সাহাবীরা সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমান কেনো আমরা প্রায় সব দেশেই পরাজিত?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলের লোকেরা ৭২টি দলে বিভক্ত ছিল। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩টি দলে। এই সবগুলো দল-ই জাহান্নামে যাবে, শুধুমাত্র একটি মাত্র দল ছাড়া।” সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, “সেই দলটি কারা?” নবীজী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যারা আমার ও আমার সাহাবাদের মত ও পথ অনুসরণ করবে।” তিরমিযীঃ ২৬৪১, আল মুজামুল কাবীরঃ ৭৬৫৯।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর সাহাবীদের যুগ থেকেই কিছু লোকেরা ক্বুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন নতুন পথভ্রষ্ট দল তৈরী করা আরম্ভ করে, আর এভাবেই মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি ও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। সর্বপ্রথম, যেই বিদআ’তী দলগুলো তৈরী হয় তাদের মাঝে রয়েছে খারেজী, ক্বাদরীয়া, মুঅতাজিলা, আশআরী-মাতুরিদী, সূফী ইত্যাদি। সেই থেকে যত সময় যাচ্ছে ইতিহাসের পরিক্রমায় মুসলমানদের মাঝে নিত্য নতুন বিভিন্ন দল, উপদল, মতবাদ বা ফেরকা সৃষ্টি হচ্ছে এবং মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আবুল আলা মওদুদী, হাসান আল-বান্না, সাইয়েদ কুতুব, ইউসুফ কারযাভী এমন কিছু লোকের “দ্বীন কায়েম মানে হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা” এই ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে বিংশ শতাব্দীতে কিছু নতুন দল সৃষ্টি হয়েছে। এই দলসমূহের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া। আর এজন্য তারা নিত্য নতুন মতবাদ আমাদের সামনে পেশ করছে এবং নিজেদের মনগড়া কিছু কাজ করে তারা সেইগুলোকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়।
‘শরিয়ায়’ বা আল্লাহর আইন কায়েম করা কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নিয়ে যেই সমস্ত দলগুলো ‘সিরাতাল মুস্তাক্বীম’ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তারা সাধারণত নিজেদেরকে ‘জিহাদী’ দল বলে আত্মতৃপ্তি বোধ করে এবং তাদের সমালোচনকারীদেরকে দরবারী, সরকারের দালাল, তাগুতের গোলাম, ইহুদীদের দালাল ইত্যাদি আজেবাজে ভাষায় অন্যায় গালি-গালাজ করে। যাই হোক, কথিত এই জিহাদী দলগুলো দুইটি বড় দলে বিভক্ত।
(১) তাদের প্রথম দল গণতন্ত্র বা ভোটের মাধ্যমে আল্লাহর আইন কায়েম করার আন্দোলনে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েম করাকে তারা ‘পবিত্র জিহাদ’ বলে মনে করে এবং এই প্রক্রিয়ায় ইলেকশান বা নির্বাচনকে তারা ওহুদ-বদর যুদ্ধের ময়দানের সমান বলে মনে করে। ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশে এই দলের নাম হচ্ছে জামআ’তে ইসলামী, আর মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে তাদের নাম হচ্ছে ইখোয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড।
