বাংগালীর সৌদি বিদ্বেষ পর্বঃ--৩


  • বাংগালীর সউদি বিদ্বেষ পর্বঃ--৩  

  • ➖➖➖➖➖➖➖ ➖➖➖➖

  • শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের পিতা তাঁর সংস্কার কার্যক্রমে বাধা প্রদান করেছিলেন৷ তাঁর ভাই সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাব শায়খের সমালোচনা করে "আস্ সওয়ায়েকুল এলাহিয়াহ্ ফিরর্রদ্দে আলাল ওয়াহ্হাবিয়াহ্" নামক একটি বই লেখেন৷ উয়ায়নার আমীর ওসমান বিন হামদ বিন মোআম্মার যিনি শায়খের বন্ধু এবং আত্মীয় ছিলেন তিনি শায়খকে তার এলাকা থেকে বের করে দেন৷

  • আমাদের দেশে যারা শায়খের বিরোধীতা করেন, তারা সাধারণত শায়খকে খেলাফত ধ্বংসের জন্য দোষারোপ করেন৷ কেউ কেউ ঊনাকে বৃটিশদের দালালও বলে থাকেন, কেউ ঊনার বিরূদ্ধে ইসলাম ধ্বংসের অভিযোগও করে থাকেন, কেউ আবার ঊনাকে জঙ্গীবাদী (সন্ত্রাসবাদী) আখ্যা দিয়ে থাকেন৷ শায়খের বিরোধীতাকারীদের জবাব দেওয়ার আগে ওসমানী খেলাফতের সময় ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু আরবে কি হচ্ছিলো আমরা সেই চিত্রগুলো একটু দেখে নেই—

  • জাবিলায় ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ যায়দ বিন খাত্তাব এর কবরে পূজা হচ্ছিল৷ গোবায়রা উপত্যকায় জেরার বিন আজদরের কবর বিদ'আতের প্রদর্শনীতে পর্যবসিত হয়েছিলো৷ বলিদাতুল ফিদা নামক স্থানে বান্ধ্যা নারীরা সন্তান লাভের আশায় একটি প্রাচীন বৃক্ষের সাথে আলিঙ্গন করত৷ দরঈয়াতে কোন কোন সাহাবার কবর জাহেলী আকীদাসমূহের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিলো৷ দরঈয়ার নিকটবর্তী একস্থানে একটি গুহায় লজ্জাকর ব্যভিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো৷ এক কথায় বলতে গেলে আরবের অনেকেই নৈতিক সীমা অতিক্রম করে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে যাচ্ছিলো৷ পরিতাপের বিষয় এই যে, সব কিছুই ইসলামের নামে হচ্ছিলো৷

  • শতাব্দীব্যাপী শিরক ও বিদআ'তে লিপ্ত থাকায় শিরকী আকীদাসমূহ তাদের অন্তরে এরূপ বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের বিরাট একটা অংশ এসব অনাচারকেই আসল দ্বীন বা প্রকৃত ইসলাম বলে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলো৷ পক্ষান্তরে যে কতিপয় আলেম ফীকহ এবং হাদীস সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তারা সত্য প্রচারের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন৷ মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব যখন এসব অনাচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন তখন অনেকেই তাঁর শত্রু হয়ে যায়৷ তাঁর আত্মীয় এবং আপনজনেরা তাকে বিপদে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়৷

  • আবদুল ওয়াহাব ছিলেন সেই সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম, তিনি হুরায়মালার কাজী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি শায়খের ওস্তাদও৷ তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি শায়খের পিতা৷ সন্তান যত বড়ই হোক সব পিতাই সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে৷ শায়খের পিতাও এই মানবিক গুণের উর্ধ্বে ছিলেন না৷ শায়খের জীবনের কথা চিন্তা করে তাঁর পিতা আতংকিত হলেন৷ পিতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শণপূর্বক শায়খ দাওয়াতের গতি কিছুটা মন্থর করেন কিন্তু পশ্চাদপসরণ করলেন না৷ পিতার মৃত্যুর পর তিনি অবিরাম গতিতে দাওয়াতের কাজ শুরু করেন৷

