Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

▌আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান : আধুনিক বিপথগামিতার নয়া-আহ্বায়ক [১ম পর্ব]

আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান : আধুনিক বিপথগামিতার নয়া-আহ্বায়ক [১ম পর্ব]

ভূমিকা ও তৎসংশ্লিষ্ট আলোচনা

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। যিনি বলেছেন, “হক এসেছে, আর বাতিল অপসৃত হয়েছে; বাতিল তো অপসৃত হওয়ারই ছিল।” [সুরা বানি ইসরায়িল: ৮১]

অজস্র সালাত ও সালাম ধার্য হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহর প্রতি। যিনি বলেছেন, “তুমি সত্য বল, যদিও তা তিক্ত হয়।” [সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব, হা: ২২৩৩; সনদ: সহিহ] অন্যত্র বলেছেন, “তুমি সত্য বল, যদিও তা তোমার নিজের বিরুদ্ধে যায়।” [সিলসিলা সহিহা, হা: ১৯১১; সনদ: সহিহ]

· পূর্বাভাস:

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোন, আপনাদেরই এক ভাইয়ের তরফ থেকে জানবেন ইমানদীপ্ত ভালোবাসা এবং সতেজ ও আন্তরিক অভিনন্দন। মুমিন হিসেবে আমরা সবাই ভ্রাতৃত্বের অমোঘ বন্ধনে আবদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেছেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ “কেবল মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।” [সুরা হুজুরাত: ১০] আর যিনি আপন ভাইয়ের জন্য সেই জিনিস পছন্দ করেন, যা নিজের জন্য পছন্দ করেন, তিনিই তো প্রকৃত ভাই, সত্যিকারের ইমানদার। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে।” [সহিহুল বুখারি, হা: ১৩; সহিহ মুসলিম, হা: ৪৫]

আমরা যদি জানতে পারি, এই পথ সিধা চলে গেছে জান্নাতের পানে, তবে আমরা কি চাইব না, আমাদের ভাইয়েরাও জানুক, এই পথ ধরে জান্নাতে যাওয়া যায়? যদি জানতে পারি, এই পথে চললে জাহান্নামে যেতে হবে, তবে আমরা কি চাইব না, আমাদের ভাইয়েরাও জেনে যাক, এ পথ জাহান্নামের পথ? অবশ্যই চাইব; এটা আমাদের ইমানের দাবি।

আমরা সকলেই জানি এবং ইমান রাখি, মানবজাতিকে হেদায়েত দেওয়ার জন্য প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আর কোনো নবি আসবেন না। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবি ও রসুল। কিন্তু যুগে যুগে নবিজির উম্মতে আসতে থাকবেন হকপন্থি উলামা। যাঁরা ওহির জ্ঞানের ভিত্তিতে দিশেহারা মানবতাকে দেখাবেন মুক্তির পথ, জানিয়ে দেবেন জান্নাত-লাভের উপায়। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁদেরকে ‘নবিদের ওয়ারিশ’ আখ্যা দিয়েছেন। [আবু দাউদ, হা: ৩৬৪১; তিরমিজি, হা: ২৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা: ২২৩; সনদ: সহিহ]

হকপন্থি উলামাগণ যেমন আসতে থাকবেন, তেমনি যুগে যুগে বাতিলপন্থি দায়িদের আবির্ভাব ঘটবে। যারা উলামাদের বেশভূষা গ্রহণ করে জাহান্নামের পথে মানুষদের আহ্বান করবে, এমনসব মিথ্যা আমদানি করবে, যা দিনে ইসলামের অন্তর্গত নয়। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের ব্যাপারেও সতর্ক করে গিয়েছেন। তিনি ফিতনা বিষয়ক হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا قَالَ هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا “জাহান্নামের দরজায় দাঁড়ানো একদল বাতিলপন্থি আহ্বায়কের (দায়ি) আবির্ভাব হবে। যে ব্যক্তি তাদের আহ্বানে সাড়া দেবে, তাকে তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছাড়বে।” সাহাবি হুযাইফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, তাদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা আমাদের বলে দিন।” তিনি বললেন, “তারা আমাদেরই মতো চামড়ার লোক হবে এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে।” [সহিহুল বুখারি, হা: ৭০৮৪]

সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, শেষ জামানায় আবির্ভূত এই লোকগুলোর ব্যাপারে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, سَيَقُومُ فِيهِمْ رِجَالٌ قُلُوبُهُمْ قُلُوبُ الشَّيَاطِينِ فِي جُثْمَانِ إِنْسٍ “অচিরেই তাদের মধ্যে এমনসব মানুষের উদ্ভব হবে, যাদের অন্তর হবে মানুষের দেহাবয়বে শয়তানের অন্তর।” [সহিহ মুসলিম, হা: ১৮৪৭; নেতৃত্ব ও প্রশাসন অধ্যায় (৩৪); পরিচ্ছেদ: ১৩]

