▌আহলুস সুন্নাহর তাকদির বিশ্বাস [২য় পর্ব]

আহলুস সুন্নাহর তাকদির বিশ্বাস [২য় পর্ব]

·রচয়িতা: আল্লামা সালিহ বিন আব্দুল আযিয আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)
·[পরিচ্ছেদ: তাকদিরের আকিদায় ভ্রষ্ট হয়েছে যারা]
আহলুস সুন্নার এই বরকতময় আকিদাতে যার ইচ্ছা সে বিরোধিতা করুক, যার ইচ্ছা সে বাধা দিক, আল্লাহর পথ থেকে ফিরে যাক এবং আল্লাহর কুরঅানের আয়াত ও নবির সুন্নাতের বিকৃত বুঝ বুঝুক। যেখানে পানশালা ভিন্ন, সেখানে তো চিন্তাফিকির ভিন্ন হবেই।

যারা তাকদিরের আকিদায় আহলুস সুন্নাহর বিরোধী মত পোষণ করে, তারা দুটি দলের অন্তর্ভুক্ত। সংক্ষেপে আমি তা উল্লেখ করছি। দল দুটি হলো (১) কাদারিয়্যাহ ফির্কা (২) জাবরিয়্যাহ ফির্কা।
(১) কাদারিয়্যাহদের মধ্যে আবার দুটি দল। এক. চরমপন্থি কাদারিয়্যাহ, দুই. মধ্যপন্থি কাদারিয়্যাহ, যারা চরমপন্থি নয়।
এক. চরমপন্থি কাদারিয়্যাহরা আল্লাহর পূর্বজ্ঞানকে অস্বীকার করে। তারা বলে, ‘কোনো বিষয় সংঘটিত হওয়ার পরেই কেবল আল্লাহ তা জানতে পারেন।’ সর্বপ্রথম সীসওয়াইহ নামের এক অগ্নিপূজক এই জঘন্য আকিদা মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। সে ছিল বুশরাবাসী বিদ‘আতী। এ ধরনের চিন্তাভাবনা সে মা‘বাদ আল-জুহানীর কাছে প্রকাশ করে। আর মা‘বাদও বুশরায় থাকত। এই আকিদা সে-ই জানসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। সে বলে বেড়াত, কাজই সর্বাগ্রে, মহান আল্লাহ কাজ সংঘটিত হওয়ার আগে কিছুই জানেন না। এটাকে মহান আল্লাহর মানহানি করার শীর্ষপর্যায় বলা যায়।

আল্লাহ কি আপনার মতো অপূর্ণ? না। বরং তিনি স্বীয় নাম এবং গুণাবলি সহকারে পরিপূর্ণ (তাতে কোনো অপূর্ণতা নেই)। তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন। অথচ সেই মা‘বাদ এই ভ্রষ্ট বিদ‘আতী আকিদা মানুষের মাঝে প্রচার করে, আর মানুষরা সেটাই গ্রহণ করে। তাদেরকে বলা হয় চরমপন্থি কাদারিয়্যাহ। তারা আল্লাহর পূর্বজ্ঞান অস্বীকার করে।

এ কারণে তাদের ব্যাপারে বিজ্ঞ আলিমগণ বলে থাকেন, তোমরা আল্লাহর ‘ইলমের ব্যাপারে কাদারিয়্যাহদের সাথে মুনাযারা করো। যদি তারা ‘আল্লাহর ইলম’ সিফাতটি স্বীকার করে, তাহলে তো তারা পরাভূত হয়ে গেল। আর যদি অস্বীকার করে বলে, আল্লাহ জানেন না, তাহলে তাদেরকে ‘কাফির’ বলতে হবে। তারা যখন বলবে, আল্লাহ সবকিছু জানেন, তখনই তারা হেরে যাবে। মুনাযারা খতম!

দুই. কাদারিয়্যাহদের দ্বিতীয় দল হচ্ছে মুতাজিলা ফের্কা। কাদারিয়্যাহ মানেযারা তাকদির অস্বীকার করে, কিংবা তাকদিরের কোনো একটি স্তর অস্বীকার করে।

মুতাজিলাদের মতে, আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনিই সবকিছুর লেখেছেন। কিন্তু তারা বলে, আল্লাহ বান্দার কর্ম সৃষ্টি করেননি। এরা মুতাজিলা ফের্কা।

অথচ বান্দার কর্মাবলি আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, هَلْ مِنْ خَٰلِقٍ غَيْرُ ٱللَّهِআল্লাহ ব্যতীত কোনো স্রষ্টা আছে কি?” [সুরা ফাতির: ৩] আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। [*] মুতাজিলারা অগ্নিপূজকদের মতো বিভ্রান্তিকর আকিদা পোষণ করে। মূলত এটা অগ্নিপূজকদের আকিদা। কেননা তারা সৃষ্টিকর্তার একাধিক অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, দুজন স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। এদিকে মুতাজিলারা আরও বাড়িয়ে বলে, প্রত্যেক মানুষ তার নিজের কর্মের স্রষ্টা। তাহলে কতগুলো সৃষ্টিকর্তা হলো! আল্লাহর পানাহ, আল-‘ইয়াযু-বিল্লাহ।

[(*) অনুবাদকের টীকা: এছাড়া আরও অনেক দলিল আছে। যেগুলো প্রমাণ করে, বান্দার কর্মাবলি আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, এবং তোমাদের কর্মকেও।’ (সুরা সাফফাত: ৯৬) নবিজি বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক কর্মকার ও তার কর্মকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সিলসিলাহ সহিহাহ, হা/১৬৩৭; সনদ: সহিহ) টীকা সমাপ্ত।]

তাদেরকে চরমপন্থা-বর্জিত কাদারিয়া বলা হয়। কারণ তারা আল্লাহর পূর্বজ্ঞান স্বীকার করে। কিন্তু তারা ‘আল্লাহ যে বান্দার কর্মেরও স্রষ্টা’এ কথাটি অস্বীকার করে থাকে। তারা বলে, বান্দাই তার নিজের কর্মের স্রষ্টা।

(২) আরেকটি ফের্কা হচ্ছে জাবরিয়্যাহ। তারাও দু ভাগে বিভক্ত। এক. চরমপন্থি জাবারিয়্যাহ, দুই. মধ্যপন্থি জাবারিয়্যাহ, যারা চরমপন্থি নয়।