  • শায়খের পিতার মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাব হুরায়মালার কাজী হন৷ প্রথম দিকে তিনিও শায়খের বিরোধীতা করেন এবং তাঁর সংস্কার কার্যক্রমের সমালোচনা করে পুস্তক প্রণয়ন করেন৷ সোলায়মানের বিরোধীতা তীব্র আকার ধারণ করলে শায়খ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের সমবেত করে তাঁর সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করেন৷ জ্ঞান পিপাসু ছাত্ররা দলে দলে শায়খের নিকট আসতে শুরু করে৷ এসব যুবকেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে শায়খের বিভিন্ন উপদেশমূলক বক্তব্য, আন্দোলনের উদ্দেশ্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে৷ সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাব তাঁর ভুল বুঝতে পেরে স্বীয় ভ্রাতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন৷

  • দাওয়াতের প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করার পর শায়খ অনুভব করলেন, মুসলিম জাহানের প্রত্যেক প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন শাসনকর্তা থাকায় আন্দোলনে সাফল্য লাভ কঠিন হবে৷ অবস্থা এমন ছিলো যে হুরায়মালার মত ছোট্ট একটি ভূখন্ডের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দু'টি গোত্র পরষ্পর দ্বন্ধে লিপ্ত ছিলো৷ তিনি অনুভব করলেন কোন শাসনকর্তার সহযোগিতা না পেলে আন্দোলন সর্বত্র দ্রুত সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে না৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উয়ায়নার শাসনকর্তা আমীর ওসমান বিন হামদ্ বিন মোআম্মাররে সাথে পত্র বিনিময় করলেন, এবং আমীরকে সত্য গ্রহণে সম্মত দেখে উয়ায়নায় হিজরত করলেন৷ সেখানে তিনি জওহরা বিনতে আবদুল্লাহ বিন মোআম্মারের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন৷

  • উয়ায়নানাতে শায়খের আন্দোলন ও সংস্কার প্রচেষ্টা যখন সাফল্য ও পূর্ণতা লাভের পথে অগ্রসর হচ্ছিলো এমন সময় সেখানে একটি ঘটনা ঘটলো৷ জনৈকা বিবাহিত নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হলে শায়খ প্রস্তারাঘাতে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন৷ এই ঘটনায় দূর্বল চিত্তের মুসলমান বিশেষ করে যারা ব্যভিচারে অভ্যস্ত তাদের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়৷ তাদের একদল এহ্ছা ও কোতায়ফের শাসনকর্তা সোলায়মান বিন মোহাম্মদ আজিজুল হুমায়দীর নিকট গমন করে তাকে শায়খের বিরূদ্ধাচরণে প্রস্তুত করে৷ এ লোকটি উচ্ছৃঙ্খল এবং লম্পট প্রকৃতির ছিলো৷

  • তার আশংকা ছিলো মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব তার রাজ্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন৷ ফলে সে উত্তেজিত হয়ে শায়খকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে আমীর ওসমানের নিকট পত্র লিখলো৷ আমীর ওসমান সোলায়মান হুমায়দীর নিকট হতে মোটা অংকের বাৎসরিক সাহায্য পেত৷ ফলে ওসমানের উপর এর দারুণ প্রভাব পড়লো৷ সে শায়খকে উয়ায়নানা থেকে চলে যেতে বললো৷

  • উয়ায়নানা হতে শায়খ দরঈয়ায় হিজরত করেন৷ দরঈয়ার আমীর মোহাম্মদ বিন সউদ অতি চরিত্রবান বলে বিখ্যাত ছিলেন৷ তাঁর স্ত্রী মোজা বিনতে আবু দাহতান অতি বিদুষী এবং ধর্মপরায়না ছিলেন৷ তিনি স্বামী আমীর মোহাম্মদ বিন সউদকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, "আল্লাহ আপনার নিকট নেয়ামত হিসেবে শায়খকে প্রেরণ করেছেন৷ তাঁকে সাহায্য সহায়তায় করুন, ইনশাআল্লাহ আপনার ইহকাল ও পরকাল কল্যাণকর হবে৷"

  • স্ত্রীর কথাগুলো তাঁর অন্তরে দাগ কাটলো৷ তিনি শায়খের সাথে দেখা করলেন৷ মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত শিরক, বিদআ'ত, অনাচার এবং এসব প্রতিরোধে করনীয় বিষয় নিয়ে শায়খ তাকে নাতিদীর্ঘ উপদেশ প্রদান করেন৷ শায়খের তেজোদৃপ্ত ভাষনে অভিভূত হয়ে আমীর তখনই বললেন, "হে শায়খ! আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের মনোনীত সঠিক দ্বীনের পথে আমি আপনার অনুসরণ করবো৷ এমনকি তাওহীদের বিরোধীদের সাথে জিহাদ করতেও আমি প্রস্তুত৷ তবে আমার দু'টি শর্ত আছে:—

