রক্তপিপাসু শী‘আ হুছী : বিপর্যস্ত ইয়ামান.......
মসজিদে নববীর মিম্বারে জিহাদের উপর অগ্নিঝরা বক্তব্য শুনলাম। একটু আশ্চর্য হলাম। সেদিন কে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তা স্মরণ করতে পারছি না। পরে শুনলাম ইয়ামানের সাথে সঊদী আরবের কিছু হচ্ছে। তারপরের সপ্তাহে জেদ্দাতে ছিলাম। সেখানকার এক মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করলাম। সেখানে খতীব সঊদী বাদশাহর ‘নছীহতে হারামাইন শরীফাইন’-এর হেফাযতক্রমে সাধারণ জনগণকে বাদশাহর সাথে থাকার উদাত্ত আহবান জানালেন এবং শী‘আ সম্প্রদায় সম্পর্কে হেকমতের সাথে পর্যালোচনামূলক মূল্যবান বক্তব্য রাখলেন। সেদিন পুরো সঊদী আরবে একই বিষয়ের উপর বক্তব্য হয়েছে। দেশের পার্লামেন্ট হচ্ছে মসজিদ। এমপি হচ্ছেন মসজিদের ইমাম। সংবিধান কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। সত্যিই রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। এরকম একটা শাসন ব্যবস্থা যদি পৃথিবীতে থাকত, তাহ’লে পৃথিবীবাসী শামিত্মর নিঃশ্বাস নিত। দুর্বলের বুকে কেউ লাথি মারতে পারত না। বিনা বিচারে কেউ বছরের পর বছর জেল খাটত না। ফিলিস্তিনীদের গায়ে আঘাত হানা ঐ হাত উদ্যত হওয়ার আগেই ভেঙ্গে যেত। কিন্তু হায়! সেদিন যে কত দূর! সেদিনের অপেক্ষার প্রহরই আমরা গুণছি প্রতিনিয়ত।
ইয়ামান সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর মন্তব্য :
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় ঈমান ইয়ামানে এবং হিকমাহ হচ্ছে ইয়ামানী’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহে, মিশকাত হা/৬২৫৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের শামে বরকত দিন এবং ইয়ামানে বরকত দিন’ (ছহীহ বুখারী হা/১০৩৭)। রাসূল (ছাঃ) আরো বলেছেন, ‘আমানতদারীতা হচ্ছে ইয়ামানে’ (তিরমিযী হা/৩৯৩৬; মিশকাত হা/৫৯৯৩; সনদ ছহীহ)।
ইয়ামানের পরিচয় :
ইয়ামান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ওমান ও সঊদী আরবের মধ্যখানে অবস্থিত। দেশটি লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরকে সংযোগকারী বাব-এল-মান্দের প্রণালীর মুখে অবস্থিত। লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পেরিম দ্বীপ এবং এডেন উপসাগরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপকে গণনায় ধরে ইয়ামানের মোট আয়তন ৫,২৭,৯৭০ বর্গকিলোমিটার। ইয়ামানের স্থল সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ১,৭৪৬ কিলোমিটার।
১৯৯০ সালে ইয়ামান আরব প্রজাতন্ত্র (উত্তর ইয়ামান) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়ামান (দক্ষিণ ইয়েমেন) দেশ দু’টিকে একত্রিত করে ইয়ামান প্রজাতন্ত্র গঠন করা হয়। ১৯৯০ সালের মে মাসের পূর্ব পর্যন্ত এদেশ দু’টি আলাদা রাষ্ট্র ‘উত্তর ইয়ামান’ এবং ‘দক্ষিণ ইয়ামান’ নামে বিভক্ত ছিল। উভয় দেশ একত্রিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উত্তর ইয়ামান গণপ্রজাতন্ত্রী এবং দক্ষিণ ইয়ামান কমিউনিস্ট শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য যে, খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে উত্তর ইয়ামানে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে।
হুছীর পরিচয় :
শী‘আদের ইছনা ‘আশারা ফের্কার একটি ফের্কা হল ‘জায়দিয়া’। তাদের একটি অংশ হচ্ছে ‘জারূদী’। হুছীরা এই জারূদী তথা জারূদ বিন যিয়াদ বিন মুনযির আল-কূফীর (মৃঃ ১৬০ হিঃ) দিকে নিজেদেরকে সম্বন্ধিত করে থাকে। জায়দিয়াদের সাথে তাদের মতদ্বন্দ্ব মূলতঃ শী‘আদের বিখ্যাত ইমামাতের মাসআলার ধরণ ও প্রকৃতি নিয়ে।
নাম : তাদের দল ‘আনছারুল্লাহ’ ও ‘শাবাব মুসলিম’ নামে পরিচিত। স্লোগান : আল্লাহু মহান! আমেরিকার জন্য মৃত্যু! ইসরাঈলের জন্য মৃত্যু! ইসলামের জন্য সাহায্য! প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৯৪ ইং। ২০০৪ সাল থেকে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতা : হোসাঈন আল-হুছী ।
যায়দী বনাম ইছনা আশারা :
শী‘আদের প্রধান দু’টি গ্রুপ হচ্ছে ইছনা আশারা ও যায়দী। ইমামাতের মাসাআলা নিয়ে তাদের মধ্যে ইখতিলাফ রয়েছে। ইছনা আশারা শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বার। শী‘আদের ইছনা আশারা গ্রুপ ১২ জন ইমামে বিশ্বাস করে। তন্মধ্যে ১১ জন ইতিমধ্যেই দুনিয়াতে এসেছেন। আরেক জন তথা ১২ তম ইমাম ‘সুররা মান রাআ’ পাহাড়ে লুকিয়ে রয়েছে। যখন সময় হবে তখন তিনি বের হবেন। এই ১২ তম ইমামই শী‘আদের ইমাম মাহদী। যখন এই ১২তম নেতা বের হবেন তখন আলী (রাঃ) মেঘের উপর থেকে তার আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দিবেন। ইরানের শী‘আরা এই ইছনা আশারা ফের্কার অমর্ত্মভুক্ত। তাদের আরেক নাম জা‘ফারি শী‘আ। ইছনা আশারা শী‘আরা ছাহাবীদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত বিদ্বেষ রাখে। বিশেষ করে আবুবকর, ওমর ও আয়েশা (রাঃ) তাদের চোখের বিষ।