(২) জিহাদীদের দ্বিতীয় দলটি সারা বিশ্বে জংগী কার্যকলাপ দ্বারা মুসলমান ও কাফের নিধন করে, আর তারা মনে করে এইভাবে তারা আল্লাহর আইন কায়েম করবে। এই দলগুলো নিজেদেরকে আল-কায়েদাহ, আইসিস, বোকো হারাম, জেএমবি ইত্যাদি নামে পরিচয় দেয়। এদের মতে জিহাদ মানে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা করা।
যাইহোক, এই উভয় দলের লোকেরা মনে করে তারা জিহাদ করছে, আর অন্যরা জিহাদ করছেনা। বিশ্বের নানা দেশে মুসলমান হত্যা করা আছে, তারা তার প্রতিবাদ করে কিন্তু অন্যরা চুপ করে দালালী করছে।
এটা আসলে কথিত ‘জিহাদী’ দলগুলোর দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না। নীচে আমি কিছু আলোচনা তুলে ধরে তাদের জবাব দিচ্ছি ইন শ আল্লাহ।
বিশ্ব রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে যারা সামান্য খোঁজ-খবর রাখেন, আশা করি সকলেই এই একটি ব্যাপারে একমত যে, আজ বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ্বেই মুসলমানেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, মুসলমানদেরকে প্রকাশ্যে জবাই করা হচ্ছে, তাদের ঘর-বাড়ি জালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মুসলমান নারীদের ইজ্জত নষ্ট করা হচ্ছে, মুসলমান শিশুদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদের উপরে কাফের মুশরেকদের অত্যাচার নির্যাতনের যেই ভয়াবহ চিত্র বর্তমান মিডিয়ার যুগে প্রকাশ পাচ্ছে, তা সত্যিই হৃদয় বিদারক। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউ’ন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেঃ বর্তমান যুগে মুসলমানদের এই শোচনীয় অবস্থার কারণ কি? মুসলমানদের এমন লাঞ্চণাকর অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি?
সত্য সন্ধানী আল্লাহ অভিমুখী প্রতিটি ভাই ও বোনকে আমি অনুরোধ করবো নীচের এই ঘটনাটি মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং অনুধাবন করার জন্য।
আবু ইসহাক আল ফাজারি রাহি’মাহুল্লাহ বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের বিরুদ্ধে তাঁদের শত্রুরা যুদ্ধের ময়দানে কখনোই মোকাবেলা করতে সক্ষম হতোনা। যখন এন্টিওখে সাহাবীদের বিরুদ্ধে রোমানদের পরাজয়ের সংবাদ তাদের বাদশাহ হেরাক্লিয়াসের কাছে পৌঁছাল, সে তখন তার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, “হায় আফসোস! তোমরা আমাকে বলো, এই লোকগুলো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তারা কি তোমাদের মতো মানুষ নয়?” লোকেরা উত্তর দিলো, “হ্যা, নিশ্চয় তারা আমাদের মতোই মানুষ।”
হেরাক্লিয়াস পুনরায় প্রশ্ন করলো, “তোমরা কি তাদের চাইতেও সংখ্যায় বেশি ছিলেনা?” লোকেরা বলল, “সব যুদ্ধেই আমাদের সৈন্য তাদের চাইতে অনেক বেশি ছিলো।”
হেরাক্লিয়াস আবার প্রশ্ন করলো, “তাহলে এটা কেমন করে হয় যে, তোমরা যখনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো আর সবসময় তোমরাই পরাজিত হও?”