  • ১. আমরা যদি আপনাকে সহায়তা করি এবং আল্লাহ যদি আমাদের বিজয়ী করেন, তাহলে আপনি আমাদের পরিত্যাগ করবেন না৷

  • ২. ফসল তোলার সময় দরঈয়াবাসীর নিকট হতে আমি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আদায় করে থাকি, আপনি তাতে বাধা দিবেন না৷"

  • জবাবে শায়খ বললেন, "আপনার প্রথম শর্ত সর্বান্তঃকরনে গ্রহণ করছি৷ আমাদের ভালো-মন্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলো৷ আর দ্বিতীয় শর্ত সম্পর্কে বক্তব্য এই যে, আল্লাহ বিজয়ী করলে গণীমতের এত সম্পদ হস্তগত হবে যে, ইনশাআল্লাহ সামান্য কর গ্রহণের ধারণাও আপনার মনে জাগবে না৷"

  • শায়খ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মোহাম্মদ বিন সৌদ গণীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ ও যাকাতের সমস্ত অর্থ শায়খের নিকট প্রদান করতেন এবং শায়খ তা আল্লাহর পথে নিঃসঙ্কোচে ব্যয় করতেন৷ মোহাম্মদ বিন সউদের ইন্তেকালের পর তাঁর স্থলাভিষক্ত আমীর আবদুল আজীজ বিন মুহাম্মদ বিন সউদ শায়খের অনুমতি ছাড়া কোনরূপ ব্যয় করা জায়েয মনে করতেন না৷

  • ঐতিহাসিক ইবনে বিশর বলেন, "গণীমত এবং যাকাতের যে অর্থ পেতেন শায়খ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে দিতেন৷ ফলে শায়খ সর্বদা ঋণী থাকতেন৷ রিয়াদ বিজয়ের সময় শায়খের ঋণের পরিমাণ ছিল চল্লিশ হাজার যা পরে গণিমতের মাল থেকে পরিশোধ করা হয়৷" রিয়াদ বিজয়ের পর যখন আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে শায়খ আশ্বস্ত হলেন, তখনই তিনি আবদুল আজীজ বিন মুহাম্মদ বিন সউদকে সর্ব বিষয়ে দায়িত্ব প্রদান করে নিজে বায়তুল মালের দায়িত্ব হতে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি লাভ করলেন৷

  • এভাবে একজন আলেম, একজন আল্লাহভীরু শাসক এবং একজন ধর্মপরায়না নারী এই ত্রয়ীর নেক নিয়্যতের সমন্বয়ে দরঈয়া আমিরাত (বর্তমান সৌদী আরব) নামক রাষ্ট্রটির বীজ বপিত হয়৷ [বিস্তারিতঃ শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব, মূল লেখকঃ আল্লামা মাসউদ আলম নদভী, অনুবাদঃ মুনতাসীর আহমদ রহমানী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ৯০, হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেন, বংশাল, ঢাকা]

  • অনেকেই বৃটিশ সম্রাজ্যের উত্থানের জন্য সৌদীকে দায়ী করে, আবার কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যে সৌদী তার সম্রাজ্যবাদ বিস্তার করছে বলে অভিযোগ করে থাকেন৷ আমরা যদি গ্রীক, রোমান, মিশরীয় সভ্যতা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত্য পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, পৃথিবী কখনো সম্রাজ্যবাদ মুক্ত ছিলো না৷ প্রতিটি রাষ্ট্র কোন না কোন সম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে৷ এক সম্রাজ্যের পতন হচ্ছে তো, আরেক সম্রাজ্যের উত্থান হচ্ছে৷ "সম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক" জাতীয় স্লোগান কিছু লোকের উর্বর মস্তিষ্কের কাল্পনিক ফসল৷

  • রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে সম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন৷ আমরা সাধারণভাবে সম্রাজ্যবাদ বলতে বুঝি, রাজ্য বিস্তার বা অন্য রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা৷ সম্রাজ্যবাদ জায়েজ কি নাজায়েজ এই বিতর্কে যাওয়ার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে মুসলিম সম্রাটগণ অস্ত্র দিয়ে পথ পরিষ্কার করেছেন, আলেমগণ জ্ঞানের আলো দিয়ে মানুষকে পথ দেখিয়েছেন৷ তাই মুসলিম রাজা, বাদশাহ, সম্রাটদের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই৷ এক সময় পৃথিবীজুড়ে মুসলিম সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিলো, গত শতাব্দী ছিলো বৃটিশদের, বর্তমান সময় আমেরিকার এর পর কার উত্থান হয় সেটা দেখার বিষয়৷

  • যারা বৃটিশ সম্রাজ্যের উত্থানের জন্য আল সৌদ পরিবারকে দায়ী করেন, তাদেরকে যদি প্রশ্ন করি আল সৌদ পরিবার মোট কত বার ক্ষমতায় এসেছে? সেক্ষেত্রে অনেকেই ভুল উত্তর দিয়ে থাকেন৷ আল সৌদ পরিবার মোট তিন তিনবার সৌদী আরবের ক্ষমতায় এসেছে৷

  • মোহাম্মদ বিন সৌদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম রাষ্ট্রটির নাম ছিলো, "দরঈয়া আমিরাত"৷ এর স্থাযিত্ব ছিলো ১৭৪৪-১৮১৮ সাল পর্যন্ত৷ মিশরের উসমানীয় শাসক মুহাম্মদ আলি পাশার আক্রমনে প্রথম সৌদি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় সৌদী রাষ্ট্রের নাম ছিলো "নজদ আমিরাত"৷ ১৮২৪ সালে তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সৌদ মিশরীয়দের কাছ থেকে নজদ (রিয়াদ) পুনরায় দখল করে নেন। ১৮৯০ সালে রশিদিরা রিয়াদ দখল করে নেয় এবং আল সৌদের সদস্যদের পরাজিত করে। রশিদিরা ছিল আরব উপদ্বীপের জাবাল শামার আমিরাত নামক রাষ্ট্রের শাসনকারী রাজবংশ। রিয়াদের উত্তরের হাইল শহর ছিল আল রশিদিদের রাজধানী৷

  • তৃতীয় রাষ্ট্রটি হলো বর্তমান "সৌদী আরব"৷ ১৯০২ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্র, শেখ শাসনাধীন এলাকা ও রাজ্য জয় করে একত্রীকরণ সম্পন্ন করার মাধ্যমে আধুনিক সৌদি আরব জন্মলাভ করে। এতে নেতৃত্ব দেন আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান বিন ফয়সাল বিন তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সৌদ৷

  • আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান যখন আরব উপদ্বীপের ছোট ছোট গোত্র এবং রাজ্যগুলো একত্র করছিলেন তখন খেলাফতের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত নাজুক৷ খেলাফতের অধীনে থাকা আরব উপদ্বীপের রাজ্যগুলো বৃটিশ, ফরাসীদের দখলে চলে যাচ্ছিলো, আবার কেউ কেউ নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করছিলো৷ খেলাফতের অধীনে হুসাইন বিন আলি ছিলেন মক্কার আমীর৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি উসমানীয় খেলাফতের বিরূদ্ধে আরব বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং নিজেকে মক্কার বাদশাহ ঘোষণা করেন৷

  • তুরষ্কের খেলাফত বিলুপ্ত হলে হুসাইন বিন আলি নিজেকে "খলিফাতুল মুসলিমীন" (মুসলমানদের খলিফা) ঘোষণা করেন৷ ১৯২৫ সালে এই স্বঘোষিত খলিফাকে পরাজিত করে আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান হেজাযের ক্ষমতায় আসেন৷ বৃটিশদের সহযোগিতায় হুসাইন বিন আলির ছেলে ফয়সাল বিন হুসাইন প্রথমে সিরিয়া এবং পরে ইরাকে হাশেমী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন৷

  • প্রথম এবং দ্বিতীয় সৌদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের দিকে আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো তখনো মধ্যপ্রাচ্যে বৃটিশদের উত্থান অত প্রবল হয়নি৷ তৃতীয় সৌদী রাষ্ট্রের সময় আরবের রাষ্ট্রগুলো ছিলো এলোমেলো যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে (সিরিজের ১৬ তম পর্বে এ ব্যাপারে সামান্য বলেছি)৷ আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান কিন্তু খেলাফত থেকে হেজাযের ক্ষমতা দখল করেনি৷ হাশেমী রাজতন্ত্রের ফয়সাল বিন হুসাইনের মত আল সৌদ পরিবারের কেউ বৃটিশদের সহযোগিতায় রাজা হয়নি৷ তাহলে বৃটিশদের নামটা কিভাবে এলো?

