অল্প পরিশ্রমে অনেক বড় সওয়াব
অধ্যায়ঃ অল্প পরিশ্রমে অনেক বড় সওয়াব
আমরা সবাই অল্প পরিশ্রমে বেশি পাওয়ার আশা রাখি। আল্লাহ তাআ’লা হচ্ছেন আর-রহ’মান (অত্যন্ত দয়াময়), আল-কারীম (মহানুভর দানশীল), আল-ওহহাব এবং আল-গানী (ধনী, প্রাচুর্যপূর্ণ)। আর সেইজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে এমন কিছু ইবাদত তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যেইগুলো দ্বারা আমরা খুব সহজেই অনেক বড় সওয়াব ও মর্যাদা পেতে পারি। পরকালের ব্যপারে আশাবাদী দ্বীনি ভাই ও বোনদের জন্য এমন কিছু সহজ আমল বর্ণনা করা হলো। আল্লাহ তাআ’লা আমাদের সবাইকে এই আমলগুলো আয়ত্ত করার তোওফিক দান করুন, আমিন।
(১) একবার, তিনবার বা দশবার সুরা ইখলাস পাঠ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা ইখলাস সম্পর্কে বলেছেন, “নিঃসন্দেহে এই (সুরা ইখলাস) ক্বুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।” সহীহ মুসলিমঃ ৮১২, তিরমিযীঃ ২৮৯৯।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার সাহাবীদেরকে বললেন, “তোমরা কি রাতে এক তৃতীয়াংশ ক্বুরআন পড়তে পার না?” প্রস্তাবটি সাহাবাদের কাছে কঠিন মনে হল। তাই তাঁরা বলে উঠলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! এই কাজ আমাদের মধ্যে কে করতে পারবে?” আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, “ক্বুল হুওয়াল্লাহু আ’হাদ, আল্লাহুস স্বামাদ, (সুরা ইখলাস) ক্বুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।” (অর্থাৎ এই সুরা পড়লে ক্বুরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়ার সমান।) সহীহ বুখারীঃ ৫০১৫, নাসায়ীঃ ৯৯৫, আবু দাউদ ১৪৬১।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি সুরা ইখলাস দশ বার পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানানো হবে।” সহীহ আল-জামি আস-সগীরঃ ৬৪৭২।
(২) অধিক পরিমান দুরুদ পাঠ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ এর প্রতিদান হিসেবে তার উপর দশটি রহমত (করুণা) অবতীর্ণ করবেন।” সহীহ মুসলিমঃ ৩৮৪, তিরমিযীঃ ৩৬১৪, নাসায়ীঃ ৬৭৮, আবু দাউদঃ ৫২৩, আহমাদঃ ৬৫৩২।
(৩) জান্নাতের একটি ধন-সম্পদের ভাণ্ডারঃ
একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীকে বলেছিলেন, “হে আব্দুল্লাহ ইবন কায়েস! আমি কি জান্নাতের ধন-সম্পদের একটি ভাণ্ডার সম্পর্কে তোমাকে অবহিত করব না?” সেই সাহাবী বললেন, “নিশ্চয়ই হে আল্লাহর রাসুল।” আল্লাহর রাসুল বললেন, “তুমি বল,
لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ
بِاللَّهِ
উচ্চারণঃ লা- হা’উলা ওয়ালা ক্বুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লা-হ।
অর্থঃ আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎ কাজ করার) কোনো শক্তি কারো নেই। সহীহ বুখারীঃ ৪২০৬, সহীহ মুসলিমঃ ২৭০৪।
দিনে-রাতে যেকোন সময় এই যিকির বেশি বেশি করে অনেক বড় সওয়াব অর্জন করা যায়।
(৪) জামাতের ৫-১০ মিনিট পূর্বে মসজিদে গিয়ে প্রথম কাতারে স্থান দখল করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “লোকেরা যদি জানত যে, আযান দেওয়া ও সালাতের প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর মধ্যে কি ফযীলত রয়েছে, তাহলে (আযান দেওয়া ও প্রথম কাতারে স্থান পাওয়ার জন্য) যদি লটারী ছাড়া অন্য কোন উপায় না থাকতো, তবে তারা অবশ্যই সেই ক্ষেত্রে লটারীর সাহায্য নিত।” সহীহ বুখারীঃ ৬১৫, সহীহ মুসলিমঃ ৪৩৭, তিরমিযীঃ ২২৫।
(৫) ইশা ও ফযরের সালাত জামাতের সহিত আদায় করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইশা সালাতের জামাতে হাযির হবে তার জন্য অর্ধেক রাত পর্যন্ত কিয়াম (নফল সালাত আদায়) করার সমান নেকী হবে। আর যে ব্যক্তি ইশা সহ ফজর সালাত জামাতের সহিত আদায় করবে, তার জন্য সারারাত ধরে কিয়াম করার সমান নেকী হবে।” সহীহ মুসলিমঃ ৬৫৬, তিরমিযীঃ ২২১, আবু দাউদঃ ৫৫৫, আহমাদ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুনাফিকদের নিকট সর্বাধিক কঠিন ও ভারী সালাত হচ্ছে ইশা ও ফজরের সালাত। এই দুই সালাত আদায়ের মধ্যে কি পরিমান কল্যাণ ও সওয়াব রয়েছে, যদি তারা সে সম্পর্কে জানত তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা এই দুই সালাতের (জামাতে) অংশগ্রহণ করত।” সহীহ বুখারীঃ ৬৫৭, সহীহ মুসলিমঃ ৬৫১।