হেরাক্লিয়াসের রাজদরবারের একজন সম্মানিত, বয়ষ্ক ও জ্ঞানী ব্যক্তি উত্তরে বলেছিলো, “আমরা তাঁদের (অর্থাৎ সাহাবাদের) বিরুদ্ধে সবসময় পরাজিত হই কারণ তাঁরা রাত জেগে সালাত আদায় করে আর দিনের বেলায় সাওম পালন করে, তাঁরা তাঁদের চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি সমূহ যথাযথভাবে রক্ষা করে, তাঁরা সৎ কাজের আদেশ করে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করে, আর তাঁরা নিজেদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারণ বজায় রাখে। পক্ষান্তরে আমরা পরাজিত হই কারণ আমরা মদ পান করি, ব্যাভিচারে লিপ্ত হই, আমরা গুনাহর কাজ করি, আমরা আমাদের চুক্তিসমূহ ভঙ্গ করি, আমরা চুরি করি, অত্যাচার করি এবং অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকি, আমরা একজন আরেকজনকে এমন কাজ করতে উৎসাহিত করি যা আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করে, আল্লাহ আযযা ওয়া যাল যেই কাজে সন্তুষ্ট হন আমরা একজন আরেকজনকে সেই কাজগুলো করতে নিষেধ করি এবং আমরা জমীনে দুর্নীতি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করি।”
হেরাক্লিয়াস তার কথা শুনে বললেন, “তুমি আমাকে সত্যি কথাই বলেছো।”
উৎসঃ আবু বকর আল-দায়নূরি, আল-মুজালাসাহ ওয়া জাওয়াহি’র আল-ই’লমঃ ৪/৯১।
অনুধাবনঃ
(১) সাহাবীরা অধিক সৈন্য সংখ্যা, উন্নত প্রযুক্তি বা এমন অন্য কোন দুনিয়াবী শক্তির কারণে জয়ী হতোনা। বরং তাদের সালাত, তাদের সিয়াম, তাদের ন্যায়পরায়ণতা সর্বোপরি, তাদের দ্বীনদারী দ্বারা তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছিলেন। যে কারণে আল্লাহ তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের বিরুদ্ধে সাহায্য করতেন। এভাবেই তারা অল্প সংখ্যক সৈন্য বাহিনী দ্বারা বিশাল বড় কাফের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হতেন।
(২) পক্ষান্তরে, বর্তমান যুগের মুসলমানেরা দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, এ কারণে তারা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত।
(৩) সাহাবাদের ঈমান ছিলো আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ, সেখানে কোন শিরক, বিদআ’ত গোমরাহী ছিলোনা। পক্ষান্তরের বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমানেরা সঠিক ইসলামী ঈমান আকিদাহ কি জানেনা। এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মুসলমান আছে যারা নিজেদেরকে পাক্কা ঈমানদার মনে করে কিন্তু তারা “আল্লাহ সর্ব জায়গায় বিরাজমান” এমন কুফুরী বিশ্বাস পোষণ করে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, হাফেজ মাওলানা, মুফতি মুহাদ্দিস, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী লোকেরা মসজিদ মাদ্রাসায় বসে উম্মতের লোকদেরকে তোতা পাখির বুলির মতো শিক্ষা দিচ্ছে “আল্লাহ সর্ব জায়গায় বিরাজমান”, আর সরলমনা মুসলমানেরা তাদেরকে আলেম মনে করে, তাদের কথা বিশ্বাস করে এমন কুফুরী আকিদাহকে মেনে নিচ্ছে। মিশরের বাদাভী নামক একজন লোকের মাজার আছে যেখানে দশ লক্ষের অধিক লোক যার তার পূজা করার জন্য। বাংলাদেশের চাঁদপুরে লেংটা বাবার মাজারে দশ লক্ষের অধিক লোক যার তার পূজা করার জন্য। পাকিস্থানে লাল শাহবাজে লক্ষ লক্ষ লোক যায়, ভারতে আজমীরে কোটি কোটি লোক যায়, ইরান ও ইরাকের শিয়াদের ধর্মই হচ্ছে কবর পূজা। এমনিভাবে বর্তমান যুগের কোটি কোটি মানুষ নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে কুফুরী বা শিরকি বিশ্বাস রাখে। এমন শিরকি বিশ্বাস থাকলে আল্লাহ বর্তমান যুগের মুসলমানদেরকে কি সাহায্য করবেন? নাকি তাদের উপর বিভিন্ন আযাব-গজব চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে দুনিয়াবী শাস্তি দিয়ে পেরেশানির মাঝে রাখবেন?
