▌তাবলিগ জামাত সম্পর্কে ইমামদ্বয়ের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? [১ম পর্ব]

তাবলিগ জামাত সম্পর্কে ইমামদ্বয়ের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? [১ম পর্ব]
·পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। যিনি বলেছেন, “ওহে যারা ইমান এনেছ, তোমরা যা করো না, তা কেন অন্যদের করতে বল? তোমরা যা করো না, তা (অন্যদের করতে) বলা আল্লাহর নিকট অতিশয় ক্রোধজনক।” [সুরা সফ: ২-৩] তিনি আরও বলেছেন, “(অনুমান ভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক।” [সুরা জারিয়াত: ১০]

অজস্র সালাত ও সালাম অবতীর্ণ হোক প্রিয় নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর প্রতি। যিনি বলেছেন, “নিশ্চয় মানুষ এমন কথাও বলে, যাতে সে কোনো ক্ষতি আছে বলে মনে করে না; অথচ এর জন্যই সে ৭০ বছরের পথ জাহান্নামে অধঃপতিত হয়।” [তিরমিজি, হা/২৩১৪; সনদ: হাসান]
· পূর্বাভাস:
পথভ্রষ্ট ফের্কা তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে গত ৬ই জুমাদাল উলা ১৪৪৩ হিজরি মোতাবেক ১০ই ডিসেম্বর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে সৌদি আরবের মসজিদগুলোতে খুতবা দেওয়া হয় এবং তাবলিগ জামাত থেকে সতর্ক করা হয়। সেদিন তাবলিগ জামাত প্রসঙ্গে আমাদের সালাফি উলামাগণ অনেক খুতবা দিয়েছেন। এর আগেও তাঁরা তাবলিগ জামাত থেকে সতর্ক করে বিভিন্ন সময় খুতবা দিয়ে এসেছেন। তাঁদের সেসব খুতবা ও বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই সালাফি জনতা প্রচার করেছে। কারণ এগুলো প্রচার করা তাদের ইমানি দায়িত্ব। তারা কুফর-শির্ক-বিদাতে ভরপুর একটি ফের্কা থেকে সতর্ক করে, প্রিয় নবিজির নির্দেশ মান্য করে মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণকামী থাকতে চেষ্টিত হয়েছে।

কিন্তু এতে মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে একদল সালাফি দাবিদারের। ‘মুসলিম ভাইদের প্রতি কেন এই আগ্রাসান?’ – বলে তারা সালাফিদের প্রতি বিদ্রুপ করে বেড়াচ্ছে। যদিও খোদ তাবলিগ জামাত কুফরি আকিদা ছড়িয়ে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতিসাধন করে চলেছে, সেদিকে তারা ভ্রুক্ষেপ করছে না। এমনই একজন মানুষ হলেন সালাফি দাবিদার ফেসবুক সেলিব্রেটি জনাব মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার ভাই।

তিনি দাবি করেছেন, সালাফিরা যেভাবে প্রচার করে, আসলে তাবলিগ জামাত তেমন নয়। বরং সালাফি বিদ্বান ইমাম ইবনু উসাইমিন ও ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুমাল্লাহ তাবলিগ জামাতের প্রশংসা করেছেন। এছাড়াও নানাকথা বলে তিনি নিজেকে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো মহানুভব মানুষ হিসেবে জাহির করেছেন, আর সালাফিদের জালেম প্রমাণ করেছেন। তিনি এ মর্মে তিনটি পোস্ট দিয়েছেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা তাবলিগ জামাত ইস্যুতে মিনার সাহেবের করা প্রথম দুটো পোস্ট এবং তাঁর করা তৎসংশ্লিষ্ট মন্তব্যের পর্যালোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। পোস্ট দুটোর লিংক আমি দিয়ে দিচ্ছি। প্রথম পোস্টের লিংক: https://tinyurl(ডট)com/32j5p926। দ্বিতীয় পোস্টের লিংক: https://tinyurl(ডট)com/3bzpydtw।

এখানে একটি বিষয় খোলাসা করে বলে রাখি। উলামাগণ তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে যে বিদাতি হুকুম দিয়েছেন, তা অনির্দিষ্টভাবে একটি দলকে দেওয়া হুকুম। তাবলিগ জামাতের প্রতিটি ব্যক্তি নির্দিষ্টভাবে এই হুকুমের আওতাভুক্ত হবে না। কারণ অনেক মানুষ তাবলিগ জামাতের প্রকৃত আকিদা ও মানহাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এজন্য আমরা দেখি, আমাদের অনেক অজ্ঞ আহলেহাদিস ভাইও তাবলিগ জামাতের সাথে জড়িত। তারা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছেন। আর তাইতো তাদেরকে সতর্কের জন্য উলামাগণ এত এত কথা বলেছেন, নসিহত করেছেন। এই কথাগুলো আমি মুজাদ্দিদুল ইয়ামান ইমাম মুকবিল আল-ওয়াদিয়ির আলোচনা থেকে শিখেছি, যিনি অনুরূপ কথা মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে ব্যক্ত করেছেন।

বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছি, তা একনজরে দেখে নিই। প্রথমত, ‘পূর্বাভাস’ উপশিরোনামে নিবন্ধের ভূমিকা লেখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রশংসা ও সমালোচনায় বৈপরীত্য দেখা দিলে করণীয় বিষয়ে প্রামাণ্য আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর মত পরিবর্তন এবং তাবলিগ জামাতকে বিদাতি ঘোষণার ব্যাপারটি প্রমাণ করা হয়েছে। চতুর্থত, ‘ইমাম ইবনু বায কি তাবলিগ জামাতের প্রশংসা করেছেন?’ – উপশিরোনামের আওতায় উদ্ধৃতি উপস্থাপনায় মিনার সাহেবের কারচুপি দেখানো হয়েছে।

পঞ্চমত, তাবলিগ জামাতকে বিদাতি বলে যারা ন্যায়চ্যুত এবং বিকৃত মানহাজের অনুসারী হলেন এমন সালাফি উলামাগণের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ষষ্ঠত, তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ যে মত পরিবর্তন করেছেন এবং তাবলিগ জামাতকে বিদাতি আখ্যা দিয়েছেন তা সুপ্রমাণিত করা হয়েছে। সপ্তমত, জনাব মিনার কর্তৃক ইমাম ইবনু বাযকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি জনাব মিনারের ছড়ানো সংশয়ের—ইমাম ইবনু বায দেওবন্দিদের প্রকৃত ব্যাপার জেনেই তাদের প্রশংসা করেছেন দাবিটির—জবাব দেওয়া হয়েছে।

অষ্টমত, তাবলিগিদের ডিফেন্সে জনাব মিনারের কিছু ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ও কূটকৌশলের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। নবমত, ‘ইমাম ইবনু বায ও ইমাম উসাইমিনের মানহাজ বনাম জনাব মিনারের মানহাজ’ উপশিরোনামের আওতায় মিনার সাহেবের কর্মের সাথে তাঁর দাবির পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং তাঁর আরও কিছু ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখানো হয়েছে। দশমত, ‘মজলুম ভাবব্যঞ্জক মিনার সাহেব যখন নিজেই জালেম’ উপশিরোনামের আওতায় মিনার সাহেবের জুলুমের ফিরিস্তি বিবৃত হয়েছে। আমার মনে হয়, নবম ও দশম আলোচনা দুটো এই নিবন্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একাদশত, এই নিবন্ধের ফলাফল বলে নিবন্ধের উপসংহার টানা হয়েছে।

