ঈমান বিশয়ক প্রশ্ন উত্তর-০১ থেকে ১২ পর্যন্ত


ঈমান বিশয়ক প্রশ্ন উত্তর-
উত্তর-০১ থেকে ১২ পর্যন্ত 
كتاب الإيمان
 প্রশ্নঃ (১) তাওহীদ কাকে বলেউহা কত প্রকার ও কি কি?
উত্তরঃ তাওহীদ শব্দটি (وحدক্রিয়ামূল থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ কোন জিনিসকে একক হিসাবে নির্ধারণ করা। না’ বাচক ও হ্যাঁ’ বাচক উক্তি ব্যতীত এটির বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ একককৃত বস্ত ব্যতীত অন্য বস্ত হতে কোন বিধানকে অস্বীকার করে একককৃত বস্তর জন্য তা সাব্যস্ত করা। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলব, “আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবূদ নেই” একথার সাক্ষ্য দেয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তির তাওহীদ পূর্ণ হবে না। যে ব্যক্তি এই সাক্ষ্য প্রদান করবেসে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত হতে উলুহিয়্যাতকে (ইবাদত) অস্বীকার করে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করবে। কারণ শুধুমাত্র নাফী বা না’ বাচক বাক্যের মাধ্যমে কোন বস্তকে গুণাগুণ থেকে মুক্ত করা হয়। আর শুধুমাত্র হ্যাঁ’ বাচক বাক্যের মাধ্যমে কোন বস্তর জন্য কোন বিধান সাব্যস্ত করলে সেই বিধানে অন্যের অংশ গ্রহণকে বাধা প্রদান করে না। যেমন উদাহরণ স্বরূপ যদি আপনি বলেন, ‘অমুক ব্যক্তি দাঁড়ানো। এই বাক্যে আপনি তার জন্য দন্ডায়মান হওয়াকে সাব্যস্ত করলেন। তবে আপনি তাকে দন্ডায়মান গুণের মাধ্যমে একক হিসাবে সাব্যস্ত করলেন না। হতে পারে এই গুণের মাঝে অন্যরাও শরীক আছে। অর্থাৎ অমুক ব্যক্তির সাথে অন্যান্য ব্যক্তিগণও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আর যদি বল, “যায়েদ ব্যতীত আর কেউ দাঁড়ানো নেই” তবে আপনি দন্ডায়মান হওয়াকে শুধুমাত্র যায়েদের সাথে সীমিত করে দিলেন। এই বাক্যে আপনি দন্ডায়মানের মাধ্যমে যায়েদকে একক করে দিলেন এবং দাঁড়ানো গুণটিকে যায়েদ ব্যতীত অন্যের জন্য হওয়াকে অস্বীকার করলেন। এভাবেই তাওহীদের প্রকৃত রূপ বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ নাফী (না বোধক) ও ইছবাত (হ্যাঁ বোধক) বাক্যের সমন্বয় ব্যতীত তাওহীদ কখনো প্রকৃত তাওহীদ হিসাবে গণ্য হবে না। মুসলিম বিদ্বানগণ তাওহীদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন।
১)          তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ
২)          তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ
৩)          তাওহীদুল আসমা অস্সিফাত
  কুরআন ও হাদীছ গভীরভাবে গবেষণা করে আলেমগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যেতাওহীদ উপরোক্ত তিন প্রকারের মাঝে সীমিত।

প্রথমতঃ তাওহীদে রুবূবীয়্যার বিস্তারিত পরিচয়ঃ
  সৃষ্টিরাজত্বকর্তৃত্ব ও পরিচালনায় আল্লাহকে এক হিসাবে বিশ্বাস করার নাম তাওহীদে রুবূবীয়্যাহ্।
১- সৃষ্টিতে আল্লাহর একত্বঃ আল্লাহ একাই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
) هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالاَرْضِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ (
আল্লাহ ছাড়া কোন স্রষ্টা আছে কিযে তোমাদেরকে আকাশ ও জমিন হতে জীবিকা প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবূদ নেই। (সূরা ফাতিরঃ ৩) কাফিরদের অন্তসার শুন্য মাবূদদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আল্লাহ বলেন,
 )أَفَمَنْ يَخْلُقُ كَمَنْ لاَ يَخْلُقُ أَفَلاَ تَذَكَّرُوْنَ(
সুতরাং যিনি সৃষ্টি করেনতিনি কি তারই মতযে সৃষ্টি করে নাতবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?” (সূরা নাহলঃ ১৭) সুতরাং আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি সকল বস্ত সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলার কর্ম এবং মাখলুকাতের কর্ম সবই আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। তাই আল্লাহ তাআলা মানুষের কর্মসমূহও সৃষ্টি করেছেন্ত একথার উপর ঈমান আনলেই তাকদীরের উপর ঈমান আনা পূর্ণতা লাভ করবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
)وَ اللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُوْنَ(
আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমাদের কর্মসমূহকেও সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আস্তসাফ্ফাতঃ ৯৬) মানুষের কাজসমূহ মানুষের গুণের অন্তর্ভুক্ত। আর মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। কোন জিনিষের স্রষ্টা উক্ত জিনিষের গুণাবলীরও স্রষ্টা।
যদি বলা হয় আল্লাহ ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রেও তো সৃষ্টি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
)تَبَارَكَ اللَّهُ اَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ (
আল্লাহ সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে উত্তম সৃষ্টিকর্তা। (সূরা মুমিনূনঃ ১৪) রাসূল () বলেছেনকিয়ামতের দিন ছবি অংকনকারীদেরকে বলা হবেতোমরা দুনিয়াতে যা সৃষ্টি করেছিলেতাতে রূহের সঞ্চার কর। উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর এই যেআল্লাহর মত করে কোন মানুষ কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম। মানুষের পক্ষে কোন অস্তিত্বহীনকে অস্তিত্ব দেয়া সম্ভব নয়। কোন মৃত প্রাণীকেও জীবন দান করা সম্ভব নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্যের তৈরী করার অর্থ হল নিছক পরিবর্তন করা এবং এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত করা মাত্র। মূলতঃ তা আল্লাহরই সৃষ্টি। ফটোগ্রাফার যখন কোন বস্তর ছবি তুলেতখন সে উহাকে সৃষ্টি করে না। বরং বস্তটিকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করে মাত্র। যেমন মানুষ মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি তৈরী করে এবং অন্যান্য জীব-জন্তু বানায়। সাদা কাগজকে রঙ্গীন কাগজে পরিণত করে। এখানে মূল বস্ত তথা কালিরং ও সাদা কাগজ সবই তো আল্লাহর সৃষ্টি। এখানেই আল্লাহর সৃষ্টি এবং মানুষের সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
২- রাজত্বে আল্লাহর একত্বঃ
  মহান রাজাধিরাজ একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি বলেনঃ
)تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(
সেই মহান সত্বা অতীব বরকতময়যার হাতে রয়েছে সকল রাজত্ব। আর তিনি প্রতিটি বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। (সূরা মুলকঃ ১) আল্লাহ আরো বলেন,
)قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ(
হে নবী! আপনি জিজ্ঞাসা করুনসব কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতেযিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার উপর কোন আশ্রয় দাতা নেই। (সূরা মুমিনূনঃ ৮৮) সুতরাং সর্ব সাধারণের বাদশাহ একমাত্র আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে বাদশাহ বলা হলে তা সীমিত অর্থে বুঝতে হবে। আল্লাহ তাআলা অন্যের জন্যেও রাজত্ব ও কর্তৃত্ব সাব্যস্ত করেছেন। তবে তা সীমিত অর্থে। যেমন তিনি বলেন,
)أَوْ مَا مَلَكْتُمْ مَفَاتِحَهُ(
অথবা তোমরা যার চাবি-কাঠির (নিয়ন্ত্রনের) মালিক হয়েছো। (সূরা নূরঃ ৬১)
আল্লাহ আরো বলেনঃ
)إِلا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ(
তবে তোমাদের স্ত্রীগণ অথবা তোমাদের আয়ত্বধীন দাসীগণ ব্যতীত। (সূরা মুমিনূনঃ ৬) আরো অনেক দলীলের মাধ্যমে জানা যায় যেআল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও রাজত্ব রয়েছে। তবে এই রাজত্ব আল্লাহর রাজত্বের মত নয়। সেটা অসম্পূর্ণ রাজত্ব। তা ব্যাপক রাজত্ব নয়। বরং তা একটা নির্দিষ্ট সীমা রেখার ভিতরে। তাই উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যেযায়েদের বাড়ীতে রয়েছে একমাত্র যায়েদেরই কর্তৃত্ব ও রাজত্ব। তাতে আমরের হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নেই এবং বিপরীত পক্ষে আমরের বাড়ীতে যায়েদও কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তারপরও মানুষ আপন মালিকানাধীন বস্তর উপর আল্লাহ প্রদত্ত নির্ধারিত সীমা-রেখার ভিতরে থেকে তাঁর আইন্তকানুন মেনেই রাজত্ব করে থাকে। এজন্যই রাসূল () অকারণে সম্পদ বিনষ্ট করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
)وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمْ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيَامًا(
যে সমস্ত ধন্তসম্পদ আল্লাহ তোমাদের জীবন ধারণের উপকরণ স্বরূপ দান করেছেনতা তোমরা নির্বোধ লোকদের হাতে তুলে দিওনা। (সূরা নিসাঃ ৫) মানুষের রাজত্ব ও মুলূকিয়ত খুবই সীমিত। আর আল্লাহর মালিকান ও রাজত্ব সর্বব্যাপী এবং সকল বস্তকে বেষ্টনকারী। তিনি তাঁর রাজত্বে যা ইচ্ছাতাই করেন। তাঁর কর্মের কৈফিয়ত তলব করার মত কেউ নেই। অথচ সকল মানুষ তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
৩- পরিচালনায় আল্লাহর একত্বঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক ও অদ্বিতীয় ব্যবস্থাপক এবং পরিচালক। তিনি সকল মাখলূকাত এবং আসমানযমিনের সব কিছু পরিচালনা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ(
সৃষ্টি করা ও আদেশ দানের মালিক একমাত্র তিনি। বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলা অতীব বরকতময়। (সূরা আরাফঃ ৫৪) আল্লাহর এই পরিচালনা সর্বব্যাপী। কোন শক্তিই আল্লাহর পরিচালনাকে রুখে দাঁড়তে পারে না। কোন কোন মাখলূকের জন্যও কিছু কিছু পরিচালনার অধিকার থাকে। যেমন মানুষ তার ধন্তসম্পদসন্তান্তসন্ততি এবং কর্মচারীদের উপর কর্তৃত্ব করে থাকে। কিন্তু এ কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট একটি সীমার ভিতরে। উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হল যেতাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অর্থ সৃষ্টিরাজত্ব এবং পরিচালনায় আল্লাহকে একক হিসাবে বিশ্বাস করা।

