▌সংবিধান প্রণয়ন করা কি বড়ো কুফর?
·পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি অবতীর্ণ হোক আল্লাহর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের ওপর।
এটি আমাদের কাছে সুবিদিত যে, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করা কঠিন গুনাহের কাজ। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা বড়ো কুফরের পর্যায়েও পৌঁছে, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে ফায়সালা করার আবশ্যকতা অস্বীকার করে, কিংবা অন্য আইন দিয়ে ফায়সালা করা বৈধ মনে করে, অথবা অন্য আইনকে আল্লাহর আইনের চেয়ে উত্তম বা সমপর্যায়ের মনে করে, কিংবা অন্য আইনকে আল্লাহর আইন বলে চালিয়ে দেয়, তাহলে উক্ত কাজের কাজি নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যাবে।
কিন্তু কেউ যদি সেসব না করে স্রেফ অন্য আইন দিয়ে ফায়সালা করে, তাহলে সে কাফির হবে না। তবে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোর মতো আরেকটি ক্ষেত্র আছে, যাকে বলা হয় তাক্বনীন বা তাশরী‘। এর অর্থ—বিধান রচনা করা বা আইন প্রণয়ন করা। কোনো ব্যক্তি যদি বিধান রচনা করে সেই বিধান দিয়ে ফায়সালা করে, তাহলে সে কাফির হবে কিনা তা নিয়ে ‘উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। আমি আবারও বলছি, এই মাসআলাহয় ‘উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে।
·
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)’র মতে সংবিধান প্রণয়নকারী শাসক কাফির হয়ে যাবে। কেননা তিনি মনে করেন, তার দ্বারা সংবিধান প্রণীত হওয়াই প্রমাণ করে, সে এই কাজ বৈধ মনে করে। পক্ষান্তরে আইম্মায়ে সালাসাহ তথা সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম ইবনু বায, ইমাম আলবানী ও ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ)’র মতে সংবিধান প্রণয়নকারী কাফির হবে না।
খারিজীদের সাথে ইমাম মুহাম্মাদের বিশাল পার্থক্যটি এখানেই যে, তিনি সংবিধান প্রণয়ন করাকে বড়ো কুফর মনে করলেও সরাসরি শাসককে ‘কাফির’ আখ্যা দেন না। কিন্তু খারিজীরা সংবিধান প্রণেতা শাসককে তাকফীরের শর্তাবলি পূরণ না হতেই এবং তাকফীরের প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিলীন না হতেই ‘কাফির’ ফতোয়া দিয়ে বসে।
·
প্রিয় পাঠক, এখন কথা হলো, এই মাসআলাহয় দুটো মতের মধ্যে সঠিক কোনটি। শরিয়তের দলিলপ্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সংবিধান প্রণয়ন করা ছোটো কুফর—এই মতটিই সঠিক। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা সৌদি আরবের প্রখ্যাত দা‘ঈ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ বুনদার বিন নায়িফ আল-‘উতাইবী (হাফিযাহুল্লাহ)’র লেখা নান্দনিক গ্রন্থ ‘আল-হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ’ থেকে একটি অধ্যায় অনুবাদ করে পেশ করছি। যে গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সদস্য ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ বিন হাসান আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)।
শাইখ বুনদার (হাফিযাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থের আলোচ্য অধ্যায়ে সংবিধান প্রণয়ন করা যে বড়ো কুফর নয়—তা খুবই চমৎকারভাবে অনেক দলিলপ্রমাণ দিয়ে তুলে ধরেছেন। তাহলে চলুন, পড়ে ফেলি প্রামাণ্য নিবন্ধখানি। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
·সৌদি আরবের প্রখ্যাত দা‘ঈ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ বুনদার বিন নায়িফ আল-‘উতাইবী (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন—
❝গাইরুল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করার একটি অন্যতম প্রকার হলো তাক্বনীন তথা সংবিধান বা আইন প্রণয়ন করা।
এর ধরন হচ্ছে—কেউ আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করে এবং সে নিজেই সেই (নব্য) বিধান আনয়ন করে।
অর্থাৎ, সে নিজেই ওই বিধান বা আইন প্রণয়ন করে। আর এক্ষেত্রে সে উক্ত কাজকে হালাল মনে করে না, আল্লাহর বিধান দিয়ে ফায়সালা করার বিধানকে অস্বীকার করে না, মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না, আল্লাহর আইন ও গাইরুল্লাহর আইনকে সমান বলে না এবং সে যে বিধান আনয়ন করেছে সেটাকে আল্লাহর দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত করে না।
এই প্রকারের হুকুম: এটি ছোটো কুফর, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না।
এর দলিল: এরকম কোনো দলিল পাওয়া যায় না, যা উল্লিখিত কাজের কাজিকে কাফির বলা আবশ্যক করে। আইন প্রণয়নের উৎসের ওপর শরিয়ত বড়ো কুফরের হুকুম লাগায়নি। যেমনভাবে (শরিয়তের) দলিলপ্রমাণ ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনি, যাদের একজন অন্যের প্রণীত আইন দিয়ে ফায়সালা করে, আরেকজন নিজের প্রণীত আইন দিয়ে ফায়সালা করে।
আমি (লেখক) বলছি, যদি এই পার্থক্য করার বিষয়টি সত্যই হতো, তাহলে শরিয়ত তা থেকে কখনোই গাফিল থাকতো না। বরং শরিয়তের দলিলপ্রমাণে এমন কিছু পাওয়া যেত, যা এই মতকে শক্তিশালী করে।
·
এই প্রকারের সাথে চারটি মাসআলাহর সম্পৃক্ততা রয়েছে। যথা:
প্রথম মাসআলাহ:
শরিয়তবিরোধী আইন প্রণয়নকারী শাসক হয়তো ওই শাসকের চেয়ে বড়ো অপরাধী হতে পারে, যে শাসক ওই কাজ করেনি। কিন্তু এখানে আলোচনার বিষয় হলো—এটাকে এমন কুফর বলা হচ্ছে, যার স্বপক্ষে কোনো দলিল নেই। বড়ো বা ছোটো অপরাধী নির্ণয় করা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়।
·দ্বিতীয় মাসআলাহ:
কিছু সম্মানিত ব্যক্তি আলোচ্য প্রকারকে তাকফীর করার দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর তা এভাবে যে, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আইন প্রণয়ন করা মহান আল্লাহর সাথে তাঁর খাস বিষয়াদি নিয়ে টানাহেঁচড়া করার পর্যায়ভুক্ত। আর তা হচ্ছে তাশরী‘ বা আইন প্রণয়ন করা।
আমি (লেখক) বলছি, আসলে এ ধরনের ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিস্তারিত কথা বলা দরকার। কেননা আইন প্রণয়নকারী দুটো অবস্থা থেকে মুক্ত নয়:
১ম অবস্থা: সে আইন প্রণয়ন করে এবং সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে আইনপ্রণয়নের হকদার বলে দাবি করে, স্রেফ কর্মের মাধ্যমে নয়। নিঃসন্দেহে এই ব্যক্তি বড়ো কুফর সংঘটনকারী কাফির। কেননা সে এমন কর্মকে হালাল মনে করছে, যেটাকে আল্লাহ হারাম সাব্যস্ত করেছেন।
দ্বিতীয় অবস্থা: সে আইন প্রণয়ন করে এবং নিজেকে আইনপ্রণয়নের হকদার বলে দাবি করে না। এই ব্যক্তি নিম্নোক্ত তিনটি কারণে কাফির হবে না। যথা:
এক. এই ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে—মর্মে কোনো দলিলের অস্তিত্ব নেই।
দুই. আহলুস সুন্নাহ ওই অসৎ বন্ধুকে কাফির আখ্যা দেয় না, যে পাপকর্ম প্রণয়ন করে, সেই পাপকে সুশোভিত করে এবং তার দিকে (মানুষকে) আহ্বান করে। যে ব্যক্তি আইন প্রণয়নকারীকে আখ্যা দেয়, তার নিকটে এই ব্যক্তি কাফির। অথচ আহলুস সুন্নাহর ঐক্যমতে এই ব্যক্তি কাফির নয়।
তিন. আহলুস সুন্নাহ ওই ছবি অঙ্কনকারীকে কাফির আখ্যা দেয় না, যারা হারাম ছবি অঙ্কনের কাজকে হালাল মনে করে না। অথচ মহান আল্লাহ তাদের ব্যাপারে হাদীসে কুদসীতে বলেছেন, من أظلم ممَّن ذهب يخلق كخلقي “তার চেয়ে বড়ো জালেম আর কে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে যায়?” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৩; সাহীহ মুসলিম, হা/৫৫০৯] তাদের ব্যাপারে রাসূল ﷺ বলেছেন, أشد الناس عذاباً يوم القيامة الذين يضاهون بخلق الله “কেয়ামতের দিন তাদেরকে সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৪; সাহীহ মুসলিম, হা/৫৪৯৪]
মূলত এদের দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু ছবি অঙ্কনকারী আল্লাহর সাথে নিজেকেও স্রষ্টা বানিয়ে নিয়েছে, আর আইন প্রণয়নকারী আল্লাহর সাথে নিজেকেও আইনপ্রণেতা বানিয়ে নিয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আইনপ্রণেতাকে কাফির আখ্যা দেয়, সে যেন ছবি অঙ্কনকারী স্রষ্টাকেও কাফির আখ্যা দেয়। দুটো সমানে সমান। ফলে যারা আইন প্রণয়নকারীকে কাফির আখ্যা দেয়, তাদের কাছে ছবি অঙ্কনকারীও কাফির। অথচ আহলুস সুন্নাহর ঐক্যমতে এই ব্যক্তি (ছবি অঙ্কনকারী) কাফির নয়।
আমি বলছি, উল্লিখিত অসৎ বন্ধু এবং ছবি অঙ্কনকারী কাফির না হওয়ার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহর মতৈক্য সে কথার ব্যাপারে অকাট্য দলিল, যে কথা আমি কিছুপূর্বে ব্যক্ত করলাম। সুতরাং এটাকে ভালো করে মনে রাখেন। কেননা এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
·
তৃতীয় মাসআলাহ:
কিছু সম্মানিত ব্যক্তি আলোচ্য প্রকারকে তাকফীর করার দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর তা এভাবে যে, আইন প্রণয়নকারী ব্যক্তি তাগূতে পরিণত হয়, আল্লাহকে ব্যতিরেকে যার নিকটে ফায়সালার জন্য যাওয়া হয়। এভাবে দলিল গ্রহণ করা বিশুদ্ধ নয়। এরূপ দলিলগ্রহণ যে ভুল, তা নিম্নোক্ত দুটো দিক থেকে বর্ণনা যায়। যথা:
১ম দিক: উক্ত দলিলগ্রহণের পদ্ধতি অশুদ্ধ একটি মূলনীতির ওপর ভিত্তিশীল। আর সেই মূলনীতি হলো—এরূপ বলা যে, তাগূত মাত্রই সে কাফির। এই মূলনীতি যে ভুল, তার দলিল নিম্নোক্ত তিন দিক থেকে দেওয়া যায়:
এক. প্রত্যেক ভ্রষ্টতার নেতাকে তাগূত বলা হয়। কেননা তাগূত শব্দটি ‘তুগইয়ান’ শব্দ থেকে উদ্গত হয়েছে, যার অর্থ ‘সীমালঙ্ঘন করা।’
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) সূরাহ নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বর্ণিত ‘তোমরা তাগূত বর্জন করো’ কথাটির তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, أي : اتركوا كل معبود دون الله ؛ كالشيطان، والكاهن، والصنم، وكل من دعا إلى الضلال “অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যকে বর্জন করো। যেমন: শয়তান, গণক, মূর্তি এবং প্রত্যেক সেই ব্যক্তি, যে মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে।” [তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৭৫]
আল-ফাইরূযাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, والطاغوت : وكل رأس ضلال، والأصنام، وما عبد من دون الله، ومردة أهل الكتاب “তাগূত হলো প্রত্যেক ভ্রষ্টতার নেতা, মূর্তি, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার ইবাদত করা হয় এবং উদ্ধত আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান)।” [আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪০০]
