তাফসীরঃ ফাতহুল মাজীদ
ইসলামিক এডুকেশন এন্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশন (এই. ই. আর. এফ)
অনুবাদ ও গবেষণা বিভাগ কর্তৃক সংকলিত।ও সম্পাদিত
সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ-আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
সম্পাদনা পরিষদঃ-
· প্রফেসর এ.কে.এম শামসুল আলম
· প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইলিয়াস আলী
· প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুযযাম্মিল আলী
· প্রফেসর ড. মুহাম্মদ লাকমান হুসেন
· অধ্যাপকড. আব্দুল্লাহ ফারুক সালাফী |
· অধ্যাপক ড. সাইফুল্লাহ আল-মাদানী
· শায়খ মুস্তফা বিন বাহারুদ্দীন সালাফী
· শায়খ ড. হাফিয় রফিকুল আল-মাদানী
· শায়খ মাসউদুল আলম উমরী
· শায়খ মুফায়যাল হুসাইন আল-মাদানী
· শায়খ মুহাম্মদ ঈসা মিয়া আল-মাদানী
· শায়খ মুহাম্মদ ইরফান আলী আব্বাস আল-মাদানী
· শায়খ হাবিবুর রহমান আল-মাদানী |
· শায়খ হাফিয় আনিসুর রহমান আল-মাদানী |
· শায়খ ইব্রাহীম বিন আবদুল হালীম আল-মাদানী
· শায়খ আব্দুন নূর আবু সাঈদ আল-মাদানী |
· শায়খ মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ খান আল-মাদানী
· শায়খ হাফিয় আনিসুর রহমান আল-মাদানী
· শায়খ ইব্রাহীম বিন আবদুল হালীম আল-মাদানী
· শায়খ আব্দুন নূর আবু সাঈদ আল-মাদানী
· শায়খ মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ খান আল-মাদানী
পরিবেশনায়ঃ আল খাইর পাবলিকেশন্ম, নাজির বাজার, | ঢাকা।
তাফসীর ফাতহুল মাজীদ
সাম্প্রতিককালে সংকলিত অন্যতম কিছু তাফসীরের মধ্যে তাফসীর ফাতহুল মাজীদ উল্লেখযোগ্য। এই তাফসীরটি শাইখ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানীর তত্ত্বাবধানে সংকলন করা হয়েছে।
খণ্ড সংখ্যাঃ ৩
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৫৯৮ (৮২৪ + ৯৬০ + ৮১৪)
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫৫০ (৯০০ + ৮৫০ + ৮০০)
তাফসীর ফাতহুল মাজীদ-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
০১. আরবী আয়াতের পাশাপাশি অতি সহজ - সরল বাংলা অনুবাদ।
০২. জটিল ও কঠিন শব্দার্থ।
০৩. গ্রহণযোগ্য বর্ণনার আলোকে শানে নুযুল।
০৪. কুরআনুল কারীম ও স্বহীহ হাদীছ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থের আলোকে সংক্ষিপ্ত তাফসীর সংকলন।
০৫. স্বহীহ আক্বীদাহ ও শারয়ী বিধানমূলক আয়াতের শিক্ষা।
০৬. কুরআন ও সহীহ হাদীছের আলোকে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সমাধান।
০৭. ভিত্তিহীন প্রচলিত তাফসীর সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
০৮. তাফসীরে ব্যবহৃত আয়াতসমূহ নম্বর ও সূরাসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
০৯. যথাসাধ্য হাদীছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
১০. সাধ্যানুযায়ী স্বহীহ বুখারী, স্বহীহ মুসলিম, সুনান আবূ দাউদ, সুনান তিরমিযি, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা মালিক ও মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থের হাদীসসমূহে মাকতাবাহ শামিলার নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
১১. বাংলাভাষী পাঠকদের সহজ পাঠের জন্য আরবী বিশেষ ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
১২. সর্বোপরি উন্নতমানের কাগজে মুদ্রণ, মজবুত ও আকর্ষণীয় বাইন্ডিং করা হয়েছে।প্রথম খণ্ডে সূরাহ আল ফাতিহাহ থেকে সূরাহ আত তাওবাহ্, দ্বিতীয় খণ্ডে সূরাহ ইউনুস থেকে সূরাহ আল ফাথির এবং তৃতীয় খণ্ডে সূরাহ ইয়াসীন থেকে সূরাহ আন নাসের তাফসীর রয়েছে।
০২. জটিল ও কঠিন শব্দার্থ।
০৩. গ্রহণযোগ্য বর্ণনার আলোকে শানে নুযুল।
০৪. কুরআনুল কারীম ও স্বহীহ হাদীছ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থের আলোকে সংক্ষিপ্ত তাফসীর সংকলন।
০৫. স্বহীহ আক্বীদাহ ও শারয়ী বিধানমূলক আয়াতের শিক্ষা।
০৬. কুরআন ও সহীহ হাদীছের আলোকে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সমাধান।
০৭. ভিত্তিহীন প্রচলিত তাফসীর সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
০৮. তাফসীরে ব্যবহৃত আয়াতসমূহ নম্বর ও সূরাসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
০৯. যথাসাধ্য হাদীছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
১০. সাধ্যানুযায়ী স্বহীহ বুখারী, স্বহীহ মুসলিম, সুনান আবূ দাউদ, সুনান তিরমিযি, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা মালিক ও মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থের হাদীসসমূহে মাকতাবাহ শামিলার নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
১১. বাংলাভাষী পাঠকদের সহজ পাঠের জন্য আরবী বিশেষ ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
১২. সর্বোপরি উন্নতমানের কাগজে মুদ্রণ, মজবুত ও আকর্ষণীয় বাইন্ডিং করা হয়েছে।প্রথম খণ্ডে সূরাহ আল ফাতিহাহ থেকে সূরাহ আত তাওবাহ্, দ্বিতীয় খণ্ডে সূরাহ ইউনুস থেকে সূরাহ আল ফাথির এবং তৃতীয় খণ্ডে সূরাহ ইয়াসীন থেকে সূরাহ আন নাসের তাফসীর রয়েছে।
2:1
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
সুরার নাম- বাকারা,(বকনা- \বাছুর)
মোট আয়াত- ২৮৬, সুরার ধরনঃ- মাদানি।
এইখানে আয়াত দেওয়া আছে ৩৪ টি
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
নামকরণ ও অবতীর্ণের সময়কাল:
اَلْبَقَرَةُ (আল-বাকারাহ) শব্দের অর্থ গাভী। এ সূরার ৬৭-৭১ নং আয়াতে বানী ইসরাঈলের সাথে সম্পৃক্ত গাভী সংক্রান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। সেখান থেকেই বাকারাহ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এটি মদীনায় অবতীর্ণ বিধি-বিধানসম্বলিত সূরাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সূরা। বিশিষ্ট তাবিঈ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা আল-বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনদের ব্যাপারে, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের ব্যাপারে এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা বাকারার ফযীলত:
সূরা বাকারার ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়। ইমাম ইবনুল আরাবী (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারাহ এক হাজার সংবাদ, এক হাজার আদেশ ও এক হাজার নিষেধ সম্বলিত একটি সূরা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ، وَإِنَّ البَيْتَ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ البَقَرَةُ لَا يَدْخُلُهُ الشَّيْطَانُ
“তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত কর না। কেননা যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয় তাতে শয়তান প্রবেশ করে না।”(তিরমিযী হা: ২৮৭৭, সহীহ) সহীহ মুসলিম এর বর্ণনায় রয়েছে:إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِيْ تُقْرَأُ فِيْهِ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ
“যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয় সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।”(সহীহ মুসলিম হা: ৫৩৯)
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের মধ্যে কাউকে যেন এরূপ না পাই যে, সে এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে পড়তে থাকে, কিন্তু সে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করে না। জেনে রেখ, যে ঘরে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করা হয় সে ঘর থেকে শয়তান দ্রুত পালিয়ে যায়। সবচেয়ে খালি ও মূল্যহীন সেই ঘর, যে ঘরে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব (কুরআন) পাঠ করা হয় না। (নাসাঈ হা: ৯৬৩, হাদীসটি হাসান)
