▌কুরবানির
সংক্ষিপ্ত বিধিবিধান
·
[এটি একটি আরবি নিবন্ধের অনুবাদ। সম্মানিত শাইখ ড. ‘আলাউয়ী বিন ‘আব্দুল ক্বাদির
আস-সাক্বক্বাফ (হাফিযাহুল্লাহ)’র তত্ত্বাবধানে ‘দুরারুস সানিয়্যাহ’ ফাউন্ডেশনের
গবেষণা বিভাগ এই নিবন্ধ প্রণয়ন করেছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিবন্ধটি সংক্ষিপ্ত, তথ্যবহুল ও সারগর্ভ হওয়ায়, আমরা এর সরল বঙ্গানুবাদ বাঙালি মুসলিম
পাঠকবর্গের করকমলে পেশ করছি। জ্ঞাতব্য যে, আমরা অনূদিত নিবন্ধের
কলেবর ছোটো করার জন্য আরবি ভূমিকাটি এড়িয়ে গিয়ে সরাসরি মূল আলোচনার শুরু
থেকে শেষ পর্যন্ত অনুবাদ করেছি। – অনুবাদক]
·
❏ প্রথম পরিচ্ছেদ: উদ্বহিয়্যাহ তথা কুরবানির পরিচয়, বৈধতা, ফজিলত ও হিকমাহ
১. উদ্বহিয়্যাহ’র পরিচয়:
আভিধানিক অর্থে, যে পশুকে কুরবানি করা হয় তথা ইদুল আজহার দিনগুলোতে জবেহ করা
হয়,
তাকেই উদ্বহিয়্যাহ বা কুরবানি বলে।
উদ্বহিয়্যাহ’র বহুবচন হলো আদ্বাহী।
পারিভাষিক অর্থে, আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জনের জন্য ইদুল আজহার দিন থেকে শুরু করে
আইয়্যামে তাশরীক্বের (১১, ১২ ও ১৩ই
যুলহাজ্ব) শেষদিন পর্যন্ত যে গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুকে কুরবানি করা হয়, তাকে উদ্বহিয়্যাহ তথা কুরবানি বলা হয়।
·
২. কুরবানির বৈধতা:
কুরবানি শরিয়তসম্মত হওয়ার ব্যাপারে
‘আলিমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এই ইজমা‘ (মতৈক্য) বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু কুদামাহ, ইমাম ইবনু দাক্বীক্ব আল-‘ঈদ, ইমাম ইবনু হাজার, ইমাম শাওকানী, ইমাম শানক্বীত্বী ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
·
৩. কুরবানির ফজিলত:
প্রথমত, কুরআন থেকে: মহান আল্লাহ বলেছেন, ذَٰلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ “এটাই হলো আল্লাহ’র বিধান; যে আল্লাহ’র নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরস্থ তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত।” [সূরাহ
হাজ্ব: ৩২] আর কুরবানির পশু মহান আল্লাহ’র নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয়ত, সুন্নাহ থেকে: বারা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, নাবী ﷺ বলেছেন, مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلاَةِ فَإِنَّمَا يَذْبَحُ لِنَفْسِه وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكُه وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ “যে ব্যক্তি (ইদের) নামাজের আগে জবেহ করেছে, সে কেবল নিজের জন্যই জবেহ করেছে। আর যে ব্যক্তি নামাজের পরে
জবেহ করেছে, সে তার কুরবানি
পূর্ণ করেছে। আর সে মুসলিমদের রীতি অনুসারেই করেছে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৫৫৬]
তৃতীয়ত, আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে জবেহ করা এবং কুরবানি করার মাধ্যমে তাঁর
নৈকট্য কামনা করা সবচেয়ে মহান ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। মহান
আল্লাহ তাঁর মহান কিতাবের একাধিক জায়গায় নামাজের সাথে জবেহ করার বিষয়টি মিলিয়ে
উল্লেখ করেছেন, জবেহের উচ্চ
মর্যাদা ও বড়ো অবস্থানের কারণে।
·
৪. কুরবানির বিধানের হিকমাহ:
ক. জীবনের মতো নেয়ামতের জন্য আল্লাহ’র
প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা
খ. ইবরাহীম (‘আলাইহিস সালাম) এর
সুন্নাহ’র পুনরুজ্জীবন:
যখন মহান আল্লাহ ইবরাহীম (‘আলাইহিস
সালাম) কে তাঁর পুত্র ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিস সালাম) এর বিনিময়ে প্রদত্ত কুরবানিকে জবেহ
করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন তিনি সেই
নির্দেশ পালন করেছিলেন। আর এখন মু’মিন ব্যক্তি ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিমাস
সালাম) এর ধৈর্যের কথা এবং নিজের জীবন ও পুত্রের ওপর আল্লাহ’র আনুগত্য ও
ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা স্মরণ করবে। পুত্রকে কুরবানি দেওয়ার পরীক্ষা-রীতি
উঠিয়ে নেওয়ার এবং পুত্রের বিনিময়ে পশু কুরবানি দেওয়ার রীতি চালু হওয়ার কারণ ছিলেন
তাঁরা দুজনেই। মু’মিন যখন এ কথা স্মরণ করবে, তখন সে আল্লাহ’র আনুগত্যের ওপর ধৈর্যধারণের ক্ষেত্রে এবং
অন্তরের চাওয়া ও প্রবৃত্তির ওপর আল্লাহ’র ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে
তাঁদের দুজনকে অনুসরণ করবে।
গ. এতে নিজেকে এবং পরিবারকে স্বচ্ছল
করার মাধ্যম রয়েছে:
অনুরূপভাবে প্রতিবেশি ও দুর্বল
ব্যক্তির প্রতি সদয় হওয়া এবং অভাবী ব্যক্তিকে দান করার মাধ্যম রয়েছে এতে। এগুলো
সবই মানুষের ওপর আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহের মাধ্যমে আনন্দ ও খুশি প্রকাশের মাধ্যম।
এটাই আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহের বয়ান। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ “আর তোমার রবের
অনুগ্রহ তুমি বর্ণনা করো।” [সূরাহ দুহা: ১১]
ঘ. পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মধ্যে
আল্লাহ প্রদত্ত সংবাদের প্রতি সত্যায়ন রয়েছে:
অর্থাৎ, এ বিষয়ের সত্যায়ন যে, তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন। আর
মানুষের খাদ্যস্বরূপ এগুলোকে জবেহ করার অনুমতি দিয়েছেন।
·
❏ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: কুরবানির বিধান এবং কুরবানি
নির্দিষ্টকরণের পদ্ধতি
১. কুরবানির বিধান:
‘আলিমগণ কুরবানির বিধানের ব্যাপারে দুটো মতে মতানৈক্য
করেছেন। যথা:
প্রথম মত: কুরবানি করা সুন্নাতে
মু’আক্কাদাহ। এটাই অধিকাংশ ফাক্বীহ’র মত। এটি মালিকীদের প্রসিদ্ধ মত এবং শাফি‘ঈ, হাম্বালী ও যাহিরীদের মত। একটি বর্ণনা অনুযায়ী এটি ইমাম আবূ
ইউসুফেরও মত। এই মতটি পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনুল মুনযির, ইমাম সান‘আনী, ইমাম ইবনু বায
এবং স্থায়ী কমিটি (সৌদি ফাতাওয়া বোর্ড)। অধিকাংশ ‘আলিম এই মত ব্যক্ত করেছেন।
দ্বিতীয় মত: সামর্থবান ব্যক্তির ওপর
কুরবানি করা ওয়াজিব। এটি হানাফীদের মত, মালিকীদেরও একটি
মত এবং হাম্বালীদেরও একটি তাখরীজকৃত মত। একদল সালাফ এই মত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম
ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইমাম সান‘আনী এই মতকে পছন্দ করেছেন। ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন এই মত
প্রকাশ করেছেন।
·
২. মানতের কুরবানি করার বিধান:
যে ব্যক্তি কুরবানি করার মানত করেছে, তার জন্য সেই মানত পূরণ করা ওয়াজিব। চাই সেই মানত নির্দিষ্ট
পশু কুরবানি করার ব্যাপারে হোক, কিংবা
অনির্দিষ্ট পশু কুরবানি করার ব্যাপারে হোক। চারটি ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের ঐক্যমতে মানতের কুরবানি করার বিধান ওয়াজিব।
·
৩. কীসের মাধ্যমে কুরবানির পশুর
নির্দিষ্টকরণ সাব্যস্ত হয়?
