Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

মুসলিমদের-বৈশিষ্ট্যগত-নাম-ব্যবহার-করা-কি-জায়েয

নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিট করুন sahih-akida.simplesite.com https://rasikulindia.blogspot.com/
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূলুল্লাহ্ -এর উপর।
দ্বীন ইসলাম মুকাম্মাল হয়েছে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগেই। অথচ আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর ওয়াফাতের পর হতেই নানামুখী ফিতনার সৃষ্টি হয়েই চলেছে। নতুন নতুন ফিতনা সৃষ্টির এ চলমান ধারাকে অব্যাহত রাখতে তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে কিছু মানুষ। যারা ক্বুরআন হাদীছের বুঝ সালাফে সালেহীনদের হতে না নিয়ে নিজ বুঝকেই প্রাধান্য দিয়ে তা আওয়ামদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তারা নিজেরা গোমরাহ হচ্ছে আবার আওয়ামদেরও গোমরাহ করছে। তারা তাদের বুঝকে তাদের অন্তরে এমনভাবে ফিট করেছে যে নানামুখী ভুলভাল ফাতওয়া দিতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাদের মুখ অথবা কলম নিসৃত এসব ফাতওয়া যে কাদের উপরে ফিট হয়ে যাচ্ছে তা তারা নিজেরাই জানেনা! উম্মাহ যেখানে নানাবিধ সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সেখানে তারা চটকদার শব্দে ঐক্যের বুলি আওড়িয়ে নতুন থিওরী আবিস্কার করে চলেছে। যা ঐক্যের নামে প্রতারণা এবং উম্মাহর মাঝে নতুন ফিতনা সৃষ্টিরই নামান্তর। এরকমই এক ফিতনার নাম হচ্ছে Only Muslim বা শুধু/স্রেফ/একমাত্র মুসলিম বলা। নতুন গজিয়ে উঠা এই ফিরক্বার তাকফীর, তাবদী, ভর্ৎসনা, তিরস্কার এবং অপবাদের জবাব দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ্ তাআলার নিকট তাওফিক্ব কামনা করছি। সাথে এ প্রার্থনাও করছি যে, তিনি যেন আমাদের দ্বীন ইসলামের উপর অটল রাখেন এবং গোমরাহীর পথসমূহের শয়তানী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দাঈদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন। আমীন।
অত্র ফিরক্বার জন্ম: শুধুমাত্র মুসলিম নামক এই ফিরক্বার জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের করাচীর মাসউদ আহমাদ বিএসসি-এর মাধ্যমে। মাসউদ সাহেব তার প্রতিষ্ঠিত এই ফিরক্বার নামকরণ এবং রেজিস্ট্রেশন করেছেন “জামআতুল মুসলিমীন’’ নামে। এমনকি উক্ত ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা শুধুমাত্র মুসলিম পরিচয় দেনেওয়ালা ব্যতীত সকলকে (আহলে হাদীছ, হানাফি, শাফেঈ, মালেকি ও হাম্বলি) মুসলিম উম্মাহ হতে খারিজ করে দিয়েছেন তার ‘মাযাহিবে খামসাহ’ নামক পুস্তিকায়। মাসউদ সাহেব উক্ত পুস্তিকার ছয়টি ভাগের একটি আহলে হাদীছ ভাগে হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ্ কে তার ফাতহুল বারীসহ নিয়ে এসে বুঝাতে চেয়েছেন আহলে হাদীছ ও ইবনু হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। নাউযুবিল্লাহ্। দেখুন- ‘মাযাহিবে খামসাহ’, ২৯ পৃষ্ঠা)।
দুঃখজনক হলেও সত্য, নিজেকে শুধু মুসলিম-ই পরিচয় দিতে হবে এ ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করে প্রখ্যাত দাঈ ড. জাকির নায়েক হাফিজাহুল্লাহ এর এক বক্তব্যের কারণে।
বাংলাদেশে এ ফিরক্বার প্রতিষ্ঠা ও ‘অনলি মুসলিম’ ধারণার প্রচার: আমাদের দেশেও “জামআতুল মুসলিমীন’’ ফিরক্বার প্রাদুর্ভাব লক্ষনীয়। আমাদের দেশে মেহেরপুরসহ কিছু এলাকায় এ ভ্রান্ত সংগঠনটির শাখা ও অনুসারী রয়েছে। তার সাথে একই মতের অনুসারী “মুসলিম উম্মাহ ফাউন্ডেশন” নামে অত্র ফিরক্বার একটি সংগঠন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন কিছুদিন হতে। যার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মুরাদ বিন আমজাদ। তারা সালাফদের ছেড়ে দিয়ে ক্বুরআন-হাদীছের নিজ বুঝ জনসাধারনের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে কিছু সমর্থক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আর সেই সমর্থক গোষ্ঠী তাদের এহেন প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে অনলাইন-অফলাইন গরম করতে ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। অথচ ক্বুরআন হাদীছের অর্ন্তনিহিত মর্ম সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণভাবেই গাফেল। অত্র সংগঠনটি শুধুমাত্র মুসলিম নামেই পরিচয় দিতে হবে এবং অন্য কোন নামে পরিচয় দেওয়া যাবেনা মর্মে ফাতওয়া দিচ্ছে। বরং তারা একধাপ এগিয়ে মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যগত নাম ব্যবহার করাকেও জাহেলিয়্যাতের সাথে তুলনা করছেন কিংবা বিদআত হিসেবে আখ্যায়িত করছেন (প্রমাণ যথাস্থানে আসবে ইনশাআল্লাহ্)।
ড. জাকির নায়েকের বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই বুঝে বা না বুঝে এ ধারণা পোষণ করেন। তারসাথে আমাদের দেশের চরমপন্থী বক্তা জসীমউদ্দিন রাহমানী তাতে বাতাস দেন। তার অনুসারীরাও এই ধারণার অনুসারী ও প্রচারকারী।
উল্লেখ্য যে, ক্বুরআন ও সহীহ হাদীছ হুজ্জাত বা দলীল এবং হুজ্জাত থেকেই ইজমায়ে উম্মাতের দলীল হওয়া সাব্যস্ত রয়েছে। সাবিলুল মু’মিনীন সংক্রান্ত আয়াত এবং অন্যান্য দলীল দ্বারা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও (উসূল) প্রমাণিত:
১) ক্বুরআন ও সুন্নাহ্-র (সহীহ হাদীছের) ঐ মর্মই (বুঝ) গ্রহনযোগ্য, যেটি সালাফে সালেহীন (সাহাবা, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আয়িম্মায়ে মুহাদ্দিছীন, উলামায়ে দ্বীন ও সহীহ আক্বিদাসম্পন্ন হাদীছ ব্যাখ্যাকারগণ) থেকে সর্বসম্মতিক্রমে সাব্যস্ত রয়েছে।
২) ইজতেহাদের বৈধতা। যেমন সালাফে সালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহন করা। আর সালাফে সালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহন করা সর্বোত্তম ইজতেহাদ।
আমাদের জানামতে মাসউদ সাহেবের পূর্বে এবং পরবর্তীতে এ যামানার হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া মুসলিম উম্মাহর: খায়রুল কুরূনের যুগ, হাদীছ সংকলনের যুগ, ফিক্বহ সংকলনের যুগ কিংবা হাদীছ ব্যাখ্যার যুগের কোন উলামা এ দাবী করেনি যে, আমাদের নাম শুধুমাত্র মুসলিম। সাথে এ দাবীও করেনি যে, বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় দেওয়া জাহেলিয়্যাত কিংবা বিদ’আত। আমরা বলব: যদি এই ধারণায় বিশ্বাসী কারো নিকট সালাফে সালেহীন হতে শুধুমাত্র মুসলিম পরিচয় দেয়ার কোন প্রমাণ থেকে থাকে এবং বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় দেওয়া জাহেলিয়্যাত কিংবা বিদআত হবে তাহলে যেন তারা তা পেশ করেন। কেননা, আমরাও ইসলাহ হতে চাই বৈকি!