উল্লেখ্য যে, শী‘আদের মোট তিনটা স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের শী‘আরা আলী (রাঃ)-কে প্রভু মনে করে। যেমন সিরিয়ার নুসাইরী শী‘আ বা বাশার আল-আসাদের সম্প্রদায়। এদেরকে বলা হয় ‘আলাবী শী‘আ। যারা আলী (রাঃ)-কে প্রভু মনে করে না, কিন্তু তাকেই একমাত্র হক্ব ইমাম মনে করে এবং আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট মনে করে বলে তাদেরকে রাফেযী বলা হয়। ইরানের ইছনা আশারা শী‘আরা এই পর্যায়ের অমর্ত্মভুক্ত। সর্বশেষ স্তর হচ্ছে যায়দী শী‘আ, তারা আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে পথভ্রষ্ট মনে করে না বা তাদের বিষয়ে বিদ্বেষও পোষণ করে না, কিন্তু তারা আলী (রাঃ)-কে তাঁদের তিনজনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অবশ্য মু‘তা বিবাহ, তাকিয়া বা ধোঁকা দেয়া ইত্যাদি মাসাআলাতে সবাই একমত।
যায়দী শী‘আদের সাথে ইছনা আশারা শী‘আদের মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে ইমামতের প্রশ্ন নিয়ে। যেখানে ইছনা আশারাগণ ১২ জন নেতায় বিশ্বাস করে, সেখানে যায়দীরা তা বিশ্বাস করে না। ইছনা আশারাগণ একজন ইমাম মাহদীর অপেক্ষায় আছে, কিন্তু যায়দীগণ এই ১২তম ইমাম ইমাম মাহদীতে বিশ্বাস করে না। এমনকি এজন্য অনেক ইছনা আশারা ফের্কার আলেম যায়দীদের কাফের বলে থাকে। যায়দীরা হুসাইন (রাঃ)-এর পৌত্র যায়েদ বিন আলীকে নিজেদের ইমাম মনে করে। যায়েদ বিন আলীর নামের দিকে নিসবাত করে তাদেরকে যায়দী বলা হয়। যায়েদ বিন আলী ১২২ হিজরীর দিকে উমাইয়া খলীফা হিশাম বিন আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। যারা সেই যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তার এই বিদ্রোহকে সমর্থন দেয় তারাই যায়দী নামে পরিচিত।
যায়দী বনাম হুছী-জারূদী :
হুছীগণ যায়দী শী‘আ হলেও তাদের মাঝে এবং সাধারণ যায়দীদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। মূলতঃ হুছীরা যায়দী শী‘আর একটা গ্রুপ, যারা জারূদীদের অন্তর্ভুক্ত। তারা নিজেদেরকে জারূদ বিন যিয়াদ বিন মুনযির আল-কূফীর (মৃ. ১৬০ হি.) দিকে নিজেদেরকে সম্বন্ধিত করে থাকে। এই জারূদ বিন যিয়াদ সম্পর্কে ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, সে মিথ্যুক, আল্লাহর শত্রু।[1] ইবনু হিববান (রহঃ) বলেন, সে রাফেযী শী‘আ। রাসূলের ছাহাবীদের দোষ-ত্রুটির বিষয়ে মিথ্যা হাদীছ তৈরী করত।[2] আল্লামা শহরাস্তানী ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থে জারূদীদের বিষয়ে বলেন, তারা তিন খলীফার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের ক্ষেত্রে এবং তাদেরকে গালি-গালাজ করার ক্ষেত্রে ইছনা আশারাদের মতই।[3] অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জারূদীগণ শী‘আদের একটা স্বাধীন ফের্কা। অবশ্য ইমামতের মাসাআলাতে তারা ইরানের ইছনা আশারা ফের্কার বিপরীতে যায়দী ফের্কার মতবাদে বিশ্বাসী।
হুছী-জারূদীদের আক্বীদা :
(এক) অবুবকর ও ওমর (রাঃ) পথভ্রষ্ট : হুছীদের অন্যতম আক্বীদা হচ্ছে আবুবকর ও ওমর (রাঃ) পথভ্রষ্ট। হুসাইন আল-হুছী বলেন, ‘নিশ্চয় আবুবকর ও ওমর ভুল করেছেন তারা নাফারমান ও পথভ্রষ্ট’। (নাউযুবিল্লাহ)।[4]
(দুই) আবুবকর (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়া ছিল চরম ভুল : হুছাইন আল-হুছী আবুবকর (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়ার বিষয়ে বলেন, ‘সাকিফায়ে বানি সা‘আদার সেই বায়‘আতের খারাপ আজো রয়েছে। আমরা মুসলিমরা আজও সেই ভ্রান্ত বায়‘আতের মাসুল দিচ্ছি’।[5]
(তিন) সবচেয়ে বড় অপরাধী ওমর (রাঃ) : হুসাইন আল-হুছী ওমর (রাঃ)-এর বিষয়ে বলেন, ‘মুসলিম উম্মাহর উপর আজ অবধি যত অত্যাচার ও নির্যাতন হয়েছে ও হচ্ছে, তার জন্য আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ) দায়ী। সবচেয়ে বেশী দায়ী ওমর (রাঃ)। কেননা রাসূলের মৃত্যুর পর থেকে আবুবকর (রাঃ)-এর আমলে যা কিছু হয়েছে তার সবকিছুর মূল কারিগর ও মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিল ওমর (রাঃ)’।[6]
সুধী পাঠক! ইরানের ইছনা আশারা এবং ইয়ামানের হুছীগণ মাযহাবগতভাবে হুবহু এক নয়। বরং তাদের মাঝে মাসাআলাগত ইখতিলাফ রয়েছে। এদিক থেকে ইয়ামানের যুদ্ধকে সম্পূর্ণ মাযহাবী রূপ দেয়া যায় না। অনেক বিস্লেষকদের মতে ইয়ামানের যুদ্ধ একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। যদিও মাযহাবী দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখেই এই রাজনৈতিক যুদ্ধটি পরিচালিত হচ্ছে যার প্রভাব অবশ্যই সুন্নী ও শী‘আ মাযহাবের উপর পড়বে। যেমনভাবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ মাযহাবগতভাবে ইরানের ইছনা আশারা ফের্কার অমর্ত্মভুক্ত না হলেও ইরান তাকে সর্মথন দিয়ে আসছে। তেমনিভাবে হুছীরা সর্ম্পূণরূপে তাদের মাযহাবী না হলেও ইরান তাদেরকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সিরিয়া এবং ইয়ামানের শী‘আরা ইছনা আশারা শী‘আ না হওয়ার পরেও ইরান তাদেরকে সহযোগিতা করে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই সহযোগিতার আড়ালে তারা নিজেদের ইছনা আশারা ফের্কার প্রচার ও প্রসার ইয়ামান ও সিরিয়ার মাটিতে করছে। পাশাপাশি সুন্নীদের বিরুদ্ধে সকল শী‘আদের একত্রিত করার মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাছিল করতে চাচ্ছে। তাইতো বলতে হয়, শী‘আদের মধ্যে যতই ইখতিলাফ থাক সুন্নীদের বিরোধিতায় তারা একাট্টা।
উত্থানের কারণ :
