) ও হেদায়াত (পথ-প্রদর্শন) ছিল।’’[5]

অন্যত্র বলা হয়েছে যে, তাওরাত ও ইনজীলের মধ্যে নূর ছিল:

إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ...وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ

‘‘আমি অবতীর্ণ করেছি তাওরাত, যার মধ্যে হেদায়াত ও নূর ... আমি তাকে (ঈসাকে) প্রদান করেছি ইনজীল যার মধ্যে হেদায়াত ও নূর...।[6]

কুরআনে আরো কয়েকটি স্থানে ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহৃত। যেমন এক স্থানে বলেছেন:

يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ

‘‘তারা ‘আল্লাহর নূর’ ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আল্লাহ ‘তাঁর নূর’ পূর্ণ করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।’’[7]

এখানে ‘আল্লাহর নূর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাস্সিরগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। আল্লামা কুরতুবী বলেন: এখানে ‘আল্লাহর নূরের’ ব্যাখ্যায় ৫টি মত রয়েছে: (১) আল্লাহর নূর অর্থ আল-কুরআন, কাফিররা কথার দ্বারা তা বাতিল করতে ও মিথ্যা প্রমাণ করতে চায়। ইবনু আববাস ও ইবনু যাইদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। (২) আল্লাহর নূর অর্থ ইসলাম, কাফিররা কথাবার্তার মাধ্যমে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। সুদ্দী এ কথা বলেছেন। (৩) আল্লাহর নূর অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ), কাফিররা অপপ্রচার ও নিন্দাচারের মাধ্যমে তাঁর ধ্বংস চায়। দাহ্হাক এ কথা বলেছেন। (৪) আল্লাহর নূর অর্থ আল্লাহর দলীল-প্রমাণাদি, কাফিররা সেগুলো অস্বীকার করে মিটিয়ে দিতে চায়। ইবনু বাহর এ কথা বলেছেন। (৫) আল্লাহর নূর অর্থ সূর্য। অর্থাৎ ফুৎকারে সূর্যকে নেভানোর চেষ্টা করার মত বাতুল ও অসম্ভব কাজে তারা লিপ্ত। ইবনু ঈসা এ কথা বলেছেন।[8]

كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنْ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ

‘‘এ কিতাব। আমি তা আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন...।’’[9]

এখানে স্বভাবতই অন্ধকার ও আলো বলতে ‘জড়’ কিছু বুঝানো হয় নি। এখানে অন্ধকার বলতে অবিশ্বাসের অন্ধকার এবং আলো বলতে আল-কুরআন অথবা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য আয়াতেও ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ বলতে ‘কুরআন’, ‘ইসলাম’ বা ‘মুহাম্মাদ ﷺ’  অর্থ গ্রহণ করেছেন মুফাস্সিরগণ[10]। এ ধরনের একটি আয়াত:

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ. يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ.

‘‘হে কিতাবীগণ, আমার রাসূল তোমাদের কাছে এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি তার অনেক কিছু তোমাদের কাছে প্রকাশ করেন এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করেন। তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে এক নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব। হেদায়াত করেন আল্লাহ তদ্বারা যে তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে তাকে শান্তির পথে এবং বের করেন তাদেরকে অন্ধকার থেকে নূরের দিকে তাঁর অনুমতিতে এবং হেদায়াত করেন তাদের সঠিক পথে।’’[11]

এ আয়াতে ‘নূর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাস্সিরগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, নূর অর্থ কুরআন, কেউ বলেছেন, ইসলাম, কেউ বলেছেন, মুহাম্মাদ ﷺ। এ তিন ব্যাখ্যার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। সবাই সঠিক পথের আলোক বর্তিকা বা হেদায়াতের নূর বুঝিয়েছেন।[12]

