আত্মমর্যাদাবোধ!
আল-কুরআনুল কারীম :
1. يَقُولُونَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ
لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ
وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ-
(১) ‘তারা বলে, আমরা যদি মদীনায় ফিরতে পারি, তাহ’লে
নিশ্চয়ই সম্মানিতরা নিকৃষ্টদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে। অথচ সম্মান তো কেবল
আল্লাহর ও তঁার রাসূলের এবং মুমিনদের জন্য কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না’ (মুনাফিকুন
৬৩/৮)।
2. مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ
الْعِزَّةُ جَمِيعًا إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ
الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ وَالَّذِينَ يَمْكُرُونَ السَّيِّئَاتِ لَهُمْ عَذَابٌ
شَدِيدٌ وَمَكْرُ أُولَئِكَ هُوَ يَبُورُ-
(২) ‘যে ব্যক্তি সম্মান চায়, সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহর
জন্যই রয়েছে সকল সম্মান। তঁার দিকেই অধিরোহন করে পবিত্র বাক্য। আর সৎকর্ম তাকে
উচ্চ করে। পক্ষান্তরে যারা মন্দকর্মের চক্রান্ত করে, তাদের
জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হবে’ (ফাতির ৩৫/১০)।
3. الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ
أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ
فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا-
(৩) ‘যারা মুমিনদের ছেড়ে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি
তাদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে? অথচ যাবতীয় সম্মান কেবল আল্লাহর জন্য’ (নিসা
৩/১৩৯)।
4. وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ
أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ-
(৪) ‘আর যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার
মর্যাদার অহংকার তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর
নিশ্চিতভাবেই সেটা নিকৃষ্টতম ঠিকানা’ (বাক্বারাহ
২/২০৬)।
5. سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ
عَمَّا يَصِفُونَ-
(৫) ‘বস্ত্ততঃ তারা যেসব কথা বলে, সে সব
থেকে তোমার প্রতিপালক মহা পবিত্র, যিনি সকল সম্মানের মালিক’ (ছফফাত
৩৭/১৮০)।
হাদীছে নববী :
6. عَنْ أَنَّ عَائِشَةَ زَوْجَ النَّبِىِّ
صلى الله عليه وسلم حَدَّثَتْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ
مِنْ عِنْدِهَا لَيْلاً. قَالَتْ فَغِرْتُ عَلَيْهِ فَجَاءَ فَرَأَى مَا أَصْنَعُ
فَقَال مَا لَكِ يَا عَائِشَةُ أَغِرْتِ. فَقُلْتُ وَمَا لِى لاَ يَغَارُ مِثْلِى
عَلَى مِثْلِكَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَقَدْ جَاءَكِ
شَيْطَانُكِ. قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَوَ مَعِىَ شَيْطَانٌ قَالَ نَعَمْ.
قُلْتُ وَمَعَ كُلِّ إِنْسَانٍ قَالَ نَعَمْ. قُلْتُ وَمَعَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ
قَالَ نَعَمْ وَلَكِنْ رَبِّى أَعَانَنِى عَلَيْهِ حَتَّى أَسْلَمَ.
