ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা ?


ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা ?


মুখে নিয়ত বলার শারঈ কোন বিধান নেই। রাসূল () ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এ ধরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এটি মানুষের তৈরী বিধান। অতএব তা পরিত্যাগ করতে হবে। বরং মনে মনে নিয়ত করতে হবে। (ছহীহ বুখারী হা/১; ছহীহ মুসলিম হা/৫০৩৬।) উল্লেখ্য যে, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)-এর নামে প্রকাশিত ‘পূর্ণাঙ্গ স্বলাত শিক্ষা ও জরুরী মাসআলা মাসায়েল’ নামক বইয়ে বলা হয়েছে যে, ক্বিবলার দিকে মুখ করে উঁচু স্থানে বসে ওযূ করতে হবে। অথচ উক্ত কথার প্রমাণে কোন দলীল পেশ করা হয়নি। (হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ), ‘পূর্ণাঙ্গ স্বলাত শিক্ষা ও জরুরী মাসআলা মাসায়েল’, সংকলনে ও সম্পাদনায়- মাওলানা আজিজুল হক (ঢাকা: মীনা বুক হাউস, ৪৫, বাংলা বাজার, চতুর্থ মুদ্রণ-আগস্ট ২০০৯), পৃঃ ৪২; উল্লেখ্য যে, মাওলানার নামে বহু রকমের স্বলাত শিক্ষা বইয়ের বাংলা অনুবাদ বাজারে চালু আছে। কোনটি যে আসল অনুবাদ তা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।) উক্ত দাবী ভিত্তিহীন। ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা

(১১) ওযূর শুরুতে ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রাহীম আল-ইসলামু হাক্কুন, ওয়াল কুফরু বাতিলুন, আল-ঈমানু নূরুন ওয়াল কুফরু যুলমাতুন’ দু‘আ পাঠ করা:
উক্ত দো‘আর প্রমাণে কোন ছহীহ দলীল নেই। যদিওবা মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) উক্ত দো‘আর সাথে আরো কিছু বাড়তি কথা যোগ করে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোন প্রমাণ উল্লেখ করেননি। (পূর্ণাঙ্গ স্বলাত শিক্ষা, পৃঃ ৪৩।) এটা পড়লে সুন্নাতের বিরোধিতা করা হবে। উক্ত দো‘আটি দেশের বিভিন্ন মসজিদের ওযূখানায় লেখা দেখা যায়। উক্ত দো‘আ হ’তে বিরত থাকতে হবে। বরং ওযূর শুরুতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে। (ছহীহ তিরমিযী হা/২৫, ১/১৩ পৃঃ; ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/৩৯৭, পৃঃ ৩২, সনদ হাসান।)
(১২) প্রতিটি অঙ্গ ধৌত করার সময় পৃথক পৃথক দো‘আ পড়া:
 ওযূর প্রত্যেক অঙ্গ ধৌত করার সময় পৃথক পৃথক দু‘আ পড়তে হবে মর্মে আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। এর পক্ষেও তিনি কোন দলীল তিনি পেশ করেননি। তবে অন্য শব্দে একটি জাল হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন- 
(রাসূল (
) বলেন) হে আনাস! তুমি আমার নিকটবর্তী হও তোমাকে ওযূর মিকদার শিক্ষা দিব। অতঃপর আমি তার নিকটবর্তী হ’লাম। তখন তিনি তাঁর দুই হাত ধৌত করার সময় বললেন, ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল হামদুল্লিা-হি ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হি’। যখন তিনি ইস্তিঞ্জা করলেন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা হাছি্ছন ফারজী ওয়া ইয়াসি্সরলী আমরী’। যখন তিনি ওযূ করেন ও নাক ঝাড়েন তখন বলেন, ‘আল্লা-হুম্মা লাক্কিনী হুজ্জাতী ওয়ালা তারহামনী রায়েহাতাল জান্নাতি’। যখন তার মুখমন্ডল ধৌত করেন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা বাইয়িয ওয়াজহী ইয়াওমা তাবইয়ায্যু উজূহুওঁ’। যখন তিনি দুই হাত ধৌত করলেন তখন বললেন, ‘আল্লাহুম্মা আ‘ত্বিনী কিতাবী ইয়ামানী’। যখন হাত দ্বারা মাসাহ করলেন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা আগিছনা বিরহমাতিকা ওয়া জান্নিবনা আযাবাকা’। যখন তিনি দুই পা ধৌত করলেন তখন বললেন, ‘আল্ল-হুম্মা ছাবিবত ক্বাদামী ইয়াওমা তাযিল্লু ফীহি আক্বদাম’।
অতঃপর তিনি বলেন, হে আনাস! ঐ সত্তার কসম করে বলছি যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, যে বান্দা ওযূ করার সময় এই দু‘আ বলবে তার আঙ্গুল সমূহের ফাঁক থেকে যত ফোঁটা পানি পড়বে তার প্রত্যেক ফোঁটা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা একজন করে ফেরেশতা তৈরি করবেন। সেই ফেরেশতা সত্তরটি জিহবা দ্বারা আল্লাহর তাসবীহ বর্ণনা করবেন। এই ছওয়াব ক্বিয়ামত পর্যন্ত হ’তে থাকবে। (তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃঃ ৩২; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ, পৃঃ ১৩, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/৩৩।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর সনদে উবাদা বিন ছুহাইব ও আহমাদ বিন হাশেমসহ কয়েকজন মিথ্যুক রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুৎনীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ তাদেরকে পরিত্যক্ত বলেছেন। ইমাম নববী বলেন, এই বর্ণনাটি বাতিল, এর কোন ভিত্তি নেই। (তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃঃ ৩২; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ, পৃঃ ১৩, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/৩৩।)
 (১৩) ওযূর পানি পাত্রের মধ্যে পড়লে উক্ত পানি দ্বারা ওযূ হবে না বলে বিশ্বাস করা:
এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) লিখেছেন, ‘উঁচু স্থানে বসবে যেন ওযূর পানির ছিটা শরীরে আসতে না পারে’।(পূর্ণাঙ্গ স্বলাত শিক্ষা, পৃঃ ৪২।) অথচ রাসূলুল্লাহ (
) পাত্রের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিতেন আবার বের করতেন এভাবে তিনি ওযূ করতেন। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮; ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৪, ৪১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭।)
(১৪) ত্রুটিপূর্ণ কথা বললে ওযূ নষ্ট হয়ে যায়। ওযূর সময় কথা বললে ফেরেশতারা রুমাল নিয়ে চলে যায়:
 ওযূকারীর মাথার উপর চারজন ফেরেশতা রুমাল নিয়ে ছায়া করে রাখে। পর পর চারটি কথা বললে রুমাল নিয়ে চলে যায় বলে যে কাহিনী সমাজে প্রচলিত আছে তা উদ্ভট, মিথ্যা ও কাল্পনিক। তাছাড়া খারাপ কথা বললে ওযূ নষ্ট হয়ে যায় এ আক্বীদাও ঠিক নয়। এ মর্মে যে হাদীছ রয়েছে তা জাল। (আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনিল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ ফিল আহাদীছিল ওয়াহিয়াহ (বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪০৩), হা/৬০৪; দায়লামী ২/১৬০, হা/২৮১৪; ইমাম সুয়ূত্বী, জামিউল আহাদীছ হা/১১৭২৬।)
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন, অপবিত্রতা দুই প্রকার। জিহবার ও লজ্জাস্থানের অপবিত্রতা। দুইটি এক রকম নয়। লজ্জাস্থানের অপবিত্রতার চেয়ে জিহবার অপবিত্র বেশি। আর এর কারণে ওযূ করতে হবে। (জাওয়াযকানী, আল-আবাতিল ১/৩৫৩ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ হা/৬০৪-এর আলোচনা দ্রঃ।) এর সনদে বাক্বিয়াহ নামক রাবী রয়েছে, সে ত্রুটিপূর্ণ। সে দুর্বল রাবীদের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনাকারী। রাসূল () থেকে উক্ত মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়নি। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহ বুখারী হা/১৯১, ১/৩১ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮, ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৪ ও ৪১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭।)
(১৫) কুলি করার জন্য আলাদা পানি নেওয়া: 
 সুন্নাত হল হাতে পানি নিয়ে একই সঙ্গে মুখে ও নাকে পানি দিবে। রাসূল () এভাবেই ওযূ করতেন। যেমন-
তিনি এক অঞ্জলি দ্বারাই কুলি করেন ও নাক পরিষ্কার করেন’।( আবূদাঊদ হা/১৩৯, ১/১৮-১৯ পৃঃ; বুলূগুল মারাম হা/৪৯, পৃঃ ১৮।)
আলাদাভাবে পানি নেওয়ার যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
তালহা (রাঃ) তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূল ()-এর নিকট গেলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি ওযূ করছিলেন। আর পানি তাঁর মুখমন্ডল ও দাড়ি থেকে তাঁর বুকে পড়ছিল। অতঃপর আমি তাকে দেখলাম তিনি কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার সময় পৃথক করলেন।
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে লাইছ ও মুছাররফ নামের দু’জন রাবী রয়েছে, যারা ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়াও আরো ত্রুটি রয়েছে। এই হাদীছ যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণ একমত। (শরহে বুলূগুল মারাম, পৃঃ ২৬।) শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, তালক বিন মুছাররফের হাদীছ পৃথক করা প্রমাণ করে, কিন্তু তা যঈফ। (তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪।)
(১৬) কান মাসাহ করার সময় নতুন পানি নেওয়া:
 ওযূতে কান মাসাহ করার ক্ষেত্রে মাথা ও কান একই সঙ্গে একই পানিতে মাসাহ করবে। কান মাসাহ করার জন্য পৃথকভাবে নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাসূল () বলেন, ‘দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত’।(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬।) বায়হাক্বীতে একই পানিতে মাথা ও কান মাসাহ করার ছহীহ হাদীছ এসেছে। (বায়হাক্বী, মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১৯১, ১/২২৯ পৃঃ; বলূগুল মারাম হা/৩৯, পৃঃ ২৩।) নতুনভাবে পানি নেওয়ার হাদীছটি ছহীহ নয়।
আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল ()-কে দেখেছেন যে, পানি দ্বারা মাথা মাসাহ করেছেন। অতঃপর তা ব্যতীত কান মাসাহ করার জন্য পৃথক পানি নিয়েছেন। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৮২, ১/১২৩ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: উক্ত শব্দে বর্ণিত হাদীছ যঈফ। উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার পরে হাদীছটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী ও বায়হাক্বীর যে মন্তব্য ইবনু হাজার আসক্বালানী তুলে ধরেছেন তা মূলতঃ এই হাদীছের ক্ষেত্রে নয়; বরং হাত ধৌত করার পর নতুন করে পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীছটির ব্যাপারে, যা ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১/১২২ পৃঃ, হা/২৮-এর আলোচনা; বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/১০৪৬ ও ৯৯৫; মাজমূউ ফাতাওয়া আলবানী, পৃঃ ৩৬।)
তাই আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,
আমি বলছি, সমালোচনা থেকে মুক্ত এমন কোন মারফূ হাদীছ এ ব্যাপারে আছে বলে আমি অবগত নই, যার দ্বারা নতুন পানি নিয়ে কান মাসাহ করা যাবে’।(বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩১৪; মুওয়াত্ত্ব হা/৯২।)
নাফে‘ বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) যখন ওযূ করতেন তখন কান মাসাহ করার জন্য দুই আঙ্গুলে পানি নিতেন। (ঐ, বায়হাক্বী হা/৩১৭-এর ভাষ্য দ্রঃ।)
