ঈমান বিশয়ক প্রশ্ন উত্তর-1..2
প্রশ্নঃ
(২৬) ঝাড়-ফুঁক করা কি আল্লাহর উপর (তাওয়াক্কুল) ভরসা করার পরিপন্থী?
উত্তরঃ তাওয়াক্কুল অর্থ
হল কল্যাণ অর্জন এবং অকল্যাণ প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার
সাথে সাথে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখা এবং তাঁর উপর নির্ভর করা। চেষ্টা করা বাদ
দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষের মাঝে সব চেয়ে বেশী আল্লাহর উপর ভরসাকারী কে? তবে উত্তর হবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। তিনি কি ক্ষতি ও অকল্যাণ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতেন না? উত্তর হল হ্যাঁ অবশ্যই করতেন।
তিনি যখন যুদ্ধে বের হতেন, তখন তীর-তরবারীর আঘাত হতে
আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধের পোষাক পরিধান করতেন। উহুদ যুদ্ধের দিন তিনি দু’টি লোহার বর্ম পরে বের হয়েছেন। সম্ভাব্য বিপদাপদ হতে বাঁচার জন্য
প্রস্ততি স্বরূপ এই ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। সুতরাং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
করা আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থী নয়। অসুস্থ মানুষ নিজের উপর ঝাড়-ফুঁক করা বা
অন্যান্য অসুস্থ ভাইদের ঝাড়-ফুঁক করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। হাদীছে প্রমাণিত
আছে যে, নবী(ﷺ) সূরা ফালাক ও নাস পড়ে নিজের
উপর এবং সাহাবীদের উপর ফুঁক দিতেন।
উত্তরঃ তাবীজ ব্যবহার
দু’ধরণের হতে
পারে।
প্রথমতঃ
কুরআনের আয়াত লিখে তাবীজে ভর্তি করে ব্যবহার করা। কুরআনের আয়াত লিখে তাবীজ ব্যবহার
নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। কুরআন পড়ে
রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করা নবী(ﷺ) থেকে প্রমাণিত আছে।
দ্বিতীয়তঃ
কুরআন ছাড়া এমন কিছু লিখে গলায় ঝুলিয়ে রাখা, যার অর্থ বোধগম্য নয়। এধরণের কিছু ব্যবহার করা কোন
ক্রমেই বৈধ নয়। কেননা সে লিখিত বস্তর অর্থ অবগত নয়। কিছু কবিরাজ রয়েছে, যারা অস্পষ্ট এবং দূর্বোধ্য ভাষায় লিখে থাকে। যা আপনার পক্ষে বুঝা বা
পাঠ করা সম্ভব নয়। এধরণের তাবীজ লিখা ও ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম এবং শির্ক।
প্রশ্নঃ (২৮) পানাহারের পাত্রে চিকিৎসা স্বরূপ আয়াতুল কুরসী বা কুরআনের
অন্য কোন আয়াত লিখে রাখা জায়েয আছে কি?
উত্তরঃ জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর কিতাবকে এত নিম্নস্তরে
নামিয়ে আনা কোন ক্রমেই জায়েয নয়। একজন মুমিন ব্যক্তি কুরআনের সব চেয়ে মহান আয়াতটি
কিভাবে পানাহারের পাত্রে লিখে রাখতে পারে? যা ঘরের ভিতরে
ফেলে রাখা হয়, শিশুরা তা নিয়ে খেলা-ধুলা করে থাকে। সুতরাং
এই কাজটি বৈধ নয়। যার ঘরে পানাহারের পাত্রে এরকম কিছু লেখা আছে, তার উচিৎ এই আয়াতগুলো মুছে ফেলা। কারণ এইভাবে কুরআনের আয়াত লিখে
চিকিৎসা করার কথা সালাফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত নয়।
কোন প্রকার পরিবর্তন, অস্বীকার
কিংবা দৃষ্টান্ত পেশ করা ছাড়াই আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে বিশ্বাস স্থাপন করা
প্রশ্নঃ
(২৯) কোন কোন ইসলামী দেশে মাদরাসার ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের
মাযহাব হল কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্দ্ধন, অস্বীকার কিংবা দৃষ্টান্ত পেশ করা ছাড়াই আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে
বিশ্বাস স্থাপন করা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের লোকেরা জ্ঞানার্জনের মাদরাসাকে
ইবনে তাইমিয়া ও তার ছাত্রদের মাদরাসা এবং আশআরীদের মাদরাসা, এই দুই ভাগে বিভক্ত করে থাকে। এই ভাবে বিভক্ত করা কি সঠিক? যে সমস্ত আলেমরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অপব্যাখ্যা করে থাকে, তাদের ব্যাপারে একজন মুসলিমের অবস্থান কি রকম হওয়া দরকার?
উত্তরঃ যে ছাত্ররা এই
শিক্ষা গ্রহণ করে যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাযহাব হল কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্দ্ধন, অস্বীকার কিংবা দৃষ্টান্ত পেশ করা
ছাড়াই আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে বিশ্বাস স্থাপন করা। প্রকৃত পক্ষে এটিই আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতি। এই মাযহাব তাদের কিতাবগুলোতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত
হয়েছে। আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাত অনুযায়ী এই
মাযহাবই সত্য। সালাফে সালেহীনের বক্তব্যও তাই। সুস্থ বিবেক এই মাযহাবকেই সমর্থন
করে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের
লোকেরা জ্ঞানার্জনের মাদরাসাকে দু’ভাগে ভাগ করে থাকেন।
একটি আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর ছাত্রদের মাদরাসা এবং অন্যটি আশআরী ও
মাতুরিদীয়াদের মাদরাসা। ইবনে তাইমিয়ার মাদরাসার ছাত্রগণ কুরআন ও সুন্নাহর
বক্তব্যকে তার বাহ্যিক অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থ গ্রহণ করার বিরোধীতা করেন। আর
আশআরী ও মাতুরিদীয়া ফির্কার লোকেরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীকে অপব্যাখ্যা করে থাকে।
সুতরাং আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর
ক্ষেত্রে উভয় মাদরাসার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের
লোকেরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে যত আয়াত ও হাদীছ এসেছে, কোন প্রকার পরিবর্তন করা ছাড়াই সেগুলোর ক্ষেত্রে ঈমান আনয়ন করে থাকেন।
আর দ্বিতীয় মাদরাসার লোকেরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পন্ন আয়াতগুলোকে তার আসল
অর্থে ব্যবহার না করে অন্য অর্থে ব্যবহার করে থাকে। নিম্নের উদাহরণটির মাধ্যমে উভয়
মাযহাবের মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ(
“বরং তাঁর হাত দু’টি সদা প্রসারিত। তিনি যেভাবে
ইচ্ছা খরচ করেন।” (সূরা মায়িদাঃ ৬৪) ইবলীস যখন আল্লাহর আদেশ
অমান্য করে আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করল তখন আল্লাহ তাকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে
বলেনঃ
)قَالَ يَاإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ(
“আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে আমার দু’টি হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি, তাকে সেজদা করতে
কিসে তোকে বারণ করল?” (সূরা সুয়াদঃ ৭৫) উপরে বর্ণিত দুই মাদরাসার শিক্ষকরা আল্লাহর দুই হাত দ্বারা কি উদ্দেশ্য, তা নিয়ে মতবিরোধ করেছেন। প্রথম
মাদরাসার লোকেরা বলেনঃ আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করতে হবে এবং আল্লাহর ক্ষেত্রে
যেরকম হাত প্রযোজ্য, আল্লাহর জন্য সেরকম হাতই সাব্যস্ত
করতে হবে। আর দ্বিতীয় মাদরাসার ছাত্ররা বলে থাকে, হাতকে
তার আসল অর্থে ব্যবহার করা যাবেনা। তাদের মতে আল্লাহর জন্য প্রকৃত হাত সাব্যস্ত
করা হারাম। তাদের মতে হাতের উদ্দেশ্য হল কুদরাত (শক্তি) অথবা নেয়ামত।
সুতরাং উভয় মাযহাবের ভিতরে এতো
পার্থক্য থাকা সত্বেও মাযহাব দু’টিকে একই কাতারে শামিল
করা যায়না। উক্ত দু’মতের কোন একটিকে বলতে হবে যে, তারা আহলে সুন্নাত বা সুন্নাতে উপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যটিকে তা বলা
যাবেনা। এতদুভয়ের মধ্যে অবশ্যই ইনসাফের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। অতএব,
তাদের মতামতগুলোকে ন্যায়ের মানদন্ডে মেপে দেখা কর্তব্য। আর সে
ন্যায়ের মানদন্ডটি হল আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং
সাহাবী, তাবেঈ ও তাদের পূণ্যবান অনুসারী এবং মুসলিমদের
ইমামগণের বক্তব্য। আতএব, উক্ত মানদন্ডের পরিমাপ অনুযায়ী এ
কথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে ইবনে
তাইমিয়া এবং তাঁর ছাত্রদের মাযহাবটি হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। তা আল্লাহর কিতাব ও
রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফে সালেহীনদের মাযহাবের অনুরূপ। পক্ষান্তরে আশআরী
সম্প্রদায়ের মাযহাব কুরআন্তসুন্নাহ এবং সালাফে সালেহীনদের মাযহাবের পরিপন্থী। তারা
বলে থাকেন আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পন্ন আয়াতগুলোকে যদি এমন অর্থের মাধ্যমে তা’বীল (অপব্যাখ্যা) করা হয়, যাতে অন্য কোন