(৬) ফযর সালাতের পর জায়নামাযে বসে থেকে সূর্য উঠা পর্যন্ত ক্বুরআন তেলাওয়াত, বিভিন্ন যিকির-আযকার ও দুয়া-দুরুদ পড়ে সময় অতিবাহিত করা এবং সূর্য উঠার পর ইশরাকের দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাআ’তে আদায় করে, অতঃপর সূর্য উঠা পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহ তাআ’লার যিকর করে, তারপর দুই রাকাত সালাত আদায় করে, তার জন্য একটি হজ্জ ও একটি উমরার সমান সওয়াব রয়েছে।” আনাস রাদিয়াল্লাহ আ’নহু আরো বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পূর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণ (একটি হাজ্জ ও একটি উমরার সমান সাওয়াব)।”
উৎসঃ তিরমিযীঃ ৫৮৬, তাআ’লীকুর রাগীবঃ ১/১৬৪, ১৬৫, মিশকাতঃ ৯৭১। হাদীসটিকে শায়খ আব্দুল আ’জিজ ইবনে বাজ রাহিমাহুল্লাহ ‘হাসান লিগাইরি’ এবং শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন।
নারীরা যদি ফযরের পরে এই আমল করেন তাহলে তারাও এই সওয়াব পাবেন ইন শা আল্লাহ।
(৭) দ্বীন শিক্ষা দেওয়া অথবা দ্বীন শেখার উদ্দেশ্যে কোন মসজিদে গমন করাঃ
রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্য নিয়ে মসজিদে যায় যে, সে নিজে কোন কল্যাণকর জিনিস (ইলম) শিখবে অথবা অন্যকে শিক্ষা দিবে তাহলে সে এমন একজন হাজীর সমান সওয়াব পাবে, যে তার হজ্জ সম্পাদন করেছে।” আত-তাবারানী, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
(৮) কোন মুসলিমকে সাহায্য করার জন্য তার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটাঃ
রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মদীনার এই মসজিদে (অর্থাৎ মসজিদে নববীতে) এক মাস ইতিকাফ করার চাইতে কোন এক মুসলমান ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে তার সাথে হাঁটা আমার কাছে অধিক প্রিয়।” হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আসবাহানী এবং ইবনে আবি দুনিয়া। শায়খ সাঈদ রাসলান হা’ফিজাহুল্লাহ হাদীসটি ‘হাসান লি গায়রি’ বলেছেন।
(৯) সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম বিতরণ ও নেক সন্তান গড়ে তোলাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র তিনটি আমল মৃত্যুর পরও বাকী থাকে (এবং সেইগুলোর সওয়াব আমলকারীর কবরে পৌঁছানো হয়)। সেইগুলো হচ্ছে (ক) সদকায়ে জারিয়া, (খ) উপকারী জ্ঞান এবং, (গ) এমন নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করবে।” সহীহ মুসলিমঃ ১৬৩১, তিরমিযীঃ ১৩৭৬।
হাদীসটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কিছু কথাঃ
(ক) “সদকায়ে জারিয়া” কথাটির অর্থ হচ্ছে এমন দান বা সাদাকাহ, যার সুফল অব্যাহত থাকে। যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করা বা সাহায্য করা। (খ) “উপকারী জ্ঞান” যেমন মানুষের মাঝে উপকারী জ্ঞান বিতরণ করা, বই প্রকাশ বা প্রচার করা, দ্বীন শিক্ষার্থীদের খচর চালানো ইত্যাদি, যার ফলে মৃত্যুর পরও তার জ্ঞানের মাধ্যমে অন্য মানুষের উপকার অব্যাহত থাকে।
রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, “এমন সাতটি জিনিস রয়েছে, যা বান্দার মৃত্যুর পরে কবরে থাকা অবস্থাতেও তার জন্য সওয়াব জমা করতে থাকেঃ (১) এমন ব্যক্তি যাকে সে শিক্ষা দিয়েছে, (২) যেই খাল সে খনন করেছে, (৩) যেই কূপ সে নির্মাণ করেছে, (৪) যেই খেজুর গাছ সে রোপন করেছে, (৫) যেই মসজিদ সে নির্মান করেছে, (৬) যেই ক্বুরআন সে দান করেছে এবং (৭) এমন সন্তান, যে সেই বান্দার মৃত্যুর পর তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।” আল-বাজ্জারঃ ৭২৮৯, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, জামি আস-সাগীর।