দ্বিতীয়তঃ তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ্ঃ
  এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করার নাম তাওহীদে উলুহীয়্যাহ। মানুষ যেভাবে আল্লাহর ইবাদত করে এবং নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করেঅনুরূপ অন্য কাউকে এবাদতের জন্য গ্রহণ না করা। তাওহীদে উলুহীয়্যাতের ভিতরেই ছিল আরবের মুশরিকদের গোমরাহী। এ তাওহীদে উলূহিয়াকে ক্রেন্দ্র করেই তাদের সাথে জিহাদ করে আল্লাহর রাসূল () তাদের জান্তমালঘরবাড়ী ও জমি-জায়গা হরণ হালাল মনে করেছিলেন। তাদের নারী-শিশুদেরকে দাস্তদাসীতে পরিণত করেছিলেন। এই প্রকার তাওহীদ দিয়েই আল্লাহ তাআলা রাসূলগণকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সমস্ত আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। যদিও তাওহীদে রুবূবীয়্যাত এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্সিফাতও নবীদের দাওয়াতের বিষয়বস্ত ছিলকিন্তু অধিকাংশ সময়ই নবীগণ তাদের স্বজাতীয় লোকদেরকে তাওহীদে উলুহীয়্যার প্রতি আহবান জানাতেন। মানুষ যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য এবাদতের কোন অংশই পেশ না করেসদাসর্বদা রাসূলগণ তাদের উম্মতদেরকে এই আদেশই দিতেন। চাই সে হোক নৈকট্যশীল ফেরেশতাআল্লাহর প্রেরিত নবীআল্লাহর সৎকর্মপরায়ণ অলী বা অন্য কোন মাখলুক। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করা বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এই প্রকার তাওহীদে ত্রুটি করবেসে কাফির মুশরিক। যদিও সে তাওহীদে রুবূবীয়াহ এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্সিফাতের স্বীকৃতী প্রদান করে থাকে। সুতরাং কোন মানুষ যদি এ বিশ্বাস করে যেআল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকারীএকমাত্র মালিক এবং সব কিছুর পরিচালককিন্তু আল্লাহর এবাদতে যদি অন্য কাউকে শরীক করেতবে তার এই স্বীকৃতী ও বিশ্বাস কোন কাজে আসবে না। যদি ধরে নেয়া হয় যেএকজন মানুষ তাওহীদে রুবূবীয়াতে এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্সিফাতে পূর্ণ বিশ্বাস করেকিন্তু সে কবরের কাছে যায় এবং কবরবাসীর ইবাদত করে কিংবা তার জন্য কুরবানী পেশ করে বা পশু জবেহ করে তাহলে সে কাফির এবং মুশরিক। মৃত্যুর পর সে হবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ(
নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হবেআল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়িদাঃ ৭২) কুরআনের প্রতিটি পাঠকই একথা অবগত আছে যেনবী () যে সমস্ত কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করেছেনতাদের জান্তমাল হালাল মনে করেছেন এবং তাদের নারী-শিশুকে বন্দী করেছেন ও তাদের দেশকে গণীমত হিসাবে দখল করেছেনতারা সবাই একথা স্বীকার করত যেআল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তারা এতে কোন সন্দেহ পোষণ করত না। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে অন্যেরও উপাসনা করততাই তারা মুশরিক হিসাবে গণ্য হয়েছে এবং তাদের জান্তমাল হরণ হালাল বিবেচিত হয়েছে।
তৃতীয়তঃ তাওহীদুল্আসমা ওয়াস্সিফাতঃ
তাওহীদুল্আসমা ওয়াস্সিফাতের অর্থ হলআল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাবে নিজেকে যে সমস্ত গুণে গুণাম্বিত করেছেন সে সমস্ত নাম ও গুণাবলীতে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় হিসাবে মেনে নেওয়া। আল্লাহ নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেনতাতে কোন পরিবর্তনপরিবর্ধনতার ধরণ বর্ণনা এবং কোন রূপ উদাহরণ পেশ করা ব্যতীত আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করার মাধ্যমেই এ তাওহীদ বাস্তবায়ন হতে পারে। সুতরাং আল্লাহ নিজেকে যে নামে পরিচয় দিয়েছেন বা নিজেকে যে গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছেনতাঁর উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। এ সমস্ত নাম ও গুণাবলীর আসল অর্থ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে তার উপর ঈমান আনতে হবে- কোন প্রকার ধরণ বর্ণনা করা বা দৃষ্টান্ত পেশ করা যাবেনা। এই প্রকারের তাওহীদে আহলে কিবলা তথা মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ গোমরাহীতে পতিত হয়েছে। এক শ্রেণীর লোক আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকারের ক্ষেত্রে এতই বাড়াবাড়ি করেছে যেএর কারণে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। আর এক শ্রেণীর লোক মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছে। আর এক শ্রেণীর লোক আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কাছাকাছি। কিন্তু সালাফে সালেহীনের মানহাজ হলআল্লাহ নিজের জন্য যে নাম নির্ধারণ করেছেন এবং নিজেকে যে সবগুণে গুণাম্বিত করেছেনসে সব নাম ও গুণাবলীরর উপর ঈমান আনয়ন করতে হবে।
আল্লাহর কতিপয় নামের দৃষ্টান্তঃ
১) الحي القيوم)) আল্লাহ তাআলার অন্যতম নাম হচ্ছে, “আল হাইয়্যুল্কাইয়্যুম” এই নামের উপর ঈমান রাখা আমাদের উপর ওয়াজিব। এই নামটি আল্লাহর একটি বিশেষ গুণেরও প্রমাণ বহন করে। তা হচ্ছেআল্লাহর পরিপূর্ণ হায়াত। যা কোন সময় অবর্তমান ছিলনা এবং কোন দিন শেষও হবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা চিরঞ্জীব। তিনি সবসময় আছেন এবং সমস্ত মাখলুকাত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও অবশিষ্ট থাকবেন। তাঁর কোন ধ্বংস বা ক্ষয় নেই।
২) আল্লাহ নিজেকে السميع (আস্সামীউ) শ্রবণকারী নামে অভিহিত করেছেন। তার উপর ঈমান আনা আবশ্যক। শ্রবণ করা আল্লাহর একটি গুণ। তিনি মাখলুকাতের সকল আওয়াজ শ্রবণ করেন। তা যতই গোপন ও অস্পষ্ট হোক না কেন।
আল্লাহর কতিপয় সিফাতের দৃষ্টান্তঃ
  আল্লাহ বলেনঃ
)وَقَالَتْ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ(
ইয়াহুদীরা বলে আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে। বরং তাদের হাতই বন্ধ। তাদের উক্তির দরুন তারা আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছেবরং আল্লাহর উভয় হাত সদা উম্মুক্তযেরূপ ইচ্ছা ব্যয় করেন। (সূরা মায়িদাঃ ৬৪) এখানে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য দুটি হাত সাব্যস্ত করেছেন। যা দানের জন্য সদা প্রসারিত। সুতরাং আল্লাহর দুটি হাত আছে। এর উপর ঈমান আনতে হবে। কিন্তু আমাদের উচিৎ আমরা যেন অন্তরের মধ্যে আল্লাহর হাত কেমন হবে সে সম্পর্কে কোন কল্পনা না করি এবং কথার মাধ্যমে যেন তার ধরণ বর্ণনা না করি ও মানুষের হাতের সাথে তুলনা না করি। কেননা আল্লাহ বলেছেন,
)لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ(
কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়তিনি সর্বশ্রোতাসর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরাঃ ১১) আল্লাহ বলেন,
)قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّي الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ(
হে মুহাম্মাদ! আপনি ঘোষণা করে দিন যেআমার প্রতিপালক প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতাপাপকাজঅন্যায় ও অসংগত বিদ্রোহ ও বিরোধিতা এবং আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করাযার পক্ষে আল্লাহ কোন দলীল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নিআর আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই, (ইত্যাদি কাজ ও বিষয় সমূহ) হারাম করেছেন। (সূরা আরাফঃ ৩৩) আল্লাহ আরো বলেন,
)وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا(
যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নাইসেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো নানিশ্চয়ই কর্ণচক্ষুঅন্তর ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৩৬) সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর হাত দুটিকে মানুষের হাতের সাথে তুলনা করলসে আল্লাহর বাণী কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়” একথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং আল্লাহর বাণী,
)فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ(
তোমরা আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করো না। (সূরা নাহলঃ ৭৪) এর বিরুদ্ধাচরণ করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলীর নির্দিষ্ট কোন কাইফিয়ত বর্ণনা করলসে আল্লাহর ব্যাপারে বিনা ইলমে কথা বলল এবং এমন বিষয়ের অনুসরণ করলযে সম্পর্কে তার কোন জ্ঞান নেই।
আল্লাহর সিফাতের আরেকটি উদাহরণ পেশ করব। তা হল আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া। কুরআনের সাতটি স্থানে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে তিনি আরশের উপরে বিরাজমান। প্রত্যেক স্থানেই (استوى على العرش) “ইসতাওয়া আলাল আরশি” বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। আমরা যদি আরবী ভাষায় ইসতিওয়া শব্দটি অনুসন্ধান করতে যাই তবে দেখতে পাই যে,(استوىশব্দটি সব সময় (علىঅব্যয়ের মাধ্যমে ব্যবহার হয়ে থাকে। আর (استوىশব্দটি এভাবে ব্যবহার হলে সমুন্নত হওয়া’ এবং উপরে হওয়া’ ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহার হয় না। সুতরাং الرَّحْمَنُ عَلَىْ العَرْشِ اسْتَوَى এবং এর মত অন্যান্য আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যেআল্লাহ সৃষ্টি জগতের উপরে সমুন্নত হওয়া ছাড়াও আরশের উপরে বিশেষ একভাবে সমুন্নত। প্রকৃতভাবেই আল্লাহ আরশের উপরে। আল্লাহর জন্য যেমনভাবে সমুন্নত হওয়া প্রযোজ্যতিনি সেভাবেই আরশের উপরে সমুন্নত। আল্লাহর আরশের উপরে হওয়া এবং মানুষের খাট-পালং ও নৌকায় আরোহনের সাথে কোন সামঞ্জস্যতা নেই। এমনিভাবে মানুষের যানবাহনের উপরে চড়া এবং আল্লাহর আরশের উপরে হওয়ার মাঝে কোন সামঞ্জস্যতা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ الْفُلْكِ وَالْأَنْعَامِ مَا تَرْكَبُونَ لِتَسْتَوُوا عَلَى ظُهُورِهِ ثُمَّ تَذْكُرُوا نِعْمَةَ رَبِّكُمْ إِذَا اسْتَوَيْتُمْ عَلَيْهِ وَتَقُولُوا سُبْحانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنقَلِبُونَ(
তিনি তোমাদের আরোহনের জন্য সৃষ্টি করেন নৌযান ও চতুষ্পদ জন্তু যাতে তোমরা তার উপর আরোহণ করতে পারতারপর তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তোমরা ওর উপর স্থির হয়ে বস এবং বলঃ পবিত্র ও মহান তিনিযিনি এদেরকে আমাদের জন্য বশীভূত করেছেনযদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে। আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবো। (সূরা যুখরুফঃ ১২-১৪) সুতরাং মানুষের কোন জিনিষের উপরে উঠা কোন ক্রমেই আল্লাহর আরশের উপরে হওয়ার সদৃশ হতে পারে না। কেননা আল্লাহর মত কোন কিছু নেই।
  যে ব্যক্তি বলে যেআরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়ার অর্থ আরশের অধিকারী হয়ে যাওয়াসে প্রকাশ্য ভুলের মাঝে রয়েছে। কেননা এটা আল্লাহর কালামকে আপন স্থান থেকে পরির্বতন করার শামিল এবং ছাহাবী এবং তাবেয়ীদের ইজমার সম্পূর্ণ বিরোধী। এ ধরণের কথা এমন কিছু বাতিল বিষয়কে আবশ্যক করেযা কোন মুমিনের মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়া সংগত নয়। কুরআন মাজীদ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
)إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ(
আমি এই কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা যুখরুফঃ ৩) আরবী ভাষায় ইসতাওয়া শব্দের অর্থ সমুন্নত হওয়া’ এবং স্থির হওয়া। আর এটাই হল ইসতিওয়া শব্দের আসল অর্থ। সুতরাং আল্লাহর বড়ত্বের শানে আরশের উপর যেভাবে বিরাজমান হওয়া প্রযোজ্যসেভাবেই তিনি বিরাজমান। যদি ইসতিওয়ার (সমুন্নত হওয়ার) অর্থ ইসতিওলা (অধিকারী) হওয়ার মাধ্যমে করা হয়তবে তা হবে আল্লাহর কালামকে পরিবর্তন করার শামিল। আর যে ব্যক্তি এরূপ করলসে কুরআনের ভাষা যে অর্থের উপর প্রমাণ বহণ করেতা অস্বীকার করল এবং অন্য একটি বাতিল অর্থ সাব্যস্ত করল।
  তাছাড়া ইসতিওয়া” এর যে অর্থ আমরা বর্ণনা করলামতার উপর সালাফে সালেহীন ঐকমত্য (ইজমা) পোষণ করেছেন। কারণ উক্ত অর্থের বিপরীত অর্থ তাদের থেকে বর্ণিত হয়নি। কুরআন এবং সুন্নাতে যদি এমন কোন শব্দ আসে সালাফে সালেহীন থেকে যার প্রকাশ্য অর্থ বিরোধী কোন ব্যাখ্যা না পাওয়া যায়তবে সে ক্ষেত্রে মূলনীতি হল উক্ত শব্দকে তার প্রকাশ্য অর্থের উপর অবশিষ্ট রাখতে হবে এবং তার মর্মার্থের উপর ঈমান রাখতে হবে।
যদি প্রশ্ন করা হয় যেসালাফে সালেহীন থেকে কি এমন কোন কথা বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে যে, “ইসতাওয়া” অর্থ আলা” (আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন)উত্তরে আমরা বলব হ্যাঁঅবশ্যই তা বর্ণিত হয়েছে। যদি একথা ধরে নেয়া হয় যেতাঁদের থেকে এর প্রকাশ্য তাফসীর বর্ণিত হয়নিতবেও এ সমস্ত ক্ষেত্রে সালাফে সালেহীনের মানহাজ (নীতি) হলকুরআন এবং সুন্নাহর শব্দ যে অর্থ নির্দেশ করবেআরবী ভাষার দাবী অনুযায়ী শব্দের সে অর্থই গ্রহণ করতে হবে।
ইসতিওয়ার অর্থ ইসতিওলা দ্বারা করা হলে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দেয়ঃ
১) ইসতিওলা অর্থ কোন বস্তর মালিকানা হাসিল করা বা কোন যমিনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তাই ইসতিওয়ার অর্থ ইসতিওলার মাধ্যমে করা হলে অর্থ দাঁড়ায়আকাশ-জমিন সৃষ্টির আগে আল্লাহ আরশের মালিক ছিলেন নাপরে মালিক হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ(
নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হলেন সেই আল্লাহ যিনি ছয় দিনে আকাশ এবং জমিন সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপরে সমুন্নত হলেন। (সূরা আরাফঃ ৫৪)
২) আর্রাহমানু আলাল আরশিস্তাওয়া” অর্থ যদি ইস্তাওলার মাধ্যমে করা শুদ্ধ হয় তাহলে এ কথাও বলা শুদ্ধ হবে যেআসমানযমিন সৃষ্টি করার পূর্বে বা সৃষ্টি করা পর্যন্ত আরশ আল্লাহর কর্তৃত্বের মধ্যে ছিলনা। এমনিভাবে অন্যান্য মাখলুকাতের ক্ষেত্রেও একই ধরণের কথা প্রযোজ্য। এ ধরণের অর্থ আল্লাহর শানে শোভনীয় নয়।
৩) এটি আল্লাহর কালামকে তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে দেয়ার শামিল।
৪) এ ধরণের অর্থ করা সালাফে সালেহীনের ইজমার পরিপন্থী।
  তাওহীদুল আসমা ওয়াস্সিফাতের ক্ষেত্রে সার কথা এই যেআল্লাহ নিজের জন্য যে সমস্ত নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেনকোন পরিবর্তনবাতিল বা ধরণ-গঠন কিংবা দৃষ্টান্ত পেশ করা ছাড়াই তার প্রকৃত অর্থের উপর ঈমান আনয়ন করা আমাদের উপর ওয়াজিব।