তাহক্বীক্ব: এ বর্ণনাটিও যঈফ। বায়হাক্বীর মুহাক্কিক মুহাম্মাদ আব্দুল ক্বাদির ‘আতা বলেন, রাসূল () থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ঐ হাদীছগুলো যঈফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (ইমাম শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ১/২০০ পৃঃ; বুলূগুল মারাম, পৃঃ ২৩-এর উক্ত হাদীছের ভাষ্য দ্রঃ।)
উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ)-এর ব্যক্তিগত আমলকে ইবনুল ক্বাইয়িম ছহীহ হওয়ার কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু উক্ত ত্রুটি থাকার কারণে তা যঈফ। যেমন তিনি বলেন, ‘রাসূল () থেকে সাব্যস্ত হয়নি যে তিনি দুই কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নিয়েছেন। তবে ইবনু ওমর থেকে সেটা ছহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে’।(সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬-এর ভাষ্য দ্রঃ।)
শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘দুই কান এককভাবে মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং মাথার জন্য ভিজা পানি দ্বারাই দুই কান মাসাহ করা জায়েয’।(তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪।)
অতএব কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং মাথা ও কান একই সঙ্গে মাসাহ করতে হবে।
জ্ঞাতব্য: অনেকে কান মাসাহকে ফরয বলেন না। অথচ কানসহ মাথা মাসাহ করা ফরয। কারণ দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। রাসূল () বলেন, ‘দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত’।(ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৩৭; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৬১, সনদ ছহীহ।)
তাছাড়া রাসূল () একই পানিতে মাথা ও কান মাসাহ করতেন। যেমন- ‘অতঃপর তিনি এক অঞ্জলি পানি নিতেন এবং মাথা ও দুই কান মাসাহ করতেন’।(পূর্ণাঙ্গ স্বলাত শিক্ষা, পৃঃ ৪২।)
(১৭) মাথা ও কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি না নেওয়া:
অনেকে দুই হাত ধৌত করার পর সরাসরি মাথা মাসাহ করেন, নতুন পানি নেন না। যেমন আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেছেন, ‘কান ও মাথা মাছহে করার জন্য নতুন পানি নেয়ার প্রয়োজন নেই, ভেজা হাত দ্বারাই মাছহে করবে’।(ছহীহ মুসলিম হা/৫৮২, ১/১২৩ পৃঃ, ‘নবী (
)-এর ওযূ’ অনুচ্ছেদ।) এটি সুন্নাতের বরখেলাফ। কারণ রাসূল () দুই হাত ধৌত করার পর নতুন পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ করতেন। যেমন- ‘হাতের অতিরিক্ত পানি ছাড়াই তিনি নতুন পানি দ্বারা তাঁর মাথা মাসাহ করতেন’।( দ্রঃ ছহীহ মুসলিম হা/৬৪৭, ১/১৩৩ পৃঃ ও হা/৬৫৬, ১/১৩৪ পৃঃ।)
(১৮) মাথার এক-চতুর্থাংশ মাসাহ করা:
মাথা মাসাহ করার ব্যাপারে অবহেলা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ চুল স্পর্শ করাকেই মাসাহ মনে করেন, কেউ মাথার চার ভাগের একভাগ মাসাহ করেন এবং কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় নেমে পড়েন। কুদূরী ও হেদায়ার লেখক চার ভাগের এক ভাগ মাসাহ করার কথা উল্লেখ করেছেন। আর দলীল হিসাবে পেশ করেছেন ছহীহ মুসলিমের হাদীছ। অথচ উক্ত হাদীছে পাগড়ী থাকা অবস্থায় মাসাহ করা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কুদূরী এবং হেদায়াতে মুগীরা (রা)-এর নামে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা ভুল হয়েছে। (আবুল হাসান বিন আহমাদ বিন জা‘ফর আল-বাগদাদী আল-কুদূরী, মুখতাছারুল কুদূরী (ঢাকা: ইসলামিয়া কুতুবখানা, বাংলাবাজার ১৯৮২/১৪০৩), পৃঃ ৩; শায়খুল ইসলাম বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনু আবী বকর আল-মারগীনানী (৫১১-৫৯৩ হিঃ), আল-হেদায়াহ (নাদিয়াতুল কুরআন কুতুবখানা (১৪০১), ১/১৭ পৃঃ; বঙ্গানুবাদ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় সংস্করণ মার্চ ২০০৬), ১/৬ পৃঃ।) যা হেদায়ার টীকাতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তারা দুইটি হাদীছকে একত্রে মিশ্রিত করে উল্লেখ করেছেন। (ছহীহ বুখারী হা/১৮৫, ১/৩১ পৃঃ; বুখারী (ইফাবা) হা/১৮৫; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২/৭৮ পৃঃ; ছহীহ তিরমিযী হা/৩৪।)
সুধী পাঠক! শরী‘আতের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীছে রাসূল () সুন্দরভাবে মাথা মাসাহ করার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। কারণ পবিত্র কুরআন তাঁর উপরই নাযিল হয়েছে। রাসূল () মাথার সামনের দিক থেকে শুরু করে পিছনে চুলের শেষ পর্যন্ত দুই হাত নিয়ে যেতেন এবং সেখান থেকে সামনে নিয়ে এসে শেষ করতেন। এভাবে তিনি পুরো মাথা মাসাহ করতেন। যেমন-
অতঃপর তিনি তাঁর দুই হাত দ্বারা মাথা মাসাহ করেন। এতে দুই হাত তিনি সামনে করেন এবং পিছনে নেন। তিনি মাথার অগ্রভাগ থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যেতেন অতঃপর যে স্থান থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন’।(ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৮৫ পৃঃ, ‘মাসাহ করার বর্ণনা’।)
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৪১ হিঃ) বলেন,
রাসূল () কখনো মাথার কিছু অংশ মাসাহ করেছেন মর্মে কোন একটি হাদীছ থেকেও প্রমাণিত হয়নি’।(ছহীহ মুসলিম হা/৬৫৬, ৫৭, ৫৯, ১/১৩৪ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬৭, ২/৮১ পৃঃ; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৮৫ পৃঃ, ‘মাসাহ করার বর্ণনা’।)
উল্লেখ্য, পাগড়ী পরা অবস্থায় থাকলে মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করা যাবে। (যঈফ আবূদাঊদ হা/১৪৭; যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৫৬৪।) আরো উল্লেখ্য যে, পাগড়ীর নীচে মাসাহ করতেন বলে যে হাদীছ আবূদাঊদে বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। (পূর্ণাঙ্গ স্বলাত শিক্ষা, পৃঃ ৪২ ও ৪৪।)
(১৯) ওযূতে ঘাড় মাসাহ করা:
ওযূতে ঘাড় মাসাহ করার পক্ষে ছহীহ কোন প্রমাণ নেই। এর পক্ষে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই জাল ও মিথ্যা। অথচ আলেমগণ এর পক্ষে মুসলিম জনতাকে উৎসাহিত করেছেন। আশরাফ আলী থানবী ঘাড় মাসাহ করার দাবী করেছেন এবং এ সময় পৃথক দো‘আ পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। (ঐ, (ঢাকা: মুমতায লাইব্রেরী, ১১, বাংলাবাজার, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী ২০১০), পৃঃ ১১৪-১১৫।) ড. শাইখ মুহাম্মাদ ইলিয়াস ফয়সাল (মদীনা মুনাওয়ারাহ) প্রণীত ও মারকাযুদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিইয়াহ, ঢাকার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ অনুদিত ‘নবীযীর স্বলাত’ বইয়ে ওযূর সুন্নাত আলোচনা করতে গিয়ে গর্দান মাসাহ করার কথা বলেছেন। এর পক্ষে জাল হাদীছও পেশ করেছেন। (তাবারাণী কবীর হা/১৭৫৮৪, ২২/৫০।) এভাবেই ভিত্তিহীন আমলটি সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। জাল দলীলগুলো নিম্নরূপ:
(এক) ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) রাসূল ()-এর ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন। ..অতঃপর তিনি তিনবার তার মাথা মাসাহ করেন এবং দুই কানের পিঠ মাসাহ করেন ও ঘাড় মাসাহ করেন, দাড়ির পেট মাসাহ করেন মাথার অতিরিক্ত পানি দিয়ে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯ ও ৭৪৪।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। (আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহযযাব ১/৪৬৫ পৃঃ।) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,
এটা জাল। নবী ()-এর বক্তব্য নয়। (তাবারাণী কবীর ১৯/১৮১।)
(দুই) আমর ইবনু কা‘ব বলেন, রাসূলুল্লাহ ()-কে ওযূ করার সময় আমি দাড়ির পেট এবং ঘাড় মাসাহ করতে দেখেছি। (লিসানুল মীযান ৬/৪২ পৃঃ; তানক্বীহ, পৃঃ ৮৩।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। ইবনুল ক্বাত্ত্বান বলেন, এর সনদ অপরিচিত। মুছাররফসহ তার পিতা ও দাদা সবাই অপরিচিত। (আবূদাঊদ হা/১৩২, ১/১৭-১৮ পৃঃ।)
(তিন) তালহা ইবনু মুছাররফ তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল ()-কে দেখেছি তিনি একবার তাঁর মাথা মাসাহ করতেন এমনকি তিনি মাথার পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতেন। আর তা হ’ল ঘাড়ের অগ্রভাগ। (যঈফ আবুদাঊদ হা/১৩২-এর আলোচনা দ্রঃ।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি মুনকার বা অস্বীকৃত। মুসাদ্দাদ বলেন, তিনি মাথার সামনের দিক থেকে পিছনের দিক পর্যন্ত মাসাহ করেন এমনকি তার দুই হাত কানের নিচ দিয়ে বের করে নেন’ এই কথা ইয়াহইয়ার কাছে বর্ণনা করলে তিনি একে অস্বীকৃতি জানান। ইমাম আবূদাঊদ বলেন, আমি ইমাম আহমাদকে বলতে শুনেছি, ইবনু উ‘আইনাহ বলতেন, মুহাদ্দিছগণ ধারণা করতেন এটা ছহীহ হাদীছের বিরোধী। তিনি এটাও বলতেন, তালহা তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে এ কথা কোথায় পেল? (সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯, ১/১৬৮ পৃঃ।)
(চার) ঘাড় মাসাহ করলে বেড়ী থেকে নিরাপদ থাকবে’।
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। (হাফেয জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী, আল-লাআলিল মাছনূ‘আহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ, পৃঃ ২০৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৮ পৃঃ।) ইমাম সুয়ূত্বী জাল হাদীছের গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। (আবু নু‘আইম, তারীখুল আছবাহান ২/১১৫ পৃঃ।)