আমাদের প্রিয় নবিজি আমাদেরকে সতর্ক-সাবধান করে আরও বলেছেন, يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنَ الأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلاَ آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لاَ يُضِلُّونَكُمْ وَلاَ يَفْتِنُونَكُمْ “শেষ জামানায় কিছুসংখ্যক মিথ্যুক ও দাজ্জাল (প্রতারক) লোকের আবির্ভাব ঘটবে। তারা তোমাদের কাছে এমনসব হাদিস নিয়ে আসবে, যা কখনো তোমরাও শোননি এবং তোমাদের বাপদাদারাও শোনেনি। সুতরাং নিজেরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে এবং তাদেরকেও তোমাদের থেকে দূরে রাখবে। তারা যেন তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে না পারে এবং তোমাদেরকে ফিতনায় ফেলতে না পারে।” [সহিহ মুসলিম, হা: ৭; সহিহ মুসলিমের ভূমিকা দ্রষ্টব্য]

খোদ সাহাবিদের আমলেই দেখা দেয় মুসলিমদের মাঝে এরকম পথভ্রষ্ট বিদাতি লোকদের আবির্ভাব। মুসলিমদের কাফির ঘোষণাকারী খারিজি সম্প্রদায়, আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভালোবাসায় অতিরঞ্জনকারী শিয়া সম্প্রদায়, তাকদির অস্বীকারকারী কাদারিয়া সম্প্রদায়— সেগুলোর অন্যতম। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে মুরজিয়া, জাবারিয়া, জাহমিয়া, মুতাজিলা, আশারি ও মাতুরিদি ফের্কার উদ্ভব হয়। তারা আকিদা ও মানহাজের ক্ষেত্রে মুসলিমদের ক্ষতিসাধন করার প্রচেষ্টা চালায়। এসব দলভুক্ত ইসলামি লেবাসধারী তথাকথিত আলিম ও দায়ি সমাজ (মূলত তারা কেউই সত্যিকারের আলিম নয়) ইসলামের ক্ষতিসাধন করে এবং হকপন্থি মুসলিম তথা আহলুস সুন্নাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

নানারকম ভ্রান্ত আকিদা এবং মিথ্যা হাদিস ও কাহিনী বর্ণনা করে তারা মুসলিমদেরকে প্রকৃত ইসলাম থেকে, কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের —সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়ি – এই তিন প্রজন্মকে একত্রে সালাফ বলা হয়— পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তখন সাহাবিদের যুগেই এ জাতীয় বিদাতি আহ্বায়কদের বিরুদ্ধে একনিষ্ঠ সুন্নাহর অনুসারী সালাফগণ অবস্থান নেন এবং মুসলিম জনতাকে এদের থেকে সতর্ক করেন। তাঁরাই হলেন ওই বিদাতিদের বিরুদ্ধে সুন্নাহর অনুসারী আহলুস সুন্নাহ তথা আহলুল হাদিস।

সুপ্রিয় ভ্রাতৃমণ্ডলী, যুগে যুগে নানাবিধ বিদাতি আহ্বায়কের আবির্ভাব ঘটেছে এবং হকপন্থি উলামায়ে কেরাম সর্বদাই মুসলিম উম্মতকে এদের থেকে সতর্ক করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের মানহাজের আলোকে এদের বাতিল মতদর্শের খণ্ডন করেছেন। সেসব হকপন্থি উলামাদের মধ্যে ইমাম আহমাদ, ইমাম ইবনু তাইমিয়া, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব অন্যতম এবং সর্বজনবিদিত। বর্তমান যুগেও বিদাতি লেখক ও বক্তার মতো নয়া-আহ্বায়কদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, বরং আগের তুলনায় এদের সংখ্যা ও দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। এরকমই এক বিপথগামিতার নয়া-আহ্বায়ক হলেন পথভ্রষ্ট বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান সাহেব।

