বাংগালীর সৌদি বিদ্বেষ পর্বঃ--৬


  • বাংগালীর সৌদি বিদ্বেষ পর্বঃ--৬


  • শীয়া ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টির পর, আল্লাহ তাঁর নূরের খানিকটা আদমের শরীরে ঢেলে দেন৷ সে নূর আদম থেকে বংশানুক্রমে মূসা (আঃ), নূহ (আঃ), ইব্রাহীম (আঃ), সোলেমান (আঃ), দাউদ (আঃ) থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পিতামহের নিকট পৌঁছায়৷

  • সেই নূরের এক অংশ মুহাম্মদ (সাঃ) এবং অন্য অংশ তাঁর চাচাত ভাই হযরত আলী (রাঃ) শরীরে স্থানান্তিরত হয়৷ হযরত আলী (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) এর মেয়েকে বিবাহ করার পর আলীর ছেলে হুসাইন (রাঃ) এর শরীরে আবার সেই দ্বিখন্ডিত নূর সংযুক্ত হয়৷ তারপর সেই নূর বংশানুক্রমে চলে এসেছে তাদের ইমাম প্রিন্স আগা খানের শরীরে৷ (ময়ূর কন্ঠী, ঋতালী: সৈয়দ মুজতবা আলী)

  • ইসমাঈলীদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত আদম (আঃ), হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সহ অন্যান্য নবীগণ নূরের তৈরী বা তাঁদের শরীরে আল্লাহর নূর বিদ্যমান৷ (শীয়ারা কিভাবে ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করেছে, এই সিরিজের পূর্বের লেখায় তা নিয়ে সামান্য আলোকপাত ছিলো) বাংলাদেশের আলেমগণের মধ্যে এক দল মনে করেন রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি, আরেক দল মনে করেন রাসূল (সাঃ) মাটির তৈরি৷

  • রাসূল (সাঃ) কিসের তৈরি সে বিতর্কে আমরা যেতে চাই না৷ জীব বিজ্ঞান বা মেডিকেল শিক্ষার্থীরা যদি মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে সেটি দোষের কিছু নয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তা প্রকাশ করতে গেলে অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট হবে৷ কেমিস্ট্রির একজন ছাত্রের কাছে এ্যাসিড থাকতে পারে, কিন্তু তা জনসম্মুখে প্রদর্শণ করা দন্ডনীয় অপরাধ৷

  • ধর্মীয় গবেষণামূলক বিষয়গুলোও আলেমদের কাছে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিলো, কিন্তু ঊনারা তা না করে এসব নিয়ে দলাদলিতে লিপ্ত হয়েছেন৷ অনেকে বলতে পারেন ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষায়তো গোপনীয়তার কিছু নেই৷ হ্যাঁ অবশ্যই নেই, তবে আমাদের এতটুকু মনে রাখতে হবে, যে কোন শিক্ষায় মানুষ ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়৷ কেউ প্রাইমারি না পড়ে, হাই স্কুলে ভর্তি হতে পারে না৷ আমাদের অধিকাংশ লোকের সূরা ফাতিহা পড়লে উচ্চারণ এবং ব্যাকরণগত ভুল হয়৷

  • এক শ্রেণীর বক্তা আছেন, যারা রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি? না মাটির তৈরি? সেসব নিয়ে আলোচনা করে ওয়াজের মাঠ গরম করেন৷ এ বিতর্কে শামিল হয়ে আমাদের মত মূর্খ মুসলমানরা একজন আরেকজনের মাথা ফাটিয়ে দেই৷ এতে মুসলমানদের লাভ হলো না ক্ষতি হলো? তা এসব বক্তাগণের ভাবার সময় নেই৷

  • সৌদী আরবে সাধারণত ধর্ম নিয়ে এধরনের দলাদলি, ফাটাফাটি বা ব্যবসা করার সুযোগ নেই৷ যারা হজ্ব বা ওমরাহ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, এবং যারা ভবিষ্যতে করার আশা পোষণ করেন, তারা একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন- কেউ বুকের উপর, কেউ পেটের উপর, কেউ নাভীর উপর, কেউ হাত না বেঁধে বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে নামায পড়ছে৷ কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না৷

  • এখানে তাহাজ্জুদের নামায সহ মোট ছয় ওয়াক্ত নামাযের আযান দেওয়া হচ্ছে৷ তাহাজ্জুদের নামাযকে তারা ফরয নামাযের মতই গুরুত্ব দেয়৷ আযানের পর থেকে জামাত শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্যবসা, বাণিজ্য অফিস সহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ৷ এখানকার মানুষ মসজিদে আসার পর দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল মসজিদের নামায আদায় করেন৷ কোন কারনে নামাযের জামাত না পেলে আমাদের মত যার যার নামায সে পড়ে বিদায় হয় না, দু'জন হলেই তারা জামাত করে নামায আদায় করে৷