এক. চরমপন্থি জাবারিয়্যাহরা জাহাম বিন সফওয়ানের অনুসারী। তার পূর্বে তারা জা‘দ বিন দিরহাম বা তাদের সমমনা বিদ‘আতীদের অনুসারী ছিল। তারা বলে, মানুষ তার কর্মে প্রবল বায়ুসঞ্চালনের জায়গায় পাখির পালকের মতো। নিজের কর্ম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা বা এক্তিয়ার তার নেই। [অর্থাৎ সে আল্লাহর হুকুমে মজবুর; পাখির পালক বায়ুতে যেমন বায়ুর বিপরীতে নড়াচড়া করতে পারে না, ঠিক তেমনি মানুষও আল্লাহর হুকুমের বাইরে চলতে পারে না। – অনুবাদক]

এ কথা যে বলে, আমি তাকে থাপ্পড় দিব। তুমি আমার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে কী দলিল উত্থাপন করবে? এ কাজ করতে যদি আল্লাহই আমাকে পরিচালনা করেন এবং বাধ্য করে থাকেন, তাহলে তুমি কেন আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবে? কারও কাছ থেকে যদি কিছু চুরি যায়, তাহলে সে তা পেতে চায়। বলে, ‘তুমি কেন চুরি করলে?’ আমার প্রয়োজন হয়েছে, তাই করেছি। আমি এক্ষেত্রে নিরুপায়, মজবুর।

আসলে তারা কাজের স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু মুনাজারায় তারা এটা অস্বীকার করে বলে, ‘বান্দা বায়ুসঞ্চালনের জায়গায় পাখির পালকের মত।’ নিঃসন্দেহে এটা ফালতু ও ভ্রান্ত কথা। এ কথা মানুষের স্বাভাবিক বিবেকের পরিপন্থি। কেননা প্রত্যেকেই জানে, তার নিজের ইচ্ছা আছে এবং তাতে সে স্বাধীন। সেজন্য আপনি ইচ্ছা করলে একটা বাড়িতে যেতে পারেন, আবার সেখানে না যেয়ে অন্যের বাড়িতেও যেতে পারেন। আসলে তাদের কথা বাতিল। স্বাভাবিক বিবেক কখনোই তা মেনে নেবে না।

·
[পরিচ্ছেদ: তাকদিরের আকিদায় আশারি-মাতুরিদিদের ভ্রান্তি ও তার ব্যবচ্ছেদ] (*)

দুই. পক্ষান্তরে মধ্যপন্থি জাবারিয়্যারা মূলত ‘আশারি’ নামে পরিচিত। তারা মনে করে, বান্দা তার কাজ নিজে সৃষ্টি করেনি, আল্লাহই তার কাজের স্রষ্টা। কিন্তু তারা কার্যকারণ বা উপায়-উপকরণ এবং তার প্রভাব অস্বীকার করে। তারা বলে, আগুনে পাতা পড়লে আগুন তা পোড়ায় না, বরং তা পোড়ান স্বয়ং আল্লাহ। চাকু রুটি-গোশত কাটে। কিন্তু তারা বলে, চাকু এটা করে না। বরং চাকু যখন চালানো হচ্ছে, তখন আল্লাহই গোশত-রুটি কাটছেন। এভাবে তারা কার্যকারণ বা উপায় অস্বীকার করে থাকে।

[(*) অনুবাদকের টীকা: বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় আশারি-মাতুরিদিদের ওপর স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদ করা হলো। যদিও তা পূর্বের পরিচ্ছেদের আওতাভুক্ত। টীকা সমাপ্ত।]

অথচ বান্দা পাপকাজ-সহ অনেক কাজই করে। এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কী হবে? তারা বলবে, এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান হচ্ছে, তারা শুধু কাজ অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা কাজ করে না।
তারা কাজ অর্জন করে’এর মানে কী? তাদের মতে, বান্দা তার কাজের মুখোমুখি হওয়ার সময় আল্লাহ তা সৃষ্টি করেন। প্রকৃতপ্রস্তাবে বান্দা নিজে তার কাজ সম্পাদন করে না।

তারা মনে করে, কাজকর্মে বান্দা কেবল কর্মস্থল। আল্লাহ বান্দার জন্য যা তাকদিরে রেখেছেন, বান্দা সেটাই করে। এতে বান্দা কেবল তাকদিরের বাস্তবায়নস্থল। আপনি আশারিদের কথা খেয়াল করলে তা দেখতে পাবেন। তারা আজ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

উদাহরণস্বরূপ আরও বলা যেতে পারে, এই যে আপনি এখন মসজিদের মধ্যে আছেন। তারা বলবে, এটা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বলেই আপনি এই স্থানে অবস্থান করছেন। তারা এর নাম দিয়েছে, كسب (উপার্জন)। তাদের মতে, প্রকৃতপক্ষে বান্দা নিজের কর্ম সম্পাদন করে না, বরং তারা শুধু كسب বা উপার্জন করে।

এই কাস্‌ব বা উপার্জনের পরিচয় কী? তাদের উলামারা এ মাসআলাহয় মতানৈক্য করে বারোটিরও অধিক মত পেশ করেছে। তাদের প্রত্যেকেই এর স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের ইমাম আবুল হাসান আল-আশারি এর কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় দেননি। তাদের এ ধরনের বিস্তর মতানৈক্য দেখে বোঝা যায়, তারা নিজেদের আকিদা সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল নয়।

কবি সত্যই বলেছেন,
مما يقال ولا حقيقة تحته~ معقولة تدنو لذي الأفهام
الكسب عند الأشعري والحال~ عند البهشمي وطفرة النظام
সমঝদারের কাছেও অধরা রয়ে যায় যেসব ভাষার সমঝ ও বাস্তবতা,
যথাক্রমে তা আশারির ‘কাস্‌ব’, বাহশামির ‘হাল’ ও নাযযামের ‘তুফরা’।”

সুতরাং আশারিদের নিকটে كسب (উপার্জন) মানে বান্দা শুধু কর্মস্থল, সে নিজে কাজ সম্পাদন করে না। এতে সে মজবুর তথা বাধ্য।

তাই বলতে হয়, তাদের বিচক্ষণ পণ্ডিতরা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছে, তারা জাবারিয়্যাহ। যদিও তারা জাবারিয়্যাহ হওয়া থেকে পলায়ন করতে চায়। মূলত তাদের নিজেদের আকিদার পাঠ্যবইগুলোর ব্যাখ্যাগ্রন্থে তাদের পণ্ডিতবর্গ উল্লেখ করেছে, তারা জাবারিয়্যাহ। তারা আবার বলে, আমরা মনে করি বান্দা বাধ্য। কিন্তু এই বাধ্যতা বাতেনি অবস্থায় প্রযোজ্য, জাহেরি অবস্থায় নয়। জাহেরি অবস্থায় বান্দা নিজ কর্মে স্বাধীন। কিন্তু বাতেনি অবস্থায় সে বাধ্য বা মজবুর। কারণ সে আল্লাহর সৃষ্টি ও তাকদির বাস্তবায়নের ক্ষেত্র মাত্র। বান্দা কখনো কাজ করে না; সে শুধু অর্জন করে।