·
প্রশংসা ও সমালোচনায় বৈপরীত্য দেখা দিলে করণীয়:

প্রশংসা ও সমালোচনায় বৈপরীত্য দেখা দিলে তা দুটো অবস্থার বাইরে যায় না। যথা: এক. বৈপরীত্য পাওয়া যায় একাধিক ইমামের বক্তব্যে। দুই. বৈপরীত্য পাওয়া যায় একজন ইমামের বক্তব্যে। মুহাদ্দিসগণের নীতিমালা অনুসারে প্রথম ক্ষেত্রটিতে মৌলিক অবস্থা হচ্ছে—ব্যাখ্যাপূর্ণ সমালোচনাকে প্রশংসার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হবে। যেমন হাফিজ ইবনু হাজার আল-আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “সমালোচনার কারণ বিষয়ে প্রাজ্ঞ এমন ব্যক্তির নিকট থেকে ব্যাখ্যাপূর্ণ সমালোচনা প্রকাশিত হলে সেটাকে প্রশংসার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হবে।” [হাফিজ ইবনু হাজার বিরচিত নুখবাতুল ফিকার ফি মুসতালাহি আহলিল আসার, পৃষ্ঠা: ৩০; তাহকিক: শাইখ আব্দুল মুহসিন আল-কাসিম; প্রকাশকাল: ১৪৪০ হি./২০১৯ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, অর্থাৎ একজন ইমামের বক্তব্যে বৈপরীত্য পাওয়া গেলে, দুটো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। হয় উক্ত ইমামের অভিমত পরিবর্তিত হয়েছে, তা প্রমাণিত হবে। তখন শেষের অভিমতকে তাঁর মত হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে। আর নাহয় মত পরিবর্তনের বিষয়টি প্রমাণিত হবে না। তখন সম্ভব হলে দুটো মতকে সমন্বয় করতে হবে। সমন্বয় করা সম্ভব না হলে বিভিন্ন ইঙ্গিতবহ প্রমাণের ভিত্তিতে দুটো মতের মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আর ইঙ্গিতবহ প্রমাণও না পাওয়া গেলে দুটো অভিমতের মধ্যে যেটা জারহ-তাদিলের অন্যান্য ইমামের অভিমতের অধিক নিকটবর্তী, সেই মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। [বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: শাইখ আব্দুল আজিজ বিন মুহাম্মাদ আল-আব্দুল লাতিফ রাহিমাহুল্লাহ বিরচিত দাওয়াবিতুল জারহি ওয়াত তাদিল, পৃষ্ঠা: ৬০; মাকতাবাতুল উবাইকান কর্তৃক প্রকাশিত; সন-তারিখবিহীন সফটকপি]

·
তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর মত পরিবর্তন:

জনাব মিনার তাবলিগ জামাতের পক্ষে ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর ফতোয়া অনুবাদ করে প্রচার করেছেন এবং সেই ফতোয়া দিয়ে সালাফিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভ্রষ্ট ফের্কা তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ তাঁর পূর্বের মত পরিবর্তন করেছেন। তিনি তাবলিগ জামাতের সমালোচনা করেছেন, তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘নিকৃষ্ট বিদাত’ আখ্যা দিয়েছেন এবং তাবলিগ জামাতকে ‘বিদাতি’ ঘোষণাও দিয়েছেন। মহান আল্লাহর তৌফিকে আমরা পর্যায়ক্রমে আমাদের দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করছি।

ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ পরিবারের লোকদের এবং অসহায়-মিসকিন মানুষদের ভরণপোষণ বহন করা মানুষদের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “এ হাদিস থেকে ওই সম্প্রদায়ের মূর্খতা প্রতীয়মান হয়, যারা ডানে-বামে বের হয়, আর নিজ পরিবারের লোকদেরকে তাদের বাড়িতে মহিলাদের সাথে রেখে চলে যায়। তাদের খোরপোষের ব্যবস্থাকারী কেউ থাকে না। তাদের ভরণপোষণ ও দেখাশোনা করবে এমন কারও মুখাপেক্ষী থাকে তারা। অথচ এদের দেখবে, এরা জনপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো কখনো এরা নগরীতেও ঘুরে বেড়ায় বিনা প্রয়োজনে। এদের অন্তরে ত্রুটি রয়েছে। এরা মনে করে, পরিবারকে আদবকেতা শেখানোর জন্য তাদের মাঝে অবস্থান করার চেয়ে এটাই উত্তম।

অথচ এটা একটা ভুল ধারণা। কেননা পরিবারে অবস্থান করা, পুত্রকন্যা সন্তানদের ও স্ত্রীবর্গ প্রমুখকে শিক্ষাদান করা তাদের ওই বহির্গমনের চেয়ে উত্তম। যে ব্যাপারে তারা মনে করছে, তারা আসলে মানুষদের হেদায়েতের পথ দেখাচ্ছে। তারা নিজ পরিবারের লোকদের ছেড়ে রাখে, যারা কিনা অন্যদের চেয়ে নসিহত ও পথনির্দেশনা প্রাপ্তির অধিক হকদার। এজন্য মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ (সুরা শুয়ারা: ২১৪) সকলের পূর্বে নিকটতম আত্মীয়দের দিয়ে তিনি শুরু করেছেন। অথচ এরা এমন সম্প্রদায়, যারা আপন পরিবার রেখে বের হয় চারমাসের জন্য, পাঁচমাসের জন্য, কেউবা একসালের জন্য। পরিবারের লোকদের তারা প্রবৃত্তি ও হাওয়ার কাছে ছেড়ে রাখে, যা তাদের ধ্বংসে নিপাতিত করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের জ্ঞানের ঘাটতির দরুন এটা সম্পন্ন হয়ে থাকে।”

এর খানিকপরে তাবলিগ জামাত প্রসঙ্গে শাইখের সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছেন, “তাবলিগের লোকজন ভালো, কোমল। কিন্তু তাদের মানহাজ স্পষ্ট (অর্থাৎ ভালো নয়)। কারণ তারা ইলমের প্রতি আগ্রহী নয়।” [দেখুন: https://youtu.be/7iA7Kvw0nVs]

ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের ইজতেমাকে ‘বিদাত’ ঘোষণা দিয়েছেন। ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর ছাত্র, কুয়েতের প্রখ্যাত বিদ্বান শাইখ সালিম বিন সাদ আত-তাউয়িল হাফিযাহুল্লাহ বলেছেন, “আমাদের শাইখ ইবনু উসাইমিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহ (তাবলিগ জামাতের সাথে) বহির্গমনের মাসআলায় সতর্ক করেছেন। দলটিকে ‘জামাআতুত তাবলিগি ওয়াদ দাওয়াহ’ বলা হয়, আবার ‘আহবাব’ নামেও এদের ডাকা হয়। তাদের একটি বার্ষিক ইজতেমা হয় বাংলাদেশে। তিনি (ইমাম ইবনু উসাইমিন) বলেছেন, ‘এটা হজের সমাবেশের প্রতিদ্বন্দ্বী।’ এটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যে এই বার্ষিক ইজতেমায় বের হয়, সে তাদের কাছে একটি মর্যাদাবহ স্তরে পৌঁছে যায়। এটা বার্ষিক সমাবেশ এবং তারা এতে লেগে থাকে। প্রতি বছর তারা বাংলাদেশে জমায়েত হয়। তিনি (ইমাম ইবনু উসাইমিন) বলেছেন, এটা সুবিদিত বার্ষিক হজ সমাবেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। এটা নিকৃষ্ট বিদাত। হজের সমাবেশ ব্যতিরেকে কোথাও বার্ষিক জমায়েতের বিধান নেই।” [দেখুন: https://youtu.be/bVNpiYps6XE]

ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর কাছে তাবলিগ জামাতের স্বরূপ স্পষ্ট হওয়ার পর তিনি তাবলিগ জামাতকে ‘বিদাতি দল’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সালাফিয়্যাহর ইমাম, মদিনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাকিহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসুলবিদ, আল্লামা শাইখ উবাইদ বিন আব্দুল্লাহ আল-জাবিরি হাফিযাহুল্লাহ (জন্ম: ১৩৫৭ হি.) বিষয়টি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন। শাইখ উবাইদ হাফিযাহুল্লাহ বলেছেন, “আমাদের ভাই আবু উমার আশ-শাইখ আব্দুল আজিজ আল-খালিফা আমাদের কাছে প্রতিপালন মন্ত্রণালয়ের মুদার্রিস (শিক্ষক) আহালির রস (أهالي الرس) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, শাইখ মুহাম্মাদ বিন উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তাবলিগ জামাতকে বিদাতি বলেছেন।

তোমরা এটা বর্ণনা করো। তোমাদের সংখ্যা কত? তোমরা বল, আমাদের কাছে উবাইদ আল-জাবিরি বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমাদের কাছে আবু উমার আশ-শাইখ আব্দুল আজিজ আল-খালিফা বর্ণনা করেছেন এবং তিনি তাঁর সাথে আরও দুইজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁরা এর সাক্ষ্য দিয়েছেন। তোমরা এটা বর্ণনা করো। আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বরকত দিন। তোমরা ভয় কোরো না। কিন্তু হিকমাহ সহকারে। আমরা এর স্বীকৃতি দিচ্ছি। আমরা এটা বারবার বলছি তোমাদের কাছে এবং তোমাদের মতো যারা আমাদের নসিহত অনুসন্ধান করে, আর আমাদের নিকট কী রয়েছে তা অনুসন্ধান করে, তাদের কাছে।” [দ্র.: http://ar(ডট)alnahj(ডট)net/audio/759 (টেক্সট সংগৃহীত হয়েছে সাহাব ডট নেট থেকে)]

এতদ্ব্যতীত তাবলিগ জামাতকে ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক বিদাতি আখ্যানের বিষয়টি উলামাদের বচনে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এজন্য আমরা দেখতে পাই, সৌদি আরবের প্রখ্যাত বিদ্বান শাইখ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আন-নাজমি হাফিযাহুল্লাহ ৬ই জুমাদাল উলা, ১৪৪৩ হিজরি তারিখের খুতবায় উল্লেখ করেছেন, “শাইখ আল্লামা মুহাম্মাদ বিন উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ তাবলিগ জামাত এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে বলেছেন, ‘তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।” [সম্পূর্ণ খুতবার অনুবাদ দেখুন: https://tinyurl(ডট)com/5n7x498w]

এ আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে তাঁর মত পরিবর্তন করেছেন। তিনি প্রথমে তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে তাঁর নিকটে থাকা ইলম অনুযায়ী প্রশংসা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এদের স্বরূপ জানতে পেরে তাঁর মত পরিবর্তন করে নিয়েছেন। জারহ-তাদিল শাস্ত্রে মুহাদ্দিসগণের এমন মত পরিবর্তনের ঘটনা নেহায়েত কম নয়। যেমন সাওয়াব বিন উতবার বায়োগ্রাফিতে আব্বাস আদ-দুরি বলেন, “আমি ইয়াহইয়া বিন মায়িনকে বলতে শুনেছি, ‘এ বর্ণনাকারী সত্যবাদী শাইখ।’ যদিও ইতঃপূর্বে আমি আবু জাকারিয়া তথা ইয়াহইয়া বিন মাইন থেকে বর্ণনাপূর্বক লিখতাম, ‘এর সমস্যা আছে। সে দুর্বল বর্ণনাকারী।’ কিন্তু আবু জাকারিয়া তাঁর মত থেকে ফিরে এসেছেন। এটাই তাঁর সর্বশেষ অভিমত।” [তারিখু বাগদাদ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৭২; গৃহীত: দাওয়াবিতুল জারহি ওয়াত তাদিল, পৃষ্ঠা: ৬০]

আর যদি ধরেও নেওয়া হয়, ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ তাবলিগের প্রশংসা করেছেন এবং প্রশংসার মত থেকে ফিরে আসেননি, যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। স্রেফ কথার কথা বলছি। যদি তাঁর মত পরিবর্তনের ঘটনা নাও ঘটত, তবুও তাঁর এ মত কখনোই গ্রহণীয় হতো না। কক্ষনো না। কারণ তিনি যদি এদের প্রকৃত স্বরূপ জানতেন, তাহলে জীবনেও এদের প্রশংসা করতেন না। মনে রাখবেন, ইমাম ইবনু উসাইমিনের চেহারাকে আল্লাহ উজ্জ্বল করে দিন, তিনি স্পষ্টভাবে আশারি-মাতুরিদি ফের্কাকে বিদাতি ঘোষণা করেছেন। সেই তিনি কীভাবে তাবলিগ জামাতকে আহলুস সুন্নাহ বলতে পারেন, যেই তাবলিগের মানহাজই দেওবন্দি মানহাজ, আর দেওবন্দি মানেই আকিদায় মাতুরিদি?! বিচ্ছিন্ন ঘটনা এখানে উল্লেখ করার কোনো মানে হয় না। এই ফের্কার নীতিমালা আছে। তাদের নীতিমালাতেই বলা আছে, তারা মাতুরিদি।

আমি আমার কথার প্রমাণ দিচ্ছি। তাবলিগ জামাতের শীর্ষনেতা, সর্বেশ্বরবাদের কুফরি আকিদাধারী, কুফর-শির্কে ভরপুর কুখ্যাত তাবলিগি নেসাব ওরফে ফাজায়েলে আমলের লেখক, মৌলবি মুহাম্মাদ জাকারিয়া কান্ধলভী দেওবন্দি নিজেদের মানহাজ বর্ণনা করেছে, “সর্বোপরি আমরা পুরো জামাত এ যুগে তাকলিদকে জরুরি মনে করি। যেমনভাবে শরয়ি তাসাউফকে (আসলে বিদাতি সুফিবাদ – অনুবাদক) আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের সবচেয়ে নিকটতম পথ মনে করি। যে ব্যক্তি তাকলিদ আর তাসাউফের এ দুই ক্ষেত্রে আমাদের বিরোধিতা করে, সে আমাদের জামাত থেকে মুক্ত। উক্ত দুই বিষয়ই দেওবন্দি মতাদর্শে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। সুতরাং যে ব্যক্তি মওদুদির জামাতের সাথে দেওবন্দি জামাতের পার্থক্য করে না, সে হঠকারী।” [মুহাম্মাদ জাকারিয়া কান্ধলভী বিরচিত ফিতনায়ে মৌদুদিয়াত, পৃষ্ঠা: ১২৬-১২৭; মাজহারি কুতুবখানা (করাচি, পাকিস্তান) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ]