(পাঁচ) যে ব্যক্তি ওযূ করবে এবং ঘাড় মাসাহ করবে তাকে ক্বিয়ামতের দিন বেড়ী দ্বারা বেড়ী পরানো হবে না’।(সিলসিলা যঈফাহ হা/৭৪৪, ২/১৬৭ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। (আল-মাছনূ‘ ফী মা‘রেফাতুল হাদীছিল মাওযূ‘, পৃঃ ৭৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ।) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী উক্ত বর্ণনাকে জাল বলেছেন। (সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ।) উক্ত বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনু আমল আল-আনছারী ও মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনে মুহাররম নামের দু’জন রাবী ত্রুটিপূর্ণ। মুহাদ্দিছগণ তাদেরকে দুর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (বায়হাক্বী, সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৬৮; আওনুল মা‘বুদ ১/৪১৭-১৮ পৃঃ।)
ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যা বর্ণনা আরো আছে। এর দ্বারা প্রতারিত হওয়া যাবে না। বরং ঘাড় মাসাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে।
(২০) ওযূর পর অঙ্গ মুছতে নিষেধ করা:
 ওযূ করার পর রুমাল, গামছা কিংবা কাপড় দ্বারা অঙ্গ মুছতে পারে। এটা ইচ্ছাধীন। (ইবনু শাহীন, নাসিখুল হাদীছ ওয়া মানসূখাহু, পৃঃ ১৪৫, দ্রঃ যাকারিয়া বিন গুলামা ক্বাদের পাকিস্তানী, তানক্বীহুল কালাম ফিল আহাদীছিয যঈফাহ ফী মাসাইলিল আহকাম (বৈরুত: দারু ইবনে হাযম, ১৯৯৯/১৪২০), পৃঃ ৯৬।) যে বর্ণনায় অঙ্গ মুছতে নিষেধ করা হয়েছে তা জাল বা মিথ্যা।
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (), আবুবকর, ওমর, আলী এবং ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ওযূর পর রুমাল দিয়ে মুখ মুছতেন না। (আওনুল মা‘বূদ ১/২৮৭ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ১/২২০ পৃঃ; নাসিখুল হাদীছ ওয়া মানসূখাহু, পৃঃ ১৪৫।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর সনদে সাঈদ বিন মাইসারা নামে একজন রাবী রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ তাকে মিথ্যুক বলেছেন। ইবনু হিববান তাকে জাল হাদীছের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী তাকে মুনকার বলেছেন। (আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫২ নং-এর ভাষ্য দ্রঃ, উল্লেখ্য, উক্ত অংশটুকু সংযোজনের ক্ষেত্রে ত্রুটি সাব্যস্ত হয়েছে বলেও মুহাদ্দিছগণ উল্লেখ করেছেন। -দ্রষ্টব্য আহমাদ হা/৮৩৯৪; ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী হা/১৩৬-এর আলোচনা, ‘ওযূর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ; ইরওয়াউল গালীল ১/১৩৩ পৃঃ।) উল্লেখ্য, উক্ত মর্মে যঈফ হাদীছও আছে।
(২১) হাত ধোয়ার সময় কনুই-এর উপরে আরো বেশী করে বাড়িয়ে ধৌত করা: হাত ধৌত করতে হবে কুনই পর্যন্ত। এর বেশি নয়। আল্লাহর নির্দেশ এটাই (সূরা মায়েদাহ ৬)। হাদীছের শেষে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করার যে বক্তব্য এসেছে তার উদ্দেশ্য অঙ্গ বাড়িয়ে ধৌত করা নয়; বরং ভালভাবে ওযূ সম্পাদন করা। (ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৫৯; ছহীহ তিরমিযী হা/৯৯; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৫২৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৮, ২/১৩২ পৃঃ।)
(২২) চামড়ার মোজা ছাড়া মাসাহ করা যাবে না বলে ধারণা করা: উক্ত ধারণা সঠিক নয়। বরং যেকোন পবিত্র মোজার উপর মাসাহ করা যাবে। (আলোচনা দ্রঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া ১/২৬২ পৃঃ; আলবানী, আছ-ছামারুল মাস্তাত্বাব, পৃঃ ১৪-১৫।) হাদীছে কোন নির্দিষ্ট মোজার শর্তারোপ করা হয়নি।
(২৩) মোজার উপরে ও নীচে মাসাহ করা: 
 অনেককে মোজার উপরে নীচে উভয় দিকে মাসাহ করতে দেখা যায়। অথচ সুন্নাত হ’ল মোজার উপরে মাসাহ করা। (ছহীহ বুখারী হা/১৮২; মুসলিম হা/৬৪৯; ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৬১ ও ১৬২, ১/২২ পৃঃ; তিরমিযী হা/৯৮, ১/২৮-২৯ পৃঃ।)
উপরে-নীচে উভয় দিকে মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তার সনদ যঈফ এবং ছহীহ হাদীছের বিরোধী। যেমন-
মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ) বলেন, আমি তাবুক যুদ্ধে রাসূল ()-কে ওযূ করিয়েছি। তিনি দুই মোজার উপরে এবং নীচে মাসাহ করেছেন। (আবূদাঊদ হা/১৬৫, ১/২২ পৃঃ; তিরমিযী হা/৯৭, ১/২৮ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৫৫০, পৃঃ ৪২; মিশকাত হা/৫২১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৬, ২/১৩১ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘এই হাদীছটি ত্রুটিপূর্ণ। আমি ইমাম আবু যুর‘আহ ও ইমাম বুখারীকে এই হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়। ইমাম আবূদাঊদও একে দুর্বল বলেছেন। (যঈফ তিরমিযী হা/৯৭, ১/২৮ পৃঃ)।) এই হাদীছের সনদে ছাওর নামক একজন রাবী রয়েছে। ইমাম আবূদাঊদ বলেন, সে রাজা ইবনু হাইওয়া থেকে না শুনেই বর্ণনা করেছে। (যঈফ আবূদাঊদ হা/১৬৫, ১/২২ পৃঃ।)
জ্ঞাতব্য : বর্তমানে অনেকেই মোজা পরিহিত অবস্থায় টাখনুর নীচে লুঙ্গি-প্যান্ট পরিধান করাকে জায়েয বলছেন ও পরিধান করছেন। এটা শরী‘আতকে ছোট করার মিথ্যা কৌশল মাত্র। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির সাথে আপোস করে তারা রাসূল ()-এর আদর্শকে নস্যাৎ করতে চায়।
(২৪) ওযূর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে দো‘আ পড়া: 
 ওযূর দো‘আ পড়ার সময় আকাশের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। উক্ত মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
উক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, রাসূল () বলেছেন, যে ব্যক্তি ভালভাবে ওযূ করল অতঃপর আকাশের দিকে চোখ তুলে দো‘আ পড়ল তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। যেকোন দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারবে। (আহমাদ হা/১২১; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৩।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি মুনকার। ‘আকাশের দিকে তাকানো’ অংশটুকু ছহীহ হাদীছের বিরোধী। তাই শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘এই অতিরিক্ত অংশটুকু অস্বীকৃত। কারণ ইবনু আম আবী উক্বাইল এককভাবে বর্ণনা করেছে। সে অপরিচিত’।(আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৯৬ এর আলোচনা, ১/১৩৫ পৃঃ।)
(২৫) ওযূর পরে সূরা ক্বদর পড়া: 
 উক্ত আমল সম্পর্কে কোন দলীল পাওয়া যায় না। অথচ আশরাফ আলী থানবী তার বইয়ে সূরা ক্বদর পড়ার কথা বলেছেন এবং ওযূর পরের দো‘আর সাথে অনেকগুলো নতুন শব্দ যোগ করেছেন যা হাদীছের গ্রন্থ সমূহে পাওয়া যায় না। (পূর্ণাঙ্গ স্বলাত, পৃঃ ৪৫।)
অতএব ওযূর করার পর শুধু নিম্নের দো‘আ পাঠ করবে- (ছহীহ মুসলিম হা/৪৭৬, ১/১২২ পৃঃ; মিশকাত ৩৯ পৃঃ, হা/২৮৯ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়; ছহীহ তিরমিযী হা/৫৫, ১/১৮ পৃঃ সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/২৮৯; ইরওয়া হা/৯৬, সনদ ছহীহ।)
(২৬) রক্ত বের হ’লে ওযূ ভেঙ্গে যায়: 
 শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া ওযূ ভঙ্গের কারণ নয়। রক্ত বের হ’লে ওযূ করতে হবে মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
ওমর ইবনে আব্দুল আযীয তামীম দারী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল () বলেন, প্রত্যেক প্রবাহমান রক্তের কারণেই ওযূ করতে হবে। (দারাকুৎনী ১/১৫৭; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭০; মিশকাত হা/৩৩৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩০৭, ২/৫৭।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭০।) ইমাম দারাকুৎনী (রহঃ) বলেন, ওমর ইবনে আব্দুল আযীয তামীম দারীর নিকট থেকে শুনেননি। আর ইয়াযীদ ইবনু খালেদ ও ইয়াযীদ ইবনু মুহাম্মাদ দুইজনই অপরিচিত। (দারাকুৎনী ১/১৫৭ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৩৩ )
তাছাড়া রক্ত বের হ’লে ছাহাবায়ে কেরাম ওযূ করতেন না মর্মে ছহীহ আছার বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
বাকর (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু ওমর (রাঃ)-কে দেখেছি, তিনি তার মুখমন্ডলে উঠা ফোড়ায় চাপ দিলেন ফলে কিছু রক্ত বের হ’ল। তখন তিনি আঙ্গুল দ্বারা ঘষে দিলেন। অতঃপর স্বলাত আদায় করেন কিন্তু ওযূ করেননি। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/১৪৬৯, সনদ ছহীহ; আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭০-এর আলোচনা দ্রঃ, ১/৬৮৩)
শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, রক্ত বের হ’লে ওযূ করা ওয়াজিব হবে মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ নেই। তা কম হোক বা বেশী হোক। (আলবানী, মিশকাত হা/৩৩৩-এর টীকা দ্রঃ ১/১০৮ পৃঃ।)
(২৭) বমি হ’লে ওযূ ভেঙ্গে যায়: 
 ওযূ ভঙ্গের কারণ হিসাবে বমিকে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। আর মানুষও তাই আমল করে থাকে। অথচ তার পক্ষে কোন ছহীহ হাদীছ নেই।
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (
) বলেছেন, স্বলাতের মধ্যে কারো যদি বমি হয় অথবা নাক থেকে রক্ত ঝরে বা মুখ দিয়ে খাদ্যদ্রব্য বের হয় কিংবা মযী নির্গত হয় তাহ’লে সে যেন ফিরে যায় এবং ওযূ করে। এরপর পূর্ববর্তী স্বলাতের উপর ভিত্তি করে স্বলাত আদায় করে। আর এই সময়ে সে কোন কথা বলবে না। (ইবনু মাজাহ হা/১২২১, ‘স্বলাত কায়েম ও তার সুন্নাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৩৭।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। উক্ত হাদীছের সনদে ইসমাঈল ইবনু আইয়াশ নামে একজন রাবী আছে, সে যঈফ। সে হিজাযের দুই ব্যক্তি বর্ণনা করেছে কিন্তু তাও যঈফ। (যঈফ ইবনে মাজাহ হা/১২২১; যঈফ আবূদাঊদ (আল-উম্ম), পৃঃ ৬৮; যঈফুল জামে‘ হা/৫৪২৬।)