(৬) নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রী আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, কোন এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার নিকট থেকে বের হলেন। তিনি বলেন, এতে আমার
মনে কিছুটা ঈর্ষা জাগল। অতঃপর তিনি এসে আমার অবস্থা দেখে বললেন, হে
আয়েশা! তোমার কি হয়েছে? তুমি কি ঈর্ষা পোষণ করছ? উত্তরে আমি বললাম, আমার মত
মহিলা আপনার মত স্বামীর প্রতি কেন ঈর্ষা করবে না? এ কথা
শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমার শয়তান কি তোমার নিকট এসে
উপস্থিত হয়েছে? তখন তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সাথেও কি শয়তান
রয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। অতঃপর আমি বললাম, প্রত্যেক
মানুষের সাথেই কি শয়তান রয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর
আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সাথেও কি রয়েছে? তিনি
বললেন, হ্যাঁ, আমার সাথেও। তবে আল্লাহ তা‘আলা তার মুকাবিলায় আমাকে সহযোগিতা
করেছেন। এখন তার ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।[1]
7. عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ
رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ يَغَارُ وَإِنَّ الْمُؤْمِنَ
يَغَارُ وَغَيْرَةُ اللَّهِ أَنْ يَأْتِىَ الْمُؤْمِنُ مَا حَرَّمَ عَلَيْهِ-
(৭) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল
(ছাঃ)
বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশ করেন এবং মুমিনগণও
স্বীয় আত্মমর্যাদা প্রকাশ করে। আল্লাহর আত্মমর্যাদায় আঘাত আসে যখন মুমিন আল্লাহ
কর্তৃক হারাম কর্মে অগ্রসর হয়।[2]
(৮) মুগীরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সা‘দ
ইবনু উবাদাহ (রাঃ) বলেছেন, যদি আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোন পরপুরুষকে দেখি তবে আমি তাকে
তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে আঘাত করব। তার এ উক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পৌঁছল। তখন
তিনি বললেন, তোমরা কি সা‘দ এর আত্মমর্যাদাবোধে আশ্চর্য হচ্ছ? আমি ওর
থেকে অধিক আত্মসম্মানী। আর আল্লাহ আমার থেকেও অধিক আত্মসম্মানের অধিকারী। আল্লাহ
আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হবার কারণে প্রকাশ্যে ও গোপনীয় (যাবতীয়) অশ্লীলতাকে হারাম করে
দিয়েছেন। অক্ষমতা প্রকাশকে আল্লাহর চেয়ে অধিক পসন্দ করেন এমন কেউই নেই। আর এজন্য
তিনি ভীতি প্রর্শনকারী ও সুসংবাদদাতাদেরকে পাঠিয়েছেন। আত্মপ্রশংসা আল্লাহর চেয়ে
অধিক কারো কাছে প্রিয় নয়। তাই তিনি জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। ওবাইদুল্লাহ ইবন আমর
বর্ণনা করে আব্দুল মালেক থেকে, আর তিনি বলেন, আল্লাহর
চেয়ে অধিক মর্যাদাশীল সত্ত্বা আর কেউ নেই।[3]
9. عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ خَسَفَتِ
الشَّمْسُ فِى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم … فَخَطَبَ النَّاسَ،
فَحَمِدَ اللَّهَ، وَأَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ
آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ، لاَ يَنْخَسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلاَ
لِحَيَاتِهِ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ ذَلِكَ فَادْعُوا اللَّهَ وَكَبِّرُوا، وَصَلُّوا
وَتَصَدَّقُوا. ثُمَّ قَالَ يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ، وَاللَّهِ مَا مِنْ أَحَدٍ
أَغْيَرُ مِنَ اللَّهِ أَنْ يَزْنِىَ عَبْدُهُ أَوْ تَزْنِىَ أَمَتُهُ، يَا
أُمَّةَ مُحَمَّدٍ، وَاللَّهِ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ
قَلِيلاً وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًاِ-
(৯) আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর সময় একবার সূর্যগ্রহণ হল। তখন রাসূল (ছাঃ) লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করেন।
