প্রশ্নঃ (১৩) কাফেরের উপর কি ইসলাম গ্রহণ করা ওয়াজিব?
উত্তরঃ প্রত্যেক
কাফেরের উপরই ইসলাম গ্রহণ করা ওয়াজিব। চাই সে কাফের ইয়াহুদী হোক বা খৃষ্টান হোক।
আল্লাহ তাআ’লা কুরআন মজীদে এরশাদ করেন,
)قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِ وَيُمِيتُ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ(
“(হে নবী!) আপনি বলে দিন, হে মানবমন্ডলী! আমি
আকাশ-জমিনের রাজত্বের মালিক আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের সবার নিকট প্রেরিত রাসূল।
তিনি ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নাই। তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দান করেন। সুতরাং
তোমরা সবাই আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাঁর প্রেরিত নিরক্ষর নবীর উপর,
যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহ এবং তাঁর সমস্ত কালামের উপর। তাঁর
অনুসরণ কর যাতে সরল পথপ্রাপ্ত হতে পার।” (সূরা আরাফঃ ১৫৮) সুতরাং রাসূল (ﷺ)এর উপর ঈমান আনয়ন করা সমস্ত
মানুষের উপর ওয়াজিব। তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশেষ অনুগ্রহ করে অমুসলিমদেরকে
মুসলিমদের আইন্তকানুন মেনে মুসলিম দেশে বসবাস করার অনুমতি দিয়েছেন।
)قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنْ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ(
“তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা
আল্লাহ এবং রোজ হাশরের উপর ঈমান রাখে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করে
দিয়েছেন, তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম,
যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া (নিরাপত্তা কর) প্রদান করে।” (সূরা তাওবাঃ ২৯) সহীহ মুসলিম শরীফে বুরায়দা h হতে বর্ণিত আছে, নবী (ﷺ) যখন কোন যুদ্ধে কাউকে আমীর
নির্বাচন করতেন, তখন তাকে আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিতেন। আরো উপদেশ দিতেন সাথীদের সাথে
ভাল ব্যবহার করার। আর বলতেন, তাদের সামনে তিনটি বিষয় পেশ
করবে, তিনটির যে কোন একটি গ্রহণ করলে তাদের সাথে যুদ্ধ
করা থেকে বিরত থাকবে। এই সমস্ত বিষয় সমূহের মধ্যে জিযিয়া গ্রহণ অন্যতম। অনেক আলেম
ইয়াহুদী-খৃষ্টান ছাড়াও অন্যান্য কাফের-মুশরেকদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ বৈধ
বলেছেন।
মোটকথা অমুসলিমদের উপর আবশ্যক
হল, হয় তারা ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা ইসলামী শরীয়তের কাছে
নতি স্বীকার করে কর দিয়ে ইসলামী শাসনের অধীনে বসবাস করবে।
উত্তরঃ যে ব্যক্তি ইলমে
গায়েব দাবী করবে সে কাফের। কেননা সে আল্লাহ তাআ’লাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ(
“হে নবী আপনি বলে দিন! আকাশ এবং জমিনে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েবের
সংবাদ জানে না এবং তারা জানে না যে, কখন পুনরুত্থিত হবে।” (সূরা নামলঃ ৬৫) যেহেতু আল্লাহ তাঁর নবীকে এই
মর্মে ঘোষণা করার আদেশ দিয়েছেন, আকাশ-জমিনে আল্লাহ ছাড়া গায়েবের খবর আর কেউ জানে না, এরপরও যে ব্যক্তি গায়েবের খবর জানার দাবী করবে, সে আল্লাহকে এই ব্যাপারে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করল। যারা ইলমে গায়েবের
দাবী করে, তাদেরকে আমরা বলব, তোমরা
কিভাবে এটা দাবী কর অথচ রাসূল (ﷺ) তা জানতেন না। তোমরা বেশী
মর্যাদাবান না রাসূল (ﷺ)? যদি তারা বলে আমরা রাসূল (ﷺ) হতে বেশী মর্যাদাবান, তাহলে তারা এ কথার কারণে কাফের
হয়ে যাবে। আর যদি বলে রাসূল (ﷺ) বেশী মর্যাদাবান, তাহলে আমরা বলব কেন তিনি
গায়েবের সংবাদ জানেন না? অথচ তোমরা তা জান বলে দাবী করছ?
আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنْ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ فَإِنَّهُ يَسْلُكُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ رَصَدًا( “তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে
সম্যকভাবে পরিজ্ঞাত। তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না- তাঁর মনোনীত
রাসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন।” (সূরা জিনঃ ২৬-২৭) ইলমে গায়েবের দাবীদারদের
কাফের হওয়ার এটি দ্বিতীয় দলীল। আল্লাহ তাআ’লা তাঁর নবীকে মানুষের জন্য ঘোষণা করতে বলেন যে,
)قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ(
“আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলিনা যে, আমার কাছে
আল্লাহর ভান্ডার আছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য জগতের বিষয় অবগতও নই। আমি এমনও বলিনা যে,
আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওয়াহ্য়ীর অনুসরণ করি, যা আমার নিকট প্রেরণ করা হয়।” (সূরা আনআ’মঃ ৫০)
মাতৃগর্ভে
কি আছে তা আল্লাহই ভাল জানেনঃ
প্রশ্নঃ (১৫) বর্তমান কালের ডাক্তারগণ মাতৃগর্ভে পুত্র সন্তান আছে না কন্যা
সন্তান বলে দিতে পারে। আর কুরআনে আছে,وَ يَعْلَمُ مَا فِىْ الأَرْحَامِ অর্থঃ “মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহই জানেন।” ইবনে
জারীর মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, একজন লোক নবী (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা করল, আমার স্ত্রী কি সন্তান প্রসব করবে? তখন উক্ত আয়াত নাযিল হয়। কাতাদা থেকেও অনুরূপ তাফসীর বর্ণিত আছে।
আল্লাহর বাণী, مَا فِىْ الأَرْحَامِ “গর্ভে যা আছে” এ কথাটি ব্যাপক। এ ব্যাপকতা
ভঙ্গকারী বিশেষ কোন দলীল আছে কি? অর্থাৎ কোন অবস্থাতে
আল্লাহ ছাড়া অন্যরাও কি মাতৃগর্ভের অবস্থা সম্পর্কে খবর রাখতে পারে?
উত্তরঃ উপরের প্রশ্নের
উত্তর দেয়ার আগে আমি বলতে চাই যে, কুরআনের কোন আয়াত কখনই বাস্তব সত্য কোন ঘটনার বিরোধী হতে পারে না। যদিও
কখনো কোন ব্যাপারে প্রকাশ্যভাবে এরকম কিছু দেখা যায়, তবে
হয়তো এটা হবে নিছক অবাস্তব দাবী অথবা কুরআনের আয়াতটি সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নয়।
কেননা কুরআনের প্রকাশ্য আয়াত এবং প্রকৃত বাস্তব ঘটনা উভয়টিই অকাট্য। দু’টি অকাট্য বিষয়ের মধ্যে কখনো বিরোধ হতে পারে না।
প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়টি সত্য
হয়ে থাকলে বলব যে, অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে তারা এখন
জানতে পেরেছে যে, মাতৃগর্ভে কি আছে। বর্তমানে ডাক্তারগণ
ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তান হওয়া সম্পর্কে যে আগাম খবর প্রদান করে, তা যদি মিথ্যা হয় তাহলে কোন কথা নেই। আর যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলেও
আয়াতের সাথে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আয়াতটি গায়েবী বিষয় সংক্রান্ত। এখানে পাঁচটি বিষয়
উল্লেখ করা হয়েছে যা আল্লাহর জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত। তম্মধ্যে মাতৃগর্ভে কি আছে তা
একটি। শিশু মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় গায়েবী বিষয়গুলো হল সে কত দিন মায়ের পেটে থাকবে,
কত দিন দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে, কি রকম আ‘মাল করবে, সে কতটুকু রিজিক গ্রহণ করবে,
সৌভাগ্যবান হবে না দুর্ভাগ্যবান হবে। গঠন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে
ছেলে না মেয়ে হবে এ সম্পর্কে অবগত হওয়া। আর গঠন পূর্ণ হওয়ার পরে মাতৃগর্ভে ছেলে না
মেয়ে এ সম্পর্কে অবগত হওয়া ইলমে গায়েবের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা গঠন পূর্ণ হওয়ার
মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বিষয়ের জ্ঞানের মতই হয়ে গেল। তবে শিশুটি তিনটি অন্ধকারের ভিতরে
লুকায়িত অবস্থায় রয়েছে। যদি অন্ধকারের আবরণগুলো অপসারণ করা হয়, তাহলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ইহা অসম্ভব নয় যে, আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে এমন শক্তিশালী যন্ত্র রয়েছে, যা এই তিনটি অন্ধকার ভেদ করতে সক্ষম। যাতে করে শিশুটি ছেলে না মেয়ে,
তা জানা যায়। আর আয়াতে মাতৃগর্ভে ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তান
হওয়ার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে- একথা বলা হয়নি। হাদীছেও এই মর্মে কোন সুস্পষ্ট
ইঙ্গিত নেই।
আয়াতের শানে নুযুলের ক্ষেত্রে
মুজাহিদ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা মুনকাতে। কারণ তিনি
তাবেয়ীদের অন্তর্ভুক্ত।
কাতাদার তাফসীরের অর্থ এই যে,
গঠন হওয়ার পূর্বে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না যে, ছেলে হবে না মেয়ে হবে। গঠন পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ ব্যতীত অন্যরাও জানতে
পারে। ইবনে কাছীর সূরা লুকমানের আয়াতের তাফসীরে বলেন, মাতৃগর্ভে
যা আছে তা দিয়ে আল্লাহ তাআ’লা কি সৃষ্টি করতে চান,
তিনি ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। কিন্তু যখন ছেলে বা মেয়ে হওয়ার
কিংবা সৌভাগ্যবান বা দুর্ভাগ্যবান হওয়ার আদেশ দিয়ে দেন, তখন
ফেরেশতাগণ এবং অন্যান্য সৃষ্টি জীবেরাও জানে। আল্লাহর বাণী,
) ويعلم مَا فِىْ الأَرْحَامِ(
“মাতৃগর্ভে যা আছে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।” এ
থেকে মানুষ কোন কিছু জানতে পারে কিনা। জানলে তা কিসের মাধ্যমে? এ প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব যে, আয়াতের মাধ্যমে
যদি গঠন প্রণালী পূর্ণ হওয়ার পর ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তান উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বাস্তব উপলব্ধির মাধ্যমে তা নির্ণয় করা সম্ভব। আয়াতের মাধ্যমে
আমরা বুঝি যে, মাতৃগর্ভের ছোট-বড় যাবতীয় অবস্থা আল্লাহ
তাআ’লা বিস্তারিতভাবে অবগত আছেন। মানুষ শুধুমাত্র গঠন
পূর্ণ হওয়ার পর ছেলে না মেয়ে এই একটি মাত্র অবস্থা জানতে পারে। আরো অসংখ্য অবস্থা
এখনও রহস্যময় রয়ে গেছে। উসূলবিদগণ উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন
ও সুন্নাহর ব্যাপকার্থক বিষয়গুলো থেকে কোন জিনিষকে আলাদা করার জন্য কুরআন্তসুন্নাহর
কোন দলীল কিংবা ইজমা বা কিয়াস বা বাস্তব উপলোব্ধি অথবা বিশুদ্ধ বিবেকের দরকার। এ
ব্যাপারে আলেমদের আলোচনা অত্যন্ত পরিস্কার।
আর আয়াতের মাধমে যদি সন্তান
সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ডাক্তারদের
কথা এবং কুরআনের আয়াতের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নাই। ডাক্তাররা সন্তান সৃষ্টি হওয়ার
পূর্বে বলতে পারে না যে, ছেলে হবে না মেয়ে হবে।
আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা যে,
পৃথিবীতে কুরআন্তসুন্নাহর সুস্পষ্ট দলীল বিরোধী কোন বাস্তব ঘটনা
পাওয়া যায়নি। ইসলামের শত্রুরা কিছু কিছু বাস্তব বিষয়ে বাহ্যিকভাবে কুরআন্তসুন্নাহ
বিরোধী ভেবে তাতে আঘাত করেছে। আল্লাহর কিতাব বুঝতে অক্ষম হওয়ার কারণে অথবা তাদের
উদ্দেশ্য অসৎ হওয়ার কারণেই তারা এমনটি করে থাকে। কিন্তু মুসলিম উম্মার আলেমগণ
তাদের এ সমস্ত ভ্রান্ত ধারণার মূলোৎপাটন করে দিয়েছেন।
এব্যাপারে
মানুষেরা তিনভাগে বিভক্তঃ
প্রথম শ্রেণীর লোকেরা কুরআনের
আয়াতের প্রকাশ্য অর্থটিকে গ্রহণ করেছে এবং এর বিপরীতে প্রতিটি বাস্তব সত্য বিষয়কে
গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। অথচ আয়াতটি উক্ত অর্থে সুস্পষ্ট নয়। এতে করে সে নিজের
অক্ষমতার কারণে নিজের উপর কিংবা কুরআনের উপর দোষ টেনে এনেছে।
অন্য একটি দল কুরআনের শিক্ষা থেকে
সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে পার্থিব বিষয়কেই গ্রহণ করার কারণে নাসি-কে পরিণত হয়েছে।
অন্য দিকে মধ্যমপন্থী দলের
লোকেরা কুরআনের শিক্ষাকে গ্রহণ করেছে এবং বাস্তব সত্য বিষয়াবলীকেই সত্য বলে
স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তারা জানে যে, উভয়টিই সত্য। কারণ
কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতগুলো চাক্ষুষ বস্তগুলোর বিরোধী হতে পারে না। তারা দলীল এবং
বিবেক সম্মত বিষয়, উভয়টির উপরই আ‘মাল করে। এর মাধ্যমে তাদের দ্বীন এবং বিবেক উভয়টিই নিরাপদ থাকল।
ঈমানদারগণ যখন সত্যের ব্যাপারে মতবিরোধ করেন, তখন আল্লাহ
তাদেরকে হেদায়েত দান করেন। আল্লাহ যাকে চান সঠিক পথের দিকে পথ প্রদর্শন করেন।
আল্লাহ আমাদেরকে এবং আমাদের
দ্বীনী ভাইদেরকে তাওফীক দান করুন এবং সঠিক পথপ্রাপ্ত এবং সঠিক পথের দিকে আহবানকারী
ও উম্মতের জন্য সংশোধনকারী নেতা হিসাবে নির্ধারণ করুন। আমি আল্লাহর কাছে তাওফীক
চাই, তারই উপর ভরসা করি এবং তারই দিকে ফিরে যাব।
প্রশ্নঃ
(১৬) সূর্য কি পৃথিবীর চার দিকে ঘুরে?
উত্তরঃ মান্যবর শায়খ
উত্তরে বলেন যে, শরীয়তের প্রকাশ্য দলীলগুলো প্রমাণ করে যে, সূর্যই
পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরে। এই ঘুরার কারণেই পৃথিবীতে দিবা-রাত্রির আগমণ ঘটে। আমাদের
হাতে এই দলীলগুলোর চেয়ে বেশী শক্তিশালী এমন কোন দলীল নাই, যার মাধ্যমে আমরা সূর্য ঘূরার দলীলগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারি। সূর্য
ঘুরার দলীলগুলো হলঃ আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنْ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنْ الْمَغْرِبِ(
“আল্লাহ তাআ’লা সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত
করেন। তুমি পারলে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর।” (সূরা বাকারাঃ ২৫৮) সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠার
মাধ্যমে প্রকাশ্য দলীল পাওয়া যায় যে, সূর্য পৃথিবীর উপর পরিভ্রমণ করে।
২) আল্লাহ বলেনঃ
فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَاقَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ “অতঃপর যখন সূর্যকে চকচকে অবস্থায় উঠতে দেখলেন তখন
বললেনঃ এটি আমার পালনকর্তা, এটি বৃহত্তর। অতপর যখন তা
ডুবে গেল, তখন বলল হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়ে
শরীক কর আমি ওসব থেকে মুক্ত।” (সূরা আনআ’মঃ ৭৮) এখানে নির্ধারণ হয়ে গেল যে, সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায়। একথা
বলা হয়নি যে, সূর্য থেকে পৃথিবী ডুবে গেল। পৃথিবী যদি
ঘূরত তাহলে অবশ্যই তা বলা হত।
৩) আল্লাহ বলেনঃ
)وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَتْ تَتَزَاوَرُ عَنْ كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَتْ تَقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ(
“তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বাম দিকে চলে যায়।” (সূরা কাহাফঃ ১৭) পাশ কেটে ডান দিকে বা বাম
দিকে চলে যাওয়া প্রমাণ করে যে, নড়াচড়া সূর্য থেকেই হয়ে থাকে। পৃথিবী যদিনড়াচড়া করত তাহলে অবশ্যই বলতেন
সূর্য থেকে গুহা পাশ কেটে যায়। উদয় হওয়া এবং অস্ত যাওয়াকে সূর্যের দিকে সম্পৃক্ত
করা হয়েছে। এটা থেকে বুঝা যায় যে, সূর্যই ঘুরে। পৃথিবী
নয়।
৪) আল্লাহ বলেনঃ
)وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ(
“এবং তিনিই দিবা-নিশি এবং চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করেছেন। সবাই আপন আপন
