·দাজ্জাল
আগমনের বিষয়টি গায়েবি জ্ঞানের অন্তর্গত। আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি, কেয়ামতের
প্রকাশিতব্য আলামতগুলোও কেয়ামতের মতোই গায়েবি বিষয়। এসব বিষয় নিয়ে না জেনে কিংবা
অপব্যাখ্যা করে একটি কথাও বলা বৈধ নয়। কিন্তু ভ্রান্ত বক্তা আবু ত্বহা আদনান
অসংখ্য বক্তব্যে দাজ্জালের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে যেয়ে নিজের মস্তিকপ্রসূত
কথাবার্তা বলেছে এবং হাদিসের নামে জালিয়াতি করেছে। এরকম কয়েকটি বক্তব্যের নমুনা
আমরা পেশ করছি।
এক. আবু
ত্বহা আদনান এক বক্তব্যে বলেছে, “আল্লাহর রসুল বলছেন যে, ‘নারীজাতি তার ফলো করবে,
সে ওই জেরুজালেম থেকে সারাবিশ্বের পলিটিক্স নিয়ন্ত্রণ করবে, সারাবিশ্বের অর্থনীতি
নিয়ন্ত্রণ করবে, সারাবিশ্বের ভৌগলিক জিনিস নিয়ন্ত্রণ করবে, মহামারি সে ছড়াবে, সে
দুর্ভিক্ষ দিবে, সে ভূমিকম্প দিতে পারবে, বৃষ্টিবর্ষণ করতে পারবে।’ এই শক্তিগুলো
কি তারা অর্জন করেনি? এই যে পুরো সিস্টেমটা আমি বললাম, আপনার কি মনে হচ্ছে, এই
পুরো জিনিসটা এক্সিডেন্টলি সব হয়ে গেছে? এর পেছনে একজন মাস্টারমাইন্ড কাজ করছে।
সেই মাস্টারমাইন্ডই হচ্ছে দাজ্জাল।” [দেখুন: https://youtu.be/i3Nk-IrMWrE
(17:39 মিনিট থেকে 18:16 মিনিট পর্যন্ত)]
পর্যালোচনা:
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও উক্ত হাদিস বলেননি। সুতরাং এটা রসুলের
নামে মিথ্যাচার হিসেবে বিবেচিত হবে। আর মিথ্যাচারের শাস্তি কী তা আমরা গত
পরিচ্ছেদে আলোচনা করেছি। তবে হ্যাঁ, নারীজাতির একটি বড়ো অংশ দাজ্জালকে অনুসরণ
করবে, এই কথা স্বতন্ত্র হাদিসে এসেছে। [আহমাদ, হা: ৫৩৫৩; সনদ: সহিহ (তাহকিক: আহমাদ
শাকির)] কিন্তু জেরুজালেম থেকে দাজ্জাল সারাবিশ্বের পলিটিক্স নিয়ন্ত্রণ করবে,
অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, ভৌগলিক জিনিস নিয়ন্ত্রণ করবে, মহামারি ছড়াবে, ভূমিকম্প
দিতে পারবে – এগুলো বিষয় বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়নি। বরং আদনান সাহেব এগুলো
বানিয়ে বলেছে, কিংবা অপব্যাখ্যা করেছে।
পরন্তু
বলে বসেছে, “এই শক্তিগুলো কি তারা অর্জন করেনি? এই যে পুরো সিস্টেমটা আমি বললাম,
আপনার কি মনে হচ্ছে, এই পুরো জিনিসটা এক্সিডেন্টলি সব হয়ে গেছে? এর পেছনে একজন
মাস্টারমাইন্ড কাজ করছে। সেই মাস্টারমাইন্ডই হচ্ছে দাজ্জাল।” এর মানে আবু ত্বহা
সাহেব মনে করে, ইসরাইলের ইহুদিরা যে বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে,
সেটাই দাজ্জালের ফিতনা! ইহুদিদের এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে একজন মাস্টারমাইন্ড কাজ
করছে। সেই মাস্টারমাইন্ডই হচ্ছে দাজ্জাল! বর্তমান ইহুদিদের কর্মকাণ্ড খোদ দাজ্জালের
ফিতনা হওয়ার ব্যাপারে সে ব্যাপারে আবু ত্বহা আদনানের কাছে কোনো শরয়ি দলিল নেই। এর
মানে এটা বোঝায়নি বক্তা আদনান যে, দাজ্জাল পরে আসবে না। বরং দাজ্জাল আড়ালে থেকে
এখন কাজ করলেও মানুষরূপে তার আবির্ভাব হবে পরে। এমনটিই মনে করে বক্তা আদনান, যা
তার বিভিন্ন বক্তব্য থেকে জানা গেছে।
এরকম
গায়েবি বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর প্রকাশ্য কথার বাইরে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। সাবেক
গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২০ হি.) বলেছেন—
أما الغيب فلا يعلمه إلا الله وحده، وإنما يعلم الرسول - ﷺ - وغيره من الخلف من الغيب ما أطلعهم الله عليه مما ورد في القرآن الكريم والسنة المطهرة بيانه من أمور الجنة والنار وأحوال القيامة وغير ذلك مما دل عليه القرآن الكريم والأحاديث الصحيحة، كأخبار الدجال وطلوع الشمس من مغربها وخروج الدابة ونزول المسيح عيسى ابن مريم في آخر الزمان وأشباه ذلك، لقول الله في سورة النمل: قُلْ لا يَعْلَمُ مَن فِي السَّماواتِ والأرْضِ الغَيْبَ إلّا اللَّهُ وما يَشْعُرُونَ أيّانَ يُبْعَثُونَ.
“এক
আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে না। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও
পরবর্তী যুগের অন্য ব্যক্তিবর্গ কেবল ততটুকু গায়েব জানেন, যতটুকু আল্লাহ তাঁদেরকে
জানিয়েছেন। যেই জ্ঞাত বিষয়গুলোর বিবরণ মহান কুরআন ও পবিত্র সুন্নাহয় এসেছে, যেমন
জান্নাত ও জাহান্নামের বিষয়াদি, কেয়ামতের পরিস্থিতি প্রভৃতি; যেগুলো প্রতীয়মান
হয়েছে মহান কুরআন ও সহিহ হাদিসের মাধ্যমে। যেমন দাজ্জাল, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়,
বিশেষ জন্তুর আবির্ভাব, শেষ যুগে মারইয়াম তনয় ইসার অবতরণ প্রভৃতি সম্পর্কিত
সংবাদসমগ্র। কারণ সুরা নামলের মধ্যে আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি বলে দাও, আল্লাহ ব্যতীত
আসমান ও জমিনে কেউই গায়েব জানে না; আর তারা উপলব্ধিও করে না কখন তাদের পুনরুত্থান
হবে’ (সুরা নামল: ৬৫)।” [মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআহ, খণ্ড: ২;
পৃৃষ্ঠা: ৩৮১-৩৮২]
মক্কার
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম হামুদ বিন আব্দুল্লাহ আত-তুওয়াইজিরি রাহিমাহুল্লাহ (১৪১৩
হি.) বলেছেন, إن الأمور التي تكون مع الدجال من الأمور الغيبية فلا يقال فيها بمجرد الرأي وإنما ينتهى فيها إلى ما جاء عن المعصوم صلوات الله وسلامه عليه "د “দাজ্জাল সংক্রান্ত যত বিষয় রয়েছে তার সবই গায়েবি
বিষয়াবলির অন্তর্গত। এক্ষেত্রে স্রেফ মানবীয় মতের ভিত্তিতে কোনো কথা বলা যাবে না।
বরং এক্ষেত্রে নিষ্পাপ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা কিছু বর্ণিত
হয়েছে, কেবল সেসব বর্ণনার কাছে যেয়েই ক্ষান্ত থাকতে হবে।” [শাইখ তুওয়াইজিরি বিরচিত
ইদাহুল মাহাজ্জা ফির রদ্দি আলা সাহিবি তানজা, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৭১; গ্রন্থটির
ভূমিকা লিখেছেন প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম আলুশ শাইখ;
মুআসসসাতুন নুর (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রথম প্রকাশ (তারিখবিহীন)]
কুরআন-সুন্নাহর
কোথাও নেই, দাজ্জাল আড়ালে থেকে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করবে এবং ইহুদিদের
ডিরেকশন দিয়ে পুরো বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সুতরাং আদনান সাহেব
গায়েবি বিষয় নিয়ে নিজের মস্তিকপ্রসূত মন্তব্য করেছেন, যা গর্হিত অপরাধ এবং কোনো
মুমিন ব্যক্তির জন্য এসব কথায় বিশ্বাস করা না-জায়েজ।
·
দুই. আবু
ত্বহা আদনান বলেছে, “সব নারীবাদী, এদেশে যত নারীবাদী আছে, সেকুলারিজম, এই
নারীবাদীরা বেশিরভাগই দাজ্জালের এজেন্ট। নিজ হাতে দাজ্জাল ট্রেনিং দিয়ে এদেরকে
