নেতানিয়াহু মাস্ট গো (আফটার হামাস)
.
গত ৭ই অক্টোবর থেকে গাযায় শুরু হওয়া ইস্রা/ইলের অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে হামাসের অস্তিত্ব নির্মূল করা। আপাতত ধরে নেওয়া যায় যে, ইস্রা/ইলের সামরিক অভিযান সফল হবে। তবে, তাদের ১৪০০+ নিহত ও ২৪০ জন জিম্মি হওয়ার মাধ্যমে যে অভূতপূর্ব ক্ষত তারা ভোগ করেছে তা সারাতে শুধু হামাসের বিরুদ্ধে বিজয় পর্যাপ্ত হবে না। দেশটি স্বল্প সময়ের মধ্যে ওয়ার টেকনোলোজিতে অকল্পনীয় একটি দেশে পরিণত হতে চেষ্টা করবে।
.
তবে, নেতানিয়াহুকে কেউ আর বিশ্বাস করে না। এরিয়েল শ্যারন ও এহুদ ওলমার্ট সরকার গাজাকে অন্তর্ভুক্ত করে স্থায়ী শান্তি চুক্তি করতে ফিলিস্তিন অথরিটির সাথে কাজ করেছিলেন। কিন্তু বেপরোয়া নেতানিয়াহু দায়িত্ব গ্রহণ করেই গাজায় হামাসের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। অবশ্য, লিকুদের পার্টি অফিসে হামাসের ‘অকারণ’ বোমা হামলার বেনিফিসিয়ারি হিসেবেই অখ্যাত নেতানিয়াহু ক্ষমতায় এসেছিলেন।
.
প্যালেস্টাইন অথোরিটি দূর্নীতিগ্রস্ত ছিল, কিন্তু তার বিকল্প ছিল না। বিপরীতে, ব্রাদারহুড-ভিত্তিক দল হামাস’কে মধ্যপ্রাচ্যে অবিশ্বাসের চোখে দেখা হতো। নেতানিয়াহু এটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। হামাসের অবস্থানকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে তিনি মুসলিমদের বিভক্ত রাখার কৌশল গ্রহণ করেন। হামাসের অর্থায়নে তিনি কাতারকে বাধা দেননি এবং একমাত্র গিলাদ শালিতের বিনিময়ে তিনি ১০০০+ হামাস বন্দিকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
.
গত ১২ বছরে নেতানিয়াহু গাজা পুনর্বাসনের জন্য বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থাগুলির প্রচেষ্টাসমূহকে ব্যাহত করেছেন। কারণ, এ সকল উদ্যোগে প্যালেস্টাইন অথোরিটি জড়িত ছিল৷ তার নীতি হচ্ছে- যে কোনো মূল্যে পশ্চিম তীর ও গাযাকে ভৌগলিক ও মনস্তাত্বিকভাবে বিভক্ত রাখতে হবে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে দেওয়া যাবে না; আবার, স্বায়ত্বশাসন প্রত্যাহার করে মুসলিমদেরকে নাগরিকত্বও দেওয়া যাবে না।
.
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হলে ইস্রা/ইলের অস্তিত্ব স্পষ্টত হুমকির মুখে পড়বে। আবার, স্বায়ত্বশাসন প্রত্যাহার করে নাগরিকত্বও প্রদান করা হলে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী (প্রায় ৫৩ লক্ষ) ইস্রা/ইলে ডেমোগ্রাফিক ও রাজনৈতিক ছকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এতে রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র/বৈচিত্র বিনষ্ট হবে। উল্লেখ্য, ইস্রা/ইলের বর্তমান জনসংখ্যা ৯৮ লক্ষ, যার বড় অংশ বহির্বিশ্বে বসবাস করে।
.
২০০৯ সালে নেতানিয়াহু ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে ডাহাফ ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে- ৭৮% ইস্রা/ইলি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সমাধানে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু নেতানিয়াহু দেশবাসীকে প্রহসনের দিকে চালিত করেন। তিনি বড় বড় হুমকি দিয়ে ক্ষমতায় আসতেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে ক্ষমতার মেয়াদ পার করতেন। অপর দিকে, কয়েক বছর পরপর হামাস তাদের দেশে রকেট নিক্ষেপ করে।
.