উসাইদ বিন হুজাইর (রাঃ) একদা রাতে সূরা বাকারাহ পাঠ আরম্ভ করেন। তাঁর পাশেই বাঁধা ঘোড়াটি হঠাৎ করে লাফাতে শুরু করে। তিনি পাঠ বন্ধ করলে ঘোড়াও লাফানো বন্ধ করে দেয়। আবার তিনি পড়তে শুরু করেন এবং ঘোড়াও লাফাতে শুরু করে। তিনি পুনরায় পড়া বন্ধ করেন, ঘোড়াটিও স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়বারও এরূপ ঘটে। তাঁর শিশু পুত্র ইয়াহইয়া ঘোড়ার পাশে শুয়ে ছিল। কাজেই তিনি ভয় করলেন যে, হয়তো ছেলের গায়ে আঘাত লেগে যাবে। সুতরাং তিনি পড়া বন্ধ করে ছেলেকে উঠিয়ে নেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করেন যে, ঘোড়ার চমকে ওঠার কারণ কী? সকালে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে হাযির হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনা শুনে বললেন: উসাইদ! তুমি পড়েই যেতে। উসাইদ (রাঃ) বলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তৃতীয় বারের পরে প্রিয় পুত্র ইয়াহইয়ার কারণে আমি পড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অতঃপর আমি মাথা আকাশের দিকে উঠালে ছায়ার ন্যায় একটি আলোকিত জিনিস দেখতে পাই এবং মুহূর্তেই তা ওপরের দিকে উঠে শূন্যে মিশে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন: তুমি কি জান সেটা কী ছিল? তাঁরা ছিলেন গগণবিহারী অগণিত জ্যোতির্ময় ফেরেশতা। তোমার (পড়ার) শব্দ শুনে তাঁরা নিকটে এসেছিলেন। যদি তুমি পড়া বন্ধ না করতে তাহলে তাঁরা সকাল পর্যন্ত এরূপ থাকতেন এবং মদীনার সকল লোক তা দেখে চোখ জুড়াতো। একজন ফেরেশতাও তাদের দৃষ্টির অন্তরাল হতেন না। (সহীহ বুখারী হা: ৫০১৮৮, সহীহ মুসলিম হা: ২১৯২)
সূরা আল-বাকারাহ ও আলি-ইমরানের ফযীলত: আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদাহ (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন- তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বসেছিলাম। অতঃপর তাঁকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনলাম তোমরা সূরা বাকারাহ শিক্ষা গ্রহণ কর। কারণ এর শিক্ষা অতি কল্যাণকর এবং এর শিক্ষা বর্জন অতি বেদনাদায়ক। এমনকি বাতিল পন্থীরাও এর ক্ষমতা রাখে না।
বর্ণনাকারী বলেন: এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- সূরা বাকারাহ ও সূরা আলি-ইমরান শিক্ষা কর। এ দু’টি জ্যোতির্ময় নূরবিশিষ্ট সূরা। এরা এদের তেলাওয়াতকারীর ওপর সামিয়ানা, মেঘমালা অথবা পাখির ঝাঁকের ন্যায় কিয়ামাতের দিন ছায়া দান করবে। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৩৪৮-৩৬১, মুসতাদরাকে হাকীম হা: ৫৬০, ইমাম হাকীম বলেন: হাদীসটি সহীহ মুসলিমের শর্তে কিন্তু তিনি বর্ণনা করেননি)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কিয়ামাতের দিন কুরআন তেলাওয়াতকারীদেরকে আহ্বান করা হবে। সূরা বাকারাহ ও সূরা আলি-ইমরান (তেলাওয়াতকারীদের) অগ্রে অগ্রে চলবে মেঘের ছায়া বা পাখির মত। এরা জোরালোভাবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৫৫৩)
১ নং আয়াতের তাফসীর:الم-(আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় অক্ষরগুলোকেالحروف المقطعات
“হুরূফুল মুক্বাত্বআত”বা বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সর্বমোট ঊনত্রিশটি সূরার শুরুতে এরূপ অক্ষর বা হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে সূরা বাকারার “الم”। এসবের মধ্যে কতকগুলো এক অক্ষর, আবার কতকগুলো দুই, তিন, চার এবং সর্বোচ্চ পাঁচ অক্ষরবিশিষ্ট।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এ বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলোর কোন নির্ভরযোগ্য তাফসীর পাওয়া যায় না। এ জন্য বলা হয়
“اَللّٰهُ أَعْلَمُ بِمُرَادِهِ بِذَلِكَ”
মহান আল্লাহই এগুলোর ব্যাপারে ভাল জানেন। (আইসারুত তাফাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) তবে এর ফযীলত প্রসঙ্গে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি এ কথা বলি না যে, আলিফ- লাম- মীম একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মীম একটি অক্ষর। প্রত্যেক অক্ষরে একটি করে নেকী দেয় হবে। আর একটি নেকীর প্রতিদান দশ গুণ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা: ২৯১০, সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা: ১৪১৬, সহীহ)
কেউ বলেছেন, এগুলোর অর্থ আছে, এগুলো সূরার নাম। কেউ বলেছেন, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার নাম। আবার কেউ বলেছেন এগুলোর কোন অর্থ নেই। কারণ আরবি ভাষায় এরূপ বিচ্ছিন্ন অক্ষরের কোন অর্থ হয় না। আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন (রহঃ) এ কথাই প্রাধান্য দিয়েছেন।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এগুলো এমন বিষয় যার জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সুতরাং এগুলোর তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত। (কুরতুবী, ইবনে কাসীর )
অতএব “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” যা সূরার শুরুতে রয়েছে, এগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকাই সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার কাজ। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না, বরং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা এগুলো অনর্থক অবতীর্ণ করেননি। এগুলোর পেছনে হিকমত রয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
তাছাড়া তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে ছিল বিশ্ব সেরা। আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত কুরআন বিশেষ করে এ সকল বিচ্ছিন্ন অক্ষর দ্বারা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের মত একটি কুরআন অথবা একটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসতে। এমনকি একটি আয়াত তৈরি করে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করলেন, তারা তাতেও সক্ষম হয়নি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি বহাল থাকবে, কিন্তু কেউ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি এবং হবেও না। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে কুরআন কোন গণক, জ্যোতিষী বা মানুষের তৈরি কিতাব নয়, বরং বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী যা শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়ে একটি চিরস্থায়ী মু‘জিযাহ।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
اَلْبَقَرَةُ (আল-বাকারাহ) শব্দের অর্থ গাভী। এ সূরার ৬৭-৭১ নং আয়াতে বানী ইসরাঈলের সাথে সম্পৃক্ত গাভী সংক্রান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। সেখান থেকেই বাকারাহ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এটি মদীনায় অবতীর্ণ বিধি-বিধানসম্বলিত সূরাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সূরা। বিশিষ্ট তাবিঈ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা আল-বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনদের ব্যাপারে, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের ব্যাপারে এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা বাকারার ফযীলত:
সূরা বাকারার ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়। ইমাম ইবনুল আরাবী (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারাহ এক হাজার সংবাদ, এক হাজার আদেশ ও এক হাজার নিষেধ সম্বলিত একটি সূরা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ، وَإِنَّ البَيْتَ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ البَقَرَةُ لَا يَدْخُلُهُ الشَّيْطَانُ
“তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত কর না। কেননা যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয় তাতে শয়তান প্রবেশ করে না।”(তিরমিযী হা: ২৮৭৭, সহীহ) সহীহ মুসলিম এর বর্ণনায় রয়েছে:إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِيْ تُقْرَأُ فِيْهِ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ
“যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয় সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।”(সহীহ মুসলিম হা: ৫৩৯)
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের মধ্যে কাউকে যেন এরূপ না পাই যে, সে এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে পড়তে থাকে, কিন্তু সে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করে না। জেনে রেখ, যে ঘরে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করা হয় সে ঘর থেকে শয়তান দ্রুত পালিয়ে যায়। সবচেয়ে খালি ও মূল্যহীন সেই ঘর, যে ঘরে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব (কুরআন) পাঠ করা হয় না। (নাসাঈ হা: ৯৬৩, হাদীসটি হাসান)
