বিদআত থেকে সাবধান!
মূল লেখক: ড: শাইখ সালেহ বিন ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ)
অনুবাদক: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী বিদআতীদের প্রতিবাদে আলেমগণের পদ্ধতি
অনুবাদক: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী বিদআতীদের প্রতিবাদে আলেমগণের পদ্ধতি
বিদআতীদের প্রতিবাদে আহ্ লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমদের পদ্ধতি হলঃ তাঁরা এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাতের উপর নির্ভর করে থাকেন। আর এটিই হল সঠিক ও সন্তোষজনক পদ্ধতি। তাঁরা বিদআতীদের কথাগুলো প্রথমে বর্ণনা করেন। তারপর একটি একটি করে সেগুলো খন্ডন করে থাকেন। সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব এবং বিদআত থেকে বিরত থাকা জরুরী, এবিষয়ে তারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণাদি উপস্থিত করে থাকেন। বিদআতীদের প্রতিবাদে তাঁরা অসংখ্য বই-পুস্তক-ক রচনা করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয়ের উপর লিখিত তাঁদের কিতাবগুলোতে তাঁরা খারেজী, যাহ্ মীয়া, মুতাজেলা এবং আশায়েরা সম্প্রদায়ের রচিত ঈমান ও আক্বীদা বিষয়ক বিদআতী কথাগুলোর উত্তর দিয়েছেন। এব্যাপারে তাঁরা বিশেষ বিশেষ গ্রন্থও রচনা করেছেন। ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল (রাঃ) যাহ্ মীয়াদের উত্তরে কিতাব লিখেছেন। অন্যান্য ইমামগণও বিভিন্ন ফিরকার লোকদের উত্তরে বিভিন্ন কিতাব রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে উসমান বিন সাঈদ দারেমী, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইবনুল কাইয়িম, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্ হাবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা কবর পূঁজারী, সূফী মতবাদ ও উপরোক্ত বাতিল ফিরকার লোকদের কঠোর প্রতিবাদ করেছেন।
বিদআতীদের প্রতিবাদে যে সমস্ত কিতাব রচিত হয়েছে, তার সংখ্যা অনেক। নিম্মে উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হল:
পুরাতন লেখনীগুলোর মধ্যে রয়েছে:
(১) ইক্বতেজাউস্ সিরাতিল মুসতাক্বীমঃ কিতাবটি শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) কর্তৃক রচিত। কিতাবের বিরাট একটি অংশ জুড়ে তিনি বিদআতীদের প্রতিবাদ করেছেন।
(২) ইনকার”ল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদাআঃ রচনায় ইবনে ওয়াজ্জাহ
(৩) আল-ইতেসামঃ ইমাম শাতেবী
(৪) আল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদআঃ তারতুসী
(৫) আল বা’ঈছু আলা ইনকারিল বিদ্ আহ্ ওয়াল হাওয়াদেছঃ আবু শামা
(৬) মিনহাজুস্ সুন্নাহ আন্ নাববীয়াহঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ)। এতে তিনি রাফেজী এবং ক্বাদরীয়া ফিরকার প্রতিবাদ করেছেন।
বর্তমান যুগে বিদআতীদের প্রতিবাদে যে সমস্ত- কিতাব রচিত হয়েছে, তার মধ্যে:
(১) আল ই বদা’উ ফী মাজিল বিদ্ আহ্ : শায়খ আলী মাহফুয
(২) আস্ সুনানু ওয়াল মুবতাদাআতঃ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আশ্ -শুকাইরী আল-হাওয়ামেদী।
(৩) আত্ -তাহজীর” মিনাল বিদআহ্ ঃ শায়খ ইবনে বায (রঃ) এ কিতাবটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
সর্বযুগের আলেমগণই লেখনী, ভাষণ, জুমআর খুৎবা, প্রচার মাধ্যম, পত্রিকা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদআত ও বিদআতীদের প্রতিবাদ করে আস ছেন। এসব কর্মত পরতা মুসলিমদের সজাগ করণে এবং বিদআতের মূল পাটনে যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে।
সমকালীন বহুল প্রচলিত কতিপয় বিদআতের উদাহরণ
সময়ের প্রবাহ, দ্বীনী ইলম্ এর স্বল্পতা, বিদআতের দিকে আহ্বানকারীর সংখ্যাধিক্য, ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ এবং কাফেরদের আচার-আচরণের সাথে সাদৃশ্য করণ, ইত্যাদি কারণে বর্তমানে বিদআতের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে, তিনি বলেছেন: )لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
অর্থঃ তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সুন্নাতের অনুসরণ করবে। সমকালীন বিদআত সমূহের মধ্যে থেকে নিম্নে আমরা কতিপয় বিদআতের আলোচনা করব।
১) নবী (ﷺ) এর জন্ম উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্ নবী পালন করা।
২) কবর, মাযার ও বিভিন্ন স্থান থেকে বরকত লাভ করা।
৩) ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ইবাদত তৈরী করা।
১) রবীউল আওয়াল মাসে নবী (ﷺ) এর জন্ম দিবস উপলক্ষে মীলাদ মাহফিল উদ্ যাপন করাঃ
অমুসলিম ইয়াহুদ-নাসারাদের অনুসরণ থেকেই এসেছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর জন্ম দিবস উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্ নবীর অনুষ্ঠান। অজ্ঞ মুসলিমেরা এবং একদল গোমরাহ্ আলেম প্রতি বছর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জন্ম উপলক্ষে রবিউল আওয়াল মাসে এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কেউ কেউ মসজিদে এ অনুষ্ঠান করে থাকে। আবার কেউ ঘর বা বিশেষভাবে এর জন্য প্রস’তকৃত স’স্থানে এ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। আর এতে শত শত সাধারণ লোক উপস্থিত’ত হয়। তারা নাছারাদের অন্ধ অনুসরণ করেই এ অনুষ্ঠানের ব্যবস’া করে থাকে। এঅনুষ্ঠানে বিদআত ও নাসারাদের সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শির্ক ও অপছন্দনীয় কর্ম-কান্ড। এতে এমন কিছু কবিতা আবৃতি করা হয়, যাতে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালামের ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দু’আ করা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করা পযর্ন্ত- নিয়ে যায়। অথচ রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
অর্থঃ নাসারাগণ যেমন মরিয়মপুত্র ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, তোমরা আমার ব্যাপারে সেরূপ বাড়াবাড়ি করোনা। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর একজন বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রসূল বল। নাসারারা ঈসা (আঃ)এর মর্যাদা বাড়াতে বাড়াতে আল্লাহর পুত্র হওয়ার আসনে বসিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তাঁকে স্বয়ং আল্লাহ হিসাব বিশ্বাস করে তাঁর ইবাদত শুর” করেছে। কেউ বা তাঁকে তিন আল্লাহর এক আল্লাহ হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিছু কিছু বিদআতী নবী প্রেমিক বিশ্বাস করে যে, রসূল (ﷺ) তাদের মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন।