যারা এখানে নূর অর্থ কুরআন বুঝিয়েছেন, তাঁদের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ: (১) এ আয়াতের প্রথমে যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলা হয়েছে, সেহেতু শেষে ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে ‘কুরআনকে’ বুঝানো হয়েছে। (২) কুরআনে বিভিন্ন স্থানে কুরআনকে ব্যাখ্যাতীতভাবে ‘নূর’ এবং ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলা হয়েছে। কাজেই এখানেও দুটি বিশেষণ দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। (৩) দুটি শব্দ দ্বারা একই বিষয় বুঝানো কুরআনের একটি রীতি। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘আমি মূসাকে কিতাব ও ফুরকান প্রদান করি’[13]। এখানে কিতাব ও ফুরকান বলতে একই কিতাব ‘তাওরাত’ বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে উপরের আয়াতেও ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে একই কিতাব ‘কুরআন’-কে বুঝানো হয়েছে। (৪) পরের আয়াতে এ দুটি বিষয়ের জন্য এক বচনের সর্বনাম ব্যবহার করে আল্লাহ বলেছেন: ‘হেদায়াত করেন আল্লাহ যদ্বারা’। এ থেকে বুঝা যায় যে, এখানে ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে একই জিনিস বুঝানো হয়েছে যদ্বারা আল্লাহ যাকে চান হেদায়াত করেন। ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ উভয়কে বুঝাতে ‘‘একবচনের’’ সর্বনাম ব্যবহার নিশ্চিত প্রমাণ যে, এখানে উভয় বিশেষণ দ্বারা একটি বিষয় নির্দেশ করা হয়েছে। (৫) এখানে আল্লাহ বলেছেন: ‘হেদায়াত করেন আল্লাহ যাহা দ্বারা’: কুরআনের পরিভাষায় এ কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; বরং কুরআনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেন নি যে, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ-কে দিয়ে কাউকে হেদায়াত করেন; বরং বলেছেন যে, তিনি কুরআন দিয়ে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন।[14]

যারা ‘নূর’ অর্থ ইসলাম বলেছেন, তাঁদের বক্তব্য: এ আয়াতে প্রথমে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা এবং শেষে কিতাব বা কুরআনের কথা বলা হয়েছে। কাজেই মাঝে নূর বলতে ইসলামকে বুঝানো স্বাভাবিক। এ ছাড়া কুরআনে অনেক স্থানে ‘নূর’ বলতে ইসলাম বুঝানো হয়েছে। আরবীতে ‘আলো’ বুঝাতে দুটি শব্দ রয়েছে: ‘দিয়া (ضياء) ও নূর (نور)। প্রথম আলোর মধ্যে উত্তাপ রয়েছে, আর দ্বিতীয় আলো স্নিগ্ধতাপূর্ণ আলো। পূর্ববর্তী শরীয়াতগুলোর বিধানের মধ্যে কাঠিন্য ছিল। পক্ষান্তরে ইসলামী শরীয়তের সকল বিধিবিধান সহজ ও জীবনমুখী। এজন্য ইসলামী শরীয়তকে নূর বলা হয়েছে।[15]

যারা এখানে ‘নূর’ অর্থ ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) বুঝিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন যে, ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। কাজেই ‘নূর’ বলতে মুহাম্মাদ ﷺ-কে বুঝানো সম্ভব। এ বিষয়ে ইমাম তাবারী বলেন:

يَعْنِيْ بِالنُّوْرِ مُحَمَّداً ﷺ الَّذِيْ أَنَارَ اللهُ بِهِ الْحَقَّ وَأَظْهَرَ بِهِ الإِسْلاَمَ وَمَحَقَ بِهِ الشِّرْكَ فَهُوَ نُوْرٌ لِمَنِ اسْتَنَارَ بِهِ يُبَيِّنُ الْحَقَّ وَمِنْ إِنَارَتِهِ الْحَقَّ تَبْيِيْنُهُ لِلْيَهُوْدِ كَثِيْراً مِمَّا كَانُوا يُخْفُوْنَ مِنَ الْكِتَابِ.