একটু খেয়াল করুন। এই ‘কাস্‌ব (অর্জন)’ শব্দটা আহলুস সুন্নার আকিদার কিতাবেও আছে। যেমন, লুম‘আতুল ই‘তিকাদ ও শারহুল আক্বীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ গ্রন্থে। তারা এর যথাযথ ব্যাখ্যা করে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا ٱكْتَسَبَتْসে তাই পাবে, যা সে উপার্জন করেছে এবং তাই তার ওপর বর্তাবে, যা সে করেছে।” [সুরা বাকারাহ: ২৮৬]

কিন্তু তারা উক্ত শব্দের মাধ্যমে উল্লিখিত বাতিল পরিভাষা না বুঝিয়ে কুরআন-সুন্নাহয় যা আছে তাই বুঝিয়েছেন। এজন্য আকিদার কিতাবগুলোর বিভিন্ন অস্পষ্ট বিষয়াদি শোধন করা দরকার। সেসব শব্দ ভালোভাবে স্পষ্ট করতে হবে, যেগুলোর মাধ্যমে আহলুস সুন্নাহ অন্যান্য বিদ‘আতী ভ্রষ্ট ফের্কার সাথে মিলে যাওয়ার সম্ভবনা রাখে।

আর তাই আমরা ‘কাস্‌ব (উপার্জন)’ শব্দটি ব্যবহার করলে তা স্পষ্টভাবে শারঈ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব। এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিব; শব্দটি বলে চুপ থাকব না। আমরা স্পষ্ট করে দিব, ‘কাস্‌ব (উপার্জন)’ হচ্ছে ওই উপার্জন, যার ফল তার কর্তার ওপর নিপাতিত হয়, হতে পারে সেটা ভালো কিংবা মন্দ। যেমন আয়াতটির প্রথমাংশে বলা হয়েছে, ‘সে তাই পাবে, যা সে উপার্জন করেছে।’ অর্থাৎ ভালো কিছু পাবে। আর পরের অংশে বলা হয়েছে, ‘তাই তার ওপর বর্তাবে, যা সে করেছে।’ অর্থাৎ খারাপ কিছু বর্তাবে। ‘কাস্‌ব (উপার্জন)’ শব্দটা কুরআনে ঐ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যে কাজের ফল তার কর্তার উপকারেও আসতে পারে, আবার ক্ষতিও হতে পারে।

কিন্তু আশারি-মাতুরিদিরা এ কথা বলে না। আশারিরা যে জাবরিয়্যাহ মতবাদ পোষণ করে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। অপরদিকে মাতুরিদিরা মুতাজিলি আকিদা ধারণ করে। কেননা তারা কাদারিয়্যাহ মতবাদ পোষণ করে। তারা ‘কাস্‌ব (উপার্জন)’ শব্দটার ক্ষেত্রে বলে, ‘অবশ্যই বান্দার ইরাদাহ বা ইচ্ছা থাকতে হবে। আর ইরাদাই বাস্তবায়িত হয়।’ তা এই ইরাদাহ (ইচ্ছা) কি আল্লাহর থেকে উদ্ভূত নাকি বান্দার থেকে?

মাতুরিদিরা বলে, এটা বান্দার থেকে উদ্ভূত। এ কথা বলে তারা মুতাজিলাদের আকিদা পোষণ করেছে।
আর আশারিরা বলে, এটা আসে স্বয়ং রবের পক্ষ থেকে। এ কথা বলে এরা আবার জাবারিয়্যাহদের মত পোষণ করেছে। অর্থাৎ তাদের মতানুযায়ী ইচ্ছা, শক্তি, কর্ম এবং যা অর্জিত হয় সব আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়; সেখানে বান্দা স্রেফ কর্মক্ষেত্র মাত্র।

এসব ভ্রান্ত আকিদা ভালোভাবে নিরিখ করলে আপনি বুঝতে পারবেন, আহলুস সুন্নাহই মধ্যপন্থি। তারা বান্দার কর্মের স্বাধীনতা আছে বলে মনে করে। তারা বলে, বান্দা তার নিজের কাজ সত্যাসত্যই করে থাকে। কাজ করার পর অনুভব করে, সে কাজটি করেছে। কিন্তু কাজটি তৈরি করেছেন মহান আল্লাহ। ইচ্ছা ব্যতিরেকে স্রেফ কুদরত (শক্তি-সামর্থ্য) দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না। আপনার কুদরত আছে, কিন্তু ইচ্ছা না থাকলে কাজটি সংঘটিত হবে না।

আপনি মসজিদে যাবেন, অথচ আপনার যাওয়ার ইচ্ছা নেই, তাহলে আপনার মসজিদে যাওয়া সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে এমনও হতে পারে, আপনার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার শক্তি আপনার নেই। আপনি বলছেন, আমি মসজিদে যাব, কিন্তু আমার শক্তি-সামর্থ্য নাই, আমি নড়তে পাড়ছি না, আমি অবশ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছি। তাহলে কি কাজ সম্পাদন হওয়া সম্ভব? না, সম্ভব নয়।

তাহলে ইচ্ছা ও শক্তি-সামর্থ্য ছাড়া কোনো কাজ সম্পাদিত হয় না। আর আপনার মধ্যে ইচ্ছা তৈরি করেছেন এবং আপনাকে শক্তি-সামর্থ্য দিয়েছেন মহান আল্লাহ।

প্রকৃতপক্ষে আপনি যে ইচ্ছা ও শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে কাজ করছেন, তা আল্লাহর সৃষ্টি। এজন্য আপনার কাজকর্মও আল্লাহর সৃষ্ট। আপনি আপনার স্বাধীনত ও ইচ্ছা অনুভব করতে পারেন। মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন, وَهَدَيْنَٰهُ ٱلنَّجْدَيْنِআমি তাকে দুটো পথ প্রদর্শন করেছি।” [সুরা বালাদ: ১০] একটি ভালোর পথ, আরেকটি মন্দের। আল্লাহ আরও বলেছেন, قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّىٰهَا - وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّىٰهَاযে নিজেকে শুদ্ধ করে, সে হয় সফলকাম। আর যে নিজেকে কলুষিত করে, সে হয় ব্যর্থ মনোরথ।” [সুরা শামস: ৯-১০]আপনার কী করা প্রয়োজন, তা আপনি আপনার অন্তরে অনুভব করেন।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সত্যনিষ্ঠ আকিদা হচ্ছে, বান্দা নিজের কর্মে স্বাধীন; সে ইচ্ছা করলে এই পথটি গ্রহণ করতে পারে, আবার অন্যটিও গ্রহণ করতে পারে। আল্লাহ রব্বুল ইজ্জাত বলে দিয়েছেন, وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًاকোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দিই না।” [সুরা বনি ইসরাঈল: ১৫] আল্লাহ হেদায়েতের জন্য রাসূল পাঠিয়েছেন এবং কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আপনি যদি হেদায়েতের ডাকে সাড়া দেন, তাহলে আপনি সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হবেন, আর সাড়া না দিলে হতভাগাদের দলভুক্ত হবেন।

·
[পরিচ্ছেদ: মানুষের ইচ্ছা ও কর্মস্বাধীনতা-সহ সমগ্র তাকদির-বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা]

এখন কেউ বলতে পারে, আপনি যে বিষয়টি আলোকপাত করছেন, তা কি এখন আছে? আর এসব আলোচনা কি ফলপ্রসূ হবে?