আর দেওবন্দিরা আকিদার ক্ষেত্রে মূলত মাতুরিদি ফের্কারই অনুসারী। যেমন দেওবন্দিদের শীর্ষস্থানীয় ইমাম, বিদ্যাসাগর, তাদের শাইখুল ইসলাম, আহলেহাদিসদের ‘নিকৃষ্ট ওয়াহাবি’ আখ্যাদাতা, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবকে ‘খারিজি’ ফতোয়াদাতা, চিশতি তরিকার অনুসারী, সাহারানপুরের সুবিখ্যাত মৌলবি, জনাব খলিল আহমাদ সাহারানপুরি লিখেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আমরা, আমাদের মাশায়েখরা, আমাদের সকল দল-উপদলের লোকেরা শাখাগত মাসায়েলে ইমাম আবু হানিফার মুকাল্লিদ, আকিদায় আবুল হাসান আল-আশআরি ও আবু মানসুর আল-মাতুরিদির অনুসারী এবং সুুুুউচ্চ চার তরিকার দিকে নিজেদের সম্বন্ধ স্থাপনকারী।” (সামান্য পরিবর্তন-সহ) [আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ, পৃষ্ঠা: ৪০-৪১; তাহকিক: মুহাম্মাদ বিন আলি আদাম আল-কাওসারি; দারুল ফাতহ (আম্মান, জর্ডান) কর্তৃক প্রকাশিত]

দেওবন্দি মাদরাসাগুলোতেও রীতিমতো মাতুরিদি আকিদার বইপুস্তক পড়ানো হয় এবং সালাফি আকিদার খণ্ডন শেখানো হয়। এরকম একটা সুফি মাতুরিদি সম্প্রদায়ের ব্যাপারে সালাফিয়্যাহর ইমাম, সালাফি আকিদার বিদ্যার্ণব, শাইখ ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ জেনেশুনে প্রশংসা করতে পারেন?! আসুন, মাতুরিদিদের ব্যাপারে শাইখের দ্ব্যর্থহীন ফতোয়া দেখে নিই।

ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ ‘আকিদা ওয়াসিতিয়্যা’র ভাষ্যগ্রন্থে বলেছেন, “লেখক রাহিমাহুল্লাহর কথা থেকে জানা গেল, যারা আহলুস সুন্নাহর মতাদর্শের বিরোধিতা করবে, তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুতরাং এক্ষেত্রে আশারি ও মাতুরিদিরা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।... তাই সেই ব্যক্তি ভুল করেছে, যে বলেছে, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত আসলে তিনটি দল: সালাফিরা, আশারিরা ও মাতুরিদিরা।’ এটা ভুল। আমরা বলি, কীভাবে এরা সবাই আহলুস সুন্নাহ হতে পারে, অথচ এদের আকিদা আলাদা?!” [শারহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৩; দারু ইবনিল জাওজি (দাম্মাম, সৌদি আরব) কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২১ হিজরি (৬ষ্ঠ প্রকাশ)] এছাড়াও ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ আরও অনেক জায়গায় আশারি-মাতুরিদিদের আহলুস সুন্নাহ থেকে খারিজ করেছেন।

এতদ্ব্যতীত ইমাম ইবনু উসাইমিনের শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্য থেকে অনেক সালাফি বিদ্বানই তাবলিগ জামাতকে বিদাতি আখ্যা দিয়েছেন। যেমন সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ, সৌদি ফতোয়া বোর্ডের ডেপুটি চেয়ারম্যান ইমাম আব্দুর রাজ্জাক আফিফি রাহিমাহুল্লাহ প্রমুখ, যাঁরা ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর শিক্ষক ছিলেন। [ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে সামনে আলোচনা আসবে, ইনশাআল্লাহ; আর ইমাম আফিফির বক্তব্য দেখুন: ফাতাওয়া ওয়া রাসাইলু সামাহাতিশ শাইখ আব্দির রাজ্জাক আফিফি, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৭৪] যেমন আল্লামা সালিহ আল-উসাইমি হাফিযাহুল্লাহ, শাইখ সালিম আত-তাউয়িল হাফিযাহুল্লাহ, শাইখ উসামা আল-উতাইবি হাফিযাহুল্লাহ প্রমুখ, যাঁরা ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর ছাত্র হিসেবে সুপরিচিত। [দ্রষ্টব্য: https://m.facebook.com/watch/?v=2669219573317988&_rdr]

বাস্তবিক অর্থে, বিদাতি ফের্কা তাবলিগ জামাত প্রসঙ্গে ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর প্রশংসার ব্যাপারটি ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক মিথ্যুক বর্ণনাকারী মুহাম্মাদ বিন হুমাইদের প্রশংসার মতো ছিল। হাফিজ জাহাবি রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, “আবু আলি আন-নাইসাবুরি ব্যক্ত করেছেন, আমি ইবনু খুজাইমার উদ্দেশে বললাম, ‘উস্তায যদি মুহাম্মাদ বিন হুমাইদ থেকে বর্ণনা করতেন (তাহলে কত ভালো হতো)! কারণ আহমাদ বিন হাম্বাল তার ভালো প্রশংসা করেছেন।’ এ শুনে তিনি বললেন, ‘অবশ্যই তিনি একে চিনতে পারেননি; আমরা একে যেভাবে চিনেছি, সেভাবে একে চিনতে পারলে তিনি কখনোই এর প্রশংসা করতেন না’।” [হাফিজ জাহাবি কৃত সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৫০৪]

এ থেকে আমরা মিনার সাহেবের দাবির অসারতা বুঝতে পারি। যিনি ‘মহব্বতের ভাই’ ডেকে সালাফিদের মানহাজে গলদ প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন। নিজের ভুয়ো মানহাজকে কৌশলে ইবনু উসাইমিনের মতো স্ট্রেইট সালাফি ইমামের মানহাজ হিসেবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছেন। মিনার সাহেবের মতো মানুষেরা পানি আর তেলকে একসাথে মেশাতে চান। সালাফিদের মানহাজের ভুল ধরার আগে সালাফদের মানহাজ তার নিজের পড়ে দেখা উচিত। সর্বেশ্বরবাদের আকিদাধারীদের সাথে মহব্বত রাখা, কুরআন-সুন্নাহর ওপর বিবেককে প্রাধান্য দেওয়া বিদাতিদের প্রতি মহব্বত রাখা সালাফদের মানহাজ ছিল না।

·
ইমাম ইবনু বায কি তাবলিগ জামাতের প্রশংসা করেছেন?