কক্ষ পথে বিচরণ করে।” (সূরা আমবীয়াঃ ৩৩) ইবনে আব্বাস বলেন, লাটিম যেমন তার কেন্দ্র বিন্দুর চার দিকে ঘুরতে থাকে, সূর্যও তেমনিভাবে ঘুরে।
৫) আল্লাহ বলেনঃ
)يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا(
“তিনি রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিনের মাধ্যমে, দিন
দৌড়ে দৌড়ে রাতের পিছনে আসে।” (সূরা আ’রাফঃ ৫৪) আয়াতে রাতকে দিনের
অনুসন্ধানকারী বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনুসন্ধানকারী পিছনে পিছনে দ্রুত অনুসন্ধান
করে থাকে। এটা জানা কথা যে, দিবা-রাত্রি সূর্যের অনুসারী।
৬) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ يُكَوِّرُ اللَّيْلَ عَلَى النَّهَارِ وَيُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَى اللَّيْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى أَلَا هُوَ الْعَزِيزُ الْغَفَّار(
অর্থঃ
“তিনি
আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন
এবং দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিযুক্ত
করেছেন। প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত। জেনে রাখুন, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” (সূরা যুমারঃ ৫) আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে
পারলাম যে, পৃথিবীর
উপরে দিবা-রাত্রি চলমান রয়েছে। পৃথিবী যদি ঘুরতো তাহলে তিনি বলতেন, দিবা-রাত্রির উপর পৃথিবীকে ঘূরান। আল্লাহ তাআ’লা
বলেন, “সূর্য এবং চন্দ্রের প্রত্যেকেই চলমান”। এই সমস্ত দলীলের মাধ্যমে জানা গেল যে, সুস্পষ্টভাবেই
সূর্য ও চন্দ্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করছে। এ কথা সুস্পষ্ট যে, চলমান বস্তকে বশীভুত করা এবং কাজে লাগানো একস্থানে অবস্থানকারী বস্তকে
কাজে লাগানোর চেয়ে অধিক যুক্তিসঙ্গত।
৭) আল্লাহ বলেনঃ
)وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا وَالْقَمَرِ إِذَا تَلَاهَا(
“শপথ সূর্যের ও তার কিরণের, শপথ চন্দ্রের যখন
তা সূর্যের পশ্চাতে আসে।” (সূরা আশ্শামসঃ ১-২) এখানে বলা হয়েছে যে, চন্দ্র সূর্যের পরে আসে। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সূর্য এবং চন্দ্র চলাচল করে এবং পৃথিবীর উপর ঘুরে। পৃথিবী যদি চন্দ্র
বা সূর্যের চার দিকে ঘুরত, তাহলে চন্দ্র সূর্যকে অনুসরণ
করতনা। বরং চন্দ্র একবার সূর্যকে, আর একবার সূর্য
চন্দ্রকে অনুসরণ করত। কেননা সূর্য চন্দ্রের অনেক উপরে। এই আয়াত দিয়ে পৃথিবী স্থির
থাকার ব্যাপারে দলীল গ্রহণ করার ভিতরে চিন্তা-ভাবনার বিষয় রয়েছে।
৮) মহান আল্লাহ বলেনঃ
)وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ, وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ,لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ(
“সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নির্ধারণ। চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত
করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্যের পক্ষে চন্দ্রকে
নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। রাতের পক্ষেও দিনের অগ্রবতী হওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই আপন
আপন কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।” (সূরা ইয়াসীনঃ ৩৮-৪০) সূর্যের চলা এবং এই চলাকে
মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর নির্ধারণ বলে ব্যাখ্যা করা এটাই প্রমাণ করে যে, সূর্য প্রকৃতভাবেই চলমান। আর
এই চলাচলের কারণেই দিবা-রাত্রি এবং ঋতুর পরিবর্তন হয়। চন্দ্রের জন্য মনযিল
নির্ধারণ করার অর্থ এই যে, সে তার মনযিলসমূহে স্থানান্তরিত
হয়। যদি পৃথিবী ঘুরত, তাহলে পৃথিবীর জন্য মনযিল নির্ধারণ
করা হত। চন্দ্রের জন্য নয়। সূর্য কর্তৃক চন্দ্রকে ধরতে না পারা এবং দিনের অগ্রে
রাত থাকা সূর্য, চন্দ্র, দিন এবং
রাতের চলাচলের প্রমাণ বহন করে।
৯) নবী (ﷺ) সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় আবু
যরকে বলেছেনঃ
أَتَدْرِي أَيْنَ تَذْهَبُ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ فَتَسْتَأْذِنَ فَيُؤْذَنُ لَهَا وَيُوشِكُ أَنْ تَسْجُدَ فَلَا يُقْبَلَ مِنْهَا وَتَسْتَأْذِنَ فَلَا يُؤْذَنَ لَهَا يُقَالُ لَهَا ارْجِعِي مِنْ حَيْثُ جِئْتِ فَتَطْلُعُ مِنْ مَغْرِبِهَا
“হে আবু যর! তুমি কি জান সূর্য যখন অস্ত যায় তখন কোথায় যায়? আবু যার বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল
জানেন। রাসূল (ﷺ) বললেন, সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় আরশের
নীচে গিয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং পুনরায় উদিত হওয়ার অনুমতি চায়। অতঃপর তাকে অনুমতি
দেয়া হয়। সে দিন বেশী দূরে নয়, যে দিন অনুমতি চাবে কিন্তু
তাকে অনুমতি দেয়া হবে না। তাকে বলা হবে যেখান থেকে এসেছ, সেখানে
ফেরত যাও। অতঃপর সূর্য পশ্চিম দিক থেকেই উদিত হবে।” এটি
হবে কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে। আল্লাহ সূর্যকে বলবেন, যেখান
থেকে এসেছ সেখানে ফেরত যাও, অতঃপর সূর্য পশ্চিম দিক থেকে
উদিত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সূর্য
পৃথিবীর উপরে ঘুরছে এবং তার এই ঘুরার মাধ্যমেই উদয়-অস্ত সংঘটিত হচ্ছে।
১০) অসংখ্য হাদীছের মাধ্যমে জানা
যায় যে, উদয় হওয়া,
অস্ত যাওয়া এবং ঢলে যাওয়া এই কাজগুলো সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত।
এগুলো সূর্য থেকে প্রকাশিত হওয়া খুবই সুস্পষ্ট। পৃথিবী হতে নয়।
হয়তো এ ব্যাপারে আরো
দলীল-প্রমাণ রয়েছে। সেগুলো আমার এই মুহূর্তে মনে আসছেনা। তবে আমি যা উল্লেখ করলাম,
এই বিষয়টির দ্বার উম্মুক্ত করবে এবং আমি যা উদ্দেশ্য করেছি,
তা পূরণে যথেষ্ট হবে। আল্লাহর তাওফীক চাচ্ছি!
প্রশ্নঃ (১৭) আল্লাহকে এক বলে সাক্ষ্য দেয়া এবং মুহাম্মদ (ﷺ) কে আল্লাহর রাসূল হিসাবে সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ কি?
উত্তরঃ আল্লাহ ছাড়া
সত্য কোন মা’বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল এ কথার ঘোষণা
দেয়া ইসলামে প্রবেশের চাবিকাঠি স্বরূপ। এই সাক্ষ্য দেয়া ব্যতীত ইসলামে প্রবেশ করা
সম্ভব নয়। এই জন্যই রাসূল (ﷺ) মুয়া’য hকে ইয়ামান দেশে পাঠানোর সময় আদেশ দিয়েছিলেন যে, তুমি সর্বপ্রথম এই কথার
সাক্ষ্য দেয়ার আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা’বূদ নাই। এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল।
প্রথম বাক্যটি অর্থাৎ “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ
ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই। সেই সাথে মুখে এই কালেমাটির উচ্চারণ করবে।
যার দাসত্ব ও উপাসনা করা হয় তার
নাম ইলাহ। (لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّهُ) “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এই বাক্যটির দু’টি অংশ। একটি ‘না’ বাচক
অংশ অপরটি ‘হ্যাঁ’ বাচক অংশ। “লা-ইলাহা” কথাটি ‘না’
বাচক। এবং “ইল্লাল্লাহ” কথাটি ‘হ্যাঁ’ বাচক।
প্রথমে সমস্ত বাতিল মা’বূদের জন্য কৃত সকল প্রকার ইবাদতকে
অস্বীকার করে দ্বিতীয় বাক্যে তা একমাত্র হক্ক মা’বূদ
আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে।
“লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই।’ যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, আপনি কিভাবে বললেন আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই?
অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাস্তবে
আল্লাহ ব্যতীত অসংখ্য মা’বূদের উপাসনা করা হচ্ছে। আল্লাহ
ব্যতীত যাদের ইবাদত করা হচ্ছে আল্লাহও তাদেরকে মা’বূদ
হিসাবে নাম রেখেছেন। আল্লাহ বলেন,
)فَمَا أَغْنَتْ عَنْهُمْ ءَالِهَتُهُمْ الَّتِى يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ لَمَّا جَاء أمْرُ رَبِّكَ(
“আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যেসব মা’বূদকে ডাকত,
আপনার পালনকর্তার হুকুম যখন এসে পড়বে, তখন
কেউ কোন কাজে আসবেনা।” (সূরা হুদঃ ১০১) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَ لاَ تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا ءَاخَرَ(
“আল্লাহর সাথে অন্য কোন মা’বূদ স্থির করবেন না”। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৩৯) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ(
“আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে মা’বূদ ডেকো না।” (সূরা কাসাসঃ ৮৮) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
) لَنْ نَدْعُوَ مِنْ دُونِهِ إِلَهًا(
“আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মা’বূদকে আমরা কখনই
আহবান করব না।” (সূরা কাহ্ফঃ ১৪)
এখন আমরা কিভাবে বলতে পারি যে,
আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। অথচ দেখা
যাচ্ছে গাইরুল্লাহর জন্য উলুহিয়্যাত উল্লেখ করা হয়েছে। আর আমরাই বা কিভাবে
গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত সাব্যস্ত করতে পারি? অথচ রাসূলগণ
তাদের সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বলেছেন,
)اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ(
“তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন মা’বূদ নাই।” (সূরা আরাফঃ ৫৯)
উপরোক্ত সমস্যার উত্তর এই যে,
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বাক্যটির মধ্যে
ইলাহা কথাটির পরে হাক্কুন শব্দ উহ্য রয়েছে। আসলে বাক্যটি এ রকম হবে, (لا اله حق الا الله) (লা-ইলাহা হাক্কুন ইল্লাল্লাহ) হাক্কুন শব্দটি উহ্য মানলেই সমস্যা দূর
হয়ে যাবে। তাই আমরা বলব আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়, তারাও
মা’বূদ কিন্তু এগুলো বাতিল মা’বূদ।
ইবাদত বা দাসত্ব পাওয়ার তাদের কোন অধিকার নাই। এ কথার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,
)ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ(
“এটাই প্রমাণিত যে, আল্লাহ-ই সত্য এবং আল্লাহ
ব্যতীত তারা যাদের উপাসনা করে তারা সবাই মিথ্যা। আল্লাহ সর্বোচ্চ সুমহান।” (লুকমানঃ ৩০) আল্লাহ আরো বলেনঃ
]أَفَرَأَيْتُمْ اللَّاتَ وَالْعُزَّى, وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى, أَلَكُمْ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنثَى, تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيزَى, إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ(
অর্থঃ
“তোমরা কি
ভেবে দেখেছ লাত ও ওয্যা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে? পুত্র সন্তান কি তোমাদের জন্য এবং কন্যা সন্তান আল্লাহর জন্যে? এমতাবস্থায় এটা তো হবে খুবই অসংগত বন্টন। এগুলো কতগুলো নাম ছাড়া অন্য
কিছু নয়, যা তোমরা নিজেরা রেখেছ এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষেরা
রেখেছে। এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলীল নাযিল করেন নি।” (সূরা নাজ্মঃ ১৯-২৩) আল্লাহ তাআ’লা কুরআনে ইউসুফ (আঃ) এর কথা
উল্লেখ করে বলেন,
)مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ(
“তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা নাম করণ করে নিয়েছো। আল্লাহ এদের
পক্ষে কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি।” (সূরা ইউসুফঃ ৪০) সুতরাং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ
অর্থ আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই। তিনি ব্যতীত অন্যান্য মা’বূদগুলো সত্য মা’বূদ নয়। বরং তা বাতিল উপাস্য।
মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল এ কথার
সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ এই যে, অন্তরে বিশ্বাস এবং মুখে এই কথার স্বীকৃতি প্রদান করা যে, মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ সমস্ত জিন ও মানুষের জন্য রাসূল হিসাবে
প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِ وَيُمِيتُ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ(
“হে মুহাম্মাদ (ﷺ) আপনি বলে দিন যে, হে মানব মন্ডলী তোমাদের সবার
প্রতি আমি আল্লাহ প্রেরিত রাসূল, সমগ্র আসমান ও জমিনের
রাজত তাঁর। একমাত্র তাঁকে ছাড়া আর কারো উপাসনা নয়। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন।
সুতরাং তোমরা সবাই বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহর উপর, তার
প্রেরিত উম্মী নবীর উপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহর উপর
এবং তাঁর সমস্ত কালামের উপর। তাঁর অনুসরণ কর, যাতে তোমরা
সরল পথ পেতে পার।” (সূরা আরাফঃ ১৫৮) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا(
“পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর
বান্দার প্রতি ফায়সালার গ্রন' অবতীর্ণ করেছেন যাতে তিনি
বিশ্ব জগতের জন্যে সতর্ককারী হতে পারেন।” (সূরা ফুরকানঃ ১) মুহাম্মাদ (ﷺ)কে রাসূল হিসাবে সাক্ষ্য
দেয়ার অর্থ হলঃ
(১) তিনি যে বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করা,
(২) তাঁর আদেশ মান্য করা,
(৩) তিনি যে বিষয় নিষেধ করেছেন, তা থেকে দূরে থাকা
(৪) তাঁর নির্দেশিত শরীয়ত
অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদত করা।
(৫) তাঁর শরীয়তে নতুন কোন বিদ্আত
সৃষ্টি না করা।
এই বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়ার অন্যতম
দাবী হল সৃষ্টি বা পরিচালনায় এবং প্রভুত্বে কিংবা এবাদতে রাসূল (ﷺ)এর কোন অধিকার নাই। বরং তিনি
আবদ্বা আল্লাহর দাস ও বান্দা। মা’বূদ নন। তিনি সত্য রাসূল। তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যাবে না। তিনি
নিজের জন্য কিংবা অপরের জন্য কল্যাণ-অকল্যাণের কোন ক্ষমতা রাখেন না। মানুষের
কল্যাণ-অকল্যাণের একমাত্র মালিক আল্লাহ। আল্লাহ তাআ’লা
বলেনঃ
)قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ(
“আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার
কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমনও বলি না যে,
আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওয়াহ্য়ীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে।” (সূরা আনআ’মঃ ৫০) সুতরাং তিনি একজন আদেশ
প্রাপ্ত বান্দা মাত্র। তাঁর প্রতি যা আদেশ করা হয় তিনি কেবল মাত্র তারই অনুসরণ করে
থাকেন। আল্লাহ বলেনঃ
)قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا قُلْ إِنِّي لَنْ يُجِيرَنِي مِنْ اللَّهِ أَحَدٌ وَلَنْ أَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا(
“বলুনঃ আমি তোমাদের ক্ষতি সাধন করার ও সুপথে আনয়ন করার মালিক নই। বলুনঃ
আল্লাহ তাআ’লার কবল থেকে আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
এবং তিনি ব্যতীত আমি আশ্্রয় স্থল পাবনা।” (সূরা জিনঃ ২১-২২) আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেনঃ
)قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنْ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِي السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ(
“আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের
এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই। কিন্তু আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েবের খবর জেনে
নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে
আমার কখনো কোন অমঙ্গল হতনা। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক এবং সুসংবাদদাতা
ঈমানদারদের জন্য।” (সূরা আরা‘ফঃ ১৮৮) এটাই হল
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ এর প্রকৃত অর্থ।
হে পাঠক! এই অর্থের মাধ্যমেই
আপনি জানতে পারলেন যে, রাসূল (ﷺ) বা অন্য কোন মাখলুক এবাদতের
অধিকারী নয়। এবাদতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআ’লা। তিনি বলেনঃ
)قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَاي وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ(
“আপনি বলুনঃ আমার স্বলাত, আমার কোরবানী এবং
আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি তাই
আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল মুসলিম।” (সূরা আন্আমঃ ১৬২-১৬৩) নবী (ﷺ)কে আল্লাহ তাআ’লা যে সম্মান দান করেছেন,