উসাইদ বিন হুজাইর (রাঃ) একদা রাতে সূরা বাকারাহ পাঠ আরম্ভ করেন। তাঁর পাশেই বাঁধা ঘোড়াটি হঠাৎ করে লাফাতে শুরু করে। তিনি পাঠ বন্ধ করলে ঘোড়াও লাফানো বন্ধ করে দেয়। আবার তিনি পড়তে শুরু করেন এবং ঘোড়াও লাফাতে শুরু করে। তিনি পুনরায় পড়া বন্ধ করেন, ঘোড়াটিও স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়বারও এরূপ ঘটে। তাঁর শিশু পুত্র ইয়াহইয়া ঘোড়ার পাশে শুয়ে ছিল। কাজেই তিনি ভয় করলেন যে, হয়তো ছেলের গায়ে আঘাত লেগে যাবে। সুতরাং তিনি পড়া বন্ধ করে ছেলেকে উঠিয়ে নেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করেন যে, ঘোড়ার চমকে ওঠার কারণ কী? সকালে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে হাযির হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনা শুনে বললেন: উসাইদ! তুমি পড়েই যেতে। উসাইদ (রাঃ) বলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তৃতীয় বারের পরে প্রিয় পুত্র ইয়াহইয়ার কারণে আমি পড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অতঃপর আমি মাথা আকাশের দিকে উঠালে ছায়ার ন্যায় একটি আলোকিত জিনিস দেখতে পাই এবং মুহূর্তেই তা ওপরের দিকে উঠে শূন্যে মিশে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন: তুমি কি জান সেটা কী ছিল? তাঁরা ছিলেন গগণবিহারী অগণিত জ্যোতির্ময় ফেরেশতা। তোমার (পড়ার) শব্দ শুনে তাঁরা নিকটে এসেছিলেন। যদি তুমি পড়া বন্ধ না করতে তাহলে তাঁরা সকাল পর্যন্ত এরূপ থাকতেন এবং মদীনার সকল লোক তা দেখে চোখ জুড়াতো। একজন ফেরেশতাও তাদের দৃষ্টির অন্তরাল হতেন না। (সহীহ বুখারী হা: ৫০১৮৮, সহীহ মুসলিম হা: ২১৯২)
সূরা আল-বাকারাহ ও আলি-ইমরানের ফযীলত: আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদাহ (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন- তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বসেছিলাম। অতঃপর তাঁকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনলাম তোমরা সূরা বাকারাহ শিক্ষা গ্রহণ কর। কারণ এর শিক্ষা অতি কল্যাণকর এবং এর শিক্ষা বর্জন অতি বেদনাদায়ক। এমনকি বাতিল পন্থীরাও এর ক্ষমতা রাখে না।
বর্ণনাকারী বলেন: এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- সূরা বাকারাহ ও সূরা আলি-ইমরান শিক্ষা কর। এ দু’টি জ্যোতির্ময় নূরবিশিষ্ট সূরা। এরা এদের তেলাওয়াতকারীর ওপর সামিয়ানা, মেঘমালা অথবা পাখির ঝাঁকের ন্যায় কিয়ামাতের দিন ছায়া দান করবে। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৩৪৮-৩৬১, মুসতাদরাকে হাকীম হা: ৫৬০, ইমাম হাকীম বলেন: হাদীসটি সহীহ মুসলিমের শর্তে কিন্তু তিনি বর্ণনা করেননি)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কিয়ামাতের দিন কুরআন তেলাওয়াতকারীদেরকে আহ্বান করা হবে। সূরা বাকারাহ ও সূরা আলি-ইমরান (তেলাওয়াতকারীদের) অগ্রে অগ্রে চলবে মেঘের ছায়া বা পাখির মত। এরা জোরালোভাবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৫৫৩)
১ নং আয়াতের তাফসীর:الم-(আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় অক্ষরগুলোকেالحروف المقطعات
“হুরূফুল মুক্বাত্বআত”বা বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সর্বমোট ঊনত্রিশটি সূরার শুরুতে এরূপ অক্ষর বা হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে সূরা বাকারার “الم”। এসবের মধ্যে কতকগুলো এক অক্ষর, আবার কতকগুলো দুই, তিন, চার এবং সর্বোচ্চ পাঁচ অক্ষরবিশিষ্ট।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এ বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলোর কোন নির্ভরযোগ্য তাফসীর পাওয়া যায় না। এ জন্য বলা হয়
“اَللّٰهُ أَعْلَمُ بِمُرَادِهِ بِذَلِكَ”
মহান আল্লাহই এগুলোর ব্যাপারে ভাল জানেন। (আইসারুত তাফাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) তবে এর ফযীলত প্রসঙ্গে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি এ কথা বলি না যে, আলিফ- লাম- মীম একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মীম একটি অক্ষর। প্রত্যেক অক্ষরে একটি করে নেকী দেয় হবে। আর একটি নেকীর প্রতিদান দশ গুণ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা: ২৯১০, সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা: ১৪১৬, সহীহ)
কেউ বলেছেন, এগুলোর অর্থ আছে, এগুলো সূরার নাম। কেউ বলেছেন, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার নাম। আবার কেউ বলেছেন এগুলোর কোন অর্থ নেই। কারণ আরবি ভাষায় এরূপ বিচ্ছিন্ন অক্ষরের কোন অর্থ হয় না। আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন (রহঃ) এ কথাই প্রাধান্য দিয়েছেন।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এগুলো এমন বিষয় যার জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সুতরাং এগুলোর তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত। (কুরতুবী, ইবনে কাসীর )
অতএব “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” যা সূরার শুরুতে রয়েছে, এগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকাই সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার কাজ। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না, বরং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা এগুলো অনর্থক অবতীর্ণ করেননি। এগুলোর পেছনে হিকমত রয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
তাছাড়া তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে ছিল বিশ্ব সেরা। আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত কুরআন বিশেষ করে এ সকল বিচ্ছিন্ন অক্ষর দ্বারা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের মত একটি কুরআন অথবা একটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসতে। এমনকি একটি আয়াত তৈরি করে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করলেন, তারা তাতেও সক্ষম হয়নি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি বহাল থাকবে, কিন্তু কেউ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি এবং হবেও না। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে কুরআন কোন গণক, জ্যোতিষী বা মানুষের তৈরি কিতাব নয়, বরং বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী যা শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়ে একটি চিরস্থায়ী মু‘জিযাহ।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরা বাকারাহ অতীব ফযীলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা।
২. যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করা হয় সে বাড়িতে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না। তাই আমাদের বেশি বেশি এ সূরা তেলাওয়াত করা দরকার।
৩. “হুরূফুল মুক্বাত্বআত”বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরের সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে। অতএব এর তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত।
৪. কুরআনুল কারীমের একটি অক্ষর তেলাওয়াত করলে দশটি নেকী হয়, বুঝে তেলাওয়াত করুক আর না বুঝে তেলাওয়াত করুক। তবে অবশ্যই বুঝে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতে হবে।
৫. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
২. যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করা হয় সে বাড়িতে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না। তাই আমাদের বেশি বেশি এ সূরা তেলাওয়াত করা দরকার।
৩. “হুরূফুল মুক্বাত্বআত”বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরের সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে। অতএব এর তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত।
৪. কুরআনুল কারীমের একটি অক্ষর তেলাওয়াত করলে দশটি নেকী হয়, বুঝে তেলাওয়াত করুক আর না বুঝে তেলাওয়াত করুক। তবে অবশ্যই বুঝে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতে হবে।
৫. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
2:2
ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡہِ ۚۛ ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ﴿۲﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২ নং আয়াতের তাফসীর :
ذٰلِكَ - ‘ঐ’শব্দটি প্রকৃত অর্থে দূরের কোন কিছুকে ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হচ্ছে ‘ঐ’আবার কখনো নিকটবর্তী বস্তুর জন্যও ব্যবহৃত হয়। তখন এর অর্থ হবে ‘এই’। এ আয়াতে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)।
ইবনু জুরাইজ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এখানে ذٰلِكَ শব্দটি هٰذَا (এই) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবি ভাষায় এ দু’টি শব্দ অনেক সময় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। কারণ আরবরা এতদুভয়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য করেন না। ইমাম বুখারী (রহঃ)ও আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে।ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য: ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুফাসসিরদের বিভিন্ন অভিমত থাকলেও সঠিক কথা হল এখানে ذٰلِكَ দ্বারা উদ্দেশ্য: কুরআনুল কারীম যা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করেছেন। (আইসারুত তাফাসীর, জাযায়েরী)كِتَابُ ‘গ্রন্থ’দ্বারা এখানে কুরআন মাজীদকে বুঝানো হয়েছে। যারা এর দ্বারা তাওরাত ও ইঞ্জিলকে উদ্দেশ্য করেছেন তাদের মতটি সঠিক নয়।
(لَا رَيْبَ فِيْهِ)
‘কোনরূপ সন্দেহ নেই’অর্থাৎ এতে কোন সংশয়-সন্দেহ নেই। এখানে رَيْبَ শব্দটি সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِثْلِه۪)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো।”(সূরা বাকারাহ ২:২৩)
এ শব্দটি আবার কখনো কখনো অপবাদ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন আরবি কবি জামীল বলেন:بثينة قالت ياجميل أربتني فقلت كلا نا يابثينة مريب
‘অর্থাৎ বুসাইনা বলল, হে জামীল! তুমি আমাকে অপবাদ দিয়েছ? আমি বললাম: হে বুসাইনা! আমরা উভয়েই উভয়ের অপবাদ দানকারী।
আয়াতে সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এ কিতাব আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অনুরূপ এ কিতাবে আলোচিত বিষয়সমূহ শতভাগ নিশ্চিত সত্য, এতেও কোন সন্দেহ করার সুযোগ নেই। পৃথিবীর মধ্যে কুরআন ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ নেই যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যে, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই
(هُدًي لِّلْمُتَّقِيْنَ)
‘মুত্তাক্বীদের জন্য হিদায়াত’অর্থাৎ এ কুরআন মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরুদের জন্য হিদায়াত দানকারী। যারা কাফির-মুশরিক তাদেরকে হিদায়াত দানকারী নয়। এমনটিই আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বলেছেন, যেহেতু মুত্তাকীরাই প্রকৃতপক্ষে কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(قُلْ ھُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا ھُدًی وَّشِفَا۬ئٌﺚ وَالَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْٓ اٰذَانِھِمْ وَقْرٌ وَّھُوَ عَلَیْھِمْ عَمًیﺚ)
“বলঃ মু’মিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার; কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব।”(সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১:৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا ھُوَ شِفَا۬ئٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ)
“আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমতস্বরূপ।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৮২)
এখানে হিদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো-الهدي الخاص
(বিশেষ হিদায়াত) অর্থাৎ দীন ইসলামের দিকে হিদায়াত দিয়ে অনুগ্রহ করা, এটা শুধু মু’মিনদের জন্য। তবে الهدي العام (সাধারণ হিদায়াত), যার উদ্দেশ্য হলো সত্যকে সুস্পষ্ট করে দেয়া, তাতে মু’মিন ও কাফির তথা সকল মানুষ শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْٓ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًي لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰي وَالْفُرْقَانِ)
“রমযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক এবং হিদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।”(সূরা বাকারাহ ২:১৫৮) (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে হিদায়াত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত ও গবেষণা করবে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তারাই হিদায়াত পাবে। অন্যথায় কেউ কুরআন তেলাওয়াত করে মুখস্ত ও গবেষণা করে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে কিন্তু হিদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশে কুরআন নাযিল করেছেন তা গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
ذٰلِكَ - ‘ঐ’শব্দটি প্রকৃত অর্থে দূরের কোন কিছুকে ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হচ্ছে ‘ঐ’আবার কখনো নিকটবর্তী বস্তুর জন্যও ব্যবহৃত হয়। তখন এর অর্থ হবে ‘এই’। এ আয়াতে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)।
ইবনু জুরাইজ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এখানে ذٰلِكَ শব্দটি هٰذَا (এই) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবি ভাষায় এ দু’টি শব্দ অনেক সময় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। কারণ আরবরা এতদুভয়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য করেন না। ইমাম বুখারী (রহঃ)ও আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে।ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য: ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুফাসসিরদের বিভিন্ন অভিমত থাকলেও সঠিক কথা হল এখানে ذٰلِكَ দ্বারা উদ্দেশ্য: কুরআনুল কারীম যা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করেছেন। (আইসারুত তাফাসীর, জাযায়েরী)كِتَابُ ‘গ্রন্থ’দ্বারা এখানে কুরআন মাজীদকে বুঝানো হয়েছে। যারা এর দ্বারা তাওরাত ও ইঞ্জিলকে উদ্দেশ্য করেছেন তাদের মতটি সঠিক নয়।
(لَا رَيْبَ فِيْهِ)
‘কোনরূপ সন্দেহ নেই’অর্থাৎ এতে কোন সংশয়-সন্দেহ নেই। এখানে رَيْبَ শব্দটি সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِثْلِه۪)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো।”(সূরা বাকারাহ ২:২৩)
এ শব্দটি আবার কখনো কখনো অপবাদ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন আরবি কবি জামীল বলেন:بثينة قالت ياجميل أربتني فقلت كلا نا يابثينة مريب
‘অর্থাৎ বুসাইনা বলল, হে জামীল! তুমি আমাকে অপবাদ দিয়েছ? আমি বললাম: হে বুসাইনা! আমরা উভয়েই উভয়ের অপবাদ দানকারী।
আয়াতে সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এ কিতাব আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অনুরূপ এ কিতাবে আলোচিত বিষয়সমূহ শতভাগ নিশ্চিত সত্য, এতেও কোন সন্দেহ করার সুযোগ নেই। পৃথিবীর মধ্যে কুরআন ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ নেই যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যে, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই
(هُدًي لِّلْمُتَّقِيْنَ)
‘মুত্তাক্বীদের জন্য হিদায়াত’অর্থাৎ এ কুরআন মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরুদের জন্য হিদায়াত দানকারী। যারা কাফির-মুশরিক তাদেরকে হিদায়াত দানকারী নয়। এমনটিই আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বলেছেন, যেহেতু মুত্তাকীরাই প্রকৃতপক্ষে কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(قُلْ ھُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا ھُدًی وَّشِفَا۬ئٌﺚ وَالَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْٓ اٰذَانِھِمْ وَقْرٌ وَّھُوَ عَلَیْھِمْ عَمًیﺚ)
“বলঃ মু’মিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার; কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব।”(সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১:৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا ھُوَ شِفَا۬ئٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ)
“আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমতস্বরূপ।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৮২)
এখানে হিদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো-الهدي الخاص
(বিশেষ হিদায়াত) অর্থাৎ দীন ইসলামের দিকে হিদায়াত দিয়ে অনুগ্রহ করা, এটা শুধু মু’মিনদের জন্য। তবে الهدي العام (সাধারণ হিদায়াত), যার উদ্দেশ্য হলো সত্যকে সুস্পষ্ট করে দেয়া, তাতে মু’মিন ও কাফির তথা সকল মানুষ শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْٓ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًي لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰي وَالْفُرْقَانِ)
“রমযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক এবং হিদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।”(সূরা বাকারাহ ২:১৫৮) (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে হিদায়াত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত ও গবেষণা করবে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তারাই হিদায়াত পাবে। অন্যথায় কেউ কুরআন তেলাওয়াত করে মুখস্ত ও গবেষণা করে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে কিন্তু হিদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশে কুরআন নাযিল করেছেন তা গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআনুল কারীম সকল প্রকার সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
২. কুরআন শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়েই আল্লাহ তা‘আলার কালাম। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবে।
৩. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি সর্বোত্তম গাইড ও জীবন বিধান।
৪. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিন-মুত্তাকীরা উপকৃত হয় বলে মুত্তাকীদের হিদায়াত দানকারী বলা হয়েছে। মূলত কুরআন সকলের জন্য পথ প্রদর্শক।
মুত্তাকীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য পরবর্তী তিনটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
২. কুরআন শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়েই আল্লাহ তা‘আলার কালাম। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবে।
৩. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি সর্বোত্তম গাইড ও জীবন বিধান।
৪. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিন-মুত্তাকীরা উপকৃত হয় বলে মুত্তাকীদের হিদায়াত দানকারী বলা হয়েছে। মূলত কুরআন সকলের জন্য পথ প্রদর্শক।
মুত্তাকীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য পরবর্তী তিনটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
2:3
الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ۙ﴿۳﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে।
চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
ওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে।
চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
ওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
2:4
وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)
ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে।
চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
তাওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)
ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে।
চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
তাওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
:১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
2:5
اُولٰٓئِکَ عَلٰی ہُدًی مِّنۡ رَّبِّہِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)
ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে। চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
তাওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)
ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে। চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
তাওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
2:6
اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا سَوَآءٌ عَلَیۡہِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَہُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۶﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৬ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে ও পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
কাফিরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الَّذِیْنَ حَقَّتْ عَلَیْھِمْ کَلِمَةُ رَبِّکَ لَا یُؤْمِنُوْنَﮯ وَلَوْ جَا۬ءَتْھُمْ کُلُّ اٰیَةٍ حَتّٰی یَرَوُا الْعَذَابَ الْاَلِیْمَ)
“নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিুক শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।”(সূরা ইউনূস ১০:৯৬-৯৭)
তাই বলে কাফিরদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না। কারণ আমাদের কাজ দাওয়াত দেয়া, হিদায়াত দেয়া নয়। হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। আমরা তাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখানোর পর হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করব।
অত্র আয়াতে ও পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
কাফিরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الَّذِیْنَ حَقَّتْ عَلَیْھِمْ کَلِمَةُ رَبِّکَ لَا یُؤْمِنُوْنَﮯ وَلَوْ جَا۬ءَتْھُمْ کُلُّ اٰیَةٍ حَتّٰی یَرَوُا الْعَذَابَ الْاَلِیْمَ)
“নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিুক শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।”(সূরা ইউনূস ১০:৯৬-৯৭)
তাই বলে কাফিরদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না। কারণ আমাদের কাজ দাওয়াত দেয়া, হিদায়াত দেয়া নয়। হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। আমরা তাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখানোর পর হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করব।
2:7
خَتَمَ اللّٰہُ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ وَ عَلٰی سَمۡعِہِمۡ ؕ وَ عَلٰۤی اَبۡصَارِہِمۡ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ٪﴿۷﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৭ নং আয়াতের তাফসীর:
অর্থাৎ সত্য গ্রহণে কাফিরদের অন্তঃকরণ, শ্রবণশক্তি ও দর্শনশক্তি আচ্ছাদিত করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সত্য অনুধাবন করতে পারে না, শুনতে পায় না এবং দেখতেও পায় না।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এ ব্যাপারে উম্মাত ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, অন্তর মোহরাঙ্কিত করাও আল্লাহ তা‘আলা নিজের একটি বিশেষ গুণরূপে উল্লেখ করেছেন। মূলত কাফিরদের অন্তর ঈমান আনা থেকে মোহরাঙ্কিত হয়ে যায় তাদের কুফরীর প্রতিদানস্বরূপ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(بَلْ طَبَعَ اللّٰهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ)
“বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন।”(সূরা নিসা ৪:১৫৫)
হাদীসেও এসেছে আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের পরিবর্তনকারী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ করতেন:يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَي دِيْنِكَ
হে অন্তরের পরিবর্তন আনয়নকারী আমাদের অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখুন। (তিরমিযী হা: ২১৪০, ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান।)
