▌ফিকহুল ফিতান : ফিতনায় অনুসরণীয় নীতিমালা
[শেষ পর্ব]
·
রচয়িতা: আল্লামাহ সুলাইমান বিন সালিমুল্লাহ আর-রুহাইলি
হাফিযাহুল্লাহ
·
[১৭শ মূলনীতি: বিচক্ষণ ও ধীরস্থির হওয়া এবং অস্থিরতা ও তাড়াহুড়ো থেকে বেঁচে
থাকা]
ফিতনার একটি ফিকহ—বুদ্ধিমত্তা ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা এবং অস্থিরতা ও তাড়াহুড়ো
থেকে বেঁচে থাকা। শয়তান তাড়াহুড়োর প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, যাতে বান্দা সঠিক বিষয় জানতে
না পারে। এজন্য ফিতনার সময় তাড়াহুড়ো শয়তানের একটি ধারালো অস্ত্র। শয়তান যখন মানুষকে
তাড়াহুড়ো করিয়ে দেয় এবং তাকে ফিতনায় ভূপাতিত করে, তখন তার জন্য ফিরে আসা অনেক কঠিন
হয়ে যায়। সে তখন নিজের মতাদর্শের পক্ষে নানাবিধ সুদূরপরাহত ব্যাখ্যা এবং উলামাদের দ্ব্যর্থবোধক
কথা তালাশ করে, যাতে সে নিজের অবস্থানকে জোরদার করতে পারে। আল্লাহ বিচক্ষণতা ভালোবাসেন,
আর ধীরস্থিরতা দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। সুতরাং ধীরস্থিরতা কল্যাণ বৈ অন্য কিছু
বয়ে নিয়ে আসে না।
তাই মহান আল্লাহ বলেছেন, كَلَّا بَلْ تُحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ “কখনো না! বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাস।” [সুরা কিয়ামা: ২০] শাওকানি রাহিমাহুল্লাহ
বলেছেন, “আয়াতে উদ্ধৃত ‘কখনো না (كَلَّا)’ কথাটি ত্বরাপ্রবণতা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য এবং ধীরস্থিরতার প্রতি উৎসাহিত
করার জন্য বলা হয়েছে।” [ফাতহুল কাদির, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৩৮]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الأَنَاةُ مِنَ اللَّهِ وَالْعَجَلَةُ مِنَ الشَّيْطَانِ “ধীরস্থিরতা আসে আল্লাহর
পক্ষ থেকে, আর তাড়াহুড়ো আসে শয়তানের পক্ষ থেকে।” [তিরমিযি, হা/২০১২; সনদ: দুর্বল]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশাজ আব্দুল কায়েসের উদ্দেশে বলেন, إِنَّ فِيكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللَّهُ الْحِلْمُ وَالأَنَاة “তোমার মাঝে দুটো গুণ রয়েছে,
যা আল্লাহ পছন্দ করেন—বিচক্ষণতা ও ধীরস্থিরতা।” [সহিহ মুসলিম, হা/১৭; ইমান অধ্যায়
(১); পরিচ্ছেদ: ৬]
বিচক্ষণতা মানে বিভিন্ন বিষয় বুঝতে পারা, আর ধীরস্থিরতা মানে সময় নেওয়া, তাড়াহুড়ো
না করা। ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বিচক্ষণতা ও ধীরস্থিরতা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং
বলেছেন, আল্লাহ এ দুটো গুণকে ভালোবাসেন। এরপর তিনি বলেছেন, “এ দুটো গুণের বিপরীত অস্থিরতা
ও তাড়াহুড়ো। উক্ত বৈশিষ্ট্যদ্বয় নিন্দিত এবং চরিত্র ও আমলবিনাশী কর্ম।” [যাদুল মাআদ,
খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬০৮]
ধীরস্থিরতা থাকবে কথা ও কাজের ক্ষেত্রে, অন্যদের আমলকে ভালো মনে করার ক্ষেত্রে
কিংবা তাদের বক্তব্য ও সংবাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে। মহান আল্লাহ বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ “ওহে যারা ইমান এনেছ, যদি
কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। যাতে
তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে না বস, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য
অনুতপ্ত হবে।” [সুরা হুজুরাত: ৬]
সংবাদের ক্ষেত্রে ধীরস্থির হতে উদ্বুদ্ধকারী বিষয় সংবাদদাতার মাঝে থাকতে পারে;
যেমন সে তাড়াহুড়ো কিংবা প্রতারণা বা ফাসেকি কাজের ব্যাপারে সুপরিচিত। আবার তা সংবাদের
মাঝেও থাকতে পারে; যেমন সংবাদটি অদ্ভুত, অথবা সুবিদিত বিষয়ের খেলাপ প্রভৃতি। যে ব্যক্তি
ধীরস্থিরতা অবলম্বন করল, সে আসলে শরিয়তসম্মত বিষয়কে ধারণ করল এবং ফিতনাগ্রস্ত হওয়া
থেকে নিরাপদ হয়ে গেল। ফিতনার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা জনপদগুলোকে হেফাজত করার একটি মাধ্যম।
একদা মুসতাওরিদ আল-কুরাশি রাদিয়াল্লাহু আনহু আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর
নিকট বললেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, تَقُومُ السَّاعَةُ وَالرُّومُ أَكْثَرُ النَّاسِ. فَقَالَ لَهُ عَمْرٌو أَبْصِرْ مَا تَقُولُ . قَالَ أَقُولُ مَا سَمِعْتُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَئِنْ قُلْتَ ذَلِكَ إِنَّ فِيهِمْ لَخِصَالاً أَرْبَعًا إِنَّهُمْ لأَحْلَمُ النَّاسِ عِنْدَ فِتْنَةٍ وَأَسْرَعُهُمْ إِفَاقَةً بَعْدَ مُصِيبَةٍ وَأَوْشَكُهُمْ كَرَّةً بَعْدَ فَرَّةٍ وَخَيْرُهُمْ لِمِسْكِينٍ وَيَتِيمٍ وَضَعِيفٍ وَخَامِسَةٌ حَسَنَةٌ جَمِيلَةٌ وَأَمْنَعُهُمْ مِنْ ظُلْمِ الْمُلُوكِ ‘কেয়ামত সংঘটনের সময় রোমকদের
সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে।’ এ কথা শোনামাত্র আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন,
‘কী বলছ, চিন্তাভাবনা করে বল।’ তিনি বললেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
থেকে যা শুনেছি, আমি তাই বর্ণনা করছি।’ তারপর আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন,
‘তুমি যদি তা-ই বলে থাক, তবে জেনে রেখ, তা হবে তাদের মধ্যকার চারটি গুণের কারণে। প্রথমত,
ফিতনার সময় তারা সবচেয়ে বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, মুসিবতের