তাতে অধিষ্ঠিত করাই নবী (ﷺ)এর জন্য যথেষ্ট। তিনি
আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। মর্যাদাবান হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তাঁর উপর আল্লাহর
পক্ষ হতে সীমাহীন শান্তির ধারা বর্ষিত হোক।
উত্তরঃ “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এই পবিত্র বাক্যটি
তাওহীদের সকল প্রকারকে অন্তর্ভুক্ত করে। কখনো প্রকাশ্যভাবে আবার কখনো
অপ্রকাশ্যভাবে। লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ বলার সাথে সাথে বাহ্যিকভাবে তাওহীদে
উলুহিয়্যাতকেই বুঝায়। তবে তা তাওহীদে রুবুবিয়্যাতকেও শামীল করে। কেননা যারা
আল্লাহর ইবাদত করে তারা আল্লাহর রুবুবিয়াতকে স্বীকার করে বলেই তা করে থাকে।
এমনিভাবে তাওহীদে আসমা ওয়াস্সিফাতকেও অন্তর্ভুক্ত করে। কারণ যার কোন ভাল নাম ও
গুণাবলী নাই মানুষ কখনই তার ইবাদত করতে রাজি হবে না। এই জন্যই ইবরাহীম (আঃ) তাঁর
পিতাকে বলেছেনঃ
)يَاأَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا(
“হে আমার পিতা! যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার
কোন উপকারে আসেনা, তার ইবাদত কেন কর?” (সূরা মারইয়ামঃ ৪২) সুতরাং তাওহীদে উলুহিয়াতের
স্বীকৃতি তাওহীদে রুবুবিয়াত ও তাওহীদে আসমা ওয়াস্সিফাতকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
উত্তরঃ উক্ত প্রশ্নের
উত্তর দেয়ার পূর্বে আল্লাহর সৃষ্টির সাধারণ নিয়ম এবং আল্লাহর শরীয়ত সম্পর্কে
আলোচনা করতে চাই। আল্লাহর সৃষ্টির নিয়মটি বিধৃত হয়েছে আল্লাহর নিম্মোক্ত বাণীসমূহে
)وَهُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ(
“তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তাহরীমঃ ২) আল্লাহর বাণী,
)إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا(
“নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসাঃ ২৪) এছাড়া আরো অসংখ্য
দলীল-প্রমাণ রয়েছে। এগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন এবং যার আদেশ প্রদান করেন তাতে
তিনি মহা কৌশলী। তিনি যাই সৃষ্টি করেন না কেন, তার পিছনে
রয়েছে এক বিরাট উদ্দেশ্য। তিনি আমাদের জন্য যে শরীয়ত দিয়েছেন, তার ভিতরেও রয়েছে এক বিরাট হিকমত। চাই কোন বস্ত ওয়াজিব করার ভিতরে হোক
কিংবা হারাম করার ভিতরে হোক। অথবা বৈধ করার মাঝেই হোক না কেন। এই হিকমত আমরা কখনো
জানতে পারি আবার কখনো জানতে পারিনা। আল্লাহ প্রদত্ব জ্ঞানের মাধ্যমে কখনো কিছু লোকে
জানে আবার অনেকে জানেই না। তাই আমরা বলব যে, আল্লাহ তাআ’লা জিন এবং মানুষকে এক বিরাট উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। তা হল একমাত্র
আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ বলেনঃ
) وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ(
“আমি জিন এবং মানুষকে আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ(
“তোমরা কি ধারণা করেছ যে, আমি তোমাদেরকে এমনিই
সৃষ্টি করেছি? আর তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না?” (সূরা মুমিনূনঃ ১১৫) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَنْ يُتْرَكَ سُدًى(
“মানুষ কি ধারণা করে যে, তাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে
দেয়া হবে?” (সূরা কিয়ামাহঃ ৩৬) এছাড়া আরো অনেক আয়াত প্রমাণ
করে যে, জিন্তইনসানের
সৃষ্টিতে আল্লাহ তাআ’লার এক মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হল
আল্লাহর ইবাদত করা। ভালবাসা ও সম্মানের সাথে আল্লাহর আদেশ সমূহ বাস্তবায়ন করা এবং
নিষেধ সমূহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হওয়ার নাম ইবাদত। আল্লাহ
তাআ’লা বলেনঃ
]وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ[
“তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা
খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করবে।” (সূরা বাইয়িনাহঃ ৫) এই হল মানুষ সৃষ্টির
উদ্দেশ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করতে অহংকার করবে, সে ব্যক্তি এই হিকমত প্রত্যাখ্যানকারী
হিসাবে গণ্য হবে। যার জন্য আল্লাহ তাআ’লা মানুষ সৃষ্টি
করেছেন। সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা না করলে কি হবে তাদের কর্মসমূহ প্রমাণ বহন করে যে,
আল্লাহ যেন তাদেরকে অযথা সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর কাছে দু’আ কবূল হওয়ার শর্তঃ
প্রশ্নঃ (২০) কিছু কিছু মানুষ আল্লাহর কাছে দু’আ করে থাকে। কিন্তু দু’আ কবূল হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। অথচ আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন, “তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব”। তাহলে মানুষ
কিভাবে আল্লাহর কাছে দু’আ করলে তা কবূল হবে?
উত্তরঃ বিশ্ব প্রতিপালক
আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা। দরূদ ও সালাম পেশ করছি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার এবং সকল সাহাবীর
উপর। মুসলিম ভাইদের জন্য আল্লাহর কাছে আকীদাহ ও আ‘মালের
ক্ষেত্রে সঠিক পথের তাওফীক প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তাআ’লা
বলেন,
)وَقَالَ رَبُّكُمْ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ(
তোমাদের
পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার
এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে। (সূরা গাফেরঃ ৬০) প্রশ্নকারী বলেছেন যে, তিনি আল্লাহর কাছে দু’আ করে থাকেন। অথচ আল্লাহ তার দু’আ কবূল করেন
না। ফলে তার কাছে এই অবস্থা কঠিন বলে মনে হয়। বিশেষ করে আল্লাহ তো ওয়াদা করেছেন,
যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দু’আ করে,
আল্লাহ তার দু’আ কবূল করেন। আল্লাহ কখনই
ওয়াদা খেলাফ করেন না। উক্ত প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব যে, দু’আ কবূলের জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। তা সর্ববস্থায় দু’আর ক্ষেত্রে বর্তমান থাকতে হবে।
প্রথম শর্তঃ একাগ্রচিত্তে আল্লাহর কাছে দু’আ করা। অন্তরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে, এই বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর কাছে দু’আ করা যে,
আল্লাহ কবূল করতে সক্ষম। দু’আ করার সময়
এই আশা রাখবে যে, আল্লাহ তা কবূল করবেন।
দ্বিতীয় শর্তঃ দু’আ করার
সময় এই কথা অনুভব করবে যে, দু’আ
কবূলের দিকে সে খুবই মুখাপেক্ষী। শুধু তাই নয় বরং এ কথাও অনুভব করবে যে, একমাত্র আল্লাহই বিপদগ্রস্ত ফরিয়াদকারীর ফরিয়াদ শ্রবণ করেন এবং তিনিই
বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। যদি এ কথা অনুভব করে যে, সে
আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী নয় এবং আল্লাহর কাছে তার কোন প্রয়োজনও নেই; বরং দু’আ করাটা যেন একটা অভ্যাসমাত্র তাহলে এ
ধরণের দু’আ কবূল না হওয়ারই উপযোগী।
তৃতীয় শর্তঃ হারাম খাওয়া থেকে দূরে থাকবে। কারণ বান্দা এবং তার দু’আ কবূল হওয়ার মধ্যে হারাম রুযী
প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। ছহীহ হাদীছে প্রমাণিত আছে যে, নবী(ﷺ) বলেছেনঃ
أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ ( يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ )وَقَالَ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ )ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ
“নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্র ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ
করেন না। আল্লাহ তাআ’লা রাসূলদের (আঃ) প্রতি যা নির্দেশ
দিয়েছেন, মুমিনদের প্রতিও তাই নির্দেশ দিয়েছেন।” তিনি বলেনঃ
)ياَ أيُّهاَ الرُّسُلُ كُلُوْا مِنْ الطَّيِّباَتِ واعْمَلُوْا صاَلِحا(ً
“হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত থেকে আহার্য গ্রহণ কর এবং সৎ কর্ম কর।” (সুরা মুমিনুনঃ ৫১) আল্লাহ বলেনঃ
)ياَ أيُّهاَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّباَتِ ماَ رَزَقْناَكُمْ (
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত সামগ্রী থেকে আহার গ্রহণ কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।” (সূরা বাকারাঃ ১৭২) অতঃপর রাসূল (ﷺ) সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ
করলেন, যে দীর্ঘ
সফর করে এলায়িত কেশ ও ধুলামিশ্রিত পোশাক নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ডাকতে থাকে হে, প্রতিপালক! হে রব!!
অথচ সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পোশাক-পরিচ্ছদ
হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় কি করে তার দু’আ কবূল হতে পারে ?”