বছর দুয়েক আগেও জনমানুষ-সহ আমরা আবু ত্বহা আদনান সাহেবকে এত ব্যাপক পরিসরে চিনতাম না। এমনকি ঘরের মধ্যে থেকেও বক্তব্য দিতে দেখা গেছে যেই মানুষটিকে, তিনি হঠাৎ পরিণত হলেন সেলিব্রেটি আলোচকে। অসংখ্য যুবক হুমড়ি খেয়ে তার বক্তব্য শুনতে লাগল, আমাদের কাছের অনেক মানুষও তার বক্তৃতা শুনে হঠাৎ ‘শেষ জামানা, দাজ্জাল, ইমাম মাহদি’ নিয়ে অদ্ভুত কথাবার্তা শুরু করে দিল এবং আরব বিশ্বের শাসকদেরকে কাফির ফতোয়া দেওয়া থেকে শুরু করে তাওহিদের দেশ সৌদি আরবের তীব্র সমালোচনা আরম্ভ করল। নবজাগরিত এই ফেতনার প্রাদুর্ভাব লক্ষ করে বাংলাদেশের সালাফি বিদ্বানদের মধ্যে শাইখ ড. আবুবকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া স্যার-সহ অনেকেই আবু ত্বহা আদনান থেকে সতর্ক-সাবধান করলেন। এতে আদনান সাহেবের ভক্তকুল ক্ষিপ্ত হয়ে সালাফি বিদ্বানদেরকে গালিগালাজ শুরু করে দিল। বিভিন্ন ইস্যুতে এই ভক্তকুল সুযোগ পেলেই সালাফি বিদ্বানদের ওপর হামলে পড়ে এবং জর্জরিত করে নির্মম বাক্যবাণে।

পরিস্থিতি যখন এমনই, সেহেতু মুসলিম উম্মতকে সতর্ক করার নিমিত্তে পথভ্রষ্ট বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনানের বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরা এবং এসবের জ্ঞানতাত্ত্বিক খণ্ডন করা জরুরি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মুত্তাকি ইমাম শাইখ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২০ হি.) বলেছেন, “যে মানুষ তোমাকে নসিহত করে, সদুপদেশ দেয়, ভুল শুধরে দেয়, সে-ই তোমার আসল ভাই। সে ব্যক্তি তোমার ভাই নয়, যে তোমার ব্যাপারে উদাসীন ও বিমুখ থাকে এবং তোমাকে তোষামোদ করে চলে। প্রকৃতপক্ষে সে মানুষই তোমার ভাই, যে তোমাকে নসিহত করে, সদুপদেশ দেয় এবং আল্লাহর দিকে আহ্বান করে। তোমাকে মুক্তির পথ বাতলে দেয়, যাতে করে সেই পথে তুমি চলতে পার। ধ্বংসের পথ থেকে তোমাকে সতর্ক করে এবং সেই পথের পরিণাম বলে দেয়, যাতে করে তুমি সেই পথ থেকে বেঁচে থাকতে পার।” [মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআহ, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২১]

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা একনজরে আবু ত্বহা আদনান সাহেবের কতিপয় বিভ্রান্তি তুলে ধরব, এরকম সমালোচনামূলক লেখার আবশ্যকতা বর্ণনা করব, পাশাপাশি আবু ত্বহা আদনানের শরিয়তভিত্তিক সমালোচনার ব্যাপারে উত্থাপিত কিছু অমূলক অভিযোগের খণ্ডন করব এবং ধারাবাহিকভাবে আদনান সাহেবের বিভ্রান্তিগুলোর জবাব দেব, ইনশাআল্লাহ।

· একনজরে আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনানের বিভ্রান্তি:

আবু ত্বহা আদনান সাহেবের বিভ্রান্তি অনেক। ইউটিউবে তার বক্তব্যের কয়েকশ ক্লিপ আছে। আমরা প্রায় একশো চল্লিশটি ভিডিয়ো তালাশ করে একগাদা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য পেয়েছি, যার দরুন তাকে পথভ্রষ্ট ছাড়া অন্যকিছু বলা যায় না। আমরা যেসব ভুল নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করব বলে মনস্থ করেছি, সেসব ভুলের ক্যাটাগরি করেছি আমরা। একেকটি ক্যাটাগরির জন্য একেকটি অধ্যায় বরাদ্দ করা হবে এবং প্রত্যেক অধ্যায়ের আওতায় একাধিক পরিচ্ছেদ থাকবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা এখানে অধ্যায়গুলো একনজরে উল্লেখ করছি।

১ম অধ্যায় : আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান একজন খারেজি বক্তা

২য় অধ্যায় : ধারণা করে কেয়ামতের সময়কাল বলে দেওয়া

৩য় অধ্যায় : দাজ্জাল সংক্রান্ত আকিদার অপব্যাখ্যা এবং না-জেনে শরিয়তের ওপর মিথ্যারোপ

৪র্থ অধ্যায় : মালহামা তথা মহাযুদ্ধ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর অপব্যাখ্যা এবং এ ব্যাপারে শরিয়তের ওপর মিথ্যারোপ