তাছাড়া এ সমস্ত মীলাদ মাহফিলে যে সমস্ত- পাপ কাজের চর্চা করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে দলবদ্ধভাবে গান-বাজনা করা, ঢোল বাজানো এবং সূফীদের বানানো বিদআতী নিয়মে বিভিন্ন জিকির-আজকার করা। কখনও কখনও নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে এ সমস্ত- কাজে অংশ নিয়ে থাকে। যার কারণে অনেক সময় অশালীন কাজকর্ম সংঘটিত হওয়ার সংবাদও শুনা যায়। এমন কি যদি এ সমস্ত অনুষ্ঠস্থান এধরণের অশ্লীল কাজ হতে মুক্ত হয় এবং শুধুমাত্র একত্রিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির মাঝে সীমিত থাকে, তথাপিও তা বৈধ নয়। কারণ তা নব আবিষ্কৃত বিদআত। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দ্বীনের ব্যাপারে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। তাছাড়া এতে অন্যান্য অনুষ্ঠানের মত অশ্লীল কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদআত বলি। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন আপনারা বিদআত বলেন? উত্তর হলো, আল্লাহর কিতাব, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত, সাহাবিদের আ‘মাল এবং সম্মানিত তিন যুগের কোন যুগে এর কোন অসি-ত্ব ছিলনা। তাই আমরা এটাকে বিদআত বলি। কারণ যে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন’ষ্টি কমনা করা হবে, কুরআন বা সুন্নায় অবশ্যই তার পক্ষে একটি দলীল থাকতে হবে। আর মীলাদ মাহফিলের পক্ষে এরকম কোন দলীল নেই বলেই এটি একটি বিদআতী ইবাদত, যা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পর তৈরি করা হয়েছে। মিশরের ফাতেমীয় শিয়া সম্প্রদায়ের শাসকগণ এটাকে সর্বপ্রথম ইসলামের নামে মুসলিমদের মাঝে চালু করে।
বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হাফস্ তাজুদ্দীন ফাকেহানী (রঃ) বলেন, একদল লোক আমাদের কাছে বার বার প্রশ্ন করেছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষ মীলাদ নামে রবীউল আওয়াল মাসে যে অনুষ্ঠান করে থাকে, শরীয়তে কি তার কোন ভিত্তি আছে? প্রশ্নকারীগণ সুস্পষ্ট উত্তর চেয়েছিল। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে উত্তর দিলাম যে, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এর পক্ষে কোন দলীল পাই নি এবং যে সমস্ত- আলেমগণ মুসলিম জাতির জন্য দ্বীনের ব্যাপারে আদর্শ স্বরূপ, তাদের কারও পক্ষ থেকে এধরণেরে আমলের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অথচ তারা ছিলেন পূর্ববর্তী যুগের (সাহাবিদের) সুন্নাতের ধারক ও বাহক। বরং এই মীলাদ নামের ইবাদতটি একটি জঘন্য বিদআত, যা দুর্বল ঈমানদার ও পেট পূজারী লোকদের আবিষ্কার মাত্র।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন, এমনি আরও বিদআতের উদাহরণ হল, কিছু সংখ্যক মানুষ রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবসকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত: এ উপলক্ষে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। অথচ রাসূলের (ﷺ) সঠিক জন্ম তারিখ সম্পর্কে আলেমগণ যথেষ্ট মতবিরোধ করেছেন। এ ধরণের অনুষ্ঠান পালনকারীদের দু’টি অবস্থার একটি হতে পারে। হয়ত তারা এব্যাপারে ঈসা (আঃ) এর জন্ম দিবস পালনের ক্ষেত্রে নাসারাদের অনুসরণ করে থাকে অথবা নবী (ﷺ) এর প্রতি অতি ভালবাসা ও সম্মান দেখানোর জন্য করে থাকে। যাই হোক এ কাজটি সাহাবিদের কেউ করেন নি। যদি কাজটি ভাল হত, তাহলে অবশ্যই তারা কাজটি করার দিকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী থাকতেন। তাঁরা রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসতেন এবং সম্মান করতেন। তাঁরা ছিলেন ভাল কাজে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহী। তবে তাদের ভালবাসা ও সম্মান ছিল তাঁর অনুসরণ, আনুগত্য, তাঁর আদেশের বাস্তবায়ন এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তাঁর সুন্নাতকে বাস্তবায়িত করার ভিতরে। তিনি যে দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, তার প্রচার ও প্রসারের ভিতরে এবং অন্তর-মন, জবান এবং শক্তি দিয়ে সে পথে জিহাদের মাধ্যমে। এটিই ছিল উম্মতের প্রথম যুগের আনসার ও মুহাজেরীনে কেরাম এবং উত্তম ভাবে তাদের অনুসারী তাবেয়ীগণের পথ।
মীলাদ নামের এ বিদআতটির প্রতিবাদে ছোট-বড় অনেক কিতাব রচনা করা হয়েছে। এতে বিদআত ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে অন্যান্য মীলাদ অনুষ্ঠানের দ্বার উন্মুক্ত করার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন মাশায়েখ ও নেতাদের মীলাদ পালন করা, যাতে মন্দ কাজের আরও অনেক দরজা খোলার ভয় রয়েছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। বর্তমানে এমীলাদ মাহফিল শুধুমাত্র রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জন্ম দিবসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নেতা-নেত্রী, পীর-ফকীর, শায়েখ-মাশায়েখ এমনকি সাধারণ মানুষের জন্ম দিবসেও মীলাদ মাহফিল উদ্ যাপন করা হয়ে থাকে।
শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রঃ) বলেন, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কারও জন্মো সব পালন করা জায়েয নয়, বরং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ এটি দ্বীনের মাঝে একটি নতুন প্রবর্তিত বিদআত। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও একাজ করেন নি। তাঁর নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোন নবী বা তাঁর কোন আত্মীয়, কন্যা, স্ত্রী অথবা কোন সাহাবীর জন্মদিন পালনের নির্দেশ দেন নি। খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম অথবা তাবেয়ীদের কেউ একাজ করেন নি। এমন কি পূর্ব যুগের কোন আলেমও এমন কাজ করেন নি। তাঁরা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং রসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার শরীয়ত পালনকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। যদি এ কাজটি ছওয়াবের হত, তাহলে আমাদের আগেই তাঁরা এটি পালন করতেন।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন। এ দ্বীন পরিপূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিদআত থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। রসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাদের এই দ্বীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। তিনি আরও বলেন, তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নব প্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। এ সমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বির”দ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেন,
فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থ: অতএব, যারা তাঁর নবীর (ﷺ) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্ না (বিপর্যয়) তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে। (সূরা নূর: ৬৩)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, وَمَاَآتاَكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا
অর্থ: তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর। এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাক। (সূরা হাশরঃ ৭)
আল্লাহ আরও বলেন, وَلَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُوْلِ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ (
অর্থ: তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করে, পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদের জন্য রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবনীতে এক সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাবঃ ২১)
আল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا
অর্থ: আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদাঃ ৩)
এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য মনোনীত দ্বীনকে আল্লাহ তায়া’লা নবী (ﷺ)এর ওফাতের পূর্বেই পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, তাঁর ওফাতের পরে লোকেরা কথায় বা কাজে যে সব নতুন প্রথার উদ্ভাবন করে শরীয়তের সাথে যুক্ত করবে, তা বিদআত হিসাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও এগুলোর উদ্দেশ্য ভাল হয়। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে জনগণকে সতর্ক করেছেন ও ভয় প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটা ধর্মের ভিতরে অতিরিক্ত সংযোজন, যার অনুমতি আল্লাহ তায়ালা কোন মানুষকে প্রদান করেন নি। ইহা আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নব নব প্রথা সংযোজনের সাথে সামঞ্জস্য স্বরূপ। সুতরাং এরূপ করার অর্থ এই যে, ইসলাম অসম্পূর্ণ ছিল। মীলাদপন্থীরা মীলাদের মাধ্যমে তা পূর্ণ করে দিলেন। এটা যে কত বড় অপরাধ এবং আল্লাহর বাণীর বিরোধী, তা সর্বজন বিদিত।
আল্লাহ বলেন: اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ
অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়েদাঃ ৩)
মীলাদ মাহফিল বা নবীর জন্মো সব পালন বা এ জাতীয় অন্যান্য উৎসবাদির প্রবর্তনের দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়া’লা এই উম্মতের জন্য ধর্মকে পূর্ণতা দান করেন নি এবং রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উপর অর্পিত রেস্বলাতের দায়িত্ব পালন করেন নি। পরবর্তীতে মীলাদপন্থীরা এসে তাকে পূর্ণ করে দিয়েছেন। এতে মারাত্মক ভয়ের কারণ রয়েছে এবং এধরণের ইবাদত তৈরি করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়া’লা এবং তাঁর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর আপত্তি উত্থাপনের শামিল। অথচ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য ধর্মকে সার্বিকভাবে পূর্ণ করত: তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করেছেন এবং রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের সুস্পষ্ট বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন কোন পথ, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে উম্মতকে তা বলে দিতে কোন ত্রুটি করেন নি।
এ কথা সকলের জানা যে, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের পয়গাম ও উপদেশ বার্তা পৌঁছিয়েছেন। যদি মীলাদ মাহফিল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দ্বীনের অংশ হত, তাহলে তিনি অবশ্যই উম্মতের কাছে বর্ণনা করতেন বা তাঁর সাহাবীগণ তা করতেন। যেহেতু এমন কিছু পাওয়া যায়না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এই মীলাদ মাহফিলের কোন সম্পর্ক নেই বরং এটা বিদআত, যা থেকে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে সাবধান থাকতে বলেছেন।
যদি আমরা এই মীলাদ মাহফিলের বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মাজিদের দিকে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই আল্লাহ তায়া’লা তাঁর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা আদেশ করেছেন বা যা থেকে নিষেধ করেছেন, তিনি আমাদেরকে তা অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি এই দ্বীনকে উম্মতের জন্য পূর্ণতা দান করেছেন। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে মীলাদ মাহফিলের কোন ইঙ্গিত পযর্ন্ত-নেইেই। এভাবে যদি আমরা সুন্নাতের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাজ করেন নি, এর আদেশও দেন নি। এমন কি তাঁর সাহাবীগণও তা করেন নি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এটা ধর্মীয় কাজ নয় বরং ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের উৎসব সমূহের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। যে ব্যক্তির সামান্যতম বিচক্ষণতা আছে এবং হক গ্রহণে ও তা বুঝার সামান্য আগ্রহ রাখে, তার বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না যে, ধর্মের সাথে মীলাদ মাহফিল বা যাবতীয় জন্ম বার্ষিকী পালনের কোন সম্পর্ক নেই। বরং যে বিদআতসমূহ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেছেন, এটি সেগুলোরই অন্তর্ভূক্ত।
বিভিন্ন স্থানে অধিক সংখ্যক লোক এই বিদআতী কাজে লিপ্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে প্রবঞ্চিত হওয়া সংগত নয়। কেননা সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সঠিক পথ জানা যায়না। বরং শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা হয়।
এই মীলাদ মাহফিল সমূহ বিদআত হওয়ার সাথে সাথে অনেক এলাকায় অন্যান্য পাপের কাজ থেকেও মুক্ত নয়। যেমন নারী-পুরুষের মেলা-মেশা, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শিরকে আঁকবার তথা বড় ধরণের শিরকও সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হল রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য আওলীয়ায়ে কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু’আ করা, সাহায্য ও বিপদ মুক্তির প্রার্থনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তারা গায়েবের খবর জানেন। এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়।
অতীব আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অনেক লোক এ ধরণের বিদআতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই ত পর ও সচেষ্ট এবং এর পিছনে যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করাতে প্রস্তুত। এধরণের অনুষ্ঠানের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে তারা দ্বিধা বোধ করে না। অথচ তারা নামাযের জামাতে ও জুমাতে অনুপস্থিত থাকাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। যদিও আল্লাহ তা’আলা এ আমলগুলো পালন করা ওয়াজিব করেছেন। তারা এটাও উপলব্ধি করে না যে, নামাযের মত গুরুপূর্ণ ইবাদত ছেড়ে দিয়ে তারা চরম অন্যায় করছে। নিঃসন্দেহে এটা দুর্বল ঈমানের পরিচয় এবং পাপাচারের মাধ্যমে অন্তরকে কুলষিত করে নেয়ার পরিচয় বহন করে।
আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, অনেকের ধারণা, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাড়িয়ে যায়। এটা বিরাট মূর্খতা ও অসত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা কারো সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোন সমাবেশেও উপস্থিত’ত হবেন না। বরং কিয়ামত পযর্ন্ত- অন্যান্য নবীদের মতই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন এবং তাঁর পবিত্র রূহ মোবারক প্রভুর নিকট উর্ধাকাশে ইল্লিয়ীনের সম্মানজনক স্থানে সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
ثُمَّ اِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ
অর্থ: এরপর তোমাদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা হবে। (সূরা মুমেনুনঃ ১৬) রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার কবরই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশ কারী এবং আমার সুপারিশ সবার আগে গৃহীত হবে।
রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর দরূদ পাঠ করা ও সালাম পাঠ করা নিঃসন্দেহে একটি ভাল আ‘মাল এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক উত্তম পন্থা। যেমন আল্লাহ তায়া’আলা বলেছেন, )اِنَّ اللّهَ وَ مَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَاَيُّهَا الَّذِيْنَ اَمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا(