সাহাবী হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অন্তরে ফেতনা এমনভাবে উপস্থিত হয় যেমন একটি মাদুর। একটি একটি পাতা যুক্ত করে যেমন মাদুর তৈরি করা হয় ঠিক তেমনভাবে অন্তরে একটি একটি করে ফেতনা আসে। যে অন্তর তা গ্রহণ করে নেয় তাতে একটা কালোদাগ পড়ে যায়। সে অন্তরে কালো দাগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষে সবটাই কালো করে দেয়। তখন তা উল্টানো কলসের মত হয়ে যায়; ভাল কথাও তার ভাল লাগে না এবং মন্দ কথাও খারাপ লাগে না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪৪)
হাদীসে এসেছে- মু’মিন যখন পাপ কাজ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে ও বিরত থাকে তবে দাগটি মুছে যায় এবং অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়। আর যখন গুনাহ করতেই থাকে তখন সে কালো দাগ আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত অন্তরকে ছেয়ে ফেলে। এটাই সে মরিচা যার বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে-
(كَلَّا بَلْ ﺒ رَانَ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ مَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ)
“কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের ওপর মরিচারূপে জমে গেছে।”(সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১৪)। (তিরমিযী হা: ৩৩৩৪, ইবনু মাযাহ হা: ৪২৪৪, ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।)
সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা সত্য গ্রহণে সচেষ্ট থাকা। আর বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা:يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلٰي دِينِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখ”। (তিরমিযী হা: ২১৪০, সিলসিলা সহীহাহ হা: ২০৯১)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জান্নাত পেতে হলে আমাদেরকে মু’মিন-মুত্তাকীদের গুণাবলী অর্জন করতে হবে, শুধু মৌখিক দাবি করে বসে থাকলে হবে না।
২. হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, আমাদের দায়িত্ব মানুষকে সঠিকভাবে দাওয়াত দেয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা।
৩. মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয় তার কর্মের কারণে। কাফিররা তাদের কর্মের কারণে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের মালিক, যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। তাই আমাদের বেশি বেশি দু‘আ করা দরকার যেন তিনি আমাদের অন্তর দীনের ওপর অটল রাখেন।
অর্থাৎ সত্য গ্রহণে কাফিরদের অন্তঃকরণ, শ্রবণশক্তি ও দর্শনশক্তি আচ্ছাদিত করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সত্য অনুধাবন করতে পারে না, শুনতে পায় না এবং দেখতেও পায় না।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এ ব্যাপারে উম্মাত ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, অন্তর মোহরাঙ্কিত করাও আল্লাহ তা‘আলা নিজের একটি বিশেষ গুণরূপে উল্লেখ করেছেন। মূলত কাফিরদের অন্তর ঈমান আনা থেকে মোহরাঙ্কিত হয়ে যায় তাদের কুফরীর প্রতিদানস্বরূপ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(بَلْ طَبَعَ اللّٰهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ)
“বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন।”(সূরা নিসা ৪:১৫৫)
হাদীসেও এসেছে আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের পরিবর্তনকারী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ করতেন:يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَي دِيْنِكَ
হে অন্তরের পরিবর্তন আনয়নকারী আমাদের অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখুন। (তিরমিযী হা: ২১৪০, ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান।)
সাহাবী হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অন্তরে ফেতনা এমনভাবে উপস্থিত হয় যেমন একটি মাদুর। একটি একটি পাতা যুক্ত করে যেমন মাদুর তৈরি করা হয় ঠিক তেমনভাবে অন্তরে একটি একটি করে ফেতনা আসে। যে অন্তর তা গ্রহণ করে নেয় তাতে একটা কালোদাগ পড়ে যায়। সে অন্তরে কালো দাগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষে সবটাই কালো করে দেয়। তখন তা উল্টানো কলসের মত হয়ে যায়; ভাল কথাও তার ভাল লাগে না এবং মন্দ কথাও খারাপ লাগে না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪৪)
হাদীসে এসেছে- মু’মিন যখন পাপ কাজ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে ও বিরত থাকে তবে দাগটি মুছে যায় এবং অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়। আর যখন গুনাহ করতেই থাকে তখন সে কালো দাগ আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত অন্তরকে ছেয়ে ফেলে। এটাই সে মরিচা যার বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে-
(كَلَّا بَلْ ﺒ رَانَ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ مَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ)
“কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের ওপর মরিচারূপে জমে গেছে।”(সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১৪)। (তিরমিযী হা: ৩৩৩৪, ইবনু মাযাহ হা: ৪২৪৪, ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।)
সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা সত্য গ্রহণে সচেষ্ট থাকা। আর বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা:يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلٰي دِينِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখ”। (তিরমিযী হা: ২১৪০, সিলসিলা সহীহাহ হা: ২০৯১)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জান্নাত পেতে হলে আমাদেরকে মু’মিন-মুত্তাকীদের গুণাবলী অর্জন করতে হবে, শুধু মৌখিক দাবি করে বসে থাকলে হবে না।
২. হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, আমাদের দায়িত্ব মানুষকে সঠিকভাবে দাওয়াত দেয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা।
৩. মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয় তার কর্মের কারণে। কাফিররা তাদের কর্মের কারণে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের মালিক, যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। তাই আমাদের বেশি বেশি দু‘আ করা দরকার যেন তিনি আমাদের অন্তর দীনের ওপর অটল রাখেন।
2:8
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ مَا ہُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ۘ﴿۸﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা সূরার শুরুতে মু’মিন-মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাদের বিপরীতে কাফিরদের কথা তুলে ধরেছেন, অতঃপর এ আয়াত থেকে পনের নং আয়াত পর্যন্ত যারা বাহ্যিক ঈমানের দাবিদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফির তাদের কথা আলোচনা করেছেন। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য এ মুনাফিকরাই কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ مَرَدُوا عَلَي النِّفَاقِ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কপটতায় সিদ্ধহস্ত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০১)
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আরো বলেন:
(يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ)
“মুনাফিকেরা ভয় করে যে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৪)مُنَافِق শব্দটি نفاق মূলধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ কপটতা, দ্বিমুখিতা, মুনাফিকী ইত্যাদি।
শরয়ী পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়- যারা অন্তরে কুফরী গোপন রাখে এবং বাহ্যিক ঈমান প্রকাশ করে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: نفاق হল ভাল প্রকাশ করা ও মন্দ গোপন করা। ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: মুনাফিক তারা যাদের কথা কাজের বিপরীত এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)أسَاسُ النِّفَاقِ:
কপটতার মূল ভিত্তি: কপটতার মূল ভিত্তি হল কুফর ও কাপুরুষতা। কুফর-মুনাফিক যা গোপন করে রাখে, আর কাপুরুষতা হল যে কারণে অভ্যন্তরীণের বিপরীত বাহ্যিক প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে মুনাফিকরা কাপুরুষ ও দুর্বল মনের হয়ে থাকে। (উসূলুদ দাওয়াহ ৩৯৭ পৃ:)