আমরা বলব, হ্যাঁ, কিছু সময় খুবই ফলপ্রসূ হবে। কেননা আমরা অনেক মানুষকে দেখি, যারা তাকদিরের দোহাই দেয়। আপনি তাকে বলেন, ‘তুমি সালাত পড় না কেন?’ সে বলবে, ‘আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দেননি!’ ‘সেটা কীভাবে?’ সে বলে বসবে, ‘হেদায়েত দিলে তো সালাত পড়তাম।’ অথচ আল্লাহ আপনাকে হেদায়েতের পথ দেখিয়েছেন। আপনাকে তা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আপনি নিজে তা অনুসরণ করেননি। তাহলে বলুন, কীভাবে আপনি নিজের দোষ ও কলঙ্ককে ডিফেন্ড করতে গিয়ে এ কথা বলে হুজ্জতি করেন যে, আল্লাহ না চাওয়ায় আপনি হেদায়েত হননি?!

শরয়ীভাবে আল্লাহ আপনাকে হেদায়েতের পথে চলতে বলেছেন, কিন্তু আপনি সে পথে চলতে অস্বীকার করেছেন। আর তাই আপনি হেদায়েত পাননি। তাহলে ‘আল্লাহ চাইলেই হেদায়েত দিতে পারতেন’এমন কথা বলে আপনি দলিল পেশ করতে পারছেন না। আর এই যুক্তি দিয়ে আপনার সাথে যে বিবাদ করতে আসে, অবশ্যই আপনি তার সাথে আলোচনা করবেন এবং তাকে পরাভূত করবেন। ফলে তার ওপর হুজ্জত (দলিল) কায়েম হয়ে যাবে।

বর্তমানে জাবারিয়্যাদের মতাদর্শ মূলত হাদাসিদের অতিপ্রচলিত মতাদর্শে কিংবা কার্টারের মতো কতিপয় পশ্চিমার মতাদর্শে পরিণত হয়েছে; যারা অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী। তারা বলে, মানুষই সব করে, মানুষই সকল কাজের কাজি। ফলে তারা তাকদির অস্বীকার করে। তাদের মতানুসারে মানুষই সব করে, তাই আপনি যা চান তাই হবে, আপনি যা চান না, তা হবে না। এই আকিদা বর্তমানে মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে। আর হাদাসিদের বিশ্বাস, চালচলন ও রীতিনীতি সম্পর্কে আপনারা অবগত আছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়তির ব্যাপারে অস্তিত্ববাদীদের আকিদা পোষণ করে। এজন্য এ ব্যাপারে সজাগ থাকুন।

উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি পৃথিবীর প্রাচ্য ও প্রাতিচ্যকে দুভাগে ভাগ করেন, তাহলে দেখবেন, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, পাকিস্থান-সহ বিভিন্ন দেশের রাফেজি-শিয়ারা তাকদিরের আকিদায় মুতাজিলা। তালিবুল ইলমরা কীভাবে তাদের রদ করবে? মানুষের আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ হলে তো তা সম্ভব হবে না। তাই তাদেরকে জানতে হবে, যাতে তারা (ভ্রান্ত আকিদার) রদ করতে সামর্থ্যবান হয়।

তদনুরূপ আশআরিরাও দারস দেওয়া-নেওয়া করছে। কখনো কখনো তারা (সহিহ আকিদার) সমালোচনা করছে। কখনো এমন সব বিষয় আলোচনা করছে, যেগুলোর ব্যাপারে সজাগ হওয়া দরকার। তাই অবশ্যই একজন ছাত্রকে তাদের আকিদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে। আবার এমন কিছু বই আছে, যেগুলোতে বাতিল মতাদর্শ পুশ করা হয়েছে।

এখন (কুরআন, হাদিস, কিংবা তাফসির পড়তে গিয়ে) ‘তৌফিক’ শব্দটি আপনার দৃষ্টিগোচর হলো। তারা আপনার কাছে এর অর্থ করবে। যেমন হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তৌফিক মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে।’ কিংবা কুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ ছাড়া আমার কোনো তৌফিক নেই।’ [সুরা হুদ: ৮৮] বাতিল ফের্কা আশারিরা তৌফিকের কী ব্যাখ্যা করে? তারা ব্যাখ্যা করে, তৌফিক মানে কুদরত বা শক্তি-সামর্থ্য। তাদের মতানুসারে আসলে তাদের স্বতন্ত্র কোনো শক্তি-সামর্থ্য নেই, ইমানের প্রতি ভালোবাসা ও খাস হেদায়েতও নেই। এখানে আল্লাহ বান্দাকে তৌফিক দিলেন, এর মানে আল্লাহ তাকে সামর্থ্যবান করলেন। সে শুধু আল্লাহর শক্তির ক্ষেত্র মাত্র। এটা আশারিদের মতবাদ।

আমি মুতাজিলাদের তাফসিরে পড়েছি, তারা বলে, তৌফিক মানে সাহায্য করা (الإعانة)সুতরাং ‘আল্লাহ ছাড়া আমার কোনো তৌফিক নেই’, এর মানে আল্লাহ ছাড়া আমার কোনো সহয়তা নেই। তাদের এই ব্যাখ্যা করার কারণ কী?কারণ এর মূলে রয়েছে কুদরত-তত্ত্ব। মহান আল্লাহ বান্দার কর্ম সৃষ্টি করেছেন। আর কুদরতও আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। তারা বলে, এজন্য কোনো কাজ করার সক্ষমতা-সহযোগিতা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। (যেখানে বান্দা কর্মক্ষেত্র মাত্র – অনুবাদক)

সুতরাং হে তালেবুল ইলম, আপনি কী পড়ছেন, তা খেয়াল করুন। তাহলে আহলুস সুন্নাহর আকিদা বিষয়ক জ্ঞান আপনার আকল-বিভ্রান্তিকর বাতিল আকিদা থেকে আপনাকে রক্ষা করবে। বিদ‘আতীদের ব্যাপারে এখানে অনেক দীর্ঘ কথা বলা যাবে। আমি আপনাদের সামনে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করলাম।

·
[পরিচ্ছেদ: মুমিনের জীবনে তাকদিরের প্রতি বিশ্বাসের অভাবনীয় প্রভাব]

এখন আমরা আল্লাহর তাকদির ও ফায়সালার প্রতি ইমানের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা আল্লাহর তাকদির ও ফায়সালার প্রতি বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের অন্তরে এর প্রভাব কী?তাকদিরের ভালোমন্দের প্রতি বিশ্বাস কি মানবজীবনে গুরুতর কোনো প্রভাব ফেলে? তাকদিরের মাধ্যমে একজন বিশ্বাসীর জন্য কি ওই ব্যক্তি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সম্ভব, যে বিশ্বাস করে না?