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। হে মুমেনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠাও। (সূরা আহযাবঃ ৫৬) নবী (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠায়, আল্লাহ তার প্রতিদান স্বরূপ তাঁর উপর দশবার রহমত নাযিল করেন।
সব সময়ই নবী (ﷺ)এর উপর দরূদ পড়ার বৈধতা রয়েছে। তবে নামাযের শেষে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে বরং নামাযের মধ্যে শেষ তাশাহ্ হুদে দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। অনেক ক্ষেত্রে এই দরূদ পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা। যেমন আযানের পরে, জুমআর দিনে ও রাতে এবং রসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালামের নাম উল্লেখ হলে। এব্যাপারে অনেক হাদীছ রয়েছে।
এরূপ বিদআতী অনুষ্ঠান এমন সব মুসলিম দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে, যারা তাদের আক্বীদা ও রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভালবাসার ব্যাপারে খুবই দৃঢ়তা রাখে। তাকে বলতে হবে, যদি তুমি সুন্নী ও রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর অনুসারী হওয়ার দাবী রাখ, তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তাঁর কোন সাহাবী বা তাঁদের সঠিক অনুসারী কোন তাবেয়ী কি একাজটি করেছেন? না এটা ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান বা তাদের মত আল্লাহর অন্যান্য শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ? এধরণের মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর প্রতি ভালবাসা প্রতিফলিত হয়না। যা করলে ভালবাসা প্রতিফলিত হয়, তা হল তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করা, তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা, যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেভাবেই তাঁর উপাসনা করা।
কুরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও তাবেয়ীদের প্রদর্শিত পথে চলার ভিতরেই রয়েছে মুসলিমদের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি।
বিদ’আত থেকে সাবধান-৪ (শেষ পর্ব)
আজকের ৪র্থ এবং শেষ পর্বে আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত বেশ কিছু বিদআত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন:
১) জীবিত বা মৃত ওলী-আওলিয়া, মাযার, খানকা ইত্যাদি বিভিন্ন স্থান থেকে বরকত লাভ করার বিদআত।
২) নামাযের শুরুতে মুখে নিয়ত পাঠ করা।
৩) ফরজ নামাযের আগে-পরে দলবদ্ধভাবে জিকির করাঃ
৪) মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিদআত যেমন, কুলখানি, চল্লিশা, হাফেজ-আলেমদের দাওয়াত দিয়ে কুরআন খতম, সবীনা খতম পড়িয়ে মৃতের রূহের উপর বখশানো, খতমে ইউনুস, খতমে জালালী, ফাতেহাখানি ইত্যাদি।
৫) সূফীদের বানোয়াট ওযীফাঃ
৬) শবে বরাতের বিদ’আত সমূহ। যেমন: সে রাতে হালুওয়া রুটি খাওয়া, মমবাতি আগরবাতী জালানো ইত্যাদি।
৭) বেশ কতিপয় কবর কেন্দ্রীক বিদআত। যেমন: কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, কবর পাকা করা, কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা ইত্যাদি।
তবে আসুন, উক্ত বিষয়গুলো কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করা যাক। আল্লাহ আমাদেরকে বিদ’আত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার তাওফীক দান করুন। সেই সাথে সেগুলো থেকে আমাদের মুসলিমদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।
২) বিশেষ স্থান এবং জীবিত বা মৃত ওলীর কাছ থেকে বরকত হাসিল করাঃ
কোন বস্তুতে স্থায়ীভাবে কল্যাণ থাকা এবং তা বৃদ্ধি হওয়ার নাম তাবার্ রুক। কাজেই যে ব স্তুতে বরকত নেই এবং যে ব্যক্তি বরকতের ক্ষমতা রাখেনা, তা থেকে বরকত লাভের আশা করা বৈধ নয়। বরকতের সঠিক অর্থ অনুযায়ী একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই সকল বরকতের মালিক। তিনিই বরকত নাযিল করেন এবং তা স্থায়ী করেন। কোন সৃষ্টি জীবের পক্ষে বরকত দান করা অথবা বরকত তৈরী করা সম্ভব নয়। তেমনিভাবে কোন মাখলুকের পক্ষে বরকত স্থায়ীভাবে ধরে রাখা বা আটকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়। সুতরাং কোন স্থান, স্মারক চিহ্ন অথবা জীবিত কিংবা মৃত আওলিয়া থেকে বরকত গ্রহণ করা বৈধ নয়। কেউ যদি এবিশ্বাস করে যে, কোন মাখলুক বরকত দিতে সক্ষম, তাহলে এ ধরণের বিশ্বাস শির্কে পরিণত হবে। আর যদি বিশ্বাস করে যে, অমুক স্থান যিয়ারত করলে অথবা স্পর্শ করার কারণে আল্লাহর পক্ষ হতে বরকত লাভ হবে, তাহলে তা সরাসরি শির্ক না হলেও শির্কের পথকে উম্মুক্ত করবে এবং পরবর্তীতে শির্কের দিকে নিয়ে যাবে। তবে হাজরে আসওয়াদের কথা ভিন্ন। কারণ হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা মু স্তাহাব। কারণ এ ব্যাপারে নবী (ﷺ) থেকে দলীল রয়েছে। শুধু তাই নয়, নবী (ﷺ) এর যে কোন সুন্নাত পালনের মাধ্যমে বরকত লাভের আশা করা বৈধ।
কোন কোন লোক শায়খ বা পীরদের শরীর, অযুর পানি এবং পাগড়ীসহ অন্যান্য বস্তুথেকে বরকত নেয়ার পক্ষে সাহাবাগণ কর্তৃক রাসূল (ﷺ)এর উচ্ছিষ্ট বস্তু থেকে বরকত গ্রহণ করাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। তাদের এ দলীল গ্রহণ সঠিক নয়। কারণ সাহাবাগণ কর্তৃক রাসূল (ﷺ)এর শরীরের লোম, মুখের থুথু এবং শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে বরকত গ্রহণ শুধু রাসূল (ﷺ)এর সাথে নির্দিষ্ট ছিল। তাও আবার রাসূল (ﷺ) জীবিত থাকাবস্থায়। মৃত্যুর পর নয়। যদি প্রশ্ন করা হয়, রাসূল (ﷺ)এর সাথে খাছ বা নির্দিষ্ট ছিল, এ কথার দলীল কি? উত্তর হল, রাসূল (ﷺ) এর ওফাতের পর সাহাবাগণ তাঁর ঘর-বাড়ীর আসবাব পত্র এবং কবর শরীফ থেকে বরকত হাসিল করার চেষ্টা করেন নি। রাসূল (ﷺ) যে সমস- স্থানে নামায আদায় করতেন এবং যেখানে তিনি বসতেন, সে সকল স্থানেও তারা বরকতের জন্য গমণ করতেন না। অথচ রাসূল (ﷺ)এর ওফাতের পর সাহাবাদের বরকতের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায় নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে আরো বেশী প্রয়োজন ছিল। তা সত্বেও কোন সাহাবী রাসূল (ﷺ)এর রেখে যাওয়া কোন জিনিষ থেকে বরকত লাভ করার চেষ্টা করেন নি। কারণ তারা ভাল করেই জানতেন যে বরকত লাভের ধারাবাহিকতা রাসূল (ﷺ)এর ওফাতের পর শেষ হয়ে গেছে। রাসূলের (ﷺ) জীবিতাবস্থায় তাঁর শরীর থেকে বরকত লাভ করাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে আওলীয়াদের ব্যবহৃত বস্তু থেকে বরকত লাভ করা বৈধ মনে করা আরও কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। কারণ সাহাবাগণ তাঁদের মধ্যকার সৎ লোক যেমন আবু বকর, উমার এবং অন্যান্য সম্মানিত সাহাবাদের কারও নিকট থেকে বরকত লাভ করেন নি। জীবিত সাহাবীদের কাছ থেকেও নয় এবং মৃত্যুবরণকারী সাহাবীদের কাছ থেকেও নয়। তাঁদের কেউ নামায আদায় কিংবা দুআ করার জন্য গারে হেরা বা হেরা পাহাড়েও যেতেন না, যেখানে রাসূল (ﷺ)এর উপর অহী নাযিল হয়েছিল। তেমনিভাবে তারা নামায পড়া অথবা দুআ করার জন্য তুর পাহাড়েও যেতেন না, যেখানে মূসা (আঃ)এর সাথে আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন। যেসমস- পাহাড়ের কিছু কিছু স্থানে নবী ও অলীদের অবস্থানের কথা প্রমাণিত আছে, সেসমস- স্থানে তাঁরা যেতেন বলেও কোন প্রমাণ নেই। রাসূল (ﷺ) মদীনাতে সবসময় যেস্থানে নামায আদায় করতেন, সাহাবীদের কেউ সেখানে গিয়ে তা স্পর্শ করেছেন বা চুম্বন করেছেন বলে প্রমাণিত নেই। এমনিভাবে মক্কা বা অন্যান্য স্থানের ক্ষেত্রেও অনুরূপ। সুতরাং যে সমস- স্থানে রাসূল (ﷺ) সম্মানিত পা দু’টি দিয়ে হেঁটেছেন, যেখানে তিনি নামায আদায় করেছেন উম্মতের জন্য সে সমস- স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করা যদি বৈধ না হয়, তাহলে অন্য কোন অলীর নামায বা ঘুমানোর স্থানে বরকতের জন্য স্পর্শ করা বা চুম্বন করা কিভাবে বৈধ হতে পারে? মোট কথা মুসলিম উম্মার উলামা সমপ্রদায় এ ব্যাপারে একমত যে, বরকতের জন্য কোন স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করা মুহাম্মাদ (ﷺ)এর নিয়ে আসা শরীয়তের কোন অংশ নয়।