এই হাদীসটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কিছু কথাঃ
(২+৩) অন্য সহীহ হাদীসে রয়েছে মানুষের মাঝে পানি বিতরণ করার জন্য পানির উৎস যেমন কুয়া বা পুকুর খনন করা শ্রেষ্ঠ সাদাকাহ সমূহের একটি। যেহেতু বর্তমান যুগে এইগুলোর প্রচলন কম, তাই বর্তমান যুগে এইগুলোর পরিবর্তে নলকূপ, পানির মটর বা ফিল্টার বিকল্প বলে গণ্য হবে।
(৪) হাদীসে নির্দিষ্টভাবে খেজুর গাছের কথা বলা হলেও, আম, জাম, কাঁঠাল, এমন যে কোন ফলদায়ক গাছ লাগানো সাদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত এবং তার জন্য অনেক বড় সওয়াব রয়েছে। কোন ব্যক্তির লাগানো ফলের গাছ থেকে ফল কোন পাখি খেলে, কোন মানুষ খেলে, কোন মানুষ বা পশু এর ছায়ায় বসলে, এই সবগুলো গাছের রোপনকারী ব্যক্তির জন্য সাদাকাহ হিসেবে কবুল হবে।
(১০) ইশার পরে চার রাকাত নফল সালাত আদায় করাঃ
আ’ব্দুল্লাহ ইবনে আ’মর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইশার পরে চার রাকাত সালাত আদায় করে, এটা তার জন্য লায়লাতুল ক্বদরে চার রাকাত সালাত আদায় করার মতোই।” মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহঃ ২/৩৪২।
আ’য়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা বলেছেন, “ইশার পরে চার রাকাত সালাত লায়লাতুল ক্বদরে চার রাকাত সালাত আদায় করার মতোই।” মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহঃ ২/৩৪২।
এই চার রাকাত সালাত দুই দুই রাকাত করে নফল সালাতের নিয়তে পড়তে হবে। এর জন্য বিশেষ কোন নিয়ম নেই, যেকোন সুরা ক্বিরাত দিয়ে পড়া যাবে।
(১১) সকাল ও সন্ধ্যায় ফযীলতপূর্ণ এই যিকির তিনবার পড়াঃ
মুমিনদের জননী জুয়াইরিয়াহ বিনতে হারেস রাদিয়াল্লাহু আ’নহা হতে বর্ণিত। একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ভোরবেলা ফজরের সালাত শেষ করে তাঁর নিকট থেকে বাইরে গেলেন। আর তিনি তাঁর জায়নামাজে বসে (যিকির-আযকারে লিপ্ত) থাকলেন। তারপর চাশতের সময় আল্লাহর নবী যখন ফিরে এলেন, তখনও জুয়াইরিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা সেখানে বসে (যিকিরে লিপ্ত) ছিলেন। এটা দেখে আল্লাহর নবী তাঁকে বললেন, “আমি যে অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে বাইরে গেলাম সে অবস্থাতেই তুমি রয়েছ?” তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার নিকট থেকে যাবার পর আমি চারটি বাক্য তিনবার পড়েছি। যদি সেইগুলিকে তোমার সকাল থেকে (এ যাবৎ) পঠিত দুয়া (ও যিকিরের) মুকাবিলায় ওজন করা যায়, তাহলে তা ওজনে সমান হয়ে যাবে। আর তা হচ্ছে এই যে,
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ: عَدَدَ
خَلْقِهِ، وَرِضَا نَفْسِهِ، وَزِنَةَ عَرْشِهِ وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ
উচ্চারণঃ সুবহা’নাল্লা-হি ওয়া বিহা’মদিহী, আ’দাদা খালক্বিহী, ওয়া রিদ্বা নাফসিহী, ওয়া যিনাতা আ’রশিহী, ওয়া মিদা-দা কালিমা-তিহি।
অর্থঃ আমি আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি; তাঁর সৃষ্টির সমান সংখ্যক, তাঁর নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, তাঁর আরশের ওজন বরাবর ও তাঁর বাণীসমূহের সমান সংখ্যক প্রশংসা।
সহীহ মুসলিমঃ ২৭২৬, তিরমিযীঃ ৩৫৫৫। উল্লেখ্য, আল্লাহর কথা বা বাণীর কোন শেষ নেই।
(১২) পূর্বের ও পরের সমস্ত মুসলিমদের জন্য দুয়া করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একটি করে সওয়াব আল্লাহ তার আমলনামায় লিখে দেন।” আত-তাবারানী, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