সুকৌশলী মিনার সাহেব মুত্তাকি ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর বরাতে সত্যের অপলাপ করে বলেছেন, “তাবলিগ জামাত সম্পর্ক শায়খ বিন বায(র.) কিছু স্থানে ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। আবার কিছু স্থানে তাদের আকিদা এবং আরো কিছু বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে বের হতে বলেছেন এবং তাদেরকে নসিহা করতে বলেছেন। তাবলিগ জামাত সম্পর্কে শায়খ বিন বায(র.) এর প্রশংসামূলক বক্তব্যগুলোর অনুবাদ কাতারভিত্তিক ফতোয়ার ওয়েবসাইট Islamweb এ সংকলন করা হয়েছে। আগ্রহীরা এখান থেকে পড়তে পারেনঃ www.islamweb(ডট)net/en/fatwa/87749/।

তাবলিগ জামাতের সঙ্গে বের হবার পরামর্শ দিয়ে শায়খ বিন বায(র.) এর বক্তব্য (মাজমু’ ফাতাওয়া থেকে): https://drive(ডট)google(ডট)com/file/d/1RLlwCn68xb6lzMNzbA8WJ2TFVydZ1ISN/view?usp=sharing। কিছু ক্ষেত্রে তাবলিগ জামাতের সমালোচনা করে এবং নসিহা করে শায়খ বিন বায(র.) এর বক্তব্য (মাজমু’ ফাতাওয়া থেকে):
https://drive(ডট)google(ডট)com/file/d/13eHds9jaxOlSui8e1jbO7aRF_rkUeeXZ/view?usp=sharing।” মিনার সাহেবের বক্তব্য সমাপ্ত।

ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ অবশ্যই তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে মত পরিবর্তন করেছেন এবং তাবলিগ জামাতকে বিদাতি ফের্কা বলেছেন। এ বিষয়ে আমরা পরে আলাপ করছি। আগে মিনার সাহেবের কথার পর্যালোচনা করে নিই। মিনার সাহেব বলেছেন, “তাবলিগ জামাত সম্পর্ক শায়খ বিন বায(র.) কিছু স্থানে ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। আবার কিছু স্থানে তাদের আকিদা এবং আরো কিছু বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে বের হতে বলেছেন এবং তাদেরকে নসিহা করতে বলেছেন।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক)

ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ কিছু জায়গায় তাবলিগ জামাতের প্রশংসা করেছেন, এ কথা ঠিক। জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে তাবলিগ জামাতের সাথে বের হতে বলেছেন এবং তাদেরকে নসিহত করতে বলেছেন, এ কথাও ঠিক। কিন্তু মুশকিল হলো, মিনার সাহেব পুরো সত্যটা বলেননি। আসুন, আমরা ইমাম ইবনু বাযের বক্তব্য থেকে দেখে নিই মিনার সাহেবের ভ্রমাত্মক ও সত্যবর্জিত উপস্থাপন। ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “আকিদাগত বিষয়ে তাবলিগ জামাতের জ্ঞান নেই। এদের সাথে বের হওয়া না-জায়েজ। তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশুদ্ধ আকিদা বিষয়ে যার জ্ঞান আছে, এমন ব্যক্তি তাদেরকে হেদায়েত দেখানো, নসিহত করা এবং কল্যাণের কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য বের হতে পারবে।” [ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ বিরচিত মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআ, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৩১; ফাতাওয়া সংকলক: শাইখ ড. মুহাম্মাদ আশ-শুওয়াইয়ির রাহিমাহুল্লাহ; দারুল কাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরি (১ম প্রকাশ)]

মিনার সাহেব মাজমুউ ফাতাওয়া থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর এসব ফতোয়া খুব ভালো করে জানা আছে। কিন্তু তিনি পুরো ফতোয়া প্রচার করেননি। কারণ ওটা করলেই যে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে! ওটা যে সালাফিদেরই কথা! তাই তিনি কু-কৌশল অবলম্বন করলেন। না-জায়েজের অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকিটুকু ব্যক্ত করলেন। বাঃ, কী চমৎকার! মাশাআল্লাহ!

·
তাবলিগ জামাতকে বিদাতি বলে যারা ন্যায়চ্যুত এবং বিকৃত মানহাজের অনুসারী হলেন:

পোস্টের শেষে গিয়ে মিনার সাহেব বলেছেন, “সবশেষে আল কুরআন থেকে একটি নসিহা উল্লেখ করছিঃ “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে বিধানসমূহ পূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠাকারী ও ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হয়ে যাও, কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের শক্রতা যেন তোমাদেরকে এর প্রতি প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ন্যায়বিচার করবেনা। তোমরা ন্যায়বিচার কর, এটা আল্লাহ-ভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।” (আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৮)” মিনার সাহেবের বক্তব্য সমাপ্ত।

মানে কী দাঁড়াচ্ছে, জানেন? ইমাম ইবনু বাযের ফতোয়া উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি যে সত্যের অপলাপ করেছেন, এ সত্ত্বেও তিনি ন্যায়পরায়ণ, ন্যায়পন্থি রয়ে গেছেন! আর বেচারা সালাফিরা ইমাম ইবনু বাজের পুরো ফতোয়া উল্লেখ করে হয়েছে ন্যায়চ্যুত, জালেম! একেবারে এ ক্লাস ক্রিটিসিজম করেছেন আমাদের মিনার সাহেব। পাশাপাশি যেসব সালাফি বিদ্বান তাবলিগ জামাতকে বিদাতি ফতোয়া দিয়েছেন, তারা সবাই ন্যায়চ্যুত হয়েছেন মিনার সাহেবের নিক্তিতে।

মিনার সাহেব তাবলিগ জামাত থেকে সতর্কীকরণ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, “বিন বায(র.), ইবনু উসাইমিন(র.) প্রমুখ মহান শায়খরা যেসব সমালোচনা করতেন, সেই সমালোচনাগুলো ছিল ইলমী, গঠনমূলক ও সংশোধনমূলক। এর বিপরীতে বর্তমানে আমরা এমন অনেক কিছু দেখছি যা মূলত রাজনৈতিক ও দমনমূলক এবং ইসলামী যত তৎপরতা আছে সেগুলোকে রুখে দেয়ার চেষ্টা।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক) অর্থাৎ যারাই তাবলিগ জামাত থেকে সতর্ক করবেন, তারা মিনার সাহেবের এসব বিশেষণের আওতাভুক্ত হবেন বলেই আমরা ধরে নেব।

এই তালিকায় আসবেন— (১) ইমাম ইবনু বাযের মহান শিক্ষক সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম আলুশ শাইখ রাহিমাহুল্লাহ, (২) যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম আলবানি রাহিমাহুল্লাহ, (৩) প্রাক্তন দুই গ্র্যান্ড মুফতি তথা ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম ইবনু বাযের সুযোগ্য ছাত্র মক্কার মুহাদ্দিস ইমাম হামুদ আত-তুওয়াইজিরি রাহিমাহুল্লাহ, (৪) সৌদি ফতোয়া বোর্ডের প্রাক্তন ডেপুটি চেয়ারম্যান ইমাম আব্দুর রাজ্জাক আফিফি রাহিমাহুল্লাহ, (৫) বিগত শতকের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুজাদ্দিদ ইমাম মুকবিল বিন হাদি আল-ওয়াদিয়ি রাহিমাহুল্লাহ, (৬) বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ইমাম তাকিউদ্দিন আল-হিলালি রাহিমাহুল্লাহ।

