তাফসীরঃ ফাতহুল মাজীদ
ইসলামিক এডুকেশন এন্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশন (এই. ই. আর. এফ)
অনুবাদ ও গবেষণা বিভাগ কর্তৃক সংকলিত।ও সম্পাদিত
সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ-আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
সম্পাদনা পরিষদঃ-
প্রফেসর এ.কে.এম শামসুল আলম
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইলিয়াস আলী
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুযযাম্মিল আলী
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ লাকমান হুসেন
অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ফারুক সালাফী |
অধ্যাপক ড. সাইফুল্লাহ আল-মাদানী
শায়খ মুস্তফা বিন বাহারুদ্দীন সালাফী
শায়খ ড. হাফিয় রফিকুল আল-মাদানী
শায়খ মাসউদুল আলম উমরী
শায়খ মুফায়যাল হুসাইন আল-মাদানী
শায়খ মুহাম্মদ ঈসা মিয়া আল-মাদানী
শায়খ মুহাম্মদ ইরফান আলী আব্বাস আল-মাদানী
শায়খ হাবিবুর রহমান আল-মাদানী |
শায়খ হাফিয় আনিসুর রহমান আল-মাদানী |
শায়খ ইব্রাহীম বিন আবদুল হালীম আল-মাদানী
শায়খ আব্দুন নূর আবু সাঈদ আল-মাদানী |
শায়খ মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ খান আল-মাদানী
শায়খ হাফিয় আনিসুর রহমান আল-মাদানী
শায়খ ইব্রাহীম বিন আবদুল হালীম আল-মাদানী
শায়খ আব্দুন নূর আবু সাঈদ আল-মাদানী
শায়খ মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ খান আল-মাদানী
পরিবেশনায়ঃ আল খাইর
পাবলিকেশন্ম, নাজির বাজার, | ঢাকা।
সাম্প্রতিককালে সংকলিত অন্যতম কিছু তাফসীরের মধ্যে তাফসীর ফাতহুল মাজীদ
উল্লেখযোগ্য। এই তাফসীরটি শাইখ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানীর তত্ত্বাবধানে
সংকলন করা হয়েছে।
খণ্ড সংখ্যাঃ ৩
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৫৯৮ (৮২৪ + ৯৬০ + ৮১৪)
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫৫০ (৯০০ + ৮৫০ + ৮০০)
তাফসীর ফাতহুল মাজীদ-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
০১. আরবী আয়াতের পাশাপাশি অতি সহজ - সরল বাংলা অনুবাদ।
০২. জটিল ও কঠিন শব্দার্থ।
০৩. গ্রহণযোগ্য বর্ণনার আলোকে শানে নুযুল।
০৪. কুরআনুল কারীম ও স্বহীহ হাদীছ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থের আলোকে সংক্ষিপ্ত তাফসীর সংকলন।
০৫. স্বহীহ আক্বীদাহ ও শারয়ী বিধানমূলক আয়াতের শিক্ষা।
০৬. কুরআন ও সহীহ হাদীছের আলোকে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সমাধান।
০৭. ভিত্তিহীন প্রচলিত তাফসীর সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
০৮. তাফসীরে ব্যবহৃত আয়াতসমূহ নম্বর ও সূরাসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
০৯. যথাসাধ্য হাদীছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
১০. সাধ্যানুযায়ী স্বহীহ বুখারী, স্বহীহ মুসলিম, সুনান আবূ দাউদ, সুনান তিরমিযি, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা মালিক ও মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থের হাদীসসমূহে মাকতাবাহ শামিলার নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
১১. বাংলাভাষী পাঠকদের সহজ পাঠের জন্য আরবী বিশেষ ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
১২. সর্বোপরি উন্নতমানের কাগজে মুদ্রণ, মজবুত ও আকর্ষণীয় বাইন্ডিং করা হয়েছে।প্রথম খণ্ডে সূরাহ আল ফাতিহাহ থেকে সূরাহ আত তাওবাহ্, দ্বিতীয় খণ্ডে সূরাহ ইউনুস থেকে সূরাহ আল ফাথির এবং তৃতীয় খণ্ডে সূরাহ ইয়াসীন থেকে সূরাহ আন নাসের তাফসীর রয়েছে।
০২. জটিল ও কঠিন শব্দার্থ।
০৩. গ্রহণযোগ্য বর্ণনার আলোকে শানে নুযুল।
০৪. কুরআনুল কারীম ও স্বহীহ হাদীছ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থের আলোকে সংক্ষিপ্ত তাফসীর সংকলন।
০৫. স্বহীহ আক্বীদাহ ও শারয়ী বিধানমূলক আয়াতের শিক্ষা।
০৬. কুরআন ও সহীহ হাদীছের আলোকে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সমাধান।
০৭. ভিত্তিহীন প্রচলিত তাফসীর সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
০৮. তাফসীরে ব্যবহৃত আয়াতসমূহ নম্বর ও সূরাসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
০৯. যথাসাধ্য হাদীছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
১০. সাধ্যানুযায়ী স্বহীহ বুখারী, স্বহীহ মুসলিম, সুনান আবূ দাউদ, সুনান তিরমিযি, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা মালিক ও মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থের হাদীসসমূহে মাকতাবাহ শামিলার নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
১১. বাংলাভাষী পাঠকদের সহজ পাঠের জন্য আরবী বিশেষ ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
১২. সর্বোপরি উন্নতমানের কাগজে মুদ্রণ, মজবুত ও আকর্ষণীয় বাইন্ডিং করা হয়েছে।প্রথম খণ্ডে সূরাহ আল ফাতিহাহ থেকে সূরাহ আত তাওবাহ্, দ্বিতীয় খণ্ডে সূরাহ ইউনুস থেকে সূরাহ আল ফাথির এবং তৃতীয় খণ্ডে সূরাহ ইয়াসীন থেকে সূরাহ আন নাসের তাফসীর রয়েছে।
2:1
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
সুরার নাম- বাকারা,(বকনা- \বাছুর)
2:35
وَ قُلۡنَا یٰۤاٰدَمُ
اسۡکُنۡ اَنۡتَ وَ زَوۡجُکَ الۡجَنَّۃَ وَ کُلَا مِنۡہَا رَغَدًا حَیۡثُ شِئۡتُمَا
۪ وَ لَا تَقۡرَبَا ہٰذِہِ الشَّجَرَۃَ فَتَکُوۡنَا مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۳۵﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৩৫ হতে ৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
2:36
فَاَزَلَّہُمَا
الشَّیۡطٰنُ عَنۡہَا فَاَخۡرَجَہُمَا مِمَّا کَانَا فِیۡہِ ۪ وَ قُلۡنَا
اہۡبِطُوۡا بَعۡضُکُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ ۚ وَ لَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ مُسۡتَقَرٌّ
وَّ مَتَاعٌ اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۳۶﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৩৫ হতে ৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
2:37
فَتَلَقّٰۤی اٰدَمُ مِنۡ
رَّبِّہٖ کَلِمٰتٍ فَتَابَ عَلَیۡہِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ ﴿۳۷﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৩৫ হতে ৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
2:38
قُلۡنَا اہۡبِطُوۡا
مِنۡہَا جَمِیۡعًا ۚ فَاِمَّا یَاۡتِیَنَّکُمۡ مِّنِّیۡ ہُدًی فَمَنۡ تَبِعَ
ہُدَایَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿۳۸﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৩৫ হতে ৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
2:39
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا
وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا
خٰلِدُوۡنَ ﴿٪۳۹﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৩৫ হতে ৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।
2:40
یٰبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ
اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتِیَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ وَ اَوۡفُوۡا بِعَہۡدِیۡۤ
اُوۡفِ بِعَہۡدِکُمۡ ۚ وَ اِیَّایَ فَارۡہَبُوۡنِ ﴿۴۰﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪০ হতে ৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
2:41
وَ اٰمِنُوۡا بِمَاۤ