৫ম অধ্যায় : কেয়ামতের আলামত হিসেবে মিথ্যা-বানোয়াট ও দুর্বল হাদিস বর্ণনা

৬ষ্ঠ অধ্যায় : উলামাদের অমূলক নিন্দা, মাদরাসার সিলেবাসের অযৌক্তিক সমালোচনা এবং বক্তা আবু ত্বহা শেষ জামানার সমস্যার সমাধান নিয়ে যা বলেছে বিগত শতবছরের উলামাদের বিরুদ্ধে তা বলতে না পারার ভয়াবহ অভিযোগ

৭ম অধ্যায় : বিদাতি দায়িদের খণ্ডন করার তীব্র নিন্দা, ‘আকিদা-মানহাজের নামে বিভক্তি’ বলে কটাক্ষ করা এবং বিদাতিদের বইপুস্তক পড়তে উৎসাহপ্রদান

৮ম অধ্যায় : কেয়ামতের আলামত-সহ বিভিন্ন বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা

৯ম অধ্যায় : আকিদা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বল ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা

১০ম অধ্যায় : দিনের ব্যাপারে উদ্ভট ও মিথ্যা ফতোয়া প্রদান

শরিয়তবিরোধীর খণ্ডন করা আহলুস সুন্নাহর মূলনীতি:

এটি খুবই জরুরি একটি আলোচনা। দিনের ব্যাপারে ভুলে পতিত ব্যক্তি ও শরিয়তবিরোধীকে রদ (রিফিউট) করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের একটি অন্যতম মূলনীতি। সালাফদের যুগ থেকেই শরিয়তবিরোধীকে রদ করার এই শরয়ি নীতি চলে আসছে। শরিয়তবিরোধীর রদকারীদের ব্যাপারে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশংসামূলক কথা বলেছেন।

ইবরাহিম বিন আব্দুর রাহমান আল-উযরি কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক আগত দলের মধ্যে সৎকর্মপরায়ণ ও নির্ভরযোগ্য মানুষ (কিতাব ও সুন্নাহর) এই ইলম গ্রহণ করবে। আর তারাই কিতাব ও সুন্নাহর ইলমের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক কৃত রদবদল, বাতিলপন্থিদের মিথ্যাচার এবং জাহিল ব্যক্তিদের ভুল ব্যাখ্যা খণ্ডন করবে।” [বাইহাকি, সুনানুল কুবরা, হা: ২১৪৩৯; ইবনু বাত্তাহ, ইবানাতুল কুবরা, হা: ৩৪; মিশকাত, হা: ২৪৮; সনদ: সহিহ (তাহকিক : আলবানি)]

সালাফগণের কর্মে আমরা এই মহান নীতির প্রতিফলন দেখতে পাই। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে এসেছে, কাব বিন উজরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, একদা তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন, যখন আব্দুর রহমান ইবনুল হাকাম বসা অবস্থায় খুতবা দিচ্ছিলেন। কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “তোমরা এই খবিসের দিকে লক্ষ করো, সে বসে বসে খুতবা দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যখন তারা দেখল ব্যবসা ও কৌতুকের বিষয়, তখন তারা (খুতবা চলাকালীন সময়ে) তোমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে গেল।’ (সুরা জুমুআহ: ১১)” [সহিহ মুসলিম, হা: ৮৬৪; জুমুআহ অধ্যায় (৮); পরিচ্ছেদ: ১১]

ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছে, “শরিয়তবিরোধীকে রদ করা এবং (দিনের ব্যাপারে) ভুলকারীদের ভুল বর্ণনা করা কি সুন্নাহর মূলনীতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত?” তিনি উত্তরে বলেছেন, “হ্যাঁ, শরিয়তবিরোধীকে রদ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের তরিকার অন্তর্ভুক্ত।” [দ্র.: https://youtu.be/OEJAMUKzjvk (অডিয়ো ক্লিপ)]

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শরিয়তবিরোধীর রদ করা আহলুস সুন্নাহর একটি অন্যতম মূলনীতি। পরন্তু শরিয়তবিরোধীকে রদ করার মাধ্যমে সুন্নাহকে ডিফেন্ড করা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার শামিল। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেছেন, “বিদাতিদের রদকারী একজন মুজাহিদ। এমনকি ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া বলেছেন, ‘সুন্নাহকে ডিফেন্ড করা সর্বোত্তম জিহাদ’।” [নাকদুল মানতিক, পৃষ্ঠা: ১২; গৃহীত: ইজমাউল উলামা আলাল হাজরি ওয়াত তাহযিরি মিন আহলিল বিদা; পৃষ্ঠা: ১০৪]

. শরিয়তবিরোধীর ব্যাপারে চুপ থাকা নিষিদ্ধ:

প্রিয় ভাই ও বোন, জেনেশুনে শরিয়তবিরোধীর ব্যাপারে চুপ থাকা যাবে না। কারণ এটা জনমানুষের দিন সংক্রান্ত বিষয়। সাধারণ মানুষের কাছে হক পৌঁছে দেওয়া আবশ্যক, যাতে করে ভুলকারীর দ্বারা তারা ধোঁকাগ্রস্ত না হয়। আর শরিয়তের ক্ষেত্রে ভুলকারীকে খণ্ডন করার নীতি সালাফদের যুগ থেকে চলে আসছে। সালাফগণ ও উম্মতের ইমামগণ ব্যক্তির দিকে তাকাননি, বরং দিনের দিকে তাকিয়েছেন।

১. আহলুস সুন্নাহর প্রখ্যাত ইমাম আল-বারবাহারি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৩২৯ হি.) বলেছেন, “জেনে রেখ, সঠিক পথ থেকে বের হয়ে যাওয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। হয় ব্যক্তি পথ ভুল করেছে, অথচ সে স্রেফ কল্যাণের অভিলাষীই ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ভুলের অনুসরণ করা যাবে না। নতুবা সে (জেনেশুনে ভুলের অনুসরণকারী) ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর না হয় ব্যক্তি সত্য গ্রহণে হঠকারিতা করেছে এবং তার পূর্ববর্তী মুত্তাকি ব্যক্তিদের বিরোধিতা করেছে। এই ব্যক্তি নিজে ভ্রষ্ট এবং অপরকে ভ্রষ্টকারী। সে এই উম্মতের অবাধ্য শয়তান। যে ব্যক্তি তার প্রকৃত অবস্থা জানে, তার উচিত ওর থেকে মানুষকে সতর্ক করা এবং ওর ঘটনা মানুষের কাছে বর্ণনা করা। যাতে করে কেউ ওর বিদাতে পতিত হয়ে ধ্বংস না হয়।” [ইমাম বারবাহারি রাহিমাহুল্লাহ, শারহুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা: ৬৯-৭০; তাহকিক: শাইখ খালিদ আর-রাদ্দাদি রাহিমাহুল্লাহ; মাকতাবাতুল গুরাবায়িল আসারিয়্যাহ, মাদিনাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৪ হি./১৯৯৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

২. বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাকিহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.) বলেছেন, “মুসলিমদের আলিমদের ওপর প্রকৃত বিষয় বর্ণনা করা, প্রত্যেক দল বা সংগঠনের সাথে (শরয়ি) বিতর্ক সম্পন্ন করা এবং সবাইকে ওই পথের ওপর চলতে নসিহত করা ওয়াজিব, যে পথ স্বয়ং আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য চিত্রিত করেছেন, আর যে পথের দিকে আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আহ্বান করেছেন। যে ব্যক্তি এই পথের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে বা কেবল আল্লাহ জানেন এমন কোনো (গুপ্ত) উদ্দেশ্যের কারণে নিজের জিদ ও হঠকারিতায় অটল থাকে, তাহলে যারা প্রকৃত বিষয়টি জানে তাদের জন্য ওই ব্যক্তির সমালোচনা করা এবং তার থেকে সতর্ক করা ওয়াজিব। যাতে করে মানুষ এই ব্যক্তিদের পথ বর্জন করে, আর যে ব্যক্তি প্রকৃত বিষয় জানে না সে তাদের দলে প্রবেশ না করে। নতুবা তারা ওই অজ্ঞ ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করবে এবং সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। যেই সঠিক পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আর এটি তো আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ করো এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ কোরো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করো।” (সুরা আনআম: ১৫৩)” [ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ, মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২০৩; দারুল কাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরি (১ম প্রকাশ)]

৩. ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ আরও বলেছেন, “পাপাচারী, মূর্খ ও বিদাতির বিরুদ্ধে কথা বলা বর্জন করা এবং নীরব থাকা আলিমদের জন্য বৈধ নয়। কেননা এটি একটি মারাত্মক গলদ। এটি অকল্যাণ ও বিদাত প্রসারিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এটি কল্যাণ কমে যাওয়া, কল্যাণ দূরীভূত হওয়া এবং সুন্নাহ অপসৃত হওয়ারও অন্যতম কারণ। সুতরাং আলিমদের জন্য হক বলা, এর দিকে লোকদের আহ্বান করা, বাতিলকে রদ করা এবং এ থেকে লোকদেরকে সতর্ক করা ওয়াজিব। তবে অবশ্যই তা হতে হবে শরয়ি ইলম ও জাগ্রত জ্ঞান সহকারে।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫৩]

