যা'দ
ইবন দিরহাম ও উমাইয়্যাহ শাসকগণ
.শাইখুল ইসলাম ইমাম আবূ 'উসমান আস-সাবূনী (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন, "আল-আযহার দিন বাসরাহতে খালিদ ইবন 'আবদুল্লাহ আল-ক্বাসরি একটি খুতবা দিলেন এবং খুতবা শেষে বললেন, 'আপনাদের বাড়িতে যান এবং কুরবানি করুন, আল্লাহ আপনাদের কুরবানীতে বরকত দান করুন। আজ আমি যা'দ ইবন দিরহামকে কুরবানি করবো। কেননা সে বলে যে আল্লাহ ইবরাহীমকে একজন খালীল হিসেবে গ্রহণ করেননি, আর না তিনি মূসার সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। যা'দ যা বলে তা থেকে তিনি মহিমান্বিত ও সুউচ্চ।' অতঃপর তিনি মিম্বার থেকে থেকে নামলেন এবং তার (নিজের) হাতে তাকে কুরবানি করলেন, এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার আদেশ দিলেন।"
.
এই বর্ণনার ব্যাখ্যায় আল-'আল্লামাহ ড. রাবী' বিন হাদী
আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, "তিনি (ইমাম সাবূনী), রাহিমাহুল্লাহ, বলেন,
'খালিদ ইবন 'আবদুল্লাহ আল-ক্বাসরি একটি খুতবা দিলেন...।' তিনি উমাইয়্যাহ রাজবংশের নেতাদের
একজন ছিলেন, আর উমাইয়্যাহ রাজবংশের নেতারা, তাদের অনেকে জালিম ছিলেন, সবাই না। যেমন
আল-হাজ্জাজ। এই খালিদের মধ্যে কিছু যুলম ছিল। কিন্তু তাদের সময়ে তারা বিদ'আতের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করতো। কোনো ব্যক্তি যদি বিদ'আতের মাধ্যমে তার মাথা উঁচু করতো তারা তাকে ধ্বংস
করে দিতো, এবং অনেক যুদ্ধে তারা খারিজীদের হত্যা করেছিল। উমাইয়্যাহদের সময়ে বিদ'আতকে
দমন করা হতো, তাই আল্লাহ তাদের সাম্রাজ্যকে হিফাযাত করেছিলেন, এবং তাদের যুগ ছিল ইসলামের
শক্তিশালী থাকার যুগগুলোর একটি। (সাম্রাজ্যের) ভিতরে ছিল ইসলামের নিরাপত্তা, আর বাইরে
ছিল বিস্তৃতি ও বিজয় (অর্থাৎ নতুন এলাকা দখল করা)। যতক্ষণ না যা'দ ইবন দিরহাম আসলো
ও শেষ খলীফার মন দখল করে নিলো, আর সে ছিল মারওয়ান ইবন মুহাম্মাদ, এবং সেখানে তার বিদ'আত
রোপণ করে দিলো, এভাবে উমাইয়্যাহ রাজবংশের পতন ঘটলো।
.
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ অনেকবার স্বীকার করেছেন যে
পূর্ব অঞ্চলের ও অন্যান্য রাজবংশগুলোর পতন তারা বিদ'আতে প্রবিষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত
ঘটেনি। [১] কেননা বিদ'আত হলো রাজবংশগুলোর পতন ঘটার কারণ, আল্লাহুল মুস্তা'আন। শাইখুল
ইসলাম এটা নিশ্চিত করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন, এবং তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এই রাজবংশ
নিরাপদ ছিল যদিও এর মধ্যে যুলম ছিল। তো যখন এই খবিশ, যা'দ ইবন দিরহাম আসলো, সে এই বিদ'আতগুলো
ছড়ালো এবং শেষ খলীফার মনে সেগুলো রোপণ করে দিলো, অতঃপর আল্লাহ তাদের (উমাইয়্যাহ) উপর
তাদেরকে শক্তিশালী করে দিলেন যারা তাকে আর তার রাজবংশের পতন ঘটিয়ে দিলো।
.
এই (যা'দ ইবন দিরহাম) লোককে হত্যা করা হয়েছিল মুসলিমদের
'উলামাদের একটি ফাতওয়ার কারণে, কারণ সে ছিল এমন কাফির যাকে হত্যা করা ফরয ছিল। সুতরাং
তিনি তাকে এই দিনে হত্যা করেছিলেন, ঈদের দিন এবং কুরবানির ঈদ। আর তিনি বলেছিলেন, 'আপনাদের
বাড়িতে যান এবং কুরবানি করুন, আল্লাহ আপনাদের কুরবানিতে বরকত দান করুন। আজ আমি যা'আদ
ইবন দিরহামকে কুরবানি করবো।' অর্থাৎ, আপনারা পশুসম্পদ কুরবানি করবেন, যেমন গরু, উট,
ভেড়া, আর আমার ক্ষেত্রে, আমার কুরবানি হবে একজন মানুষ। কিছু ব্যক্তি এই ঘটনার সনদ নিয়ে
কথা বলেছেন [২]; তবে ইসলামের ইমামগণ কোন সন্দেহ ছাড়াই এটা বর্ণনা করেন ও গ্রহণ করেন।
[৩]
.