اَنۡزَلۡتُ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَکُمۡ وَ لَا تَکُوۡنُوۡۤا اَوَّلَ کَافِرٍۭ بِہٖ
۪ وَ لَا تَشۡتَرُوۡا بِاٰیٰتِیۡ ثَمَنًا قَلِیۡلًا ۫ وَّ اِیَّایَ فَاتَّقُوۡنِ ﴿۴۱﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪০ হতে ৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
2:42
وَ لَا تَلۡبِسُوا
الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَ تَکۡتُمُوا الۡحَقَّ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۲﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪০ হতে ৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
2:43
وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ
وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ارۡکَعُوۡا مَعَ الرّٰکِعِیۡنَ ﴿۴۳﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪০ হতে ৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
2:44
اَتَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ
بِالۡبِرِّ وَ تَنۡسَوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَتۡلُوۡنَ الۡکِتٰبَ ؕ
اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۴۴﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৪ নং আয়াতের তাফসীর:
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদের একটি ঘৃণিত আচরণের কথা তিরস্কারের সাথে বলেন: তোমরা নিজেরা মানুষদেরকে সৎ (ঈমান ও কল্যাণকর) কাজ করার নির্দেশ দাও অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে তা ছেড়ে দাও, তোমরা কি তা বুঝ না? এখানে মানুষের বোধশক্তিকে ‘আকল’বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকে তার আকল বা বিবেক প্রথমেই তাকে ভাল কাজ করার প্রতি উৎসাহিত করে এবং খারাপ কাজের প্রতি নিরুৎসাহিত করে।
অতএব যে ব্যক্তি অপরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয় কিন্তু নিজে করে না অথবা অপরকে খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করে কিন্তু সে বিরত থাকে না সে ব্যক্তি বিবেকবান নয়।
আয়াতটি যদিও বানী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে কিন্তু তার বিধান সকলের জন্য প্রযোজ্য। (তাফসীরের সা‘দী, পৃ. ২৯)
যারা মানুষদেরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয় কিন্তু নিজেরা জেনেশুনে তার বিপরীত করে তাদের ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে তিরস্কার ও শাস্তির কথা এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَﭑ کَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللہِ اَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُوْنَﭒ)
“হে মু’মিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা আল্লাহর নিকট অতিশয় অসন্তোষজনক।”(সূরা সফ ৬১:২)
আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: মি‘রাজের রাতে আমি দেখেছি যে, কতকগুলো লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বল হল, এরা আপনার উম্মাতের বক্তা যারা মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ করত এবং নিজেরা করত না। তারা কিতাব পাঠ করত, কিন্তু তারা বুঝত না। (মুসনাদ আহমাদ হা: ১২৮৭৯ হাসান)
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, কিয়ামাতের দিন একটি লোককে আনা হবে। যার নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে এবং তার চারদিকে ঘুরতে থাকবে। অন্যান্য জাহান্নামীরা তাকে বলবে, জনাব আপনিতো আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ করতেন এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করতেন, আপনার এ অবস্থা কেন? সে বলবে, আফসোস! আমি তোমাদেরকে ভাল কথা বলতাম কিন্তু নিজে আমল করতাম না। আমি তোমাদেরকে খারাপ হতে বিরত রাখতাম কিন্তু নিজে বিরত থাকতাম না। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬৭, সহীহ মুসলিম হা: ২২৯০, ২২৯১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অন্যকে ভাল কাজের দিকনির্দেশনা দিয়ে নিজে তা না করা একটি ভয়াবহ অপরাধ।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদের একটি ঘৃণিত আচরণের কথা তিরস্কারের সাথে বলেন: তোমরা নিজেরা মানুষদেরকে সৎ (ঈমান ও কল্যাণকর) কাজ করার নির্দেশ দাও অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে তা ছেড়ে দাও, তোমরা কি তা বুঝ না? এখানে মানুষের বোধশক্তিকে ‘আকল’বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকে তার আকল বা বিবেক প্রথমেই তাকে ভাল কাজ করার প্রতি উৎসাহিত করে এবং খারাপ কাজের প্রতি নিরুৎসাহিত করে।
অতএব যে ব্যক্তি অপরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয় কিন্তু নিজে করে না অথবা অপরকে খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করে কিন্তু সে বিরত থাকে না সে ব্যক্তি বিবেকবান নয়।
আয়াতটি যদিও বানী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে কিন্তু তার বিধান সকলের জন্য প্রযোজ্য। (তাফসীরের সা‘দী, পৃ. ২৯)
যারা মানুষদেরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয় কিন্তু নিজেরা জেনেশুনে তার বিপরীত করে তাদের ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে তিরস্কার ও শাস্তির কথা এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَﭑ کَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللہِ اَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُوْنَﭒ)
“হে মু’মিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা আল্লাহর নিকট অতিশয় অসন্তোষজনক।”(সূরা সফ ৬১:২)
আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: মি‘রাজের রাতে আমি দেখেছি যে, কতকগুলো লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বল হল, এরা আপনার উম্মাতের বক্তা যারা মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ করত এবং নিজেরা করত না। তারা কিতাব পাঠ করত, কিন্তু তারা বুঝত না। (মুসনাদ আহমাদ হা: ১২৮৭৯ হাসান)
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, কিয়ামাতের দিন একটি লোককে আনা হবে। যার নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে এবং তার চারদিকে ঘুরতে থাকবে। অন্যান্য জাহান্নামীরা তাকে বলবে, জনাব আপনিতো আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ করতেন এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করতেন, আপনার এ অবস্থা কেন? সে বলবে, আফসোস! আমি তোমাদেরকে ভাল কথা বলতাম কিন্তু নিজে আমল করতাম না। আমি তোমাদেরকে খারাপ হতে বিরত রাখতাম কিন্তু নিজে বিরত থাকতাম না। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬৭, সহীহ মুসলিম হা: ২২৯০, ২২৯১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অন্যকে ভাল কাজের দিকনির্দেশনা দিয়ে নিজে তা না করা একটি ভয়াবহ অপরাধ।
2:45
وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا
بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ وَ اِنَّہَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ
﴿ۙ۴۵﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৫ হতে ৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
2:46
الَّذِیۡنَ یَظُنُّوۡنَ
اَنَّہُمۡ مُّلٰقُوۡا رَبِّہِمۡ وَ اَنَّہُمۡ اِلَیۡہِ رٰجِعُوۡنَ ﴿٪۴۶﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৫ হতে ৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
