আমাদের মুছলিম সমাজে কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, শাসকদেরকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করা এবং তাদের প্রতি জনসমক্ষে অনাস্থা ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা, এটা হলো ছালাফে সালিহীনের নীতি ও আদর্শ। এ বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ তারা বলে থাকেন যে, সাহাবী আবু ছা‘য়ীদ খুদরী (রা:) ‘ঈদের নামাযের পূর্বে এক খুতবায় মারওয়ান বিন হাকামকে (তৎকালীন শাসক) প্রত্যাখ্যান করেছেন।
✍ এছাড়া রাছূল (সা:) বলেছেন:-
إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ، فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ، فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ، وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ.১
অর্থ- নিশ্চয় তোমাদের এমন অনেক নেতা-কর্তা হবে যাদের মধ্যে তোমরা অনেক ভালোও দেখতে পাবে এবং অনেক মন্দও দেখতে পাবে। সুতরাং যে তাদের মন্দ কাজগুলোকে ঘৃণা করবে, সে নিষ্কৃতি পাবে। (অর্থাৎ সে তিরস্কৃত হবে না) এবং যে সেই মন্দ কাজগুলোকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করবে, সে নিরাপদ থাকবে।২
✍ আরো দেখা যায়, রাছূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:-
أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ.৩
অর্থ- অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলা হলো সর্বোত্তম জিহাদ।৪
এসব প্রমাণাদীর ভিত্তিতে তারা দাবি করেন যে, শাসককে প্রকাশ্যে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা হলো ছালাফে সালিহীনের নীতি ও আদর্শ।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তাদের এ দাবিটি কি সঠিক?
যদি সঠিক হয়, তাহলে উপরোল্লেখিত বর্ণনাগুলো এবং “যদি কেউ কোন শাসনকর্তাকে সুদপদেশ দিতে চায়, তাহলে সে যেন জনসমক্ষে তা না করে, বরং সংগোপনে করে” ইবনু আবী ‘আসিম কর্তৃক ‘ইয়ায ইবনু খাল্ফ এর সূত্রে বর্ণিত রাছূল এর এই হাদীছের মধ্যে আমরা কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করব? কিংবা শাসকদের ব্যাপারে আমরা কোন নীতি অবলম্বন করব?
এ প্রশ্নের উত্তরে আল ‘আল্লামা আশ্শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ্ আল ‘উছাইমীন (রহ:) বলেছেন:- এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়াটাও অত্যন্ত প্রয়োজন। হ্যাঁ, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, অসৎ বা খারাপ কাজ প্রত্যাখ্যান করা এবং এর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা প্রত্যেক সক্ষম ও সামর্থবান লোকের কর্তব্য।
✍ এ সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.৫
অর্থাৎ- আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকাজের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে খারাপ কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।৬
আয়াতে উল্লেখিত “ولتكن” শব্দের লাম অক্ষরটি নির্দেশ সূচক।
✍ হাদীছে বর্ণিত রয়েছে, রাছূল (সা:) বলেছেন:-
لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ، وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَلَتَأْخُذُنَّ عَلَى يَدَيِ الظَّالِمِ، وَلَتَأْطُرُنَّهُ عَلَى الْحَقِّ أَطْرًا، أَوْ لَيَضْرِبَنَّ اللهُ قُلُوبَ بَعْضِكُمْ عَلَى بَعْضٍ، ثُمَّ لَيَلْعَنَنَّكُمْ كَمَا لَعَنَهُمْ.৭
অর্থ- তুমি অবশ্যই ভালো কাজের নির্দেশ দিবে এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করবে। অত্যাচারীর হাতকে রুখে ধরবে এবং তাকে সত্যের দিকে ফিরিয়ে দিবে। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের অন্তরে বিভক্তি ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিবেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অভিসম্পাত (লা‘নাত) করবেন, যেমন তিনি তাদেরকে অভিসম্পাত করেছিলেন (অর্থাৎ যে ভাবে আল্লাহ 0 বানী ইছরাঈলকে অভিসম্পাত করেছিলেন)।৮
