ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)
নাম, উপনাম ও বংশ পরিচয় : নাম : আহমাদ, পিতা মুহাম্মদ, দাদা হাম্বল, উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ।
বংশনাম : আহমাদ
বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল বিন হিলাল বিন আসাদ বিন ইদ্রীস—- আশ্শায়বানী, আল-মারওয়াযী, আল-বাগদাদী। ইমামের ১৩তম পূর্ব পুরুষ শায়বান এর দিকে সম্পৃক্ত করায় আশ
শায়বানী, তাঁর জন্মভূমি মুরউ এর দিকে সম্পৃক্ত করায়
আল-মারওয়াযী, অতঃপর ইমামের অবস্থান বাগ্দাদ এর দিকে
সম্পৃক্ত কারয় ‘‘আল বাগ্দাদী।’’[1]
জন্ম ও
প্রতিপালন : ইমাম আহমাদ (রহ.) ১৬৪ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে মুরউতে
জন্ম গ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন তিনি মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় মুরউ হতে বাগদাদে
আসেন অতঃপর বাগদাদে জন্ম হয়। ছোট কালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন ফলে তিনি ইয়াতীম
অবস্থায় মার কাছে পালিত হন।[2]
শিক্ষা জীবন : ইমাম আহমাদ (রহ.) ছোট বয়সেই শিক্ষায় মনোনিবেশ হন।
তিনি প্রখর মেধাশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। অতি সহজেই অনেক কিছু মুখস্ত করে ফেলতেন।
ইব্রাহীম আল হারবী (রহ.) বলেন : ‘‘মনে হয় যেন আল্লাহ তা’আলা ইমাম আহমাদকে
আদি-অন্তের সকল প্রকার জ্ঞান দান করেছেন।’’[3]
শিক্ষা সফর : জ্ঞান পিপাসু ইমামুস সুন্নাহ্ ইমাম আহমাদ (রহ.)
বাগদাদের উল্লেখযোগ্য সকল আলিম হতে শিক্ষা গ্রহণের পর বিভিন্ন প্রান্তে জ্ঞান
আহরণে ছুটে চলেন। তিনি সফর করেন কুফা, বাসরা, মক্কা, মদীনা,
ত্বারতুস, দামেস্ক, ইয়ামান, মিসর ইত্যাদি অঞ্চলে। তিনি পাঁচবার
হাজ্জব্রত পালন করেন তন্মধ্যে তিনবার পায়ে হেঁটে হাজ্জ পালন করেন।[4]
হাদীসের জগতে
ইমাম আহমাদ (রহ.) : হাদীসের জগতে ইমাম আহমাদ (রহ.) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, তাঁর হাদীসের পারদর্শিতা সম্পর্কে
এক কথায় বলা যায় তিনি হাদীসের এক বিশাল সাগর। ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়াররাক
বলেন, ‘‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মত আর কাউকে দেখিনি,
তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি অন্যের চেয়ে ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর
মাঝে জ্ঞান-গরিমা বা মর্যাদা বেশী কি পেয়েছেন? তিনি বললেন
: ইমাম আহমাদ এমন একজন ব্যক্তি যাকে ৬০,০০০ (ষাট হাজার)
প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি সকল প্রশ্নের জবাবে হাদ্দাছানা ওয়া আখাবারানা অর্থাৎ হাদীস
হতে জবাব দিয়েছেন অন্য কিছু বলেন নি।’’[5]অতএব এক বাক্যে বলা যায় যে, ইমাম আহমাদ (রহ.)