2:47
یٰبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ
اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتِیَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ وَ اَنِّیۡ فَضَّلۡتُکُمۡ
عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۴۷﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৫ হতে ৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
2:48
وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا
لَّا تَجۡزِیۡ نَفۡسٌ عَنۡ نَّفۡسٍ شَیۡئًا وَّ لَا یُقۡبَلُ مِنۡہَا شَفَاعَۃٌ
وَّ لَا یُؤۡخَذُ مِنۡہَا عَدۡلٌ وَّ لَا ہُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ ﴿۴۸﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৫ হতে ৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার ফলাফল কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَا۬ءِ وَالْمُنْكَرِ)
“নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي)
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অবিচলিত থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১৩২)
তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত সালাতে মগ্ন হতেন।
এ সালাত তাদের জন্য সহজ-সাধ্য কাজ যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশী। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না সালাত তাদের জন্য সহজ নয়।
আবার আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এমন দিবসের ভয় করার আদেশ দিচ্ছেন যে দিবসে একে অপরের উপকার করতে পারবে না, কারো কোন সুপারিশ চলবে না এবং কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে কোন প্রকার শাফাআত কবূল করা হবে না। আবার অন্য আয়াত থেকে বুঝা যায় শাফাআত থাকবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৫২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআত চালু থাকবে।
সুতরাং শাফাআত দু’প্রকার:
১. বাতিল শাফাআত: الشفاعة المنفية ২. গ্রহণযোগ্য শাফাআত: الفشاعة الثابتة
বাতিল শাফাআত:
যা কাফির মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত। যে শাফায়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন অনুমতি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَضُرُّھُمْ وَلَا یَنْفَعُھُمْ وَیَقُوْلُوْنَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ شُفَعَا۬ؤُنَا عِنْدَ اللہِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ‘ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।”(সূরা ইউসুফ ১০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي)
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়।”(সূরা যুমার ৩৯:৩)
এ সকল শাফাআত বাতিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। তিনি বলেন:
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ
“ফলে (সে সময়) শাফাআতকারীদের শাফাআত তাদের (অমুসলিমদের) কোন কাজে আসবে না।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৪৮)
গ্রহণযোগ্য শাফাআত: এর জন্য তিনটি শর্ত। যথা:
১. শাফাআতকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَئِذٍ لَّا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَھُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِیَ لَھ۫ قَوْلًا)
“দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না।”(সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৯)
২. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَکَمْ مِّنْ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِیْ شَفَاعَتُھُمْ شَیْئًا اِلَّا مِنْۭ بَعْدِ اَنْ یَّاْذَنَ اللہُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَرْضٰی
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”(সূরা নাজম ৫৩:২৬)
৩. শাফাআত করার অনুমতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَه۫ إِلَّا بِإِذْنِه۪
“কে সে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া।”(সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
এসব শর্তসাপেক্ষে শাফাআত করা যাবে এবং পাওয়া যাবে। সুতরাং যে সব নামধারী মুসলিম শাফাআত করার ও পাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, সেটা তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়া কিছুই নয়।
আলোচ্য আয়াতে যে শাফাআত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা বাতিল শাফাআত যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ও কঠিন মুহূর্তে সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
২. ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা ওয়াজিব।
৩. কাফির-মুশরিকদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না এবং সেদিন কোন বিনিময় চলবে না। অপরপক্ষে ঈমানদারদের জন্য সুপারিশের ব্যবস্থা থাকবে, তবে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ও সন্তুষ্টি সাপেক্ষে।
2:49
وَ اِذۡ نَجَّیۡنٰکُمۡ
مِّنۡ اٰلِ فِرۡعَوۡنَ یَسُوۡمُوۡنَکُمۡ سُوۡٓءَ الۡعَذَابِ یُذَبِّحُوۡنَ
اَبۡنَآءَکُمۡ وَ یَسۡتَحۡیُوۡنَ نِسَآءَکُمۡ ؕ وَ فِیۡ ذٰلِکُمۡ بَلَآ ءٌ
مِّنۡ رَّبِّکُمۡ عَظِیۡمٌ ﴿۴۹﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:50
وَ اِذۡ فَرَقۡنَا بِکُمُ
الۡبَحۡرَ فَاَنۡجَیۡنٰکُمۡ وَ اَغۡرَقۡنَاۤ اٰلَ فِرۡعَوۡنَ وَ اَنۡتُمۡ
تَنۡظُرُوۡنَ ﴿۵۰﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:51
وَ اِذۡ وٰعَدۡنَا
مُوۡسٰۤی اَرۡبَعِیۡنَ لَیۡلَۃً ثُمَّ اتَّخَذۡتُمُ الۡعِجۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ وَ
اَنۡتُمۡ ظٰلِمُوۡنَ ﴿۵۱﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:52
ثُمَّ عَفَوۡنَا عَنۡکُمۡ
مِّنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِکَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۵۲﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:53
وَ اِذۡ اٰتَیۡنَا
مُوۡسَی الۡکِتٰبَ وَ الۡفُرۡقَانَ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ ﴿۵۳﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:54
وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی
لِقَوۡمِہٖ یٰقَوۡمِ اِنَّکُمۡ ظَلَمۡتُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ بِاتِّخَاذِکُمُ الۡعِجۡلَ
فَتُوۡبُوۡۤا اِلٰی بَارِئِکُمۡ فَاقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ
لَّکُمۡ عِنۡدَ بَارِئِکُمۡ ؕ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ التَّوَّابُ
الرَّحِیۡمُ ﴿۵۴﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:55
وَ اِذۡ قُلۡتُمۡ
یٰمُوۡسٰی لَنۡ نُّؤۡمِنَ لَکَ حَتّٰی نَرَی اللّٰہَ جَہۡرَۃً فَاَخَذَتۡکُمُ
الصّٰعِقَۃُ وَ اَنۡتُمۡ تَنۡظُرُوۡنَ ﴿۵۵﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:56
ثُمَّ بَعَثۡنٰکُمۡ
مِّنۡۢ بَعۡدِ مَوۡتِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۵۶﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:57
وَ ظَلَّلۡنَا عَلَیۡکُمُ
الۡغَمَامَ وَ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمُ الۡمَنَّ وَ السَّلۡوٰی ؕ کُلُوۡا مِنۡ