শায়খ আব্দুর রাজ্জাক্ব বিন আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে সেই ব্যক্তি প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একটি করে সওয়াব পাবে। কেউ যদি এই বলে দুয়া করে, “আয় আল্লাহ! আমার এবং সকল মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, জীবিত ও মৃত, সবার গুনাহ আপনি মাফ করে দিন”, তাহলে এর প্রতিদান হিসেবে আদম আ’লাইহিস সালাম থেকে কেয়ামত পর্যন্ত, এই দুনিয়াতে বসবাসকারী কোটি কোটি মুসলিম সবার জন্য একটি করে সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে।”
আপনারা নিজের জন্য, নিজের পিতা-মাতার জন্য এবং সমস্ত মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীদের ক্ষমা প্রার্থনার জন্য ছোট্ট, সুন্দর এই কুরআনী এই দুয়াটা মুখস্থ করে নিতে পারেনঃ
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ
وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
উচ্চারণঃ রব্বানাগ-ফিরলি ওয়ালি ওয়ালি-দাইয়্যা ওয়ালিল মু’মিনিনা ইয়াওমা ইয়াক্বুমুল হি’সাব।
অর্থঃ হে আমাদের পালনকর্তা! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সকল ঈমানদার লোকদেরকে আপনি সেইদিন ক্ষমা করে দিও যেইদিন হিসাব কায়েম করা হবে। সুরা ইব্রাহিমঃ আয়াত ৪১।
(১৩) অসুস্থ মুসলিমদের দেখতে যাওয়াঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন কোন ব্যক্তি তার কোন অসুস্থ মুসলিম ভাইকে দেখতে যায় তখন সে না বসা পর্যন্ত যেন জান্নাতের ফল আহরণে বিচরণ করতে থাকে। অতঃপর যখন সে (রোগীর পাশে) বসে (আল্লাহর) রহমত তাকে ঢেকে ফেলে। (রোগীকে দেখতে যাওয়ার) সেই সময়টা যদি হয় সকাল বেলা, তাহলে সত্তর হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত তার ক্ষমা ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করতে থাকে। আর যদি সময়টা হয় বিকাল বেলা, তাহলে সত্তর হাজার ফেরেশতা সকাল হওয়া পর্যন্ত তার ক্ষমা ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করতে থাকে।” তিরমিযীঃ ৯৬৯; ইবন মাজাহঃ ১৪৪২, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী, সহীহুত তিরমিযী।
(১৪) বাজারে প্রবেশ করার দুয়া পড়াঃ
বাজারে প্রবেশ করার সময় নীচের এই দুয়া পড়লে আল্লাহ তাআ’লা
(ক) তার আমলনামায় দশ লক্ষ সওয়াব দান করবেন,
(খ) তার আমলনামা থেকে দশ লক্ষ গুনাহ মুছে দেবেন,
(গ) তার মর্যাদা দশ লক্ষ গুণ উন্নীত করবেন,
(ঘ) জান্নাতে তার জন্য একটা ঘর বানাবেন।
সহীহ তিরমিযীঃ ২/১৫২; হাকিমঃ ১/৫৩৮। দুয়াটা হচ্ছেঃ
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ
لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ، وَهُوَ
حَيٌّ لاِ يَمُوتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণঃ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ’দাহু লা শারীকালাহ; লাহুল-মুলকু ওয়ালাহুল হা’মদু ইয়ুহ’ঈ ওয়াইয়ুমীত; ওয়াহুয়া হা’য়্যুল-লা ইয়ামুত; বিয়াদিহিল খাইর, ওয়া হুওয়া আ’লা কুল্লি শাই’ইং ক্বাদীর।
অর্থঃ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তাঁর কোনো শরিক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসা শুধুমাত্রই তাঁর। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন। আর তিনি চিরঞ্জীব, তার মৃত্যু নেই। সকল প্রকার কল্যাণ তাঁর হাতে নিহিত। তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিরমিযীঃ ৩৪২৮; ইবন মাজাহঃ ৩৮৬০; হাকেম ১/৫৩৮। শাইখ আলবানী হাদীসটিকে হাসান হাদীস বলেছেন।
উল্লেখ্যঃ বাজার হচ্ছে গাফিলতি, ঔদাসীন্যের জায়গা যেখানে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়, দুনিয়া নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ে। এছাড়া সেখানে খারাপ লোক বেশি জমা হয় যারা মিথ্যা, প্রতারণা, নারীদেরকে উত্যক্ত করা, খারাপ পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে দেখা-সাক্ষাত, গান-বাজনা ইত্যাদি নানাবিধ হারাম কাজ বেশি সংগঠিত হয়। এ কারণে আল্লাহর কাছে সবচাইতে ঘৃণিত জায়গা হচ্ছে বাজার। আর এ কারণেই সেখানে আল্লাহর যিকিরের জন্য, আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশের জন্যে এই দুয়া পড়লে এতো বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