মুনাফিক দু’প্রকার। যথা:
১. منافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, এরা নিজেদের সম্মান ও জান-মাল রক্ষা করার জন্য অথবা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুখে ইসলামের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা পরিপূর্ণ। এরা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ)
“মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।”(সূরা নিসা ৪:১৪৫)
এ প্রকার মুনাফিকদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার মধ্যে আলোচনা করেছেন।
২. منافق عملي
বা আমলগত মুনাফিক। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصَلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّي يَدَعَهَا: إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
“যার মাঝে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মাঝে এগুলোর একটি পাওয়া যাবে তার মাঝে সেরূপ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পরিত্যাগ করে- যখন কথা বলে তখন মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে, এবং ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে।”(সহীহ বুখারী হা: ৩৪)
কোন মু’মিন ব্যক্তির আমলে বাহ্যিকভাবে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না। কিন্তু যার অন্তরে এবং আমলে এ স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারাহসহ অন্যান্য যে সকল সূরাতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেمنافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, যারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। (তাফসীরে সা‘দী পৃ.: ১৯)
মাদানী সূরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মক্কায় কোন মুনাফিক ছিল না; বরং সেখানে ছিল ঈমানদারদের বিপরীত কাফির ও মুশরিক, তবে কিছু লোক এমন ছিলেন যারা বাহ্যত ও আপাত দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু ইয়াহূদীরা স্বীয় মতবাদে বহাল থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালাম সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব ইয়াহূদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলো গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এ দলের সূচনা এভাবে হয় যে, মদীনায় ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১. বানু কাইনুকা ২. বানু নাযীর এবং ৩. বানু কুরাইযা।
বনূ কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকি দু’টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জয়যুক্ত করলেন, ইসলামের জয়ডংকা চারিদিকে বেজে উঠল ও তার অপূর্ব দীপ্তি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠল, মুসলিমদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হল ও কাফিরদের গর্ব খর্ব হয়ে গেল, তখনই এ খবীস দলের গোড়া পত্তন হয়। আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশা বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এ গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হবার আশায় গুড়েবালি পড়ল। এ দুঃখ-পরিতাপ তো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় তাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
এখন সে চিন্তা করল যে, এভাবে কাজ হবে না। সুতরাং সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দলের কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এ গোপন পন্থা বাতলে দিল। এভাবে মদীনা ও তার আশেপাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়িম হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলার ফযলে এ কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেন না, আর থাকবেই বা কেন? এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা রাহে কুরবান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের কিছু আলামত ও বৈশিষ্ট্য:
১. مرض القلب বা অন্তরের ব্যাধি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”(সূরা বাকারাহ ২:১০)
২. الإفساد في الأرض বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِﺫ قَالُوْٓا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَﭚاَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلٰکِنْ لَّا یَشْعُرُوْنَﭛ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১১-১২)
৩. رميهم المؤمنين بالسفه বা মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া:
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ اٰمِنُوْا کَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوْٓا اَنُؤْمِنُ کَمَآ اٰمَنَ السُّفَھَا۬ئُﺚ اَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ السُّفَھَا۬ئُ وَلٰکِنْ لَّا یَعْلَمُوْنَ)
“এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে তোমরাও অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা বলে, নির্বোধেরা যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ কিন্তু তারা জানে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১৩)
৪. الخداع والرياء والتكاسل عن أداءالعبادات বা প্রতারণা করা, লোক দেখানো ইবাদত করা এবং ইবাদাতে শৈথিল্যতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًاﯝﺬ مُّذَبْذَبِیْنَ بَیْنَ ذٰلِکَﺣ لَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِ وَلَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَلَنْ تَجِدَ لَھ۫ سَبِیْلًاﯞ)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে; দোটানায় দোদুল্যমান- না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না।”(সূরা নিসা ৪:১৪২-৪৩)
৫. الاستهزاء باللّٰه واياته و رسوله বা আল্লাহ, রাসূল ও দীনের বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَبِاللّٰهِ وَآيَاتِه۪ وَرَسُولِه۪ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ)
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” (সূরা তাওবাহ ৯:৬৫)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوآ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ)
“এবং যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন তারা নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি।”(সূরা বাকারাহ ২:১৪)
৬. مؤالاة الكافرين والتربص بالمؤمين বা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও মু’মিনদের ক্ষতির প্রতীক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মান্তিুক শাস্তি রয়েছে। মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না; অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন। যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদের মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”(সূরা নিসা ৪:১৩৮-১৪১)
৭. اللد في الخصومة والعزة بالإثم বা অধিক ঝগড়াটে ও পাপ কাজে সম্মান খুঁজে:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُکَ قَوْلُھ۫ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَیُشْھِدُ اللہَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِھ۪ﺫ وَھُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِﰛ وَاِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الْاَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیْھَا وَیُھْلِکَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَﺚ وَاللہُ لَا یُحِبُّ الْفَسَادَﰜ وَاِذَا قِیْلَ لَھُ اتَّقِ اللہَ اَخَذَتْھُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُھ۫ جَھَنَّمُﺚ وَلَبِئْسَ الْمِھَادُﰝ)
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যার পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কথা তোমাকে অবাক করে তোলে। আর সে তার মনের বিষয়ের ওপর আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। মূলত সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আর যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি ছড়াতে এবং শস্য-ক্ষেত্র ও জীবজন্তু বিনাশের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি ভালবাসেন না। যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে দেয়। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২:২০৪-২০৬)