আমি বলছি, তুগইয়ান তথা সীমালঙ্ঘন কখনো কখনো মুকাফফির তথা কাফিরকারী হয়, আবার কখনো কখনো তা কুফরের পর্যায়ে পৌঁছে না। একারণে ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, فحدّك أن تكون عبداً مطيعاً لله، فإذا جاوزتَ ذلك فقد تعدّيتَ وكنتَ طاغوتاً بهذا الشيء الذي فعلته، فقد يكون كافراً وقد يكون دون ذلك “তোমার সীমানা এই যে, তুমি আল্লাহর অনুগত বান্দা হবে। তুমি যখন এই সীমানা অতিক্রম করবে, তখন তুমি সীমালঙ্ঘনকারী বিবেচিত হবে। তুমি তোমার উক্ত কাজের ফলে তাগূত বলে গণ্য হবে। আর তাগূত কখনো কাফির হয়, আবার কখনো কাফিরের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের পাপী হয়।” [শারহু সালাসাতিল উসূল, ২ নং অডিয়ো ক্লিপ; পর্বক্রম: আরবি বর্ণমালার ‘বা’ বর্ণ; প্রকাশনায়: রিয়াদস্থ তাসজীলাতুল বারাদীন বা আল-বারাদীন রেকর্ড]
দুই. ‘উলামাদের কেউ কেউ স্রেফ সীমালঙ্ঘনের কারণে ব্যক্তিকে তাগূত আখ্যা দিয়েছেন, আখ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দিকে নজর না দিয়েই। যথা:
ক. তাঁরা তাগূতের পরিচয় এভাবে দিয়েছেন যে, كل ما تجاوز به العبد حده من معبود أو متبوع أو مطاع “বান্দা যার ব্যাপারে স্বীয় সীমানা লঙ্ঘন করে, তথা উপাস্য, অনুসৃত, বা নেতা—তাদের সবাই তাগূত।” এই কথা বলেছেন ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)। [ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বি‘ঈন, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫০]
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত কথার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ومراده : من كان راضياً. أو يقال : هو طاغوت باعتبار عابده وتابعه ومطيعه؛ لأنه تجاوز به حدّه حيث نزّله فوق منزلته التي جعلها الله له، فتكون عبادته لهذا المعبود واتباعه لمتبوعه وطاعته لمطاعه : طغياناً؛ لمجاوزته الحد بذلك “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: যে ব্যক্তি এতে সন্তুষ্ট থাকে। অথবা বলা হয়, সে তার উপাসক, অনুসারী ও আনুগত্যকারীর বিবেচনায় তাগূত। কেননা সে তার নিজের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। যেহেতু আল্লাহ তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তার অনুসারীরা তাকে তার চেয়ে উঁচু মর্যাদা দেয়। ফলে এই উপাস্যের উপাসনা করা, নেতার অনুসরণ করা এবং অনুসৃত ব্যক্তির আনুগত্য করা তখন ‘তুগইয়ান’ বা তাগূতী কর্ম বিবেচিত হয়, ওই সকল কাজের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন করার কারণে।” [আল-ক্বাওলুল মুফীদ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩০]
আমি বলছি, কাউকে তাগূত বলে আখ্যা দেওয়ার মানে এই নয় যে, সেই (আখ্যাপ্রাপ্ত) ব্যক্তি কাফির। কেননা এই সম্ভাবনা আছে যে, সে তাগূত হয়েছে তার অনুসারীদের বিবেচনায়, তাঁর নিজের বিবেচনায় নয়।
খ. আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব জড়পদার্থের উপাসনা করা হয়, ‘উলামাগণ সেসবকেও তাগূত আখ্যা দিয়েছেন। আর এটা সুবিদিত যে, জড়পদার্থকে মুসলিম আখ্যা দেওয়া হয় না, যা কাফিরের বিপরীত।
ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, قال ابن قتيبة : كل معبود ؛ من حجر أو صورة أو شيطان : فهو جبت وطاغوت. وكذلك حكى الزجاج عن أهل اللغة “ইবনু কুতাইবাহ বলেছেন, পাথর, ছবি, কিংবা শয়তান-সহ যত রকমের উপাস্য আছে, তার সবই জিবত ও তাগূত। একইভাবে আয-যুজাজ ভাষাবিদদের থেকে এমনটি বর্ণনা করেছেন।” [নুযহাতুল আ‘ইয়ানিন নাওয়াযির, পৃষ্ঠা: ৪১০; তাগূত অধ্যায়]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, وهو اسم جنس يدخل فيه : الشيطان والوثن والكهان والدرهم والدينار وغير ذلك “এটি একটি জাতিবাচক বিশেষ্য, যার মধ্যে শয়তান, মূর্তি, গণক, দিরহাম, দিনার প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়।” [মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৬; পৃষ্ঠা: ৫৬৫]
আমি বলছি, যদি সকল তাগূত কাফিরই হতো, তাহলে জড়পদার্থকে তাগূত বলা সিদ্ধ হতো না।
গ. ‘উলামাগণ কাফির নয় এমন পাপীদেরকেও তাগূত বলেছেন। রাগিব আসফাহানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, الطاغوت عبارة عن : كل متعدٍّ وكل معبود من دون الله. ولما تقدم : سُمّي الساحر والكاهن والمارد من الجن والصارف عن طريق الخير : طاغوتًا “আল্লাহকে বাদ দিয়ে উপাসনা করা হয় এমন প্রত্যেক উপাস্য ও সীমালঙ্ঘনকারীকে তাগূত বলা হয়। আর পূর্বে গত হয়ে গেছে যে, জাদুকর, গণক, অবাধ্য জিন এবং কল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুতকারীকে তাগূত বলা হয়।” [আল-মুফরাদাত, পৃষ্ঠা: ১০৮]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, والطواغيت كثيرة، والمتبين لنا منهم خمسة : أولهم الشيطان وحاكم الجور وآكل الرشوة ومن عُبد فرضي والعامل بغير علم “তাগূতের সংখ্যা অনেক। তবে তাদের মধ্যে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট তাগূত পাঁচটি। যথা: (১) তাদের প্রথমজন হলো শয়তান, (২) অত্যাচারী শাসক, (৩) ঘুষখোর, (৪) যার উপাসনা করা হয়, আর সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, (৫) না জেনে ‘আমলকারী।” [আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৩৭]