সুতরাং বন্ধুরা দেরী না করে আজকেই এই দুয়া মুখস্থ করে নিন এবং যখনই ছোট-বড় যেকোন বাজারে প্রবেশ করবেন, একদিনে যতবারই বাজারে প্রবেশ করবেন, এই দুয়া পড়তে কখনোই ভুলবেন না।
(১৫) সুন্নতী পদ্ধতিতে জুমুয়া’হর সালাতের জন্য পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমুয়া’হর দিন গোসল করবে এবং তার স্ত্রীকে গোসল করাবে, সকাল-সকাল ও আগে-আগে (মসজিদে যাওয়ার জন্য) প্রস্তুত হয়, জুমুয়া’হর জন্য কোন যানবাহনে চড়ে নয়, বরং পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে এবং সেখানে অনর্থক কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে, ইমামের নিকটে বসে মনোযোগ সহকারে খুতবাহ শুনবে, তার (মসজিদে যাওয়ার) প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্নাত হিসেবে গণ্য হবে এবং প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময় সে এক বছর যাবত (নফল) সিয়াম পালন ও রাত্রিতে (নফল) সালাত আদায় করার (সমান) সওয়াব পাবে।” আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিজিঃ ৪৯৬, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহ তিরমিযীঃ ৪১০, সহীহ আত-তারগীবঃ ৬৮৭।
ইমাম ইবনে কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “তার স্ত্রীকে গোসল করাবে অর্থ হচ্ছে স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে। ইমাম ওয়াকী ‘স্ত্রীকে গোসল করাবে’ এইভাবেই অর্থ করেছেন।” যাদ আল-মাআ’দঃ ১/২৮৫।
সুতরাং, যে ব্যক্তি তার বাড়ি থেকে ১০০ কদম পায়ে হেঁটে জামে মসজিদে পৌঁছাবে, তার আমলনামায় ১০০ বছর নফল সালাত ও সাওম পালনের সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। সুবহা’নাল্লাহ!
(১৬) দশজন দাস মুক্ত করার সমান সওয়াব ও সশস্ত্র ফেরেশতা দল দিয়ে নিরাপত্তা পাওয়াসহ অনেক বড় ফযীলতের একটা দুয়াঃ
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ
لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ
عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণঃ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ’দাহু, লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হা’মদু, ইয়ুহ’য়ী ওয়া ইয়ূমীত, ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাই’ইং ক্বাদীর।
অর্থঃ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবূদ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তারই এবং সমস্ত প্রশংসা তাঁর। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন। আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
এই দুয়া ফযর ও মাগরিবের সালাতের পর পড়লেঃ
(ক) আল্লাহ তাআ’লা ঐ ব্যক্তির জন্য সশস্ত্র ফেরেশতাদের দল পাঠাবেন যারা তাকে সকাল পর্যন্ত যেকোন ক্ষতি হতে পাহারা দিয়ে রাখবেন।
(খ) তার আমলনামায় দশটি নেকী লিখে দেওয়া হবে।
(গ) তার আমলনামা থেকে দশটি ধ্বংসাত্মক গুনাহ মুছে দেওয়া হবে।
(ঘ) দশ জন ঈমানদার দাস মুক্ত করার সমান সওয়াব তাকে দেওয়া হবে।
সুনানে তিরমিযীঃ ৩৫৩৪, হাদীসটি হাসান সহীহ, দারুস সালাম তাহকীক।
বিঃদ্রঃ লক্ষ্য করুন দুয়াটাতে “ইয়ুহ’য়ী ওয়া ইয়ূমীত”, এই কথাটা অতিরিক্ত আছে, এটাসহ পড়তে হবে।
(১৭) জানাযার সালাত আদায় করা এবং কবরস্থ করা পর্যন্ত লাশের অনুসরণ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি (আল্লাহর প্রতি) ঈমান রেখে এবং সওয়াবের আশা নিয়ে কোনো মুসলিমের জানাযার সাথে যাবে এবং তার জানাযার সালাত আদায় করবে এবং তাকে দাফন করা পর্যন্ত তার সাথে থাকবে, সে দুই ক্বীরাত্ব পরিমাণ সওয়াব নিয়ে (বাড়ি) ফিরবে। এক ক্বীরাত হচ্ছে উহুদ পাহাড়ের সমান। আর যে ব্যক্তি জানাযার সালাত আদায় করবে কিন্তু মৃতকে কবরস্থ করার পূর্বেই ফিরে আসবে, সে এক কীরাত্ব পরিমাণ সওয়াব নিয়ে (বাড়ি) ফিরবে।” সহীহ বুখারীঃ ১৩২৪, সহীহ মুসলিমঃ ৯৪৫, তিরমিযী, নাসায়ীঃ ১৯৯৪।