তিনি তাকে কুরবানি কেন করলেন? তিনি বলেছেন, "কেননা
সে বলে যে আল্লাহ ইবরাহীমকে একজন খালীল হিসেবে গ্রহণ করেননি", অর্থাৎ সে (আল্লাহর
সিফাত) ভালোবাসাকে অস্বীকার করে, এবং সে বলে, আল্লাহ ভালোবাসেন না আর ভালোবাসাপ্রাপ্তও
হন না! অথচ বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেছেন যে তিনি ভালোবাসেন এবং ভালোবাসাপ্রাপ্ত
হন।
.
"নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা তাঁর পথে
সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে যেন তারা সীসা ঢালা প্রাচীর।" (সূরাহ আস-সফ, আয়াত নং ৪)
[অনুবাদ: আল-বায়ান]
.
"হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার দীন থেকে
ফিরে যাবে তাহলে অচিরেই আল্লাহ এমন কওমকে আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে
ভালবাসবে। তারা মুমিনদের উপর বিনম্র এবং কাফিরদের উপর কঠোর হবে।" (সূরাহ আল-মাইয়্যিদাহ,
আয়াত নং ৫৪) [অনুবাদ: আল-বায়ান]
.
আয়াত ও হাদীসসমূহ ইঙ্গিত করে যে আল্লাহ এমন সিফাত দ্বারা
বর্ণিত হন যা তার মর্যাদার সাথে উপযুক্ত। এই সিফাত মাখলুক্বের সিফাত থেকে ভিন্ন হয়।
তো যা'আদ এই সিফাত প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং সে এই বাস্তবতা প্রত্যাখ্যান করেছিল যে,
আল্লাহর কথা বলেন। ফলস্বরুপ, সে এই বাস্তবতা প্রত্যাখ্যান করেছিল যে, আল্লাহ মূসার
সঙ্গে কথা বলেছেন আর এই অদ্ভুত অস্বীকারকার্যের মাধ্যমে সে কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন
করেছে ও সুন্নাহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। তাই তার উপর কাফির হওয়ার হুকুম লাগানো হয়
এবং তার প্রত্যাখ্যান করার প্রতিফল হিসেবে তাকে হত্যা করা হয় তার কর্তৃক দুটি সিফাত
অস্বীকার করার কারণে। অতএব, আপনারা তার ব্যাপারে কী বলেন যে আল্লাহর সব সিফাত প্রত্যাখ্যান
করে, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইমাম হিসেবে বহাল থাকে!? [৪] জাহমিয়্যাহ, মু'তাযিলাহ, খাওয়ারিজ,
রাওয়াফিদ্ব, এবং তারা ব্যতিত অন্যান্যদের নেতাদের ব্যাপারটি এরূপ।"
.
ফুটনোটস:
.