পর দ্রুত তাদের মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। তৃতীয়ত, যুদ্ধ থেকে পলায়নের পর তারা
সত্বর আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। চতুর্থত, মিসকিন, এতিম ও দুর্বলের প্রতি তারা সবচেয়ে
বেশি শুভাকাঙ্ক্ষী। অতঃপর পঞ্চম সুন্দর গুণটি হলো, তারা শাসকদের জুলুমকে অধিক প্রতিহত
করে থাকে।’ [সহিহ মুসলিম, হা/২৮৯৮; ফিতনা অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ১০]
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “অচিরেই নানাবিধ বিচ্যুতি ও
দ্ব্যর্থবোধক বিষয়ের আবির্ভাব ঘটবে। সুতরাং তুমি অবশ্যই ধীরস্থিরতা অবলম্বন করবে। অনিষ্ট
ও অকল্যাণের মধ্যে প্রধান হওয়ার চেয়ে কল্যাণের মধ্যে অনুসারী-অনুগামী হওয়াই তোমার জন্য
উত্তম হবে।” [মুসান্নাফ ইবনি আবি শাইবা, হা/৩৭১৮৮]
·
[১৮শ মূলনীতি: ফিতনার সময় আবেগের অনুসরণ না করা]
ফিতনার একটি ফিকহ হলো—ফিতনার সময় আবেগের অনুসরণ না করা; বরং আবেগকে বিবেক দিয়ে
কয়েদ করা এবং বিবেককে শরিয়ত দিয়ে শৃঙ্খলিত করাও ফিতনার ফিকহের অন্তর্গত। ফিতনার সময়
আবেগ-অনুভূতি আসলে ঝঞ্ঝাবায়ু। ফিতনায় পতিত ব্যক্তিদের অনেকেই আবেগের দরুন ফিতনাগ্রস্ত
হয়েছে। তৌফিকপ্রাপ্ত বান্দা তো সে-ই, যে স্বীয় আবেগকে শুরুতেই বিবেক দিয়ে কয়েদ করেছে
এবং তার বিবেককে শরিয়ত দিয়ে শৃঙ্খলিত করেছে। কারণ মানুষের আবেগ থাকবেই। তাই মানুষের
কাছে এমনটা তলব করা অসম্ভব যে, সে আবেগ থেকে বিলকুল মুক্ত থাকবে। কিন্তু তার কাছে তলব
করা হবে, সে যেন নিজের আবেগকে সুবিন্যস্ত করে এবং আবেগকে ত্রুটিমুক্ত করে তোলে।
আবেগ থেকে উদ্ভূত কোনো বিষয় তার কাছে উপস্থাপিত হলে সে তা নিজের বিবেকের কাছে
পেশ করবে। বিবেক দ্বারা প্রত্যাখ্যাত বিষয়াদির ক্ষেত্রে সে আবেগের পেছনে চালিত হবে
না। যারা একেরপর এক ফিতনায় পতিত হয়েছে, তাদের অনেকেই যদি তাদের বিষয়কে নিজেদের বিবেকের
কাছে পেশ করত, তবে তারা নিরাপদে থাকত। এক্ষেত্রে মুমিন বান্দাদের সাথে সাধারণ বিবেকবান
লোকও শরিক হয় (অর্থাৎ তারাও বিবেকের কাছে পেশ করে নবউদ্ভাবিত কোনো বিষয়কে পর্যবেক্ষণ
করতে পারে)।
কিন্তু মুমিন বান্দা আরেকটি মহান মর্যাদাপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাধারণ বিবেকবানদের
চেয়ে অগ্রবর্তী থাকে। মুমিন তার সকল বিষয়কে শরিয়তের কাছে সমর্পণ করে এবং শরিয়তের সন্নিকটে
থেমে যায়। সে জানে, শরিয়তবিরোধী যত বিষয় আছে, তার কোনোটিতেই কল্যাণ নেই। যদি বিবেক
তাকে ভালো বলে, তবে এটা বিবেকেরই ত্রুটি, বিবেকেরই ভুল। কারণ সৃষ্টি ও নির্দেশ উভয়ই
আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। আল্লাহর শরিয়ত কখনোই তাঁর সৃষ্টির সাথে দ্বন্দ্বপূর্ণ হবে না।
তিনি বলেছেন, أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ “যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? অথচ তিনি অতি সূক্ষ্মদর্শী, পূর্ণ
অবহিত।” [সুরা মুলক: ১৪]
আল্লাহ আপনাকে হেফাজতে রাখুন, গভীরভাবে লক্ষ করুন, মুমিনকে কীভাবেই না নিজের
আবেগকে কয়েদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এমনকি এরকম কঠিনতম ক্ষেত্রেও! যা এই বিস্ময়কর
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। একদা মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে বললেন, أَرَأَيْتَ إِنْ لَقِيْتُ رَجُلًا مِنَ الْكُفَّارِ فَاقْتَتَلْنَا فَضَرَبَ إِحْدَى يَدَيَّ بِالسَّيْفِ فَقَطَعَهَا ثُمَّ لَاذَ مِنِّيْ بِشَجَرَةٍ فَقَالَ أَسْلَمْتُ لِلهِ أَأَقْتُلُهُ يَا رَسُوْلَ اللهِ بَعْدَ أَنْ قَالَهَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَا تَقْتُلْهُ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ قَطَعَ إِحْدَى يَدَيَّ ثُمَّ قَالَ ذَلِكَ بَعْدَ مَا قَطَعَهَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلملَا تَقْتُلْهُ فَإِنْ قَتَلْتَهُ فَإِنَّهُ بِمَنْزِلَتِكَ قَبْلَ أَنْ تَقْتُلَهُ وَإِنَّكَ بِمَنْزِلَتِهِ قَبْلَ أَنْ يَقُوْلَ كَلِمَتَهُ الَّتِيْ قَالَ “হে আল্লাহর রসুল, আমাকে বলুন, কোনো কাফিরের সঙ্গে আমার যদি (যুদ্ধক্ষেত্রে)
সাক্ষাৎ হয় এবং আমি তার সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হই, আর সে যদি তরবারির আঘাতে আমার একটি
হাত কেটে ফেলে, এরপর আমার থেকে বাঁচার জন্য গাছের আড়ালে গিয়ে বলে ‘আমি আল্লাহর জন্য
ইসলাম গ্রহণ করলাম।’ এ কথা বলার পরে আমি কি তাকে হত্যা করব?” তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে হত্যা করবে না।” এরপর তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রসুল,
সে তো আমার এক হাত কেটে ফেলার পর এ কথা বলছে।” রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
পুনরায় বললেন, “না, তুমি তাকে হত্যা করবে না। কেননা তুমি তাকে হত্যা করলে, হত্যা করার
পূর্বে তোমার যে মর্যাদা ছিল, সে সেই মর্যাদা লাভ করবে; আর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার
আগে তার যে স্তর ছিল, তুমি সেই স্তরে পৌঁছে যাবে!” [সহিহ বুখারি, হা/৪০১৯]
উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। যখন সিফফিনের
যুদ্ধের ফিতনা আসল, তখন উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর উদ্দেশে বললেন,