নেতানিয়াহুর সীমাহীন দুর্নীতি এবং দেশটির বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস নিয়ে যথাক্রমে ২০২১ ও ২০২৩ দেশে বৃহৎ গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে। দুই বারই চরম মুহুর্তে হামাস রকেট হামলা করে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে এবং অভ্যুত্থানকে থামিয়ে দিয়েছে। বিষয়গুলো দেশে সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে। ফলে, এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু নিজ ও দলের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হামাসের উপর চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
.
তিনি অতীতে সব সময় কাতারের রাষ্ট্রদূতদের লক্ষ লক্ষ ডলার ভর্তি স্যুটকেস নিয়ে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। হামাস মাছের ট্রলারে করে অস্ত্র ও বিস্ফোরক এনেছে- তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনভাবেই অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক স্বার্থে হামাসকে টিকে থাকতে দিয়েছেন। তিনি সৌদি আরবের সাথে শান্তি চুক্তি করার উপর্যুপরি চেষ্টা করে ব্যার্থ হন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ উপেক্ষিত ছিল।
.
তিনি দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত ছিলেন। তার বহু বছরের চলমান ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়া এড়াতে তিনি বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি আল্ট্রা-রাইট পলিট ব্যুরোকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন, যারা তাকে ২০২২ সালে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল। এই জোট পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনা নাকচ করতে সচেষ্ট। এই দুই মিলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেয়।
.
ইহুদি সেটেলাররা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ক্রমবর্ধমানভাবে হয়রানি, ভয়ভীতি ও আতঙ্কিত করছিল; নেতানিয়াহু বিষয়টি অবজ্ঞা করে সেটলারদেরকে স্থিতি অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি বিচারিক সংশোধনের উপর ফোকাসের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন। তিনি জেনারেল মোশে ইয়ালোন ও জেনারেল আমোস মালকা এর মতো নিরাপত্তা সংস্থার অভিজ্ঞদের কঠোর সতর্কতা উপেক্ষা করেছিলেন।
.
এখন একটা ক্ষতি হয়েছে যে, ৭ অক্টোবরের অভূতপূর্ব আঘাতের পর দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বিষয়ে ইস্রা/ইলি জনগণের ধারণা পালটে যাবে। হামাসের হামলায় গানের অনুষ্ঠানে ও বাড়িতে হতাহতের (সত্য-মিথ্যা সম্বলিত) ও জিম্মিকরণের ফুটেজগুলো তাদের মনোভাব বদলে দিতে পারে। এই ক্ষত ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ তারা মনে রাখবে। তারা যে কোনো সমাধানের (অধিগ্রহণ বা দ্বি-রাষ্ট্রীয়) পূর্বে হামাসের অস্তিত্ব নির্মূল করতে চাইবে।
.
তবে, এটি কোনো সাধারণ অভিযানের মাধ্যমে সম্ভব হবে না। হামাস গোষ্ঠীর ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তারা স্কুল, হাসপাতাল ও শ্মরণার্থী শিবির-সহ মানব-ঘণ স্থানগুলিকে অস্ত্রাগার ও রকেট লঞ্চিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তাই, হামাসকে পতন ঘটানোর জন্য মরিয়া ইস্রা/ইলী সামরিক বাহিনীর জন্য এই অভিযান কঠিন। তদুপরি, গাযা সিটির টানেলগুলো তাদের জন্য বিভীষিকাময়। .
যাহোক, হামাসের হামলার কয়েকদিন পর, প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ ও জেনারেল গাদি আইজেনকোট সহ ইস্রা/ইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রাক্তন চিফ অফ স্টাফ-সহ বেশ কয়েকজন নেতা নেতানিয়াহুর সরকারে যোগ দিয়ে একটি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। তবে একটি আশঙ্কা রয়েছে যে, গাজায় তীব্র লড়াই লেবাননের সাথে ইস্রা/ইল সীমান্তে অতিরিক্ত ক্ষেত্রগুলিতে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
.
