Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

বিদ‘আত পরিচিতি part 1

বিদ‘আত পরিচিতি

 শুধু মুখে দাবি করলেই আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হওয়া যায় না বরং তজ্জন্য তাদের পথ ও পদাঙ্ক যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হয়। আর সঠিকভাবে অনুসরণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান। তাই আহলুছ্‌ ছুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ বলতে কি বুঝায়? প্রকৃত অর্থে কারা আহলুছ্‌ ছুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ? তাদের অনুসৃত পথ, পদ্ধতি, নীতি ও আদর্শ কী? তারা কিভাবে হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন? সঠিক দালীল-প্রমাণসহ প্রথমে এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
বিদ‘আত শব্দের শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ:- ‘আরবী “বিদ‘উন” ধাতু থেকে “বিদ‘আহ” বা “বিদ‘আতুন” শব্দটি গৃহীত। “বিদ‘উন” অর্থ হলো- অপূর্ব আবিষ্কার বা পূর্ববর্তী কোন নমুনা অনুসরণ ব্যতীত নব-আবিষ্কার বা নব-উদ্ভাবন। এই অর্থেই ক্বোরআনে কারীমে ছূরা বাক্বারাহ এর ১১৭ নং আয়াতে আল্লাহ 8 তার নিজের সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন:-
 بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ.
অর্থাৎ- আছমান সমূহ ও যমীনের (পূর্ববর্তী কোন নমুনা অনুসরণ ব্যতীত) নব-উদ্ভাবক।
এই একই অর্থে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:-
قُلْ مَا كُنتُ بِدْعًا مِّنْ الرُّسُلِ.
অর্থাৎ- হে নাবী! আপনি বলে দিন যে, আমি কোন নতুন রাছূল নই।
আয়াতে বর্ণিত “বিদ‘আম মিনার রুছুলি” (আমি কোন নতুন রাছূল নই) বাক্যটি দ্বারা একথাই বুঝানো হয়েছে যে, আমি মানবজাতির  প্রতি আল্লাহর বার্তা নিয়ে প্রথম আগমনকারী কোন নতুন রাছূল নই, বরং আমার পূর্বে আরো অনেক নাবী-রাছূল আগমন করেছেন।
ক্বোরআনে কারীমে উপরোক্ত অর্থে বর্ণিত “বিদ‘উন” থেকে উদগত “বিদ‘আত” শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- অপূর্ব আবিষ্কৃত বিষয়, পূর্ববর্তী কোন নমুনা অনুসরণ ব্যতীত নতুন আবিষ্কৃত বিষয় কিংবা প্রথম আবিষ্কৃত বিষয়।
বিদ‘আতের এই অর্থটি তার পরিভাষাগত অর্থেও বিদ্যমান।
শারী‘য়াতের পরিভাষায় বিদ‘আত কাকে বলে?
‘উলামায়ে কিরাম শারী‘য়াতের পরিভাষায় “বিদ‘আত” এর বিভিন্ন সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন।  তবে তাদের বর্ণনাকৃত সেসব সংজ্ঞা অর্থ ও উদ্দেশ্যের ‍দিক থেকে প্রায় এক ও অভিন্ন এবং একটি অপরটির সম্পূরক।
শাইখুল ইছলাম ইবনু তাইমিয়াহ o বলেছেন- ধর্মের মধ্যে বিদ‘আত হলো এমন কোন বিষয়, যেটি আল্লাহ 0 ও তাঁর রাছূল 1 প্রবর্তন করেননি। অর্থাৎ যে বিষয়ে ফার্‌য-ওয়াজিব সূচক কিংবা মুছ্তাহাব সূচক কোন নির্দেশ প্রদান করেননি।