لَوْ كُنْتَ فِي شِدْقِ الأَسَدِ لأَحْبَبْتُ أَنْ أَكُونَ مَعَكَ فِيهِ وَلَكِنَّ هَذَا أَمْرٌ لَمْ أَرَهُ “যদি আপনি সিংহের মুখে পড়েন,
তবুও আমি আপনার সঙ্গে সেখানে থাকাকে ভালো মনে করব। তবে এ বিষয়টি (সিফফিনের যুদ্ধ) আমি
ভালো মনে করছি না।” [সহিহ বুখারি, হা/৭১১০]
·
[১৯শ মূলনীতি: ধৈর্যধারণ করা]
ধৈর্যশীল হওয়া ফিতনার ফিকহের অন্তর্গত। ধৈর্য হলো আলো, ধৈর্যের সবই কল্যাণকর।
আবু মালিক আল-আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيزَانَ . وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلآنِ - أَوْ تَمْلأُ - مَا بَيْنَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَالصَّلاَةُ نُورٌ وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا “পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক। আলহামদুলিল্লাহ মীযানের পরিমাপকে পরিপূর্ণ করে দেবে
এবং ‘সুবহানাল্লাহ ওয়ালহামদুলিল্লাহ’ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পরিপূর্ণ করে
দেবে। নামাজ একটি উজ্জ্বল জ্যোতি। সদাকা হচ্ছে দলিল। আর ধৈর্য হলো আলো। কুরআন তোমার
পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রমাণস্বরূপ হবে। বস্তুত সকল মানুষই প্রত্যেক ভোরে নিজেকে আমলের
বিনিময়ে বিক্রি করে। তার আমাল দ্বারা সে নিজেকে (আল্লাহর আজাব থেকে) মুক্ত করে অথবা
সে তার নিজের ধ্বংস সাধন করে।” [সহিহ মুসলিম, হা/২২৩; পবিত্রতা অধ্যায় (২); পরিচ্ছেদ:
১]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুমাল্লাহ বলেছেন, “ধৈর্য
ও দৃঢ় প্রত্যয়ের (ইয়াকিনের) মাধ্যমে দ্বীনের নেতৃত্ব অর্জিত হয় (ব্যক্তি দ্বীনের ইমাম
হয়ে যায়)।” [আল-মুসতাদরাক আলা মাজমুইল ফাতাওয়া, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৫; আশ-শাহাদাতুয
যাকিয়্যাহ ফি সানাইল আইম্মাহ আলা ইবনি তাইমিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৩৫; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন,
খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৩৫; সাওয়া‘ইকুল মুরসালাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১০৭৩; রিসালাতু ইবনিল
কাইয়্যিম ইলা আহাদি ইখওয়ানিহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৬; ইগাসাতুল লাহফান, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা:
১৬৭]
ফিতনার সময় আলোর কত প্রয়োজনই না থাকে! মিকদাদ বিন আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু
বলেছেন, আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে
শুনেছি, إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ، إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنِ، إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنُ، وَلَمَنْ ابْتُلِيَ فَصَبَرَ فَوَاهًا “নিশ্চয় যে ব্যক্তি ফিতনা থেকে দূরে থাকবে, সে-ই সৌভাগ্যবান; নিশ্চয় যে ব্যক্তি
ফিতনা থেকে দূরে থাকবে, সে-ই সৌভাগ্যবান; নিশ্চয় যে ব্যক্তি ফিতনা থেকে দূরে থাকবে,
সে-ই সৌভাগ্যবান। আর যে ব্যক্তি ফিতনায় পড়ে ধৈর্যধারণ করবে, তার জন্য কতই না মঙ্গল!”
[আবু দাউদ, হা/৪২৬৩; সনদ: সহিহ]
জামানা যত শেষের দিকে এগোবে, কেয়ামতের অমোঘ সময় যত সন্নিকটে আসবে এবং এর ফলে
ফিতনা বেড়ে যাবে, তখন ধৈর্যধারণের ব্যাপারটিও তত জটিল হবে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, فَإِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ أَيَّامَ الصَّبْرِ، الصَّبْرُ فِيهِ مِثْلُ قَبْضٍ عَلَى الْجَمْرِ، لِلْعَامِلِ فِيهِمْ مِثْلُ أَجْرِ خَمْسِينَ رَجُلًا يَعْمَلُونَ مِثْلَ عَمَلِهِ، قَالوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَجْرُ خَمْسِينَ مِنْهُمْ؟ قَالَ: أَجْرُ خَمْسِينَ مِنْكُمْ “নিশ্চয় তোমাদের পরবর্তীতে এমন যুগ আসবে, যখন ধৈর্যধারণ করা জ্বলন্ত অঙ্গার
মুষ্টিবদ্ধ করে রাখার মতো কষ্টকর হবে। এ সময় যথার্থ আমলকারীকে তার মতোই পঞ্চাশজনের
সমান সওয়াব দেওয়া হবে।” সাহাবিগণ বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, তাকে কি সেই সময়ের পঞ্চাশজনের
সমান সওয়াব দেওয়া হবে?” তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশজনের সমান সওয়াব দেওয়া
হবে।” [আবু দাউদ, হা/৪৩৪১; তিরমিযি, হা/৩০৫৮; ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৪; সিলসিলা সহিহা,
হা/৪৯৪; সনদ: সহিহ]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “স্রেফ আল্লাহর নির্দেশ
পরিত্যাগ করার দরুন ফিতনা সংঘটিত হয়। কেননা আল্লাহ হকের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ধৈর্যেরও
নির্দেশ দিয়েছেন। ফিতনা আসে হয় হক পরিত্যাগের জন্য, আর নয়তো ধৈর্য পরিত্যাগের জন্য।”
[আল-ইস্তিকামাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৯]
·
[২০শ মূলনীতি: বস্তুগত বা অজড়—সকল ধরনের দুনিয়াবি বিষয়ের লোভ বর্জন করা]
বস্তুগত বা অজড়—সকল ধরনের দুনিয়াবি বিষয়ের লোভ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা ফিতনার
ফিকহের অন্তর্গত। কারণ ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য হোক বা অস্পৃশ্য অজড় হোক, যাবতীয় দুনিয়াবি বিষয়ের