আমাদের অবস্থান: মহান আল্লাহ্ বলেন, هُوَ سَمّٰىكُمُ الْمُسْلِمِينَ অর্থাৎ- তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ (সূরা হাজ্ব: আয়াত নং-৭৮)। একথা কেউ অস্বীকার করে না যে, মুসলিমই আমাদের সত্তাগত নাম এবং পৃথিবীতে বর্তমানে আমরা এই নামেই পরিচিত। চৌদ্দশত বছর যাবৎ পৃথিবী আমাদের এ নাম সম্পর্কে অবগত আছে এবং ক্বিয়ামাত পর্যন্ত আমরা এ নামেই পরিচিত হতে থাকব ইনশাআল্লাহ্। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে রাব্বুল ইজ্জত আমাদের মুসলিম হিসেবে এ ধরায় পাঠিয়েছেন, এটা তাঁর পক্ষ হতে আমাদের জন্য নিয়ামাত এবং রহমত; ফাল্লিল্লাহিল হামদ্। কিন্তু এই নামটি ব্যতীত আল্লাহ্ তাআলা আমাদের আরো অনেক নাম রেখেছেন। যেগুলিকেও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই (দলীল সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ্)। তাছাড়া অত্র আয়াতের কোথাও এ কথা উল্লেখ নেই যে, আল্লাহ্ তাআলা আমাদের নাম শুধুমাত্র মুসলিম রেখেছেন বা প্রয়োজনের তাগিদে বৈশিষ্ট্যগত নাম রাখা বা বলা নিষিদ্ধ।
সম্মানিত পাঠকবর্গ! লক্ষ্য করুন। রাসূল ﷺ-এর ওয়াফাতের পর হতে অদ্যাবধি পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভিন্ন ফিরক্বার উদ্ভব হয়েছে। প্রত্যেক ফিরক্বার নিজ নিজ দর্শন রয়েছে। রয়েছে ভিন্ন আক্বিদা ও আমল। তাদের এসকল আক্বীদা ও আমলের ভিত্তিতে রাসূল ﷺ হতে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম, মুহাদ্দিছীন, মুজতাহিদীন, আয়িম্মায়ে মুতাকাদ্দিমীন এবং আয়িম্মায়ে মুতাআখখিরীনগণ তাদেরকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করেছেন তাদের বৈশিষ্ট্যগত কারণে। অথচ ঐসকল ফিরক্বার প্রত্যেকেই নিজেকে মুসলিম দাবী করে থাকে। বাস্তবে তারা হাক্বপন্থী মুসলিম ছিলনা। এক্ষেত্রে উলামাগণের উদ্দেশ্য ছিল কে ভ্রান্ত-বাতিল তা জনসাধারণের মাঝে প্রকাশ করা যাতে তারা সতর্ক হতে পারে। যা রাসূল ﷺ-ও ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। তিনি বলেন, تَكُونُ فِي أُمَّتِي فِرْقَتَانِ ، فَتَخْرُجُ مِنْ بَيْنِهِمَا مَارِقَةٌ ، يَلِي قَتْلَهُمْ أَوْلَاهُمْ بِالْحَقِّ অর্থাৎ- “আমার উম্মতের মধ্যে দু’টি ফিরক্বা হবে। তারপর তাদের মধ্য হতে একটি ‘মারিক্বাহ’ (পথভ্রষ্ট ফিরক্বা, খারেজীদের দল) বের হবে। তাদের সাথে লড়াই করবে ঐ দলটি, যেটি হাক্ব্বের অধিক নিকটবর্তী হবে” (সহীহ মুসলিম, হা/১৭৭৫, ইঃফাঃ হা/২৩২৭, ইঃসেঃ ২৩২৮)। বুঝা গেল, ফিরক্বার প্রয়োগ হাক্বপন্থীদের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে আবার বাতিলপন্থীদের ক্ষেত্রেও।
জাতি বা সত্তাগত নাম এবং ওয়াসফি বা বৈশিষ্ট্যগত নাম: আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ﷺ সত্তাগত নাম এবং গুণবাচক নাম রয়েছে এবং এসকল বৈশিষ্ট্যগত নামের ব্যবহার রয়েছে পবিত্র ক্বুরআন ও হাদীছে। যার দরুণ সূর্য্যালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, আমরা জাতিগত মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও বৈশিষ্ট্যগত নামে পরিচয় দেওয়া বৈধ। যাতে করে হাজারো, লাখো ফিরক্বার ভিড়ে বৈশিষ্ট্যগত পরিচয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় যে কার আক্বীদাহ কি এবং আমল কিরূপ? যেমন- সৃষ্টিগত ভাবে আল্লাহ্ আমাদেরকে মানুষ (ইনসান) বলেছেন। অথচ সেই মানুষই আবার কয়েক রকমের। লিঙ্গভেদে তাদের বৈশিষ্ট্যগত নাম হচ্ছে পুরুষ ও নারী কিংবা হিজড়া। আবার প্রত্যেক নারী-পুরুষের নামও আলাদা আলাদা। এখন যদি কেউ কোন মজলিসে শুধুমাত্র মানুষ বলে ডাক দেয় তাহলে মজলিসে উপস্থিত সকল মানুষই সাড়া দিবে। অথচ আপনার উদ্দেশ্য ছিল কোন একজন ব্যক্তিকে আহ্বান করা। এমতাবস্থায় লোকেরা আপনাকে কি সাড়া দিবে? উল্লেখ্য যে, হোক সত্তাগত কিংবা বৈশিষ্ট্যগত নাম নাম-ই হয়ে থাকে।
আল্লাহ্-র সত্তাগত নাম এবং গুণবাচক/বৈশিষ্ট্যগত নাম: পবিত্র ক্বুরআনে আল্লাহ্ ইরশাদ করেন, قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمٰنَ أَيًّا مَّا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَآءُ الْحُسْنٰىۚ وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذٰلِكَ سَبِيلًا অর্থাৎ- বল, ‘তোমরা (তোমাদের রবকে) ‘আল্লাহ’ নামে ডাক অথবা ‘রহমান’ নামে ডাক, যে নামেই তোমরা ডাক না কেন, তাঁর জন্যই তো রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। তুমি তোমার সালাতে স্বর উঁচু করো না এবং তাতে মৃদুও করো না; বরং এর মাঝামাঝি পথ অবলম্বন কর (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত নং- ১১০)। আরও দেখুন- ১) রব [সূরা ফাত্বিহা-১], ২) আর-রহমান [ঐ], ৩) আর-রহিম [ঐ], ইলাহ [নাস-৩], আল-আলীম [বাক্বারাহ-১৩৭], আল-ক্বাদীর [রূম-৫৪], আল-মালিক [হাশর-২৩], আল-কুদ্দূস [ঐ] ইত্যাদি।