(১৮) রুকুর পরে ফযীলতপূর্ণ একটি দুয়াঃ
রিফায়া ইবনে রাফি যুহকী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে সালাত আদায় করছিলাম। তিনি যখন রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে سَمِـعَ اللهُ لِمَـنْ حَمِـدَه উচ্চারণঃ “সামিআ’ল্লা হুলিমান হা’মিদাহ” বললেন, তখন পিছন থেকে একজন সাহাবী رَبَّنـا وَلَكَ الحَمْـدُ حَمْـداً كَثـيراً طَيِّـباً مُـبارَكاً فيه উচ্চারণঃ “রব্বানা ওয়া লাকাল হা’মদ, হা’মদান কাসিরান ত্বইয়িবান মুবারাকান ফিহ” বললেন। সালাত শেষ করে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এই কথাটা কে বলেছিল? সেই সাহাবী বললেন, আমি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি দেখলাম ত্রিশ জনের বেশি ফেরেশতা এই (দুয়াটার) সওয়াব কে আগে লিখবেন, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছেন।” সহীহ বুখারীঃ ৭৬৩।
(১৯) ৩৬০–টি সদকাহ করার সমান সওয়াবঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষের শরীরে ৩৬০-টি জোড়া রয়েছে। অতএব মানুষের কর্তব্য হল প্রত্যেক জোড়ার জন্য একটি করে সদকাহ করা।” সাহাবারা বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! কার শক্তি আছে এই কাজ করার?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “মসজিদে কোথাও কারো থুতু দেখলে তা ঢেকে দাও, অথবা রাস্তায় কোন ক্ষতিকারক কিছু দেখলে সরিয়ে দাও। তবে এমন কিছু না পেলে, চাশতের দুই রাকাত সালাতই এই (৩৬০-টি সদকাহর) জন্য যথেষ্ট হবে।” আবু দাউদঃ ৫২২২।
উল্লেখ্য, ইশরাকের দুই রাকাত সালাত আদায় করলে চাশতের দুই রাকাত সালাত আদায় হয়ে যাবে। ইশরাকের সালাত আর চাশতের সালাত একই সালাত, দুই সময়ে পড়লে দুই নাম।
(২০) জামাতে সহিত ফরয সালাত আদায় করার ফযীলতঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কোন ব্যক্তির জামাতে (ফরয) সালাত আদায় করা, তার ঘরে কিংবা বাজারে একাকী সালাত আদায় করার তুলনায় পঁচিশ গুণ বেশি সওয়াব বয়ে আনে। কারণ, সে যখন উত্তমরূপে ওযু করে কেবল মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন তার প্রতিটি পদক্ষেপে একটি করে দরজা (মর্যাদা) উঁচু হয়, এবং তার একটি করে পাপ মোচন হয়। সালাত শেষে যতক্ষণ পর্যন্ত সে (ওযু অবস্থাতে) সালাতের স্থানেই বসে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য এই বলে রহমতের দোয়া করতে থাকেন, “হে আল্লাহ! আপনি তার প্রতি দয়া করুন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে রহমত ভূষিত করুন।” আর সালাতের জন্য অপেক্ষার সময়টুকুও তোমাদের কারো জন্য সালাতের মধ্যেই বলে গণ্য হয়।” সহীহ মুসলিমঃ ৬১১।
(২১) নফল-সুন্নত সালাত নিজ ঘরে আদায় করার ফযীলতঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন মসজিদে (ফরয) সালাত আদায় করে তখন তার উচিত সে যেন তার সালাতের কিছু অংশ (সুন্নত বা নফল সালাত) নিজের বাড়ির জন্য রেখে দেয়। কারণ বাড়িতে পড়া ঐ কিছু সালাতের মধ্যে আল্লাহ কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।” সহীহ মুসলিমঃ ৭৭৮।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে মানব সকল! তোমরা নিজেদের ঘরে (নফল-সুন্নত) সালাত আদায় কর। কেননা, ফরয সালাত ছাড়া মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠতম সালাত হচ্ছে তার নিজ ঘরে পড়া (নফল-সুন্নত) সালাত।” নাসাঈ, ইবনে খুযাইমাহ, হাদীসটি সহীহ, সহীহ তারগীবঃ ৪৩৭।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যেখানে লোকে দেখতে পায় না, সেখানে মানুষের নফল সালাত আদায় করার চাইতে যেখানে লোকে দেখতে পায়, সেখানের সালাতের তুলনায় ২৫ গুণ (বেশি সওয়াব)।” আবু ইয়া’লা, জামে ৩৮২১নং হাদীস।
(২২) সুরা কাফিরুনের ফযীলতঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ক্বুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন ক্বুরআনের চার ভাগের এক ভাগের সমান।” তিরমিযীঃ ২৮৯৪, বায়হাকী, হাকিমঃ ২০৮৭, সহীহ আত-তারগীবঃ ৫৮৩। হাদীসটির সনদ সহীহ, ইমাম হাকিম, শায়খ আলবানী।