লোভ—যেমন: মর্যাদা প্রভৃতি—ব্যক্তিকে ফিতনায় আত্মনিয়োগের দিকে চালিত করে (দুনিয়াবি
বিষয়ের উদাহরণ হিসেবে টাকাপয়সা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, উপঢৌকন, প্রেম ও মানুষের প্রশংসার
মতো বিষয়ও আসতে পারে – অনুবাদক)। কখনো কখনো শয়তান তার কাছে সুশোভিত করে তোলে, এটা তো
আল্লাহর পথেই হচ্ছে! সম্পদের লোভ একটি ফিতনা। কখনো কখনো এটা আরও বড়ো ফিতনার দিকে টেনে
নিয়ে যায়। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ لِكُلِّ أُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةُ أُمَّتِي الْمَالُ “প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোনো
না কোনো ফিতনা রয়েছে। আর আমার উম্মতের ফিতনা হলো ধনসম্পদ।” [তিরমিযি, হা/২৩৩৬; সনদ:
সহিহ]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا “আঁধার রাতের প্রহরের মতো
ফিতনা আসার পূর্বেই তোমরা সৎ আমলের দিকে ধাবিত হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হবে, আর
বিকেলে কাফির হয়ে যাবে। বিকেলে মুমিন হবে, সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর
বিনিময়ে সে নিজের দ্বীন বিক্রি করে ফেলবে।” [সহিহ মুসলিম, হা/১১৮; ইমান অধ্যায় (১);
পরিচ্ছেদ: ৫১]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “শাসকদের বিরুদ্ধে যারা
বিদ্রোহ করেছে, তাদের অনেকেই, কিংবা তাদের অধিকাংশই বিদ্রোহ করেছে শাসকদের সাথে বিবাদে
জড়ানোর জন্য; আর শাসকরাও তাদের ওপর একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বিদ্রোহীরা একচেটিয়া
ক্ষমতাপ্রয়োগ সহ্য করে না। এদিকে কতকক্ষেত্রে শাসকের অন্য পাপও থাকে। তখন শাসকের একচেটিয়া
ক্ষমতাপ্রয়োগের প্রতি বিদ্রোহীর ঘৃণা বাকি পাপগুলোকে বড়ো করে তোলে। শাসকের সাথে লড়াইকারী
ধারণা করে, সে তার সাথে লড়াই করছে কেবল এজন্য, যাতে কোনো ফিতনা (শির্ক-কুফর) অবশিষ্ট
না থাকে এবং পুরো দ্বীন আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। বিদ্রোহীকে বিদ্রোহ করতে যেসব বিষয় সবচেয়ে
বেশি ভূমিকা রাখে, সেসবের মধ্যে অন্যতম—তার নিজের উদ্দেশ্য সাধন; হয় কর্তৃত্ব, আর নয়তো
ধনসম্পদ।” [মিনহাজুস সুন্নাহ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৪০]
জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন, আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আব্দুর রহমান বিন মুলজিম
এক রূপসী রমণীর জন্য হত্যা করেছিল। সে ওই রমণীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আর ওই মহিলা তার
মোহরের মধ্যে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছিল, আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করতে হবে।
[আল-ওয়াফি বিল ওয়াফাইয়াত, খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ১৭২] তাবেয়ি হাসান বাসরি রাহিমাহুল্লাহ
খারেজিদের ব্যাপারে বলেছেন, “আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাদেরকে এরূপ দেখেছি, যেন তারা
বিবেকহীন প্রতিকৃতি, বুদ্ধিহীন কলেবর, নরকের কীট, আর লোভী মক্ষিকা।” [মুসনাদু আহমাদ,
হা/১৮৪২৮; মুসনাদু ইবনিল মুবারক, খণ্ড: ১/১৫৩; নুয়াইম বিন হাম্মাদ কৃত আল-ফিতান, খণ্ড:
১; পৃষ্ঠা: ৪৭; আল-মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬১১]
সম্মান-মর্যাদার লোভ ব্যক্তিকে, বিশেষত তালিবুল ইলমকে ফিতনায় নিমজ্জিত হওয়ার
দিকে চালিত করে। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “ফিতনা অর্পিত হয় তিন ব্যক্তির
নিকটে। একজন কঠিন ঝানু, তার সামনে কোনোকিছু উত্থাপিত হলেই সে তরবারি দিয়ে মিটিয়ে ফেলতে
চায়। আরেকজন খতিব, বিভিন্ন বিষয়ে যার কাছে (মানুষদের) যেতে হয়। অপর আরেকজন সমাজে আলোচিত
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। উক্ত ঝানু লোককে ফিতনা ভূপাতিত করে ফেলে। আর এ দুজনকে ফিতনা পরীক্ষা
করে, এরপর তাদের নিকটস্থ বিষয়ে বালা (পরীক্ষা) নিয়ে আসে।” [মুসান্নাফ ইবনি আবি শাইবা,
হা/৩৭১৩৫]
হুযাইফা বিন উসাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “নিশ্চয় আমি দাজ্জাল ছাড়াও অন্য
বিষয়কে তোমাদের জন্য ভয় করি।” জিজ্ঞেস করা হলো, “সেটা কী?” তিনি প্রত্যুত্তর করলেন,
“আঁধার রাতের প্রহরের মতো ফিতনাসমূহ।” বলা হলো, “হে সুরাইহার পিতা, ফিতনার সময় সর্বোত্তম
মানুষ কে?” তিনি বললেন, “গুপ্ত স্বচ্ছল ব্যক্তি।” পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, “সেসময় সর্বনিকৃষ্ট
মানুষ হবে কে?” তিনি বললেন, “বাগ্মী খতিব এবং ত্বরাপ্রবণ আরোহী।” এক ব্যক্তি মন্তব্য
করল, “আল্লাহর কসম, আমি স্বচ্ছলও নই, আবার গুপ্তও নই।” হুযাইফা বললেন, “তাহলে তুমি
দু বছর বয়সী উষ্ট্রশাবকের মতো হয়ে যাও; না তুমি বাহন হবে, যার ওপর আরোহণ করা যায়, আর
না তুমি দুগ্ধবতী হবে, যার দুধ দোহন করা যায়।” [মুসান্নাফ আব্দির রাযযাক, খণ্ড: ১১;
পৃষ্ঠা: ৩৯৪; হা/২০৮২৭]
বাগ্মী খতিব যখন লোভে পড়ে, তখন সে হয়ে যায় ফিতনার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টদের একজন।
এজন্য লোভের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করা বুদ্ধিমানের কর্তব্য, যাতে সে ফিতনায় নিপাতিত
না হয়। কবি সত্যই বলেছেন, “ঐশ্বর্য কত ব্যক্তিকেই না আঘাত করেছে গর্দানে; পরন্তু তাকে
করেছে শিথিল, আর পরিণত করেছে দাসে!”