তৈরি করেছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন, দাজ্জাল তো এখনও বের হয় নাই, ট্রেনিং দিবে
কীভাবে? আমরা কি ইবলিসকে দেখি? ইবলিস নাই? ওর অস্তিত্ব নাই? এখানে ফেরেশতারা ঘিরে
রাখছেন, এটা দিনি মাজলিস। কেউ দেখতে পাচ্ছি? তাঁদের অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করতে
পারেন? দাজ্জাল এরকম একটা এভিডেন্স, এরকম একটা সৌল, সে অলরেডি রিলিজড! সে মানুষের
রূপে আমাদের সামনে আসেনি।” [দেখুন: https://youtu.be/ikRrLAjDTmQ
(১:২৮ মিনিট থেকে ২:০৩ মিনিট)]
পর্যালোচনা:
নারীবাদীরা দাজ্জালের এজেন্ট, নিজ হাতে দাজ্জাল ট্রেনিং দিয়ে এদেরকে তৈরি করেছে—
কথাটির পেছনে কোনো শরয়ি দলিল নেই, এ বিষয়ে পরবর্তী পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হবে
ইনশাআল্লাহ। আবু ত্বহা আদনান বলছে, দাজ্জাল অলরেডি ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু সে আড়ালে
রয়েছে, মানুষরূপে আবির্ভূত হয়নি। ফেরেশতাগণ, ইবলিস আমাদের সামনে প্রকাশ না পাওয়া
সত্ত্বেও যেমন অস্তিত্বশীল, তেমনভাবে দাজ্জালও আমাদের সামনে প্রকাশ পায়নি, কিন্তু
গোপনে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সুবহানাল্লাহ! এসব কথা বলতে হলে কুরআন-সুন্নাহর
স্পষ্ট দলিল লাগবে, যা আমরা ইতোমধ্যে বলেছি। কিন্তু এসব কথার কোনো দলিল নেই। বরং
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত তামিম দারি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস অনুযায়ী দাজ্জাল এখনও বন্দী
রয়েছে, শেষ যুগে আল্লাহর ফায়সালায় সে মানুষরূপেই আত্মপ্রকাশ করবে। [দেখুন: সহিহ
মুসলিম, হা: ২৯৪২; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ২৪]
বর্তমান
যুগে আকিদার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, সব্যসাচী বিদ্বান আল্লামা সালিহ বিন আব্দুল আযিয আলুশ
শাইখ হাফিযাহুল্লাহ (জন্ম: ১৩৭৮ হি.) বলেছেন, فالدجال جاءت النصوص الكثيرة بخروجه وأنه سيخرج من مَحْبَسٍ هُوَ فيه، إذا أذِنَ الله - عز وجل - بخروجه، وأنّهُ بَشَرْ من جنس البشر “অসংখ্য দলিলে বর্ণিত হয়েছে,
দাজ্জালের আবির্ভাব হবে, আর সে তার বন্দিশালা থেকে বের হবে, যখন মহান আল্লাহ তার
আবির্ভাবের ফায়সালা করবেন, এবং সে হবে মানবজাতির একজন মানুষ।” [শারহুল আকিদাতিত
তাহাবিয়্যাহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৯১৭; দারুল মাওয়াদ্দা থেকে প্রকাশিত; প্রকাশকাল:
১৪৩১ হি./২০১১ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
গ্র্যান্ড
মুফতির তত্ত্বাবধানে ‘ইলমি গবেষণার প্রধান কার্যালয়’ থেকে প্রকাশিত গবেষণাপত্রিকা
‘মাজাল্লাতুল বুহুসিল ইসলামিয়্যায়’ লেখা হয়েছে, والذي نقطع به، ونعتقده أن الدجال محبوس الآن حي موجود في مكانه، وأنه سيخرج لا محالة “আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত এবং এই
আকিদাই আমরা পোষণ করি যে, দাজ্জাল এখন তার জায়গায় জীবিত অবস্থায় বন্দী রয়েছে। আর
অবশ্যই সে আত্মপ্রকাশ করবে।” [মাজাল্লাতুল বুহুসিল ইসলামিয়্যা, খণ্ড: ৮৫; পৃষ্ঠা:
২২৯]
·
তিন. আবু
ত্বহা আদনান আরেকটি বক্তব্যে বলেছে, “আর আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জেরুজালেম থেকে শেষ জামানায় একজন ব্যক্তির আবির্ভাব হবে। সে