হাদীসের সাগর ছিলেন। এ ছাড়াও এর জলন্ত প্রমাণ হলো ইমামের সংকলিত সুপ্রসিদ্ধ হাদীস
গ্রন্থ ‘‘আল মুসনাদ’’ যার হাদীস সংখ্যা চল্লিশ হাজার।[6]
অতএব হাদীসের
জগতে ইমাম আহমাদ (রহ.) এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। হাদীস শাস্ত্রে মুসতালাহ, ঈলাল, আসমাউর
রিজাল, জারহ-তাদীল ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য
কৃতিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। হাদীস শিক্ষাদানেও তাঁর কৃতিত্ব অতুলনীয়, তাঁর একেক মজলিসে পাঁচ হাজারেরও অধিক ছাত্র অংশ গ্রহণ করত।[7]
আহলুস সুন্নাহর
ইমাম : ইমাম আহমাদ (রহ.) সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে
প্রস্ত্তত কিন্তু প্রকাশ্যভাবে সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা হতে সামান্যতম ছাড় দিতে
প্রস্ত্তত নন, প্রয়োজনে জীবন জেতে
পারে তবুও সুন্নাহর অনুসরণ বর্জন হতে পারে না, ইমাম ইসহাক
বিন রাহুয়াহ (রহ.) বলেন : ‘‘যদি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল না হতেন এবং তাঁর ইসলামের
জন্য ত্যাগ স্বীকার না হত তাহলে ইসলাম বিনাশ হয়ে যেত, অর্থাৎ
যখন সকলেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কুরআনকে মাখলুক হিসাবে স্বীকার করে নিল, তখন পৃথিবীর বুকে একজনই মাত্র ইসলামের সঠিক বিশ্বাস ধারণ করেছিলেন,
তিনিই হলেন ইমাম আহমাদ। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের
সঠিক আকীদাহ্ বিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
রাসূল (ছাঃ) হতে
চলে আসা কুরআনের সঠিক বিশ্বাস : ‘‘কুরআন আল্লাহ তা’আলার বাণী, কোন সৃষ্ট বস্ত্ত নয়।’’ কিন্তু
জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের আবির্ভাবে এ বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটানো হয়, শুরু হল ‘‘কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্ত্ত’’ এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের
প্রচারণা, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে আববাসীয় খলীফা হারুনুর
রশীদ এবং পরবর্তী খলীফা মামুনুর রশীদ প্রভাবিত হলেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাসে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা হল সকলকে বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, ‘‘কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্ত্ত’’, এ বিশ্বাসের
কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। বাধ্য হয়ে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় প্রায় সকলেই ঐক্যমত
পোষণ করলেন শুধুমাত্র দু’জন দ্বিমত পোষণ করেন, ইমাম আহমাদ
(রহ.) ও মুহাম্মাদ বিন নূহ (রহ.)। নির্দেশ দেয়া হল তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য।
গ্রেফতার করে আনার পথে মুহাম্মদ বিন নূহ (রহ.) ইন্তেকাল করেন, আর ইমাম আহমাদ (রহ.) দু’আ করেছিলেন যেন খলীফা মামুনের সাথে সাক্ষাৎ না
হয়। ইমামকে কারাবাস দেয়া হল, প্রায় আটাস (২৮)
মাস কারাগারে আবদ্ধ হয়ে থাকলেন এবং খলীফা
মু‘তাসিম এর নির্দেশে ইমামকে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ না করায় বেত্রাঘাত করা
হল। হাত বেঁধে নিষ্ঠুরভাবে কোড়াঘাত করা হয়। কোড়াঘাতে রক্ত ঝড়তে থাকে, গায়ের কাপড় পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে
পরে যান, আবার জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের ভ্রান্ত
বিশ্বাসে একমত কিনা? একমত না হলে আবার কোড়াঘাত শুরু হয়।
এভাবে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। এর কারণ শুধু একটিই তিনি কুরআন ও
সুন্নাহর অনুসারী এবং বিদ’আতী বিশ্বাস বর্জনকারী। পরিশেষে খলীফা আল মুতাওয়াক্কিল