·
[২১শ মূলনীতি: মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া]
মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া ফিতনার ফিকহের অন্তর্গত। দয়ার্দ্রতার সবই কল্যাণকর।
ফিতনার সময় এটা আরও কল্যাণকর। কারণ ফিতনার সময় অন্তরে যা আপতিত হওয়ার তাই আপতিত হয়।
এসময় অন্তরগুলো প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। তাই ফিতনার ক্ষেত্রে সুবিবেচক হকপন্থি ব্যক্তির
কর্তব্য হবে মানুষের সাথে কোমল আচরণ করা, তাদের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া। নবি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, دَخَلَ رَهْطٌ مِنَ الْيَهُودِ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا السَّامُ عَلَيْكُمْ. قَالَتْ عَائِشَةُ فَفَهِمْتُهَا فَقُلْتُ وَعَلَيْكُمُ السَّامُ وَاللَّعْنَةُ. قَالَتْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : مَهْلاً يَا عَائِشَةُ، إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِي الأَمْرِ كُلِّهِ. فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلَمْ تَسْمَعْ مَا قَالُوا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : قَدْ قُلْتُ وَعَلَيْكُمْ একদল ইহুদি নবি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ‘আস-সামু আলাইকুম, তোমাদের ওপর মৃত্যু উপনীত হোক।’
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি বিষয়টি বুঝলাম এবং বললাম, ‘ওয়া আলাইকুমুস সামু ওয়াল
লা‘নাহ, তোমাদের জন্যও ধার্য হোক মৃত্যু এবং আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়ন।’ তখন রসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘থাম, আয়িশা! আল্লাহ যাবতীয় কার্যে দয়ার্দ্রতা
পছন্দ করেন।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসুল, আপনি কি শোনেননি, তারা কী বলেছে?’ রসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তো বলেছি, ওয়া আলাইকুম, অর্থাৎ তোমাদের
ওপরও (সেটাই ধার্য হোক)।’ [সহিহ বুখারি, হা/৬০২৪; সহিহ মুসলিম, হা/২১৬৫]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে
বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِي عَلَى مَا سِوَاهُ “আয়িশা, আল্লাহ দয়ার্দ্র।
তিনি দয়ার্দ্রতা-কোমলতা পছন্দ করেন। তিনি দয়ার্দ্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন, যা কঠোরতার
দরুন দান করেন না; আর অন্য কোনো কিছুর দরুনও তা প্রদান করেন না।” [সহিহ মুসলিম, হা/২৫৯৩;
সদ্ব্যবহার অধ্যায় (৪৬); পরিচ্ছেদ: ২৩]
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِي شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ “দয়ার্দ্রতা যে কোনো বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর যে কোনো বিষয় থেকে দয়ার্দ্রতা
বিদূরিত হলে তাকে কদর্য করে দেয়।” [সহিহ মুসলিম, হা/২৫৯৪; সদ্ব্যবহার অধ্যায় (৪৬);
পরিচ্ছেদ: ২৩] জারির বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ حُرِمَ الرِّفْقَ حُرِمَ الْخَيْرَ أَوْ مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ “দয়ার্দ্রতা থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। কিংবা বলেছেন,
যে ব্যক্তি দয়ার্দ্রতা থেকে বঞ্চিত হবে সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকবে।” [সহিহ মুসলিম,
হা/২৫৯২; সদ্ব্যবহার অধ্যায় (৪৬); পরিচ্ছেদ: ২৩]
রজা বিন হাইওয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “ইসলাম কতই না সুন্দর! ইসলামকে সুশোভিত
করে ইমান। ইমান কতই না সুন্দর! ইমানকে সুশোভিত করে তাকওয়া। তাকওয়া কতই না সুন্দর! একে
সুশোভিত করে ইলম। ইলম কতই না সুন্দর! ইলমকে সুশোভিত করে বুদ্ধিমত্তা। আর বুদ্ধিমত্তা
কতই না সুন্দর! একে সুশোভিত করে দয়ার্দ্রতা।” [ইবনু আব্দিল বার্র কৃত জামিউ বায়ানিল
ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১২৬]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “মানুষকে আল্লাহর দিকে
আহ্বানকারী, মানুষদের নির্দেশদানকারী ব্যক্তি এ পথ অবলম্বন করবেন—দয়ার্দ্রতা ও কোমলতার
পথ।” [মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ২৪৫] তিনি আরও বলেছেন, “দয়ার্দ্রতা কখনো কখনো
কঠোরতাও চায়; যখন কঠোরতা ব্যতিরেকে অবস্থার সংশোধন সম্পন্ন হয় না।” একদা তাবে তাবেয়ি
ইমাম সুফিয়ান সাওরি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, “তোমরা কি জান, দয়ার্দ্রতা
কী?” তারা বলল, “আপনি বলে দিন, হে মুহাম্মাদের পিতা।” তখন তিনি জবাব দিলেন, “সকল বিষয়কে
যথাস্থানে রাখাই হবে তোমার দয়ার্দ্রতা। কঠোরতাকে কঠোরতার স্থলে রাখতে হবে এবং কোমলতাকে
কোমলতার স্থলে রাখতে হবে।” [ফাইদুল কাদির, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৬]
·
[২২শ মূলনীতি: নিজের কাজে আত্মনিয়োগ করা এবং অন্যের দায়িত্বে বেহুদা অনুপ্রবেশ
না করা]
একজন মুসলিমের যতটুকু দায়িত্ব স্রেফ তাতে মনোনিবেশ করা এবং যে দায়িত্ব তাকে
দেওয়া হয়নি তাতে অনুপ্রবেশ না করা ফিতনার একটি অন্যতম ফিকহ। একজন তৌফিকপ্রাপ্ত মুমিন
নিরাপত্তা পেয়ে খুশি হয়, নিজের দায়িত্বে নিমগ্ন থাকে, যে কাজ ভালো পারে এবং তার মর্যাদা
বা স্তরের (rank/status) সাথে যা খাপ খায় তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে, নিজের অবস্থানকে
অতিক্রম করে না। যে দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়নি, তার মধ্যে নিজেকে প্রবিষ্ট করে না। বরং
সে আল্লাহর প্রশংসা করে, কারণ দায়িত্ব থেকে সে মুক্তি পেয়েছে। যার দায়িত্ব তার কাছেই
সংশ্লিষ্ট বিষয়কে ছেড়ে দেয়। আর আল্লাহর কাছে তার জন্য সাহায্য ও তৌফিক কামনা করে। আল্লাহ
যে বিষয়কে শাসকদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, সে তার মধ্যে নিজেকে প্রবিষ্ট করে না। আবার
আল্লাহ যে বিষয়কে উলামাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, সে তার মধ্যেও নিজেকে প্রবিষ্ট করে
না। পরন্তু সে তাঁদের হিতাকাঙ্ক্ষী হয় এবং তাঁদের জন্য দোয়া করে।
মহান আল্লাহ বলেছেন, وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ ۖ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ ۗ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا “আর যখন তাদের কাছে নিরাপত্তা কিংবা ভীতিজনক কোনো বিষয় আসে, তখন তারা তা প্রচার
করে। তারা যদি সেটা রসুলের কাছে এবং তাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে
পৌঁছে দিত, তাহলে অবশ্যই অনুসন্ধানকারীরা তা (সরাসরি) জেনে নিত তাদেরই নিকট থেকে। আর
যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত না থাকত, তবে অবশ্যই অল্প কয়েকজন ছাড়া