‘‘নূর (আলো) বলতে এখানে ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বুঝানো হয়েছে, যাঁর দ্বারা আল্লাহ হক্ক বা সত্যকে আলোকিত করেছেন, ইসলামকে বিজয়ী করেছেন এবং শির্ককে মিটিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারা আলোকিত হতে চায় তার জন্য তিনি আলো। তিনি হক্ক বা সত্য প্রকাশ করেন। তাঁর হক্ককে আলোকিত করার একটি দিক হলো যে, ইহূদীরা আল্লাহর কিতাবের যে সকল বিষয় গোপন করত তার অনেক কিছু তিনি প্রকাশ করেছেন।’’[16]

এছাড়া কুরআনে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ‘নূর-প্রদানকারী প্রদীপ’ বলা হয়েছে:

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا

‘‘হে নবী, আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং আলোকোজ্জ্বল (নূর-প্রদানকারী) প্রদীপরূপে।’’[17]

এভাবে আমরা দেখলাম যে, কুরআনে সঠিক পথের নির্দেশক হিসেবে কুরআনকে ‘নূর’ বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো কোনো আয়াতে ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কুরআনের এ সকল বর্ণনা থেকে বুঝা যায় না যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, কুরআন বা ইসলাম নূরের তৈরী বা নূর থেকে সৃষ্ট। আমরা বুঝতে পারি যে, এখানে কোনো সৃষ্ট, জড় বা মূর্ত নূর বা আলো বুঝানো হয় নি। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, ইসলাম ও কুরআন কোনো জাগতিক, ‘জড়’, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা মূর্ত ‘আলো’ নয়। এ হলো বিমূর্ত, আত্মিক, আদর্শিক ও সত্যের আলোকবর্তিকা, যা মানুষের হৃদয়কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে বিশ্বাস, সত্য ও সুপথের আলোয় জ্যোতির্ময় করে।

[1] সূরা (২৪) নূর: ৩৫ আয়াত। [2] তাবারী, তাফসীর ১৮/১৩৫। আরো দেখুন, ইবন কাসীর, তাফসীর ৩/২৯০। [3] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৫৭ আয়াত। [4] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত। [5] সূরা (৬) আন্‘আম: ৯১ আয়াত। [6] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ ও ৪৬ আয়াত। [7] সূরা (৬১) সাফ: ৮ আয়াত। পুনশ্চ, সূরা (৯) তাওবা: ৩২ আয়াত। [8] কুরতুবী, তাফসীর ১৮/৮৫। [9] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১ আয়াত। [10] সূরা (২) বাকারা: ২৫৭; সূরা (৪) নিসা: ১৭৪; সূরা (৫) মায়িদা: ১৬; সূরা (৬) আন‘আম: ১২২; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৫; সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৩; সূরা (৫৭) হাদীদ: ২৮ আয়াত ...। [11] সূরা (৫) মায়িদা: ১৫-১৬ আয়াত। [12] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১; কুরতুবী, তাফসীর ৬/১১৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫। [13] সূরা (২) বাকারা: ৫৩ আয়াত। [14] ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫। [15] ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২১৯। [16] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১। [17] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫-৪৬ আয়াত।

(খ) হাদীস শরীফে নূর মুহাম্মাদী

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থে কিছু হাদীস প্রচলিত রয়েছে। একথা ঠিক যে, সৃষ্টির মর্যাদা আল্লাহর ঘোষণায় ও তার নিজের কর্মের মধ্যে নিহিত, তার সৃষ্টির উপাদান, বংশ ইত্যাদিতে নয়। এজন্য আগুনের তৈরী জিন ও নূরের তৈরী ফিরিশতার চেয়ে মাটির তৈরী মানুষ অনেক ক্ষেত্রে বেশি মর্যাদাবান। এরপরও যখন আমরা জানতে পারি যে, সৃষ্টির উপাদানেও আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে তখন আমাদের তা ভাল লাগে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোনো কথা তা যতই ভাল লাগুক, তা গ্রহণের আগে তার বিশুদ্ধতা যাচাই করা। কোনো কথাকে তার অর্থের ভিত্তিতে নয়, বরং সাক্ষ্য প্রমাণের বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে প্রথমে বিচার করা হয়। এরপর তার অর্থ বিচার করা হয়। লক্ষণীয় যে, এ অর্থের অধিকাংশ হাদীস একেবারেই ‘সনদবিহীন’ জাল কথা এবং কিছু হাদীস ‘সনদওয়ালা’ জাল কথা।

Post a Comment

0 Comments