রাসূল -র সত্তাগত নাম এবং গুণবাচক/বৈশিষ্ট্যগত নাম: রাসূল ﷺ-এর সত্তাগত নাম মুহাম্মাদ এবং আহমাদও তাঁর সত্তাগত নাম। ক্বুরআনে বলা হয়েছে- “তাঁর নাম আহমাদ” (সূরা সফ, আয়াত নং-৬)। রাসূল ﷺ বলেছেন- “আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আহমাদ (অত্যধিক প্রশংসিত), মুক্বাফফী (শেষ নবী), হাশীর (একত্রিতকারী), নবীয়ে তাওবাহ ও নবীয়ে রহমত” (মুসলিম, হা/২৩৫৫)।
ইমাম বাগাভী রাহিমাহুল্লাহ্-র শারহুস সুন্নাহতে আছে যে, রাসূল ﷺ বলেছেন, “আমার কিছু নাম রয়েছে। আমি আহমাদ, আমি মুহাম্মাদ, আমি আল-মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ্ কুফরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি আল-হাশীর। আমার পদতলে লোকদেরকে একত্রিত করা হবে এবং আমি আক্বিব (সর্বশেষ নবী)।” (শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৩০)
উপরোক্ত হাদীছগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, মুহাম্মাদ ﷺ-এর আরো অনেক নাম রয়েছে। পাশাপাশি এও প্রতীয়মান হল যে, গুণবাচক নামও নাম-ই থাকে, অন্যকিছু হয়ে যায়না। আর না গুণবাচক/বৈশিষ্ট্যগত নামে পরিচয় দিলে জাতিগত পরিচয় হতে বের হয়ে যাবে। আল্লাহ্ আমাদের বুঝার তাওফিক্ব দান করুন।
আল্লাহ্ তাআলা কি আমাদের মুসলিম ব্যতীত অন্য নামে ডেকেছেন?
পবিত্র ক্বুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন আমাদের মুসলিম ছাড়াও আরও অনেক নামে সম্বোধন করেছেন। যেমন-
১) আল-মু’মিন বা আল-মু’মিনূন: তিনি বলেন- وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقٰىٓ إِلَيْكُمُ السَّلٰمَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا অর্থাৎ- “যে তোমাদেরকে সালাম দেবে দুনিয়ার জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলবে না যে, ‘তুমি মু’মিন নও’। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অনুসন্ধান কর” (সূরা নিসা, আয়াত নং- ৯৪)। তিনি আরও বলেন- إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ “নিশ্চয় মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই” (সূরা হুজরাত, আয়াত নং- ১০)। তিনি আরও বলেন- قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ “অবশ্যই মু’মিনগণ সফল হয়েছে” (সূরা মু’মিনূন, আয়াত নং- ১)।
২) আস-সাবিকুনাল আউয়ালূন, আল- মুহাজিরীন ও আল-আনসার: তিনি বলেন- وَالسّٰبِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهٰجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسٰنٍ رَّضِىَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِى تَحْتَهَا الْأَنْهٰرُ خٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًاۚ ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ অর্থাৎ- “আর মুহাজিরআনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য” (সূরা তাওবাহ, আয়াত নং- ১০০)।
৩) রব্বানী: তিনি বলেন- مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتٰبَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِّى مِن دُونِ اللَّهِ وَلٰكِن كُونُوا رَبّٰنِيِّۦنَ بِمَا كُنتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتٰبَ وَبِمَا كُنتُمْ تَدْرُسُونَ অর্থাৎ- “কোন মানুষের জন্য সংগত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়্যাত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার বান্দা হয়ে যাও’। বরং সে বলবে, ‘তোমরা রব্বানী হও। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতে এবং তা অধ্যয়ন করতে’’ (সূরা আল-ইমরান, আয়াত নং- ৭৯)।
৪) আল ফুক্বারা: তিনি বলেন- لِلْفُقَرَآءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِى سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِى الْأَرْضِ অর্থাৎ- “(সদাকা) সেসব দরিদ্রের জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় আটকে গিয়েছে, তারা যমীনে চলতে পারে না” (সূরা বাক্বারাহ, আয়াত নং-২৭৩)।

৫) আস-সালেহীন, আশ-শুহাদা ও আস- সিদ্দীক্বীন: তিনি বলেন- وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولٰٓئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّۦنَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصّٰلِحِينَ وَحَسُنَ أُولٰٓئِكَ رَفِيقًا “আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে তারা তাদের সাথে থাকবে, আল্লাহ যাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে। আর সাথী হিসেবে তারা হবে উত্তম” (সূরা নিসা, আয়াত নং-৬৯)।
৬) আহলে যিকির: মহান আল্লাহ্ বলেন, فَسْـَٔلُوٓا أَهْلَ الذِّكْرِ সুতরাং তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর” (সূরা নাহল, আয়াত নং-৪৩)।
৭) আউলিয়াউল্লাহ্: আল্লাহ্ তাআলা বলেন- أَلَآ إِنَّ أَوْلِيَآءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ অর্থাৎ- “শুনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই, আর তারা পেরেশানও হবে না” (সূরা ইউনুস, আয়াত নং- ৬২)।