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, علماء السوء الذين يدعون إلى الضلال والكفر أو يدعون إلى البدع أو إلى تحليل ما حرم الله أو تحريم ما أحل الله : طواغيت “মন্দ ‘উলামা, যারা ভ্রষ্টতা ও কুফরের দিকে আহ্বান করে, অথবা বিদ‘আতের দিকে আহ্বান করে, কিংবা আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল করা বা আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার দিকে আহ্বান করে, তারা তাগূত।” [শারহূ সালাসাতিল উসূল, পৃষ্ঠা: ১৫১]
আমি বলছি, যদি সকল তাগূত কাফিরই হতো, তাহলে এরকম নিরঙ্কুশভাবে তাগূত আখ্যা দেওয়া জায়েজ হতো না। অন্যথায় এ থেকে একথা বলা আবশ্যক হয়ে যায় যে, তাঁরা (‘উলামারা) পাপকাজ (যা বড়ো কুফর নয়) করার কারণে কাফির আখ্যা দেন।
·
দ্বিতীয় দিক: এর ফলে আহলুস সুন্নাহ যার কাফির না হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে, তাকে কাফির আখ্যা দেওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। আর সে ওই ব্যক্তি, যে পাপকাজ তৈরি করে। যেহেতু প্রণয়ন বা তৈরি করার দিক থেকে গুণাহপ্রণেতা এবং আইনপ্রণেতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেননা উভয়েই হারাম বিষয় প্রণয়নের পাপে নিপাতিত হয়েছে।
এর দৃষ্টান্ত: একদল লোক ডাকাতি করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। এ মর্মে তারা দলের নেতা নিযুক্ত করল এবং দলের জন্য কিছু নিয়মকানুনও তৈরি করল। এই দলের নেতা তাদেরকে (অন্যায়ের দিকে) আহ্বান করে, পাশাপাশি সীমালঙ্ঘন করা, ডাকাতি করা এবং মুসলিমদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করার নিমিত্তে তাদের জন্য নিয়মকানুন তৈরি করে, আর তারা তা পালন করে। সে তাদেরকে আদেশ করে, আর তারা সে আদেশ মান্য করে। সে তাদেরকে নিষেধ করে, আর তারা তার নিষেধ মান্য করে। ফলে এই লোক গুনাহ রচনাকারীতে পরিণত হয়। অথচ সে কাফির নয়।
আমি বলছি, যেই মূলনীতির ওপর সংবিধান প্রণয়নকারীকে কাফির বলার ব্যাপারটি ভিত্তিশীল হয়েছে, সেই মূলনীতি যদি সঠিকই হতো, তাহলে এই লোককে (ডাকাতদলের নেতা) কাফির আখ্যা দেওয়া আবশ্যক হয়ে যেত। অথচ সে গুনাহগার ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে কাফির না বলার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে।
চতুর্থ মাসআলাহ:
তালিবুল ‘ইলমদের মধ্যে এই প্রকার নিয়ে ব্যাপক মতোবিরোধ থাকা সত্ত্বেও যুগশ্রেষ্ঠ তিন বিদ্বান—ইবনু বায, আলবানী ও ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আইনপ্রণেতাকে কাফির না বলার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, فإذا سن قانونًا يتضمن أنه لا حد على الزاني، أو لا حد على السارق : فهذا قانون باطل، وإذا استحله الوالي كفر “সে যদি আইন প্রণয়ন করে, যেই আইনের মধ্যে আছে—ব্যভিচারীর (শরিয়ত নির্ধারিত) দণ্ড নেই, চোরের দণ্ড নেই, তাহলে তার এই আইন বাতিল। আর শাসক যদি এই কর্মকে হালাল মনে করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।” [মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১২৪]
সংবিধান রচনাকারী আইন প্রণয়ন করাকে হালাল মনে না করলে কাফির হবে না—মর্মে ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)’র বক্তব্য দেখুন, সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূরের ৮৪৯ নং অডিয়ো ক্লিপে (৭২ মিনিট থেকে)।
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, الحكم بغير ما أنزل الله ليس بكفر مخرج عن الملة، لكنه كفر عملي [ = أصغر ] ؛ لأن الحاكم بذلك خرج عن الطريق الصحيح. ولا يفرّق في ذلك بين الرجل الذي يأخذ قانونًا وضعيًا من قبَل غيره ويحكمه في دولته وبين من ينشيء قانونًا ويضع هذا القانون الوضعي؛ إذ المهم هو هل هذا القانون يخالف القانون السماوي أم لا “আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য কারও বিধান দিয়ে ফায়সালা করা দ্বীন থেকে খারিজকারী কুফর নয়। বরং এটা আমলগত (ছোটো) কুফর। কেননা এর ফলে শাসক সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অন্যের প্রণীত কোনো আইনকে গ্রহণ করে, আর সে আইন অনুযায়ী তার দেশে শাসন করে, তার মধ্যে এবং যে ব্যক্তি আইন প্রণয়ন করে, আর সেই আইনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে—এই ব্যক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু এখানে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, সে আসমানী বিধানের বিরোধিতা করছে কি না।” [ফিতনাতুত তাকফীর, পৃষ্ঠা: ২৫; ১নং টীকা দ্রষ্টব্য]❞
·তথ্যসূত্র:
শাইখ বুনদার আল-‘উতাইবী (হাফিযাহুল্লাহ), আল-হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ; পৃষ্ঠা: ২৮-৩২; বাদশাহ ফাহাদ লাইব্রেরি, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৯ হিজরি (২য় প্রকাশ); বইটির ভূমিকা লিখেছেন সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সদস্য ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ বিন হাসান আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)।
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/ SunniSalafiAthari
·পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি অবতীর্ণ হোক আল্লাহর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের ওপর।
এটি আমাদের কাছে সুবিদিত যে, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করা কঠিন গুনাহের কাজ। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা বড়ো কুফরের পর্যায়েও পৌঁছে, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে ফায়সালা করার আবশ্যকতা অস্বীকার করে, কিংবা অন্য আইন দিয়ে ফায়সালা করা বৈধ মনে করে, অথবা অন্য আইনকে আল্লাহর আইনের চেয়ে উত্তম বা সমপর্যায়ের মনে করে, কিংবা অন্য আইনকে আল্লাহর আইন বলে চালিয়ে দেয়, তাহলে উক্ত কাজের কাজি নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যাবে।
কিন্তু কেউ যদি সেসব না করে স্রেফ অন্য আইন দিয়ে ফায়সালা করে, তাহলে সে কাফির হবে না। তবে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোর মতো আরেকটি ক্ষেত্র আছে, যাকে বলা হয় তাক্বনীন বা তাশরী‘। এর অর্থ—বিধান রচনা করা বা আইন প্রণয়ন করা। কোনো ব্যক্তি যদি বিধান রচনা করে সেই বিধান দিয়ে ফায়সালা করে, তাহলে সে কাফির হবে কিনা তা নিয়ে ‘উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। আমি আবারও বলছি, এই মাসআলাহয় ‘উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে।
·
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)’র মতে সংবিধান প্রণয়নকারী শাসক কাফির হয়ে যাবে। কেননা তিনি মনে করেন, তার দ্বারা সংবিধান প্রণীত হওয়াই প্রমাণ করে, সে এই কাজ বৈধ মনে করে। পক্ষান্তরে আইম্মায়ে সালাসাহ তথা সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম ইবনু বায, ইমাম আলবানী ও ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ)’র মতে সংবিধান প্রণয়নকারী কাফির হবে না।
খারিজীদের সাথে ইমাম মুহাম্মাদের বিশাল পার্থক্যটি এখানেই যে, তিনি সংবিধান প্রণয়ন করাকে বড়ো কুফর মনে করলেও সরাসরি শাসককে ‘কাফির’ আখ্যা দেন না। কিন্তু খারিজীরা সংবিধান প্রণেতা শাসককে তাকফীরের শর্তাবলি পূরণ না হতেই এবং তাকফীরের প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিলীন না হতেই ‘কাফির’ ফতোয়া দিয়ে বসে।
·
প্রিয় পাঠক, এখন কথা হলো, এই মাসআলাহয় দুটো মতের মধ্যে সঠিক কোনটি। শরিয়তের দলিলপ্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সংবিধান প্রণয়ন করা ছোটো কুফর—এই মতটিই সঠিক। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা সৌদি আরবের প্রখ্যাত দা‘ঈ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ বুনদার বিন নায়িফ আল-‘উতাইবী (হাফিযাহুল্লাহ)’র লেখা নান্দনিক গ্রন্থ ‘আল-হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ’ থেকে একটি অধ্যায় অনুবাদ করে পেশ করছি। যে গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সদস্য ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ বিন হাসান আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)।
শাইখ বুনদার (হাফিযাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থের আলোচ্য অধ্যায়ে সংবিধান প্রণয়ন করা যে বড়ো কুফর নয়—তা খুবই চমৎকারভাবে অনেক দলিলপ্রমাণ দিয়ে তুলে ধরেছেন। তাহলে চলুন, পড়ে ফেলি প্রামাণ্য নিবন্ধখানি। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
·সৌদি আরবের প্রখ্যাত দা‘ঈ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ বুনদার বিন নায়িফ আল-‘উতাইবী (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন—
❝গাইরুল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করার একটি অন্যতম প্রকার হলো তাক্বনীন তথা সংবিধান বা আইন প্রণয়ন করা।
এর ধরন হচ্ছে—কেউ আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করে এবং সে নিজেই সেই (নব্য) বিধান আনয়ন করে।
অর্থাৎ, সে নিজেই ওই বিধান বা আইন প্রণয়ন করে। আর এক্ষেত্রে সে উক্ত কাজকে হালাল মনে করে না, আল্লাহর বিধান দিয়ে ফায়সালা করার বিধানকে অস্বীকার করে না, মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না, আল্লাহর আইন ও গাইরুল্লাহর আইনকে সমান বলে না এবং সে যে বিধান আনয়ন করেছে সেটাকে আল্লাহর দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত করে না।
এই প্রকারের হুকুম: এটি ছোটো কুফর, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না।
এর দলিল: এরকম কোনো দলিল পাওয়া যায় না, যা উল্লিখিত কাজের কাজিকে কাফির বলা আবশ্যক করে। আইন প্রণয়নের উৎসের ওপর শরিয়ত বড়ো কুফরের হুকুম লাগায়নি। যেমনভাবে (শরিয়তের) দলিলপ্রমাণ ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনি, যাদের একজন অন্যের প্রণীত আইন দিয়ে ফায়সালা করে, আরেকজন নিজের প্রণীত আইন দিয়ে ফায়সালা করে।
আমি (লেখক) বলছি, যদি এই পার্থক্য করার বিষয়টি সত্যই হতো, তাহলে শরিয়ত তা থেকে কখনোই গাফিল থাকতো না। বরং শরিয়তের দলিলপ্রমাণে এমন কিছু পাওয়া যেত, যা এই মতকে শক্তিশালী করে।
·
এই প্রকারের সাথে চারটি মাসআলাহর সম্পৃক্ততা রয়েছে। যথা:
প্রথম মাসআলাহ:
শরিয়তবিরোধী আইন প্রণয়নকারী শাসক হয়তো ওই শাসকের চেয়ে বড়ো অপরাধী হতে পারে, যে শাসক ওই কাজ করেনি। কিন্তু এখানে আলোচনার বিষয় হলো—এটাকে এমন কুফর বলা হচ্ছে, যার স্বপক্ষে কোনো দলিল নেই। বড়ো বা ছোটো অপরাধী নির্ণয় করা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়।
·দ্বিতীয় মাসআলাহ:
কিছু সম্মানিত ব্যক্তি আলোচ্য প্রকারকে তাকফীর করার দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর তা এভাবে যে, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আইন প্রণয়ন করা মহান আল্লাহর সাথে তাঁর খাস বিষয়াদি নিয়ে টানাহেঁচড়া করার পর্যায়ভুক্ত। আর তা হচ্ছে তাশরী‘ বা আইন প্রণয়ন করা।
আমি (লেখক) বলছি, আসলে এ ধরনের ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিস্তারিত কথা বলা দরকার। কেননা আইন প্রণয়নকারী দুটো অবস্থা থেকে মুক্ত নয়:
১ম অবস্থা: সে আইন প্রণয়ন করে এবং সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে আইনপ্রণয়নের হকদার বলে দাবি করে, স্রেফ কর্মের মাধ্যমে নয়। নিঃসন্দেহে এই ব্যক্তি বড়ো কুফর সংঘটনকারী কাফির। কেননা সে এমন কর্মকে হালাল মনে করছে, যেটাকে আল্লাহ হারাম সাব্যস্ত করেছেন।
দ্বিতীয় অবস্থা: সে আইন প্রণয়ন করে এবং নিজেকে আইনপ্রণয়নের হকদার বলে দাবি করে না। এই ব্যক্তি নিম্নোক্ত তিনটি কারণে কাফির হবে না। যথা:
এক. এই ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে—মর্মে কোনো দলিলের অস্তিত্ব নেই।
দুই. আহলুস সুন্নাহ ওই অসৎ বন্ধুকে কাফির আখ্যা দেয় না, যে পাপকর্ম প্রণয়ন করে, সেই পাপকে সুশোভিত করে এবং তার দিকে (মানুষকে) আহ্বান করে। যে ব্যক্তি আইন প্রণয়নকারীকে আখ্যা দেয়, তার নিকটে এই ব্যক্তি কাফির। অথচ আহলুস সুন্নাহর ঐক্যমতে এই ব্যক্তি কাফির নয়।
তিন. আহলুস সুন্নাহ ওই ছবি অঙ্কনকারীকে কাফির আখ্যা দেয় না, যারা হারাম ছবি অঙ্কনের কাজকে হালাল মনে করে না। অথচ মহান আল্লাহ তাদের ব্যাপারে হাদীসে কুদসীতে বলেছেন, من أظلم ممَّن ذهب يخلق كخلقي “তার চেয়ে বড়ো জালেম আর কে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে যায়?” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৩; সাহীহ মুসলিম, হা/৫৫০৯] তাদের ব্যাপারে রাসূল ﷺ বলেছেন, أشد الناس عذاباً يوم القيامة الذين يضاهون بخلق الله “কেয়ামতের দিন তাদেরকে সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৪; সাহীহ মুসলিম, হা/৫৪৯৪]
মূলত এদের দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু ছবি অঙ্কনকারী আল্লাহর সাথে নিজেকেও স্রষ্টা বানিয়ে নিয়েছে, আর আইন প্রণয়নকারী আল্লাহর সাথে নিজেকেও আইনপ্রণেতা বানিয়ে নিয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আইনপ্রণেতাকে কাফির আখ্যা দেয়, সে যেন ছবি অঙ্কনকারী স্রষ্টাকেও কাফির আখ্যা দেয়। দুটো সমানে সমান। ফলে যারা আইন প্রণয়নকারীকে কাফির আখ্যা দেয়, তাদের কাছে ছবি অঙ্কনকারীও কাফির। অথচ আহলুস সুন্নাহর ঐক্যমতে এই ব্যক্তি (ছবি অঙ্কনকারী) কাফির নয়।
আমি বলছি, উল্লিখিত অসৎ বন্ধু এবং ছবি অঙ্কনকারী কাফির না হওয়ার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহর মতৈক্য সে কথার ব্যাপারে অকাট্য দলিল, যে কথা আমি কিছুপূর্বে ব্যক্ত করলাম। সুতরাং এটাকে ভালো করে মনে রাখেন। কেননা এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
·
তৃতীয় মাসআলাহ:
কিছু সম্মানিত ব্যক্তি আলোচ্য প্রকারকে তাকফীর করার দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর তা এভাবে যে, আইন প্রণয়নকারী ব্যক্তি তাগূতে পরিণত হয়, আল্লাহকে ব্যতিরেকে যার নিকটে ফায়সালার জন্য যাওয়া হয়। এভাবে দলিল গ্রহণ করা বিশুদ্ধ নয়। এরূপ দলিলগ্রহণ যে ভুল, তা নিম্নোক্ত দুটো দিক থেকে বর্ণনা যায়। যথা:
১ম দিক: উক্ত দলিলগ্রহণের পদ্ধতি অশুদ্ধ একটি মূলনীতির ওপর ভিত্তিশীল। আর সেই মূলনীতি হলো—এরূপ বলা যে, তাগূত মাত্রই সে কাফির। এই মূলনীতি যে ভুল, তার দলিল নিম্নোক্ত তিন দিক থেকে দেওয়া যায়:
এক. প্রত্যেক ভ্রষ্টতার নেতাকে তাগূত বলা হয়। কেননা তাগূত শব্দটি ‘তুগইয়ান’ শব্দ থেকে উদ্গত হয়েছে, যার অর্থ ‘সীমালঙ্ঘন করা।’
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) সূরাহ নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বর্ণিত ‘তোমরা তাগূত বর্জন করো’ কথাটির তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, أي : اتركوا كل معبود دون الله ؛ كالشيطان، والكاهن، والصنم، وكل من دعا إلى الضلال “অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যকে বর্জন করো। যেমন: শয়তান, গণক, মূর্তি এবং প্রত্যেক সেই ব্যক্তি, যে মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে।” [তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৭৫]
আল-ফাইরূযাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, والطاغوت : وكل رأس ضلال، والأصنام، وما عبد من دون الله، ومردة أهل الكتاب “তাগূত হলো প্রত্যেক ভ্রষ্টতার নেতা, মূর্তি, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার ইবাদত করা হয় এবং উদ্ধত আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান)।” [আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪০০]