মক্কার কাফেরদের শির্ক কোন ধরণের ছিল?
প্রশ্নঃ (২) যাদের কাছে নবী ()কে প্রেরণ করা হয়েছিলতাদের শির্ক কি ধরণের ছিল?
উত্তরঃ- যাদের নিকট নবী ()কে প্রেরণ করা হয়েছিলতারা তাওহীদে রুবূবীয়্যাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শির্ক করত না। কুরআনে কারীমের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায় যেতারা কেবলমাত্র তাওহীদে উলুহীয়াতে আল্লাহর সাথে শির্ক করত। রুবূবীয়াতের ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস ছিল যেআল্লাহই একমাত্র রব বা পালনকর্তা। তিনি অসহায়ের ডাকে সাড়া প্রদানকারী এবং বিপদাপদ দূরকারী।
  কিন্তু তারা এবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করত। এ ধরণের শির্ক মুসলিমকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। কেননা তাওহীদের অর্থ হল আল্লাহকে এবাদতের ক্ষেত্রে একক করা। আল্লাহর জন্য কতিপয় নির্দিষ্ট হক রয়েছেযা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা ওয়াজিব। এই হকগুলো তিন প্রকারঃ
১)          মালিকানার অধিকার
২)          ইবাদত পাওয়ার অধিকার
৩)          নাম ও গুণাবলীর অধিকার
এই জন্যই উলামাগণ তাওহীদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। তাওহীদুর রুবূবীয়্যাতাওহীদুল আসমা ওয়াস্সিফাত এবং তাওহীদুল উলুহীয়া। মুশরিকরা শেষ প্রকারের তাওহীদে আল্লাহর সাথে শরীক করতআল্লাহর সাথে অন্যকে অংশীদার সাব্যস্ত করত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا(
তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। (সূরা নিসাঃ ৩৬) আল্লাহ তাআলা বলেন,
)إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ(
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করবেআল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেনতার ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না। (সূরা মায়িদাঃ ৭২) আল্লাহ আরো বলেন,
)إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ(
নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। তবে এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের গুনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দেন।” (সূরা নিসাঃ ৪৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
)وَقَالَ رَبُّكُمْ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ(
এবং তোমাদের প্রতিপালক বলেনতোমরা আমাকে ডাকআমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। নিশ্চয়ই যারা আমার ইবাদত করতে অহংকার করবেতারা অচিরেই অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সূরা গাফেরঃ ৬০) আল্লাহ তাআলা সূরা কাফিরূনে বলেন,
)قُلْ يَاأَيُّهَا الْكَافِرُونَ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدتُّمْ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ(
বল হে কাফিররা! আমি তার ইবাদত করি নাযার ইবাদত তোমরা করএবং তোমরাও তার ইবাদতকারী নওযার ইবাদত আমি করি এবং আমি ইবাদতকারী নই তারযার ইবাদত তোমরা করে আসছ। (সূরা কাফেরূনঃ ১-৫)