দলীলের বিরোধীতা হবে না, তাহলে কোন অসুবিধা নেই।
আমরা তাদের উত্তরে বলব যে,
কুরআনের কোন শব্দকে বিনা দলীলে প্রকাশ্য অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য
অর্থে ব্যবহার করাই কুরআন্তসুন্নাহর বিরোধীতা করার নামান্তর এবং আল্লাহ সম্পর্কে
বিনা দলীলে কথা বলা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আল্লাহর ব্যাপারে বিনা ইলমে কথা বলা হারাম।
আল্লাহ তায়া,লা বলেনঃ
)قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّي الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ(
“আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র
অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন্ত যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন গুনাহ,
অন্যায়, অত্যাচার, আল্লাহর সাথে এমন বস্তকে অংশীদার করা, তিনি
যার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলাও
হারাম, যে সম্পর্কে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই”। (সূরা আরাফঃ ৩৩) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا(
যে
বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তর এদের
প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৩৬) যারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর
অপব্যাখ্যা করে, তাদের কাছে শরীয়তের কোন জ্ঞান নেই। এমন কি তারা সুস্থ বিবেক সম্পন্নও
নয়।
বলা হয় যে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রঃ) নিম্ন লিখিত তিনটি স্থানে তা’বীল করেছেনঃ (১) নবী (ﷺ) এর হাদীছ “বনী আদমের অন্তর আল্লাহর দুই
আঙ্গুলের মাঝখানে”,(২) হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে
আল্লাহর ডান হাত এবং (৩) আল্লাহর বাণী, ( وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ) তোমরা যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহ তোমাদের
সাথে আছেন। (সূরা হাদীদঃ ৪)
উত্তরে আমরা বলব যে, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল থেকে এধরণের কথা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেন, আবু হামেদ
ইমাম গাজ্জালী আহমাদ বিন হাম্বালের নামে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মাত্র তিনটি স্থানে তা’বীল করেছেন। স্থান
তিনটি হল, “হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত”,
“বনী আদমের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝখানে” এবং “আমি যেন ইয়ামানের দিক থেকে আল্লাহর
নিঃশ্বাস পাচ্ছি”। এধরণের কথা সম্পূর্ণ বানোয়াট।
আর আল্লাহর বাণী, ( وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ) তোমরা যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহ তোমাদের
সাথে আছেন। (সূরা হাদীদঃ ৪) আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) এই
আয়াতটির তা’বীল করেন নি। বরং তিনি আয়াত থেকে সাব্যস্ত কতিপয় অত্যাবশ্যকীয় বিষয়
বর্ণনা করেছেন। তিনি জাহ্মীয়া ফির্কার প্রতিবাদে
আল্লাহর ইলমকে সাব্যস্ত করেছেন। জাহ্মীয়া ফির্কার লোকেরা বলে
আল্লাহ যদি সর্বত্র থাকেন, তাহলে আল্লাহ স্বশরীরে থাকা আবশ্যক হয়। এই জন্যই তারা উক্ত আয়াতের
উল্টা ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা বলি যে, আল্লাহ সাথে আছেন এই
কথার অর্থ হল জ্ঞানের মাধ্যমে সমস্ত মাখলুকাতকে বেষ্টন করে আছেন। এটা নয় যে,
সৃষ্টিকুলের সাথে মিশে আছেন। সাথে থাকার অর্থ স্থানভেদে বিভিন্ন
হয়ে থাকে। এই জন্যই বলা হয়ে থাকে, সে আমাকে দুধের সাথে
পানি পান করিয়েছে, আমি জামাতের সাথেই স্বলাত আদায় করেছি,
তার স্ত্রী তার সাথে আছে।
উপরের উদাহরণ গুলোর প্রথম
উদাহরণে দুধের সাথে পানির সংমিশ্রন বুঝায়। দ্বিতীয় উদাহরণে একে অপরের সাথে মিশে
যাওয়া ব্যতীত একই স্থানে এক সাথে কাজ করা বুঝায় এবং তৃতীয় উদাহরণে সাথে থাকার অর্থ
একই স্থানে বা একই কাজে থাকাকে আবশ্যক করে না। সুতরাং আল্লাহ বান্দার সাথে আছেন্ত
একথার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ বান্দার সাথে মিশে আছেন অথবা
একই স্থানে আছেন। এটা আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ আল্লাহরয়েছেন সমস্ত
মাখলুকাতের উপরে। আল্লাহ আমাদের সাথে থাকার অর্থ এই যে, তিনি
সাত আকাশের উপরে আরশে আযীমে থেকেও শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, রাজত্ব, শ্রবণ,
দেখা এবং পরিচালনার মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টিজীবকে বেষ্টন করে আছেন।
সুতরাং সাথে থাকাকে কোন ব্যাখ্যাকারী যদি জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে, তাহলে আয়াতের দাবী থেকে বের হয়ে আসবে না এবং সে অপব্যাখ্যাকারীও হবে
না। তবে যে ব্যক্তি সাথে থাকাকে একসাথে সর্বস্থানে, সবসময়
বিরাজমান থাকা বুঝবে সে অপব্যাখ্যাকারী হিসাবে গণ্য হবে।
সমস্ত বানী আদমের অন্তর আল্লাহর
দুই আঙ্গুলের মাঝখানে, যেভাবে ইচ্ছা তিনি তা ঘুরান্ত
হাদীছটি মুসলিম শরীফে রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের লোকেরা এই হাদীছের অপ
ব্যাখ্যা করেন নি। তারা আল্লাহর শানে যে ধরণের আঙ্গুল প্রযোজ্য তা সাব্যস্ত করেন।
এ কথার অর্থ এই নয় যে, আমাদের অন্তরগুলো আল্লাহর আঙ্গুলের
সাথে লেগে আছে। মেঘমালা আকাশ এবং যমিনের মাঝখানে থাকে কিন্তু তা আকাশের সাথে মিশে
থাকেনা, যমিনের সাথেও নয়। তাই বানী আদমের অন্তর আল্লাহর
আঙ্গুলের সাথে মিশে থাকা জরুরী নয়।
হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহর
ডান হাত, যে তাতে স্পর্শ করল অথবা চুম্বন করল, সে যেন আল্লাহর হাতে স্পর্শ করল বা চুম্বন করল, এই হাদীছটি সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) মাজমূ ইবনে কাসের উদ্ধৃতি
দিয়ে বলেনঃ এ হাদীছটি নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়; বরং এ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ কথা
হল এটি ইবনে আব্বাসের নিজস্ব উক্তি। উপরোক্ত গ্রন্থে (৪৪/৩) সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত
হয়েছে যে, হাজরে আসওয়াদ আল্লাহর কোন গুণ নয় বা তাঁর ডান
হাতও নয়। যেহেতু বলা হয়েছে “পৃথিবীতে তাঁর ডান হাত”
শুধু ডান হাত বলা হয়নি। সুতরাং পৃথিবীর সাতে সম্পৃক্ত করার কারনে
তার অর্থ সাধারণ অর্থ থেকে আলাদা হবে। তাই হাজরে আসওয়াদকে আল্লাহর ডান হাত বলা
যাবেনা। সুতরাং তাকে তা’বীল বা ব্যাখ্যা করার প্রশ্নই আসে
না।
সহীহ আকীদাহ ও ইলম শিক্ষার
মাদরাসাকে ইবনে তাইমিয়ার মাদরাসা হিসাবে ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। কারণ তিনি নতুন কোন
মাদরাসা তৈরী করেন নি। তিনি সালাফে সালেহীনের পথই অনুসরণ করেছেন।
যারা আল্লাহর গুণাবলী সম্বলিত
আয়াতসমূকে ব্যাখ্যা করে, তাদের ব্যাপারে আমরা বলব যে,
তাদের নিয়ত যদি ভাল হয় এবং দ্বীনের প্রতি আনুগত্যশীল বলে জানা
যায়, তবে তাদের অপরাধ ক্ষমা করা হবে। কিন্তু তার কথা যে
সালাফে সালেহীনের মাযহাব বিরোধী তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা তাঁরা সর্বক্ষেত্রে
আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং তার উপর ঈমান এনেছেন। নিয়ত ভাল থাকা সত্বেও
কোন মানুষ যদি ইজতেহাদ করতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তবে তাকে তিরস্কার করা যাবে না। বরং এতে সে ইজতিহাদের ছাওয়াব প্রাপ্ত
হবে। নবী (ﷺ) বলেন,
إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ
“বিচারক যদি ইজতিহাদ করে সঠিক ফায়সালা দেয়, তার
জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে, আর যদি ইজতিহাদ করে ফায়সালা
দিতে গিয়ে ভুল করে, তাহলে তার জন্য একটি পুরস্কার রয়েছে।
কাজেই আকীদার ক্ষেত্রে ইজতিহাদ
করে যারা ভুল করেছেন, তাদেরকে গোমরাহ বলা যাবে না। বিশেষ
করে যখন জানা যাবে যে, তার নিয়ত ভাল ছিল, সে দ্বীনের প্রতি আনুগত্যশীল ছিল এবং সে সুন্নাহর অনুসরণকারী ছিল।
অবশ্য তার মতামতকে গোমরাহী মতামত বলতে কোন অসুবিধা নেই।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামাতের আকীদাহ
প্রশ্নঃ (৩০) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের
আকীদাহ কি? নাম ও
গুণের মধ্যে পার্থক্য কি? আল্লাহর প্রতিটি নাম কি একটি
করে গুণকে আবশ্যক করে? অনুরূপভাবে ছিফাতও কি নামকে আবশ্যক
করে?