যায়েদ ইবনু আলী তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল () বলেছেন, বমি অপবিত্র। (দারাকুৎনী ১/১৫৫ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি নিতান্ত যঈফ। ইমাম দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, এর সনদে সাওর নামক রাবী রয়েছে সে যায়েদ বা অন্য কারো নিকট থেকে বর্ণনা করেনি। (দারাকুৎনী ১/১৫৫ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০৭৫, ৯/৭২ পৃঃ; যঈফুল জামে‘ হা/৪১৩৯।)
অতএব বমি হ’লে ওযূ করতে হবে মর্মে কোন ছহীহ বিধান নেই।
জ্ঞাতব্য : হেদায়া ও কুদূরীতে রক্ত বের হওয়া ও বমি হওয়াকে ওযূ ভঙ্গের কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (হেদায়া ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩; বঙ্গানুবাদ ১/৮-৯ পৃঃ; কুদূরী, পৃঃ ৫।) আর সে কারণেই এই আমল চালু আছে। দুঃখজনক হ’ল, ইমাম দারাকুৎনীর উক্ত মন্তব্য থাকতে হেদায়া ও কুদূরীতে কিভাবে তা পেশ করা হ’ল?
(২৮) ওযূ থাকা সত্ত্বেও ওযূ করলে দশগুণ নেকী: 
 উক্ত ফযীলত সঠিক নয়। কারণ এ মর্মে বর্ণিত হাদীছ যঈফ।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন, যে ওযূ অবস্থায় ওযূ করবে তার জন্য দশটি নেকী রয়েছে। (আবূদাঊদ হা/৬২, ১/৯ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৫১২, পৃঃ ৩৯; তিরমিযী হা/৫৯, ১/১৯ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/২৯৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭৩, ২/৪৩ পৃঃ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৭।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। ইমাম তিরমিযী, মুনযেরী, ইরাক্বী, নববী, ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ হাদীছটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে একমত। (যঈফ আবূদাঊদ হা/১০।) উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যিয়াদ ইফরীক্বী ও গুত্বাইফ নামক দুই দুর্বল ও অপরিচিত রাবী আছে। (আবূদাঊদ হা/৬২; ইবনু মাজাহ হা/৫১২; তিরমিযী হা/৫৯; আলবানী, মিশকাত হা/২৯৩, ১/৯৬ পৃঃ।)
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন, যে ব্যক্তি একবার করে ওযূ করবে সে ব্যক্তি ওযূর নিয়ম পালন করল, যা তার জন্য আবশ্যক ছিল। যে ব্যক্তি দুইবার করে ধৌত করবে সে দ্বিগুণ ছওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি তিনবার করে ধৌত করবে তার ওযূ আমার ও আমার পূর্বের নবীগণের ওযূর ন্যায় হ’ল। (মুসনাদে আহমাদ হা/৫৭৩৫; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৪।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৩৬; তাহক্বীক্ব মুসনাদ হা/৫৭৩৫।) উক্ত যঈফ হাদীছ হেদায়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে। (ঐ, ১/১৯ পৃঃ)। এর সনদে যায়েদ আল-আম্মী নামে একজন দুর্বল রাবী আছে। (যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৪২০।)
ওছমান (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল ()-কে বলতে শুনেছি যে, কোন বান্দা যখন উত্তমরূপে ওযূ করে তখন আল্লাহ তার সামনের ও পিছনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদুল বাযযার হা/৪২২, ১/৯৩ পৃঃ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯২।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি মুনকার বা অস্বীকৃত। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫০৩৬, ১১/৬২ পৃঃ।)
(২৯) তায়াম্মুমের সময় দুইবার হাত মারা ও কনুই পর্যন্ত মাসাহ করা:
 তায়াম্মুম করার সময় একবার মাটিতে হাত মারতে হবে এবং কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করতে হবে। দুইবার হাত মারা ও কনুই পর্যন্ত মাসাহ করা সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। যেমন:
ইবনু ওমর (রাঃ) রাসূল () থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, তায়াম্মুমে দুইবার হাত মারতে হবে। মুখের জন্য একবার আর কনুই পর্যন্ত দুই হাত মাসাহর জন্য একবার। (বায়হাক্বী হা/১০৫৪, ১/২০৭; হাকেম হা/৬৩৪ ও ৬৩৬; আবূদাঊদ হা/৩৩০, ১/৪৭ পৃঃ; দারাকুৎনী ১/১৭৭; বলূগুল মারাম হা/১২৮; বিস্তারিত দ্রঃ তানক্বীহ, পৃঃ ১৯৪-১৯৭।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে কয়েকজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর আল-উমরা নামক রাবীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল হিসাবে যঈফ। আলী ইবনু যাবইয়ান নামক রাবী অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম ইবনু মাঈন বলেন, সে মিথ্যুক, অপবিত্র। ইমাম বুখারী বলেন, সে মুনকার হাদীছ বর্ণনাকারী এবং ইমাম নাসাঈ বলেন, সে হাদীছের পরিত্যক্ত রাবী। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৪২৭; যঈফুল জামে‘ হা/২৫১৯; যঈফ আবূদাঊদ হা/৩৩০।)
প্রশ্ন হ’ল, উক্ত হাদীছ হেদায়া ও কুদূরীতে কিভাবে স্থান পেল? (হেদায়া ১ম খন্ড, পৃঃ ৫০, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ; কুদূরী পৃঃ ১২।) অথচ ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তায়াম্মুম করার পদ্ধতি সম্পর্কে। (ছহীহ বুখারী হা/৩৩৮, ১/৪৮ পৃঃ; মুসলিম হা/৮৪৬, ১/১৬১ পৃঃ; মিশকাত হা/৫২৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯৩, ২/১৩৫ পৃঃ।) সেই হাদীছ প্রত্যাখ্যান করার কারণ অজানা।
নাফে‘ বলেন, আমি একদা আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর সাথে তাঁর এক কাজে গিয়েছিলাম। অতঃপর তিনি তার কাজ সমাধা করলেন। সেই দিন তার কথার মধ্যে এই কথা ছিল যে, কোন এক ব্যক্তি এক গলিতে চলছিল এমন সময় রাসূল (ছা)-এর সাক্ষাৎ পেল। তিনি তখন পায়খানা বা পেসাবখানা থেকে বের হয়েছেন। সে রাসূল ()-কে সালাম দিল কিন্তু তিনি তার উত্তর নিলেন না। এমনকি যখন গলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি দুই হাত দেওয়ালের উপর মারলেন এবং উহা দ্বারা মুখমন্ডল মাসাহ করলেন। অতঃপর পুনরায় হাত মারলেন এবং দুই হাত মাসাহ করলেন। তারপর লোকটির সালামের উত্তর দিলেন আর বললেন, আমি ওযূ অবস্থায় ছিলাম না। উহাই তোমার সালামের উত্তর দিতে আমাকে বাধা দিয়েছিল। (আবূদাঊদ হা/৩৩০, ১/৪৭ পৃঃ; মিশকাত হা/৪৬৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৭, ২/১০৯ পৃঃ, ‘অপবিত্র ব্যক্তির সাথে মিলামেশা’ অনুচ্ছেদ।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। ইমাম আবূদাঊদ বলেন, ‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে বলতে শুনেছি, মুহাম্মাদ বিন ছাবিত তায়াম্মুম সম্পর্কে একটি মুনকার হাদীছ বর্ণনা করেছে’।(যঈফ আবূদাঊদ হা/৩৩০।) ইমাম বুখারী এবং ইয়াহইয়া ইবনু মাঈনও অনুরূপ বলেছেন। ইবনু হাজার আসক্বালানী তাকে যঈফ বলেছেন। ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, হাদীটি ছহীহ নয়। কারণ মুহাম্মাদ ইবনু ছাবিত আল-আবদী অত্যন্ত দুর্বল। তার হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয় না ( যঈফ আবূদাঊদ (আল-উম্ম) হা/৫৮, পৃঃ ১৩৬।)
ইমাম আবূদাঊদ আরো বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ছাবিত রাসূলুল্লাহ ()-এর দুইবার হাত মারা ও ইবনু ওমরের কাজের যে বর্ণনা করেছে এই ঘটনার ব্যাপারে সে নির্ভরযোগ্য নয়। (যঈফ আবূদাঊদ হা/৩৩০।)
তায়াম্মুমের সঠিক পদ্ধতি: 
পবিত্র হওয়ার নিয়ত করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মাটিতে দুই হাত একবার মারবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ; ছহীহ বুখারী হা/১; মিশকাত হা/১; ছহীহ তিরমিযী হা/২৫, ১/১৩ পৃঃ; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭, পৃঃ ৩২ সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪০২।) অতঃপর ফুঁক দিয়ে ঝেড়ে ফেলে প্রথমে মুখমন্ডল তারপর দুই হাত একবার কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করবে। যেমন রাসূল (
) বলেন,
তোমার জন্য এইরূপ করাই যথেষ্ট ছিল। এই বলে তিনি তাঁর দুই হাত মাটির উপর মারলেন এবং ফুঁক দিলেন। অতঃপর দুই হাত দ্বারা মুখমন্ডল ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন। (ছহীহ বুখারী হা/৩৩৮, ১/৪৮ পৃঃ; মুসলিম হা/৮৪৬, ১/১৬১ পৃঃ; মিশকাত হা/৫২৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯৩, ২/১৩৫ পৃঃ।)
উল্লেখ্য যে, আবুদাঊদে দুইবার হাত মারা ও পুরো হাত বগল পর্যন্ত মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তার সনদ বিশুদ্ধ হ’লেও সেগুলো মূলতঃ কতিপয় ছাহাবীর ঘটনা মাত্র। যা রাসূল () তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার আগের বিষয়। (আবূদাঊদ হা/৩১৮, ১/৪৭ পৃঃ; মিশকাত হা/৫৩৬।) অতঃপর রাসূল () তায়াম্মুমের উক্ত পদ্ধতি শিক্ষা দান করেন। যেমন- ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বলেন,
এটা ছাহাবীদের কাজের ঘটনা, যা আমরা রাসূল () থেকে নকল করতে পারিনি। যেমনটি আম্মার (রাঃ) জুনুবী অবস্থায় মাটিতে গড়াগড়ি করার ঘটনা নিজের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর যখন তিনি রাসূল ()-কে জিজ্ঞেস করলেন তখন তিনি শুধু মুখমন্ডল ও দুই কব্জি মাসহের নির্দেশ দান করেন। এ পর্যন্তই শেষ করেছেন। আর আম্মার (রাঃ) তার কাজ থেকে ফিরে আসেন। (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫৩৬-এর টীকা দ্রঃ ১/১৬৭ পৃঃ।)
শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন,
কিন্তু আমল এর উপর (দুই হাত মারা) ছিল না। কারণ তখন ছাহাবীগণ রাসূল ()-এর শিক্ষা অনুযায়ী করেননি। বরং আমল ছিল শেষ হাদীছের প্রতি, যা পরেই আসছে। (ছহীহ আবূদাঊদ হা/৩৪৩, ২/১২৬ পৃঃ।) অতএব রাসূলের আমল ও বক্তব্যই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়।