طَیِّبٰتِ مَا رَزَقۡنٰکُمۡ ؕ وَ مَا ظَلَمُوۡنَا وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا
اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ ﴿۵۷﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, সামূদ, লূত ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ৬ষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এখানে ফির‘আউন জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। এছাড়াও কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এদের আলোচনা রয়েছে। (তারীখুল আম্বিয়া ১/১৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে প্রসিদ্ধ উলূল আযম নাবী মূসা ও বড় ভাই হারুনকে প্রেরণ করেছিলেন। কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত জাতি হল এরা। যেন উম্মতে মুহাম্মাদী ফির‘আউনের জাতির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা ও তাদের পরিণতি দেখে হুশিয়ার হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ এ নাবীর জীবন চরিত ও দাওয়াতী বিবরণে এবং ফির‘আউনের অবাধ্যতায় অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের পেছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শেষ নাবীর ওপর ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিম্নে এদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:
বানী ইসরাঈল, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়া‘কূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাঈল’অর্থ আল্লাহ তা‘আলা দাস। সে হিসেবে ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’বলা হয়।
ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তিন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। এর গোটা অঞ্চলকে বর্তমানে ‘মধ্যপ্রাচ্য’বলা হয়। ইয়া‘কূব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের মন্ত্রী হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিন‘আনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়া‘কূব (আঃ) সপরিবারে মিসরে চলে আসেন ও বসবাস শুরু করেন। ক্রমে সেখানে তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। পরবর্তীতে পুনরায় মিসর ফির‘আউনের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর ৫ম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারুনের সময় নিপীড়ক ফির‘আউন শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার নাম রেমেসীস-২।
মূসা (আঃ) হলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম ‘ইমরান’। তাঁর জন্ম হয় মিসরে আর লালিত-পালিত হন ফির‘আউনের ঘরে। তাঁর জন্ম ও লালন পালন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে বানী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে একটি লাল টিবির দিকে ইশারা করে সে স্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর রয়েছে বলে জানিয়েছেন। (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত হা: ৫৭১৩)
ফির‘আউন কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। কিবতী বংশীয় এ সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিসর শাসন করে। এ সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড, স্ফিংক্র প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে।। মূসা (আঃ)-এর সময়কার পরপর দুজন ফির‘আউন ছিল। সর্বসম্মত ইসরাঈলী বর্ণনাও হল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই যুগ পান। উৎপীড়ক ফির‘আনের নাম ছিল রেমেসিস-২ এবং ডুবে মরা ফির‘আউন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদে তিনি সসৈন্য ডুবে মরেন। যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং আজও তার লাশ মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতগুলো ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন: স্মরণ কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করে ফির‘আউন জঘন্যতম শাস্তি দিত। আমি তোমাদেরকে মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছি। ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো- একদা ফির‘আন স্বপ্নে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিক হতে এক আগুন এসে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে যার হাতে তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে চারদিকে নির্দেশ জারি করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সরকারি লোক দ্বারা যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলবে। আর যদি কন্যা সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দিবে। এ নীতি চালু অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ঐ ফেরআউনের ঘরেই লালিত-পালিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পরিণত বয়সে নবুয়তী পেয়ে ফির‘আউনের এ নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করার পর মূসা (আঃ)-এর সাথে স্বদেশ ত্যাগকালে যখন ফির‘আউন দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পাকড়াও করতে এসেছিল আর তোমরা এমতাবস্থায় সমুদ্রের উপকূলে ছিলে যখন তোমাদের নাজাতের কোন উপায় ছিল না, এমতাবস্থায় আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিলাম আর তোমরা মুক্তি পেলে। সুতরাং এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং তাঁর বিধান মেনে চলা উচিত।
(وَإِذْ وَاعَدْنَا)
‘আর যখন আমি মূসার সঙ্গে চল্লিশ রাত্রির অঙ্গীকার করেছিলাম’এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে তাওরাত দেয়ার জন্য যে ৪০ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন সে নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছেন। প্রথমে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলেন পরে দশ দিন বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَوٰعَدْنَا مُوْسٰی ثَلٰثِیْنَ لَیْلَةً وَّاَتْمَمْنٰھَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِیْقَاتُ رَبِّھ۪ٓ اَرْبَعِیْنَ لَیْلَةً)
“স্মরণ কর, মূসার জন্য আমি ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করি এবং আরও দশ দ্বারা সেটা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৪২)
কিন্তু তারা সময় হওয়ার পূর্বেই ধৈর্যহারা হয়ে গেল। এমনকি মূসা (আঃ) চলে যাবার পর তারা গো-বৎসের পূজা/উপাসনা করতে শুরু করে দিল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর জুলুম করল। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তাওবাহ করার নির্দেশ দিলেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।
অতঃপর মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা গো-বৎসকে তোমাদের মা‘বূদরূপে গ্রহণ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছ। অতএব একজন আরেকজনকে হত্যা করার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবাহ কর। জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার চেয়ে এটা তোমাদের জন্য উত্তম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবাধ্যতার সীমালঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন, যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনল তখন মূসাকে বলল: এগুলো যে আল্লাহ তা‘আলার কথা তা আমরা কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাব। তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে গেলে বজ্রধ্বনি তাদেরকে পাকড়াও করল। যার ফলে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর মূসা (আঃ)-এর দু‘আয় তাদেরকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়া হলো। এভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা করুণা করে তাদের এ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু তারা ছিল বড়ই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি। নিম্নে তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত প্রদান করেছিলেন তা হল:
১. বানী ইসরাঈলের হিদায়াতস্বরূপ মূসা (আঃ)-কে আসমানী কিতাব তাওরাত প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৩)
২. বিভিন্ন জঘন্য অপরাধ করার পরও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫২)
৩. ফির‘আউনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৪৯)
৪. সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫০)
৫. বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা। (সূরা বাকারাহ ২:৬০)
৬. আসমানী খাদ্য মান্না ও সালওয়া প্রদান। (সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত খাদ্য যা একমাত্র বানী ইসরাঈলের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার ছোট পাখি। ইকরামা বলেন: সালওয়া হল এক প্রকার পাখি যা চড়ুই পাখির ন্যায়। বারী বিন আনাস বলেন: মান্না মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করত।
হাদীসে এসেছে, ব্যাঙ-এর ছাতা মান্নার অর্ন্তভুক্ত, তার পানি চক্ষু রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৯) সঠিক কথা হচ্ছে মান্না হল মিষ্টি জাতীয় আর সালওয়া হল পাখির গোশত।
৭. সকল খাদ্য বানী ইসরাঈল এর জন্য হালাল করা। (সূরা আলি-ইমরান ৩:৯৩)
৮. তাদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূলগণের আগমন। যেমন হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلي اللّٰه عليه وسلم إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ إِذَا مَاتَ نَبِيٌّ قَامَ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আবূ হুরাইরাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই বানী ইসরাঈদের মধ্যে নাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এসেছে। যখন কোন নাবী মারা গেছেন তখনই তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অন্য নাবী। আর আমার পরে কোন নাবী নেই। (মুসনাদ আবূ আওয়ানা: ৭১২৮)
৯. স্বাছন্দময় জীবন যাপনের ব্যাবস্থাকরণ।
এ ছাড়াও বানী ইসরাঈলকে আরো অনেক নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে, মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর বিরোধিতা করেছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, রাত-দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার কত নেয়ামত ভোগ করছি, তিনি আমাদের ওপর কত অনুগ্রহ করছেন! কখনো যেন আমরা তাঁর সাথে কুফরী না করি, তাঁর নেয়ামত অস্বীকার না করি। বরং সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করব এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব। আল্লাহ তা‘আল্ াআমাদের তাওফীক দিন। (আমীন)!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এটা জানার জন্য যে, কারা তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে।
৩. বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরোধিতা করে তথা ইসলাম বিদ্রোহী হয় তাদের পরিণতি খুব খারাপ, যেমন মূসা (আঃ)-এর বিরোধী বানী ইসরাঈল জাতির হয়েছিল।
2:58
وَ اِذۡ قُلۡنَا
ادۡخُلُوۡا ہٰذِہِ الۡقَرۡیَۃَ فَکُلُوۡا مِنۡہَا حَیۡثُ شِئۡتُمۡ رَغَدًا وَّ
ادۡخُلُوا الۡبَابَ سُجَّدًا وَّ قُوۡلُوۡا حِطَّۃٌ نَّغۡفِرۡ لَکُمۡ خَطٰیٰکُمۡ ؕ
وَ سَنَزِیۡدُ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۵۸﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৫৮ ও ৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:
(هٰذِهِ الْقَرْيَة)
‘এ নগর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল “বায়তুল মুকাদ্দাস”, এ বিষয়ে যদিও অনেক মতানৈক্য পাওয়া যায় তবে এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১:২২৯)
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ)
“দরজা দিয়ে প্রবেশ কর” এখানে দরজা দ্বারা উদ্দেশ্য বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা, যা বর্তমানে হিত্তার দরজা বলে পরিচিত। বানী ইসরাঈলের ইয়াহূদিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা “আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন” একথা বলে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা দিয়ে সিজদাবনত অবস্থায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অবাধ্যতার বশীভূত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন বানী ইসরাঈলকে বলা হল
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ)
তোমরা সিজদাবনত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তখন তারা তা পরিবর্তন করে জানুর ভরে অর্থাৎ দাম্ভিকভাবে এবং حِطَّةٌ (ক্ষমা প্রার্থনা) এর পরিবর্তে حبة في شعرة (যবের দানা) বলতে বলতে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৯, সহীহ মুসলিম হা: ৩০১৫)
رجز অর্থ শাস্তি, এ শাস্তি কী ছিল সে ব্যাপারে কয়েকটি উক্তি পাওয়া যায়: যেমন আল্লাহ তা‘আলার গযব কঠিন ঠাণ্ডাজনিত কুয়াশা অথবা প্লেগ রোগ। প্লেগ রোগের সমর্থন হাদীসে পাওয়া যায়।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: এ প্লেগ সে আযাব ও শাস্তির অংশ যা তোমাদের পূর্বে কোন জাতির ওপর নাযিল করা হয়েছিল। তোমাদের উপস্থিতিতে কোন স্থানে যদি এ প্লেগ মহামারী দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হবে না এবং কোন স্থানে যদি এ মহামারী হয়েছে বলে শোন তাহলে সেখানে প্রবেশও করবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২১৮)
আল্লাহ তা‘আলার কালাম পরিবর্তন করা ইয়াহূদিদের স্বভাব। যখন আল্লাহ তা‘আলা এক কথা বলতে বললেন তখন তারা সে কথা পরিবর্তন করে অন্য কথা বলল। আমরাও যেন আমাদের ঘৃণ্য স্বার্থ হাসিল করার জন্য অথবা নিজেদের দল ও মত প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস পরিবর্তন না করি। কুরআনে তো কোন পরিবর্তন করা যাবেই না, যথাসম্ভব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস ও তাঁর মুখনিঃসৃত শব্দে বর্ণনা করা উচিত। কারণ জনৈক সাহাবী নাবী শব্দের স্থানে রাসূল বলেছেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নাবী বলার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী হা: ২৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৭১০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. শিক্ষা ও নসিহত প্রদানের লক্ষ্যে পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করা বৈধ।
২. জুলুম, পাপাচার ও শরীয়তের নির্দেশাবলী নিয়ে টালবাহানা করার ভয়াবহ পরিণতি থেকে সতর্ক হওয়া উচিত।
৩. নিজের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন করা হারাম।
(هٰذِهِ الْقَرْيَة)
‘এ নগর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল “বায়তুল মুকাদ্দাস”, এ বিষয়ে যদিও অনেক মতানৈক্য পাওয়া যায় তবে এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১:২২৯)