উত্তরঃ- আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদাহ হল
আল্লাহ তাআ’লা নিজের জন্য যে সমস্ত নাম ও গুণাবলী
সাব্যস্ত করেছেন, কোন প্রকার পরিবর্তন, অস্বীকার, ধরণ বর্ণনা এবং উপমা পেশ করা ছাড়াই
তার উপর বিশ্বাস করা। নাম ও গুণাবলীর মধ্যে পার্থক্য এই যে, নাম হল আল্লাহ নিজেকে যে নামে নামকরণ করেছেন, এবং
গুণ হল আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন। সুতরাং উভয়ের মধ্যে
পার্থক্য সুস্পষ্ট।
আল্লাহর প্রতিটি নাম একটি করে
গুণকে আবশ্যক করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে,
)إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ(
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়”। এখানে
(গাফুর) আল্লাহর একটি নাম। অর্থঃ ক্ষমাশীল। এই নামটির মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা করা
গুণ প্রমাণিত হয়। অনুরূপ ভাবে (রাহীম) নামটি রাহমত গুণটিকে আবশ্যক করে।
কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা কুরআন মজীদে যেসমস্ত গুণাবলীর উল্লেখ করেছেন, তা থেকে নাম নির্বাচন করা আবশ্যক নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে,
কথা বলা আল্লাহর একটি গুণ। এ থেকে মুতাকাল্লিম (বক্তা) নাম বের
করা বৈধ নয়। সুতরাং নামের তুলনায় গুণ অধিক প্রশস্ত। কারণ প্রতিটি নামই একটি করে
সিফাতকে সাব্যস্ত করে। কিন্তু প্রতিটি ছিফাতের ক্ষেত্রে এমনটি নয়।
উত্তরঃ আল্লাহর নামগুলো
নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত নয়। সহীহ হাদীছে এর দলীল হল,
اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ نَاصِيَتِي بِيَدِكَ مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ
হে
আল্লাহ! আমি আপনার বান্দা এবং আপনার এক বান্দা ও বান্দীর সন্তান। আমার কপাল আপনার
হাতে। আমার ব্যাপারে আপনার হুকুম বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আপনার ফায়সালাই ন্যায়
সম্মত। আপনার প্রতিটি নামের উসীলা দিয়ে আপনার কাছে দু’আ করছি। যে নামের মাধ্যমে আপনি
নিজের নাম কারণ করেছেন বা আপনার কোন সৃষ্টিকে (বান্দাকে) শিক্ষা দিয়েছেন অথবা
আপনার কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন অথবা যে নামগুলোকে আপনি নিজের জ্ঞান ভান্ডারে
সংরক্ষিত করে রেখেছেন।
আর এ কথা শতসিদ্ধ যে, আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারে যে সমস্ত নাম সংরক্ষিত রেখেছেন, তা একমাত্র আল্লহ ছাড়া কেউ জানে না। আর যা অজ্ঞাত তা সীমিত হতে পারে
না।
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلَّا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ
“আল্লাহর এমন নিরানব্বইটি নাম রয়েছে যে ব্যক্তি এগুলো মুখস্ত করবে,
সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে।” হাদীছে
এটা বুঝা যাচ্ছেনা যে, আল্লাহর নাম মাত্র নিরানব্বইটি।
বরং হাদীছের অর্থ এই যে, আল্লাহর নাম সমূহের মধ্যে এমন
নিরানব্বইটি নাম রয়েছে, যা মুখস্ত করলে জান্নাতে যাওয়া
যাবে। এতে বুঝা যায় যে, এই নিরানব্বইটি ব্যতীত আল্লাহর
আরো নাম রয়েছে। এখানে (من أحصاها) বাক্যটি পূর্বের বাক্যের পরিপূরক। নতুন বাক্য নয়। যেমন আরবরা বলে থাকে
আমার এমন একশটি ঘোড়া রয়েছে, যা আমি আল্লাহর রাস্তায়
জিহাদের জন্য প্রস্তত করে রেখেছি। বাক্যটির অর্থ এই নয় যে, তার কাছে ঘোড়ার সংখ্যা মাত্র একশটি। বরং তার কাছে এমন একশটি ঘোড়া আছে,
যা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদের জন্য প্রস্তত রয়েছে। অন্য কাজের জন্য
আরো ঘোড়া থাকতে পারে।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া
(রহঃ) এই মর্মে হাদীছ বিশারদগণের ঐক্যমত বর্ণনা করেছেন যে, নবী (ﷺ) থেকে আল্লাহর নামসমূহের
নির্দিষ্ট সংখ্যার বর্ণনা সহীহ সূত্রে সাব্যস্ত হয়নি। তিনি সত্যই বলেছেন। এর
প্রমাণ উলামাদের এতে বিরাট ধরণের এখতেলাফ বিদ্যমান রয়েছে। কারণ যারা তিরমিযীতে
৯৯টি নাম সম্বলিত হাদীছটিকে সহীহ বলার চেষ্টা করেছেন, তারা বলেন, এ বিষয়টি অত্যন্ত বিরাট। কারণ তা জান্নাতে পৌঁছিয়ে দিবে বলা হয়েছে।
সাহাবীগণ এ বিষয়টি নবী (ﷺ)কে নির্ধারণ করতে বলবেন না-
এটা হতে পারে না। সুতরাং বুঝা গেল যে, আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম নবী (ﷺ) থেকেই নির্ধারিত।
এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে,
এটি আবশ্যক নয়। কারণ নবী (ﷺ) থেকে যদি নির্ধারিত হত, তাহলে পরিস্কারভাবে নামগুলো
জানা থাকত এবং বুখারী-মুসলিম এবং অন্যান্য হাদীছের কিতাবে উল্লেখ থাকত। কারণ এটি
এমন বিষয়, যা বর্ণনা এবং হেফাজত করার প্রয়োজন। সুতরাং
কিভাবে তা সহীহ সূত্রে বর্ণিত না হয়ে দূর্বল এবং পরস্পর বিরোধী সূত্রে বর্ণিত হতে
পারে? নবী (ﷺ) নামগুলো বিশেষ এক উদ্দেশ্যে
বর্ণনা করেন নি। তাহলো মানুষ যেন আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাত হতে খোঁজে বের
করে। এতে করেই সৎকাজের প্রতি কে প্রকৃত আগ্রহী এবং কে আগ্রহী নয়, তা প্রকাশিত হয়ে যাবে।
আল্লাহর নামগুলো শুধু কাগজে
লিখে মুখস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। বরং উদ্দেশ্য হলঃ
১) ভালভাবে নামগুলো মুখস্ত করা।
২) নামগুলোর অর্থ অনুধাবন করা।
৩) নামগুলোর দাবী অনুযায়ী
আল্লাহর ইবাদত করা। আর তা দু’ভাবে হতে পারেঃ
(ক) আল্লাহর নাম সমূহের উসীলা দিয়ে তাঁর নিকট দু’আ করা। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا(
“আল্লাহর অনেক সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, সেই
নামগুলোর উসীলায় তাঁর কাছে দু’আ কর।” (সূরা আরাফঃ ১৮০) আপনি যা কামনা করেন তার সাথে
সাদৃশ্যপূর্ণ একটি নাম নির্বাচন করে সেই নামটি উল্লেখ করে দু’আ করবেন। যেমন ক্ষমা চাওয়ার সময়
আপনি বলবেনঃ
يا غفور اغفر لى
ইয়া
গাফুর! ইগফিরলী। অর্থঃ হে ক্ষমাশীল! আমাকে ক্ষমা করুন। ক্ষমা চাওয়ার সময় এটা বলা
কখনই উপযোগী নয় যে,
يا شديد العقاب اغفرلى
হে
কঠোর শাস্তি দাতা! আমাকে ক্ষমা করুন। এটা এক ধরণের ঠাট্টা করার শামিল। বরং বলতে
হবে, হে কঠোর
শাস্তি দাতা! আমাকে আপনার শাস্তি হতে রেহাই দিন।
২) আপনার এবাদতের মধ্যে এমন
কিছু থাকা চাই, যা আল্লাহর নামগুলোর দাবীকে আবশ্যক করে। রাহীম নামের দাবী হল রহমত করা।
সুতরাং আপনি এমন আ‘মাল করবেন, যা
আল্লাহর রহমত নাযিল হওয়ার কারণ হয়। এটাই আল্লাহর নাম সমূহ মুখস্ত করার অর্থ।
আল্লাহর নামসমূহের দাবীকে আবশ্যক করার মত আ‘মালই জান্নাতে
প্রবেশের মূল্য হতে পারে।
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন উপরে আছেন। এমর্মে একজন নারীর সাক্ষ্যঃ
প্রশ্নঃ (৩২) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে উপরে আছেন, সে ব্যাপারে সালাফদের মাযহাব
কি? যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহ
ছয়টি দিক থেকে মুক্ত এবং যে ব্যক্তি বলে যে, তিনি
প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে আছেন, তার হুকুম কি?
উত্তরঃ সালফদের মাযহাব
এই যে, আল্লাহ
স্বীয় সত্বায় মাখলুকাতের উপরে আছেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا(
“তোমরা যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ করে থাক, তাহলে
বিতর্কিত বিষয়টি আল্লাহ এবং রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং
পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।” (সূরা নিসাঃ ৫৯) আল্লাহ বলেনঃ
)وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ(
“তোমরা যে বিষয়ে মতবিরোধ কর, তার ফায়সালা
আল্লাহর নিকটে।” (সূরা শুরাঃ ১০) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ يُطِعْ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقِيهِ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْفَائِزُونَ(
“মুমিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন
তারা বলেঃ আমরা শুনলাম ও আদেশ মান্য করলাম। মূলতঃ তারাই সফলকাম। এবং যারা আল্লাহ ও
রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর শাস্তি
থেকে বেঁচে থাকে, তারাই কৃতকার্য।” (সূরা নূরঃ ৫১-৫২)আল্লাহ আরো বলেন,
)وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمْ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا(
“আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও
ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার অধিকার নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং
তাঁর রাসূলের বিরোধীতা করবে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে পতিত
হবে।” (সূরা আহযাবঃ ৩৬) আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেন,
)فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا(
“অতএব তোমার পালকর্তার কসম, তারা ঈমানদার হবে
না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে
ন্যায়বিচারক বলে মেনে নেয়। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম
সংকীর্ণতা বোধ না করে এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবূল করে নেবে।” (সূরা নিসাঃ ৬৫) সুতরাং জানা গেল যে, মতভেদের সময় ঈমানদারের পথ হল
আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহর দিকে ফেরত যাওয়া এবং তাদের কথা শ্রবণ করা ও
আনুগত্য করা। সাথে সাথে আল্লাহ এবং রাসূলের কথার বাইরে অন্য কারও কথা গ্রহণ করার
ব্যাপারে নিজের কাছে কোনরূপ স্বাধীনতা না রাখা। এ ছাড়া কেউ ঈমানদার হতে পারবে না।
পরিপূর্ণরূপে নিজেকে কুরআন ও সুন্নাহর কাছে সোপর্দ করতে হবে এবং অন্তর থেকে
সংকীর্ণতা অবশ্যই দূর হতে হবে। এর বিপরীত করলে আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।
আল্লাহ বলেন,
)وَمَنْ يُشَاقِقْ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا(
“হেদায়েতের পথ সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে কেউ রাসূলের বিরোধীতা করবে এবং
ঈমানদারদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলবে, আমি তাকে ঐ দিকেই
ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কতই না
নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থান।” (সূরা নিসাঃ ১১৫)
আল্লাহ তাআ’লা স্বীয় সত্বায় মাখলুকের উপরে থাকার মাসআলাটি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের
সুন্নাহর দিকে ফেরানোর পর তা নিয়ে গবেষণাকারী অবশ্যই জানতে পারবে যে, আল্লাহ তাআ’লা স্বসত্বায় সমস্ত মাখলুকাতের
উপরে আছেন। বিভিন্ন বাক্যের মাধ্যমে কুরআন ও সুন্নায় এই বিষয়টি অতি সুন্দর ও
সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
১) সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আকাশের উপরে আছেন।
আল্লাহ বলেন,