তিনি আরো বলেছেন- ক্বোরআন, ছুন্নাহ ও ছালাফে সালিহীনের (4) ঐকমত্যের বিরোধী প্রতিটি ‘আক্বীদাহ-বিশ্বাস ও ‘ইবাদাহ হলো বিদ‘আত। যেমন- খারিজী, রাফিযী, ক্বাদরিয়াহ, জাহ্‌মিয়াহ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কথা-বার্তা ও আক্বীদাহ-বিশ্বাস হলো বিদ‘আহ। মাছজিদে তবলা ও গান-বাজনার মাধ্যেমে ‘ইবাদাত করা, দাড়ী শেইভ বা মুন্ডানোর মাধ্যমে, গাজা বা নেশা জাতীয় দ্রব্য পানের মাধ্যেমে আল্লাহর ‘ইবাদাত বা নৈকট্য কামনা করা ইত্যাদি কর্মকান্ড, যেগুলো ক্বোরআন-ছুন্নাহ্‌র বিরোধীতাকারী বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের লোকেরা করে থাকে- এ সবই হলো বিদ‘আত।
‘আল্লামা শাত্বিবী রাহিমাহুল্লাহ বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বলেছেন- “বিদ‘আত হলো- দ্বীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবিত এমন কোন পথ যেটি বাহ্যিকভাবে শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথের মতো বা শারী‘য়াত প্রবর্তিত বিষয় সদৃশ মনে হয়,  কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি শারী‘য়াতের সম্পূর্ণ বিরোধী অথচ সেই পথ অনুসরণের দ্বারা আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভের ইচ্ছা পোষণ করা হয়”।
‘আল্লামা শাত্বিবী রাহিমাহুল্লাহ প্রদত্ত সংজ্ঞার ব্যাখ্যা:- উক্ত সংজ্ঞায় বর্ণিত “দ্বীনের মধ্যে” বাক্যটি দ্বারা একথাই বোঝানো হয়েছে যে, জাগতিক অর্থাৎ দুনইয়াওয়ী বিষয়ে নব-আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত কোন পন্থা বা বিষয় বিদ‘আতের পর্যায়ে পড়ে না এবং সেটাকে বিদ‘আত বলা যাবে না। যেমন নতুন নতুন ‍শহর-বন্দর, কল-কারখানা ও শিল্প গড়ে তোলা, নতুন প্রযুক্তি ও মেশিনারীজ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করা। এসবকে বিদ‘আত বলা যাবে না। কেননা এগুলো দ্বীনী কোন বিষয় নয় কিংবা দ্বীনে ইছলামের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বা প্রবর্তিত কোন বিষয় নয় বরং এগুলো হলো নিছক জাগতিক তথা দুনইয়াওয়ী বিষয়।
বিদ‘আতের উপরোক্ত সংজ্ঞায় বর্ণিত “নব-উদ্ভাবিত” বাক্যটি দ্বারা একথাই বুঝানো হয়েছে যে, দ্বীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবিত, আবিষ্কৃত কিংবা প্রবর্তিত এমন কোন পন্থা বা বিষয়; শারী‘য়াতে ইছলামিয়াহ্‌তে যার কোন ভিত্তি অথবা পূর্ব উদাহারণ কিংবা সদৃশ নেই, দ্বীনে ইছলামে এরূপ নতুন বা প্রথম আবিষ্কৃত প্রতিটি বিষয় ও পন্থা হলো- বিদ‘আত। আর যেসব বিষয়ের সুস্পষ্ট ভিত্তি শারী‘য়াতে রয়েছে, যেগুলো দ্বীনে ইছলামের মধ্যে প্রথম বা নব-আবিষ্কৃত নয় বরং ইছলামে যেসব বিষয়ের সদৃশ ও পূর্ব উদাহারণ রয়েছে, সেসব বিষয় বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত নয় এবং ওগুলোকে বিদ‘আত বলা যাবে না। যেমন- সার্‌ফ্‌, নাহ্‌উ, শব্দার্থ বা ভাষাজ্ঞান, উসূলে ফিক্বহ, উসূলে দ্বীন ইত্যাদি জ্ঞান-বিজ্ঞান যেগুলোর দ্বারা ইছলামী শারী‘য়াতের খিদমাত করা হয় সেসব বিষয় বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত নয়। এসব বিষয়কে বিদ‘আত বলা যাবে না। কেননা ইছলামী শারী‘য়াতে এসব বিষয়ের সুষ্পষ্ট ভিত্তি ও দলীল রয়েছে।
এ পর্যায়ে কেউ ‍যদি প্রশ্ন করেন যে, যদিও এসব জ্ঞানের ভিত্তি শারী‘য়াতে রয়েছে তবে এসব বিষয়ে কিতাব সংকলন করা- এটা তো বিদ‘আত। কেননা এভাবে কিতাব সংকলনের পক্ষে তো শারী‘য়াতে কোন দালীল নেই। তাহলে এর উত্তর কি হবে?