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ)
“দরজা দিয়ে প্রবেশ কর” এখানে দরজা দ্বারা উদ্দেশ্য বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা, যা বর্তমানে হিত্তার দরজা বলে পরিচিত। বানী ইসরাঈলের ইয়াহূদিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা “আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন” একথা বলে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা দিয়ে সিজদাবনত অবস্থায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অবাধ্যতার বশীভূত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন বানী ইসরাঈলকে বলা হল
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ)
তোমরা সিজদাবনত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তখন তারা তা পরিবর্তন করে জানুর ভরে অর্থাৎ দাম্ভিকভাবে এবং حِطَّةٌ (ক্ষমা প্রার্থনা) এর পরিবর্তে حبة في شعرة (যবের দানা) বলতে বলতে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৯, সহীহ মুসলিম হা: ৩০১৫)
رجز অর্থ শাস্তি, এ শাস্তি কী ছিল সে ব্যাপারে কয়েকটি উক্তি পাওয়া যায়: যেমন আল্লাহ তা‘আলার গযব কঠিন ঠাণ্ডাজনিত কুয়াশা অথবা প্লেগ রোগ। প্লেগ রোগের সমর্থন হাদীসে পাওয়া যায়।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: এ প্লেগ সে আযাব ও শাস্তির অংশ যা তোমাদের পূর্বে কোন জাতির ওপর নাযিল করা হয়েছিল। তোমাদের উপস্থিতিতে কোন স্থানে যদি এ প্লেগ মহামারী দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হবে না এবং কোন স্থানে যদি এ মহামারী হয়েছে বলে শোন তাহলে সেখানে প্রবেশও করবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২১৮)
আল্লাহ তা‘আলার কালাম পরিবর্তন করা ইয়াহূদিদের স্বভাব। যখন আল্লাহ তা‘আলা এক কথা বলতে বললেন তখন তারা সে কথা পরিবর্তন করে অন্য কথা বলল। আমরাও যেন আমাদের ঘৃণ্য স্বার্থ হাসিল করার জন্য অথবা নিজেদের দল ও মত প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস পরিবর্তন না করি। কুরআনে তো কোন পরিবর্তন করা যাবেই না, যথাসম্ভব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস ও তাঁর মুখনিঃসৃত শব্দে বর্ণনা করা উচিত। কারণ জনৈক সাহাবী নাবী শব্দের স্থানে রাসূল বলেছেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নাবী বলার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী হা: ২৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৭১০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. শিক্ষা ও নসিহত প্রদানের লক্ষ্যে পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করা বৈধ।
২. জুলুম, পাপাচার ও শরীয়তের নির্দেশাবলী নিয়ে টালবাহানা করার ভয়াবহ পরিণতি থেকে সতর্ক হওয়া উচিত।
৩. নিজের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন করা হারাম।
2:59
فَبَدَّلَ الَّذِیۡنَ
ظَلَمُوۡا قَوۡلًا غَیۡرَ الَّذِیۡ قِیۡلَ لَہُمۡ فَاَنۡزَلۡنَا عَلَی الَّذِیۡنَ
ظَلَمُوۡا رِجۡزًا مِّنَ السَّمَآءِ بِمَا کَانُوۡا یَفۡسُقُوۡنَ ﴿٪۵۹﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৫৮ ও ৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:
(هٰذِهِ الْقَرْيَة)
‘এ নগর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল “বায়তুল মুকাদ্দাস”, এ বিষয়ে যদিও অনেক মতানৈক্য পাওয়া যায় তবে এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১:২২৯)
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ)
“দরজা দিয়ে প্রবেশ কর” এখানে দরজা দ্বারা উদ্দেশ্য বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা, যা বর্তমানে হিত্তার দরজা বলে পরিচিত। বানী ইসরাঈলের ইয়াহূদিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা “আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন” একথা বলে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা দিয়ে সিজদাবনত অবস্থায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অবাধ্যতার বশীভূত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন বানী ইসরাঈলকে বলা হল
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ)
তোমরা সিজদাবনত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তখন তারা তা পরিবর্তন করে জানুর ভরে অর্থাৎ দাম্ভিকভাবে এবং حِطَّةٌ (ক্ষমা প্রার্থনা) এর পরিবর্তে حبة في شعرة (যবের দানা) বলতে বলতে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৯, সহীহ মুসলিম হা: ৩০১৫)
رجز অর্থ শাস্তি, এ শাস্তি কী ছিল সে ব্যাপারে কয়েকটি উক্তি পাওয়া যায়: যেমন আল্লাহ তা‘আলার গযব কঠিন ঠাণ্ডাজনিত কুয়াশা অথবা প্লেগ রোগ। প্লেগ রোগের সমর্থন হাদীসে পাওয়া যায়।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: এ প্লেগ সে আযাব ও শাস্তির অংশ যা তোমাদের পূর্বে কোন জাতির ওপর নাযিল করা হয়েছিল। তোমাদের উপস্থিতিতে কোন স্থানে যদি এ প্লেগ মহামারী দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হবে না এবং কোন স্থানে যদি এ মহামারী হয়েছে বলে শোন তাহলে সেখানে প্রবেশও করবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২১৮)
আল্লাহ তা‘আলার কালাম পরিবর্তন করা ইয়াহূদিদের স্বভাব। যখন আল্লাহ তা‘আলা এক কথা বলতে বললেন তখন তারা সে কথা পরিবর্তন করে অন্য কথা বলল। আমরাও যেন আমাদের ঘৃণ্য স্বার্থ হাসিল করার জন্য অথবা নিজেদের দল ও মত প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস পরিবর্তন না করি। কুরআনে তো কোন পরিবর্তন করা যাবেই না, যথাসম্ভব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস ও তাঁর মুখনিঃসৃত শব্দে বর্ণনা করা উচিত। কারণ জনৈক সাহাবী নাবী শব্দের স্থানে রাসূল বলেছেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নাবী বলার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী হা: ২৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৭১০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. শিক্ষা ও নসিহত প্রদানের লক্ষ্যে পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করা বৈধ।
২. জুলুম, পাপাচার ও শরীয়তের নির্দেশাবলী নিয়ে টালবাহানা করার ভয়াবহ পরিণতি থেকে সতর্ক হওয়া উচিত।
৩. নিজের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন করা হারাম।
(هٰذِهِ الْقَرْيَة)
‘এ নগর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল “বায়তুল মুকাদ্দাস”, এ বিষয়ে যদিও অনেক মতানৈক্য পাওয়া যায় তবে এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১:২২৯)
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ)
“দরজা দিয়ে প্রবেশ কর” এখানে দরজা দ্বারা উদ্দেশ্য বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা, যা বর্তমানে হিত্তার দরজা বলে পরিচিত। বানী ইসরাঈলের ইয়াহূদিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা “আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন” একথা বলে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা দিয়ে সিজদাবনত অবস্থায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অবাধ্যতার বশীভূত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন বানী ইসরাঈলকে বলা হল
(وَّادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ)