৪. এমনকি যারা দ্বীনের ব্যাপারে ভুলকারীর ব্যাপারে চুপ থাকে, তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনকারী। এ মর্মে ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “হকপন্থিরা যদি হক বর্ণনা করা থেকে চুপ থাকে, তাহলে ভুলকারীরা তাদের ভুলে অটল থাকবে এবং অন্যরা সেই ভুলের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করবে। আর নীরবতা অবলম্বনকারীরা শরিয়ত গোপনের পাপ বহন করবে, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাদের হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, সেগুলিকে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা সেসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে। তবে তারা ছাড়া, যারা তওবা করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব আমি তাদের তাওবাহ কবুল করব। বস্তুত আমি তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।” (সুরা বাকারা: ১৫৯-১৬০)

আল্লাহ আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আলিমদের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তারা তা মানুষের কাছে বর্ণনা করবে, গোপন করবে না। কিন্তু তারা সে অঙ্গীকার তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেলার কারণে আল্লাহ তাদের ভর্ৎসনা করেছেন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করা থেকে সতর্ক করেছেন। কিতাব ও সুন্নাহর বিরোধীদের ভুল বর্ণনা করা থেকে আহলুস সুন্নাহ যদি চুপ থাকে, তাহলে তারা এর মাধ্যমে ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, যে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৭২-৭৩]

৫. ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ বলেছেন, “যে মুসলিমের কাছে ইলম আছে, তার জন্য বিদআত ও শরিয়তবিরোধিতার ব্যাপারে চুপ থাকা এবং মানুষের কাছে তা বর্ণনা না করা জায়েজ নয়। কেননা সে যদি চুপ থাকে, তাহলে মানুষ তা দলিল হিসেবে গ্রহণ করবে এবং বলবে, “এটা যদি হারাম বা নিষিদ্ধই হতো, তাহলে অমুক ‘আলিম তা দেখা সত্ত্বেও চুপ করে থাকতেন না”।” [দ্র.: www.sahab(ডট)net/forums/index.php?app=forums&module=forums&controller=topic&id=122996 (টেক্সট-সহ অডিয়ো ক্লিপ)]

উপরোদ্ধৃত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো, পথভ্রষ্ট বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান সাহেবের মৌলিক বিভ্রান্তিগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকা যাবে না। বরং সেসব বিভ্রান্তির ব্যবচ্ছেদ করতে হবে, মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণের জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য।

নাম ধরে সমালোচনা করার বৈধতা:

এরকম পথভ্রষ্ট বক্তাদের ইলমি খণ্ডন করা শুরু হলেই একশ্রেণির ভক্তকুল বলে বসেন, নাম ধরে সমালোচনা করা না-জায়েজ। বাস্তবতা হলো, বিদাতি ও শরিয়তবিরোধীর নাম ধরে ইলমি সমালোচনা করা জায়েজ, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিব। এ মর্মে ইমামদের থেকে কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করছি।

১. প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ি শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৮১ হি.) বললেন, “মুআল্লা বিন হিলাল যখনই হাদিস বর্ণনা করে, তখনই মিথ্যা বলে।” তখন তাঁকে একজন সুফি বলল, “হে আবু আব্দুর রহমান, আপনি গিবত করছেন?” তখন তিনি বললেন, “চুপ করো তুমি! যদি আমরা এভাবে সুস্পষ্ট বর্ণনা না করি, তবে লোকেরা কীভাবে বাতিল থেকে হককে (আলাদা করে) চিনতে পারবে?” [হাফিজ সুয়ুতি কৃত তাদরিবুর রাবি; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৬৯; গৃহীত: শাইখ হারিসি রাহিমাহুল্লাহ, লাম্মুদ দুর্রিল মানসুর; পৃষ্ঠা: ১৮৪]

২. ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ২৬১ হি.) সহিহ মুসলিমের ভূমিকায় বলেছেন, “পরিচ্ছেদ: হাদিসের সনদ বর্ণনা করা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছাড়া রিওয়াইয়াত (বর্ণনা) গ্রহণ করা উচিত নয়; বর্ণনাকারীদের দোষত্রুটি তুলে ধরা শুধু জায়েজ নয়, বরং ওয়াজিব! এটি হারাম গিবতেরও অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং এটি ক্ষতিকারক বিষয়াদি দূর করে মর্যাদাপূর্ণ শরিয়তের বিধানসমূহকে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত করার অন্তর্ভুক্ত!” [সহিহ মুসলিম, ‘ভূমিকা’, পরিচ্ছেদ: ৫]

৩. ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.) বলেছেন, “কোনো ব্যক্তি যদি মন্দ দায়ির গিবত করে এবং নির্দিষ্টভাবে তার নাম ধরে সমালোচনা করে, যাতে মানুষ তার থেকে সতর্ক হয়, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। বরং কখনো কখনো এটা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। কারণ এর মাধ্যমে মুসলিমদের ওপর আপতিত বিপজ্জনক বিষয়কে দূরীভূত করা হয়। যেহেতু তারা তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।” [নূরুন আলাদ দার্ব, ১৫৮ নং অডিয়ো ক্লিপ; গৃহীত: সাহাব (sahab) ডট নেট]