(৭) দক্ষিণ সৌদি আরবের মুফতি ইমাম আহমাদ আন-নাজমি রাহিমাহুল্লাহ, (৮) মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস ফ্যাকাল্টির প্রাক্তন ডিন ও আকিদা ডিপার্টমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম আমান আল-জামি রাহিমাহুল্লাহ, (৯) মদিনার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম হাম্মাদ আল-আনসারি রাহিমাহুল্লাহ, (১০) সৌদি ফতোয়া বোর্ডের সাবেক সদস্য ইমাম আব্দুল্লাহ আল-গুদাইয়্যান রাহিমাহুল্লাহ, (১১) সৌদি আরবের প্রখ্যাত বিদ্বান ইমাম যাইদ আল-মাদখালি রাহিমাহুল্লাহ, (১২) বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম আব্দুল আজিজ আলুশ শাইখ হাফিযাহুল্লাহ, (১৩) সৌদি ফতোয়া বোর্ড ও সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য ইমাম সালিহ আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ।

(১৪) সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য ইমাম সালিহ আল-লুহাইদান হাফিযাহুল্লাহ, (১৫) মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মদিনার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ হাফিযাহুল্লাহ, (১৬) মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস অনুষদের সাবেক প্রধান, মদিনার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম রাবি বিন হাদি আল-মাদখালি হাফিযাহুল্লাহ, (১৭) মদিনার ফাকিহ ইমাম উবাইদ আল-জাবিরি হাফিযাহুল্লাহ, (১৮) ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর সুযোগ্য ছাত্র, সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য আল্লামা সামি আস-সুকাইর হাফিযাহুল্লাহ।

(১৯) ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর সুযোগ্য ছাত্র, সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সাবেক সদস্য আল্লামা সালিহ আল-উসাইমি হাফিযাহুল্লাহ, (২০) মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিকহ ও আকিদা উভয় ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, মদিনার মুজাহিদ আল্লামা সালিহ আস-সুহাইমি হাফিযাহুল্লাহ, (২১) মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর, মসজিদে কুবার ইমাম ও খতিব, আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ, (২২) ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মক্কা উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর আল্লামা ওয়াসিউল্লাহ আব্বাস হাফিযাহুল্লাহ, (২৩) মক্কা উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আল্লামা মুহাম্মাদ বিন উমার সালিম বাজমুল হাফিযাহুল্লাহ। এছাড়াও আরও অসংখ্য সালাফি বিদ্বান তাবলিগ জামাতের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং এটাকে বিদাতি ফের্কা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে উলামাগণের বিশদ বক্তব্য জানতে আপনারা নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলো পড়তে পারেন। (১) শাইখ রাবি আল-মাদখালি বিরচিত আকওয়ালু উলামাইস সুন্নাহ ফি জামাআতিত তাবলিগ, (২) আত-তালিকুল বালিগ আলা রদ্দিশ শাইখ আহমাদ আন-নাজমি আলা মাদিহিত তাবলিগ, (৩) শাইখ হামুদ আত-তুওয়াইজিরি বিরচিত আল-কাওলুল বালিগ ফিত তাহজিরি মিন জামাআতিত তাবলিগ, (৪) শাইখ আব্দুল আজিজ আর-রইস কৃত ফাতাওয়া আইম্মাতি আহলিস সুন্নাতিস সালাফিয়্যিন ফি জামাআতিত তাবলিগি ওয়াল ইখওয়ানিল মুসলিমিন।

·
তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর মত পরিবর্তন এবং তাবলিগ জামাতকে বিদাতি আখ্যান:

ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ কিছু জায়গায় তাবলিগ জামাতের প্রশংসা করেছিলেন সেসময় এদের ব্যাপারে তাঁর নিকটে থাকা ইলম অনুযায়ী। পরবর্তীতে তাবলিগ জামাতের ভ্রষ্টতা বিষয়ে অবগত হওয়ার পর এবং এদের মানহাজ তাঁর কাছে স্পষ্ট হওয়ার পর তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং এদের তীব্র সমালোচনা করেন। ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ তাঁর মৃত্যুর দু বছর পূর্বে বলে গিয়েছেন, “যে ব্যক্তিই আল্লাহর দিকে মানুষদের আহ্বান করে, সে-ই তাবলিগকারী মুবাল্লিগ। ‘তোমরা একটি বাণী হলেও আমার নিকট থেকে প্রচার করো।’ (সহিহ বুখারি) কিন্তু সুপরিচিত ভারতীয় তাবলিগ জামাতের অনেক কুসংস্কার, বিদাত ও শির্কি কর্মকাণ্ড রয়েছে। তাই এদের সাথে বের হওয়া না-জায়েজ। তবে যে ব্যক্তির কাছে ইলম আছে, সে তাদেরকে খণ্ডন করার জন্য এবং তাদেরকে শিক্ষাদানের জন্য বের হতে পারবে।

কিন্তু সেও যদি তাদের অনুগামী হওয়ার জন্য বের হয়, তবে তা জায়েজ হবে না। কারণ এদের কুসংস্কার ও ভুল রয়েছে, ইলমের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু এরা বাদে অন্য কোনো জাগ্রত জ্ঞান ও ইলমওয়ালা তাবলিগকারী জামাত থাকলে, তাদের সাথে বের হতে পারবে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য। কিংবা জাগ্রত জ্ঞান ও ইলমওয়ালা মানুষ এদের (বিদাতি তাবলিগ জামাতের) সাথে বের হতে পারবে জ্ঞান শেখানো, তাদের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা এবং তাদেরকে কল্যাণের দিকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। যাতে তারা বাতিল মতাদর্শ পরিত্যাগ করে এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতাদর্শ গ্রহণ করে।” [ইমাম রাবি আল-মাদখালি হাফিযাহুল্লাহ কৃত আকওয়ালু উলামাইস সুন্নাহ ফি জামাআতিত তাবলিগ, পৃষ্ঠা: ৩; সংগৃহীত: rabee(ডট)net; মাজমুউশ শাইখ রাবি; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৪৪২; দারুল ইমাম আহমাদ, মিশর কর্তৃক প্রকাশিত (সনতারিখবিহীন); ফতোয়ার অডিয়ো: https://youtu.be/uJ-RHQxmLiI]

মহান আল্লাহ ইমাম ইবনু বাযকে ফিরদাউসি নির্ঝরিণী থেকে আস্বাদান করান। তিনি ভ্রষ্ট ফের্কা তাবলিগ জামাতের স্বরূপ জানার পরে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তাবলিগ জামাতকে বিদাতি ফের্কা আখ্যা দিয়েছেন। শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযিয বিন বায রাহিমাহুল্লাহর ফতোয়া—