শায়খ মুক্ববিল বিন হাদী আল-ওয়াদেঈ আল-খাল্লালী ১৯৭৯ সালের দিকে ইয়ামানের ছা‘দা শহরের নিকটবর্তী দাম্মাজ নামক এলাকায় একটি সালাফী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই ছা‘দা শহরটি ছিল হুছী শী‘আদের ঘাঁটি। শায়খ মুক্ববিলের দাওয়াতে এক সময় সেখানে হাযার ছাত্রের সমাহার হয়। ‘দারুল হাদীছ দাম্মাজ’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে রূপলাভ করে। ছাত্ররা আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপকভাবে দাওয়াত প্রচার করত। তারা ছূফী শী‘আদের মূলোৎপাটনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। শায়খ মুক্ববিলের এই দাওয়াত থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাছিল করার জন্য আলী আব্দুল্লাহ ছালেহ সেখানকার শী‘আদের উৎখাত করার চিমত্মা করে। এমনিতেই শায়খ মুক্ববিলের দাওয়াতের জন্য তারা রাগান্বিত ছিল। সর্বোপরি সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা অস্ত্র সহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার আগে তারা তাদের সকল নষ্টের মূল হাযার হাযার ছাত্রের পদচারণায় মুখরিত ‘দারুল হাদীছ দাম্মাজ’-কে ধ্বংস করে দেয় এবং শিক্ষক ছাত্রদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। আল্লাহুল মুসতা‘আন। পরবর্তীতে তারা এই সংগ্রামকে সরাসরি সরকার বিরোধী সংগ্রাম হিসাবে পরিচালিত করে। এ সময় ইরান তার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে হুছীদের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করে। সঊদী আরব তার নিজস্ব ভূ-রাজনীতির কারণে ইয়ামানের সরকারকে হুছীদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করে এবং যুদ্ধের পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমান অবস্থা :
শী‘আ রাষ্ট্র ইরানের সহযোগিতা হুছীদেরকে দিন দিন প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলে। তারা ইরানের সহযোগিতা পেয়ে ধীরে ধীরে রাজধানী ছান‘আর দিকে অগ্রসর হ’তে থাকে। এক পর্যায়ে তারা ইয়ামানের সরকারকে উৎখাত করে। ইয়ামান সরকার তার আরব বন্ধুদের কাছে সহযোগিতার হাত পাতে। ফলতঃ আরব কান্ট্রিগুলো যরূরী ভিত্তিতে সঊদী আরবের নেতৃত্বে হুছীদের অস্ত্রাগার ও স্থাপনার উপর হামলা চালাতে থাকে। হুছীরাও জবাবে সঊদীর নাযরান সীমান্ত এলাকায় মর্টার হামলা চালাতে থাকে। অল্প দিনের ব্যবধানে সঊদী আরবের মাটিতে মসজিদ সহ বিভিন্ন জায়গায় আত্মঘাতী হামলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো হুছীদেরই কাজ। যদিও এই হামলাগুলোর অধিকাংশই হয়েছে শী‘আ অধ্যুষিত এলাকাতে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার রাজনীতি তো বর্তমান পৃথিবীর ইতিহাসে স্বীকৃত কথা।
ইরান বনাম আমেরিকা :
ইরানের পরিকল্পনা হল জেদ্দার উপর দিয়ে ইরাক-ইরানের মাঝে সংযোগ সড়ক নিয়ে যাবে। শী‘আদের আধ্যাত্মিক রাজধানী হবে বাগদাদ। এই জন্য তাদেরকে ইয়ামান হয়ে মক্কা-মদীনা-জেদ্দা দখলে নেয়া দরকার। কেননা ইরাক নিয়ে তাদের কোনও টেনশন নেই। তাদের শত্রু সুন্নী সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে আমেরিকা, যারা তাদের বাস্তব বন্ধু ও বাহ্যিকভাবে চরম শত্রু। অন্যদিকে ফিলিস্তিনও তাদের বাহ্যিক শত্রু, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরাঈলের দখলে আছে। লেবাননে আছে তাদের মদদপুষ্ট হিজবুল্লাহ। এখন শুধু দরকার সঊদী আরব। আর সঊদীকে তটস্থ রাখার জন্য বা দুর্বল করার জন্য তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত হচ্ছে ইয়ামানের জায়দী শী‘আ গোত্র হুছী। তাদেরকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে চায় ইরান।
সুধী পাঠক! সঊদী আরব এতদিন আমেরিকা নিয়ে অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কিন্তু ইয়ামানের এই সমস্যায় যথোপযুক্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় আমেরিকা সম্পর্কে সঊদী আরবের ধারণা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। তাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। আমেরিকা ইরানকে পারমাণবিক বোম তৈরী করতে দিবে না ইত্যাদি এগুলো সবই তার বাহ্যিক তর্জন-গর্জন মাত্র। বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টা। বরং প্রয়োজন পড়লে শুধু পারমাণবিক বোমা কেন, আমেরিকা ইরানের হাতে ইসরাঈলের মত অস্ত্র ভাণ্ডার তুলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আমেরিকা যদি ইরানের শত্রুই হবে, তাহ’লে এতদিন একবারও কেন ইরানে হামলা করল না? ড্রোন হামলা কী শুধু পাকিস্তানের জন্য খাছ। সন্ত্রাসী কী শুধু বিন লাদেন আর মোল্লা ওমর? হাসান নাছরুল্লাহ কী সন্ত্রাসী নয়? এক মালালার জন্য তাদের এত দরদ কেন? ঐ রকম হাযারো মালালা ফিলিস্তিনের প্রতিটি বাড়ীতে পাওয়া যাবে। কিন্তু আসল মালালাদের গুলি লাগলে তারা বেঁচে থাকে না, মারা যায়! তাদের একটাই অপরাধ তাদের যারা মারছে তারা যে ইহূদী, তারা যে খ্রীষ্টান। ইহূদী খ্রীষ্টান হলে সব মাফ। যদি তাদের জায়গায় একজন করে ইহূদী মালালা মারা যেত তাহ’লে যে কী হ’ত তা মানব চক্ষু কল্পনাও করতে পারে না। আর মুসলিমদের কথা কি বলব? টিভির পর্দায় ‘বাজরাঙ্গী ভাইজান’ দেখলে তাদের চোখ দিয়ে পানি পড়ে কিন্তু এই রকম হাযারো বাজরাঙ্গীর ঘটনা যে তাদের চারপাশে ঘটছে, তা তারা দেখেও না দেখার ভান করে। বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে পার্থক্য করার কমনসেন্সটুকু তাদের নেই। বাস্তব ঘটনার জন্য চোখের পানি ফেলার ফুরসত তো দূরে থাক, বাস্তব ঘটনা জানার আগ্রহও তাদের থাকে না। যতসব মানব দরদী ও মানবতা জেগে উঠে কাল্পনিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হায়রে হতভাগা মুসলিম!