✍ বানী ইছরাঈল সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ. كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ.৯
অর্থাৎ- বানী ইছরাঈলের মধ্যে যারা কাফির তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়ামের পুত্র ‘ঈছার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে, এটা এ কারণে যে তারা অবাধ্যতা করতো এবং সীমালঙ্ঘন করতো। তারা যেসব মন্দ কাজ করত সে বিষয়ে পরস্পরকে নিষেধ করতো না, তারা যা করতো তা অবশ্যই খুব মন্দ ছিল।১০
যাই হোক, আমাদের জেনে রাখা একান্ত আবশ্যক যে, শারী‘য়াতের এমন কতক নির্দেশাবলী রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের বিশেষ কিছু প্রেক্ষাপট ও ক্ষেত্র রয়েছে (যে নির্দেশগুলো সাধারণভাবেভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)। এসব নির্দেশ পালনে হিকমাত ও প্রজ্ঞার সাথে কাজ করা একান্ত প্রয়োজন। উল্লেখিত বিষয়েও আমাদেরকে প্রজ্ঞার সাথে কাজ করতে হবে।
শাসকদের ব্যাপারে যখন আমরা দেখব যে, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা সমালোচনা দ্বারা তাদেরকে অসৎ বা মন্দ কাজ থেকে নিবৃত করা যাবে, তাদের খারাপ কাজ বন্ধ করা যাবে এবং তাদের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে ইছলাম ও মুছলমানের স্বার্থের অনুকূলে ভালো কোন ফলাফল লাভ করা যাবে, তাহলে এমতাবস্থায় আমরা প্রকাশ্যে জনসমক্ষে শাসকদের অন্যায় ও মন্দ কাজের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাব এবং তাদেরকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করব। আর যদি দেখা যায় যে, প্রকাশ্যে সমালোচনা বা প্রতিবাদ তাদের মন্দ কাজগুলো বন্ধ করতে পারবে না কিংবা তাদেরকে অসৎ কাজ থেকে নিবৃত করতে পারবে না, কিংবা প্রকাশ্য প্রতিবাদ ও সমালোচনা দ্বারা কোন সুফল লাভ করা যাবে না, বরং তাতে যারা সৎকাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজে নিষেধ করেন, তাদের প্রতি শাসক বা শাসকবৃন্দের ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে, তাহলে এমতাবস্থায় উত্তম পন্থা হলো- প্রকাশ্যে জনসমক্ষে প্রতিবাদ না করে বরং শাসকের নিকট গোপনে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার মন্দ ও অপকর্মের প্রতিবাদ জানানো। সুতরাং এই দৃষ্টিতে বলা যায় যে, প্রশ্নে উল্লেখিত প্রমাণগুলো পরস্পর সামঞ্জ্যশীল। কারণ একটিতে আমরা দেখছি যে, প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে প্রতিবাদ বা সমালোচনা একটি খারাপ কাজের অবসান ও বিলুপ্তি ঘটাতে পারছে এবং মুছলমানদের জন্য সুফল বয়ে আনছে। আর অপরটিতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে প্রতিবাদ বা সমালোচনার দ্বারা ইছলাম ও মুছলমানের একদিকে যেমন কোন উপকার সাধিত হচ্ছে না, তেমনি তদ্বারা অসৎ ও মন্দ কাজ বা কার্যাবলী দমন কিংবা বন্ধ করা যাচ্ছে না, বরং হিতে বিপরীত হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো- রাছূল (সা:)এর নিম্নোক্ত হাদীছ অনুযায়ী ‘আমাল করা।
✍ রাছূল(সা:) ইরশাদ করেছেন:-
مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْصَحَ لِذِي سُلْطَانٍ فَلا يُبْدِهِ عَلانِيَةً ، وَلَكِنْ يَأْخُذُ بِيَدِهِ فَيَخْلُوا بِه.১১
অর্থ- যদি কেউ শাসনকর্তাকে সদুপদেশ দিতে চায় তাহলে সে যেন প্রকাশ্যে তা না করে বরং গোপনে তাকে সদুপদেশ প্রদান করে।১২