প্রশ্ন: “আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস—‘আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে, শুধুমাত্র একটি দল ব্যতীত সকল দল জাহান্নামে যাবে।’ তাবলিগ জামাতের অনেক শির্কি ও বিদাতি কর্মকাণ্ড আছে। আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের আছে দলবাজি এবং শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মতো কর্মকাণ্ড। তাহলে এই দুটি দল কি পথভ্রষ্ট (ধ্বংসযোগ্য) দলসমূহের অন্তর্ভুক্ত হবে?”
উত্তর: “এই দল দুটি (পথভ্রষ্ট) ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত। যারাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা পরিপন্থি কাজ করে, তারাই (পথভ্রষ্ট) ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ‘আমার উম্মত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো উম্মাতুল ইজাবাহ। অর্থাৎ, যারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং তাঁর জন্য নিজেদের আনুগত্যকে প্রকাশ করেছে।
প্রশ্নকর্তা: “তার মানে উল্লিখিত দল দুটি (পথভ্রষ্ট) ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত?”
শাইখ: “হ্যাঁ, (তারা) বাহাত্তর ফের্কার অন্তর্ভুক্ত।” [উক্ত কথা ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ তাঁর মৃত্যুর দুই বছর বা তারও কম সময় পূর্বে ১৪১৬ হিজরি সনে তায়েফে তাঁর ‘শারহুল মুনতাকা’র একটি দারসে বলেছেন।
দ্র.: ইমাম রাবি আল-মাদখালি হাফিযাহুল্লাহ কৃত আকওয়ালু উলামাইস সুন্নাহ ফি জামাআতিত তাবলিগ, পৃষ্ঠা: ৫; সংগৃহীত: rabee(ডট)net; মাজমুউশ শাইখ রাবি; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৪৪৪; দারুল ইমাম আহমাদ, মিশর কর্তৃক প্রকাশিত (সনতারিখবিহীন); ফতোয়ার অডিয়ো লিংক: http://ar(ডট)alnahj(ডট)net/audio/805.]

তাবলিগ জামাতকে ডিফেন্স করে তাদের ব্যাপারে ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর পূর্বের প্রশংসা এখন আর উল্লেখ করা চলবে না। কারণ তিনি এ বিষয়ে মত পরিবর্তন করেছেন। আর এ প্রশংসার ব্যাপারটি নাকচ করে দিয়েছেন ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর শ্রেষ্ঠ ছাত্র, যুগশ্রেষ্ঠ ফাকিহ, আশ-শাইখুল আল্লামা, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ (জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.)।

ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ প্রদত্ত ফতোয়া নিম্নরূপ—
প্রশ্ন: “একজন দাঈর আবির্ভাব ঘটেছে, যে বলছে, সম্মানিত শাইখ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ তাবলিগ জামাত এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রশংসারত অবস্থায় মারা গেছেন। এই কথা কি সঠিক?”
উত্তর: “এই কথা সঠিক নয়। আমরা তাঁর সাথে দশ বছর ওঠাবসা করেছি। আমরা কখনো শুনিনি যে, তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত ব্যতীত অন্য কারও প্রশংসা করেছেন। তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের দিকে মানুষদের আহ্বান করতেন। অন্য দলের কেউ ভুল করলে তিনি তাকে সেই ভুল থেকে ফিরে আসার নসিহত করতেন; তাবলিগিদের এবং অন্যান্যদেরও (ভুল থেকে ফিরে আসার নসিহত করতেন)। আমার শাইখ আশ-শাইখ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে আমি এটাই জানি।” [দ্র.: www.alfawzan(ডট)af(ডট)org(ডট)sa/en/node/14255.]

এমনকি ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে তাঁর প্রশংসাযুক্ত পূর্ববর্তী ফতোয়াগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর পার্সোনাল সেক্রেটারি ও অ্যাডভাইজার, ইমাম ইবনু বাযের ফতোয়াসমগ্রের (মাজমুউ ফাতাওয়ার) সংকলক, সম্মাননীয় শাইখ ড. মুহাম্মাদ বিন সাদ আশ-শুওয়াইয়ির রাহিমাহুল্লাহ। তিনি তাঁর একটি চিঠিতে বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন। এটা সৌদি আরবের ইলমি গবেষণা ও ফতোয়া প্রদানের সার্বজনিক দফতরের (আর-রিআসাতুল আম্মাহ লিল বুহুসিল ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা) প্যাডে লেখা চিঠি, ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ যে দফতরের প্রধান ছিলেন।

চিঠিতে শাইখ শুওয়াইয়ির রাহিমাহুল্লাহ জানিয়েছেন, তিনি নিয়মিত ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর কাছে তাঁর ফতোয়াগুলো পড়তেন, আর ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ প্রয়োজন অনুসারে সেসবে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতেন। শাইখ শুওয়াইয়ির ওই নৈমিত্তিক রীতির একটি দিনের ঘটনা বলেছেন চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, “ওইদিন আমার কাছে জনসাধারণের কাছে প্রচলিত এমনকিছু ফতোয়া ছিল শাইখের, যেসবের প্রসঙ্গ ছিল তাবলিগ জামাত। আমি তাঁকে এসব ফতোয়ার বিষয়ে জানালাম, ‘আমি এগুলো তাঁর কাছে পড়ব।’ তিনি সম্মতি জানালে আমি তাঁর কাছে ফতোয়াগুলো পড়লাম। তখন তিনি ফতোয়ার কপিগুলো নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন এবং ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিলেন।

আর বললেন, ‘দাওয়াহ ম্যাগাজিনে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা ব্যতিরেকে তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য বর্ণনা করা ঠিক হবে না। তুমি ওই ফতোয়া নাও এবং সেটাকেই অন্তর্ভুক্ত করো। এ ঘটনা সেদিন ঘটেছিল। আমি আরেক বৈঠকে দাওয়াহ ম্যাগাজিন শাইখের কাছে হাজির করে পড়ার পরে সেই ফতোয়া সংকলন করি। এটা ১৪৩৮ তম সংখ্যায় ৩রা জিলকদ ১৪১৪ হিজরি তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। শাইখের মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআ গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ৩৩১ পৃষ্ঠায় ফতোয়াটি সংকলিত হয়েছে।” [সম্পূর্ণ চিঠি দেখুন: মুহাম্মাদ বিন রমাজান আল-হাজিরি কৃত খাতারু জামাআতিত তাবলিগ ওয়াত তাহজিরু মিনহা, পৃষ্ঠা: ২৪-২৬; চিঠি দেখুন এই লিংকে: https://tinyurl(ডট)com/cuh5k2p9]

এছাড়াও আমরা একাধিক সূত্রে জেনেছি, শাইখ শুওয়াইয়ির রাহিমাহুল্লাহ তাঁর লেখা ‘আব্দুল আযিয ইবনু বায আলিমুন ফাকাদাতহুল উম্মাহ’ শীর্ষক গ্রন্থেও এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। বইটির কপি আমাদের সংগ্রহে না থাকায় পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি।