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতি কি?
প্রশ্নঃ-(৩) আকীদাহ ও অন্যান্য দীনি বিষয়ের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতিগুলো কি কি?
উত্তরঃ আকীদাহ ও দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতি হল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে পরিপূর্ণরূপে আঁকড়িয়ে ধরা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ(
হে নবী! আপনি বলুন যেতোমরা যদি আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাওতাহলে আমার অনুসরণ কর। তবেই আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১) আল্লাহ আরো বলেন,
)مَنْ يُطِعْ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا(
যে ব্যক্তি রাসূল ()এর অনুসরণ করল সে স্বয়ং আল্লাহর অনুসরণ করল। আর যারা মুখ ফিরিয়ে নিবেআমি তাদের জন্য আপনাকে সংরক্ষণকারী হিসাবে প্রেরণ করিনি। (সূরা নিসাঃ ৮০) আল্লাহ আরো বলেন,
)وَمَا آتَاكُمْ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا(
এবং আল্লাহর রাসূল তোমাদেরকে যা প্রদান করেনতা তোমরা গ্রহণ কর আর যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেনতা থেকে তোমরা বিরত থাক। (সূরা হাশরঃ ৭) যদিও আয়াতটি গণীমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছেতবে শরীয়তের অন্যান্য মাসায়েলের ক্ষেত্রেও উত্তমভাবে প্রযোজ্য হবে। নবী () জুমআর স্বলাতের খুৎবায় বলতেন,
أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وكل ضلالة فى النار
অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাবসর্বোত্তম নির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মাদ ()এর নির্দেশনা। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে দ্বীনের ভিতরে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা। প্রতিটি বিদ্আতই গোমরাহী। আর প্রতিটি গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম।” রাসূল () বলেছেন,
عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ 
তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরে হেদায়েত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের অনুসরণ করবে এবং উহাকে দৃঢ়ভাবে আকঁড়িয়ে ধরবে। আর তোমরা দ্বীনের বিষয়ে নতুন আবিস্কৃত বিষয় হতে সাবধান থাকবে। কারণ প্রতিটি নব আবিস্কৃত বিষয়ই বিদ্আত আর প্রতিটি বিদ্আতই গোমরাহী।” এ সম্পর্কে আরো অসংখ্য দলীল-প্রমাণ রয়েছে। সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথ হল আল্লাহর কিতাবরাসূলের সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের পথকে আঁকড়িয়ে ধরা। তারা সদাসর্বদা দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা করেনএর ভিতর বিভেদ সৃষ্টি করেন না। আল্লাহ বলেন,
)شَرَعَ لَكُمْ مِنْ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ(
তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীনকেযার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহ (আঃ)কে আর যা আমি অহী করেছিলাম তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীমমূসা ও ঈসা (আঃ)কেএই বলে যেতোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে বিভেদ সৃষ্টি করো না। (সূরা শুরাঃ ১৩) তাদের মাঝে কখনো মতবিরোধ হয়ে থাকলে তা হয়েছে কেবল এমন ক্ষেত্রেযাতে ইজতেহাদ করা বৈধ আছে। এই ধরণের মতবিরোধ অন্তরে বিভেদ সৃষ্টি করে না। ইজতেহাদী বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতবিরোধ হওয়া সত্বেও আপনি তাদের মাঝে একতা এবং একে অপরের প্রতি ভালবাসা দেখতে পাবেন।

প্রশ্নঃ (৪) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত কারা?
উত্তরঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তারাইযারা আকীদা ও আমালের ক্ষেত্রে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে এবং তার উপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং অন্য কোন দিকে দৃষ্টি দেয় না। এ কারণেই তাদেরকে আহলে সুন্নাত রূপে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তাঁরা সুন্নাহর ধারক ও বাহক। তাদেরকে আহলে জামাতও বলা হয়। কারণ তাঁরা সুন্নাহর উপর জামাতবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ। আপনি যদি বিদ্আতীদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করেনতবে দেখতে পাবেন যেতারা আকীদা ও আমালের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলে বিভক্ত। তাদের এ অবস্থা এটাই প্রমাণ করে যেতারা যে পরিমাণ বিদ্আত তৈরী করেছে সে পরিমাণ সুন্নাত থেকে দূরে সরে গেছে।


জান্নাতী দলের পরিচয়ঃ
প্রশ্নঃ (৫) নবী () ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন যেতাঁর মৃত্যুর পর উম্মত বিভিন্ন দলে বিভক্ত হবে। সম্মানিত শায়খের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাই।
উত্তরঃ নবী () ছহীহ হাদীছের মাধ্যমে সংবাদ দিয়েছেন যেইয়াহুদীরা ৭১ দলে বিভক্ত হয়েছেনাসারারা বিভক্ত হয়েছে ৭২ দলে। আর এই উম্মাতে মুহাম্মাদী বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। একটি দল ব্যতীত সমস্ত দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এটি হল সেই দলযারা নবী () এবং তাঁর সাহাবীদের সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। এই দলটি দুনিয়াতে বিদ্আতে লিপ্ত হওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। এটিই হল সাহায্যপ্রাপ্ত দলযা কিয়ামত পর্যন্ত হকের উপর বিজয়ী থাকবে।
 কোন কোন আলেম এই জাহান্নামী ৭২ ফির্কার পরিচয় নির্ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রথমতঃ বিদ্আতীদেরকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন এবং প্রত্যেক ভাগ থেকে শাখা-প্রশাখা বের করে নবী () কর্তৃক ঘোষিত ৭২ টি ফির্কা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিছু কিছু আলেম ফির্কাগুলো নির্ধারণ না করাই উত্তম মনে করেছেন। কারণ এই ফির্কা ৭২এ নির্ধারিত থাকার পরও আরো অসংখ্য মানুষ গোমরা হয়েছে। তারা আরো বলেন এই সংখ্যা শেষ হবে না। শেষ যামানায় কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এর সর্বশেষ সংখ্যা সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং উত্তম হল রাসূল () যা সংক্ষেপ (অস্পষ্ট) রেখেছেনতা সংক্ষেপ (অস্পষ্ট) রাখা। আমরা এভাবে বলব যেএই উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। ৭২ দল জাহান্নামে যাবে এবং মাত্র একদল জান্নাতে যাবে। অতঃপর বলবযে দলটি রাসূল () এবং তাঁর সাহাবীদের সুন্নাহর বিরোধীতা করবেসে এই ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত হবে।

