বাঙ্গালীর সৌদী বিদ্বেষ পর্বঃ-৭


  • বাঙ্গালীর সউদি বিদ্বেষ পর্বঃ-৭

  • টঙ্গীর মাছিমপুরে "নুরে মদিনা হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা" নামে একটা মাদ্রাসা আছে৷ প্রতি বছর হাফেজদের পাগড়ী প্রদান উপলক্ষ্যে সেখানে একজন আলেমকে দাওয়াত দেওয়া হত৷ আলেম সাহেব ষাট বছর বয়সে হাফেজ হয়েছেন৷ তৎকালীন সময়ে একটা ইসলামী দলের মহাসচিব৷

  • পাগড়ী প্রদান অনুষ্ঠানে মাদ্রাসার ছাত্ররা গায়, "মনে বড় আশা ছিলো যাবো মদিনায়৷" আলেম সাহেব চিৎকার দিয়ে বলেন, মদিনায় যাই কি করবেন? ওহাবীর গোষ্ঠীরা মদিনাটা শেষ কইরা দিলো৷ আমার প্রিয় সাহাবীগো রওজা মুবারক ভাইঙ্গা গুঁড়া গুঁড়া কইরা দিছে৷ আহারে আমার সোনার মদিনা! বলেই তিনি বুক ফাটা কান্না শুরু করেন৷

  • বাঙ্গালীর নরম দিল৷ তারা ফিলিস্তিনের জন্য কাঁদে, ফ্রান্সের জন্য কাঁদে, শ্রীদেবীর জন্য কাঁদে, আফগানিস্তানের জন্য কাঁদে, খেলায় হেরে কাঁদে, সিনেমা দেখে কাঁদে, রাজনীতি দেখে কাঁদে, অন্যের সুখে কাঁদে, অন্যের দুখে কাঁদে, কারনে কাঁদে, অকারনে কাঁদে ৷ আর হুজুরের কান্না দেখে, না কেঁদে কি পারে? আমরা মনে মনে ভাবি, কবে যে এই ওহাবী সৌদীদের থেকে মক্কা-মদীনা রক্ষা পাবে! কবে আমরা মদীনায় যাই দুইটা আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বালানোর সুযোগ পাবো!

  • আরেকজন বিখ্যাত আলেম, তৎকালীন সময়ে প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে তার ওয়াজের ক্যাসেট ছিলো৷ তিনি তার এক ওয়াজে বলেন- আমি মদিনা গেলাম৷ মদিনার ছোট ছোট ছেলেরা আমাকে মাগবারাতুল বাক্বীতে দেখিয়ে দিচ্ছে এটা অমুক সাহাবীর কবর, ওটা তমুক সাহাবীর কবর৷ আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এত ছোট ছোট বাচ্চারা কিভাবে এত সাহাবীর নাম মুখস্ত করেছে!

  • ঊনার ওয়াজ শোনে নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, আজ পর্যন্ত দুনিয়াতে বেহেশতের সুসংবাদ পাওয়া দশজন সাহাবীর নাম শেখা হলো না! সেই সাথে দ্বিধায়ও পড়ে যাই! হাফেজ সাহেব বললেন, ওহাবীরা সব কবর গুঁড়া গুঁড়া করে দিয়েছে৷ আবার বক্তা বলছেন, মদিনার ছোট ছোট বাচ্চাদের সব সাহাবীর নাম মুখস্ত৷ কেমনে কি!