(৪) সাহাবীরা রাতের বড় একটা অংশ নফল সালাত আদায় করে কাটাতেন। আর বর্তমান যুগের মুসলমানেরা পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করেনা।
(৫) এমনিভাবে বললে এই লিস্ট অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে যে, বর্তমান যুগের মুসলমানেরা দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যেকারণে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াবী শাস্তি ও কাফেরদের পক্ষ থেকে অত্যাচার নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে।
(৬) সুতরাং, কোন মুসলমান যদি চায় সে মুসলমানদের এই দুরবস্থা থেকে তাদেরকে সাহায্য করবে, সে যেন নিজেকে পবিত্র করে, হারাম, পাপাচার ও আল্লাহর অবাধ্যতা বর্জন করে আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হয়। প্রতিটি মুসলমান যেনো নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে সংশোধন করে দ্বীনের পথে আনার চেষ্টা করে। অতঃপর সে তার অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা অন্য মুসলমানদেরকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজের নিষেধ করে।
(৭) বর্তমানে মুসলমানদের দুরবস্থার কথা সবাই জানে, কিন্তু সমাধান জানেনা। সেকারণে মুসলমান উম্মাহর মাঝে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেই। কথিত জিহাদীরা নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে। তাদের সমাধানের পদ্ধতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সম্মানিত সাহাবীদের বিপরীত। একারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে কথিত এই জিহাদীরা সাহায্য পায়না। বরং কথিত এই জিহাদীরা যেই দেশে প্রবেশ সেই দেশের মুসলমানদের অবস্থা পূর্বের চাইতে আরো খারাপ হয়। আলজেরিয়ায়, মিশর, তিউনিয়াসিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া এমন অনেক দেশেই কথিত জিহাদীদের কারণে মুসলমানদের বিপদ ও দুর্দশা পূর্বের চাইতে অনেকগুণে বেড়ে গেছে। যদিও কথিত জিহাদীরা নিজেদেরকে হক্কপন্থী বলে মনে করছে। আল্লাহ এমন পথভ্রষ্ট লোকদের ফিতনাহ ও অনিষ্ট থেকে মুসলিমদেরকে হেফাজত করুন, আমিন।
(৮) উল্লেখ্য, বিষয়টি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানার জন্য আপনারা এই লেখাটি পড়ুনঃ
“বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহর দুর্দশা নিয়ে শায়খ ফাউজানের গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া”
Overview
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলের লোকেরা ৭২টি দলে বিভক্ত ছিল। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩টি দলে। এই সবগুলো দল-ই জাহান্নামে যাবে, শুধুমাত্র একটি মাত্র দল ছাড়া।” সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, “সেই দলটি কারা?” নবীজী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যারা আমার ও আমার সাহাবাদের মত ও পথ অনুসরণ করবে।” তিরমিযীঃ ২৬৪১, আল মুজামুল কাবীরঃ ৭৬৫৯।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর সাহাবীদের যুগ থেকেই কিছু লোকেরা ক্বুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন নতুন পথভ্রষ্ট দল তৈরী করা আরম্ভ করে, আর এভাবেই মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি ও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। সর্বপ্রথম, যেই বিদআ’তী দলগুলো তৈরী হয় তাদের মাঝে রয়েছে খারেজী, ক্বাদরীয়া, মুঅতাজিলা, আশআরী-মাতুরিদী, সূফী ইত্যাদি। সেই থেকে যত সময় যাচ্ছে ইতিহাসের পরিক্রমায় মুসলমানদের মাঝে নিত্য