প্রশ্নঃ (৬) নাজাত প্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট কিকোন ব্যক্তির মাঝে উক্ত বৈশিষ্টসমূহের কোন একটি অবর্তমান থাকলে সে ব্যক্তি কি নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে যাবে?
উত্তরঃ ফির্কা নাজীয়ার প্রধান বৈশিষ্ট হল আকীদাহইবাদতচরিত্র ও আচার ব্যবহারে নবী () এর সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরা।
  আপনি দেখতে পাবেন যেআকীদার ক্ষেত্রে তাঁরা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল () এর সুন্নাহর অনুসারী। উলুহীয়াতরুবূবীয়াত এবং আসমা ওয়াস্সিফাতের ক্ষেত্রে তারা কুরআন্তসুন্নাহর আলোকে সঠিক বিশ্বাস পোষণ করে থাকেন।
  এবাদতের ক্ষেত্রে আপনি দেখতে পাবেন যেতারা রাসূল () এর সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নকারী। এবাদতের প্রকারপদ্ধতিপরিমাণসময়স্থান এবং এবাদতের কারণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে রাসূল () এর সুন্নাহর অনুসরণ করাই তাদের বৈশিষ্ট। আপনি তাদের নিকট দ্বীনের ব্যাপারে কোন বিদ্আত খোঁজে পাবেন না। তাঁরা আল্লাহ এবং রাসূল ()এর সাথে সর্বোচ্চ আদব রক্ষা করে চলেন। আল্লাহ অনুমতি দেননিএবাদতের ক্ষেত্রে এমন বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তারা আল্লাহ এবং রাসূলের অগ্রণী হয়না।
  আখলাক-চরিত্রের ক্ষেত্রেও আপনি তাদেরকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী দেখতে পাবেন। মুসলিমদের কল্যাণ কামনা করাঅপরের জন্য উদার মনের পরিচয় দেয়ামানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলাউত্তম কথা বলাবদান্যতাবীরত্ব এবং অন্যান্য মহান গুণাবলী তাদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট।
  পার্থিব বিষয়াদিতে আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যেতারা সততার সাথে সকল প্রকার লেনদেন সম্পন্ন করে থাকেন। কাউকে ধোকা দেন না। ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তারা দ্রব্যের আসল অবস্থা বর্ণনা করে দেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূল () বলেছেন,
الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا 
পৃথক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই ক্রয়-বিক্রয় বাতিল করার অধিকার রয়েছে। যদি তারা উভয়েই সত্য বলে এবং দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করেআল্লাহ তাদের বেচা-কেনায় বরকত দান করেন। আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ-ত্রুটি গোপন করেতবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের ভিতর থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হয়।
  উপরে যে সমস্ত গুণাবলীর আলোচনা করা হলকোন ব্যক্তির মাঝে উক্ত গুণাবলীর কোন বৈশিষ্ট অবর্তমান থাকলে এ কথা বলা যাবে না যেসে নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই আপন আপন আমাল অনুযায়ী মর্যাদা লাভ করবে। তবে তাওহীদের ক্ষেত্রে ত্রুটি করলে নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্আতের বিষয়টিও অনুরূপ। কিছু কিছু বিদ্আত এমন আছেযা মানুষকে নাজী ফির্কা থেকে বের করে দেয়। তবে চরিত্র ও লেনদেনের ভিতরে কেউ ত্রুটি করলে সে নাজাত প্রাপ্ত দল থেকে বের হবে না। বরং মর্যাদা কমিয়ে দিবে।
  আখলাকের বিষয়টি একটু দীর্ঘ করে বর্ণনা করা দরকার। চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পরস্পরে একতাবদ্ধ থাকা এবং আল্লাহ তাআলা যে হকের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়েছেনতার উপর অটুট থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)شَرَعَ لَكُمْ مِنْ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ(
তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীনকেযার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহ (আঃ)কে। আর যা আমি অহী করেছিলাম তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীমমূসা ও ঈসা (আঃ)কেএই বলে যেতোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে মতভেদ করো না।” (সূরা শুরাঃ ১৩) আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যেযারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছেমুহাম্মাদ () তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ বলেন,
)إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ(
নিশ্চয় যারা দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে আপনি কোন ব্যাপারেই তাদের অন্তর্ভুক্ত নন।” (সূরা আনআমঃ ১৫৯) সুতরাং ঐক্যবদ্ধ থাকা নাজী ফির্কার (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের) অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। তাদের মাঝে কোন ইজতেহাদী বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তাদের এই মতবিরোধ পরস্পরের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রুতার সৃষ্টি করে নাবরং তারা বিশ্বাস করে যেতারা পরস্পরে ভাই। যদিও তাদের মাঝে এই মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি তাদের একজন এমন ইমামের পিছনেও স্বলাত আদায় করে থাকেতার দৃষ্টিতে সেই ইমাম ওযু বিহীন। আর ইমাম বিশ্বাস করে যেসে ওযু অবস্থায় রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যেআহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের লোকেরা উটের গোশত খেয়ে ওযু করে নি এমন ইমামের পিছনেও স্বলাত আদায় করে থাকে। ইমাম মনে করে যেউটের গোশত খেলে ওযু ভঙ্গ হয় না। আর মুক্তাদী মনে করে যেওযু ভঙ্গ হয়ে যায়। তা সত্বেও সে মনে করে উক্ত ইমামের পিছনে স্বলাত আদায় করা জায়েয আছে। এমনটি তারা এ জন্যই করে যেইজতেহাদের কারণে যে সমস্ত মতভেদ সৃষ্টি হয়তা প্রকৃত পক্ষে মতভেদ নয়। কেননা প্রত্যেকেই আপন আপন দলীলের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করেন তাদের কোন দ্বীনি ভাই দলীলের অনুসরণ করতে গিয়ে যদি কোন আমালে তাদের বিরোধীতা করেন প্রকৃত পক্ষে তারা বিরোধীতা করেননিবরং তাদের অনুরূপই করেছেন। কারণ তারাও দলীলের অনুসরণ করার প্রতি আহবান জানান। যেখানেই তা পাওয়া যাক না কেন।
  অধিকাংশ আলেমের কাছে এ বিষয়টি অস্পষ্ট নয় যেরাসূল ()এর যুগে ছাহাবীদের ভিতরে এরকম অনেক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। তিনি কাউকে ধমক দেননি বা কারও উপর কঠোরতা আরোপ করেননি। রাসূল () যখন খন্দকের যুদ্ধ হতে ফেরত আসলেনতখন জিবরীল (আঃ) এসে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী বানু কুরায়যায় অভিযান পরিচালনার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। রাসূল () ছাহাবীদেরকে বললেনতোমাদের কেউ যেন বানু কুরায়যায় না গিয়ে আসরের স্বলাত না পড়ে। সাহাবীগণ এ কথা শুনে মদীনা হতে বের হয়ে বানু কুরায়যার দিকে রওনা দিলেন। পথি মধ্যে আসরের স্বলাতের সময় হয়ে গেল। তাদের কেউ স্বলাত না পড়েই বানু কুরায়যায় পৌঁছে গেলেন। এদিকে স্বলাতের সময় শেষ হয়ে গেল। তারা বললেনঃ রাসূল () বলেছেনআসরের স্বলাত অবশ্যই বানী কুরায়যায় গিয়ে পড়তে হবে। তাদের কেউ স্বলাত ঠিক সময়েই পড়ে নিল। তাদের কথা হল রাসূল () আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বের হতে বলেছেন। তাঁর কথার অর্থ এটা নয় যেআমরা সময় মত স্বলাত না পড়ে পিছিয়ে নিব। এরাই সঠিক ছিল। তদুপুরি রাসূল () দুদলের কাউকে ধমক দেননি। সাহাবীগণও একজন অন্যজনের সাথে শত্রুতা পোষণ করেন নি বা রাসূল ()এর বক্তব্য বুঝার ক্ষেত্রে ভিন্নমত হওয়া সত্বেও তাদের মাঝে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়নি।
  এই হাদীছটি বুঝতে গিয়ে যে মতভেদের সূচনা হয়েছিলতার কারণে তাদের মধ্যে শত্রুতা বা দলাদলির সৃষ্টি হয়নি। এজন্য আমি মনে করি সুন্নী মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিৎ। তাদের মাঝে যেন কোন প্রকার দলাদলি সৃষ্টি না হয়। যাতে তারা পরস্পরে কাঁদা ছুড়াছুড়ি করবেএকে অপরকে শত্রু মনে করবে এবং ইজতেহাদী মাসআলায় মতভেদ হওয়ার কারণে একজন অপর জনকে ঘৃণা করবে। আমি মনে করি দলীলের ভিত্তিতে ইজতেহাদী কোন মাসআলায় মতভেদ হওয়া সত্বেওআহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীদের ঐকবদ্ধ হওয়া উচিৎ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলমুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। কারণ ইসলাম ও মুসলিমদের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য শত্রুরা চায় যেমুসলিমেরা পরস্পরে বিভক্ত হোক। সুতরাং আমাদের উচিৎ নাজী ফির্কার বৈশিষ্টে বৈশিষ্ট মন্ডিত হয়ে হকের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকা।

প্রশ্নঃ (৭) দ্বীনের ভিতরে মধ্যম পন্থা বলতে কি বুঝায়?
উত্তরঃ দ্বীনের ভিতরে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের অর্থ এই যেমানুষ দ্বীনের মধ্যে কোন কিছু বাড়াবে না। যাতে সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ফেলে। এমনিভাবে দ্বীনের কোন অংশ কমাবে না। যাতে সে আল্লাহর নির্ধারিত দ্বীনের কিছু অংশ বিলুপ্ত করে দেয়।
  নবী ()এর জীবনীর অনুসরণ করাও দ্বীনের মধ্যে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর জীবনাদর্শ অতিক্রম করা দ্বীনের ভিতরে অতিরঞ্জনের শামিল। তাঁর জীবন চরিতের অনুসরণ না করা তাঁকে অবহেলা করার অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যেএকজন লোক বলল আমি আজীবন রাত্রি বেলা তাহাজ্জুদের স্বলাত পড়ব। রাত্রিতে কখনই নিদ্রা যাব না। কারণ স্বলাত সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদাত। তাই আমি স্বলাতের মাধ্যমে বাকী জীবনের রাত্রিগুলো জাগরণ করতে চাই। আমরা তার উত্তরে বলব যেএই ব্যক্তি দ্বীনের মাঝে অতিরঞ্জিতকারী। সে হকের উপর নয়। নবী ()এর যুগে এরকম হয়েছিল। তিন জন লোক একত্রিত হয়ে একজন বললআমি সারা রাত্রি স্বলাত আদায় করব। আর একজন বলল আমি সারা বছর সওম রাখব এবং কখনো তা ছাড়ব না। তৃতীয় জন বলল আমি স্ত্রী সহবাস করব না। নবী ()এর কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন একদল লোকের কি হল তারা এ রকম কথা বলে থাকেঅথচ আমি সওম রাখি এবং কখনো সওম থেকে বিরত থাকি। রাত্রে ঘুমাই এবং আল্লাহর ইবাদত করি। স্ত্রীদের সাথেও মিলিত হই। এটি আমার সুন্নাত। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ থাকবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার কারণে রাসূল () তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নতার ঘোষণা করলেন। কেননা তারা সওম রাখা না রাখারাত্রি জাগরণ করাঘুমানো এবং স্ত্রী সহবাস করার ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিল। দ্বীনী বিষয়ে যে ব্যক্তি অবহেলা করে বলবে যেআমার নফল এবাদতের দরকার নেই। শুধ ফরজ ইবাদতগুলো পালন করব। আসলে সে ব্যক্তি ফরজ আমালেও অবহেলা করে থাকে। সঠিক পথের অনুসারী হল সেই ব্যক্তি যে রাসূল() এবং খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাহর উপর চলবে। অন্য একটি দৃষ্টান্ত হলমনে করুন তিন জন ভাল লোকের পাশে রয়েছে একজন ফাসেক ব্যক্তি। তিনজনের একজন বললআমি এই ফাসেককে সালাম দিব না। তার থেকে দূরে থাকব এবং তার সাথে কথা বলব না। অপর জন বললআমি এর সাথে চলবতাকে সালাম দিবহাসি মুখে তার সাথে কথা বলবতাকে দাওয়াত দিব এবং তার দাওয়াতে আমিও শরীক হব। আমার নিকট সে অন্যান্য সৎ লোকের মতই। তৃতীয়জন বললআমি এই ফাসেক ব্যক্তিকে তার পাপাচারিতার কারণে ঘৃণা করি। তার ভিতরে ঈমান থাকার কারণে আমি তাকে ভালবাসি। তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করব না। তবে তাকে সংশোধনের কারণে বর্জন করা হলে তা ভিন্ন কথা। তাকে বর্জন করলে যদি তার পাপাচারিতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়তবে আমি তাকে বর্জন করব না। এই তিনজনের প্রথম ব্যক্তি বেশী বাড়াবাড়ি করল। দ্বিতীয়জন ত্রুটি করল এবং তৃতীয়জন মধ্যম পন্থা ও সঠিক পথের অনুসরণ করল।
  অন্যান্য সকল ইবাদত ও মানুষের মুআমালাতের ক্ষেত্রেও অনুরূপ। মানুষ এতে ত্রুটিবাড়াবাড়িএবং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে থাকে।
  আরো একটি উদাহরণ ভাল করে শ্রবণ করুন। মনে করুন একজন লোক তার স্ত্রীর কথায় চলে। তার স্ত্রী তাকে যেখানে পাঠায় সেখানে যায়। সে তার স্ত্রীকে অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করে না এবং ভাল কাজে উৎসাহ দেয় না। সকল ক্ষেত্রেই স্ত্রী তার উপর কর্তৃত্ব করছে এবং তার মালিক হয়ে বসেছে।
  আরেক ব্যক্তি তার স্ত্রীর কোন ব্যাপারেই গুরুত্ব দেয়না। তার স্ত্রীর সাথে অহংকার করে চলে। যেন তার স্ত্রী তার কাছে চাকরানীর চেয়ে অবহেলিত। অন্য ব্যক্তি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে এবং আল্লাহ ও রাসূল () প্রদত্ব সীমা অনুযায়ী স্ত্রীর সাথে আচরণ করে থাকে। আল্লাহ বলেন,
)وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ(
তাদের (স্ত্রীদের) জন্য তোমাদের উপর হক রয়েছেযেমন তাদের উপর তোমাদের হক রয়েছে। (সূরা বাকারাঃ ২২৮) কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করবে না। স্ত্রীর কোন একটি চরিত্রকে অপছন্দ করলে হয়ত অন্য একটি গুণ দেখে সে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। শেষ ব্যক্তি মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারীপ্রথম ব্যক্তি স্ত্রীর সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় শিথিল এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি ত্রুটিকারী (অবহেলাকারী ও অবজ্ঞাকারী)। হে পাঠক! আপনি সকল ইবাদত ও আচর-আচরণকে উক্ত উদাহরণগুলোর উপরে অনুমান করুন।