)أَمْ أَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ(
“তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছ যে, যিনি আকাশে আছেন
তিনি তোমাদের উপর প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন না,
অতঃপর তোমরা জানতে পারবে কেমন ছিল আমার সতর্কবাণী।” (সূরা মুলকঃ ১৭)
নবী (ﷺ) রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করার হাদীছে
বলেনঃ
رَبُّنَا اللَّهُ الَّذِي فِي السَّمَاءِ
“আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। যিনি আকাশে আছেন।” তিনি
আরো বলেন,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا مِنْ رَجُلٍ يَدْعُو امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهَا فَتَأْبَى عَلَيْهِ إِلَّا كَانَ الَّذِي فِي السَّمَاءِ سَاخِطًا عَلَيْهَا حَتَّى يَرْضَى عَنْهَا
“ঐ সত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে,
কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে বিছানায় আসার জন্য ডাক দিলে স্ত্রী যদি
বিছানায় যেতে অস্বীকার করে তাহলে যিনি আকাশে আছেন, স্বামী
সন্তুষ্ট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি অসন্তুষ্ট থাকেন।”
২) আল্লাহ উপরে আছেন, এ কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেনঃ
)وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ(
“তিনিই মহা প্রতাপশালী স্বীয় বান্দাদের উপরে আছেন।” (সূরা আনআ’মঃ ১৮) আল্লাহ আরো
বলেনঃ
)يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ(
“তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে চলে। যিনি তাদের উপরে আছেন।” (সূরা নাহলঃ ৫০) নবী (ﷺ) এর বাণী,
لَمَّا قَضَى اللَّهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِي كِتَابِهِ فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِي غَلَبَتْ غَضَبِي
“আল্লাহ তাআ’লা যখন সৃষ্টি সমাপ্ত করলেন,
তখন তিনি একটি কিতাবে লিখে রাখলেন, নিশ্চয়ই
আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ করেছে। কিতাবটি তাঁর নিকটে আরশের উপরে রয়েছে।”
৩) আল্লাহর দিকে বিভিন্ন বিষয়
উঠা এবং তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন জিনিষ অবতীর্ণ হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে। উপরের
দিকে উঠা সব সময় নীচের দিক থেকেই হয়ে থাকে। এমনিভাবে অবতরণ করা সাধারণত উপরের দিক
থেকে নীচের দিকেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ(
“তাঁরই দিকে পবিত্র বাক্যসমূহ উঠে থাকে এবং সৎ আ‘মাল তাকে উপরের দিকে তুলে নেয়।” (সূরা ফাতিরঃ ১০) আল্লাহ বলেনঃ
)تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ(
“ফেরেশতাগণ এবং রূহ আল্লাহ তাআ’লার দিকে
উর্ধ্বগামী হয়।” (সূরা মা’আরিজঃ ৪) আল্লাহ বলেনঃ
)يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنْ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ(
“তিনি আকাশে থেকেই জমিনে সকল কর্ম পরিচালনা করেন।” (সূরা সেজদাঃ ৫) আল্লাহর বাণী,
)لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ(
“এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই
এবং পেছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময় প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।” (সূরা ফুচ্ছিলাতঃ ৪২) আল্লাহ বলেনঃ
)وَإِنْ أَحَدٌ مِنْ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ(
“আর মুশরেকদের কেউ যদি তোমার
কাছে আশ্রয় চায়, তবে তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে যাতে
আল্লাহর কালাম শুনতে পায়।” (সূরা তাওবাঃ ৬) কুরআন) যেহেতু আল্লাহর কালাম
এবং তা আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে তাই এর দ্বারা আমরা জানতে পারলাম যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয়
সত্বায় উপরে রয়েছেন। নবী (ﷺ) বলেনঃ
يَتَنَزَّلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ
“আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তাআ’লা প্রতিদিন
রাত্রের একতৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন কে আছে
আমার কাছে দু’আ করবে? আমি তার দু’আ কবূল করব। কে আছে আমার কাছে চাইবে? আমি তাকে
প্রদান করবো। কে আছে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে? আমি
তাকে ক্ষমা করার জন্য প্রস্তত আছি।” বারা বিন আযিব h এর হাদীছে আছে, নবী (ﷺ) তাকে বিছানায় শয়নকালে পাঠ
করার দু’আ শিক্ষা
দিয়েছেন। সেই দু’আর মধ্যে এটাও আছে,
آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ وَبِنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ فَإِنْ مُتَّ مُتَّ عَلَى الْفِطْرَةِ
“আমি আপনার অবতারিত কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি। এবং আপনার প্রেরিত
নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। এই দু’আ পাঠ করার পর যদি
তুমি মৃত্যু বরণ কর, তাহলে তুমি ফিতরাতের (ইসলামের) উপর
মৃত্যু বরণ করবে।”
৪) আল্লাহ তাআ’লা উপরে হওয়ার গুণে নিজেকে
গুণাম্বিত করা। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)سَبِّحْ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى(
“আপনি আপনার সর্বোচ্চ ও সর্বমহান পালনকর্তার নামের পবিত্রতা বর্ণনা
করুন।” (সূরা আল-আলাঃ ১) আল্লাহ বলেনঃ
)وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ(
“সেগুলোকে (ভূমন্ডল ও নভমন্ডলকে) সংরক্ষণ করা তাঁকে পরিশ্রান্ত করেনা।
তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।” (সূরা বাকারাঃ ২৫৫) নবী (ﷺ) এর বাণী,
سبحان ربي الأعلى
“আমি পবিত্রতা বর্ণনা করছি আমার সুমহান প্রভুর।”
৪) নবী (ﷺ) আরাফার মাঠে ভাষণ দেয়ার সময়
আল্লাহকে স্বাক্ষী রেখে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীদেরকে
লক্ষ্য করে বলেছেন, ((ألا هل بلغت؟ আমি কি তোমাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়েছি? উপস্থিত জনতা এক বাক্যে স্বীকার করল, হ্যাঁ আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তখন নবী (ﷺ) বললেন, (أللهم اشهد) হে আল্লাহ! আপনি স্বাক্ষী থাকুন। এ কথা বলতে বলতে তিনি উপরের দিকে
আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করতে লাগলেন এবং মানুষের দিকে তা নামাতে লাগলেন। এ হাদীছটি
মুসলিম শরীফে যাবের h থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীছটিতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ আকাশে। তা নাহলে নবী (ﷺ) এর উপরের দিকে হাত উঠিয়ে
ইশারা করা অনর্থক বলে সাব্যস্ত হবে।
৬) নবী (ﷺ) জনৈক দাসীকে প্রশ্ন করেছেন, আল্লাহ কোথায়? দাসী বলল, আকাশে। এ কথা শুনে নবী (ﷺ) বললেন,
أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ
“তাকে মুক্ত করে দাও। কেননা সে ঈমানদার।” হাদীছটি
মুসলিম শরীফে বর্ণিত মুআবীয়া বিন হাকাম আস্সুলামী h এর দীর্ঘ হাদীছের অংশ বিশেষ। এটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় সত্বায় উপরে
হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল। কেননা (أين) শব্দটি দিয়ে কোন বস্তর অবস্থান সম্পর্কেই
জিজ্ঞাসা করা হয়ে থাকে। নবী (ﷺ) যখন মহিলাটিকে আল্লাহ কোথায়-
এ কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন মহিলাটি বললঃ তিনি আকাশে। নবী (ﷺ) তার এ কথাকে মেনে নিলেন এবং
বললেনঃ এটাই ঈমানের পরিচয়। তাকে মুক্ত করে দাও। কারণ সে ঈমানদার। সুতরাং যতক্ষণ
কোন মানুষ আল্লাহ উপরে হওয়ার বিশ্বাস না করবে এবং এ কথার ঘোষণা না দিবে ততক্ষণ সে
ঈমানদার হতে পারবে না।
আল্লাহ তাআ’লা স্বীয় সত্বায় মাখলুকের উপরে হওয়ার ব্যাপারে কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে
উপরোক্ত দলীলগুলো উল্লেখ করা হল। এ ব্যাপারে আরো দলীল রয়েছে। যা এখানে উল্লেখ করা
সম্ভব নয়। এ সমস্ত দলীলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে সালাফে সালেহীন এ ব্যাপারে একমত
হয়েছেন যে, আল্লাহ স্বীয় সত্বায় মাখলুকের উপরে রয়েছেন।
এমনিভাবে তারা আল্লাহর গুণাবলী সুউচ্চ হওয়ার উপরও একমত হয়েছেন।
)وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ(
“আকাশ ও জমিনে সর্বোচ্চ মর্যদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা রুমঃ ২৭)
)وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا(
“আল্লাহর রয়েছে উত্তম নামসমূহ। কাজেই সেই নামসমূহ ধরেই (অসীলায়) তাঁকে
ডাক।” (সূরা আ’রাফঃ ১৮০)
)فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ(
“তোমরা আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অবগত আছেন
আর তোমরা অবগত নও।” (সূরা নাহলঃ ৭৪)
)فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ(
“তোমরা জেনে বুঝে আল্লাহর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করোনা।” (সূরা বাকারাঃ ২২) এমনিভাবে আরো অনেক আয়াতের মাধ্যমে
আল্লাহর সত্বা, গুণাগুণ এবং কর্মসমূহ পরিপূর্ণ এবং সর্বোচ্চ হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়।
অনুরূপভাবে কুরআন, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী সালাফে সালেহীনের সর্ব সম্মত ঐকমত্য, সুস্থ বিবেক এবং ফিতরাতও আল্লাহ উপরে হওয়ার কথা স্বীকার করে নেয়।
বিবেক এ কথা স্বীকার করে নেয় যে,
উচ্চে হওয়া একটি পরিপূর্ণ ও উত্তম গুণ। অপর পক্ষে উপরে হওয়ার
বিপরীতে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ গুণ। আল্লাহর জন্য সকল পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট সাব্যস্ত। তাই
আল্লাহর জন্য সুউচ্চে হওয়া বিবেক সম্মত। তাই উপরে হওয়াতে ত্রুটিপূর্ণ কোন গুণ
সাব্যস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা বলব যে, উপরে হওয়া
সৃষ্টিজীব দ্বারা বেষ্টিত হওয়াকে আবশ্যক করে না। আর যে ব্যক্তি এরূপ ধারণা করবে,
সে নিছক ধারণা করল এবং বিবেকভ্রষ্ট হিসাবে পরিগণিত হল।
মানুষের স্বভাব জাত ধর্মের
মাধ্যমে আল্লাহ মাখলুকের উপরে প্রমাণিত হয়। মানুষ যখন আল্লাহর কাছে দু’আ করে, তখন অন্তরকে আকাশের দিকে ধাবিত করে। এই
জন্যই মানুষ যখন আল্লাহর কাছে দু’আ করে তখন ফিতরাতের দাবী
অনুযায়ী আকাশের দিকে হাত উত্তোলন করে। একদা হামদানী নামক জনৈক ব্যক্তি ইমাম আবুল
মা‘আলী আল-জুওয়াইনীকে বলল, আপনি
তো আল্লাহ উপরে হওয়াকে অস্বীকার করেন। আপনি আমাকে বলুন, আল্লাহ
যদি উপরে না থাকেন, তা হলে আল্লাহ ভক্ত কোন মানুষ যখনই
আল্লাহর কাছে দু’আ করে, তখন তার
অন্তরকে উপরের দিকে ফেরানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কেন? এ
কথা শুনে জুওয়াইনী মাথায় হাত মারতে মারতে বলতে থাকল হামদানী আমাকে দিশেহারা করে
দিয়েছে! আমাকে হামদানী দিশেহারা করে দিয়েছে!