৩) ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে বিদআতসমূহঃ
বর্তমানে ইবাদতের ক্ষেত্রে যে সমস- বিদআতের আবিষ্কার হয়েছে, তার সংখ্যা অনেক। যার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। অথচ আল্লাহর ইবাদতের জন্য মূলনীতি হল, সকল প্রকার ইবাদতের পক্ষে কুরআন বা হাদীছ থেকে দলীল থাকতে হবে। দলীল ছাড়া কোন ইবাদত শরীয়তভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। যে ইবাদতের পক্ষে কোন দলীল নেই, তা বিদআত হিসাবে পরিগণিত হবে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন আ‘মাল করল, যার পক্ষে আমাদের কোন আদেশ নাই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে”। বর্তমানে যে সমস- বিদআতের চর্চা করা হয়, তার কতিপয় দৃষ্টান্ত পেশ করা হলঃ
১) নামাযের শুরুতে মুখে নিয়ত পাঠ করাঃ
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযসহ অন্যান্য সকল নামাযের শুরুতে নাওয়াইতু বলে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা একটি বিদআত। কারণ এটা রাসূল (ﷺ)এর সুন্নাতে নেই। আল্লাহ তায়া’লা বলেন,
قُلْ أَتُعَلِّمُونَ اللَّهَ بِدِينِكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
অর্থঃ তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে শিক্ষা দিতে চাও? অথচ আল্লাহ তায়া’লা আকাশ-যমীনের মধ্যকার সকল বস্তুসম্পর্কে অবগত আছেন। আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। (সূরা হুজরাতঃ ১৬) নিয়তের স্থান অন্তর। এটা অন্তরের কাজ, মুখের কাজ নয়। মুখে নিয়ত উচ্চারণের পক্ষে কোন সহীহ তো দূরের কথা, কোন যঈফ হাদীছও পাওয়া যায় না। রাসূল (ﷺ), সাহাবায়ে কেরাম, কোন তাবেঈ বা চার ইমামের কোন ইমাম এভাবে নিয়ত উচ্চারণ করেন নি। এটা কোন এক বুযুর্গ ব্যক্তির তৈরী করা প্রথা। ইসলামের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং তা বর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির জন্য ফরজ। পূর্বেই বলা হয়েছে, নিয়ত শব্দের অর্থঃ ইচ্ছা বা সঙ্কল্প করা। আর তা অন্তরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। মুখের মাধ্যমে নয়। সুতরাং কোন কিছু করার জন্য অন্তরে ইচ্ছা বা সঙ্কল্প করলেই সে কাজের নিয়ত হয়ে গেল। তা মুখে বলতে হবেনা।
২) ফরজ নামাযের আগে-পরে দলবদ্ধভাবে জিকির করাঃ
আমর বিন ইয়াহয়া হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার পিতাকে আমার দাদা হতে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা একবার ফজরের নামাযের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)এর ঘরের দরজার সামনে বসা ছিলাম। উদ্দেশ্য হল তিনি যখন বের হবেন, আমরা তার সাথে পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে যাত্রা করব। এমন সময় আমাদের কাছে আবু মূসা আশআরী (রাঃ) আগমণ করে বললেন, আবু আব্দুর রাহমান (ইবনে মাসউদের উপনাম) কি বের হয়েছেন? আমরা বললাম, এখনও বের হন নি। তিনিও আমাদের সাথে বসে গেলেন। তিনি যখন বের হলেন, আমরা সকলেই তাঁর কাছে গেলাম। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বললেন, হে আবু আব্দুর রাহআন! আমি মসজিদে এখনই একটি নতুন বিষয় দেখে আসলাম। আল-হাম্ দু লিল্লাহ, এতে খারাপ কিছু দেখিনি। তিনি বললেন সেটি কি? আবু মুসা (রাঃ) বললেন, আপনার হায়াত দীর্ঘ হলে আপনিও তা দেখতে পাবেন। তিনি বললেন, আমি দেখলাম মসজিদে একদল লোক গোলাকার হয়ে বসে নামাযের অপেক্ষা করছে। সেই দলের মাঝখানে একজন লোক রয়েছে। আর সবার হাতে রয়েছে ছোট ছোট পাথর। মাঝখানের লোকটি বলছে, একশতবার আল্লাহু আকবার পাঠ কর। এতে সকলেই একশতবার আল্লাহু আকবার পাঠ করে। তারপর বলে একশতবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পাঠ কর। এ কথা শুনে সবাই একশতবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে থাকে। তারপর লোকটি বলে এবার একশতবার সুবহানাল্লাহ পাঠ কর। সবাই একশতবার সুবহানাল্লাহ পাঠ করে থাকে। একথা শুনে ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে তাদের পাপের কাজগুলো গণনা করে রাখতে বললে না কেন? আর এটা বললে না কেন যে তাদের নেকীর কাজগুলো থেকে একটি নেকীও নষ্ট হবেনা। কাজেই এগুলো হিসাব করে রাখার কোন দরকার নাই। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রাঃ) চলতে থাকলেন। আমরাও তার সাথে চললাম এবং একটি হালাকার (বৈঠকের) কাছে এসে উপসি’ত হলাম। তিনি তাদের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, একি করছ তোমরা? তারা সবাই বলল পাথরের মাধ্যমে গণনা করে আমরা তাকবীর, তাসবীহ্ ইত্যাদি পাঠ করছি। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের পাপের কাজগুলোর হিসাব কর। কারণ পাপের কাজগুলো হিসাব করে তা থেকে তাওবা করা দরকার। আমি এ ব্যাপারে জিম্মাদার হলাম যে, তোমাদের ভাল কাজগুলোর একটি ভাল কাজও নষ্ট হবেনা। এ কথা বলার কারণ এই যে আল্লাহর কাছে কারও আ‘মাল বিনষ্ট হয়না। বরং একটি আমলের বিনিময়ে দশটি ছাওয়াব দেয়া হয় এবং দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদের উম্মাত! অমঙ্গল হোক তোমাদের! কিসে তোমাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে?!! এখনও নবী মুহাম্মাদের অসংখ্য সাহাবী জীবিত আছেন। এই তো রাসূল (ﷺ)এর কাপড় এখনও পূরাতন হয়নি। তাঁর ব্যবহারকৃত থালা-বাসন গুলো এখনও ভেঙ্গে যায়নি। ঐ সত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যে দ্বীন তৈরী করেছ তা কি মুহাম্মাদের দ্বীন হতে উত্তম? না তোমরা গোমরাহীর দ্বার উম্মুক্ত করেছ? তারা বলল, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমরা এর মাধ্যমে কল্যাণ ছাড়া অন্য কোন ইচ্ছা করিনি। তিনি বললেন, অনেক কল্যাণকামী আছে, যে তার উদ্দেশ্য পর্যন্ত ন্তপৌঁছতে পারে না। আল্লাহর নবী (ﷺ) আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, একটি দল কুরআন তিলাওয়াত করবে, কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালীর ভিতরে প্রবেশ করবেনা। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মনে হয় তাদের অধিকাংশই তোমাদের থেকে বের হবে। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাদেরকে ছেড়ে চলে আসলেন। আমর ইবনু সালামা (রাঃ) বলেন, আমরা তাদের অধিকাংশকেই দেখলাম নাহ্ রাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের সাথে আমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি কারণে ইবনু মাসউদ (রাঃ) এ ভালকাজগুলো অপছন্দ করেছেন। প্রথমতঃ তাস্ বীহ পাঠ করার জন্য গোলাকার হয়ে বসা। দ্বিতীয়তঃ তাসবীহ্ সমূহের সংখ্যা ১০০ নির্ধারণ করা। তৃতীয়তঃ পাথরের মাধ্যমে হিসাব করে এগুলো পাঠ করা। কেননা তাসবীহ্ পাঠের উল্লেখিত পদ্ধতির কোনটিই রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। জিকিরের ক্ষেত্রে মূলনীতি হল, প্রত্যেক ব্যক্তি হাদীছে বর্ণিত জিকিরগুলো একা একা পাঠ করবে।