(রহ.) সঠিক বিষয় উপলব্ধি করায় গোটা মুসলিম জাহানে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত অনড়,
অটল একক ব্যক্তি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-কে কারামুক্ত করেন
এবং তাঁকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেন।[8]
ইমামের
আকীদাহ্-বিশ্বাস : পৃথিবীর
বুকে যখন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সকলেই মুতাযিলাদের বাতিল আকীদাহ-বিশ্বাস গ্রহণ করে তখন
একক ব্যক্তি যিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সঠিক আকীদাহ্ বিশ্বাসের উপর অটল
ছিলেন। এমনকি নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতনেও তিনি সঠিক
আকাদীহ্ হতে সামান্যতমও বিচ্যুত হননি। সুতরাং একবাক্যে বলা যায় যে, তিনি সঠিক আকীদায় শুধু বিশ্বাসী নয় বরং সঠিক আকীদায় বিশ্বাসীদের অন্যতম
ইমাম ছিলেন।
ইমাম
আহমাদ (রহ.)-এর শিক্ষকবৃন্দ : ইমাম
আহমাদ (রহ.) বাগদাদসহ গোটা মুসলিম জাহানের প্রায় সকল শিক্ষা কেন্দ্রে জ্ঞানের
সন্ধানে অবতরণ করেন, ফলে তাঁর শিক্ষক হাতে গনা কয়েকজন হতে
পারে না বরং তাঁর শিক্ষক অগণিত ও অসংখ্য। ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : ইমাম আহমাদ
(রহ.) ‘‘মুসনাদে আহমাদ’’ গ্রন্থের হাদীসসমূহ যে সব শিক্ষক হতে গ্রহণ করেন তাঁদের
সংখ্যা হলো দুইশত তিরাশি (২৮৩) জন।[9] এছাড়াও
বিভিন্ন বিষয়ে বহু সংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন। নিন্মে প্রসিদ্ধ কয়েকজন শিক্ষকের নাম
উল্লেখ করা হল[10]:
(১) ইমাম সুফইয়ান বিন উয়ায়নাহ (রহ.)।
(২) ইমাম ওয়াকী বিন আল জাররাহ্ (রহ.)।
(৩) ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেয়ী (রহ.)।
(৪) ইমাম আব্দুর রায্যাক আস সানআনী (রহ.)।
(৫) ইমাম কুতাইবাহ বিন সাঈদ (রহ.)।
(৬) ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (রহ.)।
(৭) ইমাম ইবনু আবী শাইবাহ (রহ.) ইত্যাদি।
ইমাম
আহমাদ (রহ.)-এর ছাত্র বৃন্দ : ইমাম
আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর ছাত্র অগণিত হওয়াই সাভাবিক, তাদের সংখ্যাও গণনা সম্ভব নয় এবং তালিকাও বর্ণনা সহজ নয়। যিনি লক্ষাধিক
হাদীসের হাফেয, চল্লিশ হাজার হাদীস গ্রন্থের সংকলক তাঁর
ছাত্র বিশ্বজুড়ে হওয়াই সাভাবিক । যার মাজলিসে পাঁচ হাজার পর্যন্ত ছাত্র থাকত,
নিম্নে কয়েকজন নক্ষত্রতুল্য ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হল[11]:
১. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী (রহ.)।
২. ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশায়রী (রহ.)।
৩. ইমাম আবূ দাঊদ আস সিজিস্তানী (রহ.)।
৪. ইমাম আবূ ঈসা অত্তিমিযী (রহ.)।
৫. ইমাম আবূ আব্দুর রহমান আন্নাসাঈ (রহ.)।
৬. ইমাম সালিহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)।
৭. ইমাম আব্দুল্লাহ্ বিন আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) ইত্যাদি।
ইমাম
আহমাদ (রহ.)-এর রচনাবলী : প্রসিদ্ধ
চারজন ইমামের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশী গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি হলেন ইমাম আহমাদ বিন
হাম্বল (রহ.)। শুধু তাই নয় বরং তাঁর সংকলিত হাদীস গ্রন্থ ‘‘মুসনাদ’’ সর্ব
প্রসিদ্ধ। ইমামের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো[12]:
১. হাদীস গ্রন্থ ‘‘আল মুস্নাদ’’ (হাদীস সংখ্যা চল্লিশ হাজার)।[13]
২. আয্যুহ্দ।
৩. ফাযায়িলুস
সাহাবাহ।
৪. আল ঈলাল ওয়া
মারিফাতির রিজাল।
৫. আল ওয়ার‘।
৬. কিতাবুস
সালাত।
৭. আর্রাদ্দ
আলাল জাহমিয়্যাহ।
৮. রিসালাতু
ইমাম আহমাদ।
৯. আল মাসায়িল।
১০.
আহ্কামুন্নিসা।
১১. কিতাবুল
মানাসিক।
১২.