  • ১৯১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর আবদুল আজিজ ও বৃটিশ সরকারের মধ্যে পারস্য উপসাগরের দারিন দ্বীপে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, একে "দারিন চুক্তি" বলা হয়৷ ১৯২৭ সালের ২০ মে স্বাক্ষরিত জেদ্দার চুক্তি দারিনের চুক্তির স্থলাভিষিক্ত হয়। এতে তৎকালীন নজদ ও হেজাজ রাজতন্ত্র বলে পরিচিত সমগ্র অঞ্চলে আবদুল আজিজের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়। এর বিনিময়ে আবদুল আজিজের সেনাবাহিনী প্রতিবেশী বৃটিশ আশ্রিত রাষ্ট্রসমূহে আক্রমণ করবে না বলে সম্মতি প্রদান করা হয়৷ ইতিহাসে এধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার উদাহরণ ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে৷

  • আমি কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী না, আমার দৃষ্টিতে যে কোন সরকার তিনটি সু সম্পর্কের উপর টিকে থাকে, ১.জনগণ, ২. প্রশাসন, ৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গন৷ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম না হওয়া পর্যন্ত জনগণ সরকারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে না, তাই সরকারের উত্থান-পতনে জনগণের ভূমিকা গৌণ৷ প্রশাসন যতক্ষণ নিয়ন্ত্রণে আছে ততক্ষণ জনগণ সরকারের কিছুই করতে পারবে না৷ জনগণ এবং প্রশাসন শতভাগ সরকারের পক্ষে থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু রাষ্ট্র না থাকলে সরকারের পতন অনিবার্য৷

  • বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফেঁসে গেছে৷ আমরা যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা দেখি, একজন মুয়াজ্জিনকে তার সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে হয় অসামাজিক মাতাল মেম্বারকে৷ একজন ইমামের চারিত্রিক সনদপত্র আনতে হয় চরিত্রহীন চেয়ারম্যান থেকে৷ একজন মুফতির শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র সত্যায়িত করতে হয় ঘুষখোরের কাছে৷ বিশ্বজুড়ে এখন এই রাজনীতি চলছে৷ সমাজে খারাপ চরিত্রের মোড়ল শ্রেণীর অনেক লোক আছে আত্মরক্ষার্থে যাদের সাথে আমরা সুসম্পর্ক রাখি, এর মানে এই নয় যে তারা আমাদের বন্ধু৷ আমরা অপেক্ষা করছি সুসময়ের৷

  • মুসলিম বিশ্বের এই দূর্দিনে যারা অসৎ উদ্দেশ্য সৌদী বিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত আছে, তাদের কিছু বলার নেই৷ কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য সৎ তাদের মনে রাখতে হবে, গত একশ বছরে মাত্র দু'টি রাষ্ট্র সিংহভাগ কোরআন এবং সুন্নাহ অনুসারে পরিচালিত হয়েছে একটি আল সৌদ পরিবার শাসিত সৌদী আরব, অন্যটি তালেবান শাসিত আফগানিস্তান৷ আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনীতির সাথে খাপ খাইয়ে মিশতে পারেনি, এছাড়া তালেবানদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারনে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি৷