৩) মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিদআতঃ
মৃত ব্যক্তির উপকারের জন্য কুলখানি, চল্লিশা, হাফেজ-আলেমদের দাওয়াত দিয়ে কুরআন খতম, সবীনা খতম পড়িয়ে মৃতের রূহের উপর বখশানো, খতমে ইউনুস, খতমে জালালী, ফাতেহা খানি, ইছালে ছাওয়াব ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পালন করা সম্পূর্ণ বিদআত। এগুলোর পক্ষে কোন দলীল নেই। এ সমস- অনুষ্ঠানে শরীক হয়ে হাদীয়া ও টাকা-পয়সা গ্রহণ বা প্রদান করা সম্পূর্ণ হারাম।
৪) ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনঃ
রাসূল (ﷺ)এর মিরাজে গমণ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করা এবং রজব মাসের ২৭ তারিখের রাত্রিতে শবে মিরাজের নামে এরাত্রি উয্ যাপন করা ও এতে বিভিন্ন ইবাদতে লিপ্ত হওয়া বিদআত। এমনিভাবে হিজরী নব বর্ষ পালন করা এবং এতে শুভেচ্ছা বিনিময় করার ক্ষেত্রে শরীয়তের কোন দলীল নাই।
৫) রজব মাসে বিভিন্ন বিদআতঃ
রজব মাস ফজীলতপূর্ণ মনে করে এমাসে বিভিন্ন ইবাদত করা বিদআত। এমাসে ওমরাহ্ পালন করা। এটাকে রজবী ওমরাহ্ বলা হয়ে থাকে, বেশী করে নফল নামায পড়া এবং নফল সওম রাখা, সবই বিদআতের অন্তর্ভূক্ত। কেননা অন্যান্য মাসের উপর রজব মাসের আলাদা কোন ফজীলত নেই। এমাসের ওমরাহ্ , নামায, সওম এবং অন্য কোন প্রকার ইবাদতে অন্য মাসের চেয়ে অতিরিক্ত কোন ছাওয়াব পাওয়া যায়না।
৬) সূফীদের বানোয়াট ওযীফাঃ
সূফীদের যত জিকির রয়েছে, সবই বানোয়াট ও বিদআতী জিকির। কেননা এগুলো সবই হাদীছে বর্ণিত শরীয়ত সম্মত জিকিরের পরিপন্থী। তাছাড়া দলবদ্ধ হয়ে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর জিকির, আল্লাহু আল্লাহু বলে জিকির করা, জিকিরে যলী, জিকিরে খফী, জিকিরে রূহী, জিকিরে কলবী ইত্যাদি সবই ইবাদতের নামে নতুন সৃষ্টি তথা বিদআত বা ইসলাম বহির্ভুত কাজ।
৭) শবে বরাতের বিদআতঃ
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে কিয়াম করা (নফল নামায পড়া) এবং পরের দিন ছিয়াম পালন করা বিদআত। রাসূল (ﷺ) থেকে এই রাতের নফল নামায এবং দিনের বেলা সওম রাখার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীছ পাওয়া যায়না। এরাতকে আমাদের দেশের পরিভাষায় শবে বরাত বলা হয়ে থাকে। এরাত সম্পর্কে মানুষের বিদআতী ধারণা এবং এরাতে মানুষ যেসমস- বিদআতী আ‘মাল করে তার বি স্তারিত বিবরণ প্রয়োজন। নিম্মে তার কিছু বিবরণ পেশ করা হলঃ
শবে বরাতে কুরআন নাযিল হয়েছে বলে ধারণাঃ
শবে বরাত পালনকারীদের বক্তব্য হল, শবে বরাতের রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে। সূরা দুখানের ৩নং আয়াতকে তারা দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে। আল্লাহ বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ
অর্থঃ আমি কুরআনুল কারীমকে একটি বরকতপূর্ণ রাতে অবতীর্ণ করেছি। এবরকতপূর্ণ রাতই হল শবে বরাতের রাত। কতিপয় আলেম এভাবেই অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন।
তাদের এব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এখানে বরকতপূর্ণ রাত বলতে লাইলাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনে কাছীর (রঃ) বলেন, অত্র বরকতপূর্ণ রাতই হল লাইলাতুল ক্বদর বা ক্বদরের রাত। যেমন অন্যত্র সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য কথা হল, কুরআনের কোন অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা যদি অন্য কোন আয়াতে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়, তাহলে কুরআনের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ সূরা কদরের শুরুতে বলেন, إِنَّ أَنْزَلْنَاهُ فِى لَيْلَةِ الْقَدْرِ
অর্থঃ আমি কুরআনকে ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা কদরঃ ১) আর এ কথা সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত যে, লাইলাতুল ক্বদর রামাযান মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে নয়। এমনিভাবে আল্লাহ তায়া’লা রামাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সূরা বাকারায় বলেন, شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِى أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ
অর্থঃ রামাযান মাস এমন একটি মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) সুতরাং শবে বরাতে কুরআন নাযিল হওয়ার কথা গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।
শবে বরাতের রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার ধারণাঃ
শবে বরাতসহ অন্যান্য বিদআতী ইবাদতের পক্ষের আলেমগণ বলে থাকে, এরাতের শেষের দিকে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং সকল মানুষকে ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্বলব গোত্রের বকরীগুলোর লোম সংখ্যার চেয়ে অধিক সংখ্যক লোকের গুনাহ ক্ষমা করে থাকেন।
উপরোক্ত অর্থ বহনকারী হাদীছটি কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সকল বর্ণনাই যঈফ বা দূর্বল। নির্দিষ্টভাবে এরাতে আল্লাহর দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা চাওয়ার প্রতি আহবান জানানোর হাদীছটি সুনানে ইবনে মাজায় জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। হাদীছের সনদে ইবনে আবু সাব্ রাহ্ নামে একজন জাল হাদীছ বর্ণনাকারী রাবী রয়েছে। তাছাড়া হাদীছটি বুখারী সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রনে’ বর্ণিত সহীহ হাদীছের বিরোধী। সহীহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ তায়া’লা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি ক্ষমা করে দিব। অমুক আছে কি? অমুক আছে কি? এভাবে প্রতি রাতেই ঘোষণা করতে থাকেন। সুতরাং জাল হাদীছের উপর ভিত্তি করতঃ সহীহ হাদীছের মর্ম প্রত্যাখ্যান করে শবে বরাতের রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার আকীদা পোষণ করা এবং সে রাতে বিশেষ ইবাদত করার কোন বৈধতা নেই।
মৃত ব্যক্তির রূহ দুনিয়াতে আগমণের বিশ্বাসঃ
শবে বরাত পালনের পিছনে যুক্তি হল, এরাতে মানুষের মৃত আত্মীয়দের রূহসমূহ দুনিয়াতে আগমণ করে স্ব স্ব আত্মীয়দের সাথে সাক্ষা করে। এটি একটি অবান্তর ধারণা, যা কুরআন্তসুন্নার সুস্পষ্ট বিরোধী। আল্লাহ তায়া’লা বলেন,
) وَ مِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمٍ يُبْعَثُوْنَ (
অর্থঃ ওদের (মৃতদের) পিছনে রয়েছে অন্তরায়, তারা সেখানে কিয়ামত দিবস অবদি অবস্থান করবে। (সূরা মুমেনূনঃ ১০০)
এরাত্রে মানুষের ভাগ্য লিখা হয় বলে ধারণাঃ
তাদের এধারণাটিও ঠিক নয়। এ কথার পিছনে কুরআন হাদীছের কোন দলীল নেই। সহীহ হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
)كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ(
অর্থঃ আকাশ-জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহ তায়া’লা স্বীয় মাখলুকের তাকদীর লিখে রেখেছেন।
হালুওয়া রুটির রহস্যঃ
তাদের বক্তব্য হচ্ছে শবে বরাতের দিন ওহুদ যুদ্ধে নবী (ﷺ) এর দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছিল। তাই নবী (ﷺ) শক্ত খাবার খেতে না পারায় নরম খাদ্য হিসাবে হালুওয়া-রুটি খেয়েছিলেন। তাই আমরাও নবীর দাঁত ভাঙ্গার ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করে হালুওয়া-রুটি খেয়ে থাকি। এটি একটি কাল্পনিক কথা। কারণ ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে, শাবান মাসে নয়।