তাছাড়া, গাজায় অপরিমেয় বেসামরিক হত্যার ফলে মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি করছে, যা আরব প্রতিবেশীদের অস্থিতিশীল করে তুলছে। এটা ফিলিস্তিন সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হাজার হাজার মুসলিমকে রাস্তায় নিয়ে আসতে পারে। মার্কিন আধিপত্য-বিরোধী শক্তিগুলো এটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এবং আফগানের মতো করে অস্ত্রের যোগান উপস্থিত করতে পারে। এই শঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রও সর্বাধুনিক অস্ত্র মোতায়েন করছে।
.
এজন্য ইস্রা/ইলী মিলিটারি দ্রুততম সময়ে হামাসকে নির্মূল করতে চেষ্টা করবে। এটা নিশ্চিত হওয়ামাত্র অথর্ব মাহমুদ আব্বাসের সরকারকে সমগ্র ফিলিস্তিনের উপর দায়িত্ব গ্রহণের ব্যবস্থা করবে এবং গাজা-সহ ফিলিস্তিনের পুনঃগঠনে দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করবে। কিন্তু ইস্রা/ইলের পক্ষে ফিলিস্তিনিদের কোনো প্রকারের জাতীয় মর্যাদা প্রদান করা সম্ভব হবে না। আর, হামাস এখন যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ বিরতির রাস্তা খুঁজবে।
.
হামাসের পতন ঘটবে এবং গাজায় রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে। সেখানে ইস্রা/ইল নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে না। তারা আন্তর্জাতিক বাহিনী- মিশর, জর্দান ও সৌদি আরবের মতো প্রতিবেশী আরব দেশগুলির সহযোগিতায় একটি ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা চালু করতে পারে। তাদেরকে ১৯৭৩ সালের পর থেকে অধিকৃত কিছু ভূমি ছেড়ে দিতে হতে পারে। কিন্তু নেতানিয়াহু এই প্রক্রিয়ার কোনো অংশকে নির্দেশ দেওয়ার অবস্থান হারিয়েছেন।
.
তিনি কেবল তার শত্রুদেরই নয়, এখন তার বন্ধুদেরও আস্থা হারিয়েছেন। এমনকি তিনি ইস্রা/ইলি নিরাপত্তা বাহিনীর জেনারেলদের আস্থা হারিয়েছেন। গত ২৯ অক্টোবর রাতে তিনি একটি টুইটে হামাসের আক্রমণের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলির উপর দোষ চাপান। এতে চরম অনাস্থার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়; তিনি শীঘ্রই টুইটটি ডিলিট করেন এবং স্পষ্ট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু সামরিক কর্মকর্তাদের আস্থা ও মনোবল স্থায়ীভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
.
এখন ইস্রা/ইল এক জটিল সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের শত্রু হলো হামাস; কিন্তু তাদের হাতে মারা পড়ছে নিরস্ত্র জনগণ। প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্বের সামনেও ইস্রা/ইলে একটি যুক্তিসঙ্গত সরকারের প্রয়োজন হবে। নেতানিয়াহুর জোট হুমকিতে পড়েছে। তিনি ইস্রা/ইলকে আত্মবিশ্বাসের সাথে আর নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। দেশটির নিরাপত্তায় ও অর্থনীতিতে যে ধ্বংসলীলা সাধিত হয়েছে তার জন্য তাকে পদত্যাগ করতেই হবে।
.
যুক্তরাষ্ট্র দুটি বিমানবাহী রণতরীর ও একটি সাবমেরিনের পূর্ণাঙ্গ বহর এবং বিমানযোগে যুদ্ধাস্ত্র পাঠিয়ে এবং যুদ্ধাবস্থায় বাইডেন ও ব্লিংকেন সেদেশে সফর করে নিশ্চিত করেছেন যে, হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানে সফল হতেই হবে। এখন হামাসের অস্তিত্ব যদি অবশিষ্ট থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের (ও ইস্রা/ইলের) মর্যাদাহানি হবে। অপর দিকে, গণরোষের মুখে এবং আন্তর্জাতিক মহলে স্থিতির স্বার্থে নেতানিয়াহুকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে।
. Mohammad Salimullah
0 Comments