কিতাবুস্সন্নাহ, ইত্যাদি।
ইমাম আহমাদ
(রহ.) সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
(১) ইমাম আলী ইবনুল
মাদীনী (রহ.) বলেন : আল্লাহ তা’আলা রাসূল (ছাঃ)-এর পর দু’জন ব্যক্তির মাধ্যমেই
ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন হলেন আবূ বকর < যার
মাধ্যমে মুরতাদ ও ভন্ড নাবীদের দমন করেছেন, আর অপরজন
আহমাদ বিন হাম্বল, যার মাধ্যমে কুরআনের মানহানীর সময়
কুরআনকে সমুন্নত করেছেন।[14]
(২) ইমাম আব্দুল
ওয়াহ্হাব আল ওয়াররাক (রহ.) বলেন : ‘‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মত আর কাউকে
দেখিনি, তাকে জিজ্ঞাসা করা হল আপনি অন্যের চেয়ে ইমাম
আহমাদের মাঝে জ্ঞান-গরিমার বা মর্যাদার বেশী পেয়েছেন কি? তিনি
বললেন : ইমাম আহমাদ এমন একজন ব্যক্তি যাকে ৬০,০০০ (ষাট
হাজার) প্রশ্ন করা হল, তিনি সকল প্রশ্নের জবাবে
হাদ্দাছানা ওয়া আখ্বারানা অর্থাৎ শুধু হাদীস হতে জবাব দিয়েছেন অন্য কিছু বলেন নি।[15]
(৩) ইমাম শাফেয়ী
(রহ.) বলেন : আমি বাগদাদ হতে বের হয়ে ইমাম আহমাদের চেয়ে অধিক আল্লাহভীরু, তাকওয়াশীল, ফাকীহ ও জ্ঞানী আর কাউকে পাইনি।[16]
ইমাম আহমাদ
(রহ.)-এর ইন্তেকাল : জন্মের পরই
মৃত্যুর পর্ব, আল্লাহ তা’আলার এ
নিয়মের ব্যতিূম মহামানব মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেনি, ঠিক একই নিয়মের শিকার হলেন আহ্লুস্সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমম- ইমাম
আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)। ২৪১ হিজরী ১২ রবিউল আউয়াল শুূবার সকল মাখলুককে ছেড়ে মহান
খালিক এর ত্বরে পাড়িজমান।[17] আল্লাহ তাঁকে জানণাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন!
ইমম (রহ.)-এর
জানাযায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয় যে, ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়ার্রাক (রহ.) বলেন : জাহেলী যুগে কিংবা
ইসলামী যুগে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। খোলা
মরুভূমিতে প্রথম জানাযা সম্পন্ন হয় যাতে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৬-৮ লক্ষ, কেউ কেউ বলেন দশ লক্ষ, আর নারীর সংখ্যা ছিল ৬০
হাজার। এ ছাড়াও কয়েকদিন পর্যন্ত জানাযা চলতে থাকে।[18]
জানাযার এ বিড়ল
দৃশ্য প্রমাণ করে ইমাম আহমাদ সত্যিই সত্যিই আহ্লুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের ইমাম।
– আবূ আবদুল্লাহ
মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
[1] হুলিয়াতুল আউলিয়া- ৯/১৬২ পৃঃ, তাহযীবুল কামাল- ১/৩৫ পৃঃ, তারিখে বাগদাদ-
৪/৪১৪ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা- ১১/১৭৮ পৃঃ, আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ- ১০/৭৭৫ পৃঃ, মানাকিব
লি ইবনুল জাওযী- ১৮ পৃঃ, ইত্যাদি।
[2] সিয়ারু
আলাম আনন্নুবালা- ১১/১৭৯ পৃঃ, আলবিদায়াহ্ ওয়ান
নিহায়াহ- ১০/৭৭৫ পৃঃ।
[3] ত্ববাকাতুল
হানাবিলাহ- ১/৯ পৃঃ, সিয়ারু আলমিন্নুবালা- ১১/১৮৮ পৃঃ।
[4] মুকাদ্দামাতু
কিতাব মাসায়িলি ইমাম আহমাদ- ১/২০ পৃঃ।
[5] ত্ববাকাতুল
হানাবিলাহ, ১/৯ পৃঃ।
[6] তাদবীনুস
সুন্নাহ আন্নাবাবীয়্যাহ, ১২২ পৃঃ।
[7] মুকাদ্দামাহ
কিতাব মাসায়িলি ইমাম আহমাদ, ১/২৪, ২৫ পৃঃ।
[8] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ১১/২৫০-২৫২ পৃঃ।
[9] সিয়ারু
আলাম আন্নুবালা, ১১/১৮০ পৃঃ।
[10] মকাদ্দামাহ্
কিতাব মাসায়িল ইমাম আহমাদ, ১/২১ পৃঃ।
[11] তাহ্যীবুল
কামাল, ১/৪৪০-৪৪২ পৃঃ।, সিয়ারু
আলামুন্নুবালা, ১১/
[12] মুকাদ্দিমাতু
কিতাব মাসায়িলি ইমাম আহমাদ, ১/৩০-৩৫ পৃঃ।