‘আলিমগণ ওই মাধ্যমের ব্যাপারে তিনটি মতে মতানৈক্য করেছেন, যার দ্বারা কুরবানির পশু নির্দিষ্ট হয়। যথা:
প্রথম মত: কথার মাধ্যমে কুরবানির পশু
নির্দিষ্ট হয়। যেমন এরূপ বলা যে, এটি কুরবানির
পশু। এটি হাম্বালী ও শাফি‘ঈদের মত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
দ্বিতীয় মত: নিয়াত-সহ কুরবানির পশু
কেনার মাধ্যমে কুরবানির পশু নির্দিষ্ট হয়। এটি হানাফীদের মত এবং হাম্বালীদেরও
আরেকটি মত। এই মতই ব্যক্ত করেছেন ইমাম ইবনুল ক্বাসিম, যিনি মালিকীদের একজন। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু
তাইমিয়্যাহ এবং স্থায়ী কমিটি (সৌদি ফাতাওয়া বোর্ড)।
তৃতীয় মত: কেবল জবেহের মাধ্যমেই
কুরবানির পশু নির্দিষ্ট হয়। এটি মালিকীদের প্রসিদ্ধ মত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম
শাওকানী।
·
❏ তৃতীয় পরিচ্ছেদ: কুরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি
১ম শর্ত: কুরবানির পশু গৃহপালিত পশুর
অন্তর্ভুক্ত হতে হবে, আর সেগুলো হলো
উট,
গরু ও ছাগল।
এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, কুরবানির পশুকে গৃহপালিত পশুর অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। আর
সেগুলো হলো উট, গরু ও ছাগল। এ
ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু ‘আব্দিল বার্র, ইমাম ইবনু রুশদ, ইমাম নাওয়াউয়ী ও
ইমাম সান‘আনী।
·
২য় শর্ত: কুরবানির পশুকে
শরিয়ত-নির্ধারিত বয়সে উত্তীর্ণ হতে হবে।
এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, কুরবানির পশুকে শরিয়ত-নির্ধারিত বয়সে উত্তীর্ণ হতে হবে। মেষ
(ভেড়া) ছাড়া অন্য পশুর ক্ষেত্রে সানিয়্যাহ ব্যতিরেকে এবং মেষের ক্ষেত্রে জাযা‘
ব্যতিরেকে কুরবানির পশু শার‘ঈভাবে যথেষ্ট হবে না। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন
ইমাম ইবনু ‘আব্দিল বার্র, ইমাম নাওয়াউয়ী ও
ইমাম শানক্বীত্বী। ইমাম ইবনু হাযম ছাগলের ক্ষেত্রে সানিয়্যাহ যথেষ্ট হওয়ার
ব্যাপারে এবং ইমাম তিরমিযী মেষের ক্ষেত্রে জাযা‘ যথেষ্ট হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘
বর্ণনা করেছেন।
উট, গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে সানিয়্যাহ এবং মেষের ক্ষেত্রে জাযা‘—পরিভাষা
দুটোর অর্থ:
পাঁচ বছর পূর্ণকারী উট, দুই বছর পূর্ণকারী গরু এবং এক বছর পূর্ণকারী ছাগল হলো
সানিয়্যাহ পশু। আর ছয় মাস পূর্ণকারী মেষ হলো জাযা‘ পশু। এই অর্থ ব্যক্ত করেছেন
হানাফী ও হাম্বালীদের ফাক্বীহবৃন্দ। তাঁদের এই বক্তব্যকে পছন্দ করেছেন ইবনু ‘উসাইমীন। আর এই মর্মে ফাতওয়া দিয়েছে স্থায়ী কমিটি (সৌদি
ফাতাওয়া বোর্ড)।
·
৩য় শর্ত: কুরবানির পশুকে সেসব
দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হবে, যেসব ত্রুটি