প্রশ্নঃ (৮) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট ঈমান অর্থ কিঈমান কি বাড়ে এবং কমে?
উত্তরঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে ঈমানের অর্থ হল অন্তরের বিশ্বাসমৌখিক স্বীকারোক্তি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমাল- এই তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম।
  যেহেতু উক্ত বিষয় সমূহের সমষ্টির নাম ঈমান সে হিসাবেতা বাড়বে এবং কমবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ অন্তরের বিশ্বাসেরও তারতম্য হয়ে থাকে। অতএব সংবাদ শুনে কোন কিছু বিশ্বাস করা আর আপন চোখে দেখে বিশ্বাস করা এক কথা নয়। অনুরূপভাবে একজনের দেয়া সংবাদ বিশ্বাস করা আর দুজনের সংবাদ বিশ্বাস করা এক কথা নয়। এ জন্যই ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন,
)وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِ الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِى(
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দেখান আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন। আল্লাহ বললেনতুমি কি বিশ্বাস কর নাইবরাহীম (আঃ) বললেনবিশ্বাস তো অবশ্যই করিকিন্তু আমার অন্তর যাতে পরিতৃপ্ত হয় এজন্য আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই। (সূরা বাকারাঃ ২৬০) কাজেই অন্তরের বিশ্বাস এবং তার স্থিরতা ও প্রশান্তির দিক থেকেও ঈমান বৃদ্ধি পায়। মানুষ তার অন্তরে ইহা সহজেই অনুভব করে থাকে। সে যখন ইসলামী অনুষ্ঠান বা ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হয়ে জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা শুনেতখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। এমন কি সে যেন জান্নাত- জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। সে যখন মজলিস থেকে উঠে যায়তখন গাফলতি চলে আসে এবং এই বিশ্বাস কমতে থাকে।
  এমনিভাবে মুখের আমালের (যিকর্) কারণেও ঈমান বৃদ্ধি পায়। কেননা যে ব্যক্তি দশবার আল্লাহর যিকর করলসে একশতবার যিকর্কারীর সমান নয়। দ্বিতীয় ব্যক্তির আমাল প্রথম ব্যক্তির আমালের চেয়ে অনেক বেশী। তাই তার ঈমান বেশী হওয়াই স্বাভাবিক।
  এমনিভাবে যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে ইবাদত সম্পন্ন করবে আর যে ব্যক্তি ত্রুটিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে- উভয়ে সমান নয়।
  এমনিভাবে আমালের মাধ্যমেও ঈমান বাড়ে। যে ব্যক্তি বেশী আমাল করে তার ঈমান কম আমালকারীর চেয়ে বেশী। ঈমানের বেশী-কম হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
)وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلَائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا(
আমি জাহান্নামের তত্বাবধায়ক হিসেবে ফেরেশতাকেই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তাদের এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছিযাতে কিতাবধারীরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। (সূরা মুদ্দাস্ছিরঃ ৩১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
)وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَى رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ(
আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয়তখন তাদের কেউ কেউ বলেএ সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলতবে যারা ঈমানদারএ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। বস্তুতঃ যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে এটি তাদের অন্তরে কলুষের সাথে আরো কলুষ বৃদ্ধি করেছে এবং তারা কাফের অবস্থায়ই মৃত্যু করল। (সূরা তাওবাঃ ১২৪-২৫) ছহীহ হাদীছে নবী () হতে বর্ণিত আছে,
مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الْحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ
দ্বীন ও জ্ঞানে অপূর্ণ হওয়া সত্বেও জ্ঞানী পুরুষদের জ্ঞানকে তোমাদের চেয়ে অধিক হরণকারী আর কাউকে দেখিনি।” সুতরাং ঈমান বাড়ে এবং কমে। প্রশ্ন হল ঈমান বাড়ার কারণ কি?
ঈমান বৃদ্ধি হওয়ার উপায় সমূহঃ
প্রথম উপায়ঃ আল্লাহর সমস্ত নাম ও গুণাবলীসহ আল্লাহ তাআলার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পাবেনিঃসন্দেহে তার ঈমানও তত বৃদ্ধি পাবে। এ জন্যই যে সমস্ত আলেম আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা এ সম্পর্কে জ্ঞানহীন আলেমদের চেয়ে ঈমানের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী।
দ্বিতীয় উপায়ঃ সৃষ্টির ভিতরে আল্লাহর নিদর্শন সমূহ সম্পর্কে গবেষণা করা এবং আল্লাহ মানব জাতিকে যে জীবন বিধান দিয়েছেনতার ভিতরে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে যতই চিন্তা করবেততই তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
)وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ وَفِي أَنفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ(
বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে। এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেওতোমরা কি অনুধাবন করবে না?” (সূরা যারিয়াতঃ ২০) আল্লাহর সৃষ্টিরাজির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করলে যে ঈমান বৃদ্ধি পায়এ মর্মে অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে।
তৃতীয় উপায়ঃ বেশী বেশী সৎ কাজ সম্পাদন করা। সৎ আমাল যতই বৃদ্ধি পাবেঈমান ততই বৃদ্ধি পাবে। এই সৎ আমাল মুখের কথার মাধ্যমে হোককিংবা কাজের মাধ্যমে হোক যেমন যিকর-আযকারস্বলাতসওম এবং হজ্জ। এসব কিছুই ঈমান বৃদ্ধির মাধ্যম।
ঈমান কমে যাওয়ার কারণ সমূহঃ
প্রথম কারণঃ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ঈমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই কমবেঈমানও তত কমতে থাকবে।
দ্বিতীয় কারণঃ সৃষ্টিতে ও শরীয়তে আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে গবেষণা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা না করা ঈমানের ঘাটতি হওয়ার অন্যতম কারণ।
তৃতীয় কারণঃ গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া। কেননা গুনাহের কাজ করলে অন্তরে এবং ঈমানের উপর বিরাট প্রভাব পড়ে। এই জন্যই নবী () বলেছেন,
لَا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ
ব্যভিচারী ঈমান থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না।
চতুর্থ কারণঃ সৎ আমাল না করা ঈমান হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু যদি বিনা কারণে কোন ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে ঈমান কমার সাথে সাথে সে শাস্তির সম্মুখীন হবে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য কারণে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে অথবা ওয়াজিব নয় এমন কাজ ছেড়ে দিলে ঈমানের ঘাটতি হবেকিন্তু শাস্তির সম্মুখীন হবে না। এই জন্যই রাসূল() মহিলাদেরকে জ্ঞান ও দ্বীনের ক্ষেত্রে অপূর্ণ বলেছেন। এর কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন যেতাদের যখন মাসিকের রক্ত বের হয়তখন তারা স্বলাত-সওম থেকে বিরত থাকে। অথচ মাসিক অবস্থায় স্বলাত-সওম থেকে বিরত থাকার কারণে তাদেরকে দোষারূপ করা হয় না। বরং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু পুরুষদের তুলনায় তাদের আমাল কম হয়ে গেলসে হিসাবে তারা পুরুষেরে চেয়ে কম ঈমানের অধিকারী।