হবে ইহুদি বংশোদ্ভূত, ইহুদি মায়ের সন্তান। কোঁকড়ানো চুল, স্ট্রংলি বিল্ড, শারীরিক
শক্তি অনেক বেশি। সে আকাশ নিয়ন্ত্রণ করবে, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করবে, পলিটিক্স
নিয়ন্ত্রণ করবে, সে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, ভৌগলিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে, মানি
নিয়ন্ত্রণ করবে, টাকা, সে খাবার নিয়ন্ত্রণ করবে, সে ফ্লাই করবে, সে ডান হাতে
জান্নাত নিয়ে আর বাম হাতে জাহান্নাম নিয়ে ঘুরবে, সে মহামারি ছড়াবে।” [দেখুন: https://youtu.be/i3Nk-IrMWrE
(০:৫৩ মিনিট থেকে ১:৩৩ মিনিট)]
পর্যালোচনা:
এই হাদিসটি কি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন? কোনো হাদিসগ্রন্থে
এরকম হাদিস খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং উক্ত হাদিসে প্রদত্ত এসব তথ্যের বেশিরভাগই
অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। দাজ্জালের নির্দেশে কোথাও বৃষ্টি হবে, আবার কোথাও অনাবৃষ্টি
হবে এবং সে মেঘের মতো গতিতে চলবে - এটা হাদিসে এসেছে। [দেখুন: সহিহ মুসলিম, হা:
২৯৩৭; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ২০] কিন্তু এখান
থেকে অপব্যাখ্যা করে আদনান বলেছে, ‘দাজ্জাল আকাশ ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করবে, আর
ফ্লাই করবে!’
আমরা
ইতঃপূর্বে বলেছি, কুরআন-সুন্নাহর দলিল ব্যতিরেকে কুরআন-সুন্নাহর কোনো অংশকে তার প্রকাশ্য
অর্থ থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ভিন্ন অর্থ করা না-জায়েজ। এ ব্যাপারে সাহাবিগণের ইজমা হয়ে
গেছে, কেননা তাঁরা কুরআন-সুন্নাহর কোনো অংশের এরূপ অপব্যাখ্যা করেননি। ইমাম কাদি
আবু ইয়ালা রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৪৫৮ হি.) তাঁর ‘ইবতালুত তাবিল (অপব্যাখ্যার
অপনোদন)’ গ্রন্থে বলেছেন, لا يجوز رد هذه الأخبار ولا التشاغل بتأويلها، والواجب حملها على ظاهرها “এসব
হাদিস প্রত্যাখ্যান করা এবং এসবের ভিন্ন ব্যাখ্যা করা না-জায়েজ। বরং হাদিসগুলোকে
সেসবের প্রকাশ্য অর্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা আবশ্যক।” [দেখুন: শাইখুল ইসলাম কৃত
আল-ফাতওয়া আল-হামাবিয়্যাহ, তাহকিক: ড. হামাদ আত-তুওয়াইজিরি; পৃষ্ঠা: ৪৮৮-৪৯০;
দারুস সামিয়ি (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (২য়
প্রকাশ)]
বরং
কুরআন-সুন্নাহর দলিল ছাড়া তাবিল করা বিদাতিদের কাজ। ইমাম আহমাদ ইবনু সুরাইজ
আশ-শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৩০৩ হি.) বেশকিছু ইলাহি গুণাবলির আলোচনা করার পর
বলেছেন, اعتقادنا فيه وفي الآي المتشابه في القرآن أن نقبلها، ولا نردها، ولا نتأولها بتأويل المخالفين، ولا نحملها على تشبيه المشبهين... ونقول : الآية والخبر صحيحان، والإيمان بهما واجب، والقول بهما سنة، وابتغاء تأويلها بدعة وزندقة “এসব বিষয়ে এবং কুরআনের দ্ব্যর্থবোধক অস্পষ্ট
আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের আকিদা হচ্ছে— আমরা এগুলো গ্রহণ করে নেব, এগুলোকে
প্রত্যাখ্যান করব না, আবার শরিয়তবিরোধীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যাও
করব না, এবং সাদৃশ্যদানকারীদের সাদৃশ্য মোতাবেকও এসব বিষয়ের প্রয়োগ করব না।...