(৩০) মুছল্লীর ওযূতে ত্রুটি থাকলে ইমামের ক্বিরাআতে ভুল হয়: 
 আলেমদের মাঝে উক্ত বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু উক্ত মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
শাবীব আবী রাওহ ছাহাবীদের কোন একজন থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল () একদা ফজরের স্বলাত আদায় করলেন এবং সূরা রূম পড়লেন। কিন্তু পড়ার মাঝে কিছু গোলমাল হ’ল। স্বলাত শেষে তিনি বললেন, তাদের কী হয়েছে যে, যারা আমাদের সাথে স্বলাত আদায় করে অথচ উত্তমরূপে ওযূ করে না। এরাই আমাদের কুরআন তেলাওয়াতে গোলযোগ ঘটায়। (নাসাঈ হা/৯৪৭, ১/১১০ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/২৯৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭৫, ২/৪৪।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুল মালেক বিন উমাইর নামে একজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী রয়েছে। (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/২৯৫-এর টীকা দ্রঃ; নাসাঈ হা/৯৪৭; যঈফুল জামে‘ হা/৫০৩৪।)
(২৮) মাথার চুলের গোড়ায় নাপাকি থাকবে মনে করে সর্বদা মাথার চুল ছোট করে রাখা বা কামিয়ে রাখা: 
 নাপাকি থাকার ভয়ে এক শ্রেণীর মুরববী সর্বদা মাথা ন্যাড়া করে রাখেন বা চুল খুব ছোট করে রাখেন এবং একে খুব ফযীলতপূর্ণ মনে করেন। আলী (রাঃ) এরূপ করতেন বলে তারা এর অনুসরণ করে থাকেন। অথচ উক্ত মর্মে যে বর্ণনা প্রচলিত আছে তা যঈফ, মোটেই আমলযোগ্য নয়।
আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল () বলেছেন, যে ব্যক্তি নাপাকীর এক চুল পরিমাণ স্থানও ছেড়ে দিবে এবং উহা ধৌত করবে না তার সাথে আগুনের দ্বারা এই এই ব্যবস্থা করা হবে। আলী (রাঃ) বলেন, সেই অবধিই আমি আমার মাথার সাথে শত্রুতা করেছি। একথা তিনি তিনবার বললেন। তিনি তার মাথার চুল খুব ছোট করে রাখতেন। (আবূদাঊদ হা/২৪৯, ১/৩৩ পৃঃ; আহমাদ হা/১১২১; মিশকাত হা/৪৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪০৮।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৩০; ইরওয়াউল গালীল হা/১৩৩; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৪৪৪, ১/১৩৮ পৃঃ।) উক্ত বর্ণনার সনদে ‘আত্বা, হাম্মাদ ও যাযান নামের ব্যক্তি ত্রুটিপূর্ণ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৩০, ২/২৩২ পৃঃ।)
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল () বলেছেন, প্রত্যেক চুলের নীচেই অপবিত্র রয়েছে। সুতরাং চুলগুলোকে ভালভাবে ধৌত করবে এবং চামড়াকে সুন্দর করে পরিষ্কার করবে। (আবূদাঊদ হা/২৪৮, ১/৩৩ পৃঃ; তিরমিযী হা/১০৬, ১/২৯ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৫৯৭, পৃঃ ৪৪; আলবানী, মিশকাত হা/৪৪৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪০৭, ২/৯৭ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৮০১।) এর সনদে হারিছ ইবনু ওয়াজীহ নামক এক রাবী আছে। ইমাম আবূদাঊদ বলেন, তার হাদীছ মুনকার আর সে দুর্বল রাবী। ( যঈফ আবূদাঊদ হা/২৮৪; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৪৪৩, ১/১৩৮ পৃঃ।)
আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত স্বলাত, এক জুম‘আ থেকে অপর জুম‘আ, আমানত আদায় করা- এর মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফফারা। আমি বললাম, আমানত আদায়ের অর্থ কী? তিনি বললেন, জানাবাতের গোসল করা। কারণ প্রতিটি পশমের গোড়ায় অপবিত্রতা রয়েছে। (ইবনু মাজাহ হা/৫৯৮, পৃঃ ৪৪, ‘পবিত্রতা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০৬।)
তাহক্বীক্ব : উক্ত হাদীছও যঈফ। (যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৫৯৮।) এর সনদে উতবা ইবনু আবী হাকীম নামে একজন দুর্বল রাবী আছে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৮০১, ৮/২৭২।)
(২৯) ঋতুবতী মহি’লা বা অপবিত্র ব্যক্তিদেরকে মুখস্থ কুরআন তেলাওয়াত করতে নিষেধ করা: 
 অপবিত্র ব্যক্তি বা ঋতুবতী মহি’লা কুরআন স্পর্শ না করে মুখস্থ তেলাওয়াত করতে পারে। (ছহীহ বুখারী হা/৩০৫ ও ৩০৬, ‘ঋতু’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭।) মুখস্থও পড়া যাবে না বলে যে কথা প্রচলিত আছে তা সঠিক নয়। অনুরূপ অপবিত্র ব্যক্তি সালাম-মুছাফাহা করতে পারে না, কোন বিশেষ পাত্র স্পর্শ করতে পারে না ও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না বলে যে কথা সমাজে প্রচলিত আছে তা কুসংস্কার মাত্র। আর এ ব্যাপারে যে সমস্ত কথা বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ ও ভিত্তিহীন। যেমন-
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল () বলেছেন, ঋতুবতী অবস্থায় স্ত্রী লোক এবং অপবিত্র ব্যক্তি কুরআনের কোন অংশ পড়বে না। (তিরমিযী হা/১৩১; মিশকাত হা/৪৬১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩২, ২/১০৮।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি মুনকার। ইমাম তিরমিযী বলেন, আমি ইমাম বুখারীকে বলতে শুনেছি ইসমাঈল বিন আইয়াশ হিজায ও ইরাকের অধিবাসীদের থেকে বর্ণনা করেছে। তার হাদীছগুলো মুনকার। সে যঈফ হাদীছ বর্ণনা করেছে। (যঈফ তিরমিযী হা/১৩১।)
আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল () অপবিত্র না থাকলে প্রত্যেক অবস্থাতেই তিনি আমাদের কুরআন পড়াতেন। (আহমাদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু হিববান, বলূগুল মারাম হা/১০০।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (যঈফ তিরমিযী হা/১৪৬।)
আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল () পায়খানা হ’তে বের হয়ে আমাদেরকে কুরআন পড়াতেন এবং আমাদের সাথে গোশত খেতেন। অপবিত্রতা ছাড়া কুরআন হ’তে তাকে কোন কিছু বাধা দিতে পারত না। (আবূদাঊদ হা/২২৯; নাসাঈ হা/২৬৫; মিশকাত হা/৪৬০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩১, ২/১০৭।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (ইরওয়াউল গালীল হা/৪৮৫।)
পবিত্রতা সম্পর্কে প্রসিদ্ধ কয়েকটি যঈফ ও জাল হাদীছ: 
নিম্নে কয়েকটি বর্ণনা পেশ করা হ’ল যেগুলো মানুষের মুখে মুখে খুবই প্রচলিত। অথচ তা যঈফ ও জাল বর্ণনা। এ সমস্ত বর্ণনা প্রচার করা উচিত নয়।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী () যখন তিনি টয়লেটে প্রবেশ করতেন তখন আংটি খুলে রাখতেন। (আবূদাঊদ হা/১৯; তিরমিযী হা/১৭৪৬; নাসাঈ হা/৫২১৩; মিশকাত হা/৩৪৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩১৬, ২/৬২।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি মুনকার ও যঈফ। ইমাম আবূদাঊদ বলেন, ‘এই হাদীছ মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য’।( যঈফ আবূদাঊদ হা/১৯)
ঈসা ইবনু ইয়াযদাদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল () বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ পেশাব করে তখন সে যেন পুরুষাঙ্গ তিনবার ঝেড়ে নেয়। (ইবনু মাজাহ হা/৩২৬; বলূগুল মারাম হা/৯০।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে যাম‘আহ ইবনু ছালেহ আল-জুনদী ও ঈসা ইবনু ইয়াযদাদ নামক দুইজন দুর্বল রাবী আছে। (তাহক্বীক্ব মুসনাদ হা/১৯০৭৬; যঈফ ইবনু মাজাহ হা/৩২৬; সিলসিলা যঈফাহ হা/১৬২১।)
আবু রাফে‘ (রাঃ) বলেন, রাসূল () যখন স্বলাতের জন্য ওযূ করতেন, তখন আপন আঙ্গুলে পরিহিত আংটিকে নেড়ে দিতেন। (দারাকুৎনী ১/৯৪; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৯; মিশকাত হা/৪২৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৯৫।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে মা‘মার ও তার পিতা মুহাম্মাদ ইবনু উবায়দুল্লাহ নামে দুইজন দুর্বল রাবী আছে। (যঈফ ইবনু মাজাহ হা/৪৪৯; যঈফুল জামে‘ হা/৪৩৬১।)
আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল () বললেন, এই সকল ঘরের দরজা মসজিদের দিক হ’তে (অন্য দিকে) ফিরিয়ে দাও। কারণ আমি মসজিদকে ঋতুবতী ও নাপাক ব্যক্তির জন্য জায়েয মনে করি না। (আবূদাঊদ হা/২৩২; মিশকাত হা/৪৬২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৩, ২/১০৮ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে জাসরা বিনতে দিজাজা নামক একজন বর্ণনাকারী আছে সে অত্যধিক ত্রুটিপূর্ণ। (যঈফ আবূদাঊদ হা/২৩২; ইরওয়াউল গালীল হা/১২৪, ১৯৩, ৯৬৮।)
আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল () বলেছেন, (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না সেই ঘরে, যাতে কোন ছবি রয়েছে অথবা কুকুর বা নাপাক ব্যক্তি রয়েছে। (আবুদাউদ হা/২২৭, ৪১৫২; নাসাঈ হা/২৬১; মিশকাত হা/৪৬৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৪, ২/১০৮।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (যঈফ আবুদাউদ হা/২২৭, ৪১৫২; যঈফ নাসাঈ হা/২৬১; মিশকাত হা/৪৬৩।)
আলী (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল ()-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল ()! আমি নাপাকীর গোসল করেছি ও ফজরের স্বলাত পড়েছি। অতঃপর দেখি এক নখ পরিমাণ জায়গায় পানি পৌঁছেনি, রাসূল () বললেন, যদি তখন তুমি উহার উপর তোমার (ভিজা) হাত মুছে দিতে, তোমার পক্ষে যথেষ্ট হ’ত। (ইবনু মাজাহ হা/৬৬৪, পৃঃ ৪৮; মিশকাত হা/৪৪৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪১৩, ২/৯৮।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু উবায়দুল্লাহ নামে একজন দুর্বল বর্ণনাকারী আছে। (যঈফ ইবনু মাজাহ হা/৬৬৪; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৪৪৯-এর টীকা দ্রঃ।
 ﷺ)-এর স্বলাত- এর অংশবিশেষ শায়খ মুযাফফর বিন মুহসিন জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ 