থাকলে সে পশু দিয়ে কুরবানি করা যথেষ্ট হয় না।
এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, কুরবানির পশুকে সেসব দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হবে, যেসব ত্রুটি থাকলে সে পশু দিয়ে কুরবানি করা যথেষ্ট হয় না।
তাই স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রুগ্ন, স্পষ্ট খোঁড়া এবং হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে যাওয়া কৃশকায়
(শীর্ণকায়) পশু দিয়ে কুরবানি করা যথেষ্ট হবে না। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন
ইমাম ইবনু ‘আব্দিল বার্র, ইমাম ইবনু রুশদ, ইমাম ইবনু কুদামাহ, ইমাম নাওয়াউয়ী ও ইমাম ইবনু হাযম।
·
৪র্থ শর্ত: শরিয়ত-নির্ধারিত সময়ের
মধ্যে কুরবানি করতে হবে।
কুরবানি করার প্রথম ও শেষ সময়ের আলোচনা
দ্রষ্টব্য। [পরবর্তী পরিচ্ছেদে এই আলোচনা করা হয়েছে – অনুবাদক]
·
৫ম শর্ত: কুরবানির নিয়াত করতে হবে।
কুরবানিদাতার জন্য এই শর্ত আরোপ করা
হয়েছে যে,
তাকে নির্দিষ্ট পশুর মাধ্যমে কুরবানি
করার নিয়াত করতে হবে। এটি চার ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের মত।
·
❏ চতুর্থ পরিচ্ছেদ: কুরবানি করার সময়
১. কুরবানি করার প্রথম সময়:
ফজর উদয় হওয়ার পূর্বে কুরবানি করা:
ইদুল আজহার দিন ফজর উদয় হওয়ার পূর্বে কুরবানি করা জায়েজ নয়। এ ব্যাপারে ইজমা‘
বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনুল মুনযির, ইমাম ‘আব্দিল
বার্র ও ইমাম কুরতুবী।
ইদের নামাজের পূর্বে কুরবানি করা: ইদের
নামাজের পূর্বে কুরবানি করা জায়েজ নয়। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু
‘আব্দিল বার্র, ইমাম নাওয়াউয়ী ও
ইমাম ইবনু রুশদ।
কুরবানি করার প্রথম সময়: কুরবানি করার
সময় শুরু হয় ইদের নামাজের পর। এটি হানাফী ও হাম্বালীদের মত। এই মতকে পছন্দ করেছেন
ইমাম ত্বাহাউয়ী, ইমাম শাওকানী ও
ইমাম ‘উসাইমীন।
যারা লোকালয়ে থাকে না, তাদের কুরবানির সময়: যারা এমন জায়গায় থাকে, যেখানে ইদের নামাজ পড়া হয় না—যেমন: বেদুইন
বা যাযাবর সম্প্রদায়—তাদের জন্য ইদের নামাজ পড়ার মতো সময় হওয়ার
পর থেকে কুরবানি করার সময় শুরু হয়ে যায়। আর সেই সময়ের পরিমাণ হলো—সূর্যের
এক বর্শা পরিমাণ উঁচুতে ওঠা। এটি হাম্বালীদের অভিমত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম
ইবনু ‘উসাইমীন।
·
২. কুরবানি করার সর্বশেষ সময়:
ফাক্বীহগণ কুরবানি করার সময়ের ব্যাপ্তি
নিয়ে মতদ্বৈধতা করেছেন। যথা:
প্রথম মত: কুরবানি করার সময়কাল তিনদিন।
ইদের দিন এবং আইয়্যামে তাশরীক্বের (১১, ১২ ও ১৩ই
যুলহাজ্ব) প্রথম দুই দিন। এটি অধিকাংশ ফাক্বীহ তথা হানাফী, মালিকী ও হাম্বালীদের অভিমত।
দ্বিতীয় মত: আইয়্যামে তাশরীক্বের