পাকিস্তান সমাচার :
ইয়ামান হামলায় পাকিস্তান সঊদী আরবকে সহযোগিতা করছে কি-না এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখা-লেখি হয়েছে। সংবাদ বিস্লেষকরা এই নিয়ে কথা ও কলমের অনেক ফুল ঝুরি ঝরিয়েছেন।
১৯৬৭ সালের কথা। আরব-ইসরাঈল যুদ্ধ। ইসরাঈলে হামলা চালাবার জন্য সিরিয়ার আকাশে একটি বোমারু বিমান উড়ছে। ইসরাঈলের সীমান্ত থেকে বিমানটিকে ভূপাতিত করার জন্য সকল রকমের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বিমান চালক এত দক্ষতার সাথে বিমান চালাচ্ছে যে, তাদের সকল নিশানা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে ইসরাঈলের সকলেই নিশ্চিতভাবে ধারণা করল যে, এই বিমানের পাইলট কোনও আরব নয় বরং অবশ্যই পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সদস্য।
এই যুদ্ধের প্রায় ২৫ বছর পর অনানুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান স্বীকার করে যে, তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরাই সে সময় ইসরাঈলের বিরুদ্ধে আরব বন্ধুদের সাথে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সকল বিবৃতি স্পষ্ট করছিল এই যুদ্ধের সাথে পাকিস্তান বিন্দুমাত্র শরীক নেই।
সুতরাং আজকেও বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে পাকিস্তানের বিবৃতি সব সময় হবে তারা ইয়ামানের সাথে যুদ্ধে কোনও পক্ষের সাথেই নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সঊদী আরবকে সহযোগিতা না করার কথা পাকিস্তান কল্পনাও করতে পারে না। আর যদি করে থাকে তাহ’লে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত। নওয়াজ শরীফ তো সঊদী বাদশাহদের ঘরের লোক। পাকিস্তানের পারমাণবিক বোম বানানোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করেছে সঊদী আরব।
বাদশাহ সালমান ও তার ছেলে মুহাম্মাদ :
ইয়ামান ও সঊদী আরবের ঘটনায় সবচেয়ে আলোচিত নাম হচ্ছে বাদশাহ সালমান ও তার ছেলে মুহাম্মাদ। ক্ষমতায় এসেই সকল সরকারী কর্মচারীদের দুই মাসের বেতনের সমান টাকা তার পক্ষ থেকে হাদিয়া হিসাবে দেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ইসলামের আইন-কানূন রক্ষার অন্যতম মাধ্যম ‘আল-আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার’ সংস্থার প্রধান করেন। ফলে বহুদিন থেকে ধীরে ধীরে দুর্বল হ’তে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হালে পানি পায়। বারাক ওবামাকে বিমান বন্দরে ছেড়ে ছালাত আদায় করতে গিয়ে ক্ষমতার প্রথমদিকেই ভাল হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী উত্তরসূরী নির্বাচনেও তিনি আগের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে নিজের ছেলেকে স্থলাভিষিক্ত করেন। অবশ্য মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে যে, তার ভাই নিজে থেকেই ইস্তফা দিয়েছেন।
তার সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে হুছীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সাথে সাথেই লাইম লাইটে আসেন তার ছেলে। ধারণা করা হয় তার ছেলের পরামর্শেই তিনি এই রিস্কি ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি প্রথম অভিযানে তার ছেলে মুহাম্মাদ স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। বিস্লেষকদের ধারণা মতে যদি সঊদী আবর এই হামলাতে সফল হয়, তাহ’লে বাদশাহ সালমানের ছেলে মুহাম্মাদের ভবিষ্যৎ ক্ষমতা আরো শক্তিশালী হবে। আর যদি এই হামলা সঊদীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তাহ’লে বাদশাহ সালমানের ছেলে মুহাম্মাদের রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। তবে তিনি অল্প সময়ে সঊদী তরুণদের মাঝে ভালই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাকে সঊদী আরবের অনেক ভুল-ত্রুটির চুলচেরা বিস্লেষণ করতে দেখেছি। বিশেষ করে আরব বসন্তের সময়ের লেখালেখি এবং মিসর, সিরিয়া ও লিবিয়ার ঘটনাবলির বাস্তবতাতে মনে হচ্ছিল হোসনী মোবারককে যেমন অধিকাংশ মিসরী পসন্দ করে না, মু‘আম্মার আল-গাদ্দাফীকে যেমন অধিকাংশ লিবিয়ান পসন্দ করে না। ঠিক তেমনি মনে হয় সঊদী বাদশাহকে তার দেশের কেউ পসন্দ করে না। তাইতো তাদের দেশেও বসন্তের বিপস্নবের হাওয়া লাগার সম্ভাবনা খুব জোরেশোরেই গুঞ্জন তুলেছিল মিডিয়াগুলো। কিন্তু সঊদে আরবে পদার্পণের পর সংক্ষেপ্ত সময়ের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে যে, দেশের প্রায় ৮০% লোক তাদের বাদশাহকে এবং বাদশাহর পরিবারকে মন থেকে সম্মান করে এবং ভালবাসে। মিডিয়া যে মানুষের মাথায় কত রকম মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা ও কল্পনাপ্রসূত বিষয় পেশ করে, সেটাকে অসিত্মত্বহীন অবস্থা থেকে বাস্তবে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, তা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হ’তে হয়।
পরিশেষে বলা যায়, সঊদী আরবের এখন চোখ খুলার সময় এসেছে। দেরীতে হলেও সঊদী আরবের এখন বোধদয়ের সময় এসেছে। ইসলামের স্বার্থে সঊদী আরবের উচিত আরো দূরদর্শী হওয়া। ইরান যেমন শী‘আ গ্রুপগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তেমনি সঊদী আরবের উচিত বিভিন্ন দেশের সুন্নী গ্রুপগুলোকে নির্দ্বিধায় সহযোগিতা করা। সুন্নী গ্রুপগুলোর মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখা। অলসতা আর বিলাসিতা অনেক হয়েছে। এখন মক্কা-মদীনাবাসীর গর্জে উঠার দিন। এখন একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তার খেসারত দিতে হবে বহুদিন। আল্লাহর কাছে দো‘আ করছি, হে আল্লাহ! আপনি মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন-আমীন!!