তোমরা সিজদাবনত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তখন তারা তা পরিবর্তন করে জানুর ভরে অর্থাৎ দাম্ভিকভাবে এবং حِطَّةٌ (ক্ষমা প্রার্থনা) এর পরিবর্তে حبة في شعرة (যবের দানা) বলতে বলতে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৯, সহীহ মুসলিম হা: ৩০১৫)
رجز অর্থ শাস্তি, এ শাস্তি কী ছিল সে ব্যাপারে কয়েকটি উক্তি পাওয়া যায়: যেমন আল্লাহ তা‘আলার গযব কঠিন ঠাণ্ডাজনিত কুয়াশা অথবা প্লেগ রোগ। প্লেগ রোগের সমর্থন হাদীসে পাওয়া যায়।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: এ প্লেগ সে আযাব ও শাস্তির অংশ যা তোমাদের পূর্বে কোন জাতির ওপর নাযিল করা হয়েছিল। তোমাদের উপস্থিতিতে কোন স্থানে যদি এ প্লেগ মহামারী দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হবে না এবং কোন স্থানে যদি এ মহামারী হয়েছে বলে শোন তাহলে সেখানে প্রবেশও করবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২১৮)
আল্লাহ তা‘আলার কালাম পরিবর্তন করা ইয়াহূদিদের স্বভাব। যখন আল্লাহ তা‘আলা এক কথা বলতে বললেন তখন তারা সে কথা পরিবর্তন করে অন্য কথা বলল। আমরাও যেন আমাদের ঘৃণ্য স্বার্থ হাসিল করার জন্য অথবা নিজেদের দল ও মত প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস পরিবর্তন না করি। কুরআনে তো কোন পরিবর্তন করা যাবেই না, যথাসম্ভব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস ও তাঁর মুখনিঃসৃত শব্দে বর্ণনা করা উচিত। কারণ জনৈক সাহাবী নাবী শব্দের স্থানে রাসূল বলেছেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নাবী বলার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী হা: ২৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৭১০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. শিক্ষা ও নসিহত প্রদানের লক্ষ্যে পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করা বৈধ।
২. জুলুম, পাপাচার ও শরীয়তের নির্দেশাবলী নিয়ে টালবাহানা করার ভয়াবহ পরিণতি থেকে সতর্ক হওয়া উচিত।
৩. নিজের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন করা হারাম।
2:60
وَ اِذِ اسۡتَسۡقٰی
مُوۡسٰی لِقَوۡمِہٖ فَقُلۡنَا اضۡرِبۡ بِّعَصَاکَ الۡحَجَرَ ؕ فَانۡفَجَرَتۡ مِنۡہُ
اثۡنَتَاعَشۡرَۃَ عَیۡنًا ؕ قَدۡ عَلِمَ کُلُّ اُنَاسٍ مَّشۡرَبَہُمۡ ؕ کُلُوۡا وَ
اشۡرَبُوۡا مِنۡ رِّزۡقِ اللّٰہِ وَ لَا تَعۡثَوۡا فِی الۡاَرۡضِ مُفۡسِدِیۡنَ ﴿۶۰﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৬০ ও ৬১ নং আয়াতের তাফসীর:
৬০ নং আয়াতে একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা বানী ইসরাঈলকে দেয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াতে مِصْرَ ‘মিসর’শব্দ দ্বারা কোন্ জায়গা বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য পাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক কথা হল: مصر দ্বারা উদ্দেশ্য যে কোন শহর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস-সহ অন্যান্যরাও এ মতই পোষণ করেছেন।
(ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ)
‘আর তাদের ওপর লাঞ্ছনা......পতিত হল’এর ভাবার্থ হচ্ছে তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র স্থায়ী করে দেয়া হয়েছে। অপমান ও হীনতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: তাদেরকে লাঞ্ছিত করার অর্থ হল, হীন অবস্থায় স্বহস্তে মুসলিমদেরকে জিযিয়া প্রদান করা। আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: المسكنة এর অর্থ হল “দরিদ্রতা”। যহহাক (রহঃ) বলেন: “জিযিয়া”।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের সাথে কুফরী করার নেপথ্যে বানী ইসরাঈলকে তিন প্রকার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে।
১. الذِّلَّةُ অপমান ও লাঞ্ছনা।
২. الْمَسْکَنَةُ দরিদ্রতা।
৩. بَا۬ءُوْ بِغَضَبٍ আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ ও ক্রোধ।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের একটি জঘন্য পাপের কথা উল্লেখ করেছেন যা অন্যান্য জাতিরা করতে সাহস পায়নি।
যখনই তাদের কাছে কোন নাবী-রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰحَسْرَةً عَلَی الْعِبَادِﺈ مَا یَاْتِیْھِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আফসোস সে বান্দাদের জন্য, যাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।”(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস রয়েছে যে,
إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ قَتَلَهُ نَبِيٌّ, أَوْ قَتَلَ نَبِيًّا, وَإِمَامُ ضَلَالَةٍ, وَمُمَثِّلٌ مِنَ الْمُمَثِّلِينَ
কিয়ামাতের দিন যাদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তারা ওরাই যাদেরকে কোন নাবী হত্যা করেছেন অথবা তারা কোন নাবীকে হত্যা করেছে, অনুরূপ পথভ্রষ্ট নেতা এবং চিত্র শিল্পীরা। (মুসনাদ আহমাদ: ৩৮৬৮, সনদ হাসান)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে চলার পরিণতি খুবই খারাপ।
২. উত্তম কিছু বর্জন করে অধম কিছু গ্রহণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।
৩. নাবী-রাসূলদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরী কাজ।
৬০ নং আয়াতে একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা বানী ইসরাঈলকে দেয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াতে مِصْرَ ‘মিসর’শব্দ দ্বারা কোন্ জায়গা বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য পাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক কথা হল: مصر দ্বারা উদ্দেশ্য যে কোন শহর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস-সহ অন্যান্যরাও এ মতই পোষণ করেছেন।
(ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ)
‘আর তাদের ওপর লাঞ্ছনা......পতিত হল’এর ভাবার্থ হচ্ছে তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র স্থায়ী করে দেয়া হয়েছে। অপমান ও হীনতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: তাদেরকে লাঞ্ছিত করার অর্থ হল, হীন অবস্থায় স্বহস্তে মুসলিমদেরকে জিযিয়া প্রদান করা। আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: المسكنة এর অর্থ হল “দরিদ্রতা”। যহহাক (রহঃ) বলেন: “জিযিয়া”।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের সাথে কুফরী করার নেপথ্যে বানী ইসরাঈলকে তিন প্রকার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে।
১. الذِّلَّةُ অপমান ও লাঞ্ছনা।
২. الْمَسْکَنَةُ দরিদ্রতা।
৩. بَا۬ءُوْ بِغَضَبٍ আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ ও ক্রোধ।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের একটি জঘন্য পাপের কথা উল্লেখ করেছেন যা অন্যান্য জাতিরা করতে সাহস পায়নি।
যখনই তাদের কাছে কোন নাবী-রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰحَسْرَةً عَلَی الْعِبَادِﺈ مَا یَاْتِیْھِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আফসোস সে বান্দাদের জন্য, যাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।”(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস রয়েছে যে,
إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ قَتَلَهُ نَبِيٌّ, أَوْ قَتَلَ نَبِيًّا, وَإِمَامُ ضَلَالَةٍ, وَمُمَثِّلٌ مِنَ الْمُمَثِّلِينَ