তাই আমরা বলব যে, প্রশ্নে উল্লেখিত প্রমাণ ও বর্ণনাগুলো একটি অপরটিকে যেমন বাত্বিল করছে না, তেমনিএগুলো পরস্পর বিরোধী বা সাংঘর্ষিক নয়। বরং প্রতিটি বর্ণনাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সঠিক এবং পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ তখনই করা যাবে, যখন দেখা যাবে যে, তাতে মন্দ-অসৎ কর্ম বন্ধ হবে এবং সৎকর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। মোটকথা, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ কেবল তখনই করা যাবে যখন দেখা যাবে যে, এর দ্বারা ইছলাম ও মুছলমানের বিশেষ কোন উপকার বা কল্যাণ সাধিত হবে।
আর যদি দেখা যায় যে, শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা সমালোচনা কোন সুফল বয়ে আনবে না, এর দ্বারা মন্দ-অসৎ কর্ম বন্ধ করা যাবে না কিংবা এর স্থলে ভালো ও সৎকর্ম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, মোটকথা এর দ্বারা ইছলাম ও মুছলমানের কোন উপকার বা কল্যাণ সাধিত হবে না, তাহলে এক্ষেত্রে প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে প্রতিবাদ-সমালোচনা না করে কিংবা তাকে (শাসনকর্তা-কে) প্রত্যাখ্যান না করে বরং গোপনে-একান্তে শাসক-কে সুদপদেশ প্রদান করতে হবে।
আমরা জানি যে, কোন শাসনকর্তা কখনও সকল লোককে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন না। শাসকরা তো দূরের কথা, মাছজিদের একজন ইমাম সাহেবও তাঁর পিছনে সালাত আদায়কারী সকল মুক্বতাদীকে খুশি রাখতে পারেন না। কিছু সংখ্যক মুক্বতাদীর অভিযোগ থাকে যে, ইমাম সাহেব সালাত বেশি দীর্ঘায়িত করেন। আবার কিছু সংখ্যকের অভিযোগ থাকে যে, তিনি সালাত খুব সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন। কিছু সংখ্যক লোক একটু আগে-ভাগে নামায আদায় করে নিতে চান, আবার কেউ চান একটু বিলম্বে নামায পড়তে। সুতরাং যেখানে মাছজিদের একজন ইমামের পক্ষে তার সকল মুক্বতাদীকে খুশি রাখা সম্ভবপর হয় না, সেখানে একজন শাসনকর্তার পক্ষে; যার দায়িত্বের পরিধি একজন ইমামের তুলনায় অনেকগুণ বেশি ব্যাপক ও বিস্তৃত, তার পক্ষে তার অধিনস্থ সকল লোককে খুশি রাখা কি করে সম্ভব হবে? এ বাস্তবতা ও সত্যটি উপলদ্ধি করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
এরই সাথে সাথে আমাদেরকে এ বিষয়টিও বুঝতে হবে যে, যদি কেউ প্রকাশ্যে শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, কিংবা জনসমক্ষে তাদের প্রতিবাদ জানায়, তাহলে যারা মুছলিম উম্মাহ্র শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্যকে ঘৃণা ও অপছন্দ করে, যারা চায় যে মুছলমান জাতি পরস্পর বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকুক, তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
অতএব মুছলমান যুবকদের উচিত, প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়গুলোকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। তাদের উচিত, যে কোন কাজ করার পূর্বে তার ফলাফল সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা।
✍ রাছূলুল্লাহ(সা:) বলেছেন:-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.১৩
অর্থ- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও ক্বিয়ামাত দিবসে বিশ্বাস পোষণ করে, সে যেন উত্তম কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।১৪
তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত রাছূলের এই হাদীছটিকে নিজের কথা-বার্তার ভারসাম্য বজায়ের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা এবং নিজের কাজে-কর্মেও এই মাপকাঠি অনুসরণ করা। একমাত্র আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়াতা‘আলাই তাওফীক্ব ও সফলতা দানকারী।
এবার কারো মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, তাহলে উপরোক্ত জাওয়াবের (শাইখ ‘উছাইমীন (রহ:) এর উপরোক্ত উত্তরের) অর্থ কি এই যে, বর্তমান সমাজে বিদ্যমান অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করা শারী‘য়াত সম্মত নয়?