নতুন বিভিন্ন দল, উপদল, মতবাদ বা ফেরকা সৃষ্টি হচ্ছে এবং মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আবুল আলা মওদুদী, হাসান আল-বান্না, সাইয়েদ কুতুব, ইউসুফ কারযাভী এমন কিছু লোকের “দ্বীন কায়েম মানে হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা” এই ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে বিংশ শতাব্দীতে কিছু নতুন দল সৃষ্টি হয়েছে। এই দলসমূহের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া। আর এজন্য তারা নিত্য নতুন মতবাদ আমাদের সামনে পেশ করছে এবং নিজেদের মনগড়া কিছু কাজ করে তারা সেইগুলোকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়।
‘শরিয়ায়’ বা আল্লাহর আইন কায়েম করা কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নিয়ে যেই সমস্ত দলগুলো ‘সিরাতাল মুস্তাক্বীম’ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তারা সাধারণত নিজেদেরকে ‘জিহাদী’ দল বলে আত্মতৃপ্তি বোধ করে এবং তাদের সমালোচনকারীদেরকে দরবারী, সরকারের দালাল, তাগুতের গোলাম, ইহুদীদের দালাল ইত্যাদি আজেবাজে ভাষায় অন্যায় গালি-গালাজ করে। যাই হোক, কথিত এই জিহাদী দলগুলো দুইটি বড় দলে বিভক্ত।
(১) তাদের প্রথম দল গণতন্ত্র বা ভোটের মাধ্যমে আল্লাহর আইন কায়েম করার আন্দোলনে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েম করাকে তারা ‘পবিত্র জিহাদ’ বলে মনে করে এবং এই প্রক্রিয়ায় ইলেকশান বা নির্বাচনকে তারা ওহুদ-বদর যুদ্ধের ময়দানের সমান বলে মনে করে। ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশে এই দলের নাম হচ্ছে জামআ’তে ইসলামী, আর মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে তাদের নাম হচ্ছে ইখোয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড।
(২) জিহাদীদের দ্বিতীয় দলটি সারা বিশ্বে জংগী কার্যকলাপ দ্বারা মুসলমান ও কাফের নিধন করে, আর তারা মনে করে এইভাবে তারা আল্লাহর আইন কায়েম করবে। এই দলগুলো নিজেদেরকে আল-কায়েদাহ, আইসিস, বোকো হারাম, জেএমবি ইত্যাদি নামে পরিচয় দেয়। এদের মতে জিহাদ মানে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা করা।
যাইহোক, এই উভয় দলের লোকেরা মনে করে তারা জিহাদ করছে, আর অন্যরা জিহাদ করছেনা। বিশ্বের নানা দেশে মুসলমান হত্যা করা আছে, তারা তার প্রতিবাদ করে কিন্তু অন্যরা চুপ করে দালালী করছে।
এটা আসলে কথিত ‘জিহাদী’ দলগুলোর দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না। নীচে আমি কিছু আলোচনা তুলে ধরে তাদের জবাব দিচ্ছি ইন শ আল্লাহ।
বিশ্ব রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে যারা সামান্য খোঁজ-খবর রাখেন, আশা করি সকলেই এই একটি ব্যাপারে একমত যে, আজ বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ্বেই মুসলমানেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, মুসলমানদেরকে প্রকাশ্যে জবাই করা হচ্ছে, তাদের ঘর-বাড়ি জালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মুসলমান নারীদের ইজ্জত নষ্ট করা হচ্ছে, মুসলমান শিশুদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদের উপরে কাফের মুশরেকদের অত্যাচার নির্যাতনের যেই ভয়াবহ চিত্র বর্তমান মিডিয়ার যুগে প্রকাশ পাচ্ছে, তা সত্যিই হৃদয় বিদারক। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউ’ন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেঃ বর্তমান যুগে মুসলমানদের এই শোচনীয় অবস্থার কারণ কি? মুসলমানদের এমন লাঞ্চণাকর অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি?