৮) হিযবুল্লাহ্: আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন- أَلَآ إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ অর্থাৎ- “জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম” (সূরা মুযদালাহ, আয়াত নং-২২।
উল্লেখ্য যে, হিযবুল্লাহ্ (আল্লাহ্-র দল) এর বিপরীতে হিযবুশ শয়তান রয়েছে এবং আউলিয়াউল্লাহ্ (আল্লাহ্-র বন্ধু) এর বিপরীতে আউলিয়াউশ শয়তান রয়েছে। আর শয়তানের অনুসারীরাই প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।
৯) তাগুত, ফাসেক, যালেম ও মুনাফিক্ব ইত্যাদি। নোটঃ এ নামগুলো মুসলিমের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের পাশাপাশি কাফির মুশরিকদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।
সহীহ আহাদীছে মুসলিমদের কতিপয় বৈশিষ্ট্যগত নামের উল্লেখ:
১) সাহাবী: প্রাণপ্রিয় রাসূলে আকরাম ﷺ ইরশাদ করেন-
لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَهُ
“তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালমন্দ কর না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ সওয়াব হবে না। ( সহীহ বুখারী ৩৬৭৩, মুসলিম ৪৪/৫৪, হাঃ ২৫৪০)
২) উম্মাতে মুহাম্মাদী: عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ مَا أَحَدٌ أَغْيَرَ مِنَ اللَّهِ أَنْ يَرَى عَبْدَهُ أَوْ أَمَتَهُ تَزْنِي يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلاً وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا ‏"‏‏ ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, হে উম্মাতে মুহাম্মাদী! আল্লাহর চেয়ে অধিক আত্মমর্যাদাবোধ আর কারো নেই। তিনি তাঁর কোন বান্দা নর হোক কি নারী হোক তার ব্যভিচার তিনি দেখতে চান না। হে উম্মাতে মুহাম্মাদী! যা আমি জানি, তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে হাসতে খুব কম এবং কাঁদতে অধিক অধিক। (বুখারী, হা/৫২২১, মুসলিম, হা/৯০১)
৩) আহলুল বদর: সহীহ হাদীছে এসেছে- قال النبي صلى الله عليه وسلم لعمر رضي الله عنه وما يدريك لعل الله اطلع على أهل بدر “রাসূল (ﷺ) সাহাবী ওমর রাযিঃ কে লক্ষ্য করে বলেন- বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের ব্যাপারে তোমার কি ধারণা?” (সহীহ মুসলিম: ২৪৯৪)
এছাড়াও রাসূল ﷺ আমাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত নামে ডেকেছেন। দেখুন- ৪) আল- গুরাবা (মুসলিম, হা/১৪৫), ৫) ত্বায়েফাহ (বুখারী, হা/৭৩১১, মুসলিম, হা/১৫৬), ৬) হাওয়ারীইউন (মুসলিম, হা/৫০), ৭) আছহাব (মুসলিম, হা/৫০), ৮) আল-খলিফাহ (আহমাদ, হা/১৪১৪), ৯ ও ১০) আহলুল ক্বুরআন, আহলুল্লাহ্ (হাকেম, হা/২০৪৬)। ১১) মুফাররীদ (মুসলিম, হা/২৬৭৬),
উপর্যুক্ত দলীলসমূহের দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, মুসলিমদের আরও অনেক গুণবাচক/বৈশিষ্ট্যগত নাম রয়েছে। যেগুলো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল ﷺ রেখেছেন। এর দ্বারা শুধুমাত্র মুসলিম বলতে হবে ফিরক্বার দাবীর অসাড়তা প্রমাণিত হলো এবং প্রয়োজনে/চাহিদার আলোকে বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় প্রদান বৈধ হিসেবে সাব্যস্ত হল। আলহামদুলিল্লাহ্।
সাহাবীগণ মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যগত নামে ডেকেছেন:
১) আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিআল্লাহু আনহু ও অন্য খলিফাগণকে সাহাবায়ে কেরামগণ ‘আমীরুল মুমিনীন’ বা মুমিনদের নেতা বলতেন। এ বিষয়টি মুতাওয়াতির বা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত এবং এর উপর উম্মাহর ইজমা রয়েছে।
২) সাইয়্যেদুনা ওমর রাদ্বিআল্লাহু আনহু বলেন, ‘হে কুরাইশদের দল’ (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩৮২৮৯, মুস্তাদরাক হাকেম, হা/৮৩৭৪)।
৩) সাইয়্যেদুনা ওমর রাদ্বিআল্লাহু আনহু আরও বলেন, ‘হে আনসারের দল’ (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩৮১৯৯)।
৪) হুযায়ফা রাদ্বিআল্লাহু আনহু-র সামনে এক ব্যক্তি মুসলিমদের ‘আল-মুছাল্লুন’ বা মুছল্লীগণ বলেছিলেন (মুসলিম, হা/২৭)।
এগুলো ছাড়াও আরো অনেক নামও সাহাবীগণ হতে প্রমাণিত রয়েছে। আল্লাহ্ আজ্জা ওয়াজাল্লা তাঁদের সবার উপরে সন্তুষ্ট হোন। আমীন।
প্রখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন রাহিমাহুল্লাহ্ও মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যগত নামে অভিহিত করেছেন:
প্রখ্যাত তাবেঈ ইবনু সীরীন রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ১১০ হিজরী)- যার ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। ‍যিনি অসংখ্য সাহাবীর শিষ্য এবং সহীহানের অন্যতম প্রধান রাবী। তিনি হাক্বপন্থী মুসলিমদের জন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ নামটি ব্যবহার করেছেন এবং বিপরীত বিদআতী মতবাদের বিশ্বাসীদের ‘আহলুল বিদআহ’ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন- এমন এক সময় ছিল যখন লোকেরা (হাদীছের) সানাদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো না। কিন্তু পরে যখন ফিতনাহ্ (হাদীছের নামে মিথ্যা কথার আমদানী) দেখা দিল তখন লোকেরা হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে বললো, ‘তোমরা যাদের নিকট থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছ, আমাদের কাছে তাদের নাম বল’। যদি দেখা যেতো তারা আহলুস সুন্নাহর লোক, তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হতো। আর যদি দেখা যেতো তারা আহলুল বিদ’আহ তথা আহলুস সুন্নাহর লোক না, তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হতো না।’’ (মুসলিম, মুক্বাদ্দামাহ)
এছাড়াও আহলুল ইলমগণ মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যগত নাম আহলুস সুন্নাহ বা এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন। দেখুন-
১. আইয়ুব আস-সাখতিয়ানী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ১৩১ হিজরী) [ইবনু আদী, আল-কামিল ১/৭৫)।
২. যায়েদাহ বিন কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ্ [খত্বীব আল জামে, হা/৭৫৫]।
৩. ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ্ [আল-মুনতাখাব মিন ইলালিল খাল্লাল, হা/১৮৫]।
৪. আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ ইমাম আল বুখারী রাহিমাহুল্লাহ্ [জুয রাফউল ইয়াদাঈন, হা/১৫]।
৫. ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন রাহিমাহুল্লাহ্ [তারীখু ইবনু মাঈন, রাবী নং-২৯৫৫]।
৬. আবূ ওবায়েদ ক্বাসেম বিস সাল্লাম [আল-আমওয়াল, হা/১২১৮]।
৭. ইমাম হাকেম নিশাপুরী রাহিমাহুল্লাহ্ [মুস্তাদরাক হাকেম, হা/৩৯৭]।
৮. ইমাম মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী রাহিমাহুল্লাহ্ [কিতাবুস সালাত, হা/৫৮৮]।
৯. ইমাম আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাক্বী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ৪৫৭ হিজরী) [কিতাবুল ই’তিক্বাদ ওয়াল হিদায়া ইলা সাবীলির রাশাদ আলা মাযহাবিস সালাফ ওয়া আছহাবিল হাদীছ]
১০. ইমাম আবূ হাতিম আর-রাযী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ২৭৭ হিজরী)। তিনি জাহমিয়াদের এই নিদর্শন বর্ণনা করেছেন যে, তারা আহলুস সুন্নাহকে মুশাব্বিহা বলে। [উসূলুদ দ্বীন, ৩৮ পৃষ্ঠা]।
১১. ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ৩১০ হিজরী) [ত্বাবারী, ছরীহুস সুন্নাহ, ২০ পৃষ্ঠা]।
১২. ইমাম ফুযায়েল বিন ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ১৮৭ হিজরী) [তাহযীবুল আছার, হা/১৯৭৫]
১৩. ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র আল-আন্দালুসী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ৪৬৩ হিজরী) [আত-তামহীদ ১/৮]।
১৪. খত্বীব বাগদাদী রাহিমাহুল্লাহ্ আহলে হাদীছের বৈশিষ্ট্যগত নামের উপরে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। [দেখুন- শারফু আছহাবিল হাদীছ]
১৫. আবূ ইসহাক্ব ইব্রাহীম বিন মূসা আল-কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ৭৯১) [শাত্বিবী, আল-ইতিছাম ১/৬১]।
১৬. আসমাউর রিজালের ইমাম হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃঃ ৭৪৮ হিজরী) [সিয়ারু আলামিন নুবালা ৫/৩৭৪]।
১৭. হাফেয আহমাদ ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ্ (মৃৎ ৮৫২ হিজরী) [ফাৎহুল বারী ১/২৮১]
১৮. মুহাম্মাদ বিন ওমর আদ-দাউদী রাহিমাহুল্লাহ্ ইমাম, হাফেয, আল-মুফীদ (উপকারকারী), মুহাদ্দীছুল ইরাক্ব ইবনু শাহীন রাহিমাহুল্লাহ্ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, যখন তার নিকটে কারো মাযহাবের কথা উল্লেখ করা হতো তখন তিনি বলতেন, ‘আমি মুহাম্মাদী মাযহাবের’ [তারীখু বাগদাদ ১১/২৬৭, যুবায়ের আলী যাঈ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন এর সানাদ সহীহ]।
আলোচনার সার সংক্ষেপ হলো: ক্বুরআন, হাদীছে রাসূল ﷺ এবং মুসলিম উম্মাহর আহলুল ইলম, মুহাদ্দিছীন ও ইমামগণের সর্বসম্মত উক্তিসমূহ দ্বারা দিনের আলোর মত সুস্পষ্ট যে, মুসলিমদের আরো গুণবাচক নাম রয়েছে। যেগুলো দ্বারা তাদের ডাকা হয়েছে। সুতরাং তাদের দাবী একেবারেই বাতিল এবং দলীলহীন যে, আল্লাহ্ তাআলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন এবং মুসলিম ব্যতীত বৈশিষ্ট্যগত নামে পরিচয় দেওয়া বিদআত।
সম্মানিত পাঠকগণ! লক্ষ্য করুন, ইসলামের আদি হতে অদ্যাবধি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে আসা মুসলিমদের এসকল বৈশিষ্ট্যগত নামের ব্যবহার পূর্ণ হয়ে আছে তাফসীর, হাদীছ, রিজালশাস্ত্র, সিরাতগ্রন্থ, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি কিতাবসমূহে। যদি বৈশিষ্ট্যগত নাম ব্যবহার তাদের ফাতওয়ানুযায়ী অবৈধ কিংবা বিদআত হয় তাহলে এ ফাতওয়া কোথায় এবং কার উপরে বর্তাচ্ছে?