ঘটনাটি এভাবেই বর্ণিত হয়েছে।
ঘটনার সূত্র সঠিক হোক কিংবা ভুল হোক, তাতে কিছু আসে
যায়না। প্রতিটি ব্যক্তির অনুভূতিও হামদানীর মতই। দু’আ
করার সময় সবাই উপরের দিকে অন্তর ও হাত উঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকে। এ কথা
কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
সহীহ মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা h হতে বর্ণিত আছে, অতঃপর রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ
করেন, যে দীর্ঘ
সফর করে এলোমেলো কেশ ও ধুলামলিন পোষাক নিয়ে অন্তত্য ব্যকুলভাবে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ডাকতে থাকে হে আমার প্রতিপালক! হে রব!! অথচ সে ব্যক্তির
পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পোষাক পরিচ্ছদ হারাম
পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় কি করে তার দু’আ কবূল হতে পারে ? এমনিভাবে স্বলাতে বান্দা
তার অন্তরকে আকাশের দিকে ফেরায়। বিশেষ করে সে যখন সেজদায় যায় তখন বলে,سبحان ربي الأعلى অর্থঃ আমি পবিত্রতা বর্ণনা করছি আমার সুউচ্চ প্রভুর। যেহেতু সে জানে যে তার
মা’বূদ আকাশে
তাই সে এভাবে বলে থাকে।
যারা আল্লাহ আরশের উপরে হওয়াকে
অস্বীকার করে তারা বলে থাকে, আল্লাহ তাআ’লা ছয়টি দিক থেকে মুক্ত অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা
কোন নির্দিষ্ট দিকে অবস্থান করেন না; বরং তিনি সর্বদিকে
সর্বত্র সদা বিরাজিত। আমরা বলব এ কথাটি একটি বাতিল কথা। কেননা এটা এমন কথা যা
আল্লাহ নিজের জন্য সাব্যস্তকৃত বিষয়কে অস্বীকার করার নামান্তর। আর সৃষ্টিকুলের
মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী নবী (ﷺ) আল্লাহর জন্য যে সমস্ত
গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, তাও বাতিল করার আহবান জানায়। তা এই যে, মহান
আল্লাহ তাআ’লা উপরের দিকে রয়েছেন। আল্লাহ উপরে আছেন এ কথা
অস্বীকার করা হলে আল্লাহকে অস্তিত্বহীন বস্তর সাথে তুলনা করা হয়ে যায়। কেননা দিক
হল ছয়টি। উপর, নীচ, ডান, বাম, পশ্চাৎ এবং সম্মুখ। অস্তিত্ব সম্পন্ন যে
কোন বস্তকে এই ছয়টি জিনিষের সাথে সম্পর্কিত রাখতে হবে। এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে
বিবেক সম্মত ও গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ তাআ’লার ক্ষেত্রে যদি
ছয়টি দিককে সমানভাবে অস্বীকার করা হয়, তা হলে আল্লাহ নাই
এ কথাই আবশ্যক হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ) কোন মানুষের সুস্থ মস্তিষ্ক এই ছয়টি দিকের
বাইরে কোন জিনিষের অস্তিত্বকে সম্ভব মনে করতে পারে কি? কেননা
বাস্তবে আমরা এ ধরণের কোন জিনিষের অস্তিত্ব খোঁজে পাইনি। আমরা দেখতে পাই যে,
প্রতিটি মু’মিন ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে,
আল্লাহ উপরে। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের
সুন্নাত, সালাফে সালেহীনের ইজমা, সুস্থ বিবেক এবং ফিতরাতও তা সমর্থন করে। যেমন আমরা ইতোপূর্বে বর্ণনা
করেছি। আমরা এও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তাআ’লা সকল বস্তকে বেষ্টন করে আছেন, কিন্তু
আল্লাহকে কোন বস্তই পরিবেষ্টন করতে পারে না। কোন মু’মিনের
জন্যই এটা বৈধ নয় যে, সে মানুষের কথাকে গ্রহণ করতে গিয়ে
কুরআন্তসুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করবে। সে মানুষটি যত বড়ই হোক না কেন। আমরা ইতি পূর্বে
দলীলগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।
যারা বলে আল্লাহ মু’মিন ব্যক্তির অন্তরে আছেন, তাদের কথার পক্ষে
আমাদের জানামতে কুরআন, সুন্নাহ কিংবা সালাফে সালেহীনের
কোন উক্তি পাওয়া যায় না। কথাটির অর্থ যদি এই হয় যে, আল্লাহ
বান্দার অন্তরে অবতীর্ণ হয়ে আছেন, তাহলে কথাটি সম্পূর্ণ
মিথ্যা ও বানোওয়াট । আল্লাহ তাআ’লা এ থেকে অনেক পবিত্র।
বড় আশ্চর্যের কথা এই যে, কিভাবে একজন মানুষ
কুরআন্তসুন্নাহর ভাষ্য মতে আল্লাহ তাআ’লা আকাশে হওয়াকে
প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহ তাআ’লা মু’মিনের অন্তরে থাকেন একথা মেনে নিতে পারে?! অথচ
এর পক্ষে কুরআন্তসুন্নাহর একটি দলীলও মিলে না।
আল্লাহ মু’মিন বান্দার অন্তরে আছেন্ত এ কথার অর্থ যদি এই হয় যে, মু’মিন ব্যক্তি সদা-সর্বদা অন্তরে আল্লাহকে
স্মরণ করে, তাহলে এ কথা সত্য। তবে বাক্যটি পরিবর্তন করা
দরকার, যাতে বাতিল অর্থের সম্ভাবনা দূর হয়ে যায়। এভাবে
বলা উচিৎ যে, মু’মিন বান্দার
অন্তরে সবসময় আল্লাহর যিকর বিদ্যমান রয়েছে। তবে যারা এ কথা বলে তাদের কথা থেকে
পরিস্কার বুঝা যায় যে, তাদের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ আকাশে
আছেন একথাকে অস্বীকার করা এবং মু’মিনের অন্তরে আল্লাহর
অবস্থানকে সাব্যস্ত করা। অথচ এটা বাতিল।
সুতরাং আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফে সালেহীনের ইজমা বাদ দিয়ে এমন বাক্য ব্যবহার
থেকে সাবধান থাকা উচিৎ, যা সত্য-মিথ্যা উভয়েরই সম্ভাবনা
রাখে। মুমিনদের উচিৎ প্রথম যুগের আনসার-মুহাজির সাহাবীদের পথ অনুসরণ করা। তবেই
তারা আল্লাহর সন'ষ্টি অর্জনে সক্ষম হবেন। আল্লাহ বলেন,
)وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ(
“আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে অগ্রগামী এবং যারা তাদের
অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং
তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তাদের জন্য প্রস্তত রেখেছেন এমন জান্নাত,
যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা থাকবে
চিরকাল। এটাই হল মহান সফলতা।” (সূরা তাওবাঃ ১০০)
আল্লাহ আমাদেরকে এবং আপনাদেরকে
তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর রহমত দান করুন। তিনিই মহান
দাতা।
প্রশ্নঃ
(৩৩) আল্লাহ তাআ’লার শানে যেভাবে প্রযোজ্য, তিনি সেভাবেই আরশের
উপরে আছেন এটাই কি সালাফে সালেহীনের ব্যাখ্যা?