হ্যাঁ, এর প্রভাব রয়েছে। আমরা আহলুস সুন্নাহর যে আকিদা, ইমানের মূলনীতি উল্লেখ করেছি, তা স্রেফ মস্তিষ্কপ্রসূত বাচনিক আলাপ নয়। এ আলোচনা মানবজীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। যেমন আল্লাহর অনুবর্তী হওয়া, তাঁকে ভালোবাসা ও তাঁর সম্পর্কে জানার মতো মহান বিষয়ের সাথেও তা মিশে আছে। জ্ঞানের মাধ্যমেই তারা তাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হবে এবং তাঁকে ভালবাসতে শিখবে। তাহলে এর প্রভাব ও পরিণতি আসলে কী?

প্রথমত, তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস মানে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর নাম ও গুনাবলির প্রতি বিশ্বাস। আপনি তাকদিরের প্রতি ইমান এনেছেন, এর মানে আপনি বিশ্বাস করেন, আল্লাহ সবকিছুই করতে সক্ষম। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌআল্লাহ সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।” [সুরা হাশর: ৬] ফলে কোনো কিছুই আপনার কাছে কঠিন মনে হবে না। কারণ আপনি মহান আল্লাহর নান্দনিক নাম ‘কাদির’ এর প্রতি ইমান এনেছেন।

তাকদিরের প্রতি ইমান মানেআল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা মহান সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাস। কেননা আল্লাহই যাবতীয় বিষয়ের পরিচালক। তাকদিরের প্রতি আপনার ইমান যখন পাকাপোক্ত হয়ে যাবে, তখন আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, তিনিই আপনার মহান রব, আর আপনি তাঁর গোলাম। তাঁর রাজত্বে কেবল তাঁরই হুকুম চলে, যেখানে আপনি একজন দুর্বল-অসহায় বান্দা। তাহলে দুর্বল-নিঃস্ব বান্দা কার অভিমুখী হবে? অবশ্যই সে বিশুদ্ধচিত্তে ও সর্বান্তকরণে তাঁর অভিমুখী হবে, যিনি মহান শক্তিধর ও প্রতাপশালী রব।

সুতরাং তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছে, আপনি খুবই দুর্বল, অসহায়, প্রতিটি কাজে আপনি আল্লাহর মুখাপেক্ষী। যেই আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। মহান আল্লাহ বলেন, لِتَعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ ٱللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَىْءٍ عِلْمًۢاযাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং স্বীয় জ্ঞান দিয়ে সবকিছুকে বেষ্টন করে আছেন।” [সুরা তালাক: ১২] এটা তাকদিরের প্রতি বিশ্বাসের ফল। তাকদিরের প্রতি ইমান আপনার যত বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর প্রতি ইমান তত বেড়ে যাবে।

কোনো বিপদে পড়লে আপনি বুঝবেন, এ বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। তখন আপনি তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং ইমানের বলে বলীয়ান হবেন। তাকদিরের প্রতি বিশ্বাসের ফলে মহান আল্লাহর প্রতি আপনার ইমান বেড়ে যাবে। এজন্য আপনি দেখতে পাবেন, যারা বিশ্বাস করে, তাকদিরের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে, তাদের ইমানের লেভেল অনেক উঁচুতে। খেয়াল করলে দেখবেন, আল্লাহর প্রতি তাদের প্রীতি-ভালোবাসা, আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়ার ঐকান্তিকতা এবং তাঁর পরিচিতি বিষয়ক জ্ঞান-গরিমা তাঁদের অনেক অনেক বেশি থাকে, অন্যান্য মানুষের চেয়ে।

দ্বিতীয়ত, আহলুস সুন্নার আকিদা অনুযায়ী আমরা বলি, তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস উপায় অবলম্বনের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন ওমর বিন খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, “আমরা এক তাকদির থেকে ফিরে আরেক তাকদিরের দিকে যাচ্ছি।” তাই আপনাকে অবশ্যই উপায় অবলম্বন করতে হবে, এটাও আপনার তাকদির-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কার্যকারণ সম্পাদন করাও আল্লাহর তাকদিরের আওতাভুক্ত। আপনি কর্ম সম্পাদনের সাথে সাথে ঐ সত্ত্বার প্রতি ভরসা করবেন, যিনি চিরঞ্জীব ও অমরণশীল।

এ বিশ্বাসই হবে আপনার জীবনের চালিকাশক্তি। এর ফলে আপনি কাজে নিয়োজিত হবেন এবং ফল লাভ করবেন। তাতে এ উম্মাহ শক্তিশালী হবে। আর এজন্যই সাহাবিগণ একে অপরের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতেন না। তাঁরা তাকদির বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাই বলে তাঁরা মনে করতেন না, আল্লাহ আমাদের ওপর আসমান থেকে সোনা বর্ষণ করবেন। বরং আবশ্যিকভাবে কর্ম সম্পাদন করতে হবে, এবং উৎপাদনকার্যে মনোযোগ দিতে হবে।

আহলুস সুন্নাহ কর্মফলকে বিন্যস্ত করে কাজের ওপর। তাই তাদের তাকদির-বিশ্বাস মানবতাকে করে তোলে উজ্জীবিত, শক্তিশালী ও কঠোর পরিশ্রমী। সমগ্র উম্মত ও তার প্রত্যেক সদস্য কাজকর্মে ব্রতী হয়। আপনি মুসলিমদের পশ্চাদ্‌গামিতার সময়কাল পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবেন, তারা কাজ করত না। বলত, আল্লাহই আমাকে খাওয়াবেন, ইনশাআল্লাহ। অথচ আল্লাহ কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর আল্লাহ আপনাকে তৌফিক দিবেন, আপনার জীবিকার বন্দোবস্ত করবেন।