এ প্রশ্নের জাওয়াবে আল ‘আল্লামা আশ্শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ্ আল ‘উছাইমীন (রহ:) বলেছেন:- না, এর অর্থ এটা নয়। আমরা উপরে আলোচনা করেছি শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো সম্পর্কে, সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন রকম অপকর্ম ও অসৎকর্ম সম্পর্কে নয়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন- আমাদের সমাজে সুদের লেন-দেন, জুয়া, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি বিভিন্নরকম অপকর্ম প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে জুয়ার ছড়াছড়ি আমাদের সমাজে খুব বেশি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মানুষ এসব অপকর্মকে খুব সাধারণ বিষয় হিসেবেই গ্রহণ করে নিয়েছে। যার দরুন এসব অসৎকর্মের সমালোচনা বা প্রতিবাদকারী একজন লোক খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ উল্লেখিত বিষয়গুলোকে মাদক দ্রব্য, মূর্তি, দেব-দেবী, ভাগ্য নির্ধারক তীর ইত্যাদীর পর্যায়ভুক্ত করে হারাম ঘোষণা করেছেন। কিন্তু জনগণ এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে না। আপনি দেখবেন যে, আপনার গাড়ী-বাড়ী ইত্যাদিরও ইনস্যুরেন্স রয়েছে। অথচ আপনি জানেন না যে, এসবের জন্য কি পরিমাণ অর্থ আপনার থেকে কেটে রাখা হচ্ছে বা হবে। সুতরাং এটা হচ্ছে এক প্রকার জুয়া। সমাজে সাধারণ ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করা, এগুলোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা একান্ত প্রয়োজন।
যাই হোক, আমরা এখানে মূলত আলোচনা করছি শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো সম্পর্কে। যেমন- কেউ যদি মাছজিদে দাঁড়িয়ে বলে যে, “বর্তমান সরকার এই — এই অপকর্ম করেছে, এই সরকার অত্যাচারী, সীমালঙ্ঘনকারী” (যালিম বা ফাছিক্ব), অথবা কেউ যদি প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে শাসকের বিরোধিতা করতে কিংবা তার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতে শুরু করে, অথচ যে বা যাদের বিরুদ্ধে সে কথা বলছে তাদের কেউই এখানে এই সমাবেশে উপস্থিত নন, সরকার বা শাসককর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের সমালোচনা ও প্রতিবাদ সম্পর্কেই আমরা এখানে আলোচনা করছি।
এ বিষয়ে মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসনকর্তা; যার বিরুদ্ধে আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন, তাকে সামনে রেখে তার উপস্থিতিতে কথা বলা এবং তার অনুপস্থিতিতে কথা বলা, এ দু’য়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ছালাফে সালিহীনের মধ্যে যারাই শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের সকলেই আমীর বা শাসকের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি তাকে তার অপকর্ম বা অসৎকর্মের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাছাড়া বিচারক বা শাসনকর্তাকে সামনে রেখে তার উপস্থিতিতে তাকে প্রতিবাদ জানানো, আর তার অনুপুস্থিতিতে প্রতিবাদ করা, এ দু‘য়ের মধ্যে পার্থক্য হলো এই যে, যার বিরুদ্ধে কথা-বার্তা বলা হবে সে যদি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত থাকে, তাহলে সে আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্ষম হবে এবং সে তার দৃষ্টিভঙ্গি বা কাজের ব্যাখ্যা দিতে পারবে। তাতে হয়ত দেখা যাবে যে, সে তার নীতি বা কর্মে সঠিক অবস্থানেই রয়েছে, পক্ষান্তরে আমরা যারা তার বিরোধিতা করছি তারা নিজেরাই ভুলের মধ্যে নিপতিত রয়েছি।
অতএব আপনি যদি শাসনকর্তার মঙ্গলকামী এবং তার হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন, তাহলে তার ও আপনার মাঝে যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে সরাসরি তার সাথে আলোচনা করুন এবং তাকে সদুপদেশ ও সুপরামর্শ দিন।