উত্তরঃ আল্লাহর ক্ষমতা
ও মর্যাদা অনুযায়ী যেভাবে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া শোভা পায়, তিনি সেভাবেই আরশের উপর
প্রতিষ্ঠিত।
মুফাস্সিরগণের ইমাম আল্লামা
ইবনে জারীর বলেন, ইসতিওয়া অর্থ হল সমুন্নত হওয়া, উপরে হওয়া। আল্লাহর বাণী,
)الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى(
এর
অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন যে, “আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত।” এই
অর্থ ব্যতীত সালাফে সালেহীন হতে অন্য কোন অর্থ বর্ণিত হয়নি। তদুপরি ইসতিওয়া শব্দটি
ভাষাগত দিক থেকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে।
১) অন্য কোন শব্দের সাথে যুক্ত
না হয়ে এককভাবে ব্যবহার হলে অর্থ হবে, পরিপূর্ণ হওয়া। আল্লাহ বলেনঃ
)وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَى(
“যখন তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক হলেন এবং পরিপূর্ণতায় পৌঁছলেন।” (সূরা ক্বাছাছঃ ১৪)
২) ইসতিওয়া শব্দটি আরবী অক্ষর (واو) এর সাথে মিলিত হয়ে ব্যবহার হলে অর্থ হবে সমান
সমান হওয়া, একটি জিনিষ অন্যটির বরাবর হওয়া। যেমন বলা হয় (استوى الماء والعتبة) পানি কাষ্ঠের সমান হয়ে গেছে।
৩) আরবী অব্যয় (إلى) এর সাথে মিলিত হয়ে আসলে অর্থ হবে, ইচ্ছা করা, মনোনিবেশ করা। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
)ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ(
“অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন।” (সূরা বাকারাঃ ২৯)
৪) আরবী অব্যয় (على) এর সাথে মিলিত হয়ে আসলে অর্থ হবে, সমুন্নত হওয়া, উপরে হওয়া। যেমন আল্লাহ বলেন,
)الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى(
“আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত।”
আবার কোন কোন সালাফ বলেন
ইসতিওয়া শব্দটি إلى এবং على এর মধ্যে থেকে যে কোন একটির সাথেই মিলিত হয়ে আসুক না কেন, অর্থের দিক থেকে কোন পার্থক্য
নেই। একটি অন্যটির অর্থে ব্যবহার হয়। তাই উভয় ক্ষেত্রে অর্থ হবে আল্লাহ আরশের উপর
সমুন্নত।
‘আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত’ এ কথাটির
বিস্তারিত ব্যাখ্যা।
প্রশ্নঃ (৩৪) সম্মানিত শায়খ! আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করুন! আপনি বলেছেন, আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত
হওয়া বিশেষ এক ধরণের সমুন্নত হওয়া, যা কেবলমাত্র আল্লাহর
বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে প্রযোজ্য। আমরা কথাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চাই।
উত্তরঃ আমরা বলি যে, আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত
হওয়া একটি বিশেষ ধরণের সমুন্নত হওয়া। যা আল্লাহর বড়ত্ব ও সম্মানের ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য। আল্লাহ সমস্ত মাখলুকের উপরে হওয়ার সাথে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়ার কোন
সম্পর্ক নেই। এই জন্যই এ রকম বলা ঠিক হবে না যে, আল্লাহ
মাখলুকাতের উপর সমুন্নত হলেন অথবা আকাশের উপরে কিংবা জমিনের উপরে। অথচ তিনি সকল
বস্তর উপরে। অন্যান্য মাখলুকাতের ক্ষেত্রে আমরা বলি আল্লাহ তাআ’লা আকাশ-জমিনসহ সকল মাখলুকের উপরে আছেন। আর আরশের ক্ষেত্রে বলব যে,
আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত (مستوي)। সুতরাং ইসতিওয়া (সমুন্নত হওয়া) গুণটি সাধারণভাবে
উপরে হওয়া থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এই জন্যই আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া গুণটি
আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সমপৃক্ত এবং তা আল্লাহর কর্মগত গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। আর
মাখলুকের উপরে হওয়া আল্লাহর সত্বার সাথে সম্পর্কিত গুণ, যা আল্লাহর সত্বা হতে কখনো
বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া দুনিয়ার আকাশে আল্লাহর অবতরণ সংক্রান্ত
হাদীছে এরূপ ব্যাখ্যাই প্রদান করেছেন।
যদি বলা হয় আল্লাহ ছয়দিনে
আকাশ-জমিন সৃষ্টি করার পর আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। তার পূর্বে তিনি আরশের উপরে
ছিলেন না। ইসতিওয়া অর্থ বিশেষ এক ধরণের উপরে হওয়া। তাই কোন বস্ত অন্য বস্তর উপরে
সমুন্নত হওয়ার অর্থ বস্তটি তার উপরে আছে। কিন্তু উপরে থাকলেই সমুন্নত হওয়া জরুরী
নয়। এই জন্যই প্রতিটি উপরের বস্তকে সমুন্নত বলা যায়না। তার বিপরীতে প্রতিটি
সমুন্নত বস্তই অপর বস্তর উপরে বিরাজমান।
আমাদের কথা, আল্লাহর শানে যে ধরণের সমুন্নত হওয়া প্রযোজ্য তিনি সে রকমভাবেই আরশে
আযীমে সমুন্নত- এর অর্থ এই যে, আরশের উপরে আল্লাহর
সমুন্নত হওয়া আল্লাহর অন্যান্য সিফাতের মতই। আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলী আল্লাহর
ক্ষমতা ও বড়ত্ব অনুযায়ী তাঁর সাথে প্রতিষ্ঠিত। আরশের উপরে তাঁর সমুন্নত অন্য কোন
মাখলুকাতের সমুন্নত হওয়ার মত নয়। আল্লাহর সত্বা যেহেতু অন্য কোন সত্বার মত নয়,
তাই তাঁর সিফাতও অন্য কোন সিফাতের মত নয়। আল্লাহ বলেনঃ
)لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ(
“তাঁর অনুরূপ কোন কিছু নেই। তিনি সব কিছু দেখেন এবং শুনেন।” (সূরা শুরাঃ ১১) আল্লাহর সত্বার মত কোন সত্বা
নেই এবং আল্লাহর গুণাবলীর মত কোন গুণাবলীও নেই। একজন বিদ্আতী লোক ইমাম মালেক
(রঃ)কে জিজ্ঞাসা করল যে, আল্লাহ আরশের উপরে কি অবস্থায় সমুন্নত আছেন? উত্তরে
মহামান্য ইমাম বললেন, ‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া
একটি জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়। তার উপরে ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে
এব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিদ্আত।’ পরবর্তী বিদ্যানগণ সকল
সিফাতের ক্ষেত্রে ইমাম মালেক (রঃ) এর এ উক্তিটিকে একটি মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ
করেছেন।
প্রশ্ন
(৩৫) কোন ক্ষেত্রে ইন্শাআল্লাহ বলতে হবে? এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বলতে হবে না?
উত্তরঃ ভবিষ্যতের সাথে
সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে ইন্শাআল্লাহ বলা উত্তম। আল্লাহ বলেনঃ
)وَلا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَلِكَ غَدًا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ (
“কখনই তুমি কোন বিষয়ে বলোনা, আমি ওটা আগামীকাল
করবো। তবে এভাবে বলবে যে, যদি আল্লাহ চান।” (সূরা কাহাফঃ ২৩-২৪) অতীত হয়ে গেছে এমন বিষয়ের
ক্ষেত্রে ইনশাআল্লাহ বলার দরকার নেই। যেমন কোন লোক যদি বলে গত রবিবারে রমাদ্বন মাস
এসেছে ইনশাআল্লাহ। এখানে ইনশাআল্লাহ বলার প্রয়োজন নেই। কারণ তা অতীত হয়ে গেছে।
অনুরূপভাবে ইনশাআল্লাহ আমি কাপড় পরিধান করেছি। এখানেও ইনশাআল্লাহ বলার দরকার নেই।
কারণ কাপড় পরিধান করা শেষ হয়ে গেছে। স্বলাত আদায় করার পর ইনশাআল্লাহ স্বলাত পড়েছি
বলার দরকার নেই। কিন্তু যদি বলে ইনশাআল্লাহ মাকবূল স্বলাত পড়েছি তাহলে কোন অসুবিধা
নেই। কারণ স্বলাত কবূল হল কি না তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা।
উত্তরঃ ইরাদাহ (ইচ্ছা)
দু’প্রকার
১) ইরাদাহ কাওনীয়া (সৃষ্টি গত
ইচ্ছা)
২) ইরাদা শারঈয়া (শরীয়ত গত
ইচ্ছা)
আল্লাহর যে ইচ্ছা সৃষ্টি করার
সাথে সম্পৃক্ত তাই ইরাদাহ কাওনীয়া। আর যে ইচ্ছা ভালবাসার সাথে সম্পৃক্ত তাকে
ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআ’লা কোন জিনিষকে
ভালবেসে যে ইচ্ছা পোষাণ করেন তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। ইরাদাহ শরঈয়ার উদাহরণ হল,
আল্লাহর বাণী
)وَاللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ(
“আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা করেন।” (সূরা নিসাঃ ২৭) এখানে ইচ্ছা করেন অর্থ
ভালবাসেন। এখানে সৃষ্টিগত ইচ্ছা অর্থে ব্যবহার হয়নি; বরং ব্যবহৃত হয়েছে শরীয়তগত ইচ্ছায়। যদি সৃষ্টিগত অর্থে
হত তাহলে সকল মানুষকে ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু তা তো করেন নি। কেননা অধিকাংশ বনী
আদমই কাফির। সুতরাং আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা করেন অর্থ আল্লাহ তোমাদেরকে
ক্ষমা করা পছন্দ করেন। আল্লাহ কোন জিনিষকে ভালবাসার অর্থ এই নয় যে, তা অবশ্যই কার্যকরী হবে। তা কার্যকরী না হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য
রয়েছে।
ইরাদাহ
কাওনীয়া তথা সৃষ্টির সাথে সংলিষ্ট ইচ্ছার দৃষ্টান্ত হল,
)إِنْ كَانَ اللَّهُ يُرِيْدُ أَنْ يُغْوِيَكُمْ(
“যদি আল্লাহই তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন।” (সূরা হুদঃ ৩৪) এখানে যে ইচ্ছার কথা বলা
হয়েছে, তাতে
আল্লাহর ভালবাসা থাকা জরুরী নয়।
যদি
বলা হয় কার্যকরী হওয়া বা না হওয়ার দিক থেকে ইরাদাহ কাওনীয়া এবং ইরাদাহ শরঈয়ার
মধ্যে পার্থক্য কি? উত্তরে আমরা বলব যে, ইরাদাহ কাওনীয়াতে
উদ্দিষ্ট বস্ত অবশ্যই কার্যকরী হবে। আল্লাহ কোন বস্ত সৃষ্টি করতে চাইলে তা অবশ্যই
করবেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئاً أَنْ يَقُوْلَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ(
“আল্লাহর আদেশ তো এমনই যে, তিনি যখন কোন কিছু
সৃষ্টি করতে চান, তখন তিনি বলেন, হয়ে যাও। আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়।” (সূরা ইউনুছঃ ৮২) আর ইরাদা শরঈয়া বাস্তবায়িত
হওয়া আবশ্যক নয়। কখনো তা কার্যকরী হয় আবার কখনো কার্যকরী হয়না। অথচ আল্লাহ তাআ’লা শরীয়তগতভাবে জিনিষটি
বাস্তবায়িত হওয়াকে পছন্দ করেন।
যদি কোন লোক জিজ্ঞাসা করে যে,
আল্লাহ কি পাপ কাজের ইচ্ছা পোষণ করেন? উত্তর
হল সংঘটিত হওয়ার দিক থেকে পাপ কাজও আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। কিন্তু আল্লাহ তা পছন্দ
করেন না এবং ভালবাসেন না। তবে আকাশ-জমিনে যা কিছু হয়, তা
আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়।
উত্তরঃ ইলহাদের