আমরা বলি, কুরআনের আয়াত এবং হাদিস বিশুদ্ধ দলিল। এ দুয়ের প্রতি ইমান রাখা ওয়াজিব।
এ দুটো দলিল মোতাবেক কথা বলা সুন্নাহ এবং এসবের অপব্যাখ্যা করা বিদাত ও মুনাফেকি।”
[দ্রষ্টব্য: ইবনু সুরাইজ কৃত জুযউন ফিহি আজবিবাতুন ফি উসুলিদ দিন, পৃষ্ঠা: ৮৬;
যাহাবি কৃত আল-উলু, পৃষ্ঠা: ২০৮; ইবনুল কাইয়্যিম বিরচিত ইজতিমাউল জুয়ুশিল
ইসলামিয়্যা, পৃষ্ঠা: ১৭৪; গৃহীত: শাইখ ফাইসাল আল-জাসিম কৃত আশায়িরা ফি মিযানি
আহলিস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা: ২৯৬; মাবাররাতুল খাইরিয়্যা (কুয়েত সিটি) কর্তৃক প্রকাশিত;
প্রকাশকাল: ১৪২৮ হি./২০০৭ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
ইমাম ইবনু
কুদামা আল-মাকদিসি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৬২০ হি.) বলেছেন, وأما الإجْماع فَإن الصَّحابَة أجمعُوا على ترك التَّأْوِيل بِما ذَكرْناهُ عَنْهُم وكَذَلِكَ أهل كل عصر بعدهمْ ولم ينْقل التَّأْوِيل إلّا عَن مُبْتَدع أو مَنسُوب إلى بِدعَة “আর সর্ববাদিসম্মত
অভিমতের ব্যাপারটি হলো, সাহাবিগণ শরিয়তের দলিলের প্রকাশ্য অর্থ থেকে ফিরিয়ে দিয়ে
ভিন্ন ব্যাখ্যা তথা তাবিল বর্জনের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন; আমরা তাঁদের নিকট
থেকে যা বর্ণনা করেছি তার কারণে। তদ্রুপ তাঁদের পরবর্তী সকল যুগের (হকপন্থি)
অধিবাসীগণ এমনটিই মনে করেছেন। কেবল বিদাতি কিংবা বিদাতের প্রতি সম্পৃক্ত লোক ছাড়া
অন্য কেউ তাবিল করেছেন বলে জানা যায়নি।” [ইবনু কুদামা বিরচিত যাম্মুত তাবিল,
পৃষ্ঠা: ৪০]
জ্ঞাতব্য
যে, আমরা দলিলবিহীন তাবিল তথা অপব্যাখ্যার বিরোধিতা করি। কিন্তু কুরআন, সুন্নাহ,
বা ইজমা থেকে প্রাপ্ত দলিলসাপেক্ষ তাবিল বা ভিন্নার্থের বিরোধিতা করি না। যেমন
ওজুর আয়াতে এসেছে, ‘তোমরা যখন নামাজে দাঁড়াবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ধৌত করবে...।’
[সুরা মায়িদা: ৬] এ আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ অনুযায়ী আমরা কেউ নামাজে দাঁড়ানোর পরে
ওজু শুরু করি না, বরং হাদিস থেকে প্রাপ্ত দলিলের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করি, ‘এর মানে,
তোমরা যখন নামাজ পড়ার ইচ্ছে করবে, তখন ওজু করে নাও।’ [বিস্তারিত দেখুন: ইমাম ইবনু
উসাইমিন কৃত শারহু ফাতহি রব্বিল বারিয়্যা বি তালখিসিল হামাবিয়্যা, পৃষ্ঠা: ৪৪৭;
ইবনু উসাইমিন কৃত আত-তালিক আলা মাওয়াদি মিন শারহিল আকিদাতিত তাহাবিয়্যা, পৃষ্ঠা:
৬৫-৬৭; ইবনু উসাইমিন কৃত শারহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৮৯-৯০]
·
চার. আবু
ত্বহা আদনান ভিন্ন আরেকটি বক্তব্যে বলেছে, “আর সেকুলাররা যে এডুকেশন সিস্টেমটা
দাঁড় করিয়ে রেখেছে, দিস ইজ ক্রিয়েটেড বাই দাজ্জাল! এই এডুকেশন সিস্টেমটা দাজ্জাল
নিজেই এই ফাংশন করেছে।” [দেখুন: https://youtu.be/IZQ5jWZXUXQ
(৫:১৫ মিনিট থেকে ৫:৩৩ মিনিট পর্যন্ত)]
পর্যালোচনা:
সেকুলারদের তৈরিকৃত এডুকেশন সিস্টেম দাজ্জালের তৈরি— এ কথা বলতে অবশ্যই দলিল
লাগবে। কারণ আমরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছি, দাজ্জাল ও কেয়ামতের
প্রকাশিতব্য আলামত সংক্রান্ত বিষয়গুলো গায়েবি জ্ঞানের অন্তর্গত। কুরআন-সুন্নাহর
বাইরে এসব নিয়ে একটি কথাও বলা বৈধ হবে না। কিন্তু আদনান সাহেবের এই কথার পক্ষে
কোনো শরয়ি দলিল নেই। এজন্য উক্ত কথা বিশ্বাস করা না-জায়েজ।
·
পাঁচ.
আদনান সাহেব আরেকটি বক্তব্যে বলেছে, “দাজ্জালের বাহিনীর সাথে মুসলিমদের ব্যাপক
ফাইট হবে। কিন্তু মুসলিমরা তাদের সাথে পেরে ওঠবে না। কেন পেরে ওঠবে না? কারণ
আল্লাহ পাক দাজ্জালকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। সে একটা পরীক্ষা, একটা ফিতনা।...
এজন্য মুসলিমরা তার সাথে পেরে উঠবে না। তাহলে কী হবে? আল্লাহ রব্বুল আলামিন তখন
মুসলিমদের দোয়া কবুল করবেন এবং ইসা আলাইহিস সালামকে আকাশ থেকে পাঠাবেন আবারও।”
[দেখুন: https://youtu.be/LaoZHhtGhbM
(৮:০৭ মিনিট থেকে ৯:২২ মিনিট)]
পর্যালোচনা:
দাজ্জালের বাহিনী ইহুদিদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ করার কথা হাদিসে এসেছে। [দেখুন:
সহিহ মুসলিম, হা: ২৯২২; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ:
১৮] কিন্তু এই যুদ্ধ হবে ইসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করার পরে। হাদিসের জগদ্বিখ্যাত
ব্যাখ্যাকারগণ এভাবে বুঝেছেন। কারণ আবু ত্বহা আদনানের বিবরণ হুবহু হাদিসে পাওয়া
যায় না। দাজ্জালের ফিতনার সময় ইসা আলাইহিস সালামের আগমনের পূর্বেই তার সাথে যুদ্ধ
করার কথা হাদিসে পাওয়া যায় না। বরং সহিহ মুসলিমের আরেকটি সুস্পষ্ট হাদিস অনুযায়ী
বোঝা যায়, ইসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করার পরে দাজ্জাল ও তার বাহিনীর সাথে মুসলিমগণ
যুদ্ধ করবে।
রসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, فَيَفْتَتِحُونَ قُسْطُنْطِينِيَّةَ فَبَيْنَمَا هُمْ يَقْتَسِمُونَ الْغَنَائِمَ قَدْ عَلَّقُوا سُيُوفَهُمْ بِالزَّيْتُونِ إِذْ صَاحَ فِيهِمُ الشَّيْطَانُ إِنَّ الْمَسِيحَ قَدْ خَلَفَكُمْ فِي أَهْلِيكُمْ . فَيَخْرُجُونَ وَذَلِكَ بَاطِلٌ فَإِذَا جَاءُوا الشَّأْمَ خَرَجَ فَبَيْنَمَا هُمْ يُعِدُّونَ لِلْقِتَالِ يُسَوُّونَ الصُّفُوفَ إِذْ أُقِيمَتِ الصَّلاَةُ فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ فَأَمَّهُمْ فَإِذَا رَآهُ عَدُوُّ اللَّهِ ذَابَ كَمَا يَذُوبُ الْمِلْحُ فِي الْمَاءِ فَلَوْ تَرَكَهُ لاَنْذَابَ حَتَّى يَهْلِكَ وَلَكِنْ يَقْتُلُهُ اللَّهُ بِيَدِهِ فَيُرِيهِمْ دَمَهُ فِي حَرْبَتِهِ “অবশেষে
মুসলিমরা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। তারা নিজেদের তরবারি জয়তুন বৃক্ষে লটকিয়ে
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগ করতে থাকবে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে শয়তান উচ্চৈঃস্বরে বলতে