[13] তাদ্বীনুস
সুন্নাহ আন্নাবাবীয়্যাহ, ১২২ পৃঃ।
[14] ত্বব্কাত
আল হানাবিলাহ, ১/৩১ পৃঃ।
[15] ত্বব্কাত
আল হানাবিলাহ্, ১/৯ পৃঃ।
[16] তারিখে
বাগদাদ, ৪/৪১৯ পৃঃ, মানাকিব
বাইহাকী, ১/৫২৯ পৃঃ।
[17] সিয়ারু
আলামুন্নুবালা, ১১/৩৩৭ পৃঃ, আলবিদায়াহ,
১০/৭৯১ পৃঃ।
[18] সিয়ারু
আলামুন্নুবালা ১১/৩৩৯ পৃঃ।
, ১/২৪, ২৫ পৃঃ।
[8] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ১১/২৫০-২৫২ পৃঃ।
——————————————————————–
সমসাময়িককালের
ধর্মীয় নেতারা খলিফার রোষানল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একে একে খলিফার
দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিই সমর্থন দিতে শুরু করেন; কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে
হাম্বল (রহ.) মুতাজিলা মতবাদকে ভ্রান্ত বলে তা মানতে অস্বীকার করেন এবং এ জন্য
নির্মম নির্যাতন ও কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন। পবিত্র কোরআন ‘সৃষ্টি’ এ সম্পর্কে
মুতাজিলা মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা আব্বাসীয় খলিফা মামুন-অর-রশীদ তাঁর
বিরোধিতাকারী ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে তলব করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি মুতাজিলা মতবাদ
গ্রহণ করেছেন কি না। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর
দিলেন, ‘না, পবিত্র কোরআন হচ্ছে
মহান আল্লাহর বাণী, কী করে কোরআনকে সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা
করা সম্ভব?’ মামুন-অর-রশীদ ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে কারাগারে
পাঠান।
খলিফা
মামুন-অর-রশীদ ইন্তেকাল করলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন খলিফা আল মুতাসিম। তিনিও ইমাম
সাহেবকে কারাগার থেকে বের করে এনে পবিত্র কোরআনের সৃষ্টি সম্পর্কে মুতাজিলা
মতবাদকে স্বীকার করেন কি না তা জানতে চান। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তখনো এ
ভ্রান্ত মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন।
খলিফা
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর সঙ্গে যুক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করলেন। কিছু
ধর্মীয় নেতাও খলিফার যুক্তি সমর্থন করে বিভিন্ন দলিল পেশ করলেন। কিন্তু ইমাম সাহেব
প্রতিটি কথার দাঁতভাঙা জবাব দিলেন। তাঁর যুক্তি এবং অকাট্য সব দলিল দরবারি আলেমদের
মুখে পেরেক ঠুকে দিচ্ছিল। অসহায়ের মতো এ ওর দিকে তাকাচ্ছিলেন।
ইমামের
এই আক্রমণাত্মক চেহারা দেখে মুতাজিলাদের সবচেয়ে কুটিল পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রী
আবু দাউদ মুতাসিমকে উত্তেজিত করার জন্য বললেন ’আমিরুল মুমিনিন, এই লোকটি পথভ্রষ্ট আর অন্যকেও সে ভ্রষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
আপনার সামনেই বসে আছেন আপনার রাষ্ট্রীয় ফকিহ্ ও বিচারকরা। আপনি এঁদের কাছেই
জিজ্ঞেস করুন, দেখুন তাঁরা কী বলেন?’ তাঁরা যা বলবেন তা তো পরিষ্কার! তাঁরা সবাই একবাক্যে ইমাম আহমদ ইবনে
হাম্বল (রহ.)-কেই গুমরাহ্ ও পথভ্রষ্ট বলে ফতোয়া দিলেন; কিন্তু
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানালেন।
খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ বললেন, ‘আহমাদ! তুমি আমার এই মত
গ্রহণ করো, আমি তোমাকে আমার দরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে
বসিয়ে দেব; তখন তুমি এমন লোকদের সঙ্গে ওঠাবসা করবে,
যারা এই দামি কার্পেটের ওপর হাঁটতে পেরে গর্ব বোধ করে।’ ইমাম
সাহেব বললেন_’বেশ, আমি অত্যন্ত