দু’আ
কবূলের সকল মাধ্যম অবলম্বন করা সত্বেও নবী (ﷺ) এ লোকের দু’আ কবূল হওয়াকে অসম্ভব মনে
করলেন। দু’আ কবূলের কারণগুলো নিম্নরূপঃ
১) আকাশের দিকে হাত উত্তোলন
করা। কেননা আল্লাহ তাআ’লা আকাশে আরশের উপরে। আল্লাহর দিকে হাত উঠানো দু’আ কবূলের অন্যতম কারণ। হাদীছে এসেছে,
)إِنَّ اللَّهَ حَيِيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحْيِي إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا(
“নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত লজ্জাশীল ও সম্মানী। বান্দা যখন তাঁর দিকে দু’হাত উঠিয়ে দু’আ করে, তখন
তিনি হাত দু’টিকে খালি অবস্থায় ফেরত দিতে লজ্জা বোধ করেন।”
২) এই লোকটি আল্লাহর একটি নাম رب)) ‘পালনকর্তা’ উচ্চারণ
করে করে দু’আ করেছে। এই নামের উসীলা গ্রহণ করা দু’আ কবূলের অন্যতম কারণ। কেননা রব্ব অর্থ পালনকর্তা, সমস্ত মাখলুকাতের সৃষ্টিকারী ও পরিচালনাকারী। তাঁর হাতেই আকাশ-জমিনের
চাবি-কাঠি। এ জন্যই আপনি কুরআন মজীদের অধিকাংশ দু’আতেই
দেখতে পাবেন, ‘রব্ব’ বা
পালনকর্তা শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
)رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَى رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ(
“হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহবানকারীকে ঈমানের
প্রতি আহবান করতে যে, তোমাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আন।
তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! অতঃপর আমাদের সকল গুনাহ মাফ কর এবং
আমাদের সকল দোষত্রুটি দূর করে দাও, আর আমাদের মৃত্যু দাও
নেক লোকদের সাথে। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দাও, যা
তুমি ওয়াদা করেছ তোমার রাসূলগণের মাধ্যমে এবং কিয়ামতের দিন তুমি আমাদিগকে অপমানিত
করো না। নিশ্চয় তুমি ওয়াদা খেলাফ করো না। অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দু’আ এই বলে কবূল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোন
পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, সে পুরুষ হোক বা
নারী লোক হোক। তোমরা সকল নারী-পুরুষই সমান।” (সূরা আল-ইমরানঃ ১৯৩-১৯৫) সুতরাং আল্লাহর এই নামের
(রব্ব) মাধ্যমে উসীলা দেয়া দু’আ কবূলের অন্যতম কারণ।
৩) এই লোকটি মুসাফির ছিল। সফর
করাকে অধিকাংশ সময় দু’আ কবূলের কারণ হিসাবে গণ্য করা হয়। কেননা সফর অবস্থায় মানুষ আল্লাহর
প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। স্বদেশে অবস্থানকারীর চেয়ে মুসাফির আল্লাহর অনুগ্রহের
প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। মুসাফির এলোমেলো কেশ বিশিষ্ট ও ময়লাযুক্ত কাপড়
পরিধানকারী হয়। মনে হয় সে নিজের নফসের প্রতি কোন গুরুত্বই দিচ্ছে না। আল্লাহর কাছে
দু’আ করা ব্যতীত তার অন্য কোন উপায় নেই। সফরে থেকে এলোকেশ
বিশিষ্ট হয়ে ও ময়লাযুক্ত পোশাক পরিহিত অবস্থায় দু’আ করা
দু’আ কবূলের পক্ষে খুবই সহায়ক। হাদীছে আছে, আল্লাহ তাআ’লা আরাফার দিন বিকাল বেলা দুনিয়ার
আকাশে নেমে আসেন এবং আরাফাতে অবস্থানকারীদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন,
“প্রতিটি অঞ্চল হতে তারা আমার কাছে এসেছে, ধুলা-মলিন পোষাক নিয়ে এবং এলোকেশ বিশিষ্ট অবস্থায়।
যাই হোক দু’আ কবূলের উপরোক্ত কারণগুলো থাকা সত্বেও কোন কাজ হলো না। কারণ একটাই তার
খাদ্য-পানীয় ছিল হারাম, পোষাক ছিল হারাম এবং হারাম খেয়ে
তার দেহ গঠিত হয়েছে। এ জন্যই নবী (ﷺ) বলেছেন, কি ভাবে তার দু’আ কবূল করা হবে? দু’আ
কবূলের এই শর্তগুলো পাওয়া না গেলে দু’আ কবূলের কোনই
সম্ভাবনা নেই। শর্তগুলো বর্তমান থাকার পরও যদি দু’আ কবূল
না হয়, তাহলে বুঝতে হবে কি কারণে দু’আ কবূল হয়নি, তা আল্লাহই ভাল জানেন। দু’আকারী এ বিষয়ে জানার কোন সুযোগ নাই। দু’আ
কবূলের সকল শর্ত বর্তমান থাকার পরও দু’আ কবূল না হলে হতে
পারে আল্লাহ তার উপর থেকে দু’আ কবূলের চেয়ে বড় কোন মুসিবত
দূর করবেন। অথবা এও হতে পারে যে, কিয়ামতের দিনের জন্য তার
দু’আকে সঞ্চয় করে রাখবেন এবং সেদিন তাকে অধিক পরিমাণে
বিনিময় দান করবেন। কেননা ব্যক্তি দু’আ কবূলের সকল শর্ত
বাস্তবায়ন করে আল্লাহর কাছে দু’আ করার পরও দু’আ কবূল করা হয়নি এবং তার উপর থেকে বড় কোন মুসিবতও দূর করা হয়নি। হয়ত
বান্দা দু’আ কবূলের সকল শর্ত পূরণ করে দু’আ করেছে। কিন্তু দ্বিগুণ পুরস্কার দেয়ার জন্য তার দু’আ কবূল করা হয়নি। একটি পুরস্কার দু’আ করার
কারণে এবং অন্য একটি পুরস্কার মুসীবত দূর না করার কারণে। সুতরাং তার জন্য দু’আ কবূলের চেয়ে মহান জিনিষ তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন সঞ্চয় করে রাখা হবে।
মানুষের উচিৎ হল দু’আর ফলাফলের জন্য তাড়াহুড়া না করা। কেননা তাড়াহুড়া করা দু’আ কবূল না হওয়ার অন্যতম কারণ। হাদীছে এসেছে,
يُسْتَجَابُ لِأَحَدِكُمْ مَا لَمْ يَعْجَلْ قَالُوْا كَيْفَ يَعْجَلُ يَا رَسُولُ اللَّهِ؟ قَالَ يَقُولُ دَعَوْتُ و دَعَوْتُ وَ دَعَوْتُ فَلَمْ يُسْتَجَبْ لِى
“তোমাদের কেউ দু’আয় তাড়াহুড়া না করলে তার দু’আ কবূল হয়ে থাকে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে
তাড়াহুড়া করা হয়ে থাকে? রাসূল (ﷺ) বললেন, বান্দা বলে থাকে কত দু’আ করলাম, কত দু’আ
করলাম, কত দু’আ করলাম, কিন্তু কবূল তো হচ্ছে না।” তাই কারও জন্য দু’আতে তাড়াহুড়া এবং দু’আ করতে করতে ক্লান্তি বোধ
করে দু’আ করা ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়; বরং
বেশী বেশী দু’আ করা উচিৎ। কারণ দু’আ একটি ইবাদত। যা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে এবং প্রতিদান
বৃদ্ধি করবে। কাজেই হে দ্বীনী ভাই! ছোট-বড় এবং কঠিন্তসহজ সকল বিষয়ে আপনাকে বেশী
বেশী দু’আ করার উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দিন।
প্রশ্নঃ
(২১) ইখলাছ অর্থ কি? কোন মানুষ যদি এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন'ষ্টি
ছাড়া অন্য কিছুর নিয়ত করে, তবে তার বিধান কি?
উত্তরঃ বান্দা তার আ‘মালের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ
তাআ’লার নৈকট্য কামনা করবে এবং বেহেশতে পৌঁছার চেষ্টা
করবে।
আর যদি বান্দা তার আ‘মালে অন্য কিছুর নিয়ত করে, তবে তাতে নিম্ন
লিখিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
১) যদি আল্লাহর সন'ষ্টি ছাড়া অন্যের নৈকট্য লাভের
নিয়ত করে এবং এবাদতের মাধ্যমে মানুষের প্রশংসা অর্জনের নিয়ত করে, তাহলে তার আ‘মাল বাতিল হয়ে যাবে। এটা শির্কের
অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে কুদছীতে বর্ণিত আছে, নবী (ﷺ) বলেন, আল্লাহ বলেন,
أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ
“আমি সমস্ত শরীকদের চেয়ে শির্ক থেকে অধিক মুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন
কোন আ‘মাল করল, যাতে সে আমার
সাথে অন্য কোন কাউকে শরীক করল, আমি তাকে এবং সে যা শরীক
করল, তাকে প্রত্যাখ্যান করব।”
২) যদি আ‘মালের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য
লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করে যেমন, নেতৃত্ব লাভ, সম্মান লাভ ইত্যাদি তাহলে তার আ‘মাল বাতিল হয়ে যাবে। এ ধরণের আ‘মাল তাকে
আল্লাহর নৈকট্য দান করবে না। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ أُوْلَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُون(
“যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, হয় আমি তাদের দুনিয়াতেই তাদের আ‘মালের প্রতিফল
ভোগ করিয়ে দেব এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হবে না। এরাই হল সেসব লোক
যাদের জন্য আখেরাতে আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা দুনিয়াতে যা কিছু করেছিল,
সবই বরবাদ করেছে, আর যা কিছু উপার্জন
করেছিল, সবই বিনষ্ট।” (সূরা হুদঃ ১৫-১৬)
প্রথম প্রকার শির্ক এবং এই
প্রকার শির্কের মাঝে পার্থক্য এই যে, প্রথম লোকটি আল্লাহর
ইবাদতকারী হিসেবে মানুষের প্রশংসা অর্জনের নিয়ত করেছে। আর দ্বিতীয় লোকটি আল্লাহর
ইবাদতকারী হিসেবে মানুষের প্রশংসা অর্জনের নিয়ত করেনি। মানুষের প্রশংসার প্রতি তার
কোন ভ্রুক্ষেপও নেই।
৩) আ‘মাল শুরু করার সময় আল্লাহর
নৈকট্য লাভের নিয়ত করেছে। কিন্তু পার্থিব স্বার্থ এমনিতেই চলে আসার সম্ভাবনা থাকে।