হারিস ইবনু হাবালাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন, যা আমি ঘুমানোর সময় পাঠ করবো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি যখন বিছানায় শয়ন করতে যাবে, তখন ক্বুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন সুরা পাঠ করবে। কেননা এতে শিরক থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে।” আবু দাউদঃ ৫০৫৫, তিরমিযীঃ ৩৪০৩, আহমাদঃ ২৪০০৯। শায়খ আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। সহীহ আত-তারগীবঃ ৬০৫।
ফযর ও মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নত সালাতের প্রথম রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস, বিতির সালাত তিন রাকাত পড়লে প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস পড়া মুস্তাহাব বা উত্তম। এছাড়া বিছানাতে শোবার পর ঘুমানোর পূর্বে সুরা কাফিরুন একবার পড়া মুস্তাহাব।
(২৩) একজন খাদেমের সেবা থেকে উত্তম আমলঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু এবং ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আ’নহাকে বলেছিলেন, “আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছু বলে দিবো না, যা তোমাদের জন্য একজন খাদেম অপেক্ষাও উত্তম হবে? যখন তোমরা তোমাদের বিছানায় যাবে, তখন তোমরা দুইজনে ৩৩ বার সুবহা’-নাল্লাহ, ৩৩ বার আলহা’মদুলিল্লা-হ, ৩৪ বার আল্লা-হু আকবার বলো।” সহীহ বুখারীঃ ৩৭০৫, সহীহ মুসলিমঃ ২৭২৬।
(২৪) একটি মাত্র রোযা দুই বছরের গুনাহর জন্য কাফফারা হবেঃ
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে আরাফার দিনের রোজার ব্যপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, “আরাফার দিনের রোজা বিগত ও সামনের এক বছরের গুনাহ সমূহের জন্য কাফফারা স্বরূপ।” সহীহ মুসলিমঃ ১১৬২।
(২৫) সারা বছর ধরে রোযা রাখার সমান সওয়াবঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “রমজানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দু’মাসের রোজার সমান। সুতরাং এই হলো এক বছরের রোজা।” অপর হাদীসে আছে, “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে (শাওয়াল মাসে) ছয় দিন রোজা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরো এক বছর রোজা রাখার সমতুল্য।”
মহান আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “যে কোন সৎকাজ নিয়ে এসেছে, তার জন্য প্রতিদান হবে তার দশগুণ।” সুরা আনআ’মঃ ১৬০।
হাদীসের উৎস গ্রন্থঃ মুসনাদে আহমদঃ ৫/২৮০, সুনানে দারেমিঃ ১৭৫৫।
(২৬) আশুরার দিন রোযা রাখার ফযীলতঃ
আশুরা বা মুহাররাম মাসের দশম তারিখে রোযা রাখার সওয়াব সবচাইতে বেশি। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আশুরার দিন রোযা রাখা এক বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব।” ইবনে হিব্বানঃ ৩৬৩১, হাদীসটির সনদ সহীহ।
আশুরার দিনে রোযা রাখার আরো ফযীলত হচ্ছে, তার বদলে বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ হবে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি আশা করি যে, আশুরার দিনের রোযা বিগত এক বছরের গুনাহ-খাতা মোচন করে দেবে।” সহীহ মুসলিমঃ ১১৬২, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৯৭, আবু দাউদঃ ২৪২৫।
উল্লেখ্য, আশুরার রোযা রাখার জন্য তার আগের দিন অতিরিক্ত একটি রোযা রাখা সুন্নত।
(২৭) অন্তর থেকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁর প্রশংসা করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্তরের গভীর থেকে বলেঃ “আলহা’মদুলিল্লাহি রব্বিল আ’লামীন” (অর্থঃ সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা বিশ্ব জাহানের রব্ব আল্লাহর জন্য), তার জন্য ত্রিশটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তার থেকে ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হয়।” আহমাদঃ ৮০১২, হাদীসটি সহীহ, সহীহ আত-তারগীবঃ ১৫৫৪।