সূত্র:-
(১) ফাতাওয়া লিল আ-মিরীনা বিল মা‘রুফ ওয়ান-না-হীনা ‘আনিল মুনকার
(২) লিক্কাউল বাব আল মাফতূহ্- ৬২/৩৯
১. رواه مسلم
২. সাহীহ্ মুছলিম
৩. رواه أبو داؤد و الترمذي, إبن ماجه
৪. ছুনানু আবী দাউদ, জামে‘ তিরমিযী, ছুনানু ইবনে মাজাহ
৫. سورة آل عمران- ١٠٤
৬. ছূরা আ-লে ‘ইমরান- ১০৪
৭. رواه الترمذي و أبو داؤود و الطبراني
৮. জামে‘ তিরমিযী, ছুনানু আবী দাঊদ, ত্বাবারানী
৯. سورة المائدة- ٧٧-٧٨
১০. ছূরা আল মা-য়িদাহ- ৭৭-৭৮
১১. سنن البيهقي, السنة لإبن أبي عاصم
১২. ছুনানে বাইহাক্বী, আছ্ছুন্নাহ্ লি ইবনি আবী ‘আসীম
১৩. رواه البخاري و مسلم
১৪. সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
Overview
✍ এছাড়া রাছূল (সা:) বলেছেন:-
إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ، فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ، فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ، وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ.১
অর্থ- নিশ্চয় তোমাদের এমন অনেক নেতা-কর্তা হবে যাদের মধ্যে তোমরা অনেক ভালোও দেখতে পাবে এবং অনেক মন্দও দেখতে পাবে। সুতরাং যে তাদের মন্দ কাজগুলোকে ঘৃণা করবে, সে নিষ্কৃতি পাবে। (অর্থাৎ সে তিরস্কৃত হবে না) এবং যে সেই মন্দ কাজগুলোকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করবে, সে নিরাপদ থাকবে।২
✍ আরো দেখা যায়, রাছূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:-
أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ.৩
অর্থ- অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলা হলো সর্বোত্তম জিহাদ।৪
এসব প্রমাণাদীর ভিত্তিতে তারা দাবি করেন যে, শাসককে প্রকাশ্যে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা হলো ছালাফে সালিহীনের নীতি ও আদর্শ।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তাদের এ দাবিটি কি সঠিক?
যদি সঠিক হয়, তাহলে উপরোল্লেখিত বর্ণনাগুলো এবং “যদি কেউ কোন শাসনকর্তাকে সুদপদেশ দিতে চায়, তাহলে সে যেন জনসমক্ষে তা না করে, বরং সংগোপনে করে” ইবনু আবী ‘আসিম কর্তৃক ‘ইয়ায ইবনু খাল্ফ এর সূত্রে বর্ণিত রাছূল এর এই হাদীছের মধ্যে আমরা কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করব? কিংবা শাসকদের ব্যাপারে আমরা কোন নীতি অবলম্বন করব?
এ প্রশ্নের উত্তরে আল ‘আল্লামা আশ্শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ্ আল ‘উছাইমীন (রহ:) বলেছেন:- এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়াটাও অত্যন্ত প্রয়োজন। হ্যাঁ, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, অসৎ বা খারাপ কাজ প্রত্যাখ্যান করা এবং এর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা প্রত্যেক সক্ষম ও সামর্থবান লোকের কর্তব্য।
✍ এ সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.৫
অর্থাৎ- আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকাজের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে খারাপ কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।৬
আয়াতে উল্লেখিত “ولتكن” শব্দের লাম অক্ষরটি নির্দেশ সূচক।
✍ হাদীছে বর্ণিত রয়েছে, রাছূল (সা:) বলেছেন:-
لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ، وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَلَتَأْخُذُنَّ عَلَى يَدَيِ الظَّالِمِ، وَلَتَأْطُرُنَّهُ عَلَى الْحَقِّ أَطْرًا، أَوْ لَيَضْرِبَنَّ اللهُ قُلُوبَ بَعْضِكُمْ عَلَى بَعْضٍ، ثُمَّ لَيَلْعَنَنَّكُمْ كَمَا لَعَنَهُمْ.৭