আনন্দের সঙ্গে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম, কিন্তু
আল্লাহর কিতাব এবং রাসুল (সা.)-এর হাদিস থেকে আপনাকে সমর্থনের দলিল দিতে হবে।’
অবস্থা বেগতিক দেখে মুতাজিলারা ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁরা ভাবলেন, না জানি খলিফাই তাঁর মত পাল্টে ফেলেন। তখন সবাই একসঙ্গে হৈচৈ করে বলে উঠলেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! এই লোকটি কাফের, পথভ্রষ্ট; এ সবাইকে ভ্রষ্ট করে দেবে।’ এদের মধ্যে একজন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! লোকটিকে আপনি ছেড়ে দেবেন না! ওকে কঠিন শাস্তি দিন।’ মুতাসিম ইমামকে জনসমক্ষে ৭০ ঘা বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে মুতাজিলারা ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁরা ভাবলেন, না জানি খলিফাই তাঁর মত পাল্টে ফেলেন। তখন সবাই একসঙ্গে হৈচৈ করে বলে উঠলেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! এই লোকটি কাফের, পথভ্রষ্ট; এ সবাইকে ভ্রষ্ট করে দেবে।’ এদের মধ্যে একজন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! লোকটিকে আপনি ছেড়ে দেবেন না! ওকে কঠিন শাস্তি দিন।’ মুতাসিম ইমামকে জনসমক্ষে ৭০ ঘা বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলেন।
এই
নৃশংস ঘটনার ব্যাপারে ইমামের নিজের বর্ণনা এ রকম_যখন প্রথম আঘাত
করল আমি বললাম, ‘বিসমিল্লাহ’। ‘লা হাওলা ওয়ালা কুউয়াতা
ইল্লা বিল্লাহ’। ‘আল কুরআন কালামুল্লাহ গাইরা মাখলুক’। ‘কুল লান ইউছিবুনা ইল্লা মা
কাতাবাল্লাহু লানা ! দেখ, কেমন লাগে তার মজা।’ এরপর
কতক্ষণ মেরেছে আমি জানি না। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরই আমার
জ্ঞান ফিরে এলে দেখলাম আর মারছে না।
মুতাসিম
চিৎকার করে বললেন, ‘এখনো আমার কথা মেনে নাও, আমি তোমাকে ছেড়ে দেব।’ ওর এ কথার জবাব আমার কাছে ছিল না। আমি চুপ করে
থাকলাম। জল্লাদ চিৎকার করে বলছে, ‘খলিফার কথা শুনতে পাচ্ছ
না! তাঁর কথা মানছ না!’ সে পাগলের মতো এ কথা বলছে আর ওর গায়ের যত শক্তি আছে সব
একত্র করে মারছে। মুতাসিম হাতের ইশারা করলে থামে। তখন সে জিজ্ঞেস করে, ‘কি আহমদ, এখনো আমার কথা শোনো, আমি তোমাকে ছেড়ে দেব।’ কিন্তু আমার কোনো কথা নেই। এভাবে বেশ কয়েকবার
সে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে এবং তার জল্লাদ আমার মুখ
দিয়ে কিছুই বের করতে পারেনি।
আঘাতের
ফলে ইমামের শরীর থেকে স্রোতের মতো রক্ত ঝরছিল, তিনি জ্ঞান হারালেন।
খলিফা তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। দুই বছর পর তাঁকে কারাগার থেকে
মুক্তি দেওয়া হয়। তারপর ইমাম সাহেবকে তাঁর বাড়িতে পেঁৗছে দেওয়ার আদেশ দেওয়া
হয়েছিল। সেদিনের এই ঘটনার পর থেকে মুতাসিম আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি।
তীব্র অনুশোচনা আর বিচিত্র দুঃস্বপ্নে তিনি প্রায় অর্ধ-উন্মাদ। বারবার লোক
পাঠিয়ে ইমামের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে ইমাম সুস্থ হয়ে উঠলেন;
কিন্তু দুই হাত ও দুই ঠোঁটে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করতেন। মৃত্যু
পর্যন্ত তাঁর এই সমস্যাটা ছিল। মুতাজিলা ছাড়া অন্য সবাইকে ইমাম ক্ষমা করে
দিয়েছিলেন। (তাবাকাতে শাফেয়িয়াহ্ আল কুবরা)
৭৫
বছর বয়সে ২৪১ হিজরি সনের রবিউল আউয়াল মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁকে বাগদাদে
শহীদদের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। লাখ লাখ শোকাহত মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নেয়।


0 Comments