লেখক: আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব
[1] ইবনু আদী, আল কামিল ফিয যুয়াফা, ৩/১৮৯ পৃঃ।
[2] ইবনু হিববান, আল মাজরম্নহীন, ১/১৯৭ পৃঃ।
[3] আলস্নামা শহরাসত্মানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরম্নত : দারম্নল মা‘আরিফ, ১৪০৪ হি.) ১/১৫৩ পৃঃ।
[4] হুসাইন আল হুছী, দুরম্নসুম মিন হাদইল কুরআন, পৃঃ ২৩।
[5] মাসউলিইয়্যাতু আহলিল বায়ত, পৃঃ ১১।
[6] দুরম্নসুম মিন হাদইল কুরআন, সূরা মায়িদার দারস দ্রষ্টব্য।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় ঈমান ইয়ামানে এবং হিকমাহ হচ্ছে ইয়ামানী’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহে, মিশকাত হা/৬২৫৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের শামে বরকত দিন এবং ইয়ামানে বরকত দিন’ (ছহীহ বুখারী হা/১০৩৭)। রাসূল (ছাঃ) আরো বলেছেন, ‘আমানতদারীতা হচ্ছে ইয়ামানে’ (তিরমিযী হা/৩৯৩৬; মিশকাত হা/৫৯৯৩; সনদ ছহীহ)।
ইয়ামানের পরিচয় :
ইয়ামান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ওমান ও সঊদী আরবের মধ্যখানে অবস্থিত। দেশটি লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরকে সংযোগকারী বাব-এল-মান্দের প্রণালীর মুখে অবস্থিত। লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পেরিম দ্বীপ এবং এডেন উপসাগরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপকে গণনায় ধরে ইয়ামানের মোট আয়তন ৫,২৭,৯৭০ বর্গকিলোমিটার। ইয়ামানের স্থল সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ১,৭৪৬ কিলোমিটার।
১৯৯০ সালে ইয়ামান আরব প্রজাতন্ত্র (উত্তর ইয়ামান) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়ামান (দক্ষিণ ইয়েমেন) দেশ দু’টিকে একত্রিত করে ইয়ামান প্রজাতন্ত্র গঠন করা হয়। ১৯৯০ সালের মে মাসের পূর্ব পর্যন্ত এদেশ দু’টি আলাদা রাষ্ট্র ‘উত্তর ইয়ামান’ এবং ‘দক্ষিণ ইয়ামান’ নামে বিভক্ত ছিল। উভয় দেশ একত্রিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উত্তর ইয়ামান গণপ্রজাতন্ত্রী এবং দক্ষিণ ইয়ামান কমিউনিস্ট শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য যে, খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে উত্তর ইয়ামানে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে।
হুছীর পরিচয় :
শী‘আদের ইছনা ‘আশারা ফের্কার একটি ফের্কা হল ‘জায়দিয়া’। তাদের একটি অংশ হচ্ছে ‘জারূদী’। হুছীরা এই জারূদী তথা জারূদ বিন যিয়াদ বিন মুনযির আল-কূফীর (মৃঃ ১৬০ হিঃ) দিকে নিজেদেরকে সম্বন্ধিত করে থাকে। জায়দিয়াদের সাথে তাদের মতদ্বন্দ্ব মূলতঃ শী‘আদের বিখ্যাত ইমামাতের মাসআলার ধরণ ও প্রকৃতি নিয়ে।
নাম : তাদের দল ‘আনছারুল্লাহ’ ও ‘শাবাব মুসলিম’ নামে পরিচিত। স্লোগান : আল্লাহু মহান! আমেরিকার জন্য মৃত্যু! ইসরাঈলের জন্য মৃত্যু! ইসলামের জন্য সাহায্য! প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৯৪ ইং। ২০০৪ সাল থেকে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতা : হোসাঈন আল-হুছী ।
যায়দী বনাম ইছনা আশারা :
শী‘আদের প্রধান দু’টি গ্রুপ হচ্ছে ইছনা আশারা ও যায়দী। ইমামাতের মাসাআলা নিয়ে তাদের মধ্যে ইখতিলাফ রয়েছে। ইছনা আশারা শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বার। শী‘আদের ইছনা আশারা গ্রুপ ১২ জন ইমামে বিশ্বাস করে। তন্মধ্যে ১১ জন ইতিমধ্যেই দুনিয়াতে এসেছেন। আরেক জন তথা ১২ তম ইমাম ‘সুররা মান রাআ’ পাহাড়ে লুকিয়ে রয়েছে। যখন সময় হবে তখন তিনি বের হবেন। এই ১২ তম ইমামই শী‘আদের ইমাম মাহদী। যখন এই ১২তম নেতা বের হবেন তখন আলী (রাঃ) মেঘের উপর থেকে তার আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দিবেন। ইরানের শী‘আরা এই ইছনা আশারা ফের্কার অমর্ত্মভুক্ত। তাদের আরেক নাম জা‘ফারি শী‘আ। ইছনা আশারা শী‘আরা ছাহাবীদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত বিদ্বেষ রাখে। বিশেষ করে আবুবকর, ওমর ও আয়েশা (রাঃ) তাদের চোখের বিষ।
উল্লেখ্য যে, শী‘আদের মোট তিনটা স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের শী‘আরা আলী (রাঃ)-কে প্রভু মনে করে। যেমন সিরিয়ার নুসাইরী শী‘আ বা বাশার আল-আসাদের সম্প্রদায়। এদেরকে বলা হয় ‘আলাবী শী‘আ। যারা আলী (রাঃ)-কে প্রভু মনে করে না, কিন্তু তাকেই একমাত্র হক্ব ইমাম মনে করে এবং আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট মনে করে বলে তাদেরকে রাফেযী বলা হয়। ইরানের ইছনা আশারা শী‘আরা এই পর্যায়ের অমর্ত্মভুক্ত। সর্বশেষ স্তর হচ্ছে যায়দী শী‘আ, তারা আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে পথভ্রষ্ট মনে করে না বা তাদের বিষয়ে বিদ্বেষও পোষণ করে না, কিন্তু তারা আলী (রাঃ)-কে তাঁদের তিনজনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অবশ্য মু‘তা বিবাহ, তাকিয়া বা ধোঁকা দেয়া ইত্যাদি মাসাআলাতে সবাই একমত।