শেষদিন তথা ১৩ই যুলহাজ্ব পর্যন্ত কুরবানি করার সময় অবশিষ্ট থাকে। এটি শাফি‘ঈদের
অভিমত এবং হাম্বালীদের আরেকটি মত। এটি একদল সালাফের অভিমত। এই মতকে পছন্দ করেছেন
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনুল
ক্বাইয়্যিম, ইমাম শাওকানী, ইমাম ইবনু বায ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
·
৩. কুরবানির দিনগুলোর রাতে কুরবানি করা
(অর্থাৎ,
আইয়্যামে তাশরীক্বের দুই রাতে):
রাতে কুরবানির বিধান নিয়ে ফাক্বীহগণ
তিনটি মতে মতদ্বৈধতা করেছেন। যথা:
প্রথম মত: রাতে জবেহকৃত কুরবানি যথেষ্ট
হবে না। এটি মালিকীদের অভিমত এবং হাম্বালীদের একটি মত।
দ্বিতীয় মত: রাতে জবেহকৃত কুরবানি
যথেষ্ট হবে; তবে এই কাজ
মাকরূহ (অপছন্দনীয়)। এটি হানাফী ও শাফি‘ঈদের অভিমত এবং হাম্বালীদের একটি মত।
তৃতীয় মত: রাতে কুরবানির পশু জবেহ করা
কোনো কারাহাহ (মাকরূহ হওয়া) ছাড়াই জায়েজ। এটি হাম্বালীদের একটি মত। এই মতকে পছন্দ
করেছেন ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম সান‘আনী, ইমাম শাওকানী ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
·
৪. সত্বর কুরবানি করা:
কুরবানি করার সময় শুরু হওয়ার পরপরই
জলদি কুরবানি করা মুস্তাহাব। এটি চার ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের মত।
·
❏ পঞ্চম পরিচ্ছেদ: কুরবানির আদব ও সুন্নাতসমূহ
১. কুরবানি দিতে ইচ্ছুক—এমন ব্যক্তির
চুল মুণ্ডন করা এবং নখ কর্তন করার বিধান:
কুরবানি দিতে ইচ্ছুক—এমন ব্যক্তির
চুল মুণ্ডন করা এবং নখ কর্তন করার বিধান কী, তা নিয়ে ফাক্বীহগণ তিনটি মতে মতানৈক্য করেছেন। যথা:
প্রথম মত: এই কাজ বৈধ। এটি হানাফীদের
অভিমত এবং মালিকীদের একটি মত। এই মত ব্যক্ত করেছেন লাইস বিন সা‘দ। ইমাম ইবনু
‘আব্দিল বার্র এই মতকে পছন্দ করেছেন এবং উক্ত মত বর্ণনা করেছেন সমগ্র মদিনা ও
কুফার ফাক্বীহগণের নিকট থেকে।
দ্বিতীয় মত: যে ব্যক্তি কুরবানি করার
ইচ্ছা করেছে, তার জন্য
কুরবানি না করা পর্যন্ত চুল মুণ্ডন করা এবং নখ কর্তন করা হারাম। এটি হাম্বালীদের
অভিমত এবং মালিকীদের একটি মত। এটি একদল সালাফের অভিমত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম
ইবনু হাযম,
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ইমাম ইবনু বায ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
তৃতীয় মত: যে ব্যক্তি কুরবানি করার
ইচ্ছা করেছে, তার জন্য
কুরবানি না করা পর্যন্ত চুল মুণ্ডন করা এবং নখ কর্তন করা মাকরূহ। এটি মালিকী ও
শাফি‘ঈদের অভিমত এবং মালিকীদের একটি মত।
কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করার পর চুল
মুণ্ডন ও নখ কর্তন করে ফেললে ফিদইয়াহ (বিনিময়) দেওয়ার বিধান:
কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করেছে—এমন ব্যক্তি
চুল মুণ্ডন ও নখ কর্তন করে ফেললে, তাকে কোনো
ফিদইয়াহ দিতে হবে না। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু কুদামাহ ও ইমাম
মারদাউয়ী।
·
২. জবেহের সময় কিবলামুখী করা:
জবেহকারীর জন্য কিবলামুখী হওয়া
মুস্তাহাব (পছন্দনীয়) আমল। চার ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের ঐক্যমতে এই কাজ মুস্তাহাব। আর এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণিত হয়েছে।
·
৩. বকরিকে শোয়ানোর পূর্বে ছুরিতে ধার
দেওয়া:
বকরি বা ছাগীকে শোয়ানোর পূর্বে ছুরিতে
ধার দেওয়া মুস্তাহাব। চার ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের ঐক্যমতে এই কাজ মুস্তাহাব।
·৪. বকরিকে জবেহ করা, উটকে নহর করা এবং গরুকে জবেহ ও নহর করার ব্যাপারে ঐচ্ছিকতা:
বকরিকে জবেহ করা এবং উটকে নহর করা
সুন্নাত। আর গরুকে জবেহ ও নহর করার ব্যাপারে ঐচ্ছিকতা রয়েছে। বকরিকে জবেহ করা এবং
উটকে নহর করার ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম ইবনু রুশদ, ইমাম কুরতুবী, ইমাম ইবনু কুদামাহ ও ইমাম নাওয়াউয়ী। গরুর ক্ষেত্রে যে
ঐচ্ছিকতা রয়েছে, সে ব্যাপারে
ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু রুশদ ও ইমাম কুরতুবী।
[নহরের পরিচয়: পশুকে দাঁড় করিয়ে তার ঘাড় ও বুকের মধ্যবর্তী
নিচু স্থানে বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করাকে নহর বলা হয়। – অনুবাদক]
·৫. জবেহের সময় তাকবীর দেওয়া:
জবেহের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পর
তাকবীর দেওয়া তথা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন
ইমাম ইবনু কুদামাহ ও ইমাম আল-ক্বারী। আর এ ব্যাপারে মানুষের আমল বর্ণনা করেছেন
ইমাম তিরমিযী এবং একদল মালিকী।
·
৬. সামর্থ্য থাকলে নিজে জবেহ করা:
সামর্থ্য থাকলে কুরবানি নিজে জবেহ করা
মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম নাওয়াউয়ী।
·
৭. কুরবানির মাংস থেকে নিজে খাওয়া, অপরকে খাওয়ানো এবং পরে খাওয়ার জন্য জমা করে রাখা:
কুরবানিদাতার জন্য কুরবানির মাংস থেকে
নিজে খাওয়া, অপরকে খাওয়ানো
এবং পরে খাওয়ার জন্য জমা করে রাখা জায়েজ। চার ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের ঐক্যমতে এই কাজ জায়েজ।
·
৮. কুরবানির পশু জবাই করার জন্য
প্রতিনিধি নিয়োগ করা:
কুরবানিদাতার জন্য কুরবানির পশু জবাই
করার নিমিত্তে প্রতিনিধি নিয়োগ করা জায়েজ, যদি সেই প্রতিনিধি মুসলিম হয়ে থাকে। চার ফিক্বহী মাযহাব তথা
হানাফী,
মালিকী, শাফি‘ঈ ও হাম্বালীদের ঐক্যমতে এই কাজ জায়েজ। আর এ ব্যাপারে
ইজমা‘ বর্ণিত হয়েছে।
·৯. কোন কাজটি উত্তম? কুরবানির পশু জবেহ করা, না কি পশুর মূল্য সদকা (দান) করা?