থাকবে, ‘দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবারপরিজনের মধ্যে চলে এসেছে।’ এ কথা
শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বের হবে। অথচ এটা ছিল মিথ্যা সংবাদ। মুসলিমরা যখন
সিরিয়া পৌঁছবে, তখন দাজ্জালের আগমন ঘটবে। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ
করে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করবে। হঠাৎ নামাজের সময় হবে। তখন ইসা
আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন এবং নামাজে তাদের ইমামতি করবেন। আল্লাহর শত্রু
(দাজ্জাল) তাকে দেখামাত্রই বিচলিত হয়ে যাবে, যেমন লবণ পানিতে মিশে যায়। যদি ইসা
আলাইহিস সালাম তাকে এমনিই ছেড়ে দেন, তবুও সে নিজে নিজেই বিগলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে
যাবে। অবশ্য আল্লাহ ইসা আলাইহিস সালামের হাতে তাকে হত্যা করবেন এবং দাজ্জালের রক্ত
ইসা আলাইহিস সালামের বর্শাতে তিনি তাদেরকে দেখিয়ে দিবেন।” [সহিহ মুসলিম, হা:
২৮৯৭; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ৯]
হাফিয
ইবনু হাজার আল-আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮৫২ হি.) বলেছেন, فالمراد بقتال اليهود : وقوع ذلك إذا خرج الدجال ونزل عيسى “ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ বলতে উদ্দেশ্য হচ্ছে— এমন
যুদ্ধ, যা সংঘটিত হবে তখন, যখন দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে ও ইসা আলাইহিস সালাম অবতরণ
করবেন।” [ইবনু হাজার কৃত ফাতহুল বারি, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৬১০]
সহিহ
মুসলিমের ভাষ্যে ইমাম আসয়ুবি রাহিমাহুল্লাহও (মৃত: ১৪৪২ হি.) অনুরূপ কথা বলেছেন।
[আল-বাহরুল মুহিতুস সাজ্জাজ ফি শারহি সহিহিল ইমাম মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, খণ্ড: ৪৪;
পৃষ্ঠা: ৪৬২; দারু ইবনিল জাওযি (সৌদি আরব) কর্তৃক প্রকাশিত]
ইমাম
ইবনুল মুলাক্কিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮০৪ হি.) বলেছেন, المراد بقوله: «تقاتلون اليهود»: إذا نزل عيسى، فإن المسلمين معه واليهود مع الدجال “হাদিসের
কথা– ‘তোমরা ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ করবে’ – এর মানে এমন যুদ্ধ, যা সংঘটিত হবে তখন,
যখন ইসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন। তখন মুসলিমরা থাকবে তাঁর সাথে এবং ইহুদিরা
থাকবে দাজ্জালের সাথে।” [আত-তাওদিহ লি শারহিল জামিয়িস সহিহ, খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা:
৬৬৩; কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত]
·সুপথপ্রাপ্তির অভিলাষী
এক
গুনাহগার বান্দা—
Md
Abdullah Mridha.
·‘আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান : বিপথগামিতার নয়া-আহ্বায়ক’ বইয়ের ৩য় অধ্যায়ের ২য় পরিচ্ছেদ
0 Comments