হাদীছে জিবরীল এবং আবদুল কায়েসের হাদীছের মধ্যে সমন্বয়ঃ
প্রশ্নঃ (৯) হাদীছে জিবরীলে ঈমানের ব্যাখ্যায় রাসূল () বলেছেনঈমান হল আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখাতাঁর ফেরেশতাআসমানী কিতাব এবং তাঁর রাসূলগণের উপর বিশ্বাস রাখাপরকালের উপর বিশ্বাস এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস রাখার নাম।’ অথচ আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের হাদীছে নবী () ঈমানের ব্যাখ্যায় বলেছেনঈমান হল আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই তিনি এক ও অদ্বিতীয়একথার সাক্ষ্য দেয়াস্বলাত কায়েম করাযাকাত দেয়া এবং গণীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ প্রদান করা।’ উপরের উভয় হাদীছের মধ্যে আমরা কিভাবে সমন্বয় করব?
উত্তরঃ এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে আমি বলতে চাই যেআল্লাহর কিতাব এবং রাসূল ()এর সুন্নাহর ভিতরে কোন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নেই। কুরআনের এক অংশ অন্য অংশের বিরোধী নয়। এমনিভাবে রাসূল ()এর সুন্নাহর ক্ষেত্রেও একই কথা। কুরআন ও সুন্নাতে পরস্পর বিরোধী কোন জিনিষ নেই। এ মূলনীতিটি মনে রাখলে কুরআনহাদীছ বুঝার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
 )أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيْرًا(
তারা কি কুরআন গবেষণা করেনাএটি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নিকট থেকে হততাহলে তারা উহাতে অনেক মতভেদ দেখতে পেত। (সূরা নিসাঃ ৮২) কুরআনের ভিতরে যেহেতু মতবিরোধ নাইরাসূলের () হাদীছের ক্ষেত্রেও তাই। এক হাদীছ অন্য হাদীছের বিরোধী নয়। রাসূল () যদি এক স্থানে ঈমানকে একভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং অন্য স্থানে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেনযা আপনার দৃষ্টিতে প্রথম ব্যাখ্যার বিরোধী মনে হয়কিন্তু আপনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করেনতাহলে আপনি কোন দ্বন্দ্ব পাবেন না।
হাদীছে জিবরীলে (আঃ) নবী () দ্বীনকে ইসলামঈমানইহসান এই তিনভাগে ভাগ করেছেন। আর আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের হাদীছে শুধুমাত্র দ্বীনের একটি মাত্র প্রকার তথা ইসলামের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে শুধুমাত্র ইসলামের কথা উল্লেখ হবেসেখানে ঈমানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কারণ মুমিন হওয়া ব্যতীত ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান পালন করা সম্ভব নয়। আবার যেখানে শুধুমাত্র ঈমানের আলোচনা হবেসেখানে ইসলামও অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ প্রত্যেক মুমিনকে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। আর যেখানে ঈমান ও ইসলাম একই সাথে উল্লেখ হবেসেখানে ঈমান দ্বারা উদ্দেশ্য হবে অন্তরের বিষয়সমূহ। আর ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হবে বাহ্যিক আমাল সমূহ। ইলম অর্জনকারীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা। শুধুমাত্র ইসলামের আলোচনা আসলে ঈমানও তার ভিতরে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الإِسْلامُ(
 ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৯) আর এটা জানা বিষয় যেইসলাম আকীদাহঈমান ও বাহ্যিক আমালের সমষ্টি। এককভাবে ঈমানের উল্লেখ হলে ইসলামকে তার ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দুটি একসাথে উল্লেখ হলে ঈমানের অর্থ হবে অন্তরে বিশ্বাস করার বিষয়সমূহ আর ইসলামের অর্থ হবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক আমালসমূহ। এই জন্যই পূর্ববর্তী যুগের কোন কোন আলেম বলেছেনইসলাম প্রকাশ্য বিষয় এবং ঈমান গোপনীয় বিষয়। কারণ তা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি কখনো দেখতে পাবেন যেমুনাফেক ব্যক্তি স্বলাত পড়ছেসওম রাখছে এবং সাদকা করছে। এই ব্যক্তি প্রকাশ্যভাবে মুসলিম কিন্তু মুমিন নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
)وَمِنْ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ(
মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ এমন আছেযারা বলে আমরা আল্লাহর উপর এবং পরকালের উপর ঈমান আনয়ন করেছিঅথচ তারা মুমিন নয় (সূরা বাকারাঃ ৮)

ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে
প্রশ্নঃ (১০) রাসূল () হাদীছে জিবরাঈলে বলেছেনঈমান হল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাসআল্লাহর কিতাবের উপর বিশ্বাসরাসূলদের উপর বিশ্বাসপরকালের উপর বিশ্বাস এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন। অন্য হাদীছে রয়েছেঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। উভয় হাদীছের মধ্যে আমরা কিভাবে সমন্বয় করব?
উত্তরঃ যে ঈমানের মাধ্যমে আকীদাহ্উদ্দেশ্যতার রুকন মোট ছয়টি। সেগুলো হাদীছে জিবরাঈলে উল্লেখিত হয়েছে। জিবরীল (আঃ) যখন নবী ()কে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেনউত্তরে নবী () বললেনঈমান হল তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতিফেরেশতাদের প্রতিআসমানী কিতাবসমূহের প্রতিরাসূলগণের প্রতিপরকালের প্রতি এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি। অপর পক্ষে যেখানে ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা থাকার কথা বলা হয়েছেসেখানে ঈমানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার সৎ আমাল উদ্দেশ্য। এই জন্য স্বলাতকে ঈমানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আল্লাহবলেন,
)وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ(
আল্লাহ তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অতীব দয়ালু (সূরা বাকারাঃ ১৪৩) তাফসীরকারকগণ বলেছেনএখানে ঈমান দ্বারা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে ফিরে আদায় করা স্বলাত উদ্দেশ্য। কেননা ছাহাবীগণ কাবার দিকে মুখ করে স্বলাত আদায়ের পূর্বে বাইতুল মুক্বাদ্দাসের দিকে ফিরে স্বলাত আদায় করতেন।

প্রশ্নঃ (১১) মসজিদে আসার অভ্যাস আছে এমন ব্যক্তিকে কি আমরা মুমিন হিসাবে সাক্ষ্য দিতে পারি?
উত্তরঃ কোন সন্দেহ নাই যেকোন ব্যক্তি যদি স্বলাতের জন্য মসজিদে আসেতার মসজিদে আসাটাই তার ঈমানের পরিচয় বহন করে। কারণ তা না হলে কিসে তাকে ঘর থেকে বের করে মসজিদে যাওয়ার কষ্ট স্বীকার করতে বাধ্য করল?
প্রশ্নকারী যে হাদীছটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তা হলনবী () বলেছেন,
إِذَا رَأَيْتُمُ الرَّجُلَ يَعْتَادُ الْمَسْجِدَ فَاشْهَدُوا لَهُ بِالْإِيمَانِ
তোমরা যদি কোন ব্যক্তিকে মসজিদে আসতে অভ্যস্ত দেখতবে তার ঈমান আছে বলে সাক্ষ্য প্রদান কর। কিন্তু এই হাদীছটি দূর্বল। রাসূল () হতে এই হাদীছটি ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়নি।