  • আপনার কোন ধর্মীয় ভুল আচরণ তাদের চোখে পড়লে তারা আপনাকে বলবে, হাদা বিদআ্ অর্থাৎ এটি বিদআত৷ তারপর সঠিক পন্থা জানিয়ে বলবে, হাদা সুন্নাহ্ অর্থাৎ এটি সুন্নাত৷ এরপর মানা না মানা আপনার ব্যাপার৷ মানলে কেউ আপনাকে পুরুষ্কৃত করবে না, না মানলে আপনাকে কেউ বিদাতি বলে তিরষ্কারও করবে না৷ যেহেতু আরবী তাদের মাতৃভাষা, তাই ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষাটা তারা পরিবার থেকেই পেয়ে যাচ্ছে৷ আর উচ্চতর শিক্ষার জন্যতো মাদ্রাসা আছেই৷

  • আলেমদের মত আমাদের মাদ্রাসাগুলোও বিভক্ত৷ যেসব মাদ্রাসায় রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি আক্বীদার ওস্তাদ আছেন তারা আবার ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, ফাতেহা ই ইয়াজদহম ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান জাঁকঝমকের সাথে পালনের শিক্ষা দিয়ে থাকেন৷ ঊনাদের মতে ঊনারা আওলাদে রাসূল, আশেকে রাসূল, সুন্নী ইত্যাদি৷

  • অন্যদিকে যারা রাসূল (সাঃ) মাটির তৈরি শিক্ষা দেন, তাদের মতে ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, ফাতেহা ই ইয়াজদহমের মত অনুষ্ঠানগুলি বিদআত৷ সৌদী আলেমগণের মতেও এগুলো বিদআত, এবং এখানে রমজান এবং ঈদ ব্যতীত আর কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্দীপণার সহিত পালন করা হয় বলে অধমের জানা নেই৷

  • মিলাদুন্নবী পালনকারীদের মতে যারা রাসূল (সাঃ) কে মাটির তৈরি মনে করে, তারা ওহাবী এবং সৌদীদের দালাল৷ যাদেরকে ওহাবী বলা হয় তাঁরা সাধারণত সীরাতুন্নবী পালনের পক্ষে৷ যেহেতু মিলাদুন্নবী ত্বরীকার আলেমগণের সাথে সৌদী আলেমগণের বিশাল মতভেদ রয়েছে, সেহেতু তাদের থেকে আপনি সৌদী সম্পর্কে কোন পজেটিভ ধারণা পাবেন না৷

  • ওহাবী বা সীরাতুন্নবী পালনকারীগণ কেন সৌদী আরবের প্রতি নেগেটিভ ধারণা পোষণ করেন? ইনশাআল্লাহ! এই সিরিজের পরবর্তী লেখাতে সে সম্পর্কে সামান্য ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো৷ তার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলি--

  • এক লোক তার স্ত্রীকে তালাক দিবে৷ বৈঠকে গ্রাম্য সালিশদাররা জিজ্ঞেস করলো, তুমি তাকে তালাক দিবা কেন? লোকটা উত্তর দিলো, সে কাইত হয়ে ঘুমায়৷ সালিশদাররা বললো, ঠিক আছে সে এখন থেকে চিৎ হয়ে ঘুমাবে৷ লোকটা বললো, সে চিৎ হয়ে ঘুমাইলে নাক ডাকে৷ সালিশদাররা বললো, ঠিক আছে সে এখন থেকে আলাদা বিছানায় ঘুমাবে৷ লোকটা বললো, এর চেয়ে তালাক দেওয়াইতো ভালো৷

  • স্ত্রীর কাইত, চিৎ বা নাক ডাকা লোকটার সমস্যা না৷ সমস্যা হলো তালাকের প্রতি সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ৷ একত্রে থাকার জন্য তাকে যত রকম সমাধানই দেওয়া হোক না কেন, সে কিন্তু ঘুরেফিরে তালাকই বেছে নিবে৷ কেউ যখন মনের মাঝে কোন বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে, তখন আল্লাহ না চাইলে দুনিয়ার কেউ তাকে পরিবর্তন করতে পারে না৷

  • কেউ যদি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে থাকেন যে, সৌদী আরবের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা তার বিশাল বড় ঈমাণী দায়িত্ব এবং এর দ্বারা তিনি দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল করছেন, ঊনাকে অধম বিন্দু মাত্র বাধা দেই না৷ এই সিরিজের লেখাগুলো আল্লাহর সেসব ঈমাণদার বান্দাগণের জন্য নয়৷ যারা বিভিন্ন সময় সৌদী নিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করে বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকেন, সেসব কৌতুহলী ভাই-বোনদের জন্য এই সিরিজ।

  • (কলাম--->>সাইদুর রহমান।)