হ্যাঁ, এর উত্তরে আমরা বলব- আপনি (প্রশ্নকারী) যেভাবে বলেছেন তাতে তো এসব বিষয় এমনকি ক্বোরআনে কারীম একত্রকরণ ও সংকলন করাও জঘন্য কাজ তথা বিদ‘আত সাব্যস্থ হয়ে যায়। অথচ এরূপ দাবি (“ক্বোরআনে কারীম সংকলন বা একত্রকরণ করা, নাহ্‌উ, সার্‌ফ্‌, উসূলে হাদীছ, উসূলে ফিক্বহ্ ইত্যাদি; ক্বোরআন ও ছুন্নাহ পঠন-পাঠন ও সঠিকভাবে বুঝার জন্য সহায়ক ও প্রয়োজনীয় বিষয়াদী গ্রন্থনা ও সংকলন করা বিদ‘আত” বলে দাবি করা) যে সম্পূর্ণ অবান্তর, ভিত্তিহীন ও বাতিল দাবি, এ বিষয়ে মুছলিম উম্মাহ্‌র মধ্যে কোন দ্বিমত নেই বরং এতদ্বিষয়ে সকলেরই ইজমা‘ বা ঐকমত্য রয়েছে। সুতরাং অন্য কোন দালীল যদি নাও থাকে তবুও কেবলমাত্র উম্মাতের ইজমা‘ এর ভিত্তিতে ক্বোরআন, ছুন্নাহ এবং এগুলো সঠিকভাবে জানা ও বুঝার জন্য প্রকৃত অর্থে সহায়ক যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞান রয়েছে সেগুলো সংকলন ও গ্রন্থনা শুধু জাইয-ই নয় বরং তা অতি প্রয়োজনীও বটে। মাঝে মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে যে বা যারা এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থনা ও সংকলনকে বিদ‘আত বলেছেন, মূলত: ছুন্নাত ও বিদ‘আত সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে তারা এরূপ বলেছেন। তাদের কথা মোটেও ধর্তব্য নয়। তবে অনেকেই রূপক অর্থে এটাকে বিদ‘আত বলেছেন। যেমন রামাযানে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে তারাওয়ীহের সালাত আদায়কে ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব 3 বিদ‘আত বলেছিলেন। অথচ প্রকৃত অর্থে এটি আদৌ বিদ‘আত ছিলনা। কেননা রাছূলুল্লাহ 1  নিজেই সাহাবায়ে কিরামকে (4) নিয়ে মাছজিদে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে তারাওয়ীহের সালাত আদায় করেছেন। ‘উমার 3 রূপক অর্থে এটাকে বিদ‘আত বলেছেন।
উপরে বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বর্ণিত “যেটি বাহ্যিকভাবে শারী‘য়াত প্রবতিত পথ বা বিষয় সদৃশ মনে হয়” বাক্যটি দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, বাহ্যিকভাবে শারী‘য়াত প্রবর্তিত বিষয়াদির সাথে কোন সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য নেই, এমনসব বিষয় বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত নয় এবং সেগুলোকে বিদ‘আত বলা যাবে না।
(যেমন- প্রাণীর ছবি ব্যতীত রং-বেরংয়ের চাটাই বা জায়নামাযের উপর সালাত আদায় করা, রামাযানে পরিমিত পরিমাণে বিভিন্ন রকম হালাল ইফতারী আয়োজন করা, সাদাক্বাহ বা অর্থসম্পদের যাকাত আদায়ে নতুন নোট ব্যবহার করা, বিমানে চড়ে হাজ্জের ছফর করা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো যদিও দ্বীনের মধ্যে অর্থাৎ দ্বীনী বিষয়ে নব-আবিষ্কৃত, তবে শারী‘য়াত প্রবর্তিত তথা দ্বীনী কোন বিষয়ের সাথে এসবের বাহ্যিক কোন সাদৃশ্যতা বা মিল না থাকায় এগুলোকে বিদ‘আত বলা যাবে না বরং এগুলো নিছক স্বাভাবিক রীতি-প্রথা ও বৈষয়িক কর্মকান্ড বলে বিবেচিত হবে।
আর বাস্তবে শারী‘য়াত পরিপন্থি হওয়া সত্ত্বেও যদি কোন বিষয় বাহ্যিকভাবে দ্বীনী; শারী‘য়াত সম্মত কোন বিষয়ের অনুরূপ বা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে অর্থাৎ, কোন বিষয় প্রকৃত অর্থে দ্বীনী; শারী‘য়াত সম্মত নয় তবে বাহ্যিকভাবে সেটি দ্বীনী; শারী‘য়াতসম্মত কোন বিষয়ের মতো বলে মনে হয়, দ্বীনের মধ্যে প্রবর্তিত কিংবা আবিষ্কৃত এরকম বিষয়ও বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। যেমন- কেবল দাঁড়িয়ে থেকে রোযা পালনের মানত করা, সব কিছু বাদ দিয়ে নির্বিঘ্নে ‘ইবাদাত পালনের জন্য নপংসুক হয়ে যাওয়া, শারী‘য়াত সম্মত কোন কারণ ছাড়াই বিশেষ কোন খাবার বা পোষাক বেছে নেয়া এবং অন্য সব হালাল খাবার বা পোষাক বর্জন করা, সম্মিলিতভাবে উচ্চস্বরে দু‘আ-দুরূদ বা যিক্‌র-আযকার করা, শারী‘য়াতে যেসব দিন, তারিখ বা সময়ের জন্য বিশেষ কোন ‘ইবাদাত নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি, এমন কোন দিন, তারিখ বা সময়ের জন্য বিশেষ কতক ‘ইবাদাত নির্দিষ্ট করে নেয়া। যেমন- বৃহস্পতি বা শুক্রবার রাতকে ‍যিক্‌র-আযকার ও সালাতের জন্য, ১৫ই শা‘বানকে রোযা পালনের জন্য এবং ১৪ই শা‘বান দিবাগত রাতকে বিশেষ কিছু ‘ইবাদাত ও সালাতের জন্যে নির্ধারণ বা নির্দিষ্ট করে নেয়া, এসবই হলো- বিদ‘আত। কেননা এগুলো হলো দ্বীনে ইছলামের মধ্যে শারী‘য়াত পরিপন্থি এমন কিছু কাজ, যেগুলোকে বাহ্যিকভাবে দ্বীনী তথা শারী‘য়াত প্রবর্তিত বিষয়াদির সদৃশ বা অনুরূপ ‍বিষয় ও কর্ম বলে মনে হয়।
বিদ‘আত অবিষ্কারকারী একথা ভালো করে জানে যে, দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু প্রবর্তন বা চালু করতে হলে অবশ্যই সেটাকে ধর্মীয় আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে হবে নতুবা মানুষ সেটাকে গ্রহণ করবে না। দ্বীনী বিষয়ে শারী‘য়াতসম্মত বা শারী‘য়াত প্রবর্তিত বিষয়ের অনুরূপ বলে মনে হয় না- এমন কোন পথ মানুষ অনুসরণ করতে চায় না। আর তাই বিদ‘আত অাবিষ্কারকারী ধর্মের মধ্যে যখন নতুন কিছু চালু করতে চায় তখন সেটাকে সে ধর্মের আদলে ও সাজে উপস্থাপন করে থাকে কিংবা এমন কোন  বিষয়ের আশ্রয় নেয়, যে বিষয়টি বাহ্যত দ্বীনী বা ধর্মীয় বিষয় বলে মনে হয়। যাতে সাধারণ মানুষ এটাকে দ্বীনী কাজ মনে করে সহজেই গ্রহণ করে।  প্রয়োজনে সে নেক্‌কার-দ্বীনদার, পরহেযগার লোকদের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ বা সুপরিচিত মর্যাদাসম্পন্ন কারো অনুসরণের দোহাই দিয়ে নিজের আবিষ্কৃত বিদ‘আতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
দেখুন! জাহিলিয়্যাত যুগের ‘আরবগণ মিল্লাতে ইবরাহীম-কে (ইবরাহীম 5 এর অনুসৃত দ্বীনকে) পরিবর্তন করে নতুন যেসব পথ প্রবর্তন বা বিষয় আবিষ্কার করেছিল, সেগুলোকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কিরূপ ধর্মীয় খোঁড়া ব্যাখ্যা ও যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল। তারা তাদের আবিষ্কৃত শিরকী পন্থার পক্ষে তথা মূর্তি ও দেব-দেবীর পূজা করার পক্ষে বলেছিল:-
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى.
অর্থাৎ- আমরা তাদের ‘ইবাদাত কেবল এজন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী করে দেয়।
দুন্‌ইয়াতে সর্বপ্রথম শিরকের আবির্ভাব বা উৎপত্তি কিভাবে হলো সে ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায় যে, মানুষের ফিত্বরাতি অর্থাৎ স্বভাবজাত ধর্ম; ইছলামকে বাদ দিয়ে তাদেরকে শির্‌ক চর্চায় নিয়োজিত করার জন্যে অভিশপ্ত ইবলীছ শির্‌কের বিষয়টিকে ধর্মীয় আঙ্গিকে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছিল। তাদেরকে ক্বাওমে নূহ্ এর পাঁচজন নেক্‌কার-পরহেযগার লোকের নাম দিয়ে বলেছিল যে, তোমরা এদের মূর্তি বা ছবি সামনে নিয়ে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাত করতে থাকো, এতে করে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাতের প্রতি তোমাদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। আর এভাবেই পর্যায়ক্রমে ইবলীছ; শাইত্বান তাদেরকে উক্ত পাঁচজন নেক্‌কার লোকের ছবি বা মূর্তির ‘ইবাদাতে তথা শির্‌কে নিপতিত করেছিল।
জাহিলিয়্যাহ যুগের মাক্কাবাসীগণ ‘আরাফাহ-তে অবস্থানকে বর্জন করেছিল এই যুক্তি বলে যে, হারাম শরীফের (মাক্কাহ মুকাররমাহ-র) বাহিরে ‍গিয়ে অবস্থান করা হলে হারাম শরীফের প্রতি অসম্মান প্রদর্শিত হবে।
উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহ্‌র ত্বাওয়াফ করার পিছনে তারা যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল যে, আমরা যে পোষাক বা কাপড় পরিধান করে আল্লাহ্‌র নাফরমানী বা গুনাহের কাজ করেছি, সেই কাপড় গায়ে ‍দিয়ে কোন অবস্থাতেই আমরা আল্লাহ্‌র ঘর ত্বাওয়াফ করতে পারি না।