কিন্তু আপনি যদি ঘোষণা দেন, ‘নভোমণ্ডল থেকে আমার জন্য সোনারূপা নাজিল হবে’, তাহলে কীভাবে হয়, বলুন? আল্লাহ বলেছেন, قُلْ هَاتُوا۟ بُرْهَٰنَكُمْ إِن كُنتُمْ صَٰدِقِينَআপনি বলে দিন, তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে প্রমাণ উপস্থিত করো।” [সুরা বাকারা: ১১১] আসলে আপনার অলীক দাবির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

সুতরাং তাকদিরের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে, কাজের ফল কেবল কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। তাই আপনাকে উপায় অবলম্বন করতে হবে, আর কাজে ব্রত হতে হবে। মনে রাখবেন, উপায় অবলম্বন করা তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। তাই আপনি কাজকর্মে পরিশ্রমী হোন। সেই সাথে জেনে রাখুন, সবকিছু মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বর্ণনা অনুযায়ী, তাকদিরের প্রতি বিশ্বাসের ফলে বান্দার অন্তর আল্লাহর প্রতি প্রশান্ত হয়। সে বিপদে পড়লেও সন্তুষ্ট থাকে, আল্লাহর ফায়সালার সামনে আত্মসমর্পণ করে। আবার কল্যাণপ্রাপ্ত হলে দাম্ভিক বনে যায় না, অতি-আনন্দিত অপরাধী হয় না। সে জানে, সবকিছু দেওয়ার মালিক আল্লাহ। প্রাপ্ত কল্যাণটুকু যেমন তার জন্য পরীক্ষা, তেমন বিপদ-আপদ-দুর্যোগও তার জন্য যাচাই-নিরীক্ষা। ইরশাদ হয়েছে, وَنَبْلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلْخَيْرِ فِتْنَةًۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَআমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” [সুরা আম্বিয়া: ৩৫]

সে জানে সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত হয়। তিনি বলেছেন, “তাদের কোনো কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোনো অকল্যাণ হয়, তাহলে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে। বলে দিন, এ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে তাদের পরিণতি কী হবে, যারা কখনও কোনো কথা বুঝতে চেষ্টা করে না? আপনার যে কল্যাণ হয়, তা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় আপনার নিজের কারণে।” [সুরা নিসা: ৭৮-৭৯]

মহান আল্লাহ সুরা নিসায় বলেছেন, “আপনার যে কল্যাণ হয়, তা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় আপনার নিজের কারণে।” এই আকিদা যখন অন্তরে বিদ্যমান থাকে, তখন অন্তর হয় প্রশান্ত। ঐশ্বর্যবান হয়েও সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় না। আবার দরিদ্র হলেও সে চিন্তা-বিপর্যস্ত ও আশাহত হয় না। তাকে কেবল এতটুকু জানতে হবে, কাজ করা তার জন্য অপরিহার্য, আর বাকিটুকু আল্লাহর ওপর সোপর্দিত।

তাকদির-বিশ্বাসের প্রভাবটা লক্ষ করেন। এ বিশ্বাস ইমানদারদের মধ্যে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা তৈরি করে। তাইতো সাহাবিগণ যখন তাকদিরের প্রতি যথোচিত ইমান আনয়ন করেছেন, তখন তাঁদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃসুলভ ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। একজন আরেকজনকে যে হিংসা করে, এটা কোথা থেকে আসে?

হিংসুক লোক বলে, ‘আরে, এ দেখি বাড়ি বানিয়ে ফেলল! সে কাজ করল, আর ধনী হয়ে গেল! আমি বুঝতে পারছি না, সে এত সম্পদ পেল কোথায়?’
আবার একজনের যা আছে অন্যের তা না থাকলে, সে তার ভাইয়ের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়। মনেপ্রাণে কামনা করে, আল্লাহ তার ভাইকে দেওয়া সামগ্রী ছিনিয়ে নিন। আসলে সে তাকদিরের প্রতি যথোচিত ইমান আনতে পারেনি। কেননা তার ভাইকে যা দেওয়া হয়েছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে সে যখন হিংসাবশত ওই ভাইয়ের ধ্বংস কামনা করে, তখন সে যেন আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরের বিরুদ্ধবাদী হয়ে ওঠে।

তাকদিরের প্রতি যথার্থ বিশ্বাস থাকলে সে মনে করত, তার ভাইয়ের কাছে যা এসেছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। সেই নেয়ামত তার জন্য পরিক্ষাস্বরূপ। আর আপনি যে পাননি, সেটাও একটা পরিক্ষা। কখনো কখনো কমের মধ্যেই কল্যাণ থাকে, যেমন বেশির মধ্যও থাকে অকল্যাণ।

এখানেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস অন্তর থেকে হিংসা দূরীভূত করে। কেননা সে জানে, যদি তাকে হিংসা করে, তাহলে সে আল্লাহর ফায়সালার বিরুদ্ধবাদী হয়ে যাবে। এজন্য সে আর মানুষকে হিংসা করবে না। আল্লাহ বলেছেন, أَمْ يَحْسُدُونَ ٱلنَّاسَ عَلَىٰ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضْلِهِনাকি যা কিছু আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে দান করেছেন, সে বিষয়ের জন্য তারা মানুষকে হিংসা করে?” [সুরা নিসা: ৫৪] হিংসা বড়ো নিন্দার কাজ। হিংসা ভালো আমলকে গলাধঃকরণ করে, যেমন আগুন গিলে ফেলে কাঠখড়ি।

কেননা তাকদিরের প্রতি ইমানের জন্য হিংসা একটি ত্রুটি, অন্তরায়। মনে রাখা উচিত, আল্লাহই দেন, আবার আল্লাহই বঞ্চিত করেন। তাহলে হিংসা কেন? হৃদয়ে যখন তাকদিরের বিশ্বাস হবে দৃঢ়মূল, হিংসা-বিদ্বেষ তখন হয়ে যাবে ধৃত-অপসৃত। ইমানদাররা দুনিয়াতেই ভাই ভাই হয়ে স্ব স্ব আসনে সহাবস্থান করবে। আর আখেরাত, সে তো আরও মধুর! তারা থাকবে একসাথে, শাহী পালঙ্কে, পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে। আমরা মহান আল্লাহর বদান্যতা কামনা করছি।

এগুলো তাকদিরের প্রতি বিশ্বাসের কিছু ফল ও পরিণতি, এর আরও কতগুলো ফল ও উপকারিতা আছে। কিন্তু কলেবর সংক্ষেপ করার জন্য সেগুলো উল্লেখ করা যাচ্ছে না। এ থেকেই আহলুস সুন্নাহর বর্কতময় আকিদার শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায়। এ যেন জ্যোতির ওপর জ্যোতি, এ আকিদা অন্তর ও কর্মের জ্যোতি; আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির্ময় পথ দেখান। যে তা গ্রহণ করে, সে বিশাল ঐশ্বর্যই গ্রহণ করে।