তোমরা শয়তানেরই অনুসরণ করতে।” [সুরা নিসা: ৮৩]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ثَلاَثٌ لاَ يُغَلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ مُسْلِمٍ إِخْلاَصُ الْعَمَلِ لِلَّهِ وَمُنَاصَحَةُ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَلُزُومِ جَمَاعَتِهِمْ فَإِنَّ دَعوتَهُم تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِم “মুমিনের অন্তর তিনটি বিষয়ে
খেয়ানত (অবহেলা) করতে পারে না: আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ আমল, মুসলিমদের নেতৃবর্গের প্রতি
কল্যাণকামিতা এবং মুসলিমদের জামাআতকে ধারণ করা। কেননা মুসলিমদের দোয়া তাদেরকে পেছন
দিক থেকে পরিবেষ্টন করে রাখে (অর্থাৎ তাদের দোয়া কবুল হয়)।” [তিরমিযি, হা/২৬৫৮; ইবনু
মাজাহ, হা/৩০৫৬; সনদ: সহিহ]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكَهُ مَا لاَ يَعْنِيهِ “নিশ্চয় ব্যক্তির ইসলামের
অন্যতম সৌন্দর্য অর্থহীন বিষয় ত্যাগ করা।” [তিরমিযি, হা/২৩১৮; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৫৫;
সনদ: সহিহ]
ইবনু রজব আল-হাম্বালি রাহিমাহুল্লাহ জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম গ্রন্থে এ হাদিসের
ব্যাখ্যায় বলেছেন, “এ হাদিসের অর্থ: ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য—অর্থহীন কথা
ও কাজ ত্যাগ করা এবং স্রেফ অর্থবহ কথা ও কাজের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা।” [জামিউল
উলুমি ওয়াল হিকাম, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১১৪] আলি কারি রাহিমাহুল্লাহ ‘অর্থহীন বিষয় ত্যাগ
করা’ কথাটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, “অর্থাৎ যে বিষয়ের গুরুত্ব নেই এবং কথা, কাজ, দৃষ্টি
ও মননের দিক থেকেও তা ব্যক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” [মিরকাতুল মাফাতিহ, খণ্ড: ৯;
পৃষ্ঠা: ৭৬]
ফিতনার সময় উম্মতের ওপর যেসব অনিষ্ট ও ক্ষতি আপতিত হয়েছে, তার অনেকগুলোই আলোচ্য
বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। অনেক মানুষ নিজেকে এমনসব বিষয়ের মধ্যে প্রবিষ্ট করে, যেসব বিষয়ের
দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়নি, কিংবা যেসব বিষয় তারা ভালো পারে না। ফলে তারা নিজেদের জন্য
এবং উম্মতের জন্যও অনিষ্ট বয়ে নিয়ে আসে।
[অনুবাদকের টীকা: আল্লাহ শাইখকে উত্তম পুরস্কার দিন। আমরা এ ধরনের কত লোককেই
না দেখে থাকি! দু পাতা পড়া বিদ্যা নিয়ে তালাকের জটিল ফতোয়া দেওয়া লোকেরা, কাশ্মীর-আফগান-সিরিয়ায়
জিহাদে যাওয়ার জন্য ফতোয়াদাতা ভুঁইফোড় মুফতিরা, সেসব মুফতির ফতোয়া নিয়ে প্রচার-প্রসারে
লেগে যাওয়া অপরিণামদর্শী বুদ্ধুরা, কাফির রাষ্ট্রের সাথে কোনো মুসলিম দেশের চুক্তি
হলে তা নিয়ে বিনা ইলমে ফতোয়া কপচানো আবেগীরা, আর প্রত্যেক ইস্যুতেই জবান দরাজ করা সেলিব্রেটিরা
সবাই শাইখের আলোচ্য লোকদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর কাছে এদের থেকে পানাহ চাই এবং এদের
কর্মকাণ্ড থেকেও পানাহ চাই। টীকা সমাপ্ত]
·
[২৩শ মূলনীতি: সুস্পষ্ট-পরিষ্কার পথে চলা এবং দ্ব্যর্থবোধক-অস্পষ্ট বিষয় পরিহার
করা]
ফিতনার একটি ফিকহ—সুস্পষ্ট-পরিষ্কার পথে চলা এবং দ্ব্যর্থবোধক-অস্পষ্ট বিষয়
পরিহার করা। মহান আল্লাহ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। মহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের
দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের
জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।” [সুরা মাইদাহ: ৩]
ইসলামের যেসব বিধান জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, সেসবের সংখ্যা অনেক ও সেগুলো
সুস্পষ্ট। তাই মুমিনের উচিত হবে, সুস্পষ্ট-পরিষ্কার বিধিবিধানের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য
অর্জন করতে সচেষ্ট হওয়া; ইখলাস বজায় রাখলে যেসব বিধানের আমল নিঃসন্দেহে জান্নাতের পথ
হিসেবে বিবেচিত। আর মুমিনের উচিত দ্ব্যর্থবোধক-অস্পষ্ট বিষয় পরিহার করা, যেগুলোর ক্ষেত্রে
সে হবে প্রতারিত। পক্ষান্তরে যেসব বিষয় হকের পরিপন্থি হিসেবে সুস্পষ্ট, সেগুলো আরও
আগে পরিত্যাগ করতে হবে। মুতার্রিফ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “(নিজেকে ও উম্মতকে) প্রতারণার
মাধ্যমে জিহাদের ফজিলত তালাশ করার চেয়ে জিহাদে গমন না করে বসে থাকার মধ্যে যে আস্থা
ও নির্ভরতা আছে, তা গ্রহণ করাই আমার কাছে উত্তম।” [ইবনু সাদ কৃত তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড:
৭; পৃষ্ঠা: ১৪৩]
ইবনুল আশআসের ফিতনার সময় মুতার্রিফ রাহিমাহুল্লাহর কাছে একদল লোক আগমন করে তাঁকে
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সাথে যুদ্ধ করতে ডাকছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে বল দেখি,
তোমরা আমাকে যে কাজ করতে ডাকছ, তা কি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে বেশি কিছু?” তারা
বলল, “না, এরচেয়ে বেশি নয়।” তিনি বললেন, “তাহলে আমি একটি ফজিলত পাওয়া এবং ধ্বংসে নিপাতিত
হওয়ার মাঝে বাজি ধরতে পারব না।” [ইবনু সাদ কৃত তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১৪৩;
ইবনু আসাকির কৃত তারিখু দিমাশক, খণ্ড: ৫৮; পৃষ্ঠা: ৩১৫]
তাবেয়ি ইবনু সিরিন রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, একদা সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস
রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলা হলো, “আপনি কি লড়াই করবেন না? আপনি তো শুরা সদস্যদের একজন?
অন্যদের চেয়ে শাসক হওয়ার হক তো আপনারই বেশি!” তিনি বললেন, “আমি ততক্ষণ লড়াই করব না,
যে পর্যন্ত তারা আমার কাছে এমন তরবারি নিয়ে আসছে, যার দুটো চোখ আছে, একটি জবান ও দুটো
ঠোঁট আছে (যা বলে দেবে, কে কাফির, আর কে মুসলিম; বলে দেবে, এ জিহাদ শরিয়তসম্মত কিনা)।”
[মুসান্নাফ আব্দির রাযযাক, হা/২০৭৩৬; তাবারানি কৃত মুজামুল কাবির, হা/৩২২; মুস্তাদরাকুল
হাকিম, হা/৮৩৭০; হাকিম হাদিসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন এবং হাইসামি বলেছেন, এ হাদিসের বর্ণনাকারীরা
আস-সহিহ গ্রন্থের (বুখারি বা মুসলিমের) বর্ণনাকারী।]
·
[২৪শ মূলনীতি: দায়িত্বের প্রতি যত্নবান হওয়া]
দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল হতে সচেষ্ট থাকা ফিতনার ফিকহের অন্তর্গত। আল্লাহ প্রত্যেককে
যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল হওয়ার চেষ্টা করা তার জন্য ওয়াজিব।
আর তা সম্পন্ন হবে—যাদের প্রতি সে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের জন্য কল্যাণ আনয়ন এবং
তাদের থেকে অকল্যাণকে প্রতিহত করার মাধ্যমে। ফিতনার সময় উক্ত আবশ্যকীয়তা আরও গুরুত্ববহ
হয়ে ওঠে। কারণ ফিতনাবাজরা যুবাদের ছিনিয়ে নিতে এবং তাদেরকে ফিতনার ফাঁদে ফেলতে নানাবিধ
প্রচেষ্টা চালায়। তাই প্রত্যেক দায়িত্বশীলের কর্তব্য হবে নিজের দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব
দেওয়া এবং যাদের প্রতি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَا مِنْ عَبْدٍ اسْتَرْعَاهُ اللهُ رَعِيَّةً فَلَمْ يَحُطْهَا بِنَصِيحَةٍ إِلاَّ لَمْ يَجِدْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ “কোনো বান্দাকে যদি আল্লাহ
জনগণের দায়িত্ব প্রদান করেন, আর সে কল্যাণকামী হয়ে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে
সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।” [সহিহ বুখারি, হা/৭১৫০; সহিহ মুসলিম, হা/১৪২] নবি
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, مَا مِنْ وَالٍ يَلِي رَعِيَّةً مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَيَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لَهُمْ إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ “যে দায়িত্বশীল ব্যক্তিই একদল মুসলিম জনগণের দায়িত্ব লাভ করার পর মৃত্যুবরণ
করে এ অবস্থায় যে, সে জনগণের সাথে খেয়ানতকারী, তাহলেই আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম
করে দেবেন।” [সহিহ বুখারি, হা/৭১৫১; সহিহ মুসলিম, হা/১৪২]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللَّهُ رَعِيَّةً يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ “আল্লাহ যাকেই জনগণের দায়িত্ব
দেন, আর তার মৃত্যু হয় খেয়ানতকারী হিসেবে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে
দেবেন।” [সহিহ মুসলিম, হা/১৪২; ইমান অধ্যায় (১); পরিচ্ছেদ: ৬৩]
[অনুবাদকের টীকা: এখানে একটি সুপ্রসিদ্ধ হাদিস নিয়ে আসা অপ্রাসঙ্গিক হবে না
বলে মনে করছি। ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ “জেনে রেখ, তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীন
লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক বা নেতা তার অধীন লোকদের প্রতি দায়িত্বশীল এবং
সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার পরিবারের লোকদের প্রতি দায়িত্বশীল,
সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। প্রত্যেক স্ত্রী স্বীয় স্বামীর গৃহ ও সন্তানের প্রতি
দায়িত্বশীল, সেও এদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মুনিবের ধনসম্পদের প্রতি
দায়িত্বশীল, সেও এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই (নিজ নিজ স্থানে)
এক একজন দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীন লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা
হবে।” (সহিহ বুখারি, হা/৭১৩৮; সহিহ মুসলিম, হা/১৮২৯) টীকা সমাপ্ত]
·
[২৫শ মূলনীতি: আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেওয়া, ফিতনা থেকে পানাহ চাওয়া]
আল্লাহর শরণ নেওয়া, ফিতনা থেকে পানাহ চাওয়া এবং ফিতনা সংঘটনের আগে-পরে সর্বদাই
দোয়া করা ফিতনার একটি অন্যতম ফিকহ। সবচেয়ে বিশিষ্ট মূলনীতি এটাই। ফিতনা সংঘটনের আগে
যেমন এটা ধারণ করতে হবে, তেমনি সংঘটনের পরেও এটা অবলম্বন করতে হবে। যাইদ বিন সাবিত
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنَ الْفِتَنِ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ. قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الْفِتَنِ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ “তোমরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য
সকল ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো।” সাহাবিগণ বললেন, “প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য
সকল ফিতনা থেকে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইছি।” [সহিহ মুসলিম, হা/২৮৬৭; জান্নাত অধ্যায়
(৫৩); পরিচ্ছেদ: ১৭]
আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান বিন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
سَأَلْتُ عَائِشَةَ أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ بِأَىِّ شَىْءٍ كَانَ نَبِيُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَفْتَتِحُ صَلاَتَهُ إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ قَالَتْ كَانَ إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ افْتَتَحَ صَلاَتَهُ : اللَّهُمَّ رَبَّ جِبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
আমি উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞেস করলাম, “নবি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে যখন নামাজ পড়তেন, তখন কীভাবে তাঁর নামাজ শুরু করতেন?” জবাবে
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাতে যখন তিনি নামাজ পড়তে উঠতেন, তখন এ দোয়া পড়ে
নামাজ শুরু করতেন, “হে আল্লাহ, জিবরিল, মিকাইল ও ইসরাফিলের প্রতিপালক, আকাশ ও জমিনের
সৃষ্টিকর্তা, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ের পরিজ্ঞাতা, আপনার বান্দারা যেসব বিষয়ে
মতানৈক্য করে, আপনিই সেগুলোর ফায়সালা করবেন। আপনার সৃষ্টিগত অনুমতিক্রমে সত্য ও ন্যায়সংক্রান্ত
যেসব বিষয়ে মতানৈক্য হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আপনি আমাকে সুপথ দেখান। বস্তুত আপনিই যাকে
ইচ্ছে সরল পথ দেখিয়ে থাকেন।” [সহিহ মুসলিম, হা/৭৭০; মুসাফিরদের নামাজ অধ্যায় (৬);
পরিচ্ছেদ: ২৬]
হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “নিশ্চয় মানুষের কাছে এমন এক জামানা আসবে,
যে জামানায় পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তির প্রার্থনার ন্যায় প্রার্থনাকারী ব্যতিরেকে আর কেউ
মুক্তি পাবে না।” [মুসান্নাফ ইবনি আবি শাইবা, হা/২৯১৭৩]
·
[২৬শ মূলনীতি: আল্লাহর কিতাব, রসুলের সুন্নাহ ও সালাফদের মানহাজের দিকে প্রজ্ঞাপূর্ণ
আহ্বান ফিতনার অন্তর্গত নয়]
ফিতনার আরেকটি ফিকহ—উত্তম উপদেশ ও প্রজ্ঞা সহকারে আল্লাহর কিতাব ও রসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দিকে মানুষদের আহ্বান করা এবং এ উম্মতের প্রথম সারির
লোকদের আল্লাহ যে কর্মপন্থা দিয়ে সংশোধন করেছেন তার দিকে আহ্বান করা ফিতনার আওতাভুক্ত
নয়। এ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। যাতে কোনো মুসলিম হক সহকারে হকের দিকে
দাওয়াত দেওয়া বন্ধ করে না দেয় এই ভয়ে যে, তাকে ‘ফিতনাবাজ দাঈ’ বলে বিদ্রুপাত্মক ট্যাগ
লাগানো হবে! প্রকৃতপ্রস্তাবে উত্তম উপদেশ ও প্রজ্ঞা সহকারে আল্লাহর কিতাব ও রসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দিকে মানুষদের আহ্বান করা এবং এ উম্মতের প্রথম সারির
লোকদের আল্লাহ যে কর্মপন্থা দিয়ে সংশোধন করেছেন তার দিকে আহ্বান করাই সংস্কারক সৎকর্মশীল
বান্দাদের পথ, তাঁদের কর্মপদ্ধতি। যদিও তাঁদের দাওয়াতের প্রকৃত ব্যাপার যারা বোঝে না,
তারা ভ্রমাত্মক ধারণা পোষণ করে থাকে, তাঁদের দাওয়াতে ফিতনা আছে!