যায়দী শী‘আদের সাথে ইছনা আশারা শী‘আদের মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে ইমামতের প্রশ্ন নিয়ে। যেখানে ইছনা আশারাগণ ১২ জন নেতায় বিশ্বাস করে, সেখানে যায়দীরা তা বিশ্বাস করে না। ইছনা আশারাগণ একজন ইমাম মাহদীর অপেক্ষায় আছে, কিন্তু যায়দীগণ এই ১২তম ইমাম ইমাম মাহদীতে বিশ্বাস করে না। এমনকি এজন্য অনেক ইছনা আশারা ফের্কার আলেম যায়দীদের কাফের বলে থাকে। যায়দীরা হুসাইন (রাঃ)-এর পৌত্র যায়েদ বিন আলীকে নিজেদের ইমাম মনে করে। যায়েদ বিন আলীর নামের দিকে নিসবাত করে তাদেরকে যায়দী বলা হয়। যায়েদ বিন আলী ১২২ হিজরীর দিকে উমাইয়া খলীফা হিশাম বিন আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। যারা সেই যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তার এই বিদ্রোহকে সমর্থন দেয় তারাই যায়দী নামে পরিচিত।
যায়দী বনাম হুছী-জারূদী :
হুছীগণ যায়দী শী‘আ হলেও তাদের মাঝে এবং সাধারণ যায়দীদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। মূলতঃ হুছীরা যায়দী শী‘আর একটা গ্রুপ, যারা জারূদীদের অন্তর্ভুক্ত। তারা নিজেদেরকে জারূদ বিন যিয়াদ বিন মুনযির আল-কূফীর (মৃ. ১৬০ হি.) দিকে নিজেদেরকে সম্বন্ধিত করে থাকে। এই জারূদ বিন যিয়াদ সম্পর্কে ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, সে মিথ্যুক, আল্লাহর শত্রু।[1] ইবনু হিববান (রহঃ) বলেন, সে রাফেযী শী‘আ। রাসূলের ছাহাবীদের দোষ-ত্রুটির বিষয়ে মিথ্যা হাদীছ তৈরী করত।[2] আল্লামা শহরাস্তানী ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থে জারূদীদের বিষয়ে বলেন, তারা তিন খলীফার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের ক্ষেত্রে এবং তাদেরকে গালি-গালাজ করার ক্ষেত্রে ইছনা আশারাদের মতই।[3] অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জারূদীগণ শী‘আদের একটা স্বাধীন ফের্কা। অবশ্য ইমামতের মাসাআলাতে তারা ইরানের ইছনা আশারা ফের্কার বিপরীতে যায়দী ফের্কার মতবাদে বিশ্বাসী।
হুছী-জারূদীদের আক্বীদা :
(এক) অবুবকর ও ওমর (রাঃ) পথভ্রষ্ট : হুছীদের অন্যতম আক্বীদা হচ্ছে আবুবকর ও ওমর (রাঃ) পথভ্রষ্ট। হুসাইন আল-হুছী বলেন, ‘নিশ্চয় আবুবকর ও ওমর ভুল করেছেন তারা নাফারমান ও পথভ্রষ্ট’। (নাউযুবিল্লাহ)।[4]
(দুই) আবুবকর (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়া ছিল চরম ভুল : হুছাইন আল-হুছী আবুবকর (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়ার বিষয়ে বলেন, ‘সাকিফায়ে বানি সা‘আদার সেই বায়‘আতের খারাপ আজো রয়েছে। আমরা মুসলিমরা আজও সেই ভ্রান্ত বায়‘আতের মাসুল দিচ্ছি’।[5]
(তিন) সবচেয়ে বড় অপরাধী ওমর (রাঃ) : হুসাইন আল-হুছী ওমর (রাঃ)-এর বিষয়ে বলেন, ‘মুসলিম উম্মাহর উপর আজ অবধি যত অত্যাচার ও নির্যাতন হয়েছে ও হচ্ছে, তার জন্য আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ) দায়ী। সবচেয়ে বেশী দায়ী ওমর (রাঃ)। কেননা রাসূলের মৃত্যুর পর থেকে আবুবকর (রাঃ)-এর আমলে যা কিছু হয়েছে তার সবকিছুর মূল কারিগর ও মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিল ওমর (রাঃ)’।[6]
সুধী পাঠক! ইরানের ইছনা আশারা এবং ইয়ামানের হুছীগণ মাযহাবগতভাবে হুবহু এক নয়। বরং তাদের মাঝে মাসাআলাগত ইখতিলাফ রয়েছে। এদিক থেকে ইয়ামানের যুদ্ধকে সম্পূর্ণ মাযহাবী রূপ দেয়া যায় না। অনেক বিস্লেষকদের মতে ইয়ামানের যুদ্ধ একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। যদিও মাযহাবী দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখেই এই রাজনৈতিক যুদ্ধটি পরিচালিত হচ্ছে যার প্রভাব অবশ্যই সুন্নী ও শী‘আ মাযহাবের উপর পড়বে। যেমনভাবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ মাযহাবগতভাবে ইরানের ইছনা আশারা ফের্কার অমর্ত্মভুক্ত না হলেও ইরান তাকে সর্মথন দিয়ে আসছে। তেমনিভাবে হুছীরা সর্ম্পূণরূপে তাদের মাযহাবী না হলেও ইরান তাদেরকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সিরিয়া এবং ইয়ামানের শী‘আরা ইছনা আশারা শী‘আ না হওয়ার পরেও ইরান তাদেরকে সহযোগিতা করে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই সহযোগিতার আড়ালে তারা নিজেদের ইছনা আশারা ফের্কার প্রচার ও প্রসার ইয়ামান ও সিরিয়ার মাটিতে করছে। পাশাপাশি সুন্নীদের বিরুদ্ধে সকল শী‘আদের একত্রিত করার মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাছিল করতে চাচ্ছে। তাইতো বলতে হয়, শী‘আদের মধ্যে যতই ইখতিলাফ থাক সুন্নীদের বিরোধিতায় তারা একাট্টা।
উত্থানের কারণ :