কুরবানির পশুর মূল্য সদকা করার চেয়ে
পশু জবেহ করাই উত্তম। এই মত ব্যক্ত করেছেন হানাফী, মালিকী ও হাম্বালীদের ফাক্বীহবৃন্দ। আর এই মতকে পছন্দ
করেছেন ইমাম ইবনু বায ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
·
১০. কুরবানির মাংস থেকে কসাইয়ের
পারিশ্রমিক দেওয়া:
কুরবানির মাংস থেকে কসাইয়ের পারিশ্রমিক
দেওয়া জায়েজ নয়। চার ফিক্বহী মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী, শাফি‘ঈ ও
হাম্বালীদের ঐক্যমতে এই কাজ না-জায়েজ।
·
১১. আলাদাভাবে মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে
কুরবানি করা:
আলাদাভাবে মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে
কুরবানি করা শরিয়তসম্মত নয়। এটি শাফি‘ঈদের অভিমত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু
‘উসাইমীন।
·❏ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: পশু জবেহের শর্তাবলি
১. বিসমিল্লাহ পাঠ:
জবেহের ক্ষেত্রে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়াকে
শর্ত করার ক্ষেত্রে ‘আলিমগণ তিনটি মতে মতদ্বৈধতা করেছেন। যথা:
প্রথম মত: বিসমিল্লাহ বলা হলো জবেহের
শর্ত। ইচ্ছাকৃত হোক বা বিস্মৃতিজনিত কারণে হোক, বিসমিল্লাহ না বলা হলে জবেহ বৈধ হবে না। এটি যাহিরীদের
অভিমত এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমাদের মত। একদল সালাফ এই মত ব্যক্ত করেছেন।
আর এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
দ্বিতীয় মত: মনে থাকলে বিসমিল্লাহ বলা
ওয়াজিব। তবে ভুল গেলে এই বিধান বাতিল হয়ে যাবে। এটি হানাফী, মালিকী ও হাম্বালীদের অভিমত। এই মতকে পছন্দ করেছে স্থায়ী
কমিটি (সৌদি ফাতওয়া বোর্ড)।
তৃতীয় মত: বিসমিল্লাহ বলা সুন্নাতে
মুআক্কাদাহ। এটি শাফি‘ঈদের অভিমত এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমাদের মত। একদল
সালাফ এই মত ব্যক্ত করেছেন। আর এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু ‘আব্দিল বার্র।
·
২. রক্ত প্রবাহিত করা:
‘আলিমগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, চারটি জিনিস কাটার মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করার বিষয়টি
অর্জিত হয়। যথা: খাদ্যনালী, কণ্ঠনালী এবং
দুই শাহরগ। এ ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনুল মুনযির, ইমাম ইবনু কুদামাহ, ইমাম ইবনু বায ও ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
·
৩. জবেহ যথেষ্ট হওয়ার জন্য কতটুকু কাটা
ওয়াজিব?
জবেহ যথেষ্ট হওয়ার জন্য কতটুকু কাটা
ওয়াজিব,
তা নিয়ে ফাক্বীহগণ অনেকগুলো মতে
মতদ্বৈধতা করেছেন। আমরা তার মধ্য থেকে কিছু মত উল্লেখ করছি—
প্রথম মত: সবগুলো রগ তথা খাদ্যনালী, কণ্ঠনালী ও দুই শাহরগ কাটা জবেহ যথেষ্ট হওয়ার শর্ত। এটি
মালিকীদের একটি মত এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমাদের মত। এই মত ব্যক্ত করেছেন
লাইস বিন সা‘দ। আর এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনুল মুনযির।
দ্বিতীয় মত: দুই শাহরগ ও কণ্ঠনালি কাটা
জবেহ যথেষ্ট হওয়ার শর্ত। এটি মালিকীদের অভিমত এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম
আহমাদের মত।
তৃতীয় মত: কণ্ঠনালি ও খাদ্যনালি কর্তন
করা ওয়াজিব। এটি শাফি‘ঈ ও হাম্বালীদের অভিমত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু বায।
চতুর্থ মত: কোনো নির্দিষ্টকরণ ছাড়াই
চারটির মধ্যে যে কোনো তিনটি রগ কর্তন করা ওয়াজিব। এটি হানাফীদের প্রসিদ্ধ অভিমত
এবং হাম্বালীদের একটি মত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ।
পঞ্চম মত: দুই শাহরগ কর্তন করা ওয়াজিব।
এটি হাম্বালীদের একটি মত। এই মতকে পছন্দ করেছেন ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন।
·তথ্যসূত্র:
https://d1.islamhouse.com/
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/
0 Comments