এভাবে তারা তাদের নব-আবিষ্কৃত ‍বিভিন্ন বিষয়াদী অর্থাৎ বিদ‘আতকে বৈধ করার জন্য বাহ্যিকভাবে এমন অনেক ব্যাখ্যা ও ‍যুক্তি প্রদর্শন করে, যেগুলো দৃশ্যতঃ ধর্মীয় ও শারী‘য়াত সম্মত বলে মনে হয়। যদিও প্রকৃত অর্থে সেগুলো আদৌ ধর্মীয় বা শারী‘য়াত সম্মত কোন ব্যাখ্যা বা যুক্তি নয়।
সুতরাং কাফির-মুশরিকরা যেখানে নিজেদের নতুন আবিষ্কৃত তথা বিদ‘আতী পন্থা বা বিষয়াদিকে বৈধতা দেয়ার জন্য সেটাকে ধর্মীয় আঙ্গিকে উপস্থাপন করে থাকে, সেখানে মুছলমান বলে দাবিদার লোকেরা নিজেদের বিদ‘আতকে বৈধতা দানের জন্যে সেটাকে ধর্মীয় আঙ্গিকে; শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ, পন্থা বা বিষয়াদির সাথে বাহ্যিক সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে পেশ করবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। আর একারণেই বিদ‘আতের সংজ্ঞায় “বাহ্যিকভাবে শারী‘য়াত প্রবর্তিত বা শারী‘য়াত সম্মত বিষয় সদৃশ মনে হয়” কথাটি সংযোজন করতে হয়েছে।
বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বর্ণিত “যে পথ অবলম্বনের দ্বারা আল্লাহ্‌র অধিক নৈকট্য লাভের ইচ্ছা পোষণ করা হয়” মূলত এই বাক্যটির মাধ্যমে বিদ‘আতের পরিপূর্ণ অর্থ ও সঠিক চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। কেননা এটা (বেশি ছাওয়াব বা আল্লাহ্‌র অধিক নৈকট্য অর্জন) হলো বিদ‘আত প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
বিদ‘আত চর্চাকারী যখন দেখে যে, ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 7 ইরশাদ করেছেন:-
مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.
অর্থাৎ- আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ‘ইবাদাতের জন্য।১০
তখন সে বেশি বেশি ‘ইবাদাত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়। কারণ সে মনে করে যে, মানুষ যেন বেশি বেশি আল্লাহ্‌র ‘ইবাদত-বন্দেগী করে, এটাই হলো উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য। সে আয়াতের অর্থটাকেই কেবল দেখে। ‘ইবাদাতের জন্যে শারী‘য়াতে যেসব নিয়ম-নীতি ও সীমারেখা দেওয়া হয়েছে, বিদ‘আত আবিষ্কার বা চর্চাকারী সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করে না কিংবা সেগুলোকে যথেষ্ট মনে করে না। বরং সে (বিদ‘আত আবিষ্কারকারী) মনে করে যে, যেহেতু আয়াতে সাধারণভাবে শুধু ‘ইবাদাতের কথা বলা হয়েছে সুতরাং স্থান-কাল ও অবস্থা বিবেচনায় ‘ইবাদাতের কিছু নিয়ম-নীতি নিজের পক্ষ হতে নির্ধারণ করে নেয়া আবশ্যক।
বিদ‘আত আবিষ্কার বা চর্চাকারী কখনো নিজেকে প্রকাশ করার বা লৌকিকতার চরম আগ্রহ ও মানসিকতার দরুন কিংবা জাগতিক অন্য কোন লোভ-লালসার দরুন বিদ‘আত আবিষ্কার বা চর্চা করে থাকে। আবার কখনো সে মনে করে যে, একই পদ্ধতিতে একই ‘ইবাদাত বারবার করতে করতে মানুষের মধ্যে ঐ ‘ইবাদাতের প্রতি এক ধরনের অনীহা ও বিরক্তি ভাব চলে আসে। এমতাবস্থায় তাদের সামনে যদি ‘ইবাদাতের নতুন কোন পন্থা বা পথ তুলে ধরা হয় তাহলে তারা তাতে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বোধ করবে। কেননা একথা স্বীকৃত যে, প্রত্যেক নতুনই (বিষয়/বস্তু) সুস্বাদু। মোটকথা, নতুনের মধ্যে স্বাদ থাকে। প্রতিটি নতুন বিষয়-বস্তুর প্রতি মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা প্রবল থাকে এবং একই কাজ দীর্ঘ দিন কিংবা বারংবার করতে থাকলে এর প্রতি মানুষের বিরক্তি ভাব চলে আসে। এসব ভ্রষ্ট চিন্তা-ভাবনা থেকেই বিদ‘আতের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে থাকে।