শায়খ মুক্ববিল বিন হাদী আল-ওয়াদেঈ আল-খাল্লালী ১৯৭৯ সালের দিকে ইয়ামানের ছা‘দা শহরের নিকটবর্তী দাম্মাজ নামক এলাকায় একটি সালাফী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই ছা‘দা শহরটি ছিল হুছী শী‘আদের ঘাঁটি। শায়খ মুক্ববিলের দাওয়াতে এক সময় সেখানে হাযার ছাত্রের সমাহার হয়। ‘দারুল হাদীছ দাম্মাজ’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে রূপলাভ করে। ছাত্ররা আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপকভাবে দাওয়াত প্রচার করত। তারা ছূফী শী‘আদের মূলোৎপাটনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। শায়খ মুক্ববিলের এই দাওয়াত থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাছিল করার জন্য আলী আব্দুল্লাহ ছালেহ সেখানকার শী‘আদের উৎখাত করার চিমত্মা করে। এমনিতেই শায়খ মুক্ববিলের দাওয়াতের জন্য তারা রাগান্বিত ছিল। সর্বোপরি সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা অস্ত্র সহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার আগে তারা তাদের সকল নষ্টের মূল হাযার হাযার ছাত্রের পদচারণায় মুখরিত ‘দারুল হাদীছ দাম্মাজ’-কে ধ্বংস করে দেয় এবং শিক্ষক ছাত্রদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। আল্লাহুল মুসতা‘আন। পরবর্তীতে তারা এই সংগ্রামকে সরাসরি সরকার বিরোধী সংগ্রাম হিসাবে পরিচালিত করে। এ সময় ইরান তার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে হুছীদের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করে। সঊদী আরব তার নিজস্ব ভূ-রাজনীতির কারণে ইয়ামানের সরকারকে হুছীদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করে এবং যুদ্ধের পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমান অবস্থা :
শী‘আ রাষ্ট্র ইরানের সহযোগিতা হুছীদেরকে দিন দিন প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলে। তারা ইরানের সহযোগিতা পেয়ে ধীরে ধীরে রাজধানী ছান‘আর দিকে অগ্রসর হ’তে থাকে। এক পর্যায়ে তারা ইয়ামানের সরকারকে উৎখাত করে। ইয়ামান সরকার তার আরব বন্ধুদের কাছে সহযোগিতার হাত পাতে। ফলতঃ আরব কান্ট্রিগুলো যরূরী ভিত্তিতে সঊদী আরবের নেতৃত্বে হুছীদের অস্ত্রাগার ও স্থাপনার উপর হামলা চালাতে থাকে। হুছীরাও জবাবে সঊদীর নাযরান সীমান্ত এলাকায় মর্টার হামলা চালাতে থাকে। অল্প দিনের ব্যবধানে সঊদী আরবের মাটিতে মসজিদ সহ বিভিন্ন জায়গায় আত্মঘাতী হামলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো হুছীদেরই কাজ। যদিও এই হামলাগুলোর অধিকাংশই হয়েছে শী‘আ অধ্যুষিত এলাকাতে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার রাজনীতি তো বর্তমান পৃথিবীর ইতিহাসে স্বীকৃত কথা।
ইরান বনাম আমেরিকা :
ইরানের পরিকল্পনা হল জেদ্দার উপর দিয়ে ইরাক-ইরানের মাঝে সংযোগ সড়ক নিয়ে যাবে। শী‘আদের আধ্যাত্মিক রাজধানী হবে বাগদাদ। এই জন্য তাদেরকে ইয়ামান হয়ে মক্কা-মদীনা-জেদ্দা দখলে নেয়া দরকার। কেননা ইরাক নিয়ে তাদের কোনও টেনশন নেই। তাদের শত্রু সুন্নী সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে আমেরিকা, যারা তাদের বাস্তব বন্ধু ও বাহ্যিকভাবে চরম শত্রু। অন্যদিকে ফিলিস্তিনও তাদের বাহ্যিক শত্রু, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরাঈলের দখলে আছে। লেবাননে আছে তাদের মদদপুষ্ট হিজবুল্লাহ। এখন শুধু দরকার সঊদী আরব। আর সঊদীকে তটস্থ রাখার জন্য বা দুর্বল করার জন্য তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত হচ্ছে ইয়ামানের জায়দী শী‘আ গোত্র হুছী। তাদেরকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে চায় ইরান।
সুধী পাঠক! সঊদী আরব এতদিন আমেরিকা নিয়ে অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কিন্তু ইয়ামানের এই সমস্যায় যথোপযুক্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় আমেরিকা সম্পর্কে সঊদী আরবের ধারণা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। তাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। আমেরিকা ইরানকে পারমাণবিক বোম তৈরী করতে দিবে না ইত্যাদি এগুলো সবই তার বাহ্যিক তর্জন-গর্জন মাত্র। বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টা। বরং প্রয়োজন পড়লে শুধু পারমাণবিক বোমা কেন, আমেরিকা ইরানের হাতে ইসরাঈলের মত অস্ত্র ভাণ্ডার তুলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আমেরিকা যদি ইরানের শত্রুই হবে, তাহ’লে এতদিন একবারও কেন ইরানে হামলা করল না? ড্রোন হামলা কী শুধু পাকিস্তানের জন্য খাছ। সন্ত্রাসী কী শুধু বিন লাদেন আর মোল্লা ওমর? হাসান নাছরুল্লাহ কী সন্ত্রাসী নয়? এক মালালার জন্য তাদের এত দরদ কেন? ঐ রকম হাযারো মালালা ফিলিস্তিনের প্রতিটি বাড়ীতে পাওয়া যাবে। কিন্তু আসল মালালাদের গুলি লাগলে তারা বেঁচে থাকে না, মারা যায়! তাদের একটাই অপরাধ তাদের যারা মারছে তারা যে ইহূদী, তারা যে খ্রীষ্টান। ইহূদী খ্রীষ্টান হলে সব মাফ। যদি তাদের জায়গায় একজন করে ইহূদী মালালা মারা যেত তাহ’লে যে কী হ’ত তা মানব চক্ষু কল্পনাও করতে পারে না। আর মুসলিমদের কথা কি বলব? টিভির পর্দায় ‘বাজরাঙ্গী ভাইজান’ দেখলে তাদের চোখ দিয়ে পানি পড়ে কিন্তু এই রকম হাযারো বাজরাঙ্গীর ঘটনা যে তাদের চারপাশে ঘটছে, তা তারা দেখেও না দেখার ভান করে। বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে পার্থক্য করার কমনসেন্সটুকু তাদের নেই। বাস্তব ঘটনার জন্য চোখের পানি ফেলার ফুরসত তো দূরে থাক, বাস্তব ঘটনা জানার আগ্রহও তাদের থাকে না। যতসব মানব দরদী ও মানবতা জেগে উঠে কাল্পনিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হায়রে হতভাগা মুসলিম!