বিশেষ করে তালিবুল ইলমরা অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে তাওহিদকে এবং তাওহিদের আলোচনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিবে। কেননা এ জ্ঞান আল্লাহ-সম্পর্কে জানার জ্ঞান। আর যে কোনো জ্ঞান তার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়ের বদৌলতেই শরাফত অর্জন করে। তাই সবার সেরা জ্ঞান মূলত তাওহিদের জ্ঞান। এজন্য যারা অন্য বিষয়ের ওপর যেরূপ গুরুত্ব দিচ্ছে, অথচ তাওহিদের প্রতি সেরূপ গুরুত্ব দিচ্ছে না, তাদের কাজটি ত্রুটিপূর্ণ।

তাই আমরা অবশ্যই তাওহিদকে গুরুত্ব দিব এবং তা আমাদের বাসাবাড়িতে প্রচার করব। আমরা তাওহিদের প্রকার ও তাওহিদের মূলনীতি শেখাব, তদ্‌সংশ্লিষ্ট মৌলিক পুস্তিকার দারস দিব। যাতে আল্লাহর প্রতি মানবহৃদয়ের ভালোবাসা ও শঙ্কামিশ্রিত শ্রদ্ধা পূর্ণতা পায়। আর শঙ্কা, আশা ও ভালবাসাযোগে আল্লাহর প্রতি ইবাদত নিবেদন করে। সেই সাথে হেদায়েত আর সত্যের ওপর ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবিচলতা অর্জিত হয়। এতে করে অজস্র কল্যাণ হাসিল হবে।

·
[পরিচ্ছেদ: একনজরে আহলুস সুন্নাহর তাকদির বিশ্বাস ও উপসংহার]

এখন সংক্ষেপে আমি যা বলেছি, তা আবার পুনরাবৃত্তি করছি। তাকদির সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা হচ্ছে, আপনি বিশ্বাস করবেন, আল্লাহ অনন্তকাল থেকে সৃষ্টি সম্পর্কে জানেন, তাঁর জ্ঞান পূর্ব থেকেই রয়েছে, যে পূর্বের কোনো সীমা নেই। কিয়ামত অবধি সৃষ্টিজগতের সমস্ত কর্মাবলি তিনি লিখে রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবে; আর সবকিছু তাঁর ইচ্ছাতেই বাস্তবায়িত হয়, অনিচ্ছায় কিছু হয় না। আর আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা; আপনার মন্দ কাজও আল্লাহরই সৃষ্টিযা আপনি সত্যাসত্যই করেন, আনুষঙ্গিকভাবে নয়।

আপনার স্বাধীন ইচ্ছা আছে। ভালো-মন্দ যে কোনো পথে আপনি স্বেচ্ছায় চলতে পারেন। আর এই এখতিয়ারের ব্যাপারে আপনার হিসাব নেয়া হবে। আর আল্লাহ জানেন, আপনি কোনটা গ্রহণ করবেন এবং আপনার ওপর কী বর্তাবে। এসব কিছু তিনি লাওহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন। আপনি ইতোপূর্বে জেনেছেন, এই আকিদাতে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। তাদের ভ্রষ্টতার মূল কারণ, তারা তাকদিরের গোপন বিষয়াদির পেছনে পড়েছে। তারা বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন তালাশ করেছে এবং ভ্রষ্টতায় পতিত হয়েছে।

কেন এবং কীভাবে’প্রশ্ন দুটি গোপন বিষয়। যদি তাকদিরের গোপন বিষয়ে ‘কেন হলো এবং কীভাবে হলো’ এ জাতীয় প্রশ্ন করা হলে কোনো ফলাফলে পৌঁছা যাবে কি? না, পৌঁছা যাবে না।

এমনি একটি ব্যাপার হলো রূহ। রূহের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, قُلِ ٱلرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّى وَمَآ أُوتِيتُم مِّنَ ٱلْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًاবলে দিন, রূহ আমার পালনকর্তার আদেশ ঘটিত। এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।” [সুরা বানি ইসরাইল: ৮৫] রূহ আপনার নিকটেই আছে। আপনি কি জানেন তা দেখতে কেমন, তা কীভাবে আপনার মধ্যে প্রবেশ করে, আর কীভাবে সঞ্চালিত হয়? এও কি জানেন, আপনি কীভাবে স্বপ্ন দেখেন?

এসব আপনার মধ্যেই হচ্ছে, অথচ আপনি জানেন না। এমনকি আপনার সবচেয়ে কাছের জিনিস সম্বন্ধেও আপনি জানেন না। যেমন লোম; যা আপনার মুখে উদ্‌গত হয়, অথচ আপনি জানেন না তা কীভাবে বের হয়, আর কীভাবেই বা বাড়ে!
তাহলে আপনি কীভাবে আল্লাহর গুপ্তবিষয় তাকদির নিয়ে তত্ত্বতালাশ করেন? এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ‘তা-ইতাহিল কাদারিয়্যাহ’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যাতে তিনি মুসলিমদের মাঝে তাকদির নিয়ে সংশয় সৃষ্টিকারী জনৈক জিম্মি ইহুদির খণ্ডন করেছেন।

এ বিষয়ে ভ্রষ্টতার আসল কারণ কী তা তিনি বয়ান করেছেন। যা থেকে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি এবং নিজেকেও সাবধান করছি। শাইখুল ইসলাম বলেছেন, وأصل ضلال الخلق من كل فرقة ~ هو الخوض في فعل الإله بعلةসব ফের্কার ভ্রষ্টতার মূল আছে যে কারণ, তা হচ্ছে রবের কর্মের হেতু-ইল্লত অন্বেষণ।’

আল্লাহ এটা কেন করলেন, কীভাবে করলেনএমন প্রশ্ন করা হয়। অথচ এগুলো আল্লাহর সৃষ্টির গোপন বিষয়। আপনি কি আল্লাহর ফায়সালার বিরুদ্ধাচারণ করতে চান? না কি তাঁর মতো জানতে চান? আরে ভাই, আপনি তো তাঁর পালিত-নগণ্য বান্দা মাত্র। শাইখুল ইসলাম বলেছেন, فإنهم لم يفهموا حكمة له ~ فصاروا على نوع من الجاهليةতাদের বুঝে আসে না রবের হিকমাহ বিভিন্ন, তাই তো সে হয়ে যায় জাহেলিয়াতে বিপন্ন।’

তারা আল্লাহর হিকমাহ বুঝে না। আসলে সৃষ্টিকুল যদি আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞা জেনেই যেত, তাহলে তাদের মধ্যে আর রবের মধ্যে পার্থক্য কী থাকত?