সময়ের প্রয়োজনে আসা সিফাতী নাম ‘আহলুল হাদীছ’। এটি সালাফে সালেহীন প্রয়োগ করেছেন। এটিতে কোন সাওয়াবেরও কোন আশা করা হয় না। তাই শব্দগতভাবে বা শারঈ দৃষ্টিকোন থেকে বিদআত বলার কোন সু্যোগই নেই।
আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা আমাদেরকে বিপদগামী ফাতওয়া হতে হেফাযত করুন। আমীন।
আহলে হাদীছ মুসলিমগণের একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম ও এর উপর ইজমা: রাসূল ﷺ বলেছেন, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي مَنْصُورِينَ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ‏ অর্থাৎ- “তবে আমার উম্মাতের একটি দল সকল সময়েই সাহায্যপ্রাপ্ত থাকবে। যেসব লোকেরা তাদেরকে অপমানিত করতে চায় তারা ক্বিয়ামাত পর্যন্ত তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।" (সুনানে তিরমিযী, হা/২১৯২) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারীর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদিনী রাহিমাহুল্লাহ্, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ্, আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ ইমাম আল বুখারী রাহিমাহুল্লাহ্সহ অন্যান্য ইমামগণ বলেছেন ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ হচ্ছে ‘আহলে হাদীছগণ’ (মাসয়ালাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃষ্ঠা নং-৪৭ সূত্রে শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ রাহিমাহুল্লাহ্, আহলে হাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম)।
ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন,
إِذَا رَأَيْتُ صَاحِبَ حَدِيْثٍ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘আমি যখন কোন ‘সাহেবে হাদীছ’ অর্থাৎ ‘আহলে হাদীছকে’ দেখি তখন যেন রাসূল ﷺ কেই জীবন্ত দেখি’। [শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/৮৫ যুবায়ের আলী যাঈ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন এর সানাদ সহীহ]।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন, ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দলটি দ্বারা যদি আছহাবুল হাদীছ উদ্দেশ্য না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা? [হাকেম, মারিফাতু উলূমিল হাদীছ, ৪ পৃষ্ঠা, সানাদ সহীহ]।
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন, “যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে আহলে হাদীছদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে দেখ, তখন বুঝবে যে সেই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে আছে।” (খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩)
ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন, “দুনিয়াতে এমন কোন বিদআতী নেই, যে আহলে হাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না।” (মা’রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃষ্ঠা নং- ৪)
হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মাক্কীর খলিফা ও জামেআ নিযামিয়া হায়দারাবাদের প্রতিষ্ঠাতা আনওয়ারুল্লাহ লিখেছেন, “প্রত্যেক সাহাবী আহলে হাদীছ ছিলেন। কেননা হাদীছ শাস্ত্রের সূচনা তাঁদের আমল থেকেই শুরু হয়েছে। কারন তাঁরা রাসূল ﷺ-এর নিকট হতে হাদীছ গ্রহন করে সরাসরি উম্মাতের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের আহলে হাদীছ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।” (হাক্বীকাতুল ফিক্বহ, ২/২২৮ পৃষ্ঠা, ইদারাতুল ক্বুরআন ওয়াল উলূম আল-ইসলামিয়া)
দেওবন্দিদের প্রসিদ্ধ আলেম এবং বহু গ্রন্থ প্রণেতা মুহাম্মাদ ইদরীস কান্ধলভী লাহোরী লিখেছেন, “সকল সাহাবীই তো আহলে হাদীছ ছিলেন।” (ইজতিহাদ আওর তাক্বলীদ কি বে-মিছাল তাহক্বীক, পৃষ্ঠা নং-৪৮)
উপরোক্ত বক্তব্যগুলো মুহাদ্দীছগণের মাঝে কোনরূপ অস্বীকৃতি ও আপত্তি ব্যতিরেকেই প্রচলিত রয়েছে। সুতরাং আহলে হাদীছ নামটি বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় প্রদান করা জায়েয ও বিশুদ্ধ হওয়ার পক্ষে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। আর এ কথা সূর্যকিরণের চেয়েও উজ্জ্বল যে, মুসলিম উম্মাহ ভ্রষ্টতার উপর একমত হতে পারেন না। রাসূল ﷺ বলেছেন- “আল্লাহ্ আমার উম্মতকে কখনো গোমরাহীর উপরে একত্রিত করবেন না এবং জামআতের উপরে আল্লাহর হাত রয়েছে।” (মুস্তাদরাক হাকেম, হা/৩৯৮,৩৯৯)
বিঃদ্রঃ- সালাফে সালেহীনের আছার হতে “আহলেহাদীছ” উপাধি ও বৈশিষ্ট্যগত নামের ব্যবহারের প্রায় ৫০টি উদ্ধৃতি জানতে হলে পড়ুন শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ রাহিমাহুল্লাহ্-র “আহলে হাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম” বইটি। আল্লাহ্ শায়েখকে জান্নাতের মর্যাদাপূর্ণ স্থান দান করুন, আমীন।
একটি ভুল ধারনার অপনোদন: কতিপয় ফিরক্বার লোকেরা একথা বলে যে, মুহাদ্দীছগণকেই শুধুমাত্র আহলেহাদীছ বলা হয়ে থাকে। ত্বায়েফাহ মানছূরাহ-র ব্যাখ্যায় যাদেরকে আহলে হাদীছ বলে পরিচিত করা হয়েছে তারা একমাত্র মুহাদ্দীছগণ এবং তারা ব্যতীত সাধারন কোন ব্যক্তি আহলে হাদীছের অর্ন্তভুক্ত নন।
দুনিয়ার প্রত্যেক বিদআতী আহলে হাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। উপরোক্ত কথাগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। একথা প্রমাণিত যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ জান্নাতে যাবে। আমাদের প্রশ্ন হলো: তবে কি শুধুমাত্র মুহাদ্দীছগণই জান্নাতে যাবেন আর তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ জান্নাতের বাইরের দরজায় দাড়িয়ে থাকবেন? এমন ধারণা শুধু বাতিলই নয়, বরং ইসলামের সাথে ঠাট্টা-মশকরার শামিল।
কেননা, আহলেহাদীছ-একটি গুণবাচক/বৈশিষ্ট্যগত নাম। এর দ্বারা দুই শ্রেণীর আক্বিদাসম্পন্ন মুসলমান উদ্দেশ্য।
১. সহীহ আক্বিদাসম্পন্ন মুহাদ্দীছিনে কেরাম,
২. সহীহ আক্বিদা সম্পন্ন সাধারন জনগণ। যারা হাদীছের উপর আমল করে থাকেন, যারা রাসূল এর কথাকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়, যারা সালাফে সালেহীনের বুঝ অনুযায়ী ক্বুরআন হাদীছের বুঝ নেয় এবং যারা দলীলের ভিত্তিতে মুহাদ্দীছগণের পথে চলেন এবং তাদের অনুসরণ করেন। (মুক্বাদ্দামাতুল ফিরক্বাতিল জাদীদাহ, পৃষ্ঠা নং-১৯)