  • মাদ্রাসার পাশেই অলিম্পিয়া মতি মসজিদ৷ মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি আবদুল কাইয়্যুম সাহেব৷ তিনি অন্যদের মত অত রসালো ওয়াজ করেন না৷ তিনি বলেন- কবর নিয়ে আমাদের দেশে যা হয় তা শিরক, বিদআত৷ কবরের ব্যক্তির কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই৷ মুফতি সাহেবের উপর আমাদের কিছুটা বিরক্তিও আছে, ঊনি তবারক, মিষ্টি, মিলাদ এসবকেও বিদআত বলেন৷

  • আমাদের মত সাধারণ মানের মুসলমানদের ক্বোরআন-হাদীস থেকে ইসলামকে জানার সুবিধা খুবই কম, বা ক্বোরআন-হাদীস থেকে ইসলামকে জানতে আমরা ততটা আগ্রহী নয়৷ সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আলেমগণই আমাদের ভরসা৷ কিন্তু একই বিষয়ে যখন ভিন্ন ভিন্ন আলেমের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় তখন আমরা বিভক্ত হয়ে যাই৷ যে যে আলেমকে ভক্তি বা শ্রদ্ধা করেন তিনি তাকে অন্ধভাবে সমর্থন করতে থাকেন৷ আবার কেউ কেউ আমার মত সংশয়বাদী মন নিয়ে বড় হন৷

  • আলহামদুলিল্লাহ! এটি আমার সৌভাগ্য যে সাহাবীদের স্মৃতি বিজড়িত তিনটি স্থান আমার যিয়ারত করার সুযোগ হয়েছে৷ মদিনা থেকে প্রায় দুইশ কিঃ মিঃ দূরে বদর প্রান্তর৷ এর সাথে ছোট একটি মসজিদ রয়েছে, মসজিদের সামনে বদর যুদ্ধে শহীদ হওয়া ১৪ জন সাহাবীর নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক আছে৷ চারদিকে ইটের দেয়ালে ঘেরাও করা স্থানটি বর্তমানে স্থানীয়দের গোরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ এর এক কোনে সাহাবীগণের কবর সংরক্ষিত আছে৷

  • মসজিদে নববী থেকে প্রায় আট-দশ কিঃ মিঃ দূরে জাবালে উহূদ বা উহূদ পাহাড় অবস্থিত৷ এ পাহাড়ের পাদদেশে উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়৷ এ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর আপন চাচা হযরত হামযা (রাঃ) সহ ৭০ জন সাহাবী শহীদ হন৷ উক্ত পাহাড়ের পাদদেশে হযরত হামযা (রাঃ) সহ শুহাদায়ের উহুদের কবর সংরক্ষিত রয়েছে৷ তবে আমাদের দেশের মত উঁচু না, সমতল ভূমিতে ইটের ঘেরাও করা৷ প্রতিদিন হাজার হাজার যিয়ারতকারীগণ উক্ত কবর যিয়ারত করেন৷

  • মসজিদে নববীর সামান্য পূর্ব দক্ষিণ দিকে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ বিশাল কবরস্থান "মাগবারাতুল বাক্বী" অবস্থিত৷ এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন অগণিত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আউলিয়ায়ে কেরাম৷ এ কবরস্থানের বর্তমান বর্তমান আয়তন প্রায় ১৭৪৯৬২ বর্গ মিটার৷ এখানকার ভিতরের কবর গুলো ব্লকে ভাগ ভাগ করা৷ প্রবেশ মুখে হাতের ডান পাশে বেশ কিছু কবর সংরক্ষিত আছে, অনেকের ধারণা এগুলোই সাহাবীগণের কবর৷ তবে নির্ধারিতভাবে কারো নামের উল্লেখ নেই৷ আমি বেশ কয়েকবার এখানকার সিকিউরিটি গার্ডদের প্রশ্ন করেছিলাম, এগুলো সাহাবীগণের কবর কি না? প্রতিবারই একই প্রকার জবাব পেয়েছি, তারা বলেন- হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, আল্লাহ অধিক ভালো জানেন৷