যাই হোক, বিদ‘আতের উপরোক্ত সংজ্ঞা দ্বারা জানা যায় যে, দ্বীনের মধ্যে নব-আবিষ্কৃত যেসব পথ, পন্থা বা বিষয়াদী, যেগুলো দ্বীনী বিষয়াদির অনুরূপ বলে মনে হয়, কিন্তু এতদসত্ত্বেও এগুলো দ্বারা যদি ‘ইবাদাত অর্থাৎ আল্লাহ্‌র  নৈকট্য অর্জন উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে তাহলে তা বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য হবেনা এবং এরূপ কোন বিষয়কে বিদ‘আত বলা যাবে না। বরং এধরনের বিষয় জাগতিক স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ও রীতি-নীতি সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে গণ্য হবে। যেমন- সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে সম্পদের ট্যাক্স বা ভ্যাট দেয়া ইত্যাদি বিষয় বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
বিদ‘আতের উপরোক্ত সংজ্ঞাটি তারাই দিয়ে থাকেন- যারা যেসকল কাজের দ্বারা ‘ইবাদাত উদ্দেশ্য হয়না এরূপ নিছক্‌ জাগতিক বিষয়াদিকে বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করেন না। পক্ষান্তরে যারা মনে করেন যে, ‘ইবাদাতে যেমন ‍বিদ‘আত হতে পারে তেমনি স্বাভাবিক জাগতিক বিষয়াদী, রীতি-প্রথা বা কাজ-কর্মেও বিদ‘আত হতে পারে, তারা বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বলে থাকেন যে, “বিদ‘আত হলো:- দ্বীনে ইছলামের মধ্যে শারী‘য়াত প্রবর্তিত বা শারী‘য়াত সম্মত পথ বা বিষয়ের (দ্বীনী বিষয়ের) অনুরূপ নতুন আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত এমন কোন পথ বা বিষয়, যে পথ বা বিষয় অনুসরণের দ্বারা উদ্দেশ্য তা-ই হয়ে থাকে যা শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ অনুসরণের দ্বারা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে”।
অন্য কথায়, যে পথ সেই উদ্দেশ্যে অনুসরণ করা হয়ে থাকে, যে উদ্দেশ্যে শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ অনুসরণ করা হয়।
বাহ্যিকভাবে প্রথমোক্ত সংজ্ঞা ও দ্বিতীয় সংজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য এতটুকু যে, প্রথমোক্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- “যে পথ অনুসরণের দ্বারা বেশি বেশি আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাত বা আল্লাহ্‌র অধিক নৈকট্য লাভের ইচ্ছা পোষণ করা হয়”।
আর দ্বিতীয় সংজ্ঞাটিতে বলা হয়েছে- “যে পথ অনুসরণের দ্বারা উদ্দেশ্যে তা-ই হয়ে থাকে, যা শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ অনুসরণের দ্বারা উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে”। অর্থাৎ শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ যে উদ্দেশ্যে অনুসরণ করা হয়, দ্বীনী কোন বিষয় নয় তবে দ্বীনী বিষয়ের সদৃশ ইছলামে নব-আবিষ্কৃত বানোয়াট কোন পথ বা বিষয় যদি সেই একই উদ্দেশ্যে অনুসরণ করা হয়, তাহলে এই নব-আবিষ্কৃত পথ বা বিষয়টি ‘ইবাদাত সংশ্লিষ্ট হোক কিংবা স্বাভাবিক জাগাতিক কোন বিষয় সংশ্লিষ্ট হোক, সর্বাবস্থায় সেটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।
বিদ‘আতের এই দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি যারা দিয়েছেন তাদের কথা হলো:- মানুষের ইহ-পরকালের কল্যাণের জন্যই শারী‘য়াত প্রবর্তন করা হয়েছে এবং শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ অনুসরণের উদ্দেশ্যও হলো দুন্‌ইয়া ও আখিরাতে পরিপূর্ণ কল্যাণ লাভ করা। বিদ‘আত চর্চাকারীও এই উদ্দেশ্যেই বিদ‘আত চর্চা করে থাকে। যখন সে দ্বীনের মধ্যে দ্বীন সদৃশ নব-আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত ‘ইবাদাতমুলক কোন কাজ (যদিও ঐ কাজটি প্রকৃত অর্থে কোন ‘ইবাদাত নয়) করে থাকে, তখন এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আখিরাতে পরিপূর্ণ কল্যাণ, মর্যাদা ও প্রতিদান লাভ করা। আর যখন সে দ্বীনের মধ্যে শারী‘য়াত সদৃশ স্বাভাবিক জাগতিক বিষয়াদী ও রীতি-প্রথা বিষয়ক কোন কাজ-কর্ম করে থাকে, তাহলে এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে জাগতিক পরিপূর্ণ কল্যাণ, মর্যাদা ও প্রতিদান লাভ করা।  সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, শারী‘য়াত প্রবর্তনের মূলে যে উদ্দেশ্য রয়েছে, বিদ‘আতকারী সেই উদ্দেশ্যে যেভাবে ‘ইবাদাতের মধ্যে নতুন পথ বা বিদ‘আত চর্চা বা অনুশীলন করে থাকে, তেমনি ঐ একই উদ্দেশ্যে জাগতিক স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ও রীতি-প্রথার মধ্যেও নতুন পথ তথা বিদ‘আত অনুশীলন করে থাকে। দু’টি ক্ষেত্রেই (‘ইবাদাত এবং ‘আদাত তথা স্বাভাবিক জাগতিক কাজ-কর্ম ও রীতি-প্রথায়) বিদ‘আত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।