এখন আপনারা একটু মুসা ও খিজির (আলাইহিমাস সালাম) এর কথা খেয়াল করুন। খিজির (আলাইহিস সালাম) বিদ্যাবত্তায় মুসা (আলাইহিস সালাম) কে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এমন কিছু কাজ করেছিলেন, যা মুসার জানা ছিল না। তিনি নৌকা ফুটো করে দিলেন। মুসা কেবল বাহ্যিক দিকটাই দেখলেন। ‘আপনি কি এর আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্যে এতে ফুটো করে দিলেন? নিশ্চয় আপনি বড়োই গুরুতর মন্দ কাজ করলেন।’ [সুরা কাহাফ: ৮১]

মুসা জিজ্ঞাসা করলেন, তাদের ডুবিয়ে দেয়ার জন্য আপনি তাতে ছিদ্র করলেন? অথচ এতে তাদের জন্য কল্যাণ ছিল, যা তিনি জানতেন না। মুসা একজন নবি হয়েও তা জানতেন না। কিন্তু খিজির জানতেন আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের কথা। মহান আল্লাহ বলেছেন, ءَاتَيْنَٰهُ رَحْمَةً مِّنْ عِندِنَا وَعَلَّمْنَٰهُ مِن لَّدُنَّا عِلْمًاযাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম, আর আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম বিশেষ জ্ঞান।” [সুরা কাহফ: ৬৫]

এরপরে খিজির এক বালককে হত্যা করলেন, যে খেলাধুলা করছিল। সুবহানআল্লাহ। মুসা বললেন, ‘আপনি প্রাণের বিনিময় ব্যতিরেকেই একটি নিষ্পাপ জীবন শেষ করে দিলেন!’ [সুরা কাহাফ: ৭৪]মুসা দুনয়নে যা দেখছেন, কেবল তাই জানেন। অাভ্যন্তরীণ বিষয় তো তাঁর জানা নেই। আর জানবেনই বা কী করে?! তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, একটা বালককে আপনি হত্যা করে দিলেন?

তৃতীয় পর্যায়ে খিজির এক গ্রামে গেলেন। তিনি সেখানে মেহমান হিসেবে থাকতে চাইলেন। কিন্তু তারা মেজবানি করতে অস্বীকৃতি জানাল। বলল, আমরা তোমাদের মেজবানি করব না। তখন খিজির সে গ্রামের একটি ভূপতিত দেওয়াল সোজা করে দিলেন। মুসা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলে তো তাদের কাছ থেকে এর পারিশ্রমিক আদায় করতে পারতেন।’ [সুরা কাহফ: ৭৭]

অর্থাৎ আপনি তাদের থেকে বিনিময় নিন। কেননা তারা আমাদের সম্মান করেনি। অথচ আপনি তাদের ভালো করছেন!মুসা বাহ্যিক দিক দেখেছেন। আর খিজিরের আছে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান।যদিও তার কাজ বাহ্যিক দিক থেকে ভালো না, কিন্তু তাতে রয়েছে আল্লাহর প্রজ্ঞা। তিনি খিজিরকে পাঠিয়েছিলেন মুসার জ্ঞানের স্বল্পতা বোঝাতে। কারণ মুসা বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’ তাঁকে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, তিনি যাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান করতে পারেন।

দুই সৃষ্ট বান্দামুসা আর খিজিরের জ্ঞানের মধ্যে যদি এমন পার্থক্য হয়, তাহলে আপনার এবং আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে কেমন পার্থক্য হতে পারে? আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার সাথে আপনার জ্ঞান ও ক্ষমতার তুলনাই হতে পারে না। তাহলে আপনি গোপন জিনিস জানবেন কীভাবে? আর কীভাবে হলো, তাই বা জানবেন কী করে?

তাই আপনারা ‘কীভাবে হলো এবং কেন হলোএমন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলো শয়তান প্রবেশদ্বার। এসব থেকে নিজেকে বাচিয়ে চলুন। আর উক্ত ঘটনটি স্মরণ করুন। প্রত্যেক শুক্রবারে (সুরা কাহফ) পড়ুন। জানুন, তাতে কী কী প্রামাণিকতা, উপদেশ, আর প্রজ্ঞা আছে। ব্যাপারটা খেয়াল করুন, মানুষ হয়ে মানুষের কর্ম সম্পর্কে জানতে পারে না, কর্মের হকিকত উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়, বরং সেই কাজের ব্যাপারে আপত্তি করে। অথচ ওই কাজেই রয়েছে কল্যাণ, ওই কাজেই রয়েছে হিকমাত।

সুতরাং আল্লাহর কর্মাবলি দেখে আপনার স্বল্প সমঝ আর সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে তা ব্যাখ্যা করতে চান কীভাবে? নিঃসন্দেহে এ কাজ চরম ভ্রষ্টতার নামান্তর। মহান আল্লাহ তার পূর্ণ প্রজ্ঞায় মাখলুকের থেকে বিলকুল আলাদা। আল্লাহ বলেছেন, “আপনি বলে দিন, অতএব পরিপূর্ন প্রজ্ঞা আল্লাহরই। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে পথ প্রদর্শন করতেন।” [সুরা আনআম: ১৪৯]

তিনি আরও বলেন, قُلْ ءَأَنتُمْ أَعْلَمُ أَمِ ٱللَّهُআপনি বলে দিন, তোমরা বেশি জান, না আল্লাহ বেশি জানেন?” [সুরা বাকারা: ১৪০] নিঃসন্দেহে তিনিই সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান। আল্লাহর কাছে কামনা করি, তিনি যেন আমাদের ও তোমাদের হেদায়েতের পথ আলোকিত করে দেন, আমাদেরকে পরহেজগারদের অন্তর্ভুক্ত করেন, আর আমাদের সন্তানসন্ততিদের তৌফিক দেন, তাঁকে রাজিখুশি করার তৌফিক।

আমাদের মাঝে যে বিভ্রান্তিতে আছে, তাকে তিনি সঠিকতা দান করুন, আর যে গাফিল, তাকে হেদায়েত দিন। আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানসন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন, পাশাপাশি আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করার তৌফিক দিন। ইয়া আল্লাহ, আমাদের নবি মুহাম্মাদের ওপর দয়া ও শান্তির বারিধারা বর্ষণ করুন।
·তথ্যসূত্র:
·ভাষান্তর: আব্দুর রহমান মৃধা
পরিমার্জনা: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা


Post a Comment

0 Comments