অর্থ- তুমি অবশ্যই ভালো কাজের নির্দেশ দিবে এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করবে। অত্যাচারীর হাতকে রুখে ধরবে এবং তাকে সত্যের দিকে ফিরিয়ে দিবে। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের অন্তরে বিভক্তি ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিবেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অভিসম্পাত (লা‘নাত) করবেন, যেমন তিনি তাদেরকে অভিসম্পাত করেছিলেন (অর্থাৎ যে ভাবে আল্লাহ 0 বানী ইছরাঈলকে অভিসম্পাত করেছিলেন)।৮
✍ বানী ইছরাঈল সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ. كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ.৯
অর্থাৎ- বানী ইছরাঈলের মধ্যে যারা কাফির তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়ামের পুত্র ‘ঈছার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে, এটা এ কারণে যে তারা অবাধ্যতা করতো এবং সীমালঙ্ঘন করতো। তারা যেসব মন্দ কাজ করত সে বিষয়ে পরস্পরকে নিষেধ করতো না, তারা যা করতো তা অবশ্যই খুব মন্দ ছিল।১০
যাই হোক, আমাদের জেনে রাখা একান্ত আবশ্যক যে, শারী‘য়াতের এমন কতক নির্দেশাবলী রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের বিশেষ কিছু প্রেক্ষাপট ও ক্ষেত্র রয়েছে (যে নির্দেশগুলো সাধারণভাবেভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)। এসব নির্দেশ পালনে হিকমাত ও প্রজ্ঞার সাথে কাজ করা একান্ত প্রয়োজন। উল্লেখিত বিষয়েও আমাদেরকে প্রজ্ঞার সাথে কাজ করতে হবে।
শাসকদের ব্যাপারে যখন আমরা দেখব যে, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা সমালোচনা দ্বারা তাদেরকে অসৎ বা মন্দ কাজ থেকে নিবৃত করা যাবে, তাদের খারাপ কাজ বন্ধ করা যাবে এবং তাদের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে ইছলাম ও মুছলমানের স্বার্থের অনুকূলে ভালো কোন ফলাফল লাভ করা যাবে, তাহলে এমতাবস্থায় আমরা প্রকাশ্যে জনসমক্ষে শাসকদের অন্যায় ও মন্দ কাজের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাব এবং তাদেরকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করব। আর যদি দেখা যায় যে, প্রকাশ্যে সমালোচনা বা প্রতিবাদ তাদের মন্দ কাজগুলো বন্ধ করতে পারবে না কিংবা তাদেরকে অসৎ কাজ থেকে নিবৃত করতে পারবে না, কিংবা প্রকাশ্য প্রতিবাদ ও সমালোচনা দ্বারা কোন সুফল লাভ করা যাবে না, বরং তাতে যারা সৎকাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজে নিষেধ করেন, তাদের প্রতি শাসক বা শাসকবৃন্দের ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে, তাহলে এমতাবস্থায় উত্তম পন্থা হলো- প্রকাশ্যে জনসমক্ষে প্রতিবাদ না করে বরং শাসকের নিকট গোপনে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার মন্দ ও অপকর্মের প্রতিবাদ জানানো। সুতরাং এই দৃষ্টিতে বলা যায় যে, প্রশ্নে উল্লেখিত প্রমাণগুলো পরস্পর সামঞ্জ্যশীল। কারণ একটিতে আমরা দেখছি যে, প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে প্রতিবাদ বা সমালোচনা একটি খারাপ কাজের অবসান ও বিলুপ্তি ঘটাতে পারছে এবং মুছলমানদের জন্য সুফল বয়ে আনছে। আর অপরটিতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে প্রতিবাদ বা সমালোচনার দ্বারা ইছলাম ও মুছলমানের একদিকে যেমন কোন উপকার সাধিত হচ্ছে না, তেমনি তদ্বারা অসৎ ও মন্দ কাজ বা কার্যাবলী দমন কিংবা বন্ধ করা যাচ্ছে না, বরং হিতে বিপরীত হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো- রাছূল (সা:)এর নিম্নোক্ত হাদীছ অনুযায়ী ‘আমাল করা।
✍ রাছূল(সা:) ইরশাদ করেছেন:-
مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْصَحَ لِذِي سُلْطَانٍ فَلا يُبْدِهِ عَلانِيَةً ، وَلَكِنْ يَأْخُذُ بِيَدِهِ فَيَخْلُوا بِه.১১
অর্থ- যদি কেউ শাসনকর্তাকে সদুপদেশ দিতে চায় তাহলে সে যেন প্রকাশ্যে তা না করে বরং গোপনে তাকে সদুপদেশ প্রদান করে।১২