আমি বলছি, তুগইয়ান তথা সীমালঙ্ঘন কখনো কখনো মুকাফফির তথা কাফিরকারী হয়, আবার কখনো কখনো তা কুফরের পর্যায়ে পৌঁছে না। একারণে ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, فحدّك أن تكون عبداً مطيعاً لله، فإذا جاوزتَ ذلك فقد تعدّيتَ وكنتَ طاغوتاً بهذا الشيء الذي فعلته، فقد يكون كافراً وقد يكون دون ذلك “তোমার সীমানা এই যে, তুমি আল্লাহর অনুগত বান্দা হবে। তুমি যখন এই সীমানা অতিক্রম করবে, তখন তুমি সীমালঙ্ঘনকারী বিবেচিত হবে। তুমি তোমার উক্ত কাজের ফলে তাগূত বলে গণ্য হবে। আর তাগূত কখনো কাফির হয়, আবার কখনো কাফিরের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের পাপী হয়।” [শারহু সালাসাতিল উসূল, ২ নং অডিয়ো ক্লিপ; পর্বক্রম: আরবি বর্ণমালার ‘বা’ বর্ণ; প্রকাশনায়: রিয়াদস্থ তাসজীলাতুল বারাদীন বা আল-বারাদীন রেকর্ড]
দুই. ‘উলামাদের কেউ কেউ স্রেফ সীমালঙ্ঘনের কারণে ব্যক্তিকে তাগূত আখ্যা দিয়েছেন, আখ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দিকে নজর না দিয়েই। যথা:
ক. তাঁরা তাগূতের পরিচয় এভাবে দিয়েছেন যে, كل ما تجاوز به العبد حده من معبود أو متبوع أو مطاع “বান্দা যার ব্যাপারে স্বীয় সীমানা লঙ্ঘন করে, তথা উপাস্য, অনুসৃত, বা নেতা—তাদের সবাই তাগূত।” এই কথা বলেছেন ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)। [ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বি‘ঈন, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫০]
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত কথার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ومراده : من كان راضياً. أو يقال : هو طاغوت باعتبار عابده وتابعه ومطيعه؛ لأنه تجاوز به حدّه حيث نزّله فوق منزلته التي جعلها الله له، فتكون عبادته لهذا المعبود واتباعه لمتبوعه وطاعته لمطاعه : طغياناً؛ لمجاوزته الحد بذلك “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: যে ব্যক্তি এতে সন্তুষ্ট থাকে। অথবা বলা হয়, সে তার উপাসক, অনুসারী ও আনুগত্যকারীর বিবেচনায় তাগূত। কেননা সে তার নিজের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। যেহেতু আল্লাহ তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তার অনুসারীরা তাকে তার চেয়ে উঁচু মর্যাদা দেয়। ফলে এই উপাস্যের উপাসনা করা, নেতার অনুসরণ করা এবং অনুসৃত ব্যক্তির আনুগত্য করা তখন ‘তুগইয়ান’ বা তাগূতী কর্ম বিবেচিত হয়, ওই সকল কাজের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন করার কারণে।” [আল-ক্বাওলুল মুফীদ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩০]
আমি বলছি, কাউকে তাগূত বলে আখ্যা দেওয়ার মানে এই নয় যে, সেই (আখ্যাপ্রাপ্ত) ব্যক্তি কাফির। কেননা এই সম্ভাবনা আছে যে, সে তাগূত হয়েছে তার অনুসারীদের বিবেচনায়, তাঁর নিজের বিবেচনায় নয়।
খ. আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব জড়পদার্থের উপাসনা করা হয়, ‘উলামাগণ সেসবকেও তাগূত আখ্যা দিয়েছেন। আর এটা সুবিদিত যে, জড়পদার্থকে মুসলিম আখ্যা দেওয়া হয় না, যা কাফিরের বিপরীত।
ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, قال ابن قتيبة : كل معبود ؛ من حجر أو صورة أو شيطان : فهو جبت وطاغوت. وكذلك حكى الزجاج عن أهل اللغة “ইবনু কুতাইবাহ বলেছেন, পাথর, ছবি, কিংবা শয়তান-সহ যত রকমের উপাস্য আছে, তার সবই জিবত ও তাগূত। একইভাবে আয-যুজাজ ভাষাবিদদের থেকে এমনটি বর্ণনা করেছেন।” [নুযহাতুল আ‘ইয়ানিন নাওয়াযির, পৃষ্ঠা: ৪১০; তাগূত অধ্যায়]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, وهو اسم جنس يدخل فيه : الشيطان والوثن والكهان والدرهم والدينار وغير ذلك “এটি একটি জাতিবাচক বিশেষ্য, যার মধ্যে শয়তান, মূর্তি, গণক, দিরহাম, দিনার প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়।” [মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৬; পৃষ্ঠা: ৫৬৫]
আমি বলছি, যদি সকল তাগূত কাফিরই হতো, তাহলে জড়পদার্থকে তাগূত বলা সিদ্ধ হতো না।
গ. ‘উলামাগণ কাফির নয় এমন পাপীদেরকেও তাগূত বলেছেন। রাগিব আসফাহানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, الطاغوت عبارة عن : كل متعدٍّ وكل معبود من دون الله. ولما تقدم : سُمّي الساحر والكاهن والمارد من الجن والصارف عن طريق الخير : طاغوتًا “আল্লাহকে বাদ দিয়ে উপাসনা করা হয় এমন প্রত্যেক উপাস্য ও সীমালঙ্ঘনকারীকে তাগূত বলা হয়। আর পূর্বে গত হয়ে গেছে যে, জাদুকর, গণক, অবাধ্য জিন এবং কল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুতকারীকে তাগূত বলা হয়।” [আল-মুফরাদাত, পৃষ্ঠা: ১০৮]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, والطواغيت كثيرة، والمتبين لنا منهم خمسة : أولهم الشيطان وحاكم الجور وآكل الرشوة ومن عُبد فرضي والعامل بغير علم “তাগূতের সংখ্যা অনেক। তবে তাদের মধ্যে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট তাগূত পাঁচটি। যথা: (১) তাদের প্রথমজন হলো শয়তান, (২) অত্যাচারী শাসক, (৩) ঘুষখোর, (৪) যার উপাসনা করা হয়, আর সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, (৫) না জেনে ‘আমলকারী।” [আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৩৭]