আভিধানিক অর্থ বাঁকা হয়ে যাওয়া বা এক দিকে ঝুকে পড়া। আল্লাহর বাণীঃ
)لِسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَهَذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُبِينٌ(
“যার দিকে তারা ইঙ্গিত করে,
তার ভাষা তো আরবী নয় এবং এ কুরআন পরিস্কার আরবী ভাষায়।” (সূরা নাহলঃ ১০৩) লাহাদ কবর যেহেতু এক পাশ
দিয়ে বাঁকা করে ভিতরের দিকে প্রবেশ করানো থাকে, তাই তাকে লাহাদ বলা হয়। সঠিক বিষয় জানা না থাকলে ইলহাদ
জানা সম্ভব নয়। আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর ক্ষেত্রে সঠিক কথা হল এগুলোকে আমরা আহলে
সুন্নাতদের মূলনীতি অনুযায়ী কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন,
বিকৃতি, বাতিল এবং উপমা-দৃষ্টান্ত
বর্ণনা ছাড়াই আল্লাহর শানে প্রযোজ্য অর্থে ব্যবহার করব। সুতরাং আমরা যখন সঠিক পথ
জানতে পারলাম, তখন তার বিপরীত পথে যাওয়ার নামই ইলহাদ বা
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে বক্রপথ অবলম্বন। আলেমগণ ইলহাদকে কয়েক ভাগে বিভক্ত
করেছেনঃ
১) আল্লাহর কোন নাম বা কোন
গুণকে সরাসরি অস্বীকার করাঃ যেমন জাহেলী যুগের লোকেরা আল্লাহর ‘রাহমান’ নামটি অস্বীকার করত। কিংবা নামটির প্রতি ঈমান আনয়ন করল কিন্তু নামটি যে
গুণের প্রতি প্রমাণ বহণ করে, তা অস্বীকার করল। যেমন কোন
কোন বিদ্আতী বলে থাকে, আল্লাহ দয়াবিহীন দয়ালু, শ্রবণশক্তিহীন শ্রবণকারী।
২) আল্লাহ নিজেকে যে নামে
নামকরণ করেন নি, সে নামে তাঁকে নামকরণ করাঃ এভাবে নাম রাখা ইলহাদ হওয়ার কারণ হল আল্লাহর
নাম সমূহ কুরআন এবং সুন্নাহতে যেভাবে এসেছে সেভাবেই মানতে হবে। কারও পক্ষে জায়েয
নেই যে, নিজ থেকে আল্লাহর নাম রাখবে। কারণ এটি আল্লাহর
ব্যাপারে অজ্ঞতা বশতঃ কথা বলার শামিল। যেমন খৃষ্টানেরা আল্লাহকে পিতা বলে এবং
দার্শনিকরা ক্রিয়াশীল কারণ বলে থাকে।
৩) আল্লাহর নামসমূহকে
সৃষ্টিকুলের গুণাবলীর প্রতি নির্দেশ দানকারী মনে করে উপমা স্বরূপ বিশ্বাস করাও
ইলহাদের অন্তর্ভুক্ত। ইলহাদ হওয়ার কারণ হল, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহর
নাম ও গুণাবলী মানুষের নামের মতই, সে তাকে তার আপন অর্থ
হতে সরিয়ে ফেলল এবং সঠিক অর্থ বর্জন করে অন্য অর্থ গ্রহণ করল। এ রকম করা কুফরী। আল্লাহ
বলেনঃ
)لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ(
“তাঁর অনুরূপ আর কেউ নেই। তিনি সব কিছু জানেন এবং শুনেন।” (সূরা শুরাঃ ১১) আল্লাহ আরো বলেন,
)هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا(
“তাঁর সমকক্ষ কেউ আছে কি?” (সূরা মারইয়ামঃ ৬৫) ইমাম বুখারীর (রঃ) উস্তাদ নাঈম
ইবনে হাম্মাদ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে মাখলুকের সাথে তুলনা করল, সে কুফরী করল। যে ব্যক্তি আল্লাহর কোন গুণকে অস্বীকার করল, সেও কুফরী করল। আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত গুণে গুণাম্বিত করেছেন, তাতে মাখলুকের সাথে কোন তুলনা নেই।
৪) আল্লাহর নাম থেকে মূর্তির
নাম বের করাঃ যেমন ইলাহ থেকে লাত নাম বের করা, আজীজ থেকে উজ্জা এবং মান্নান থেকে মানাত ইত্যাদি। এখানে
ইলহাদ হওয়ার কারণ এই যে, আল্লাহর নামগুলো শুধু তার জন্যই
নির্দিষ্ট। অন্য কোন মাখলুককে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত এবাদতের অংশ প্রদান করার
উদ্দেশ্যে এগুলোর অর্থ স্থানান্তর করা জায়েয নেই।
প্রশ্নঃ
(৩৮) আল্লাহর ‘চেহারা’, আল্লাহর ‘হাত’
এজাতীয় যে সমস্ত বিষয় আল্লাহ নিজের দিকে সম্বন্ধ করেছেন তা কত
প্রকার?
উত্তরঃ আল্লাহ তা’আলা নিজের দিকে যেসমস্ত বিষয়
সম্বন্ধ করেছেন তা তিন প্রকার। যথাঃ (১) স্বয়ং সম্পূর্ণ কোন বস্তকে
আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা। এটি হল সৃষ্টিকে তার স্রষ্টার দিকে সম্পৃক্ত করার
শ্রেণীভুক্ত। এটি কখনো সাধারণ ভঙ্গিতে হয় যেমন আল্লাহ বলেনঃ
)إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ(
“আমার জমিন অতি প্রশস্ত।” (সূরা আনকাবূতঃ ৫৬) কখনো কোন জিনিষের মর্যাদা
বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়। যেমন বলা হয়, بيت الله)) আল্লাহর ঘর, (ناقة الله) আল্লাহর উটনী ইত্যাদি। আল্লাহ বলেনঃ
]وَطَهِّرْ بَيْتِي لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ[
“এবং আমার ঘরকে পবিত্র রেখো তাদের জন্যে যারা তাওয়াফ করে এবং যারা
দাঁড়ায়, রুকূ করে ও সিজদা করে।” (সূরা হাজ্জ- ২৬) আল্লাহ আরো বলেন,
]نَاقَةَ اللَّهِ وَسُقْيَاهَا[
“আল্লাহর উষ্ট্রী ও তাকে পানি পান করাবার বিষয়ে সাবধান হও।” (সূরা শামস্ত ১৩)
(২) অন্যের উপর নির্ভরশীল কোন
বস্তকে আল্লাহর প্রতি সম্বন্ধ করা। সাধারণত সম্বানের জন্যই তাকে আল্লাহর দিকে
সম্বন্ধ করা হয়। আল্লাহ ঈসা (আঃ) এর ব্যাপারে বলেনঃ
)وَرُوحٌ مِنْهُ(
“তিনি আল্লাহর রূহ।” (সূরা নিসাঃ ১৭১) এখানে ঈসা (আঃ)এর সম্মান
বৃদ্ধির জন্য তাঁকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত করা হয়েছে। তিনি আল্লাহর রূহ এর অর্থ
হল, আল্লাহ
যে সমস্ত রূহ সৃষ্টি করেছেন, তাঁর রূহও সে সমস্ত রূহের
অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু এরূহ অন্যান্য রূহের তুলনায় অধিক
মর্যাদা সম্পন্ন। এ নয় যে, আল্লাহর রূহ ঈসা (আঃ) এর রূহের
ভিতরে প্রবেশ করে আছে।
৩) আল্লাহর সিফাতকে আল্লাহর
দিকে সম্পৃক্ত করাঃ কুরআনে ব্যাপকভাবে এ ভঙ্গিতে আল্লাহর সিফাতের বিবরণ এসেছে।
আল্লাহর কোন সিফাতই তাঁর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমনঃوجه الله আল্লাহর চেহারা, يد الله আল্লাহর হাত, قدرة الله আল্লাহর শক্তি বা ক্ষমতা, عزة الله আল্লাহর ইয্যত বা সম্মান।
উত্তরঃ আল্লাহর নাম ও গুণ অস্বীকার
করা দু‘ধরণের হতে
পারেঃ (১) মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে অস্বীকার করা। এটা নিঃসন্দেহে কুফরী।
সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর কোন নামকে অস্বীকার করে অথবা কুরআন ও সুন্নায়
বর্ণিত আল্লাহর কোন গুণকে অস্বীকার করে, যেমন বলল,
আল্লাহর কোন হাত নাই, এধরণের কথা
মুসলিমের ঐক্যমতে সম্পূর্ণ কুফরী। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সংবাদকে মিথ্যা
প্রতিপন্ন করা কুফরী এবং তা ইসলাম থেকে মানুষকে বের করে দেয়। (২) ব্যাখ্যার
মাধ্যমে অস্বীকার করা। তা হল সরাসরি অস্বীকার না করে ব্যাখ্যা করে অস্বীকার করা।
এটি আবার দু‘প্রকার। (ক) ব্যাখ্যাটি আরবী ভাষা অনুপাতে
হওয়া। এটি কুফরী নয়। (খ) আরবী ভাষাতে ব্যাখ্যাটির পক্ষে কোন প্রকার যুক্তি না
থাকা। এটি কুফরীকে আবশ্যক করে। ব্যাখ্যার কোন সুযোগ না থাকলে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী
হিসাবে সাব্যস্ত হবে। যেমন কেউ বলল, প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর
কোন ‘হাত’ নেই। এমনকি ‘নিয়ামত’ কিংবা ‘শক্তি’
অর্থেও নেই। এ রকম বিশ্বাস পোষণকারী কাফের। কেননা সে
সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীকে অস্বীকার করল। আর যদি আল্লাহর বাণী,بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوْطَتَانِ “বরং তাঁর দু’হাত প্রসারিত।” (সূরা মায়িদাঃ ৬৪) এর ব্যাখ্যায় কেউ বলে এখানে
আল্লাহর দু’হাত দ্বারা আকাশ-জমিন উদ্দেশ্য, সে কাফের
হিসাবে গণ্য হবে। কারণ আরবী ভাষাতে এধরণের ব্যাখ্যা ঠিক নয় এবং শরঈ বাস্তবতারও
পরিপন্থী। কিন্তু হাতকে যদি নেয়ামতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে কিংবা শক্তির মাধ্যমে
ব্যাখ্যা করে, তাহলে কাফের হবে না। কারণ ‘হাত’ কখনো কখনো ‘নেয়ামত’
অর্থে ব্যবহার হয়। কিন্তু হাতের প্রকৃত অর্থ পরিত্যাগ করলে
অবশ্যই বিদআতীদের দলভুক্ত হবে।
উত্তরঃ যে ব্যক্তি এই
বিশ্বাস পোষণ করবে যে, আল্লাহর সিফাত তথা গুণাবলী মানুষের গুণাবলীর মতই সে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।
কেননা কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহর গুণাবলী মানুষের গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ
নয়। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ(
“তাঁর অনুরূপ আর কেউ নেই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা শুরাঃ ১১) দু’টি জিনিষের নাম ও গুণ এক হলেই
জিনিষ দু’টি সকল দিক থেকে এক হওয়া জরুরী নয়। এটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। মানুষের মুখমন্ডল আছে। উটেরও মুখমন্ডল আছে। মুখ দু’টি কি একই রকম? কখনই নয়। অনুরূপভাবে উটের হাত
আছে পিপিলিকারও হাত আছে। হাত দু‘টি কি সমান? তাহলে কেন আমরা বলব না যে, আল্লাহর চেহারা
আছে। তা মাখলুকাতের চেহারার অনুরূপ নয়। আল্লাহর হাত আছে। কিন্তু তা মানুষের হাতের
মত নয়। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ(
“তারা যথার্থভাবে আল্লাহর ক্ষমতা ও সম্মান বুঝতে পারেনি। কিয়ামতের দিন
গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর
ডান হাতে।” (সূরা যমারঃ ৬৭) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)يَوْمَ نَطْوِي السَّمَاءَ كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ(
“সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব, যেভাবে গুটানো
হয় লিখিত কাগজপত্র।” (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৪) কোন মাখলুকের কি এধরণের হাত রয়েছে? কখনই নয়। সুতরাং আমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি সৃষ্টিজীবের মত নন। না সত্বায় না গুণাবলীতে। لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ অর্থঃ “তাঁর মত আর কেউ নেই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা শুরাঃ ১১) এই জন্যই আল্লাহর কোন
সিফাতের ধরণ গঠন বা প্রকৃতি অনুসন্ধান করা ঠিক নয়। কিংবা এরকম ধারণা করা ঠিক নয় যে, আল্লাহর গুণসমূহ মানুষের
গুণাবলীর মতই।
প্রশ্নঃ
(৪১) আমরা জানি যে, রাত ভূপৃষ্ঠের উপরে ঘুর্ণায়মান। আর আল্লাহরাতের তিন ভাগের এক ভাগ
অবশিষ্ট থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। এ হিসাবে আল্লাহ তাআ’লা রাতভর দুনিয়ার আকাশেই থাকেন। এর উত্তর কি?