কিছু হাদিস দেখে নিনঃ---- 


নিয়ত বিষয়ক
●●● উমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, "যাবতীয় কার্য নিয়ত (বা সংকল্পের) উপর নির্ভরশীল । আর মানুষের জন্য তাই প্রাপ্য হবে, যার সে নিয়ত করে । অতএব যে ব্যক্তি হিযরত (স্বদেশ ত্যাগ) আল্লাহর (সন্তোষ লাভের) উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে, তাঁর হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে । আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত যে সংকল্প নিয়ে করবে তারই জন্য হবে ।" -[বুখারী, মুসলিম, রিয়াদুস স্বা-লিহীনঃ ১]
●●● আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ "নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন ।" -[বুখারী, মুসলিম, রিয়াদুস স্বা-লিহীনঃ ৮]
 নিয়ত মুখে উচ্চারণ করার বিধান কি?
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى “কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে যা সে নিয়ত করবে।” (বুখারী ও মুসলিম) নিয়ত আরবী শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা বা সংকল্প। নিয়তের স্থান হচ্ছে অন্তর। তা মুখে উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি যখন ওযু করবেন তখন এটাই একটা নিয়ত। একজন বিবেকবান, সুস্থ মস্তিষ্ক, বাধ্য করা হয়নি এমন লোক কোন কাজ করবে আর সেখানে তার কোন নিয়ত বা ইচ্ছা থাকবে না এটা সম্ভব নয়। এজন্য কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, (নিয়ত ছাড়া কোন আমল করা যদি আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতি আবশ্যক করতেন, তবে তা হতো সাধ্যাতিত কাজ চাপিয়ে দেয়ার অন্তর্গত।)
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এ ব্যাপারে কোন দলীল প্রমাণিত নেই। না প্রমাণিত আছে ছাহাবায়ে কেরাম থেকে। যারা মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করে আপনি দেখবেন তারা হয় মূর্খ নতুবা কোন আলেম বা মুরব্বীর অন্ধানুসারী। মুখে নিয়ত পাঠকারীদের যুক্তি হচ্ছে, অন্তরের ইচ্ছার সাথে মুখের কথা ও কাজের মিলের জন্য নিয়ত পাঠ করা উচিৎ। কিন্তু তাদের এ যুক্তি অসাড়। একাজ শরীয়ত সম্মত হলে রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কথা বা কাজে উম্মতের সামনে তার বর্ণনা পাওয়া যেত। (আল্লাহ্‌ই তাওফীক দাতা)
ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা
(১০) ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা :
মুখে নিয়ত বলার শারঈ কোন বিধান নেই। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এ ধরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এটি মানুষের তৈরী বিধান। অতএব তা পরিত্যাগ করে মনে মনে নিয়ত করতে হবে।[1] উল্লেখ্য যে, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)-এর নামে প্রকাশিত ‘পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা ও যরূরী মাসআলা মাসায়েল’ নামক বইয়ে বলা হয়েছে যে, ক্বিবলার দিকে মুখ করে উঁচু স্থানে বসে ওযূ করতে হবে।[2] অথচ উক্ত কথার প্রমাণে কোন দলীল পেশ করা হয়নি। উক্ত দাবী ভিত্তিহীন।
[1]. ছহীহ বুখারী হা/১; ছহীহ মুসলিম হা/৫০৩৬; মিশকাত হা/১। [2]. হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ), ‘পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা ও জরুরী মাসআলা মাসায়েল’, সংকলনে ও সম্পাদনায়- মাওলানা আজিজুল হক (ঢাকা : মীনা বুক হাউস, ৪৫, বাংলা বাজার, চতুর্থ মুদ্রণ-আগস্ট ২০০৯), পৃঃ ৪২; উল্লেখ্য যে, মাওলানার নামে বহু রকমের ছালাত শিক্ষা বইয়ের বাংলা অনুবাদ বাজারে চালু আছে। কোন্টি যে আসল অনুবাদ তা আল্লাহই ভাল জানেন।
 নিয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত
আমল ও ইবাদত শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং তাতে সওয়াব পাওয়া-না পাওয়ার কথা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত শুদ্ধ হলে আমল শুদ্ধ; নচেৎ না। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়, যার সে নিয়ত করে থাকে। যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব কোন বিষয় লাভের উদ্দেশ্যে হয়, সে ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়। যার হিজরত কোন মহিলাকে বিবাহ্‌ করার উদ্দেশ্যে হয়, তার প্রাপ্যও তাই। যে যে নিয়তে হিজরত করবে সে তাই পেয়ে থাকবে।” (বুখারীমুসলিমমিশকাত ১নং)
নাম নেওয়া লোক দেখানো, কোন পার্থিব স্বার্থলাভ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কোন আমল করা এক ফিতনা; যা কানা দাজ্জালের ফিতনা অপেক্ষা বড় ও অধিকতর ভয়ঙ্কর । একদা সাহাবীগণ কানা দাজ্জালের কথা আলোচনা করছিলেন। ইত্যবসরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বের হয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ আমি কি তোমাদেরকে এমন (ফিতনার) কথা বলে দেব না, যা আমার নিকট কানা দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে অধিকতর ভয়ানক?” সকলে বললেন, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “ তা হল গুপ্ত শির্ক; লোকে নামায পড়তে দাঁড়ালে তার প্রতি অন্য লোকের দৃষ্টি খেয়াল করে তার নামাযকে আরো সুন্দর বা বেশী করে পড়তে শুরু করে।” (ইবনে মাজাহ্‌সুনানবায়হাকীসহিহ তারগিব ২৭নং)
বলাবাহুল্য, আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে কোনও আমল করলে গুপ্ত শির্ক করা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে এবং গৃহ্‌স্থালির প্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।” (কুরআন মাজীদ ১০৭/-)
জ্ঞাতব্য যে, প্রত্যেক ইবাদাত কবুল হওয়ার মূল বুনিয়াদ হল তাওহীদ।
অতএব মুশরিকের কোন ইবাদাত গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন প্রত্যেক ইবাদত মঞ্জুর হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত হল দু’টি; নিয়তের ইখলাস বা বিশুদ্ধচিত্ততা এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর তরীকা, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত।
  
পরিচ্ছদঃ ১/ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি কিভাবে ওহী শুরু হয়েছিল
১। হুমায়দী (রহঃ) আলকামা ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য।
কিভাবে Ohi শুরু

থেকে বর্ণিত উমর ইবনে খাত্তাব রা: আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু শুনেছি 'alaihi WA sallam) বলেন, "কাজের পুরস্কার উদ্দেশ্য উপর নির্ভর করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে তার অভিপ্রেত হয়েছে অনুযায়ী পুরস্কার পাবেন অতঃপর কেউ। পার্থিব উপকারের জন্য বা বিয়ে করার জন্য একজন মহিলার নিমগ্ন হয়ে যাওয়া, তার অভিবাসনের জন্য তিনি যা নিযুক্ত করেছিলেন তার জন্য। "
তাহক্বীক: মারফু হাদিস। তাখরীজ : বুখারীঃ তাওহীদ.পাবলিকেশান্স ১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩; মুসলিমঃ ৫০৩৬; আবূ দাউদঃ ২২০৩; তিরমিযীঃ ১৭৪৮; দারাকুতনীঃ ১৩৪; নাসাঈঃ ৭৫, ৩৪৫০, ৩৮১০; আহমাদঃ ১৭০, ৩০৭। মুসলিম ২৩/৪৫ হা: ১৯০৭ , (আধুনিক প্রকাশনী. ১ , ইসলামিক ফাউন্ডেশন. ১) 
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) 
 ব্যাখ্যাঃ
ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ নিয়ত বলতে অন্তরের সংকল্প বুঝায়। অন্তরের দৃঢ় সংকল্পই নিয়ত; কিন্তু কিরমানী বলেন, "দৃঢ়তা" নিয়তের শর্ত নয়। এটি একটি অতিরিক্ত বিশেষণ যা নিয়ত শব্দটির পূর্বে যোগ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেনঃ ফকীহগনের মধ্যে নিয়ত সম্পর্কে মতবিরোধ আছে। এটা কি রুকন, না শর্ত? মোটকথা এই যে, কাজের প্রারম্ভে নিয়ত করা রুকন আর কাজের মধ্যে নিয়ত করা জরুরী। নিয়তের মধ্যে শরিয়ত বিরধী কোন সংকল্প থাকতে পারবে না। এটা নিয়তের প্রধান শর্ত।

কোন কাজ করতে যাওয়ার পূর্বে নিয়ত করা অপরিহার্য। শরীয়তের পরিভাশায় আল্লাহর সন্তোষটি এবং তাঁর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্য কাজ করার সংকল্পকে নিয়ত বলা হয়। সৎকাজ করে পুণ্য লাভ করতে হলে তাঁর উদ্দেশ্যও সৎ হতে হবে। কাজের শুভ পরিনতি লাভের জন্য ভালো নিয়ত বা সৎ উদ্দেশ্য একান্ত অপরিহার্য। যথাযথ নিয়ত বা সংকল্প ব্যাতিরেকে আমল সঠিক, পরিপূর্ণ ও পুন্যবহ হতে পারে না।

হিজরত অর্থ পরিত্যাগ করা। এক বস্ত হতে অন্য বস্তুর দিকে প্রস্থান করাকে হিজরত বলা হয়। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ্‌ এবং তদীয় রাসুল (সাঃ) যা নিষেধ করেছে তা পরিহার করাকে হিজরত বলে। ইসলামী শরীয়তে দু'ভাবে হিজরত হতে পারে।

১) ভয়-ভীতিপূর্ণ ভূখণ্ড হতে হিজরত করে শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ডে চলে যাওয়া। যেমনঃ ইসলামের প্রথম দিকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুমতিক্রমে কিছু সংখ্যক সাহাবী মক্কাবাসীদের অত্যাচারের আশঙ্কায় শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ ভূখণ্ড হাবশায় হিজরত করেছিলেন। এমনিভাবে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও আল্লাহর নির্দেশক্রমে মক্কা হতে সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় হিজরত করেছিলেন।

২) যে ভূখণ্ডে কাফেরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে সেই ভূখণ্ডে অবস্থান করে ঈমান রক্ষা করা অসম্ভব হলে মু'মিনদের প্রভাবিত নিরাপদ ভূখণ্ডে হিজরত করে চলে যাওয়ায় একান্ত যুক্তিযুক্ত। এই জাতীয় হিজরতের অবকাশ সর্বদাই রয়েছে।