কিয়ামাতের দিন যাদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তারা ওরাই যাদেরকে কোন নাবী হত্যা করেছেন অথবা তারা কোন নাবীকে হত্যা করেছে, অনুরূপ পথভ্রষ্ট নেতা এবং চিত্র শিল্পীরা। (মুসনাদ আহমাদ: ৩৮৬৮, সনদ হাসান)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে চলার পরিণতি খুবই খারাপ।
২. উত্তম কিছু বর্জন করে অধম কিছু গ্রহণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।
৩. নাবী-রাসূলদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরী কাজ।
2:61
وَ اِذۡ قُلۡتُمۡ
یٰمُوۡسٰی لَنۡ نَّصۡبِرَ عَلٰی طَعَامٍ وَّاحِدٍ فَادۡعُ لَنَا رَبَّکَ یُخۡرِجۡ
لَنَا مِمَّا تُنۡۢبِتُ الۡاَرۡضُ مِنۡۢ بَقۡلِہَا وَ قِثَّآئِہَا وَ فُوۡمِہَا
وَ عَدَسِہَا وَ بَصَلِہَا ؕ قَالَ اَتَسۡتَبۡدِلُوۡنَ الَّذِیۡ ہُوَ اَدۡنٰی
بِالَّذِیۡ ہُوَ خَیۡرٌ ؕ اِہۡبِطُوۡا مِصۡرًا فَاِنَّ لَکُمۡ مَّا سَاَلۡتُمۡ ؕ
وَ ضُرِبَتۡ عَلَیۡہِمُ الذِّلَّۃُ وَ الۡمَسۡکَنَۃُ ٭ وَ بَآءُوۡ بِغَضَبٍ مِّنَ
اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ کَانُوۡا یَکۡفُرُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ
یَقۡتُلُوۡنَ النَّبِیّٖنَ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ ؕ ذٰلِکَ بِمَا عَصَوۡا وَّ کَانُوۡا
یَعۡتَدُوۡنَ ﴿٪۶۱﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম,
মী-ম।
FATHUL MAJID
৬০ ও ৬১ নং আয়াতের তাফসীর:
৬০ নং আয়াতে একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা বানী ইসরাঈলকে দেয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াতে مِصْرَ ‘মিসর’শব্দ দ্বারা কোন্ জায়গা বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য পাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক কথা হল: مصر দ্বারা উদ্দেশ্য যে কোন শহর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস-সহ অন্যান্যরাও এ মতই পোষণ করেছেন।
(ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ)
‘আর তাদের ওপর লাঞ্ছনা......পতিত হল’এর ভাবার্থ হচ্ছে তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র স্থায়ী করে দেয়া হয়েছে। অপমান ও হীনতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: তাদেরকে লাঞ্ছিত করার অর্থ হল, হীন অবস্থায় স্বহস্তে মুসলিমদেরকে জিযিয়া প্রদান করা। আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: المسكنة এর অর্থ হল “দরিদ্রতা”। যহহাক (রহঃ) বলেন: “জিযিয়া”।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের সাথে কুফরী করার নেপথ্যে বানী ইসরাঈলকে তিন প্রকার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে।
১. الذِّلَّةُ অপমান ও লাঞ্ছনা।
২. الْمَسْکَنَةُ দরিদ্রতা।
৩. بَا۬ءُوْ بِغَضَبٍ আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ ও ক্রোধ।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের একটি জঘন্য পাপের কথা উল্লেখ করেছেন যা অন্যান্য জাতিরা করতে সাহস পায়নি।
যখনই তাদের কাছে কোন নাবী-রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰحَسْرَةً عَلَی الْعِبَادِﺈ مَا یَاْتِیْھِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আফসোস সে বান্দাদের জন্য, যাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।”(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস রয়েছে যে,
إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ قَتَلَهُ نَبِيٌّ, أَوْ قَتَلَ نَبِيًّا, وَإِمَامُ ضَلَالَةٍ, وَمُمَثِّلٌ مِنَ الْمُمَثِّلِينَ
কিয়ামাতের দিন যাদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তারা ওরাই যাদেরকে কোন নাবী হত্যা করেছেন অথবা তারা কোন নাবীকে হত্যা করেছে, অনুরূপ পথভ্রষ্ট নেতা এবং চিত্র শিল্পীরা। (মুসনাদ আহমাদ: ৩৮৬৮, সনদ হাসান)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে চলার পরিণতি খুবই খারাপ।
২. উত্তম কিছু বর্জন করে অধম কিছু গ্রহণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।
৩. নাবী-রাসূলদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরী কাজ।
আপনি চাইলে -Whatapps-Facebook-Twitter-ব্লগ- আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking-ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন-মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]-:-admin by rasikul islam নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিটকরুন -এই ওয়েবসাইটে -https://sarolpoth.blogspot.com/(জানা অজানা ইসলামিক জ্ঞান পেতে runing update)< -https://rasikulindia.blogspot.com (ইসলামিক বিশুদ্ধ শুধু বই পেতে, পড়তে ও ডাউনলোড করতে পারবেন). Main Websaite- esoislamerpothe.in , comming soon my best world websaite৬০ নং আয়াতে একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা বানী ইসরাঈলকে দেয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াতে مِصْرَ ‘মিসর’শব্দ দ্বারা কোন্ জায়গা বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য পাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক কথা হল: مصر দ্বারা উদ্দেশ্য যে কোন শহর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস-সহ অন্যান্যরাও এ মতই পোষণ করেছেন।
(ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ)
‘আর তাদের ওপর লাঞ্ছনা......পতিত হল’এর ভাবার্থ হচ্ছে তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র স্থায়ী করে দেয়া হয়েছে। অপমান ও হীনতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: তাদেরকে লাঞ্ছিত করার অর্থ হল, হীন অবস্থায় স্বহস্তে মুসলিমদেরকে জিযিয়া প্রদান করা। আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: المسكنة এর অর্থ হল “দরিদ্রতা”। যহহাক (রহঃ) বলেন: “জিযিয়া”।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের সাথে কুফরী করার নেপথ্যে বানী ইসরাঈলকে তিন প্রকার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে।
১. الذِّلَّةُ অপমান ও লাঞ্ছনা।
২. الْمَسْکَنَةُ দরিদ্রতা।
৩. بَا۬ءُوْ بِغَضَبٍ আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ ও ক্রোধ।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের একটি জঘন্য পাপের কথা উল্লেখ করেছেন যা অন্যান্য জাতিরা করতে সাহস পায়নি।
যখনই তাদের কাছে কোন নাবী-রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰحَسْرَةً عَلَی الْعِبَادِﺈ مَا یَاْتِیْھِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আফসোস সে বান্দাদের জন্য, যাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।”(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস রয়েছে যে,
إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ قَتَلَهُ نَبِيٌّ, أَوْ قَتَلَ نَبِيًّا, وَإِمَامُ ضَلَالَةٍ, وَمُمَثِّلٌ مِنَ الْمُمَثِّلِينَ
কিয়ামাতের দিন যাদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তারা ওরাই যাদেরকে কোন নাবী হত্যা করেছেন অথবা তারা কোন নাবীকে হত্যা করেছে, অনুরূপ পথভ্রষ্ট নেতা এবং চিত্র শিল্পীরা। (মুসনাদ আহমাদ: ৩৮৬৮, সনদ হাসান)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে চলার পরিণতি খুবই খারাপ।
২. উত্তম কিছু বর্জন করে অধম কিছু গ্রহণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।
৩. নাবী-রাসূলদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরী কাজ।
0 Comments