যত সংস্কারক আছে, যাঁরা দাওয়াতের এই পথ অবলম্বন করে থাকেন, তাঁরা মূলত নবি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অনুসরণ করেন। মহান আল্লাহ বলেছেন, قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ ۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي ۖ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ “বল, এটা আমার পথ। আমি জ্ঞান
সহকারে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও (জ্ঞান সহকারে আহ্বান
করে)। আমি আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” [সুরা ইউসুফ:
১০৮] তিনি আরও বলেছেন, ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ “তুমি তোমরা রবের পথে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম
পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক করো। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন, কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট
হয়েছে এবং তিনি খুব ভালো করেই জানেন কারা হেদায়েতপ্রাপ্ত।” [সুরা নাহল: ১২৫]
যে ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ
করবে, সে-ই বিষয়টি খুব স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। নবি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে হক নিয়ে এসেছেন এবং হকের দিকে আহ্বান করেছেন।
যারা তাঁর প্রতি ইমান আনেনি, তাঁদের কথাগুলোর মাঝে এ কথাও ছিল—“এ লোক পিতা-পুত্রের
মাঝে বিভেদ তৈরি করছে।” তথাপি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত বন্ধ করেননি।
বরং ধৈর্য ধরেছেন, ধৈর্যের সাথে এসব প্রতিরোধ মোকাবেলা করেছেন এবং আল্লাহর পথে সত্যিকারের
জিহাদ করেছেন।
সংস্কারক ব্যক্তিবর্গের অবস্থাও এমনই ছিল, যাঁরা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
অনুসরণ করে গেছেন। যেমন ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ,
শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ এবং জ্ঞানী বাদশা আব্দুল
আযিয আলু সাউদ (ইনি তৃতীয় সৌদি আরব তথা বর্তমান সৌদি আরব কিংডমের স্থপতি বাদশা আব্দুল
আযিয – অনুবাদক) প্রমুখ। বাদশা আব্দুল আযিয যখন তাওহিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন এবং
আল্লাহর শরিয়তকে ফায়সালাকারী নির্ধারণ করলেন, তখন তাঁর যুগের অনেক মানুষ এসবকে ফিতনা
আখ্যা দিয়েছিল এবং তাঁর নিন্দা-সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাহিমাহুল্লাহ
হককে আঁকড়ে ধরেছিলেন, ধৈর্যের সাথে বিরোধীদের মোকাবেলা করেছিলেন এবং এসব বিষয়ে অনেক
খুতবা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “আমরা নতুন মাযহাব ও নতুন আকিদার ধারকবাহক নই। ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের
আকিদাই আমাদের আকিদা।”
তিনি আরও বলেছিলেন, “কিতাব ও সুন্নাহ থেকে যত লোকের কাছে আমাদের জন্য নসিহত
রয়েছে, আমরা সর্বদা সেই নসিহত গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রয়েছি, তা সে ছোটো বিষয়েই হোক,
কিংবা বড়ো বিষয়ে। আর যে আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে, আমরা কিতাব-সুন্নাহর পরিপন্থি কাজ
করব, আমরা কখনোই তার সে কথা গ্রহণ করব না। আল্লাহ আমাদের ইসলামের শরিয়ত অনুসরণের নির্দেশ
দিয়েছেন এবং এ শরিয়তকে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার আদেশ দিয়েছেন। আমাদের দ্বীনকে দৃঢ়হস্তে
আঁকড়ে ধরার জন্য যারা আমাদের ওপর রাগান্বিত হয়েছে, তারা যতখুশি আমাদের ওপর রাগতে থাকুক।
আমাদের মুসলিম ভাইদের সকল বিষয় আমরা মেনে নিব, যেসবের মাঝে আছে কল্যাণকামিতা। তবে একটি
শর্ত আছে। তাদের নসিহত-কল্যাণকামিতা হতে হবে হকের ক্ষেত্রে। আর দুটো বিষয় কখনোই মেনে
নেওয়া সম্ভব নয়। যদিও পুরো পৃথিবীবাসী আমাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং লড়াই করতে
করতে আমাদের একজনও অবশিষ্ট না থাকে। একটি বিষয়: আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন,
যদিও তা সরষেদানা পরিমাণ হয়। কারণ স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য চলবে না। কিতাব
ও সুন্নাহ থেকে আমরা কখনোই সরে দাঁড়াব না।”
অনুরূপভাবে যারাই নিজেদের দাওয়াতে সংস্কার আনতে চায়, এই মানহাজ ধারণ করা তাদের
সবার জন্য আবশ্যক। আর তাদের জেনে রাখা কর্তব্য, তারা কল্যাণ, হেদায়েত ও সুন্নাহর আহ্বায়ক,
অকল্যাণ ও ফিতনার আহ্বায়ক নয়।
[শেষকথা]
আমি ইমাম আবু আমর আদ-দানি রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য পেশ করে আমার আলোচনার সমাপ্তি
টানব। আবু আমর আদ-দানি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যেই ইলম জেনেছে তা প্রচার করা এবং যেই
হাদিস শুনেছে তা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে উলামা ও হাদিস বর্ণনাকারী ব্যক্তিবর্গের ওপর
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। সেই দায়িত্ব রক্ষার্থে আমি এ গ্রন্থে ফিতনা
ও তার দুর্বিপাক, বিভিন্ন যুগ ও সেসবের অনিষ্টতা এবং কেয়ামত ও তার নিদর্শনাবলি সম্পর্কে
পর্যাপ্ত একগুচ্ছ হাদিস সংকলন করেছি। যাতে বুদ্ধিমান মুমিন এসব হাদিসে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যে
সজ্জিত হতে সক্ষম হয়, নিজেকে এসবের পরিচর্যায় নিয়োগ করতে পারে, এবং এসব বৈশিষ্ট্য কাজে
লাগানোর পাশাপাশি এগুলো আঁকড়ে ধরতে জোর প্রচেষ্টা চালাতে পারে। আর রক্তপাত, সম্পদলুণ্ঠন,
হারামকে হালালকরণ প্রভৃতির মতো যেসব বিষয় ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর আপতিত হয়েছে—যা বান্দার
দ্বীনকে ছিনিয়ে নেয় এবং ইমানকে দুর্বল করে তোলে—সেসবের ভয়াবহতা যেন তার কাছে পরিষ্কার
হয়ে যায়, তাই এগুলো সংকলন করেছি। এতে করে সে নিজ দ্বীনের বিনষ্টি ও বিলয়ের আশঙ্কায়
নিজের অবস্থা সংশোধনের জন্য আমল করতে পারবে।” [আস-সুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খণ্ড:
১; পৃষ্ঠা: ১৭৭-১৭৮]
আল্লাহই ভালো জানেন, তবে আমার মনে হয়েছে, উদ্ধৃত মূলনীতিগুলোই ফিতনার ফিকহের
সবচেয়ে বিশিষ্ট মূলনীতি। আমি এগুলো জমা করেছি সর্বজায়গায় অবস্থানরত আমার মুসলিম ভাইদের
জন্য। আল্লাহর নান্দনিক নাম ও সুউন্নত গুণাবলির অসিলায় আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা
করছি, তিনি যেন প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ফিতনার অনিষ্ট থেকে মুসলিমদের হেফাজত করেন।
আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। আল্লাহ অজস্র সালাত ও সালাম ধার্য করুন আমাদের নবি মুহাম্মাদের
জন্য।
·সমাপ্ত, আলহামদুলিল্লাহ।
·অনুবাদক: মুহাম্মাদ
আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari
আমাদের ওয়েব সাইটঃ- https://salafi-pdfbooks.blogspot.com/
আমাদের ওয়েব সাইটঃ- https://salafi-pdfbooks.blogspot.com/
আমাদের ওয়েব সাইটঃ https://salafimp3web.blogspot.com/
0 Comments