এই হাদিসটি মুহাজিরে উম্মে কায়েসের নামে মুহাদ্দিস মহলে পরিচিত। ঘটনার সারমর্ম এই যে, উম্মে কায়েস নাম্নী এক মহিলার নিকট এক ব্যাক্তি বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে ঐ ব্যাক্তির হিজরত না করা পর্যন্ত তাঁর সাথে বিবাহে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ফলে সেই ব্যাক্তি উম্মে কায়েসকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করে মদীনায় আগমনপূর্বক তাঁর সাথে দাম্পত্য প্রণয় স্থাপন করে। এই লোকটিকে মুহাজিরে উম্মে কায়েস নামে অভিহিত করা হয়। ওহীর প্রারম্ভ পরবের সাথে হাদিসটির সামঞ্জস্য বিধানের ব্যাপারে হাদিসের ভাষ্যকরগন বিভিন্ন মতামত ব্যাক্ত করেছেন। তাঁর সার সংক্ষেপ নিম্নরূপঃ

প্রথমতঃ মহান আল্লাহ্‌ নবী রাসুলগনকে সাধারনভাবে এবং বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে বিশেষভাবে এ মর্মে অহী করেছেন যে, আমলসমূহের পারিতোষিক সহিহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। কাজেই আমল সম্বলিত অহীর বর্ণনা প্রসঙ্গে সর্বপ্রথমে এই হাদিসটির সংকলন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে সঙ্গতভাবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ ইমাম বুখারী (রাহেমাহুল্লাহ) তার সহিহ হাদিস গ্রন্থের সূচনায় এই হাদিসটি সংকলন করে নিয়তের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা হতে হিজরত করে মদীনায় গমনপূর্বক খুতবা ডান প্রসঙ্গে এই হাদিস বলেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ওহী প্রাপ্তির সূচনাই ছিল হিজরত। তিনি তদীয় বাসস্থান হতে হিজরত করে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সর্বপ্রথম ওহীর সন্ধান লাভ করেছিলেন। সুতরাং ওহীর প্রারম্ভ পর্বের সাথে হিজরত সম্বলিত এই হাদিসটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
তৃতীয়তঃ কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করতে হলে নিয়তকে খালেস করা একান্ত অপরিহার্য। ইমাম বুখারী (রাহেমাহুল্লাহ) তাঁর সহীহ গন্থ সংকলনের ন্যায় একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করতে গিয়ে প্রথমে নিয়ত এবং হিজরতের গুরুত্ব সম্বলিত এই হাদিসটি সংকলন করার মাধ্যমে বরকত হাসিল করার ইচ্ছা করেছেন। অধ্যায়ের সাথে হাদিসটির সামঞ্জস্য বিধানের অনুকুলে আরও অনেক যুক্তি প্রমান পেশ করা যেতে পারে।

আলোচ্য হাদিসে মুহাদ্দিস ইমামগণের ব্যাখ্যা হতে সুস্পষ্টতঃই জানা যায় যে, নিয়ত অন্তরের ব্যাপার, মুখে উচ্চারণ করার ব্যাপার নয়। কুরআন-হাদিসের কোথাও নামায, রোজা বা যে কোন আমলের আরম্ভ করার পূর্বে কোন ভাষায় মুখে উচ্চারণপূর্বক নিয়ত করতে হবে এমন কোনই প্রমান নেই। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী ও তাবা-তাবেয়ীদের আমলেও মুখে নিয়ত উচ্চারনের প্রমান বিদ্যমান নেই। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন, “মুখে উচ্চারণ না করার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নতের অনুসরণ রয়েছে-“ আশে’আতুল লোম’আত। বহু গ্রন্থ প্রণেতা আশরাফ আলী থানভী (রাহেমাহুল্লাহ) লিখেছেনঃ “মুসল্লি মনে মনে নামাযের নিয়ত বা সংকল্প করবে যে, আমি যোহরের নামায পড়তেছি। তারপর আল্লাহু আকবার বলে হাত বাঁধলেই হয়ে যাবে। সমাজে প্রচলিত লম্বা-চওড়া নিয়ত পাঠের প্রয়োজনীয়তা নাই।“ (বেহেশতী জেওর ২য় খণ্ড ১৭,১৮ পৃষ্ঠা) মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রাহেমাহুল্লাহ) লিখেছেন, “অন্তরেই নামাজের মনস্থ করে নিতে হবে। অর্থাৎ মনে মনে ধারনা করবে যে, আমি ফজরের নামায পড়তেছি। মুখে নিয়ত করার কোনই প্রয়োজন নেই”। (রাহে নাজাতঃ ৯ পৃষ্ঠা)
টীকাঃ চার মাযহাবের ইমামগন একমত হয়েছেন যে, নিয়ত ব্যাতিত নামায শুদ্ধ হবে না। (কিতাবুল ফিকহে “আলাল মাযাহিবিল আরবাআহঃ ১ম খণ্ড ২১০ পৃষ্ঠা)
জমা বা একত্রিত করে আদায় করার নিয়ত থাকা কী যরূরী?

অর্থাৎ জমা বা একত্রিত করে আদায় করার জন্য প্রথম সালাত আদায়ের সময়েই জমা করে পড়ার নিয়্যত থাকা যরুরী?
আলেমগণের মধ্যে এ ব্যাপারে কয়েকটি মত রয়েছে:
শাফে‘ঈ ও হাম্বলীদের নিকট যদি দ্বিতীয় সালাতকে এগিয়ে নিয়ে এসে প্রথম ওয়াক্তে দু’সালাতকে একত্রে পড়ে তবে সেখানে দ্বিতীয় সালাতকে আদায় করার নিয়্যত প্রথম সালাত আদায়ের সময়েই থাকতে হবে। অবশ্য যদি প্রথম সালাতকে দেরী করে দ্বিতীয় সালাতের সময়ে নিয়ে যায় তখন প্রথম সালাত আদায়ের সময় দ্বিতীয় সালাতকে একত্রিত করার নিয়্যত লাগবে না।
সে হিসেবে যদি প্রথম সালাত আদায় করার সময় দ্বিতীয় সালাতকে এগিয়ে নিয়ে আদায় করার নিয়্যত না করে তবে তার জমা বা একত্রিত করে আদায় করা শুদ্ধ হবে না। [রাওদাতুত তালেবীন, ১/৩৯৬; কাশশাফুল কিনা‘ ২/৮]
কারণ কখনও কখনও দ্বিতীয় সালাতকে প্রথম সালাতের সময়ে আদায় করা হয় একত্রিত করার জন্য, আবার কখনও তা করা হতে পারে ভুলবশতঃ। সুতরাং এতদোভয়ের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়্যতের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী।
পক্ষান্তরে মালেকী মাযহাবের আলেমগণের মতে, প্রথম সালাত আদায় করার সময়ে দ্বিতীয় সালাতকে তার সাথে জমা করার নিয়্যত করা ওয়াজিব কিন্তু শর্ত নয়। (আর তা দ্বিতীয় সালাতকে এগিয়ে নিয়ে আসা বা প্রথম সালাতকে দেরীতে আদায় করা উভয় ক্ষেত্রেই সমান) সুতরাং যদি কেউ প্রথম সালাত আদায়ের সময় দ্বিতীয় সালাতকে জমা নিয়্যত করা ছেড়ে দিল, তবে তাতে সালাত বাতিল হবে না। [হাশিয়াতুল আদাওয়ী (১/৩৩৫)]
আর এক বর্ণনায় ইমাম আহমাদ, ইমাম মুযানী এবং ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, প্রথম সালাত আদায়ের সময় দ্বিতীয় সালাত তার সাথে একত্রিত করার নিয়্যতের বাধ্য-বাধকতা নেই। [আল-মুহাযযাব, (১/১৯৭); আল-ইনসাফ:২/৩৪১]
ইবন তাইমিয়্যা রহ. বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর সাথীদের নিয়ে দু’ সালাত জমা ও কসর করে আদায় করছিলেন তখন তিনি তার সাথীদের কাউকে জমা ও কসর করার নিয়্যত করার জন্য আলাদা নির্দেশনা দেন নি। বরং তিনি মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন এ পুরো সময় তিনি দু’ রাকাআত কসর করেছেন কোনোরূপ জমা করা ব্যতীতই। তারপর তিনি আরাফায় যোহর আদায় করেছেন তখন তিনি সাহাবীগণকে জানিয়ে দেন নি যে, তিনি এর পরেই আসরকে আদায় করে নিতে চান। কিন্তু তিনি আসরও আদায় করলেন আর সাহাবীগণেরও কেউই যোহরের সালাতের পূর্বে আসরকে তার সাথে পড়ার নিয়্যত করেন নি। [মাজমু‘ ফাতাওয়া: ২৪/৫০]
সুতরাং এটাই হচ্ছে প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত। কারণ প্রথম সালাতের সময় দ্বিতীয় সালাতকে তার সাথে আদায় করার নিয়্যত করার বাধ্য-বাধকতার কোনো দলীল পাওয়া যাচ্ছে না, বরং দলীল তার উল্টোটাই প্রমাণ করে।
 প্রচলিত ভুলঃ
  প্রচলিত উযূর মধ্যে বাংলায় বা আরবীতে নাওয়াইতুআন আতআজ্জা...... নিয়্যাত হিসাবে পড়া হয়। কিন্তু সহীহ হাদীস তো দূরের কথা কোন যঈফ হাদীসেরও মুখে নিয়্যাত উচ্চারণের কথা বলা নেই।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এর পদ্ধতিঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়্যাত করবে।’’ (সহীহুল বুখারী-১/১, সহীহ্ মুসলিম’ ৪৬) অতএব নিয়্যাত করতে হবে পড়তে হবে না। আনোয়ার শাহ্ কাশ্মিরী (রঃ) বুখারীর শরা হতে লিখেছেন; নিয়্যাত হলো- অন্তরের কার্যসমূহ। (ফয়যুল বারী-১/৮ পৃঃ)

Post a Comment

0 Comments