আল্লাহ সম্পর্কে শয়তানের ওয়াস্ওয়াসা (কুমন্ত্রনা)
প্রশ্নঃ (১২) আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে শয়তান একজন মানুষকে এমন ওয়াস্ওয়াসা (কুমন্ত্রনা) প্রদান করে যেসে ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা করে। এ সম্পর্কে আপনার উপদেশ কি?
উত্তরঃ প্রশ্নকারী যে সমস্যার কথা ব্যক্ত করলেন এবং যার পরিণতিকে ভয় করছেনআমি তাকে বলব যেহে ভক্ত! আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। উক্ত সমস্যার ভাল ফলাফল ব্যতীত মন্দ কোন ফল হবে না। কেননা এই ওয়াস্ওয়াসাগুলো শয়তান মুমিনদের মাঝে প্রবেশ করায়যাতে সে মানুষের ঈমানকে দূর্বল করে দিতে পারে এবং তাদেরকে মানষিক অস্থিরতায় ফেলে দিয়ে ঈমানী শক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে। শুধু তাই নয় অনেক সময় মুমিনদের সাধারণ জীবনকে বিপন্ন করে তুলে।
  প্রশ্নকারী ব্যক্তির সমস্যাই মুমিনদের প্রথম সমস্যা নয় এবং শেষ সমস্যাও নয়বরং দুনিয়াতে একজন মুমিন অবশিষ্ট থাকলেও এই সমস্যা বর্তমান থাকবে। সাহাবীগণও এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আবু হুরায়রা h হতে বর্ণিত,
 جَاءَ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَأَلُوهُ إِنَّا نَجِدُ فِي أَنْفُسِنَا مَا يَتَعَاظَمُ أَحَدُنَا أَنْ يَتَكَلَّمَ بِهِ قَالَ وَقَدْ وَجَدْتُمُوهُ قَالُوا نَعَمْ قَالَ ذَاكَ صَرِيحُ الْإِيمَانِ
 সাহাবীদের একদল লোক রাসূল ()এর কাছে আগমণ করে জিজ্ঞাসা করলআমরা আমাদের অন্তরে কখনো কখনো এমন বিষয় অনুভব করিযা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হয়। রাসূল () বললেন যেসত্যিই কি তোমরা এরকম পেয়ে থাকতাঁরা বললেন হ্যাঁআমরা এরকম অনুভব করে থাকি। রাসূল () বললেনএটি তোমাদের ঈমানের স্পষ্ট প্রমাণ
  রাসূল () আরো বলেন,
 يَأْتِي الشَّيْطَانُ أَحَدَكُمْ فَيَقُولُ مَنْ خَلَقَ كَذَا مَنْ خَلَقَ كَذَا حَتَّى يَقُولَ مَنْ خَلَقَ رَبَّكَ فَإِذَا بَلَغَهُ فَلْيَسْتَعِذْ بِاللَّهِ وَلْيَنْتَهِ          
তোমাদের কারো কাছে শয়তান আগমণ করে বলেকে এটি সৃষ্টি করেছেকে ঐটি সৃষ্টি করেছেএক পর্যায়ে বলে কে তোমার প্রতিপালককে সৃষ্টি করেছেতোমাদের কারও অবস্থা এরকম হলে সে যেন শয়তানের কুমন্ত্রনা হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং এরকম চিন্তা-ভাবনা করা হতে বিরত থাকে।” ইবনে আব্বাস h হতে বর্ণিত,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إنِّى اُحَدِّثُ نَفْسِى بِالشَّيْءِ لَأَنْ يَكُونَ حُمَمَةً أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ أَن ْ يَتَكَلَّمَ بِهِ فَقَالَ النبي صلى الله عليه وسلم الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي رَدَّ أَمْرَهُ إِلَى الْوَسْوَسَةِ
নবী ()এর কাছে একজন লোক আগমণ করে বললআমার মনে কখনো এমন কথার উদয় হয়যা উচ্চারণ করার চেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া আমার কাছে বেশী ভাল মনে হয়। রাসূল () বললেনসমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি এই বিষয়টিকে নিছক একটি মনের ওয়াস্ওয়াসা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
  শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) তাঁর কিতাবুল ঈমানে বলেছেনমুমিন ব্যক্তি শয়তানের প্ররোচনায় কখনো কুফরীর ওয়াস্ওয়াসায় পতিত হয়। এতে তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়। সাহাবীগণ রাসূল ()এর কাছে ব্যক্ত করলেন যেহে আল্লাহর রাসূল! () আমাদের কেউ কেউ তার অন্তরে এমন বিষয় অনুভব করেযা মুখে উচ্চারণ করার চেয়ে আকাশ থেকে জমিনে পড়ে যাওয়াকে অধিক শ্রেয় মনে করে। এটা শুনে রাসূল () বললেনইহা ঈমানের সুস্পষ্ট আলামত। অন্য বর্ণনায় নবী () বলেছেনসমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি শয়তানের কুমন্ত্রণাকে নিছক একটি মনের ওয়াস্ওয়াসা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। মুমিন ব্যক্তি এই ধরণের ওয়াস্ওয়াসাকে অপছন্দ করা সত্বেও তার মনে এর উদয় হওয়া এবং তা প্রতিহত করতে প্রাণপন চেষ্টা করা তার ঈমানদার হওয়ার প্রমাণ বহন করে। যেমন কোন মুজাহিদের সামনে শত্রু এসে উপস্থিত হল। মুজাহিদ শত্রুকে প্রতিহত করল এবং পরাজিত করল। এটি একটি বিরাট জিহাদ। এই জন্যই ইলম অর্জনকারী ও এবাদতে লিপ্ত ব্যক্তিগণ বেশী বেশী ওয়াস্ওয়াসা এবং সন্দেহে পতিত হয়ে থাকে। অথচ অন্যদের এ রকম হয়না। কেননা এরা তো আল্লাহর পথ অনুসরণ করে না। এরা আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত রয়েছে। শয়তানের উদ্দেশ্যও তাই। অপর পক্ষে যারা ইলম অর্জন এবং এবাদতের মাধ্যমে তাদের প্রতিপালকের পথে চলেশয়তান তাদের শত্রু। সে তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে রাখতে চায়।
  প্রশ্নকারীকে আমি বলব যেযখন আপনি বুঝতে পারবেনএটা শয়তানের কুমন্ত্রনাতখন তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হোন। আর জেনে রাখুন যেআপনি যদি তার সাথে সদা-সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত থাকেনতার পিছনে না ছুটেনতাহলে সে আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যেমন নবী () বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ لِي عَنْ أُمَّتِي مَا وَسْوَسَتْ بِهِ صُدُورُهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ أَوْ تَكَلَّمْ     
মালে পরিণত করা অথবা মুখে উচ্চারণ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের মনের ওয়াস্ওয়াসাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
আপনাকে যদি বলা হয় শয়তান মনের ভিতরে ওয়াস্ওয়াসা দেয় তা কি আপনি বিশ্বাস করেনসেটাকে আপনি কি সত্য মনে করেনআপনার মনে আল্লাহ সম্পর্কে যে ধরণের ওয়াস্ওয়াসার উদয় হয়তার ব্যাপারে আপনার ধারণা কি তাইউত্তরে আপনি অবশ্যই বলবেনএ ব্যাপারে আমাদের কথা বলা সম্পূর্ণ অনুচিত। হে আল্লাহ! আপনি পূত-পবিত্র। এটি একটি বিরাট অপবাদ। আপনি অন্তর দিয়ে মনের এ সব ওয়াস্ওয়াসাকে ঘৃণা করবেন এবং জবানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করবেন। আর আপনি এ থেকে দূরে থাকবেন। সুতরাং এগুলো শুধুমাত্র মনের কল্পনা এবং ওয়াস্ওয়াসাযা আপনার অন্তরে প্রবেশ করে থাকে। এটি একটি শয়তানের ফাঁদ। মানুষকে শির্কে লিপ্ত করার জন্যই সে এ ধরণের ফাঁদ পেতে রেখেছে। মানুষকে গোমরাহ করার জন্য শয়তান তাদের শিরা-উপশিরায় চলাচল করে থাকে।
  সামান্য কোন জিনিষের ক্ষেত্রে শয়তান মানুষের মনে কুমন্ত্রনা দেয় না। আপনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জনবসতিপূর্ণ বড় বড় শহরের কথা শ্রবণ করে থাকেন। এসমস্ত শহরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনার অন্তরে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়না। অথবা এ ধরণের সন্দেহ হয়না যেশহরটি বসবাসের উপযোগী নয় অথবা শহরে কোন জন্তমানুষ নেই। এ ক্ষেত্রে সন্দেহ না হওয়ার কারণ হল শয়তানের এতে কোন লাভ নাই। কিন্তু মানুষের ঈমানকে বরবাদ করে দেয়ার ভিতরে শয়তানের বিরাট স্বার্থ রয়েছে। জ্ঞানের আলো এবং হেদায়েতের নূরকে মানুষের অন্তর থেকে নিভিয়ে দেয়ার জন্য ও তাকে সন্দেহ এবং পেরেশানীর অন্ধকার গলিতে নিক্ষেপ করার জন্য শয়তান তার অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী নিয়ে সদা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নবী () শয়তানের ওয়াস্ওয়াসা থেকে বাঁচার উপযুক্ত ঔষধও আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন। এসব ধারণা থেকে বিরত থাকা এবং শয়তানের ধোকা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। মুমিন ব্যক্তি যদি ওয়াস্ওয়াসা থেকে বিরত থেকে আল্লাহর সন'ষ্টি কামনায় এবাদতে লিপ্ত হয়আল্লাহর ইচ্ছায় অন্তর থেকে উহা চলে যাবে। সুতরাং আপনার অন্তরে এ জাতীয় যা কিছু উদয় হয়তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ থাকুন। আপনি তো আল্লাহর ইবাদত করেনতাঁর কাছে দুআ করেন এবং তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা করেন। আপনার অন্তরে যে সমস্ত কুধারণার উদয় হয়তার বর্ণনা যদি অন্যের কাছ থেকে শুনেনতাহলে আপনি তাকে হত্যা করে ফেলতে ইচ্ছা করবেন। তাই যে সমস্ত ওয়াস্ওয়াসা মনের মধ্যে জাগেতার প্রকৃত কোন অস্তিত্ব নেইবরং তা ভিত্তিহীন মনের কল্পনা মাত্র। এমনিভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পবিত্র কাপড় পরিধানকারী কোন ব্যক্তির মনে যদি এমন ওয়াস্ওয়ার জাগ্রত হয় যেহয়তোবা কাপড়টি নাপাক হয়ে গেছেহয়তোবা এ কাপড় পরিধান করে স্বলাত আদায় করলে স্বলাত বিশুদ্ধ হবে নাএমতাবস্থায় সে উক্ত ওয়াস্ওয়াসার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না। উপরোক্ত আলোচনার পর আমার সংক্ষিপ্ত নসীহত এই যেঃ
১)          ওয়াস্ওয়াসার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নবী ()এর আদেশ মোতাবেক ওয়াস্ওয়াসা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে এবং আল্লাহর কাছে শয়তানের প্ররোচনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে।
২)          বেশী করে আল্লাহর যিকির করবে।
৩)          আল্লাহর সন'ষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে অধিক হারে এবাদতে লিপ্ত থাকবে। যখনই বান্দা পরিপূর্ণরূপে এবাদতে মশগুল থাকবেইনশাআল্লাহ এধরণের কুচিন্তা দূর হয়ে যাবে। 
৪)          এই রোগ থেকে আল্লাহর কাছে আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দুআ করবে।
আপনি চাইলে -Whatapps-Facebook-Twitter-ব্লগ- আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking-ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন-মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]-:-admin by rasikul islam নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিটকরুন -এই ওয়েবসাইটে -https://sarolpoth.blogspot.com/(জানা অজানা ইসলামিক জ্ঞান পেতে runing update)< -https://rasikulindia.blogspot.com (ইসলামিক বিশুদ্ধ শুধু বই পেতে, পড়তে ও ডাউনলোড করতে পারবেন). Main Websaite- esoislamerpothe.in , comming soon my best world websaite

Post a Comment

0 Comments