পাকিস্তান সমাচার :
ইয়ামান হামলায় পাকিস্তান সঊদী আরবকে সহযোগিতা করছে কি-না এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখা-লেখি হয়েছে। সংবাদ বিস্লেষকরা এই নিয়ে কথা ও কলমের অনেক ফুল ঝুরি ঝরিয়েছেন।
১৯৬৭ সালের কথা। আরব-ইসরাঈল যুদ্ধ। ইসরাঈলে হামলা চালাবার জন্য সিরিয়ার আকাশে একটি বোমারু বিমান উড়ছে। ইসরাঈলের সীমান্ত থেকে বিমানটিকে ভূপাতিত করার জন্য সকল রকমের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বিমান চালক এত দক্ষতার সাথে বিমান চালাচ্ছে যে, তাদের সকল নিশানা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে ইসরাঈলের সকলেই নিশ্চিতভাবে ধারণা করল যে, এই বিমানের পাইলট কোনও আরব নয় বরং অবশ্যই পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সদস্য।
এই যুদ্ধের প্রায় ২৫ বছর পর অনানুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান স্বীকার করে যে, তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরাই সে সময় ইসরাঈলের বিরুদ্ধে আরব বন্ধুদের সাথে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সকল বিবৃতি স্পষ্ট করছিল এই যুদ্ধের সাথে পাকিস্তান বিন্দুমাত্র শরীক নেই।
সুতরাং আজকেও বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে পাকিস্তানের বিবৃতি সব সময় হবে তারা ইয়ামানের সাথে যুদ্ধে কোনও পক্ষের সাথেই নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সঊদী আরবকে সহযোগিতা না করার কথা পাকিস্তান কল্পনাও করতে পারে না। আর যদি করে থাকে তাহ’লে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত। নওয়াজ শরীফ তো সঊদী বাদশাহদের ঘরের লোক। পাকিস্তানের পারমাণবিক বোম বানানোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করেছে সঊদী আরব।
বাদশাহ সালমান ও তার ছেলে মুহাম্মাদ :
ইয়ামান ও সঊদী আরবের ঘটনায় সবচেয়ে আলোচিত নাম হচ্ছে বাদশাহ সালমান ও তার ছেলে মুহাম্মাদ। ক্ষমতায় এসেই সকল সরকারী কর্মচারীদের দুই মাসের বেতনের সমান টাকা তার পক্ষ থেকে হাদিয়া হিসাবে দেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ইসলামের আইন-কানূন রক্ষার অন্যতম মাধ্যম ‘আল-আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার’ সংস্থার প্রধান করেন। ফলে বহুদিন থেকে ধীরে ধীরে দুর্বল হ’তে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হালে পানি পায়। বারাক ওবামাকে বিমান বন্দরে ছেড়ে ছালাত আদায় করতে গিয়ে ক্ষমতার প্রথমদিকেই ভাল হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী উত্তরসূরী নির্বাচনেও তিনি আগের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে নিজের ছেলেকে স্থলাভিষিক্ত করেন। অবশ্য মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে যে, তার ভাই নিজে থেকেই ইস্তফা দিয়েছেন।
তার সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে হুছীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সাথে সাথেই লাইম লাইটে আসেন তার ছেলে। ধারণা করা হয় তার ছেলের পরামর্শেই তিনি এই রিস্কি ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি প্রথম অভিযানে তার ছেলে মুহাম্মাদ স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। বিস্লেষকদের ধারণা মতে যদি সঊদী আবর এই হামলাতে সফল হয়, তাহ’লে বাদশাহ সালমানের ছেলে মুহাম্মাদের ভবিষ্যৎ ক্ষমতা আরো শক্তিশালী হবে। আর যদি এই হামলা সঊদীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তাহ’লে বাদশাহ সালমানের ছেলে মুহাম্মাদের রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। তবে তিনি অল্প সময়ে সঊদী তরুণদের মাঝে ভালই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাকে সঊদী আরবের অনেক ভুল-ত্রুটির চুলচেরা বিস্লেষণ করতে দেখেছি। বিশেষ করে আরব বসন্তের সময়ের লেখালেখি এবং মিসর, সিরিয়া ও লিবিয়ার ঘটনাবলির বাস্তবতাতে মনে হচ্ছিল হোসনী মোবারককে যেমন অধিকাংশ মিসরী পসন্দ করে না, মু‘আম্মার আল-গাদ্দাফীকে যেমন অধিকাংশ লিবিয়ান পসন্দ করে না। ঠিক তেমনি মনে হয় সঊদী বাদশাহকে তার দেশের কেউ পসন্দ করে না। তাইতো তাদের দেশেও বসন্তের বিপস্নবের হাওয়া লাগার সম্ভাবনা খুব জোরেশোরেই গুঞ্জন তুলেছিল মিডিয়াগুলো। কিন্তু সঊদে আরবে পদার্পণের পর সংক্ষেপ্ত সময়ের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে যে, দেশের প্রায় ৮০% লোক তাদের বাদশাহকে এবং বাদশাহর পরিবারকে মন থেকে সম্মান করে এবং ভালবাসে। মিডিয়া যে মানুষের মাথায় কত রকম মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা ও কল্পনাপ্রসূত বিষয় পেশ করে, সেটাকে অসিত্মত্বহীন অবস্থা থেকে বাস্তবে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, তা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হ’তে হয়।
পরিশেষে বলা যায়, সঊদী আরবের এখন চোখ খুলার সময় এসেছে। দেরীতে হলেও সঊদী আরবের এখন বোধদয়ের সময় এসেছে। ইসলামের স্বার্থে সঊদী আরবের উচিত আরো দূরদর্শী হওয়া। ইরান যেমন শী‘আ গ্রুপগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তেমনি সঊদী আরবের উচিত বিভিন্ন দেশের সুন্নী গ্রুপগুলোকে নির্দ্বিধায় সহযোগিতা করা। সুন্নী গ্রুপগুলোর মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখা। অলসতা আর বিলাসিতা অনেক হয়েছে। এখন মক্কা-মদীনাবাসীর গর্জে উঠার দিন। এখন একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তার খেসারত দিতে হবে বহুদিন। আল্লাহর কাছে দো‘আ করছি, হে আল্লাহ! আপনি মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন-আমীন!!
লেখক: আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব
[1] ইবনু আদী, আল কামিল ফিয যুয়াফা, ৩/১৮৯ পৃঃ।
[2] ইবনু হিববান, আল মাজরম্নহীন, ১/১৯৭ পৃঃ।
[3] আলস্নামা শহরাসত্মানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরম্নত : দারম্নল মা‘আরিফ, ১৪০৪ হি.) ১/১৫৩ পৃঃ।
[4] হুসাইন আল হুছী, দুরম্নসুম মিন হাদইল কুরআন, পৃঃ ২৩।
[5] মাসউলিইয়্যাতু আহলিল বায়ত, পৃঃ ১১।
[6] দুরম্নসুম মিন হাদইল কুরআন, সূরা মায়িদার দারস দ্রষ্টব্য।
0 Comments