উত্তরঃ আল্লাহ কুরআন মজীদে
নিজেকে যেসমস্ত গুণে গুণাম্বিত করেছেন এবং যেসমস্ত নামে নিজেকে নামকরণ করেছেন তাঁর
উপর ঈমান আনয়ন করা আমাদের উপর ওয়াজিব। এমনিভাবে রাসূল (ﷺ) আল্লাহর যে সমস্ত নাম ও
গুণাবলী বর্ণনা করেছেন কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন অস্বীকৃতি, পরিচয়ের
জন্য ধরণ নির্ধারণ করা বা উপমা পেশ করা ব্যতীত তার উপর ঈমান আনা আবশ্যক। পরিবর্তন
সাধারণতঃ হয়ে থাকে আয়াত ও হাদীছ সমূহে। আর অস্বীকার হয়ে থাকে আকীদার ভিতরে। ধরণ,
পদ্ধতি ও উপমা বর্ণনা করা হয় সিফাত তথা গুণের ভিতরে। সুতরাং
উপরোক্ত চারটি দোষ হতে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পরিস্কার করতে হবে। আল্লাহর নাম ও
গুণাবলীর ক্ষেত্রে কেন, কেমন? এ
ধরণের প্রশ্ন করা যাবে না। এমনিভাবে আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাপারে ধরণ বর্ণনার চিন্তা
করা থেকে মানুষ সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে অনেক বিষয় সহজ
হয়ে যাবে। এটাই ছিল সালাফে সালেহীনের আদর্শ। ইমাম মালেকের (রঃ) কাছে এক লোক এসে
বলল, হে আবু আবদুর রহমান! আল্লাহ তো আরশের উপরে আছেন,
তবে কিভাবে? উত্তরে ইমাম মালেক (রঃ)
বললেন, আরশের উপরে থাকার বিষয়টি জ্ঞাত আছে। কিভাবে আছেন
তা আমাদের জানার বাইরে। এ বিষয়ে ঈমান রাখা ওয়াজিব। আর এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ্আত।
আমার মনে হচ্ছে তুমি একজন বিদ্আতী লোক।
যে ব্যক্তি বলে যেহেতু রাত সারা
পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে আর আল্লাহ তাআ’লা রাতের এক
তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন, তাই আল্লাহ
সারা রাতই এ আকাশে থাকেন। কারণ শেষ তৃতীয়াংশ তো এক স্থান হতে অন্য স্থানে
প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়ে থাকে।
উত্তরে আমরা বলব যে, এই প্রশ্নটি কোন ছাহাবী করেন নি। যদি প্রশ্নটি কোন মুসলিমের অন্তরে
হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল
অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন। আমরা বলব পৃথিবীর কোন অংশে যতক্ষণ রাতের এক তৃতীয়াংশ
থাকবে, ততক্ষণ সেখানে আল্লাহর অবতরণের বিষয়টি নিশ্চিতভাবে
বাস্তবায়িত হবে। রাত শেষ হয়ে গেলে তা শেষ হয়ে যাবে। তবে আল্লাহর অবতরণের ধরণ আমরা
জানিনা। তার সঠিক জ্ঞানও আমাদের কাছে নেই। আর আমরা জানি আল্লাহর মত আর কেউ নেই।
আমাদের উচিৎ হবে আল্লাহর কিতাবের সামনে আত্মসমর্পণ করা এবং এ কথা বলা যে, আমরা শুনলাম এবং ঈমান আনয়ন করলাম ও অনুসরণ করলাম। এটাই আমাদের করণীয়।
প্রশ্নঃ
(৪২) আল্লাহকে দেখার ব্যাপারে সালাফে সালেহীনের অভিমত কি? যারা বলে যে, চর্মচক্ষু দিয়ে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয় বরং আল্লাহকে দেখার অর্থ পরিপূর্ণ
ঈমানের নামান্তর, তাদের হুকুম কি?
উত্তরঃ আল্লাহ তাআ’লা কুরআন মজীদে কিয়ামতের আলোচনা
করতে গিয়ে বলেন,
)وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ(
“সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জল হবে। তারা তাদের পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে
থাকবে।” (সূরা কিয়ামাহঃ ২২-২৩) আয়াতের মধ্যে সুস্পষ্ট দলীল
পাওয়া যায় যে, কিয়ামত দিবসে জান্নাতের মধ্যে আল্লাহকে চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা যাবে। এর
অর্থ এ নয় যে, আল্লাহর সমগ্র সত্বাকে দর্শন করা সম্ভব
হবে।
)وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا(
“তারা তাঁকে জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ব করতে পারে না।” (সূরা ত্বোহাঃ ১১০) জ্ঞানের মাধ্যমে কোন জিনিষকে
আয়ত্ব করার বিষয়টি চোখের মাধ্যমে দেখে আত্ত্ব করার চেয়ে অধিকতর ব্যাপক। যখন
জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে জানা সম্ভব নয় তাহলে প্রমাণিত হচ্ছে যে
চর্মচক্ষু দ্বারা পরিপূর্ণভাবে দর্শন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ (
“দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পারে না, অবশ্য তিনি
দৃষ্টিসমূহকে পেতে পারেন।” (সূরা আনআ’মঃ ১০৩) প্রকৃত পক্ষেই মানুষ
আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখবে। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে তাঁকে বেষ্টন করতে পারবে না। কারণ
আল্লাহ তাআ’লা এর অনেক উর্দ্ধে। এটাই সালাফে সালেহীনের মাযহাব। তাঁরা বিশ্বাস করেন
যে, আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকা বেহেশ্তবাসীর জন্য হবে
সবচেয়ে বড় নেয়ামত। এই জন্যই নবী (ﷺ) দু’আয় বলতেনঃ
)وَأَسْأَلُكَ لَذَّةَ النَّظَرِ إِلَى وَجْهِكَ(
উচ্চারণঃ-
আস্আলুকা লায্যাতান্নাযরি ইলা ওয়াজ্হিকা। অর্থঃ “হে আল্লাহ আমি আপনার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকার
পরিতৃপ্তি প্রার্থনা করছি।” আল্লাহর চেহারার দিকে তাকানোর
স্বাদ খুবই বিরাট। যে ব্যক্তি আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহ লাভ করেছে, সেই কেবলমাত্র তা অনুভব করতে সক্ষম হবে। আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন আমাকে এবং আপনাদেরকে তাঁর দিদার লাভে ধন্য করেন।
যারা ধারণা করে যে, আল্লাহকে চর্মচক্ষু দ্বারা দেখা সম্ভব নয়; বরং
আল্লাহকে দেখার অর্থ পরিপূর্ণভাবে অন্তর দিয়ে আল্লাহকে বিশ্বাস করার নামান্তর,
তাদের কথা বাতিল এবং দলীল বিরোধী। প্রকৃত অবস্থা এই ধারণাকে
মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কারণ অন্তরের পরিপূর্ণ বিশ্বাস দুনিয়াতেই বর্তমান রয়েছে।
নবী (ﷺ) ইহসানের ব্যাখ্যায় বলেনঃ
أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
“ইহসান হল তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ। তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে
বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।” তুমি এমন ঈমান নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন
তুমি আল্লাহকে দেখছ। এটিই পরিপূর্ণ ঈমানের পরিচয়। যে সমস্ত আয়াত ও হাদীছে আল্লাহকে
দেখার কথা আছে, সেগুলোকে অন্তরের বিশ্বাসের মাধ্যমে
ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ ভুল এবং কুরআনের আয়াতকে তার আসল অর্থ হতে পরিবর্তন করার
শামিল। যে ব্যক্তি এ ধরণের ব্যাখ্যা করবে তার প্রতিবাদ করা ওয়াজিব।
0 Comments