৪. ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহকে (জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.) উলামা ও তুল্লাবুল ইলম কর্তৃক শরিয়তবিরোধীদের নাম ধরে সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো মানুষকে ভুল ও বিপথগামিতা থেকে সতর্ক করতে হবে। আর প্রয়োজন দেখা দিলে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে সতর্ক করতে হবে। কেননা ব্যক্তির দ্বারা মানুষ ধোঁকাগ্রস্ত হয়। বিশেষত যেসব লোকের চিন্তা ও দর্শনে ভ্রষ্টতা রয়েছে, আর (মানুষের মধ্যে) তাদের প্রসিদ্ধি আছে, মানুষ তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা করে, তাহলে সেসব লোকের নাম উল্লেখ করা এবং তাদের থেকে সতর্ক করায় কোনো সমস্যা নেই। আলিমগণ জারাহ (কাউকে মন্দ বলা) ও তাদিল (কাউকে ভালো বলা) শাস্ত্রে আলোচনা করেছেন, হাদিস বর্ণনাকারীদের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাদের ব্যাপারে যা বলা হয় তা বলেছেন, অর্থাৎ মন্দ গুণের কথা আলোচনা করেছেন। তাঁরা তা ব্যক্তিগত কারণে-বলেননি,-বরং-উম্মতের-নসিহতের-জন্য-বলেছেন।”-[দ্র.: https://m.youtube.com/watch?v=_DPtrywcDIc (অডিয়ো ক্লিপ)]

· রদ করার পূর্বে ব্যক্তিগতভাবে জানানো শর্ত নয়:

কোনো শরিয়তবিরোধীর ভুলত্রুটির খণ্ডন করতে চাওয়া হলেই একদল ভাই আপত্তি পেশ করে বলেন, রদ করার আগে তাঁকে ব্যাক্তিগতভাবে জানানো জরুরি, পার্সোনালি নসিহত না করে প্রকাশ্য সমালোচনা করা যাবে না ইত্যাদি। এ ব্যাপারে সত্য কথা এই যে, রদ করার পূর্বে ব্যক্তিগতভাবে জানানোকে স্বয়ং আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জরুরি মনে করেননি এবং সালাফগণও জরুরি মনে করেননি। এ প্রসঙ্গে আমরা ‘রদ করার পূর্বে কি ব্যক্তিগতভাবে জানানো শর্ত’—শিরোনামে বিশদ আলোচনা করেছি। [দ্র.: https://tinyurl(ডট)com/v7dumf8] তারপরও এখানে দুটো ফতোয়া উল্লেখ করছি।

·১. বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল-মুজাদ্দিদ, আল-ফাকিহ, আন-নাকিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আল-আলবানি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.) প্রদত্ত ফতোয়া—

প্রশ্ন: “এ থেকে কতিপয় লোকের এরকম বক্তব্য বা শর্তারোপ উদ্ভূত হয়েছে যে, কারও রদ (রিফিউটেশন) প্রকাশ করার আগে অবশ্যই রদের একটি কপি যাকে রদ করা হচ্ছে তার কাছে পাঠাতে হবে, তিনি না দেখা পর্যন্ত রদ প্রকাশ করা যাবে না। তারা বলছে, এটাই সালাফদের মানহাজ।”

উত্তর: “এটা শর্ত নয়। কিন্তু যদি সম্ভব হয়, আর এই কর্মপন্থার মাধ্যমে এটাই আশা করা হয় যে, জনসাধারণের মাঝে বিষয়টি না ছড়িয়ে সমঝোতা হোক, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা ভালো কাজ। পক্ষান্তরে এটাকে আগে শর্ত বানানো, তারপর এটাকে সার্বজনিক শর্ত বানানো, এগুলো কোনোভাবেই প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ নয়। তোমরা সকলেই জান, মানুষ স্বর্ণ-রৌপ্যের খনিস্বরূপ (যারা ভালো, তারা সবক্ষেত্রেই ভালো)। তুমি যার ব্যাপারে জেনেছ, সে আমাদের সাথে আমাদের মানহাজ ও আদর্শের ওপরেই আছে, আর সে নসিহত গ্রহণও করে, তাহলে তুমি তার ভুল না ছড়িয়ে তাকে চিঠি লিখ। কমপক্ষে তুমি তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে এক্ষেত্রে ঠিক আছ। কিন্তু এটা শর্ত নয়। এমনকি এটা যদি শর্তও হতো, তথাপি তা পূরণ করা সম্ভবপর হতো না। তুমি কোথা থেকে তার ঠিকানা জোগাড় করবে? তারপর কীভাবেই বা চিঠি আদানপ্রদান করবে? এরপর তার তরফ থেকে চিঠির জবাব আসবে, নাকি আসবে না? এগুলো পুরোপুরি ধারণানির্ভর ব্যাপার। এই শর্ত বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এজন্য এই বিষয়কে শর্ত ধরে নেওয়া যাবে না।” [সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নুর, ৬৩৮ নং অডিয়ো ক্লিপ; গৃহীত: আজুর্রি (ajurry) ডট কম]