তাই আমরা বলব যে, প্রশ্নে উল্লেখিত প্রমাণ ও বর্ণনাগুলো একটি অপরটিকে যেমন বাত্বিল করছে না, তেমনিএগুলো পরস্পর বিরোধী বা সাংঘর্ষিক নয়। বরং প্রতিটি বর্ণনাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সঠিক এবং পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ তখনই করা যাবে, যখন দেখা যাবে যে, তাতে মন্দ-অসৎ কর্ম বন্ধ হবে এবং সৎকর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। মোটকথা, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ কেবল তখনই করা যাবে যখন দেখা যাবে যে, এর দ্বারা ইছলাম ও মুছলমানের বিশেষ কোন উপকার বা কল্যাণ সাধিত হবে।
আর যদি দেখা যায় যে, শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা সমালোচনা কোন সুফল বয়ে আনবে না, এর দ্বারা মন্দ-অসৎ কর্ম বন্ধ করা যাবে না কিংবা এর স্থলে ভালো ও সৎকর্ম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, মোটকথা এর দ্বারা ইছলাম ও মুছলমানের কোন উপকার বা কল্যাণ সাধিত হবে না, তাহলে এক্ষেত্রে প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে প্রতিবাদ-সমালোচনা না করে কিংবা তাকে (শাসনকর্তা-কে) প্রত্যাখ্যান না করে বরং গোপনে-একান্তে শাসক-কে সুদপদেশ প্রদান করতে হবে।
আমরা জানি যে, কোন শাসনকর্তা কখনও সকল লোককে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন না। শাসকরা তো দূরের কথা, মাছজিদের একজন ইমাম সাহেবও তাঁর পিছনে সালাত আদায়কারী সকল মুক্বতাদীকে খুশি রাখতে পারেন না। কিছু সংখ্যক মুক্বতাদীর অভিযোগ থাকে যে, ইমাম সাহেব সালাত বেশি দীর্ঘায়িত করেন। আবার কিছু সংখ্যকের অভিযোগ থাকে যে, তিনি সালাত খুব সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন। কিছু সংখ্যক লোক একটু আগে-ভাগে নামায আদায় করে নিতে চান, আবার কেউ চান একটু বিলম্বে নামায পড়তে। সুতরাং যেখানে মাছজিদের একজন ইমামের পক্ষে তার সকল মুক্বতাদীকে খুশি রাখা সম্ভবপর হয় না, সেখানে একজন শাসনকর্তার পক্ষে; যার দায়িত্বের পরিধি একজন ইমামের তুলনায় অনেকগুণ বেশি ব্যাপক ও বিস্তৃত, তার পক্ষে তার অধিনস্থ সকল লোককে খুশি রাখা কি করে সম্ভব হবে? এ বাস্তবতা ও সত্যটি উপলদ্ধি করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
এরই সাথে সাথে আমাদেরকে এ বিষয়টিও বুঝতে হবে যে, যদি কেউ প্রকাশ্যে শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, কিংবা জনসমক্ষে তাদের প্রতিবাদ জানায়, তাহলে যারা মুছলিম উম্মাহ্র শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্যকে ঘৃণা ও অপছন্দ করে, যারা চায় যে মুছলমান জাতি পরস্পর বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকুক, তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
অতএব মুছলমান যুবকদের উচিত, প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়গুলোকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। তাদের উচিত, যে কোন কাজ করার পূর্বে তার ফলাফল সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা।
✍ রাছূলুল্লাহ(সা:) বলেছেন:-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.১৩
অর্থ- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও ক্বিয়ামাত দিবসে বিশ্বাস পোষণ করে, সে যেন উত্তম কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।১৪
তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত রাছূলের এই হাদীছটিকে নিজের কথা-বার্তার ভারসাম্য বজায়ের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা এবং নিজের কাজে-কর্মেও এই মাপকাঠি অনুসরণ করা। একমাত্র আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়াতা‘আলাই তাওফীক্ব ও সফলতা দানকারী।
এবার কারো মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, তাহলে উপরোক্ত জাওয়াবের (শাইখ ‘উছাইমীন (রহ:) এর উপরোক্ত উত্তরের) অর্থ কি এই যে, বর্তমান সমাজে বিদ্যমান অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করা শারী‘য়াত সম্মত নয়?