... এরপর তিনি বলেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শন সমুহের মধ্যে দু’টি নিদর্শন। কারো
মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা
দেখবে তখন তোমরা আল্লাহর নিকট দো‘আ করবে। তাঁর মহত্ব ঘোষণা করবে এবং ছালাত আদায়
করবে ও ছাদাক্বা প্রদান করবে।
এরপর
তিনি আরো বললেন, হে উম্মতে মুহাম্মদী! আল্লাহর কসম, আল্লাহর
কোন বান্দা যিনা করলে কিংবা কোন নারী যিনা করলে, আল্লাহর
চাইতে বেশী অপসন্দকারী কেউ নেই। হে উম্মাতে মুহাম্মদী! আল্লাহর কসম, আমি যা
জানি তা যদি তোমরা জানতে তা হলে তোমরা অবশ্যই কম হাঁসতে ও বেশি কাঁদতে। ।[4]
10. عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ
بَيْنَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ قَالَ بَيْنَا
أَنَا نَائِمٌ رَأَيْتُنِى فِى الْجَنَّةِ، فَإِذَا امْرَأَةٌ تَتَوَضَّأُ إِلَى
جَانِبِ قَصْرٍ، فَقُلْتُ لِمَنْ هَذَا الْقَصْرُ فَقَالُوا لِعُمَرَ بْنِ
الْخَطَّابِ، فَذَكَرْتُ غَيْرَتَهُ، فَوَلَّيْتُ مُدْبِرًا. فَبَكَى عُمَرُ
وَقَالَ أَعَلَيْكَ أَغَارُ يَا رَسُولَ اللَّهِ-
(১০) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সময়
আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট বসা ছিলাম। তখন তিনি বললেন, আমি
নিদ্রিত ছিলাম। দেখলাম, আমি জান্নাতে অবস্থিত। হঠাৎ দেখলাম এক মহিলা একটি প্রাসাদের পাশে
ওযূ করছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ প্রাসাদটি কার? তারা
উত্তরে বললেন, উমরের। তখন তাঁর (উমরের) আত্মমর্যাদাবোধের কথা আমার স্মরণ হল। আমি
পেছনের দিকে ফিরে চলে আসলাম। এ কথা শুনে উমর (রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ইয়া
রাসূলাল্লাহ! আপনার সম্মুখে কি আমার মর্যাদাবোধ থাকতে পারে? [5]
মনীষীদের
বক্তব্য :
১. ইবনু
হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, আত্মমর্যাদাবোধ হলো প্রতিযোগিতামূলক
কাজে মনের আবেগ ও ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণাধীন রেখে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যমে নিজের
বৈশিষ্ট্য তথা আত্মমর্যাদাকে ফুটিয়ে তোলা। বিশেষ করে দু’জন স্ত্রীর মাঝে বিষয়টি
বেশী পরিলক্ষিত হয়। মূলতঃ এটি আদম সন্তানের নিজস্ব অধিকার আদায়ের সৃষ্টিগত
প্রক্রিয়া’।[6]
২. জনৈক
মনীষী বলেন, যার গাইরাত তথা আত্মমর্যাদাবোধ নেই তার কোন সম্মান নেই।[7]
৩. ইমাম
নববী (রহঃ) বলেন, গাইরাত বা আত্মমর্যাদাবোধ হলো মানবীয় গুণের পূর্ণাঙ্গতার প্রতীক।[8]
৪.
কাফাবী (রহঃ) বলেন, আত্মমর্যাদা হ’ল অন্যের বৈধ অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা, যা
ব্যক্তির মধ্যে অসন্তোষের উদ্রেক করে।[9]
৫. ইবনু
হাযাম (রহঃ) বলেন, আত্মমর্যাদা সমুন্নত হলে ভালবাসা সমুন্নত হয়।[10]
সারবস্ত্ত
:
১. গাইরাত
বা আত্মমর্যাদা দ্বারা আত্মসম্মানবোধ সংরক্ষণ এবং অন্যায়-অপকর্ম থেকে নিজেকে
হেফাযত করা যায়।
২.
গাইরাত একজন ব্যক্তির প্রকৃত ব্যক্তিত্ব সমুন্নতকারী।
৩.
গাইরাতের ফলে সমাজে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয় এবং অশালীন অপসংস্কৃতি দূরীভূত হয়।
৪.
গাইরাতের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দশনাবলী এবং হুদুদ বা সীমারেখার প্রতি সম্মানবোধকে
অক্ষুণ্ণ রাখা যায়।
৫.
সুন্দও ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে গাইরাত তথা আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ একান্ত
যরূরী নিয়ামক। এতদ্ব্যতীত আর্দশিক সমাজ এবং অসভ্য সমাজের মাঝে মূলত কোন পার্থক্য
সূচিত হয় না।
[1]. মুসলিম হা/২৮১৫; মিশকাত
হা/৩৩২৩।
[2]. বুখারী হা/৫২২৩; মুসলিম
হা/২৭৬১।
[3]. বুখারী হা/৭৪১৬; মিশকাত
হা/৩৩০৯।
[4]. বুখারী হা/১০৪৪; মিশকাত
হা/১৪৮৩।
[5]. বুখারী হা/৩২৪২; ইবনু
মাজাহ হা/১০৭।
[6]. ফাৎহুল
বারী ৯/৩২০ পৃ.।
[7] . মুহাযারাতুল
উদাবা ২/২৫৫ পৃ.।
[8] . শারহু
নববী আলা ছহীহ মুসলিম ৪/১২৫ পৃ.।
[9] . আল-কুল্লিয়াত
৬৭১ পৃ. ।
[10]. মুদাউয়াতুন
নুফুস ১/৫৫ পৃ.।
0 Comments