তাই বিদ‘আতের এই শেষোক্ত সংজ্ঞা প্রদানকারীদের কথা হলো- শুধু ‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে নতুন প্রথা প্রবর্তনকে বিদ‘আত বলা হবে, অথচ একই উদ্দেশ্যে অন্য ক্ষেত্রে (‘আদাত বা স্বাভাবিক জাগতিক কাজে-কর্মে ) নতুন প্রথা প্রবর্তনকে বিদ‘আত বলা যাবে না, এটা হতে পারে না। বরং যে উদ্দেশ্যে ইছলামী শারী‘য়াত প্রবর্তিত হয়েছে অর্থাৎ দুন্‌ইয়া ও আখিরাতে পরিপূর্ণ কল্যাণ লাভ, সেই উদেশ্যে ‘ইবাদাতের মধ্যে নতুন প্রথা প্রবর্তন যেভাবে বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, তেমনি ঐ একই উদ্দেশ্যে ‘আদাতের মধ্যে তথা স্বাভাবিক জাগতিক বা বৈষয়িক কাজ-কর্মে নতুন প্রথা প্রবর্তন বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।
বিদ‘আতের উপরোক্ত সংজ্ঞা দু’টিকে বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলোর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অর্থ ও উদ্দেশ্যের ‍দিক থেকে দু’টি সংজ্ঞাই এক ও অভিন্ন। কেননা পর্যালোচনা করলে উভয় সংজ্ঞা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনী বিষয়ে শারী‘য়াতসম্মত বিষয়ের অনুরূপ জাগতিক স্বাভাবিক কাজ-কর্ম, রীতি-নীতি কিংবা আচার-অচরণমূলক নতুন কোন কাজ বা প্রথা প্রবর্তনের দ্বারা যদি আল্লাহর (0) নৈকট্য লাভ করা উদ্দেশ্য না হয়, কিংবা এগুলো যদি ‘ইবাদাত হিসাবে পালিত না হয় বরং নিছ্‌ক জাগতিক ও স্বাভাবিক বিষয় ও রীতি-প্রথা হিসেবে পালিত হয়ে থাকে, তাহলে শারী‘য়াতের পরিভাষায় তা বিদ‘আত হিসেবে গণ্য হবে না, বরং নিছ্‌ক স্বাভাবিক জাগতিক বিষয়ে নতুন আবিষ্কৃত কোন কর্ম বা পথ হিসাবে গণ্য হবে। এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই।
অপরদিকে দ্বীনী বিষয়ে দ্বীন সদৃশ নতুন কোন রীতি-নীতি কিংবা স্বাভাবিক জাগতিক কোন বিষয় বা কাজ-কর্ম প্রবর্তনের দ্বারা যদি আল্লাহ্‌র (0) নৈকট্য কামনা করা হয় কিংবা তা ‘ইবাদাত হিসেবে অথবা শারী‘য়াত প্রবর্তিত বিষয় হিসেবে দেখা হয়, তাহলে উভয় সংজ্ঞা মতেই সেটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।
তাইতো দেখা যায় যে, পাপকাজ সমূহের মধ্যে এমন অনেক পাপ রয়েছে যেগুলো বিদ‘আত। পক্ষান্তরে এমন অনেক পাপ কাজ রয়েছে যেগুলো কাবীরাহ গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও তা দ্বীনের মধ্যে না হওয়ার কারণে অথবা শারী‘য়াত সদৃশ না হওয়ার কারণে কিংবা আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাত বা নৈকট্য অর্জন কিংবা ইহ-পরকালের কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত না হওয়ার কারণে সেগুলোকে বিদ‘আত বলা যায় না ।

((উপরোক্ত বিষয়ে আমার (অনুবাদক; আবূ ছা‘আদা হাম্মাদ বিল্লাহ্‌-র) কথা হলো:- মুলতঃ বিদ‘আতের উপরোক্ত সংজ্ঞা দু’টির মধ্যে পরস্পর তেমন কোন বিরোধ নেই। কেননা প্রথমোক্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-
طَرِيقَة فِي الدِّينِ مُخْتَرَعَة، تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ يُقْصَدُ بِالسُّلُوكِ عَلَيْهَا الْمُبَالَغَةُ فِي التَّعَبُّدِ لِلَّهِ سُبْحَانَهُ.
অর্থাৎ- দ্বীনের মধ্যে শারী‘য়াত সদৃশ নব-আবিষ্কৃত পথ অনুসরণের দ্বারা আল্লাহ্‌র (8) অধিক ‘ইবাদাত করা বা তাঁর অধিক নৈকট্য অর্জন করা উদ্দেশ্য হবে।
আর দ্বিতীয় সংজ্ঞাটিতে বলা হয়েছে-
طَرِيقَةٌ فِي الدِّينِ مُخْتَرَعَةٌ، تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ، يُقْصَدُ بِالسُّلُوكِ عَلَيْهَا مَا يُقْصَدُ بِالطَّرِيقَةِ الشَّرْعِيَّةِ.