সত্য সন্ধানী আল্লাহ অভিমুখী প্রতিটি ভাই ও বোনকে আমি অনুরোধ করবো নীচের এই ঘটনাটি মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং অনুধাবন করার জন্য।
আবু ইসহাক আল ফাজারি রাহি’মাহুল্লাহ বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের বিরুদ্ধে তাঁদের শত্রুরা যুদ্ধের ময়দানে কখনোই মোকাবেলা করতে সক্ষম হতোনা। যখন এন্টিওখে সাহাবীদের বিরুদ্ধে রোমানদের পরাজয়ের সংবাদ তাদের বাদশাহ হেরাক্লিয়াসের কাছে পৌঁছাল, সে তখন তার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, “হায় আফসোস! তোমরা আমাকে বলো, এই লোকগুলো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তারা কি তোমাদের মতো মানুষ নয়?” লোকেরা উত্তর দিলো, “হ্যা, নিশ্চয় তারা আমাদের মতোই মানুষ।”
হেরাক্লিয়াস পুনরায় প্রশ্ন করলো, “তোমরা কি তাদের চাইতেও সংখ্যায় বেশি ছিলেনা?” লোকেরা বলল, “সব যুদ্ধেই আমাদের সৈন্য তাদের চাইতে অনেক বেশি ছিলো।”
হেরাক্লিয়াস আবার প্রশ্ন করলো, “তাহলে এটা কেমন করে হয় যে, তোমরা যখনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো আর সবসময় তোমরাই পরাজিত হও?”
হেরাক্লিয়াসের রাজদরবারের একজন সম্মানিত, বয়ষ্ক ও জ্ঞানী ব্যক্তি উত্তরে বলেছিলো, “আমরা তাঁদের (অর্থাৎ সাহাবাদের) বিরুদ্ধে সবসময় পরাজিত হই কারণ তাঁরা রাত জেগে সালাত আদায় করে আর দিনের বেলায় সাওম পালন করে, তাঁরা তাঁদের চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি সমূহ যথাযথভাবে রক্ষা করে, তাঁরা সৎ কাজের আদেশ করে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করে, আর তাঁরা নিজেদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারণ বজায় রাখে। পক্ষান্তরে আমরা পরাজিত হই কারণ আমরা মদ পান করি, ব্যাভিচারে লিপ্ত হই, আমরা গুনাহর কাজ করি, আমরা আমাদের চুক্তিসমূহ ভঙ্গ করি, আমরা চুরি করি, অত্যাচার করি এবং অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকি, আমরা একজন আরেকজনকে এমন কাজ করতে উৎসাহিত করি যা আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করে, আল্লাহ আযযা ওয়া যাল যেই কাজে সন্তুষ্ট হন আমরা একজন আরেকজনকে সেই কাজগুলো করতে নিষেধ করি এবং আমরা জমীনে দুর্নীতি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করি।”
হেরাক্লিয়াস তার কথা শুনে বললেন, “তুমি আমাকে সত্যি কথাই বলেছো।”
উৎসঃ আবু বকর আল-দায়নূরি, আল-মুজালাসাহ ওয়া জাওয়াহি’র আল-ই’লমঃ ৪/৯১।
অনুধাবনঃ
(১) সাহাবীরা অধিক সৈন্য সংখ্যা, উন্নত প্রযুক্তি বা এমন অন্য কোন দুনিয়াবী শক্তির কারণে জয়ী হতোনা। বরং তাদের সালাত, তাদের সিয়াম, তাদের ন্যায়পরায়ণতা সর্বোপরি, তাদের দ্বীনদারী দ্বারা তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছিলেন। যে কারণে আল্লাহ তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের বিরুদ্ধে সাহায্য করতেন। এভাবেই তারা অল্প সংখ্যক সৈন্য বাহিনী দ্বারা বিশাল বড় কাফের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হতেন।
(২) পক্ষান্তরে, বর্তমান যুগের মুসলমানেরা দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, এ কারণে তারা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত।