হাফেয ইবনু হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ্ আহলে হাদীছের তিনটি আলামাত বর্ণনা করেছেন: ১. তারা হাদীছের উপর আমল করেন। ২. তারা সুন্নাত তথা হাদীছের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকেন। ৩. তারা সুন্নাত বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন। (সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬১২৯, অন্য সংস্করণে হা/৬১৬২)
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন, “আমার নিকটে ঐ ব্যক্তিই আহলে হাদীছ, যিনি হাদীছের উপর আমল করেন।” (খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে ১/৪৪)
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন, “আমরা আহলে হাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলে হাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হাক্বদার।” (মাজমুউল ফাতওয়া, ৪/৯৫)
কিছু মানুষ ‘আহলেহাদীছ’ নাম শুনে জ্বলে-পুড়ে মরে এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে অপচেষ্টা চালান যে, আহলেহাদীছ নামটি দলবাজি। আমরা যেহেতু মুসলিম তাই আমাদেরকে মুসলিম বলাই উচিৎ। সেজন্যই আমরা ক্বুরআন, হাদীছ, সালাফে সালেহীন, মুহাদ্দীছিন এবং ইমামগণের অসংখ্য দলীল পেশ করেছি এ মর্মে যে, আহলেহাদীছ বলা কেবল জায়েযই নয়; বরং পছন্দনীয় বটে। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে বুঝার তাওফিক্ব দান করুন। আমীন।
মুরাদ বিন আমজাদ-এর হাদীছের অপব্যাখ্যা ও ধৃষ্টতা: আমাদের দেশে শুধুমাত্র মুসলিম ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা মুরাদ বিন আমজাদ আমার একটি পোস্টে একটি মন্তব্য করেছিলেন (স্ক্রিনশট সংরক্ষিত)। যাতে তিনি বুখারীর একটি হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মুসলিমদের আইডল সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিআল্লাহু আযমাঈনগণের বৈশিষ্ট্যগত নাম মুহাজির, আনসার-কে জাহেলিয়্যাত হিসেবে আখ্যা দিয়ে তা রাসূল ﷺ-এর দিকে নিসবাত করেছেন। আউযুবিল্লাহ্। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ক্বুরআন ও হাদীছের বুঝ সালাফে সালেহীনের হতে না নিয়ে নিজ বুঝ অনুযায়ী ফাতওয়া প্রদানে তারা কতটা সিদ্ধহস্ত। যে সাহাবীদের ব্যাপারে মহাল রাব্বুল আলামিন পবিত্র ক্বুরআনে বলেছেন- لَّقَد تَّابَ اللَّهُ عَلَى النَّبِىِّ وَالْمُهٰجِرِينَ وَالْأَنصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِى سَاعَةِ الْعُسْرَةِ অর্থাৎ- অবশ্যই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করলেন, যারা তার অনুসরণ করেছে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে“ (সূরা তাওবাহ: ১১৭)। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন- لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَهُ অর্থাৎ- তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালমন্দ কর না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ সওয়াব হবে না (সহীহ বুখারী ৩৬৭৩, মুসলিম ৪৪/৫৪, হাঃ ২৫৪০)।
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল ﷺ প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যগত নামকে জাহেলিয়্যাত বলা এবং তা রাসূল ﷺ-এর নিসবাত করা কি ধরণের মুসলিমের কাজ বলে মনে হয়? এটা কি রাসূল ﷺ-এর শানে গোস্তাখী নয়? এটা কি রাসূল ﷺ-এর উপর বুহতান আরোপ করা নয়? আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মুরাদ বিন আমজাদ সাহেব এখানে ক্ষান্ত দেননি। উনাকে সতর্ক করার পরও তিনি উক্ত বিষয়কে এ যামানার প্রসিদ্ধ একজন আলেমে দ্বীন উস্তাযুল আলেম আল্লামা বিন বায রাহিমাহুল্লাহ্-র প্রতি সম্মন্ধ করে বুঝাতে চেয়েছেন তিনিও নাকি সাহাবীর ‘মুহাজির-আনসার’ বৈশিষ্ট্যগত নামকে জাহেলিয়্যাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক।
এবার আসুন দেখি মুরাদ বিন আমজাদ সাহেব কিভাবে নিজ বুঝ অনুযায়ী হাদীছের ইস্তিদলাল করে আল্লাহ্-র রাসূলের প্রতি মিথ্যারোপ করেছেন এবং একজন প্রসিদ্ধ আলেমদের প্রতি বুহতান লাগিয়েছেন। সহীহ বুখারীর পূর্ণ হাদীছটি হলো:
“জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নাবী ﷺ-এর পরিচালনায় যুদ্ধে শামিল ছিলাম। এ যুদ্ধে বহু মুহাজির সাহাবী যোগদান করেছিলেন। মুহাজিরদের মধ্যে একজন কৌতুক পুরুষ ছিলেন। তিনি কৌতুকবশতঃ একজন আনসারীকে আঘাত করলেন। তাতে আনসারী সাহাবী অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন এবং উভয় গোত্রের সাহায্যের জন্য নিজ নিজ লোকদের আহবান জানালেন। আনসারী সাহাবী বললেন, হে আনসারীগণ! মুহাজির সাহাবী বললেন, হে মুহাজিরগণ সাহায্যে এগিয়ে আস। নাবী ﷺ এতদশ্রবণে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, জাহেলী যুগের ডাকাডাকি কেন? অতঃপর বললেন, তাদের ব্যাপার কী? তাঁকে ঘটনা জানানো হল। মুহাজির সাহাবী আনসারী সাহাবীর কোমরে আঘাত করেছে। রাবী বলেন, নাবী ﷺ বললেন, এ ধরনের হাঁকডাক ত্যাগ কর, এ অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। ‘আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল বলল, তারা আমাদের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছে? আমরা যদি মদিনায় নিরাপদে ফিরে যাই তবে সম্মানিত ব্যক্তিগণ অবশ্যই বাহির করে দিবে অপদস্ত ব্যক্তিদেরকে। তখন ‘উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এই খাবীসকে হত্যা করার অনুমতি দিবেন? নাবী ﷺ বললেন, লোকজন বলাবলি করবে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর সাহাবীদেরকে হত্যা করে থাকে। (বুখারী, হা/৩৫১৮)
আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ ইমাম আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ্ উপরোক্ত হাদীছটি তার সহীহ বুখারীর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য (كتاب المناقب) অধ্যায়ে নিয়ে এসে বাব কায়েম করেছেন এইভাবে- بَابُ مَا يُنْهَى مِنْ دَعْوَةِ الْجَاهِلِيَّةِ অর্থাৎ- “জাহেলী যুগের মত সাহায্যের আহবান জানানো নিষিদ্ধ”