১/ শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
"এই হলো যা'আদ, তার সাথে সম্পৃক্ত করা হয় মারওয়ান ইবন মুহাম্মাদ আল-যা'দীকে, বানু
উমাইয়্যাহর শেষ খলীফা। রাজবংশ বিলুপ্ত হওয়ার পর্যন্ত তার (মারওয়ান) উপর তার (যা'আদ)
কুপ্রভাব জারি ছিল। কেননা যখনই বিদ'আতের আগমন ঘটেছিল যা কিনা রাসূলগণের দ্বীনের বিপরীত,
যারা রাসূলগণের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল আল্লাহ তাদের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন এবং তাদেরকে
ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।" (মাজমু' আল-ফাতাওয়া, ১৩/১৭৭)
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, "তাবেঈদের
যুগের শেষে জাহমিয়্যাহদের সংখ্যা যখন অনেক বেড়ে গেল, তারা ছিল প্রথম লোকসকল যারা রায়ের
দ্বারা ওয়াহীর বিরোধিতা করতো, এজন্য, ইমামদের কাছে তারা ছিল অতি ক্ষুদ্র, দমিত ও নিন্দিত।
তাদের প্রথমজন ছিল তাদের শাইখ যা'আদ ইবন দিরহাম। সে তার কিছু বিষয় মানুষজন থেকে গোপন
করেছিল, এবং সে ছিল মারওয়ান ইবন মুহাম্মাদের পরামর্শদাতা ও তার শাইখ। একারণে তাকে আল-যা'দী
বলা হতো। আর তার হাতেই আল্লাহ বানু উমাইয়্যাহর রাজ্য ও খিলাফাহ সরিয়ে নেন এবং তাদেরকে
বিভিন্ন ভূখণ্ডে বিভক্ত করে দেন এবং মু'আত্তিলাহদের (অর্থাৎ সিফাত অস্বীকারকারীদের
শাইখ যা'আদ ইবন দিরহাম) শাইখের মাধ্যমে তাদেরকে সম্পূর্ণ ছিন্নবিচ্ছিন করে দেন। (আস-সাওয়ায়িক্ব
আল-মুরসালাহ, ৩/১০৭০-১০৭১)
২/ এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী আত-তারিখ আল-কাবীর
(৩/১৫৮/৫৪২) ও খালক্ব আফ'আল আল-'ইবাদ (পৃষ্ঠা নংঃ ২৯) গ্রন্থদ্বয়ে, আদ-দারিমী রাদ্দ
'আলা আল-জাহমিয়্যাহ (পৃষ্ঠা নংঃ ২১ ও ২০৯) গ্রন্থে, আল-খাল্লাল আস-সুন্নাহ (৫/৮৭,৮৮)
গ্রন্থে, আল-আজুররী আশ-শারিয়াহ (নংঃ ২০৯) গ্রন্থে, আল-লালিকাঈ শারহ উসূল আল-ইতিক্বাদ
(২/১৩১৯/৫১২) গ্রন্থে, ইবন বাত্তাহ আল-ইবানাহ (২/১২০) গ্রন্থে, আল-বাইহাক্বী আস-আসমা
ওয়াস-সিফাত (১/৬১৭,৫৬৩) গ্রন্থে, আল-খাতীব আল-বাগদাদী তারিখ আল-বাগদাদ (১২/৪২৫) গ্রন্থে,
ইবন 'আসাকির তারিখ দিমাশক্ব (৫/৪৮৭) গ্রন্থে, আল-মিযযী তাহযীব আল-কামাল (৮/১১৮ ও ২৩/৩৪৮)
গ্রন্থে, আয-যাহাবী আল-'উলু (পৃষ্ঠা নংঃ ১৩১) গ্রন্থে, এবং অন্যান্য। এটি একটি বিখ্যাত
ঘটনা যেমনটি আয-যাহাবী আল-মিযানে (১/৩৯৯) বলেছেন। দেখুন: মুহাম্মাদ ইবন খালীফাহ আত-তামিমীর
মাক্বালাহ আত-তা'তীল ওয়াল-যা'দ ইবন দিরহাম, ফুটনোট নংঃ ১৫৯।
৩/ যেসব 'উলামা এই ঘটনা তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
আল-বাগাউয়ী (শারহুস সুন্নাহ, ১/১৮৬), ইবন তাইমিয়্যাহ (আল-মাজমু', ১২/২৭, ১১৯, ৩৫০ এবং
বায়ান তালবিস আল-জাহমিয়্যাহ, ২/৪৮৭-৪৮৮), ইবনুল ক্বাইয়্যিম (আল-কাফিয়্যাহ আশ-শাফিয়্যাহ
১/৩৫ আল-হাররাসের ভাষ্যসহ এবং আস-সাওয়াইক্ব আল-মুরসালাহ, ৩/১০৭১, ৪/১৩৯৬)), আয-যাহাবী
(আল-মিযান ১/৩৯৯), ইবন কাসীর (আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, ১২/৭২৪), ইবন আবিল-'ইয আল-হানাফী
(শারহ্ আত-তাহাউইয়্যাহ ২/৭৯৪)
৪/ আবূ নাসর আস-সিজযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, "নিশ্চয়ই
এমন এক সময় ছিল যখন তার কথা গৃহীত হতো যে কিনা আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা ও তার রাসূল
ﷺ কে প্রত্যাখ্যান করতো এবং বিশুদ্ধ 'আক্বলের বিরোধিতা
করতো, এবং এসবের পরেও এই অশান্ত সময়ে সে ইমাম হিসেবে বিবেচিত হয়। আল্লাহুল মুস্তা'আন।"
(আর-রাদ্দ 'আলা মান আনকারা আল-হারফ ওয়াস-সাওত, পৃষ্ঠা নংঃ ২২)
.(শারহ্ 'আক্বীদাতুস-সালাফ ওয়া আসহাবুল-হাদীস, পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৯)
.উৎস: shorturl.at/inC68
.অনুবাদক: রিফাত রাহমান সিয়াম
0 Comments