এই ফতোয়া আমরা ইমাম ইবনু বায বিষয়ক আলোচনার শুরুতে উল্লেখ করেছি। উক্ত ফতোয়া ১৪১৪ হিজরি প্রকাশিত, যেখানে তিনি তাবলিগ জামাতের সাথে বের হওয়া না-জায়েজ ঘোষণা দিয়েছেন। এরপরে তিনি তাঁর মৃত্যুর দুবছর পূর্বে অর্থাৎ ১৪১৮ হিজরির দিকে পুনরায় এক ফতোয়ায় তাবলিগ জামাতের সাথে বের হওয়া না-জায়েজ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই সময়ের দিকেই তিনি তাবলিগ জামাতকে পথভ্রষ্ট ৭২ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত বলে ফতোয়া দেন। এটাই ছিল তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে তাঁর সর্বশেষ অভিমত।

·
জনাব মিনার কর্তৃক ইমাম ইবনু বাযকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার:

মিনার সাহেব নিজের বাতিল মতাদর্শকে ডিফেন্ড করার জন্য ইমাম ইবনু বাযকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বলেছেন, “একবার ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের এক অনুষ্ঠানে শায়খ বিন বায(র)কে দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি যেতে পারেননি; কিন্তু একটি চিঠি দিয়ে তাঁর ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন। শায়খ বিন বায(র.) এর মহব্বতপূর্ণ ভাষা এবং নসিহাগুলো দেখলে হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। আজকের দিনে এমন কিছু হলে "বিদআতীদের সাথে আঁতাত" (!) এর দায়ে শায়খ বিন বায(র.) এর মানহাজের ব্যবচ্ছেদ শুরু হয় যেতো হয়তো। বিপরীত ধারার মুসলিম ভাই সম্পর্কে ইনসাফ করে ২-১ লাইন লিখলে বা বললেই এখন মানহাজগত শুদ্ধির নামে যা হচ্ছে... ...। আজকে কেউ যদি তাবলিগ জামাতের মুখলিস ভাইদের প্রতি ইনসাফ করে কিছু কথা বলে, তাদের ব্যাপারে ভালো কিছু বলা হয়েছে এমন ২/১টি ফতোয়া উল্লেখ করে, তবে তার "মানহাজ শুদ্ধ নেই" বলে চিৎকার শুরু হয়। অথচ শায়খ বিন বায(র.) কিংবা শায়খ ইবন উসাইমিন(র.) এর আদর্শ কেমন ছিল। অন্যের কাছ থেকে ইনসাফ চাইলে আগে নিজের উচিত অন্যের সাথে ইনসাফ করা।

শায়খ বিন বায(র.) মোটেও দেওবন্দী তথা আশআরী-মাতুরিদিদের আকিদার সাথে একমত ছিলেন না। তবে এ জন্য তিনি মোটেও দেওবন্দীদের সাথে শত্রুতামূলক মনোভাব রাখতেন না। বরং দ্বীনি ভাই হিসেবে মহব্বত করতেন। সাধ্যমত নসিহা করতেন এবং সাহায্য করতেন। তবে ভুল জিনিসকে সঠিক বলতেন না; যে স্থানে ভুল আছে, সেই ভুলকে ঠিকই চিহ্নিত করে দিতেন।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক)

ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ দেওবন্দিদের স্বরূপ জানতে পারেননি, যদি জানতেন, তাহলে কোনোভাবেই এদের মতো কুখ্যাত বিদাতি ফের্কার প্রশংসা করতেন না। আর তাইতো তিনি দেওবন্দিদের দাওয়াতি শাখা তাবলিগ জামাতের স্বরূপ জানতে পেরে এ ফের্কাকে বিদাতি আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম ইবনু বায সালাফিদের চোখের মণি। তিনি তাবলিগকে বিদাতি ফের্কা না বললেও তাঁর ব্যাপারে সালাফিরা কখনোই এমন কথা বলত না, যা ব্যক্ত করেছেন সালাফিদের প্রতি বিষ উদ্‌গিরণকারী মৌলবি জনাব মিনার সাহেব। দোয়া করি, আল্লাহ তাঁকে হেদায়েত দিন। বরং সালাফিরা এমনটি ঘটলে ইমাম ইবনু বাযের ব্যাপারে ওজর পেশ করত, তিনি তাঁর কাছে প্রকাশিত বিষয় ও তাঁর নিকটে থাকা জ্ঞানের ভিত্তিতেই এ কথা বলেছেন, প্রকৃত বিষয় জানলে তিনি এমনটি বলতেন না।

সালাফিদের প্রতি কুধারণাকারী মিনার সাহেব ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর না-জানার বিষয়টি নিয়ে সালাফিদের টিটকারি করেছেন। নিজেকে ‘খুব মধ্যপন্থি উদার’ প্রমাণকারী মৌলবি মিনার সাহেব সালাফিদের টিটকারি করতে ছাড়েননি। বুকভরা বিষ নিয়ে থাকলে তার কিয়দংশ বোধহয় এভাবেই প্রকাশ পায়। জনৈক আহলেহাদিস ভাই আহলেহাদিস-বিদ্বেষী মিনার সাহেবকে ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উনারা দেওবন্দী সম্পর্কে নাও জানতে পারেন। তাই এসব বলা আরকি।’ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিনার সাহেব যে বিষমাখা প্রত্যুত্তর দেন, তা দেখুন। মিনার সাহেব লিখেছেন, “জি হাঁ। দেওবন্দীদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন একুশ শতকের বাংলাদেশের ফেসবুক নিবাসী জারহ-তাদিলের "ইমাম" (!!) গণ। শায়খ বিন বায(র), শায়খ ইবন উসাইমিন(র) প্রমুখ উলামারা তাবলিগ, দেওবন্দ সব সম্পর্কের এক্কেবারে অজ্ঞ ছিলেন।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক)

এখন মিনার সাহেবকে আমরা একটা শীতল জবাব দিই। জনাব, ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে সালাফগণ যে সমালোচনা করেছেন এবং তাঁকে ভ্রষ্ট আখ্যা দিয়েছেন, তা নিশ্চয় আপনার জানা আছে। [বিস্তারিত সমালোচনা জানতে দেখুন: ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ কৃত আস-সুন্নাহ কিতাব, ইমাম মুকবিল আল-ওয়াদিয়ি কৃত নাশরুস সাহিফা ফি যিকরিস সাহিহি মিন আকওয়ালি আইম্মাতিল জারহি ওয়াত তাদিলি ফি আবি হানিফা]

এখন বলুন, তাঁরা কি এসব সমালোচনা সঠিক বিষয় সম্পর্কে জেনে করেছিলেন, না না-জেনে করেছিলেন? যদি আপনি বলেন, প্রকৃত বিষয় জেনেই সমালোচনা করেছিলেন, তাহলে আপনি ইমাম আবু হানিফাকে বিদাতি বললেন। আর যদি বলেন, প্রকৃত বিষয় তাঁদের অবগতির বাইরে ছিল, তাহলে আপনি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডে পতিত হলেন! ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে আমরা সালাফিরা এজন্যই বলি, তিনি এদের প্রকৃত স্বরূপ জানতেন না। মৃত্যুর পূর্বে তাবলিগ জামাতকে তাঁর বিদাতি ঘোষণা করা থেকেই তা প্রমাণিত হয়।
·
আগামী পর্বে সমাপ‍্য, ইনশাআল্লাহ। Md Abdullah Mridha


Post a Comment

0 Comments