যেমন পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে এবাদতের নিয়তের সাথে সাথে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা
অর্জনের নিয়ত করা, স্বলাতের মাধ্যমে শরীর চর্চার নিয়ত করা,
সওমর মাধ্যমে শরীরের ওজন কমানো ও চর্বি দূর করা এবং হজ্জের
মাধ্যমে পবিত্র স্থান এবং হাজীদেরকে দেখার নিয়ত করা। এ রকম করাতে এবাদতে ইখলাছের
ছাওয়াব কমে যাবে। আর যদি এবাদতের নিয়তটাই প্রবল হয়, তা
হলে পরিপূর্ণ প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে। আর ঐ পরিমাণ মিশ্রিত নিয়ত তার কোন ক্ষতি
করবে না- মিথ্যা ও গুনাহ করার দ্বারা যেমন হয়। হজ্জের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআ’লা বলেছেনঃ
)لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ(
“তোমাদের উপর তোমাদের পালন কর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোন পাপ নেই।” (সূরা বাকারাঃ ১৯৮) আর যদি এবাদতের নিয়ত ছাড়া
অন্য কোন নিয়ত প্রবল থাকে তাহলে দুনিয়াতে যা অর্জন করল ছওয়াব হিসেবে কেবল তাই পাবে, পরকালে ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত
হবে। এ রকম করার কারণে সে ব্যক্তি পাপী হওয়ার আশংকা রয়েছে। কেননা সে আল্লাহর
এবাদতের মাধ্যমে দুনিয়ার নগণ্য স্বার্থের নিয়ত করেছে। এ রকম ব্যক্তির ক্ষেত্রে
আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُون(
“তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যারা সাদ্কা
বন্টনে আপনাকে দোষারোপ করে। সাদ্কা থেকে কিছু পেলে তারা সন্তুষ্ট হয় এবং না পেলে
অসন্তুষ্ট হয়।” (সূরা তাওবাঃ ৫৮) আবু দাউদ শরীফে আবু হুরায়রা h হতে বর্ণিত আছে, একজন লোক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কাছে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কোন লোক যদি
দুনিয়ার কোন সম্পদ লাভের আশায় জিহাদে যায় তবে তার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
নবী (ﷺ) বললেন, সে প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে।
লোকটি কয়েকবার প্রশ্ন করল। নবী (ﷺ) প্রতিবারই বললেন, সে ব্যক্তি ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত
হবে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে উমার বিন খাত্তাব h থেকে বর্ণিত আছে, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ
“যে ব্যক্তি দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য হিজরত করবে অথবা কোন
মহিলাকে বিবাহ করার জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত তার নিয়ত
অনুযায়ীই হবে।”
আর যদি তার কাছে উভয়টি সমান হয়
অর্থাৎ এবাদতের নিয়ত কিংবা অন্য কোন নিয়তের কোনটিই প্রবল না হয়, তাহলেও বিশুদ্ধ কথা হলো সে ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। যেমনিভাবে কোন
ব্যক্তি আল্লাহর জন্য এবং অন্যের জন্য ইবাদত করলে ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।
মোট কথা অন্তরের নিয়তের
ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই বান্দা কখনো সিদ্দীকীনের স্তরে পৌঁছে
যায় আবার কখনো নিকৃষ্টতম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই জন্যই কোন কোন সালাফে সালেহীন
বলেছেন, এখলাছের ব্যাপারে আমি যতটুকু নাফসের সাথে জিহাদ
করেছি, অন্য কোন ব্যাপারে আমার নাফসের সাথে ততটুকু জেহাদ
করিনি।
আমরা আল্লাহর কাছে নিয়ত ও আ‘মালে এখলাস কামনা করি।
উত্তরঃ মানুষ আশাকে
ভয়ের উপর প্রাধান্য দিবে? না ভয়কে আশার উপর? এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে
মত পার্থক্য রয়েছে।
ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল h বলেছেন, মানুষের নিকট আশা এবং ভয় সমান সমান হওয়া উচিৎ। একটিকে অন্যটির উপর
প্রাধান্য দেয়া উচিৎ নয়। তিনি আরো বলেন, একটি অন্যটির উপর
প্রাধান্য দিলে বিপথগামী হবে। কেননা আশাকে প্রাধান্য দিলে মানুষ আল্লাহর পাকড়াও
থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে। আর ভয়কে প্রাধান্য দিলে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে
পড়বে।
কোন কোন আলেম বলেন, সৎ আ‘মালের ক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত পাওয়ার
আশাকে প্রাধান্য দিবে এবং পাপ কাজের প্রতি ধাবিত হওয়ার সময় আল্লাহর ভয়কে সামনে
রাখবে। কেননা বান্দা আনুগত্যের কাজের দ্বারা আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা আবশ্যক হওয়ার
কাজ করে থাকে। তাই আশার দিককে অর্থাৎ আ‘মালটি কবূল হওয়ার
আশাকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। আর মনের ভিতরে যদি পাপ কাজের ইচ্ছা জাগ্রত হয়, তখন আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। যাতে পাপ কাজে লিপ্ত না হয়।
কিছু কিছু আলেম বলেছেন, সুস্থ ব্যক্তির ভয়কে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। আর অসুস্থ ব্যক্তির জন্য
আশার আলো থাকা দরকার। কেননা সুস্থ ব্যক্তির নিকটে ভয় বেশী থাকলে পাপের কাজে অগ্রসর
হওয়া থেকে বিরত থাকবে। আর রোগী ব্যক্তি আশাকে প্রাধান্য দিবে। কারণ সে যদি আশাকে
প্রাধান্য দেয়, তা হলে আল্লাহর সাথে ভাল ধারণা রাখা
অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে।
এই মাসআলাতে আমার কাছে গ্রহণ
যোগ্য কথা হল মানুষের অবস্থাভেদে হুকুম বিভিন্ন হবে। ভয়ের দিককে প্রাধান্য দিতে
গেলে যদি আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়ার আশঙ্ককা থাকে, তা
হলে মন থেকে এ ধরণের ভয় দূর করে দিয়ে আশার দিককে স্থান দিবে। আর যদি আশঙ্ককা থাকে
যে, আশার দিককে প্রাধান্য দিতে গেলে আল্লাহর পাকড়াও থেকে
নিজেকে মুক্ত ভাবার ভয় রয়েছে, তা হলে ভয়কেই প্রাধান্য
দিবে। মানুষ তার অন্তরের ডাক্তার। যদি তার অন্তর জীবিত থাকে। আর যদি অন্তর মৃত হয়ে
থাকে, তা হলে তার কোন চিকিৎসা নেই।
উপায়
গ্রহণ আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থী নয়
প্রশ্নঃ (২৩) উপায় গ্রহণ করা কি আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থী উপসাগরীয়
যুদ্ধের সময় কেউ কেউ উপায় অবলম্বন করেছে। আবার কতক লোক এই বলে উপায় অবলম্বন করা বাদ
দিয়েছে যে, আমরা
আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
উত্তরঃ- মুমিনের উপর কর্তব্য হল অন্তরকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত রাখা এবং কল্যাণ
অর্জন এবং অকল্যাণ দূর করণে আল্লাহর উপর ভরসা করা। কেননা আকাশ-জমিনের চাবি কাঠি
আল্লাহর হাতে। তাঁর হাতেই মানুষের সকল বিষয়। আল্লাহ তাআ’লা
বলেনঃ
)وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَيْهِ يُرْجَعُ الْأَمْرُ كُلُّهُ فَاعْبُدْهُ وَتَوَكَّلْ عَلَيْهِ وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ(
“আল্লাহর নিকটেই আছে আকাশ ও জমিনের গোপন তথ্য, আর
প্রত্যেকটি বিষয় প্রত্যাবর্তন করবে তাঁরই দিকে; অতএব
তাঁরই বন্দেগী কর এবং তাঁরই উপর ভরসা রাখ, আর তোমাদের
কার্যকলাপ সম্বন্ধে তোমার পালনকর্তা বে-খবর নন।” (সূরা হুদঃ ১২৩) মূসা (আঃ) স্বজাতিকে লক্ষ্য
করে বলেনঃ
)وَقَالَ مُوسَى يَاقَوْمِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِينَ فَقَالُوا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنْ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ(
অর্থঃ
আর মূসা বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহর উপর ঈমান এনে থাক, তবে তারই উপর ভরসা কর যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাক। তখন তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে এই জালেম সম্প্রদায়ের ফিতনার বিষয়ে পরিণত করোনা। আর আমাদেরকে
অনুগ্রহ করে এই কাফেরদের কবল হতে উদ্ধার করুন। (সূরা ইউনুসঃ ৮৪-৮৬) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلْ الْمُؤْمِنُونَ(
মুমিনদের
উপর আবশ্যক হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ভরসা করা। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৬০) আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেনঃ
)وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا(
যে
ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।
আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন। (সূরা তালাকঃ ৩) সুতরাং বান্দার উপর আবশ্যক
হল তার মালিক এবং আকাশ-জমিনের মালিকের উপর ভরসা করবে এবং তাঁর প্রতি ভাল ধারণা
রাখবে। সাথে সাথে বাহ্যিক উপায়-উপকরণ গ্রহণ করবে এবং আত্মরক্ষামূলক সতর্কতা
অবলম্বন করবে। কেননা কল্যাণ সংগ্রহের উপকরণ গ্রহণ করা এবং অকল্যাণ থেকে বেঁচে
থাকার উপায় অবলম্ভন করা আল্লাহর উপর ঈমান আনা এবং তাঁর উপর ভরসা করার পরিপন্থী নয়।
দেখুন সর্বশ্রেষ্ঠ ভরসাকারী মুহাম্মাদ (ﷺ) নিজেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন
উপায় ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। নিদ্রায় যাওয়ার পূর্বে তিনি সূরা ইখলাস, ফালাক এবং নাস পাঠ করার
মাধ্যমে রোগ-ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য শরীরে ফুঁক দিতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের
আঘাত থেকে শরীর হেফাজত করার জন্য লোহার পোষাক পরিধান করতেন। যখন মুশরেক সম্প্রদায়
মদীনা আক্রমণ করার জন্য তার চারপাশে একত্রিত হল, তখন
মদীনাকে সংরক্ষণ করার জন্য তার চতুর্পার্শ্বে খন্দক খনন করেছেন। যুদ্ধের সময়
আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহ যে সমস্ত হাতিয়ার সৃষ্টি করেছেন, তার
জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। আল্লাহ তাআ’লা তাঁর
নবী দাউদ (আঃ) এর সম্পর্কে বলেনঃ
)وَعَلَّمْنَاهُ صَنْعَةَ لَبُوسٍ لَكُمْ لِتُحْصِنَكُمْ مِنْ بَأْسِكُمْ فَهَلْ أَنْتُمْ شَاكِرُونَ(
“আমি তাঁকে তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। অতএব তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে? (সূরা আম্বিয়াঃ ৮০) আল্লাহ তাআ’লা দাউদ (আঃ) কে ভালভাবে
যুদ্ধের বর্ম তৈরী করার আদেশ দিয়েছেন এবং তা লম্বা করে তৈরী করতে বলেছেন। কারণ
আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে অধিক শক্তিশালী।
উপরের আলোচনার উপর ভিত্তি করে
বলা যায় যে, যুদ্ধের স্থানের কাছাকাছি অঞ্চলের লোকদের
জন্য ক্ষতিকারক গ্যাস শরীরে প্রবেশের ভয় থাকলে তারা যদি উপযুক্ত পোষাক পরিধান করে,
তা হলে কোন অসুবিধা নেই। কেননা এই সমস্ত উপকরণ শরীরকে হেফাজত
করবে। এমনিভাবে খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে রাখাতেও কোন অসুবিধা নেই। বিশেষ করে যদি
প্রয়োজনের সময় এগুলো না পাওয়ার ভয় থাকে। সর্বোপুরি ভরসা থাকবে আল্লাহর উপর। আল্লাহ
তাআ’লা এ সমস্ত আসবাব গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছেন তাই এই
সমস্ত আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা বৈধ। এই জন্য নয় যে, এগুলোর
ভিতরে কল্যাণ-অকল্যাণ বয়ে আনার ক্ষমতা আছে।
পৃথিবীতে মানুষের চলার জন্য
আল্লাহ তাআ’লা যে সমস্ত নেয়ামত সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এই যে,
তিনি যেন আমাদের সকলকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন এবং আমাদের ও
আমাদের মুমিন ভাইদেরকে তাঁর প্রতি জন্য ঈমান এবং তাঁর উপর ভরসার বলে বলিয়ান করেন
এবং এমন সব উপায় উপকরণ গ্রহণ সহজ করেন যা তাঁর পক্ষ থেকে অনুমদিত ও মনোনিত।
উত্তরঃ উপায়-উপকরণ
গ্রহণ করা কয়েক প্রকার হতে পারেঃ-
১) যা মূলতই তাওহীদের পরিপন্থী।
তা এই যে, কোন
ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন জিনিষের উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করল, বাস্তবে যার কোন প্রভাবই নাই। মুসিবতে পড়ে কবর পূজারীরা এমনটি করে
থাকে। এটি বড় শির্ক। যারা এ ধরণের শির্কে লিপ্ত হবে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ(
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শির্ক করবে, আল্লাহ
তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালেমদের জন্য কোন
সাহায্যকারী থাকবে না।” (সূরা মায়িদাঃ ৭২)
২) শরীয়ত সম্মত উপায়-উপকরণের
উপর ভরসা করা এবং আল্লাহ তাআ’লাই যে এগুলোর সৃষ্টিকারী, তা একেবারে ভুলে
যাওয়া। এটাও এক প্রকার শির্ক। তাবে এটা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না।
(৩) মানুষ উপায়-উপকরণ অবলম্বন
করার সাথে সাথে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করবে এবং বিশ্বাস করবে যে, এই উপকরণ আল্লাহর পক্ষ থেকেই।
তিনি ইচ্ছা করলে এটি ছিন্ন করে দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে অবশিষ্ট রাখতে পারেন। এই
ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা কোনভাবেই তাওহীদের পরিপন্থী নয়।
মোট কথা এই যে, শরীয়ত সম্মত উপায়-উপকরণ বর্তমান থাকা সত্বেও এগুলোর উপর পরিপূর্ণরূপে
ভরসা করা ঠিক নয়। বরং সম্পূর্ণরূপে ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই করতে হবে। সুতরাং
কোন চাকরীজীবি যদি তার বেতনের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে এবং সকল বস্তর
সৃষ্টিকারী আল্লাহর উপর ভরসা করতে ভুলে যায়, তাহলে সে এক
প্রকার শির্কে লিপ্ত হবে। আর যে কর্মচারী এই বিশ্বাস রাখে যে, বেতন কেবল একটি মাধ্যম মাত্র তাহলে এটা আল্লাহর উপর ভরসার বিরোধী হবে
না। নবী (ﷺ) ও আল্লাহর উপর ভরসা করার
সাথে সাথে আসবাব গ্রহণ করতেন।
উত্তরঃ যাদু বা অন্য
কোন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঝাড়-ফুঁক করাতে কোন অসুবিধা নেই। যদি তা কুরআনের আয়াত
বা অন্য কোন বৈধ দু’আর মাধ্যমে হয়ে থাকে। নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত আছে যে, তিনি সাহাবীদেরকে ঝাড়-ফুঁক
করেছেন। নবী (ﷺ) থেকে ঝাড়-ফুঁকের বিভিন্ন দু’আও প্রমাণিত আছে। তম্মধ্যে
কয়েকটি দু’আ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
رَبَّنَا اللَّهُ الَّذِي فِي السَّمَاءِ تَقَدَّسَ اسْمُكَ أَمْرُكَ فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ كَمَا رَحْمَتُكَ فِي السَّمَاءِ فَاجْعَلْ رَحْمَتَكَ فِي الْأَرْضِ اغْفِرْ لَنَا حُوبَنَا وَخَطَايَانَا أَنْتَ رَبُّ الطَّيِّبِينَ أَنْزِلْ رَحْمَةً مِنْ رَحْمَتِكَ وَشِفَاءً مِنْ شِفَائِكَ عَلَى هَذَا الْوَجَعِ فَيَبْرَأَ
“হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার নাম অতি পবিত্র। আকাশ এবং যমিনে আপনার আদেশ
বাস্তবায়িত হয়। আকাশে যেমন আপনার রহমত বিস্তৃত রয়েছে, জমিনেও
অনুরূপভাবে আপনার রহমত বিস্তার করুন। আপনি আমাদের গুনাহ ও অপরাধসমূহ ক্ষমা করুন।
আপনি পবিত্রদের প্রভু, এই রোগীর উপর আপনার রহমত ও শিফা
অবতীর্ণ করুন। এই ভাবে ঝাড়-ফুঁক করলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠত।”
بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللَّهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ
“আল্লাহর নামে তোমাকে ঝাড়-ফুঁক করছি। প্রতিটি এমন রোগ আরোগ্যের জন্যে,
যা তোমাকে কষ্ট দেয়। প্রতিটি মানুষের অকল্যাণ থেকে এবং হিংসুকের
বদ নজর থেকে আল্লাহ তোমাকে শিফা দান করুন। আল্লাহর নামে তোমাকে ঝাড়-ফুঁক করছি।”
أَعُوذُ بِاللَّهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ
আমি
আল্লাহ এবং তাঁর কুদরতের উসীলায় আমার কাছে উপস্থিত ও আশংকিতকারী অনিষ্টতা থেকে
আশ্রয় প্রার্থনা করছি। রোগী ব্যক্তি শরীরের যেখানে ব্যথা অনুভব করবে, সেখানে হাত রেখে উপরোক্ত দু’আটি পাঠ করবে। উপরের দু’আগুলো ছাড়াও হাদীছে
আরো অনেক দু’আ বর্ণিত হয়েছে।
কুরআনের আয়াত অথবা হাদীছে
বর্ণিত দু’আ বা যিকর লিখে গলায় ঝুলিয়ে রাখার ব্যাপারে
আলোমেগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন বৈধ। আবার কেউ বলেছেন অবৈধ। তবে অবৈধ
হওয়াটাই সত্যের অধিক নিকটবর্তী। কারণ এসব ঝুলিয়ে রাখার পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া
যায়না। এটাই সর্বাধিক সঠিক কথা; বরং একাজটি একটি শিরকী
কাজ বলে গণ্য হবে। কারণ এখানে এমন জিনিষকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে আল্লাহ
যাকে শরীয়ত সম্মত মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃতি দেন নি। নবী (ﷺ) থেকে কোন দলীল পাওয়া যায়না।
কুরআন বা অন্য দু’আ পড়ে রোগীর শরীরে ফুঁক দেয়ার কথা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু রোগীর
গলায় বা হাতে কুরআনের আয়াত লিখে ঝুলিয়ে রাখা কিংবা কুরআনের আয়াত লিখে বালিশের নীচে
রেখে দেয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।
0 Comments