  • আরবের লোকদের কোন কিছু সম্পর্কে যদি ধারণা না থাকে তাহলে তারা সাধারণত বিষয়টা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বলে- আল্লাহ অধিক ভালো জানেন৷ কিন্তু আমাদের দেশের অনেক বড় বড় আলেমও অনুমানের উপর কথা বলে থাকেন৷ যেমন- উপরে দু'জন বক্তার কথা উল্লেখ করেছি৷ আল্লাহ পাক যদি আমাকে এই পূণ্য ভূমি যিয়ারতের সুযোগ না দিতেন, তাহলে আমাকে ঐ আলেমগণের কথার উপর বিশ্বাস করে সারা জীবন একটা মিথ্যা ধারণার উপর থাকতে হত৷

  • তাহলে কি সৌদী আরবে সাহাবীগণের কবর ধ্বংস করা হয় নি?হ্যাঁ, কিছু সাহাবীগণের কবরকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের মত কবর কেন্দ্রিক শিরক, বিদআত জমে উঠেছিলো৷ সেগুলো মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (রহঃ) নেতৃত্বে ধ্বংস করে দেওয়া হয়৷

  • এখানে আপনাকে বোঝতে হবে জমির সব কীট কিন্তু ফসলের জন্য ক্ষতিকর নয়, আপনি যদি সে উপকারী কীটের কথা চিন্তা করে জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ রাখেন তাহলে আপনি কখনো ভালো ফসল পাবেন না৷ একটা কবর ধ্বংস করে যদি হাজার হাজার মানুষকে শিরক, বিদআত থেকে ফেরানো যায়, তাহলে সেটি ধ্বংস করা জায়েয কি না সে ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমগণ ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন৷

  • মদিনাবাসীর মাঝে অপরাধী এবং আত্মহত্যাকারী ব্যতীত বাকি লোকদের মাগবারাতুল বাক্বীতে দাফন করা হয়৷ সাধারণত আমাদের দেশের অনেকের আকাংখা থাকে মাগবারাতুল বাক্বীতে দাফন হওয়ার, কিন্তু এখানকার রাজ পরিবারের কাউকে মাগবারাতুল বাক্বীতে দাফন করা হয় না৷ বিষয়টাকে আপনি নেগেটিভভাবে দেখলে এভাবে বলতে পারেন- ওহাবীর বংশধরদের কপালে মাগবারাতুল বাক্বীর মাটি নাই৷

  • কিন্তু বিষয়টাকে আপনি যদি পজেটিভভাবে দেখেন তাহলে- আপনাকে মনে রাখতে হবে মদীনাতে যদি কোন হাজী বা আমাদের মত কোন প্রবাসী শ্রমিক মারা যায় তাহলে দূতাবাসের অনুমতিক্রমে তাদেরও এখানে দাফন করা যায়, এবং প্রতিদিন ফরয নামাযের পর একাধিক লাশ এখানে দাফন করা হচ্ছে৷ সুতরাং চাইলেই মাগবারাতুল বাক্বীতে দাফন হওয়া রাজ পরিবারের জন্য কোন ব্যাপার না, কিন্তু তারা যেটা করছে মাগবারাতুল বাক্বী মদিনাবাসীর হক্ব এবং এটি মদিনাবাসীর জন্যই সংরক্ষিত করে রেখেছে৷

  • প্রতি ফরয নামাযের যদি নূন্যতম দুই জনের লাশ দাফন করা হয় তাহলে মাগবারাতুল বাক্বীতে দৈনিক দশ, মাসে তিনশ লাশ দাফন করা হচ্ছে (প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে)৷ এত লাশের কবর যদি সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে মদিনাতে শুধু কবর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না, যার কারনে প্রতি কয়েক বছর পর তারা পুরাতন কবরগুলো সংস্কার করে সেখানে নতুন কবরের জায়গা করে৷

  • আমাদের দেশের বিশাল এক গোষ্ঠী আলেম আছেন যারা কবরের প্রতি বিশেষ ভক্তি করে থাকেন৷ এই কবর ভক্ত আলেম এবং তাদের অনুসারীদের কাছে আপনি কখনো সৌদী আরবের কোন সুনাম পাবেন না৷

  • (কলাম--->>সাইদুর রহমান।)