  • যারা আল সৌদ পরিবারের বংশানুক্রমে শাসনকে বাঁকা চোখে দেখেন, সেসব ভাইরা একটু ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে দেখবেন ইসলামের পূর্ব থেকে পৃথিবীতে বংশানুক্রমে শাসন ব্যবস্থা চলে আসছে৷ খোলাফায়ে রাশেদীনের পর থেকে বংশানুক্রমেই খেলাফত ব্যবস্থা চলে আসছে৷ নবুওয়তের যে ধারা তাও বংশানুক্রমে৷ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পর পৃথিবীর যত নবী এসেছেন সবাই ছিলেন ঊনার বংশধর৷ কেউ ভাববেন না আমি নবুওয়ত এবং রাজনীতি এক করে দেখছি, আমি শুধু বংশগত গুণাবলীর ধারা বোঝাতে চেয়েছি৷ সাহাবীর ঘরে সাহাবীই হয়েছে, আলেমের ঘরে আলেম হয়, কেনানের মত দূর্ভাগা খুব কমই হয়৷ উত্তরাধিকার সূত্রে শাসক হওয়াকে ঘৃণার চোখে দেখা আমরা কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি কে আল্লাহর ওয়াস্তে বিলিয়ে দেই না, বরং সেগুলো কিভাবে দ্বীগুণ করা যায় সে চিন্তায় মশগুল থাকি৷

  • পাঠকদের এখানে আরেকটু লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন খেলাফতের শাসনামলে স্পেন, বাগদাদ, কায়রোতে যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে হেজাযে কিন্তু উল্লেখ করার মত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি৷ আমি খেলাফতের শাসকদের দোষারোপ করছি না৷ বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের মদীনায় আগমন, "সাপ যেভাবে গর্তে ফিরে আসে, ইসলাম সেভাবে মদীনায় ফিরে আসবে" রাসূল (সাঃ) এর বাণীকে ইঙ্গিত করছে কি না সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে বলছি৷

  • আল সৌদ পরিবারের বাদশাহগণ নিজেদের খলিফা নয় খাদেম হিসেবে পরিচয় দেন৷ সৌদী রাজার উপাধী "খাদেমুল হারামাইন" অর্থাৎ দুই হারাম শরীফের (মক্কা-মদীনা) খাদেম৷ আধ্যাত্মিক ভাবে মক্কা এবং মদীনা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন এবং এটা নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কোন কারন নেই৷ তিনি যাকে পছন্দ করবেন তার হাতেই এর সেবা করার দায়িত্ব দিবেন৷ বাহ্যিকভাবে আমরা যদি ভাবি, বর্তমানে আল সৌদ পরিবারের বাইরে এমন কোন শাসক বা ব্যক্তি আছে কি যার হাতে আমরা মক্কা-মদীনার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত হতে পারি?

  • আমাদের দেশের অনেক বক্তা ওয়াজ মাহফিলের মাঠে শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (রহঃ) এবং মোহাম্মদ বিন সৌদ সম্পর্কে প্রচুর অপপ্রচার করে থাকেন এদের মাঝে একদল হলেন সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাবের মত, যারা শায়খের আন্দোলন সম্পর্কে স্পষ্ট জানেন না৷ আরেক শ্রেণী হলো সোলায়মান বিন মোহাম্মদ আজিজুল হুমায়দীর মত জাহেল, যারা সাধারণ মানুষের অবচেতন মনে সুক্ষ্মভাবে সৌদী বিদ্বেষী বীজ বপন করে চলেছে৷

  • সিরিজের পূর্বের লেখাগুলোতে দ্বিতীয় পক্ষের লোকগুলো সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিয়েছি৷ এদের সম্পর্কে এর বেশি বলতে গেলে ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে৷ কারো সাথে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, যারা জানতে চায় তাদের জন্যই লেখাগুলো৷ যারা শুধুমাত্র দ্বীনের স্বার্থে সৌদী বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন, তারা বর্তমান ফিতনার যুগে কোন ধরনের দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং সে রকম দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন একটি দেশের নাম বলবেন কি?

  • একই সমাজে কেউ গাঁজা খায়, কেউ হিরোইন খায়, কেউ ফেন্সিডেল খায়, কেউ ইয়াবা খায়, কেউ পান খায় একেকজন একেক নেশায় জড়িত৷ এর মাঝে আপনি কাকে ভালো বলবেন? নিশ্চয়ই পানখোরকে৷ বর্তমান মুসলিম বিশ্বের এমন কোন রাষ্ট্র আছে কি, যারা কোরআন এবং সুন্নাহর ক্ষেত্রে সৌদী আরবের চেয়ে অগ্রসর আছে? হ্যাঁ, আমরা তাদের আরো ভালো করতে বলতে পারি কিন্তুু তার পূর্বেতো আমাদের ইয়াবার নেশা ছাড়তে হবে৷

  • (কলাম--->>সাইদুর রহমান।)