এ প্রশ্নের জাওয়াবে আল ‘আল্লামা আশ্শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ্ আল ‘উছাইমীন (রহ:) বলেছেন:- না, এর অর্থ এটা নয়। আমরা উপরে আলোচনা করেছি শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো সম্পর্কে, সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন রকম অপকর্ম ও অসৎকর্ম সম্পর্কে নয়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন- আমাদের সমাজে সুদের লেন-দেন, জুয়া, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি বিভিন্নরকম অপকর্ম প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে জুয়ার ছড়াছড়ি আমাদের সমাজে খুব বেশি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মানুষ এসব অপকর্মকে খুব সাধারণ বিষয় হিসেবেই গ্রহণ করে নিয়েছে। যার দরুন এসব অসৎকর্মের সমালোচনা বা প্রতিবাদকারী একজন লোক খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ উল্লেখিত বিষয়গুলোকে মাদক দ্রব্য, মূর্তি, দেব-দেবী, ভাগ্য নির্ধারক তীর ইত্যাদীর পর্যায়ভুক্ত করে হারাম ঘোষণা করেছেন। কিন্তু জনগণ এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে না। আপনি দেখবেন যে, আপনার গাড়ী-বাড়ী ইত্যাদিরও ইনস্যুরেন্স রয়েছে। অথচ আপনি জানেন না যে, এসবের জন্য কি পরিমাণ অর্থ আপনার থেকে কেটে রাখা হচ্ছে বা হবে। সুতরাং এটা হচ্ছে এক প্রকার জুয়া। সমাজে সাধারণ ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করা, এগুলোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা একান্ত প্রয়োজন।
যাই হোক, আমরা এখানে মূলত আলোচনা করছি শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো সম্পর্কে। যেমন- কেউ যদি মাছজিদে দাঁড়িয়ে বলে যে, “বর্তমান সরকার এই — এই অপকর্ম করেছে, এই সরকার অত্যাচারী, সীমালঙ্ঘনকারী” (যালিম বা ফাছিক্ব), অথবা কেউ যদি প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে শাসকের বিরোধিতা করতে কিংবা তার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতে শুরু করে, অথচ যে বা যাদের বিরুদ্ধে সে কথা বলছে তাদের কেউই এখানে এই সমাবেশে উপস্থিত নন, সরকার বা শাসককর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের সমালোচনা ও প্রতিবাদ সম্পর্কেই আমরা এখানে আলোচনা করছি।
এ বিষয়ে মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসনকর্তা; যার বিরুদ্ধে আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন, তাকে সামনে রেখে তার উপস্থিতিতে কথা বলা এবং তার অনুপস্থিতিতে কথা বলা, এ দু’য়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ছালাফে সালিহীনের মধ্যে যারাই শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের সকলেই আমীর বা শাসকের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি তাকে তার অপকর্ম বা অসৎকর্মের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাছাড়া বিচারক বা শাসনকর্তাকে সামনে রেখে তার উপস্থিতিতে তাকে প্রতিবাদ জানানো, আর তার অনুপুস্থিতিতে প্রতিবাদ করা, এ দু‘য়ের মধ্যে পার্থক্য হলো এই যে, যার বিরুদ্ধে কথা-বার্তা বলা হবে সে যদি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত থাকে, তাহলে সে আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্ষম হবে এবং সে তার দৃষ্টিভঙ্গি বা কাজের ব্যাখ্যা দিতে পারবে। তাতে হয়ত দেখা যাবে যে, সে তার নীতি বা কর্মে সঠিক অবস্থানেই রয়েছে, পক্ষান্তরে আমরা যারা তার বিরোধিতা করছি তারা নিজেরাই ভুলের মধ্যে নিপতিত রয়েছি।
অতএব আপনি যদি শাসনকর্তার মঙ্গলকামী এবং তার হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন, তাহলে তার ও আপনার মাঝে যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে সরাসরি তার সাথে আলোচনা করুন এবং তাকে সদুপদেশ ও সুপরামর্শ দিন।
সূত্র:-
(১) ফাতাওয়া লিল আ-মিরীনা বিল মা‘রুফ ওয়ান-না-হীনা ‘আনিল মুনকার
(২) লিক্কাউল বাব আল মাফতূহ্- ৬২/৩৯
১. رواه مسلم
২. সাহীহ্ মুছলিম
৩. رواه أبو داؤد و الترمذي, إبن ماجه
৪. ছুনানু আবী দাউদ, জামে‘ তিরমিযী, ছুনানু ইবনে মাজাহ
৫. سورة آل عمران- ١٠٤
৬. ছূরা আ-লে ‘ইমরান- ১০৪
৭. رواه الترمذي و أبو داؤود و الطبراني
৮. জামে‘ তিরমিযী, ছুনানু আবী দাঊদ, ত্বাবারানী
৯. سورة المائدة- ٧٧-٧٨
১০. ছূরা আল মা-য়িদাহ- ৭৭-৭৮
১১. سنن البيهقي, السنة لإبن أبي عاصم
১২. ছুনানে বাইহাক্বী, আছ্ছুন্নাহ্ লি ইবনি আবী ‘আসীম
১৩. رواه البخاري و مسلم
১৪. সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
Overview