অর্থাৎ- দ্বীনের মধ্যে শারী‘য়াত সদৃশ নব-আবিষ্কৃত যে পথ বা বিষয় অনুসরণের দ্বারা তা-ই উদ্দেশ্য হবে, যা কিছু শারী‘য়াত প্রবর্তিত পথ বা বিষয় অনুসরণের দ্বারা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
এ দু’টি কথা শাব্দিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন হলেও পরিভাষাগত অর্থ ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে এক ও অভিন্ন। কেননা প্রথমতঃ এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই যে, আল্লাহ্‌র (7) সন্তুষ্টি ও তাঁর নৈকট্য অর্জন হলো বান্দাহ্‌র ইহ-পরকালীন সবচেয়ে বড় সফলতা ও কল্যাণ। অপরদিকে ইছলামী শারী‘য়াত প্রবর্তন এবং এর অনুসরণের উদ্দেশ্যও হচ্ছে তা-ই। সুতরাং এই অর্থে প্রথমোক্ত সংজ্ঞার সাথে দ্বিতীয় সংজ্ঞার কোন বিরোধ বা পার্থক্য নেই।
দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়ে সকলেই একমত যে, ইছলামী শারী‘য়াত প্রবর্তন এবং অনুসরণের দ্বারা যদিও পরকালীন কল্যাণই হলো মূল ও মুখ্য, তথাপি এর দ্বারা একইসাথে দুন্‌ইয়া-আখিরাতের কল্যাণ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। বান্দাহ যাতে একই সাথে দুনইয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করতে পারে, এটাই হলো ইছলামী শারী‘য়াত প্রবর্তন এবং তা অনুসরণের উদ্দেশ্য। যেমন ‘আল্লামা আবূ ইছহাক্ব আশ্‌শাত্বিবী o তার আল ই‘তিসাম গ্রন্থে শারী‘য়াত প্রবর্তনের কারণ সম্পর্কে বলেছেন:-
“إنَّ وَضْعَ الشَّرَائِعِ إِنَّمَا هُوَ لِمَصَالِحِ الْعِبَادِ فِي الْعَاجِلِ وَالْآجِلِ مَعًا”
অর্থ- শারী‘য়াত প্রবর্তন করে দেয়া হয়েছে বান্দাহ্‌গণের একই সাথে ইহ-পরকালীন কল্যাণের নিমিত্ত।
তাই, বিদ‘আতের দ্বিতীয় সংজ্ঞায় যা বলা হয়েছে, তার অর্থ দাঁড়ায়:- একই সাথে দুন্‌ইয়া-আখিরাতের কল্যাণ অর্জনের নিমিত্ত কেউ যদি দ্বীনের মধ্যে শারী‘য়াত সদৃশ নতুন কোন পথ বা পন্থা প্রবর্তন, আবিষ্কার বা অনুসরণ করে (সে পথ বা বিষয়টি ‘ইবাদাহ সংক্রান্ত হোক বা জাগতিক কোন কাজ-কর্ম বা স্বাভাবিক রীতি-নীতি সংক্রান্ত হোক) সর্বাবস্থায় সেটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।
এই অর্থ হতে একথাও পরিষ্কার যে, ‘আদাতমুলক অর্থাৎ স্বাভাবিক জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নব-আবিষ্কৃত বা প্রবর্তিত কোন পথ অনুসরণের দ্বারা যদি আখিরাতের কল্যাণ উদ্দেশ্য না হয় বরং শুধু মাত্র দুন্‌ইয়াওয়ী বা জাগতিক কল্যাণ অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে সেটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে না। কেননা মানুষের শুধুমাত্র জাগতিক কল্যাণ সাধন শারী‘য়াতের উদ্দেশ্য নয়, বরং একই সাথে উভয় জগতের কল্যাণ সাধনই হলো শারী‘য়াত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য এবং তন্মধ্যে পরকালীন কল্যাণটাই হলো প্রধান বা মুখ্য বিষয়। বিদ‘আতের প্রথমোক্ত সংজ্ঞা দ্বারা মূলত: এ কথাটিই বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া দ্বীনের মধ্যে শারী‘য়াত সদৃশ ‘ইবাদাতমূলক নতুন কোন প্রথা প্রবর্তন বা অনুসরণ করা বিদ‘আত, এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কেননা ‘ইবাদাত মূলক কাজের দ্বারা সাধারণত আল্লাহ্‌র (0) নৈকট্য কিংবা পরকালীন কল্যাণ ও সফলতাই যে কামনা করা হয় এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই সর্ব-বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞাত।))
সূত্র: আল ই‘তিসাম- লিল ইমাম আবী ইছহাক্ব আশ্‌শাত্বিবী।

১. سورة البقرة- ٧١١ 
২. ছূরা আল বাক্বারাহ- ১১৭ 
৩. سورة الأحقاف- ٩ 
৪. ছূরা আল আহক্বাফ- ৯ 
৫. ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়াহ- ৪/১০৭-১০৮ 
৬. ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়াহ- ১৮/৩৪৬ 
৭. سورة الزمر- ٣ 
৮. ছূরা আয্ যুমার- ৩ 
৯. سورة الذاريات- ٦٥ 
১০. ছূরা আয্ যারিয়াত- ৫৬