এ রাতে কবর যিয়ারতের পিছনে যুক্তি ও তা খন্ডনঃ
এরাতে রাসূল (ﷺ) বাকী কবরস্থান যিয়ারত করেছেন। তাই আমাদেরকেও এরাতে কবর যিয়ারত করতে হবে। এমর্মে ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ। হাদীছের সনদে হাজ্জাজ ইবনে আরত্বাত নামক একজন যঈফ রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।
একশত রাকাত নামাযের ভিত্তি খন্ডনঃ
এরাতে একশত রাকাত নামাযের ব্যাপারে যত হাদীছ রয়েছে, তার সবই জাল বা বানোওয়াট। এ নামায সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) থেকে কোন হাদীছ প্রমাণিত নেই। একশত রাকাত নামায পড়ার বিদআতটি ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়। মসজিদের ইমামগণ অন্যান্য নামাযের ন্যায় এ নামাযও চালু করে দেয়।
শবে বরাতের রোযাঃ
শবে বরাতের সওম রাখার প্রমাণ স্বরূপ দু’টি হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে। প্রথম হাদীছঃ শাবান মাসের মধ্যরাত এলে তোমরা রাতে কিয়াম কর এবং দিনে ছিয়াম পালন কর। এই হাদীছের সনদে ইবনে আবু সাব্ রাহ নামক একজন জাল হাদীছ রচনাকারী রাবী থাকার কারণে হাদীছটি গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয় হাদীছঃ ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন, একবার রাসূল (ﷺ) জনৈক ব্যক্তিকে বললেন, তুমি কি সিরারে শাবানের সওম রেখেছ? লোকটি বলল না। অতপর নবী (ﷺ) রামাযানের পরে সওম দু’টি কাযা আদায় করতে বললেন।
অধিকাংশ আলেমদের মতে সিরার অর্থ মাসের শেষ। উক্ত ব্যক্তি শাবানের শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সওম পালনে অভ্যস- ছিল অথবা এটা তার মানতের সওম ছিল। রামাযানের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ভয়ে সে সওম রাখা ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ শাবান মাসের শেষের দিকে রামাযানের রোযার সাথে মিশিয়ে সওম রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই রাসূল (ﷺ) তাকে সওম দু’টি কাযা আদায় করতে বলেছিলেন।
প্রিয় পাঠক মন্ডলী! শবে বরাতের পিছনে এত আয়োজন, যার জন্য সরকারী ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা এর পিছনে ব্যয় করা হয়ে থাকে। অথচ এর পিছনে কোন ভিত্তি নেই। মুসলিম জাতির উচিৎ এবিদআত থেকে বিরত থাকা। পরিতাপের বিষয় এই যে, অনেকেই এবিদআতকে বিদআতে হাসানাহ বলে থাকে। আসলে বিদআতে হাসানাহ বলতে কিছু নেই। ইসলামের নামে তৈরীকৃত সকল বিদআতই মন্দ, হাসানাহ বা ভাল বিদআত নামে কোন বিদআতের অসি-ত্ব নেই। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, )كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٍ وَ كُلُّ ضَلَالَةٍ فِى النَّارِ(
অর্থঃ প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা আর সমস- ভ্রষ্টতার পরিণাম হল জাহান্নাম। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, “সমস- বিদআতই ভ্রষ্টতা যদিও মানুষ তাকে উত্তম বলে থাকে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, শবে বরাতের এ আয়োজন শুধুমাত্র বাংলাদেশ, ভারত, পাকি স্তানসহ অনারব দেশসমূহেই দেখা যায়। আরব দেশসমূহে এর ত পরতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে ইসলামের প্রাণ কেন্দ্র সৌদি আরবে শবে বরাতের কোন অসি-ত্বই দেখা যায়না। মক্কা-মদীনার সম্মানিত ইমামগণের কেউ কোন দিন শবে বরাত উদ্ যাপন করার প্রতি জনগণকে উৎসাহিত করেন না। কারণ তারা ভাল করেই জানেন যে ইহা দ্বীনের কোন অংশ নয়। বরং তা একটি নব আবিষকৃত বিদআত। এজন্যই তাঁরা শবে বরাতসহ অন্যান্য সকল বিদআত থেকে মুসলিম জাতিকে সতর্ক করে থাকেন এবং তাদের সকল জুমআর খুৎবা ও অন্যান্য আলোচনা ও ভাষণে বিনা শর্তে কুরআন্তসুন্নার অনুসরণের আহবান জানান।
কবরের সাথে সম্পৃক্ত বিদআত সমূহ
বর্তমানকালে মুসলিম সমাজ যেসমস্ত বিদআতে পরিপূর্ণ তার মাঝে কবরের সাথে সম্পৃক্ত বিদআত সবচেয়ে ভয়াবহ। কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, কবর পাকা করা, কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা, কবর থেকে বরকত হাসিলের জন্য এবং মৃত অলীদের উসীলা দেয়াসহ অন্যান্য শির্কী উদ্দেশ্যে কবর যিয়ারত করা, মহিলাদের কবর যিয়ারত করা এসব কিছুই বিদআত। রাসূল (ﷺ) কবর যিয়ারতকারিনী মহিলা এবং কবরের উপর মসজিদ নির্মাণকারী ও কবরে প্রদীপ প্রজ্জলনকারীদের উপর লানত করেছেন।
রাসূল (ﷺ) শির্কের সকল পথই বন্ধ করে দিয়েছেন এবং শির্ক থেকে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। তিনি কবরের ব্যাপারে আরও কঠোরভাবে সাবধান করেছেন এবং আওলীয়া ও সৎ লোকদেরকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। কেননা সৎ লোকদেরকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করাই তাদের ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে সাবধান থাকবে। কেননা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেই অতীত জাতিসমূহ ধ্বংস হয়েছে। তিনি আরও বলেন, খৃষ্টানরা যেমন মরিয়মের পুত্র ঈসা (আঃ) কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা আমাকে নিয়ে তেমনভাবে বাড়াবাড়ি করনা। আমি আল্লাহর একজন বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল বল। তিনি কবরের উপর প্রাচীর নির্মাণ এবং ঘর-গম্বুজ নির্মান করতে নিষেধ করেছেন। আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী বলেন, আমাকে আলী (রাঃ) বললেন, আমাকে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যে কাজ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, আমি কি তোমাকে সে কাজ দিয়ে পাঠাবনা? তা এই যে কোন মূর্তি পেলে তা ভেঙ্গে ফেলবে এবং মাটি থেকে উঁচু কোন কবর পেলে তা ভেঙ্গে মাটির সমান করে দিবে। এমনিভাবে রাসূল (ﷺ) কবরের উপর চুনকাম করতে এবং তার উপর কোন প্রকার নির্মাণ কাজ করতে নিষেধ করেছেন। জাবের (রাঃ) রাসূল (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) কবরের উপর চুনা লাগাতে, কবরের উপর বসতে এবং তার উপর কিছু নির্মান করতে নিষেধ করেছেন।
রাসূল (ﷺ) কবরের কাছে নামায আদায় করতে নিষেধ করেছেন। উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রাঃ) বলেন,
)لَمَّا نُزِلَ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَفِقَ يَطْرَحُ خَمِيصَةً لَهُ عَلَى وَجْهِهِ فَإِذَا اغْتَمَّ كَشَفَهَا عَنْ وَجْهِهِ فَقَالَ وَهُوَ كَذَلِكَ لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ يُحَذِّرُ مِثْلَ مَا صَنَعُوا(
অর্থঃ রাসূল (ﷺ) যখন মৃত্যুকালিন সময়ে উপনীত হলেন, তখন তাঁর মুখমন্ডল একটি চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। তাঁর অবস্থা যখন একটু ভাল হত, তখন মুখের উপর থেকে চাদরটি সরাতেন এবং বলতেন ইয়াহুদ-নাসারাদের উপর আল্লাহর লানত, তারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে। তাদের মত করা থেকে সাবধান করার জন্যই তিনি একথা বলেছেন। তাঁর কবরকে মসজিদে পরিণত করার ভয় না থাকলে মুমেন জননী আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে কবর না দিয়ে তাঁকে ঘরের বাইরে কবর দেয়া হত। রাসূল (ﷺ) আরও বলেন,
أَلَا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ
অর্থঃ জেনে রাখা উচিৎ যে, তোমাদের পূর্বের লোকেরা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করত। সাবধান! তোমরা কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করোনা। আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি। কবরকে মসজিদে পরিণত করার অর্থ হল কবরের কাছে নামায আদায় করা। যদিও তার উপর মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। মূলতঃ নামাযের জন্য কোন স্থানে গমণ করাই উক্ত স্থানকে মসজিদে রূপান্তরিত করার শামীল।
বর্তমান কালে অধিকাংশ মুসলিম সমাজ রাসূল (ﷺ) এর নিষেধ অমান্য করে চলেছে। রাসূল (ﷺ) যা নিষেধ করেছেন, তারা তাতেই লিপ্ত হয়েছে। এতে করে তারা বড় শির্কে লিপ্ত হয়েছে। কবরের উপর নির্মাণ করেছে মসজিদ, গম্বুজ। কবরকে পরিণত করেছে মাযার বা যিয়ারতের স্থানে। লিপ্ত হয়েছে তার কাছে পশু যবেহ করা, কবরবাসীর কাছে দুআ করা, তাদের কাছে আশ্রয় চাওয়া, তাদের নামে মানতি পেশ করাসহ শির্কের প্রতিটি প্রকারে।
রাসূল (ﷺ) কবরের কাছে বা কবরের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে নিষেধ করেছেন। মুসলিমেরা তাঁর নিষেধ অমান্য করে কবরকে নামাযের স্থানে পরিণত করেছে। তিনি কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। তারা তাকে মসজিদে পরিণত করেছে। তিনি কবরে প্রদীপ জ্বালাতে নিষেধ করেছেন। তারা তাতে বাতি জ্বালিয়ে হাজার হাজার টাকা অপচয় করছে। রাসূল (ﷺ) মাযারের (কবরের) পাশে ওরশ (উৎসব) করতে নিষেধ করেছেন। এরা কবরের পাশে প্রতি বছর ঈদের মত উৎসব পালন করে চলছে। রাসূল (ﷺ) উঁচু কবরকে মাটির সাথে সমান করে দিতে বলেছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে ইমাম মুসলিম আবুল হাইয়াজ আল আসাদী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, আবুল হাইয়াজ আল আসাদী (রাঃ) বলেন,
)قَالَ لِي عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ أَلَّا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ(
অর্থঃ আমাকে আলী (রাঃ) বললেন, রাসূল (ﷺ) আমাকে যে কাজের জন্য পাঠিয়েছিলেন, আমি কি তোমাকে সে কাজের জন্য পাঠাবো না? তা এই যে কোথাও কোন মূর্তি দেখতে পেলে তা ভেঙ্গে ফেলবে। কোন উঁচু কবর পেলে তা মাটির সাথে সমান করে দিবে। সহীহ মুসলিম শরীফে ছুমামা বিন শুফাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আমরা একদা ফুজালা বিন উবাইদের সাথে রোম দেশের বারদুস অঞ্চলে ছিলাম। সেখানে আমাদের একজন সঙ্গী মৃত্যু বরণ করলেন। ফুজালা (রাঃ) তাঁর কবরকে মাটির সাথে সমান করে রাখতে বললেন। কবর পূজারীরা হাদীছের বিরোধীতা করে কবরকে ঘরের মত উঁচু করে থাকে।
প্রিয় পাঠক ভাই! লক্ষ্য করুন! কবরের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) কি বলেছেন, আর এরা করছে কি। তারা রাসূল (ﷺ)এর সুন্নাতের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলছে। তাদের বিদআতী কাজ-কর্মের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
প্রিয় পাঠক ! আরো লক্ষ্য করুন! রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে কেন কবর যিয়ারত করতে বলেছেন? আমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে বলেছেন যাতে কবর আমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং যাতে আমরা কবরের পাশে গিয়ে কবরবাসীর জন্য দুআ করতে পারি, তার জন্য আল্লাহর রহ্ মত ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি। বর্তমান যুগের নামধারী মুসলিমেরা কবর যিয়ারতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ পালটিয়ে দিয়েছে। দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। বর্তমানে তাদের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হল তথায় গিয়ে শির্কে লিপ্ত হওয়া, কবরবাসীর কাছে দুআ করা, তার উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করা, কবরবাসীর কাছে প্রয়োজন পূর্ণ করার আবেদন করা, কবর থেকে বরকত তালাশ করা ইত্যাদি।
পরিশিষ্ট
বিদআত হল কুফরীর প্রাথমিক পর্যায়। তা দ্বীনের মাঝে এমন বিষয় অতিরিক্ত করার নামান্তর, যার অনুমতি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল প্রদান করেন নি। বিদআত যে কোন ক্ববীরা গুনাহ থেকে নিকৃষ্ট। শয়তানের কাছে ক্ববীরা গুনাহের চেয়ে বিদআত অনেক বেশী প্রিয়। কেননা পাপী লোক পাপ করার সময় ভাল করেই জানে যে, সে পাপের কাজে লিপ্ত হচ্ছে। তাই সে তাওবা করার সুযোগ পায়। কিন্তু বিদআতী বিদআতকে দ্বীন মনে করেই পালন করে থাকে। কাজেই সে তাওবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। নবী (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ حَجَبَ التَّوْبَةَ عَنْ صَاحِبِ بِدْعَةٍ حَتَّى يَدَعَهَا
অর্থঃ বিদআত পরিত্যাগ করার পূর্বে আল্লাহ তায়া’লা বিদআতীর তাওবা কবূল করেন না। বিদআত সুন্নাতকে ধ্বংস করে ফেলে এবং বিদআতীরা সুন্নাত ও সুন্নীদেরকে ঘৃণা করে।
বিদআত মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আল্লাহর ক্রোধকে আবশ্যক করে এবং অন্তরকে নষ্ট করে দেয়। বিদআতী কিয়ামতের দিনে নবী (ﷺ) এর হাউজে কাউছার থেকে বঞ্চিত হবে। নবী (ﷺ) বলেন
إِنِّي فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَيَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِي ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَأَقُولُ إِنَّهُمْ مِنِّي فَيُقَالُ إِنَّكَ لَا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِي
অর্থঃ কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের জন্যে হাউজে কাউছারের নিকট উপস্থিত থাকব। যে ব্যক্তি আমার কাছে আসবে, আমি তাকে তা থেকে পানি পান করাবো। যে আমার হাউজ থেকে একবার পানি পান করবে, তার আর কখনও পিপাসা হবে না। এমন সময় আমার কাছে একদল লোক আগমণ করবে। আমি তাদেরকে চিনতে পাবো। তারাও আমাকে চিনতে পাবে। অতঃপর আমার ও তাদের মাঝে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হবে। আমি বলব, তারা আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না, তারা আপনার পরে কত বিদআত তৈরী করেছিল। আমি বলব আমার রেখে আসা দ্বীনের মধ্যে যারা পরিবর্তন করেছো, তারা এখান থেকে সড়ে যাও। অতঃপর তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হবে।
বিদআতীকে নছীহত করা এবং তার বিদআতের প্রতিবাদ করা ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে বিদআতীর সাথে চলা-ফেরা করা বৈধ নয়। কেননা এতে বিদআতীর খারাপ আক্বীদা ও আমলগুলো অন্যদের মাঝে প্রবেশ করতে পারে।
বিদআতীদেরকে শক্তি প্রয়োগ করে ঠেকানো সম্ভব না হলে বিদআতী এবং তাদের অনিষ্টতা হতে মানুষকে সতর্ক করা আবশ্যক। আর শক্তি প্রয়োগ করার সুযোগ থাকলে মুসলিম সমাজের আলেমদের এবং শাসকদের উচিৎ শক্তি প্রয়োগ করে বিদআত প্রতিহত করা ও বিদআতীদেরকে শাসি- দেয়া। কেননা তারা ইসলামের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জেনে রাখা উচিৎ যে, কুফরী রাষ্টসমূহ বিদআতীদেরকে তাদের বিদআত প্রচারে উৎসাহ এবং বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করে থাকে। তারা এটাকে ইসলাম ধ্বংসের অন্যতম মাধ্যম মনে করে।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাঁর দ্বীনকে বিজয় দেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে অপমানিত করেন। নবী (ﷺ), তাঁর পরিবার এবং তাঁর সাথীদের উপর শান্তির ধারা বর্ষিত হোক।
0 Comments