·২. বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল্লামাতুল ফাকিহ, ইমাম রাবি বিন হাদি বিন উমাইর আল-মাদখালি হাফিযাহুল্লাহ (জন্ম: ১৩৫১ হি./১৯৩২ খ্রি.) প্রদত্ত ফতোয়া—

প্রশ্ন: “শাইখানা, কিছু কথা ছড়ানো হচ্ছে, আর তা সালাফীদের জন্য বিপথগামিতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদল লোক দাবি করছে, কারও থেকে সতর্ক করার আগে তাকে ব্যক্তিগত নসিহত করা ওয়াজিব। শাইখানা, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?”

উত্তর: “আমি আগেও এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আমরা এ ধরনের লোকদের নিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছি। তুমি দেখবে, সে ব্যাপকভাবে অন্যদের ব্যাপারে নাম ধরে নানারকম বাতিল কথা, মিথ্যাচার ও রটনা প্রচার করছে। যখন তাকে নসিহত করা হবে, সমালোচনা করা হবে, তখনই সে বলে, তারা আগে আমাকে সতর্ক করল না কেন? তারা আগে আমাকে নসিহত করল না কেন? তারা আগে আমাকে জানাল না কেন? এগুলো হলো বিভ্রান্তিকর আপত্তি। আমরা তাদের কাছ থেকে আশা করব, তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করুক, হকের দিকে ফিরে আসুক, আদব ও বিনয়ের সাথে। আর তারা এসব আপত্তি বর্জন করুক।

আচ্ছা, এ ভুল করেছে, তোমার সাথে কথা বলেনি, তোমাকে নসিহত করেনি। কিন্তু তুমি আগে হকের দিকে ফিরে আস, তারপর তাকে দোষারোপ করো। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে তোমার অনুসরণ করা হচ্ছে, আর তুমি তোমার বাতিল মতবাদ ও ত্রুটিবিচ্যুতির মধ্যেই অবস্থান করছ, আর বলছ, তারা এটা করল না, তারা এটা করল! এগুলো অর্থহীন প্রলাপ। মুমিনদের কর্তব্য হলো, তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব নসিহতই গ্রহণ করবে।

তুমি বইয়ের মধ্যে, আর লেকচারের মধ্যে তোমার ভুল প্রচার করছ! তুমি যদি তোমার ভুল গোপনে রাখ, আর ভুলগুলো অন্ধকারের মধ্যে চর্চা করো, তাহলে সেটা তোমার আর আল্লাহর মধ্যকার ব্যাপার। আর এই লোক যদি তোমার ভুল আবিষ্কার করে ফলে, সে তোমাকে নসিহত করবে। এটা তোমার আর তার ব্যাপার। কিন্তু তুমি জগৎ জুড়ে তোমার (ভুল) কথা ও কাজ প্রচার করছ। এখন কোনো মুসলিম এসে তোমাকে খণ্ডন করল। এতে কোনো শর্তের ব্যাপার নেই। এসব আপত্তি বর্জন করো। যেসব আপত্তি মূলত বাতিলপন্থিদের, যারা বাতিল ও হঠকারিতায় অটল থেকে লাঞ্ছিত হয়েছে।” [“১৪০০ হিজরিতে শাইখ রাবির সাক্ষাৎকার”– শীর্ষক অডিয়ো ক্লিপ থেকে গৃহীত; দ্রষ্টব্য: www.rabee(ডট)net/ar/questions.php?cat=29&id=605]

সুপথপ্রাপ্তির অভিলাষী

এক গুনাহগার বান্দা—

Md Abdullah Mridha.

[সংযুক্তি: লম্বা ভূমিকা সংবলিত পোস্ট শেয়ার না হওয়ায় পোস্ট সংক্ষিপ্ত করা হলো। ভূমিকার বাকি অর্ধেক পরবর্তী পোস্টে পাবলিশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ। ওয়াফ্ফাকাকুমুল্লাহ।]

·[ক্রমশ চলবে, ইনশাআল্লাহ]


Post a Comment

0 Comments