তাছাড়া উক্ত হাদীছে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, রাসূল ﷺ কোন বিষয়টিকে জাহেলী যুগের সাথে তুলনা করেছেন। হাদীছে উল্লেখ রয়েছে وَقَالَ الأَنْصَارِيُّ يَا لَلأَنْصَارِ وَقَالَ الْمُهَاجِرِيُّ يَا لَلْمُهَاجِرِيْنَ যখন আনসারীগণ আনসারীদের এবং মুহাজিরগণ মুহাজিরদের সাহায্যের জন্য ডাকলেন তখন রাসূল বললেন مَا بَالُ دَعْوَى أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ জাহেলী যুগের ডাকাডাকি কেন? হাদীছের পরের অংশে তিনি (রাসূল ) বিষয়টিকে আরও পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন এইভাবে- دَعُوْهَا فَإِنَّهَا خَبِيْثَةٌ অর্থাৎ- এইভাবে সাহায্যের জন্য আবেদন করা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ।
আর এমন কর্ম আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর দ্বারা কি করে সম্ভব যে, যে সাহাবীদের তিনি হে আমার সাহাবী! হে আমার সাথী বলেছেন। অগণিত বার সাহাবীদের স্বয়ং তিনি মুহাজির ও আনসার বলে ডেকেছেন। যাদেরকে তিনি স্বয়ং গালি দিতে নিষেধ করেছেন। যাদের মধ্য হতে তাঁর জীবদ্দশায় জান্নাতের সু-সংবাদ দিয়েছেন, যার পক্ষ হতে সাহাবীগণের প্রশংসা হাদীছের বিশাল ভাণ্ডারে সংরক্ষিত রয়েছে। তিনিই কিভাবে আল্লাহ্ ও তার দেয়া নামকে জাহেলিয়্যাত বলে আখ্যা দিবেন? সম্মানিত পাঠকগণই নিজ নিজ ঈমান অনুযায়ী বিচার করবেন! আল্লাহই সাহায্যস্থল।
এখন রইল মুরাদ বিন আমজাদের আল্লামা বিন বায রাহিমাহুল্লাহ্-র উপর মিথ্যা তোহমত! উনার দাবীনুযায়ী বিন বায রাহিমাহুল্লাহও বৈশিষ্ট্যগত নামের ব্যবহারকে জাহেলিয়্যাত বলে আখ্যা দিয়েছেন। অথচ আমরা আল্লামা বিন বায রাহিমাহুল্লাহ্ হতে এর বিপরীত দেখতে পাই।
প্রমাণ: ফিতনার এ যুগে আওয়ামকে হাক্বপন্থী জামাআতকে খোঁজে বের করে তাকে আঁকড়ে ধরার প্রসঙ্গের এক পর্যায়ে তিনি বলেন- كأنصار السنة في مصر والسودان، وجمعية أهل الحديث في باكستان والهند، وغيرهم ممن يدعو إلى كتاب الله، وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم، ويخلص العبادة لله وحده، ولا يدعو معه سواه من أصحاب القبور ولا غيرهم. অর্থাৎ- যেমন: সুদান ও মিশরে আছে ‘আনসারুস সুন্নাহ’, ভারত উপমহাদেশে আছে ‘আহলেহাদীছ’। এছাড়া আরো অন্য দেশে বিভিন্ন ‘জামাআত’ আছে যারা মানুষকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল ﷺ-এর সুন্নাতের প্রতি আহবান জানায়, দাওয়াত দেয় এক আল্লাহর ইবাদতকে তার জন্যে খালেস ও নির্ভেজাল করার। কবর পুজারী ও অন্যান্য বাতিল ফিরকার মত তারা আল্লাহর সাথে শিরকের দিকে মানুষকে আহবান করে না।" (মাজমূ ফাতাওয়া- শাইখ বিন বায ৮/১৮১)।
প্রমাণিত হলো- বিন বায রাহিমাহুল্লাহ্ স্বয়ং মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যগত নামে চিহ্নিত করার পাশাপাশি জনসাধারণের নিকট তাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের আর কিছুই বলার নেই। সম্মানিত পাঠকগণই এর ফায়সালা করবেন। তবে শুধুমাত্র মুরাদ বিন আমজাদ সাহেব-কে একটা কথাই বলব: এখনও সময় আছে তাওবাহ করার। আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালূ।
পরিশেষে, মহান আল্লাহ্ বলেন- وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِمَّنْ دَعا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صالِحاً وَقالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ' অত্র আয়াতের তাফসীরে তাফসীরে বাগাভী (৪/১৩২)-এ উল্লেখ রয়েছে- প্রসিদ্ধ সাহাবী সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিআল্লাহু আনহু বলেছেন- هو رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَعَا إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ অর্থাৎ- উক্ত আয়াত রাসূল ﷺ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যখন তিনি (আল্লাহ্) তাকে বিধর্মীদের لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ-এর উপর শাহাদাতের দাওয়াহ দিতে বলেছেন তখন অত্র আয়াত নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ- বিধর্মীদের দাওয়াহ দেওয়া বা পরিচিতির সময় নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং- আমরা যখন বিধর্মীদের নিকট আমাদের পরিচয় দিব তখন নিজেদের মুসলিম বলেই পরিচয় দিব। যেমনটি আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন। অতঃপর অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ত্বাবারী (২১/৪৬৯)-তে প্রসিদ্ধ তাবেঈ হাসান বাসরী রাহিমাহুল্লাহ্ মুসলিমদের আরও বৈশিষ্ট্যগত নামে অভিহিত করেছেন- قال: هذا حبيب الله، هذا وليّ الله، هذا صفوة الله، هذا خيرة الله، هذا أحبّ الخلق إلى الله অর্থাৎ- হাবিবুল্লাহ্, ওয়ালিউল্লাহ্, সিফাওয়াতুল্লাহ্, খায়রাতুল্লাহ্, ইত্যাদি। সুতরাং প্রতীয়মাণ হলো যে, মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যগত নামও রয়েছে। যা ক্বুরআন, হাদীছ, ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। বিভিন্ন মুসলিম ফিরক্বা সমৃদ্ধ ভূ-খন্ডে অবস্থানকালে প্রয়োজনে বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় প্রদান সম্পূর্ণরূপে বৈধ।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন, ﻭﻻ ﻋــﻴﺐَ ﻋﻠﻰ ﻣﻦ ﺃﻇﻬﺮ ﻣﺬﻫﺐ ﺍﻟﺴﻠﻒ، ﻭﺍﻧﺘﺴﺐ ﺇﻟﻴﻪ، ﻭﺍﻋﺘﺰﻯ ﺇﻟﻴﻪ؛ ﺑﻞ ﻳﺠﺐ ﻗَﺒﻮﻝ ﺫﻟﻚ ﻣﻨﻪ بالإتفاق؛ ﻓــﺈﻥ ﻣﺬﻫﺐ ﺍﻟﺴﻠﻒ ﻻ ﻳﻜﻮﻥ ﺇﻻ ﺣﻘﺎ. ‘‘যে ব্যক্তি সালাফদের মাযহাব প্রকাশ করে, তার দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করে (অর্থাৎ, নিজেকে ‘সালাফী’ বলে) এবং নিজেকে ঐ লোক বলে দাবি করে, তার কোনো দোষ নেই। বরং সর্বসম্মতিক্রমে এই মাযহাবকে গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা সালাফদের মাযহাব হক্ব ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।’’ [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ্), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৪৯)
তাই প্রয়োজনের তাগিদে বা চাহিদানুযায়ী বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় প্রদানে আমাদের হৃদয়ে সংকীর্নতা রাখার কোন অবকাশ নেই।
আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা আমাদের সকলকে সালাফে সালেহীনদের বুঝমত দ্বীন বুঝার এবং সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর অটল থাকার তাওফিক্ব দান করুন, আমীন।

Post a Comment

0 Comments