মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ
সম্প্রতি ‘ইজতিমা’ নামে পঞ্চগড়ে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান উদযাপনের ঘোষণা নিয়ে সারা দেশের মুসলমানদের মাঝে উত্তেজনা তৈরি হয়। কাদিয়ানীরা তাদের বার্ষিক ধর্মীয় জমায়েতটিকে এমন এক সময়ে ‘ইজতিমা’ নামে আখ্যায়িত করে, যখন মুসলমানেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী টঙ্গির ইজতিমা নিয়ে অস্থিরতায় ভুগছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে এই সম্প্রদায়টির চেতনা ও কর্ম সম্পর্কে যারা অবগত তারা তাদের এই কাজটির তাৎপর্য সহজেই বুঝবেন।
অবশেষে আলিম-উলামা ও সাধারণ জনগণের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে তা স্থগিত করা হয়। কিন্তু ‘ইজতিমা’ নামে কাদিয়ানীদের এই ধর্মীয় জমায়েতের ঘোষণা এবং তা স্থগিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কিছু লোকের এমন কিছু কথাবার্তা ও আচরণের সংবাদ সামনে এসেছে, যা খুবই দুঃখজনক।
সেসব বিষয়ে না গিয়ে এই লেখায় শুধু একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আর তা হচ্ছে, কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে আমাদের দেশে এমন সব কর্মকাণ্ড- নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে, যা ইসলামের জন্যেও চরম অবমাননাকর, এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম নাগরিকদের জন্যেও চরম মর্মযাতনার কারণ। সেইসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে অতি জঘন্য একটি বিষয় হচ্ছে, এরা মুসলিম না হয়েও এবং মুসলিমজাহানে অমুসলিম হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও ন্যক্কারজনক ভাবে ইসলামের পরিচয় ও পরিভাষা ব্যবহার করে চলেছে।
ইসলামের সাথে এদের বিদ্রোহ একেবারেই সুস্পষ্ট। এরা ইসলামের সমান্তরালে আলাদা একটি ভ্রান্ত ধর্ম, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমান্তরালে আলাদা মিথ্যা নবী, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আসা ওহীর সমান্তরালে আলাদা মিথ্যা ওহী, সাহাবায়ে কেরামের সমান্তরালে আলাদা মিথ্যা সাহাবা-জামাত- উদ্ভাবন করে নিয়েছে। যারা নবুওতের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না- তাদেরকে, অর্থাৎ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে কাফের আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে একটি আলাদা ধর্মমত ও ধর্মীয় জাতীয়তা গ্রহণের পরও সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক ভাবে ইসলামের পরিচয় ও মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে চলেছে।
ইসলামের প্রতি সমর্পিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণকারী মুসলিম উম্মাহর জন্য এর চেয়ে অপমানজনক ও হৃদয়বিদারক ব্যাপার আর কী হতে পারে?
কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের সুস্পষ্ট কুফরী মতাদর্শের ব্যাপারে এবং এই কুফরী মতাদর্শের প্রচারক নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার স্ত্রী-পরিবার, সঙ্গী-সহচরদের ব্যাপারে যখন ইসলামের অতি মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষাসমূহ প্রয়োগ করে তখন এটা হয় ইসলামের চরম অবমাননা এবং মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির উপর চরম আঘাত। এই ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক কাজটিই তারা করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। এদের এই গর্হিত কর্মকাণ্ড- বন্ধ করার জন্যই এদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে।
এ দেশের ন্যায়নিষ্ঠ জনগণ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষ হতে যখনই এই অতি যৌক্তিক দাবিটি উত্থাপিত হয় তখনই এদেশের চিহ্নিত কিছু লোকের যেন গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। একইসাথে শুরু হয় কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রতারণামূলক প্রচার-প্রচারণা। যেমন, কোনো রাষ্ট্র কি কারো ধর্ম নিরূপণের অধিকার রাখে? রাষ্ট্র কি ফতোয়া দিতে পারে? সর্বধর্মের লোকদের ভোটে নির্বাচিত কোনো সরকার কি কাউকে অমুসলিম ঘোষণা করতে পারে ইত্যাদি।
যে সম্প্রদায়টির জন্মই হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি বিদ্রোহ, বিদ্রূপ আর প্রতারণার উপর- এরা যে প্রতারণাই করে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য। কে না বোঝে যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবির অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্র এদের ধর্মীয় পরিচয় নিরূপণ করুক বা রাষ্ট্র ফতোয়া দিক? এদের ধর্ম-পরিচয় তো কুরআন-সুন্নাহর বিধান অনুসারে এবং গোটা মুসলিম জাহানের উলামা ও মুসলিম গবেষকদের ফতোয়া ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নির্ণীত হয়েই আছে। আর তা হচ্ছে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় একটি অমুসলিম সম্প্রদায়।
সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সৌদি আরব থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম দেশ এদের রাষ্ট্রীয়ভাবেও অমুসলিম ঘোষণা করে এদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড বন্ধ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত এদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা না করার কারণে এরা উপরোক্ত প্রতারণামূলক ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড- অব্যাহতভাবে করেই যাচ্ছে। এটা যাতে করতে না পারে এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি করা হচ্ছে; যা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত একটি দাবি।
কোথাও কোনো হাতুড়ে চিকিৎসক যদি সাধারণ রোগীদের কাছে চিকিৎসক সেজে প্রতারণা করতে থাকে তখন তার এই প্রতারণা বন্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ দাবি যেমন যৌক্তিক কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিটিও তেমনি। তদ্রূপ যে কোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও বোঝে যে, একটি রাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যে সব রকমের লোকই থাকে। ভোটার তালিকায় যেমন অনেক ভালো মানুষ থাকে তেমনি কিছু প্রতারক ও দুর্নীতিবাজ লোকও থাকে। এ কারণে কি প্রতারকচক্র এই দাবি করতে পারে যে, নির্বাচিত সরকার চোর-বাটপারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না? প্রতারক ও দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি ও প্রতারণা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না? রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবির অর্থ, এদেরকে সাধারণ মুসলমানের সাথে প্রতারণার সুযোগ না দেওয়া।
কাদিয়ানী সম্প্রদায় যেমন এদেশের সরকার ও প্রশাসনকে উপরোক্ত নানা অপযুক্তির মাধ্যমে বিভ্রান্ত করতে চায় তেমনি সাধারণ মানুষকে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার জন্যও প্রতারণামূলক নানা বক্তব্য সম্বলিত পুস্তিকা ও বইপত্র প্রচার করে থাকে। এই সবগুলো এদের প্রতারক স্বভাবেরই নানা দৃষ্টান্ত।
মুসলিম নামে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের উপস্থিতি এবং প্রতিনিয়ত এদের ইসলামের শাআইর এবং অতি মর্যাদাপূর্ণ ও সংবেদনশীল পরিভাষাসমূহের ব্যবহার নিষিদ্ধ না করার অর্থ হবে, ইসলামের সাথে এই বিদ্রোহ, বিদ্রূপ ও অবমাননার ধারা অব্যাহত থাকতে দেওয়া, যা কোনো মুসলিম-সরকারের বৈশিষ্ট্য তো হতেই পারে না কোনো ন্যায়নিষ্ঠ সরকারের বৈশিষ্ট্যও হতে পারে না। আমরা আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি, সরকার ও প্রশাসনে যেসকল ঈমানদার ও সুনীতিসম্পন্ন ব্যক্তি আছেন তারা বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন এবং সাহসিকতার সাথে এই মহা প্রতারণার ধারা সমূলে উৎপাটিত করবেন।
ইনশাআল্লাহ এই পথে সাধ্যমতো সঠিক ও ইখলাসপূর্ণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা হাশরের ময়দানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআত লাভের ওসীলা হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
0 Comments