(২৮) সর্বদা আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকাঃ
আমরা অনেকে মনে করি, যদি আমাদের টাকা-পয়সা থাকতো তাহলে আল্লাহর রাস্তায় অনেক দান-সাদাকাহ করে লোকদেরকে সাহায্য করতাম, মসজিদ মাদ্রাসায় দিয়ে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব অর্জন করতাম। আবার অনেকে আশা করি, আমার যদি অমুক আলেমের মতো দ্বীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতো, তাহলে মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দিয়ে অনেক বড় কল্যাণ হাসিল করতে পারতাম। এই ধরণের নেক আশা রাখা উত্তম, এবং এর জন্য সওয়াব রয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত, আল্লাহ একেকজনকে একেকভাবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তার হিসাব নেবেন। সুতরাং আল্লাহ যাকে যেই সামর্থ্য দিয়েছেন, সে অনুযায়ী বেশি বেশি করে নেকীর কাজে অগ্রসর হতে হবে, যাতে করে আল্লাহর রহমত পেতে পারি, জান্নাতুল ফেরদাউস পেতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকেই কবুল করুন, আমিন।
আজকে আমি এমন একটা আমল বলে দিচ্ছে, যাকে আমরা অনেকেই খুব ‘হালকা’ বলে মনে করি, কিন্তু সুন্নতী পদ্ধতি অনুযায়ী জীবনে যদি এই আমল বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদাকা করা, মসজিদ-মাদ্রাসা বানানো, জিহাদে অংশগ্রহণ করার চাইতেও বেশি কল্যাণকর হতে পারে। আর সেটা হচ্ছেঃ সর্বদা আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি কি তোমাদেরকে তা জানাবো না, আমলের মধ্যে যা সর্বোত্তম, তোমাদের মালিক (আল্লাহর) কাছে যা অত্যন্ত পবিত্র, তোমাদের জন্য যা অধিক মর্যাদা বৃদ্ধিকারী, (আল্লাহর পথে) সোনা-রূপা ব্যয় করার তুলনায় যা তোমাদের জন্য উত্তম এবং তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হয়ে তাদেরকে হত্যা এবং তারা তোমাদেরকে হত্যা করে ফেলার চাইতে অধিকতর শ্রেষ্ঠ?” সাহাবীগণ বললেন, “অবশ্যই হ্যাঁ।” তিনি বললেন, “(সেটা হচ্ছে) আল্লাহ তাআ’লার যিকির।” তিরমিযীঃ ৫/৪৫৯, নং-৩৩৭৭; ইবনে মাজাহঃ ২/১৬৪৫, নং-৩৭৯০; আরও দেখুন সহীহ ইবন মাজাহঃ ২/৩১৬; সহীহ তিরমিযীঃ ৩/১৩৯।
(২৯) যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে জিহাদের চাইতে অধিক প্রিয়ঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের চাইতে উত্তম এমন কোন দিন নেই, যেই দিনগুলোতে নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয়।” সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, “আল্লাহর পথে জিহাদও নয় হে রাসুলুল্লাহ?” তিনি বললেন, “আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। অবশ্য সেই মুজাহিদের কথা ভিন্ন, যে জান-মাল নিয়ে জিহাদে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু আর কোন কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না (অর্থাৎ আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যায়)।” সহীহ বুখারী।
(৩০) চাশতের নামায আদায় করার জন্য মসজিদে গমন করার ফযীলতঃ
আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজ ঘর থেকে ওযু করে (মসজিদের দিকে) বের হয় সে একজন ইহরামধারী হাজ্জীর সমান সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র চাশতের নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই বের হয়, সে একজন উমরাকারীর সমান সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি এক ওয়াক্ত নামায আদায়ের পর আরেক ওয়াক্ত নামায আদায়ের মধ্যবর্তী সময়ে কোন বাজে কথা বা কাজ করবে না, তাকে ইল্লিয়্যীনে (সৎকর্মশীল লোকদের সৎ কর্ম সমূহ লিপিবদ্ধ করার নিবন্ধ গ্রন্থে) লিপিবদ্ধ করা হয় (অর্থাৎ তার মর্যাদা সুউচ্চ হবে।)” আবু দাউদঃ ৫৫৮, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৬৩, সহীহ আত-তারগীবঃ ৩১৫, হাদীসটি হাসান।
0 Comments