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, علماء السوء الذين يدعون إلى الضلال والكفر أو يدعون إلى البدع أو إلى تحليل ما حرم الله أو تحريم ما أحل الله : طواغيت “মন্দ ‘উলামা, যারা ভ্রষ্টতা ও কুফরের দিকে আহ্বান করে, অথবা বিদ‘আতের দিকে আহ্বান করে, কিংবা আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল করা বা আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার দিকে আহ্বান করে, তারা তাগূত।” [শারহূ সালাসাতিল উসূল, পৃষ্ঠা: ১৫১]
আমি বলছি, যদি সকল তাগূত কাফিরই হতো, তাহলে এরকম নিরঙ্কুশভাবে তাগূত আখ্যা দেওয়া জায়েজ হতো না। অন্যথায় এ থেকে একথা বলা আবশ্যক হয়ে যায় যে, তাঁরা (‘উলামারা) পাপকাজ (যা বড়ো কুফর নয়) করার কারণে কাফির আখ্যা দেন।
·
দ্বিতীয় দিক: এর ফলে আহলুস সুন্নাহ যার কাফির না হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে, তাকে কাফির আখ্যা দেওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। আর সে ওই ব্যক্তি, যে পাপকাজ তৈরি করে। যেহেতু প্রণয়ন বা তৈরি করার দিক থেকে গুণাহপ্রণেতা এবং আইনপ্রণেতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেননা উভয়েই হারাম বিষয় প্রণয়নের পাপে নিপাতিত হয়েছে।
এর দৃষ্টান্ত: একদল লোক ডাকাতি করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। এ মর্মে তারা দলের নেতা নিযুক্ত করল এবং দলের জন্য কিছু নিয়মকানুনও তৈরি করল। এই দলের নেতা তাদেরকে (অন্যায়ের দিকে) আহ্বান করে, পাশাপাশি সীমালঙ্ঘন করা, ডাকাতি করা এবং মুসলিমদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করার নিমিত্তে তাদের জন্য নিয়মকানুন তৈরি করে, আর তারা তা পালন করে। সে তাদেরকে আদেশ করে, আর তারা সে আদেশ মান্য করে। সে তাদেরকে নিষেধ করে, আর তারা তার নিষেধ মান্য করে। ফলে এই লোক গুনাহ রচনাকারীতে পরিণত হয়। অথচ সে কাফির নয়।
আমি বলছি, যেই মূলনীতির ওপর সংবিধান প্রণয়নকারীকে কাফির বলার ব্যাপারটি ভিত্তিশীল হয়েছে, সেই মূলনীতি যদি সঠিকই হতো, তাহলে এই লোককে (ডাকাতদলের নেতা) কাফির আখ্যা দেওয়া আবশ্যক হয়ে যেত। অথচ সে গুনাহগার ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে কাফির না বলার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে।
চতুর্থ মাসআলাহ:
তালিবুল ‘ইলমদের মধ্যে এই প্রকার নিয়ে ব্যাপক মতোবিরোধ থাকা সত্ত্বেও যুগশ্রেষ্ঠ তিন বিদ্বান—ইবনু বায, আলবানী ও ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আইনপ্রণেতাকে কাফির না বলার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, فإذا سن قانونًا يتضمن أنه لا حد على الزاني، أو لا حد على السارق : فهذا قانون باطل، وإذا استحله الوالي كفر “সে যদি আইন প্রণয়ন করে, যেই আইনের মধ্যে আছে—ব্যভিচারীর (শরিয়ত নির্ধারিত) দণ্ড নেই, চোরের দণ্ড নেই, তাহলে তার এই আইন বাতিল। আর শাসক যদি এই কর্মকে হালাল মনে করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।” [মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১২৪]
সংবিধান রচনাকারী আইন প্রণয়ন করাকে হালাল মনে না করলে কাফির হবে না—মর্মে ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)’র বক্তব্য দেখুন, সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূরের ৮৪৯ নং অডিয়ো ক্লিপে (৭২ মিনিট থেকে)।
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, الحكم بغير ما أنزل الله ليس بكفر مخرج عن الملة، لكنه كفر عملي [ = أصغر ] ؛ لأن الحاكم بذلك خرج عن الطريق الصحيح. ولا يفرّق في ذلك بين الرجل الذي يأخذ قانونًا وضعيًا من قبَل غيره ويحكمه في دولته وبين من ينشيء قانونًا ويضع هذا القانون الوضعي؛ إذ المهم هو هل هذا القانون يخالف القانون السماوي أم لا “আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য কারও বিধান দিয়ে ফায়সালা করা দ্বীন থেকে খারিজকারী কুফর নয়। বরং এটা আমলগত (ছোটো) কুফর। কেননা এর ফলে শাসক সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অন্যের প্রণীত কোনো আইনকে গ্রহণ করে, আর সে আইন অনুযায়ী তার দেশে শাসন করে, তার মধ্যে এবং যে ব্যক্তি আইন প্রণয়ন করে, আর সেই আইনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে—এই ব্যক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু এখানে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, সে আসমানী বিধানের বিরোধিতা করছে কি না।” [ফিতনাতুত তাকফীর, পৃষ্ঠা: ২৫; ১নং টীকা দ্রষ্টব্য]❞
·তথ্যসূত্র:
শাইখ বুনদার আল-‘উতাইবী (হাফিযাহুল্লাহ), আল-হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ; পৃষ্ঠা: ২৮-৩২; বাদশাহ ফাহাদ লাইব্রেরি, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৯ হিজরি (২য় প্রকাশ); বইটির ভূমিকা লিখেছেন সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সদস্য ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ বিন হাসান আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)।
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/
0 Comments