(৩) সাহাবাদের ঈমান ছিলো আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ, সেখানে কোন শিরক, বিদআ’ত গোমরাহী ছিলোনা। পক্ষান্তরের বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমানেরা সঠিক ইসলামী ঈমান আকিদাহ কি জানেনা। এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মুসলমান আছে যারা নিজেদেরকে পাক্কা ঈমানদার মনে করে কিন্তু তারা “আল্লাহ সর্ব জায়গায় বিরাজমান” এমন কুফুরী বিশ্বাস পোষণ করে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, হাফেজ মাওলানা, মুফতি মুহাদ্দিস, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী লোকেরা মসজিদ মাদ্রাসায় বসে উম্মতের লোকদেরকে তোতা পাখির বুলির মতো শিক্ষা দিচ্ছে “আল্লাহ সর্ব জায়গায় বিরাজমান”, আর সরলমনা মুসলমানেরা তাদেরকে আলেম মনে করে, তাদের কথা বিশ্বাস করে এমন কুফুরী আকিদাহকে মেনে নিচ্ছে। মিশরের বাদাভী নামক একজন লোকের মাজার আছে যেখানে দশ লক্ষের অধিক লোক যার তার পূজা করার জন্য। বাংলাদেশের চাঁদপুরে লেংটা বাবার মাজারে দশ লক্ষের অধিক লোক যার তার পূজা করার জন্য। পাকিস্থানে লাল শাহবাজে লক্ষ লক্ষ লোক যায়, ভারতে আজমীরে কোটি কোটি লোক যায়, ইরান ও ইরাকের শিয়াদের ধর্মই হচ্ছে কবর পূজা। এমনিভাবে বর্তমান যুগের কোটি কোটি মানুষ নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে কুফুরী বা শিরকি বিশ্বাস রাখে। এমন শিরকি বিশ্বাস থাকলে আল্লাহ বর্তমান যুগের মুসলমানদেরকে কি সাহায্য করবেন? নাকি তাদের উপর বিভিন্ন আযাব-গজব চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে দুনিয়াবী শাস্তি দিয়ে পেরেশানির মাঝে রাখবেন?
(৪) সাহাবীরা রাতের বড় একটা অংশ নফল সালাত আদায় করে কাটাতেন। আর বর্তমান যুগের মুসলমানেরা পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করেনা।
(৫) এমনিভাবে বললে এই লিস্ট অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে যে, বর্তমান যুগের মুসলমানেরা দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যেকারণে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াবী শাস্তি ও কাফেরদের পক্ষ থেকে অত্যাচার নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে।
(৬) সুতরাং, কোন মুসলমান যদি চায় সে মুসলমানদের এই দুরবস্থা থেকে তাদেরকে সাহায্য করবে, সে যেন নিজেকে পবিত্র করে, হারাম, পাপাচার ও আল্লাহর অবাধ্যতা বর্জন করে আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হয়। প্রতিটি মুসলমান যেনো নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে সংশোধন করে দ্বীনের পথে আনার চেষ্টা করে। অতঃপর সে তার অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা অন্য মুসলমানদেরকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজের নিষেধ করে।
(৭) বর্তমানে মুসলমানদের দুরবস্থার কথা সবাই জানে, কিন্তু সমাধান জানেনা। সেকারণে মুসলমান উম্মাহর মাঝে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেই। কথিত জিহাদীরা নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে। তাদের সমাধানের পদ্ধতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সম্মানিত সাহাবীদের বিপরীত। একারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে কথিত এই জিহাদীরা সাহায্য পায়না। বরং কথিত এই জিহাদীরা যেই দেশে প্রবেশ সেই দেশের মুসলমানদের অবস্থা পূর্বের চাইতে আরো খারাপ হয়। আলজেরিয়ায়, মিশর, তিউনিয়াসিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া এমন অনেক দেশেই কথিত জিহাদীদের কারণে মুসলমানদের বিপদ ও দুর্দশা পূর্বের চাইতে অনেকগুণে বেড়ে গেছে। যদিও কথিত জিহাদীরা নিজেদেরকে হক্কপন্থী বলে মনে করছে। আল্লাহ এমন পথভ্রষ্ট লোকদের ফিতনাহ ও অনিষ্ট থেকে মুসলিমদেরকে হেফাজত করুন, আমিন।
(৮) উল্লেখ্য, বিষয়টি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানার জন্য আপনারা এই লেখাটি পড়ুনঃ
“বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহর দুর্দশা নিয়ে শায়খ ফাউজানের গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া”
Overview
0 Comments