৮. الإفساد بين المؤمنين বা মু’মিনদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللّٰهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ)
“তারা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো। তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শোনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:৪৭)
৯. الغدر وعدم الوفاء بالعهد বা বিশ্বাসঘাতকতা ও অঙ্গীকার পূর্ণ না করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْھُمْ مَّنْ عٰھَدَ اللہَ لَئِنْ اٰتٰٿنَا مِنْ فَضْلِھ۪ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَکُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَﮚفَلَمَّآ اٰتٰٿھُمْ مِّنْ فَضْلِھ۪ بَخِلُوْا بِھ۪ وَتَوَلَّوْا وَّھُمْ مُّعْرِضُوْنَﮛفَاَعْقَبَھُمْ نِفَاقًا فِیْ قُلُوْبِھِمْ اِلٰی یَوْمِ یَلْقَوْنَھ۫ بِمَآ اَخْلَفُوا اللہَ مَا وَعَدُوْھُ وَبِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَﮜ)
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল, ‘আল্লাহ নিজ কৃপায় আমাদেরকে দান করলে আমরা নিশ্চয়ই সদাকাহ দেবো এবং অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করলো এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরালো। পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল করে দিলেন করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল সেটা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৭৫-৭৭)
১০. الأمر بالمنكر و النهي عن المعروف বা অসৎ কাজের নির্দেশ ও সৎ কাজে বাধা প্রদান করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ بَعْضُھُمْ مِّنْۭ بَعْضٍﺭ یَاْمُرُوْنَ بِالْمُنْکَرِ وَیَنْھَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَیَقْبِضُوْنَ اَیْدِیَھُمْﺚ نَسُوا اللہَ فَنَسِیَھُمْﺚ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ ھُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“মুনাফিক নর ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে, তারা হাত বন্ধ করে রাখে, তারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে বিস্মৃত হয়েছেন; মুনাফিকেরা তো পাপাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৭)
১১. التحاكم الي الطاغوت: বা তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّھُمْ اٰمَنُوْا بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاکَمُوْٓا اِلَی الطَّاغُوْتِ وَقَدْ اُمِرُوْٓا اَنْ یَّکْفُرُوْا بِھ۪ﺚ وَیُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّھُمْ ضَلٰلًۭا بَعِیْدًا)
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।”(সূরা নিসা ৪:৬০)
১২. الصدود عن الله ورسوله বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ تَعَالَوْا اِلٰی مَآ اَنْزَلَ اللہُ وَاِلَی الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْکَ صُدُوْدًاﮌﺆفَکَیْفَ اِذَآ اَصَابَتْھُمْ مُّصِیْبَةٌۭ بِمَا قَدَّمَتْ اَیْدِیْھِمْ ثُمَّ جَا۬ءُوْکَ یَحْلِفُوْنَﺣ بِاللہِ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّآ اِحْسَانًا وَّتَوْفِیْقًا)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন তাদের কোন মুসীবত হবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করতে করতে তোমার নিকট এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছুই চাইনি।’(সূরা নিসা ৪:৬১-৬২)
১৩. الكذب والخوف وكره المسلمين বা মিথ্যা, ভয় ও মুসলিমদের অপছন্দ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَحْلِفُوْنَ بِاللہِ اِنَّھُمْ لَمِنْکُمْﺚ وَمَا ھُمْ مِّنْکُمْ وَلٰکِنَّھُمْ قَوْمٌ یَّفْرَقُوْنَﮇلَوْ یَجِدُوْنَ مَلْجَاً اَوْ مَغٰرٰتٍ اَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا اِلَیْھِ وَھُمْ یَجْمَحُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে সদাকাহ বণ্টন সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে, অতঃপর এটার কিছু তাদেরকে দেয়া হলে তারা পরিতুষ্ট হয়, আর এটার কিছু তাদেরকে না দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা বিক্ষুব্ধ হয়।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫৬ - ৫৭)
১৪. الإضرار بالمؤمنين বা মু’মিনদের ক্ষতিসাধন করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَّکُفْرًا وَّتَفْرِیْقًۭا بَیْنَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَاِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللہَ وَرَسُوْلَھ۫ مِنْ قَبْلُﺚ وَلَیَحْلِفُنَّ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّا الْحُسْنٰیﺚ وَاللہُ یَشْھَدُ اِنَّھُمْ لَکٰذِبُوْنَ)
“এবং যারা মাসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই সেটা করেছি’; আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০৭)
প্রথম দুই আয়াতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও মূলত প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও হয়তো এ কথা ভাবে না যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুণই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে ধোঁকাবাজি করছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِنْ یُّرِیْدُوْٓا اَنْ یَّخْدَعُوْکَ فَاِنَّ حَسْبَکَ اللہُﺚ ھُوَ الَّذِیْٓ اَیَّدَکَ بِنَصْرِھ۪ وَبِالْمُؤْمِنِیْنَ)
“যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।”(সূরা আনফাল ৮:৬২)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকেও নয় বরং তারা ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজেরাই ধোঁকায় পতিত হয়। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।”(সূরা নিসা ৪:১৪২)
এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ধোঁকা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মু’মিনগণও ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত হয়ে সমস্ত ধোঁকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ ছিলেন।
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধি এর অর্থ হচ্ছে شك বা সংশয়। এরূপ মত পোষণ করেছেন- মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বসরী, আবুল আলিয়া ও কাতাদাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) । ত্বাওস (রহঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধির অর্থ হচ্ছে رياء বা লোক দেখানোর জন্য কাজ করা।
আবদুর রহমান বিন যায়িদ (রহঃ) বলেন: مرض অর্থ হচ্ছে “দীনের ব্যাপারে তাদের অন্তরের ব্যাধি” শারীরিক ব্যাধি নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন: ব্যাধি দুই প্রকার। উভয় প্রকারের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
১. مرض الشكوك والشبهات বা সংশয় ও সন্দেহের ব্যাধি:
যেমন কুফরী, মুনাফিকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস ইত্যাদি এ প্রকার ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধির আরোগ্য দান না করেন তাহলে তা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এখানে এ ব্যাধির কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَتَرَی الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوْنَ فِیْھِمْ یَقُوْلُوْنَ نَخْشٰٓی اَنْ تُصِیْبَنَا دَا۬ئِرَةٌ)
“আর আপনি তাদের দেখবেন যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে যে, তারা দৌড়ে গিয়ে ওদেরই মধ্যে ঢুকে এ বলে যে, আমরা ভয় করছি আমাদের ওপর না জানি কোন মুসিবত পতিত হয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫: ৫২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ غَرَّ ھٰٓؤُلَا۬ئِ دِیْنُھُمْﺚ وَمَنْ یَّتَوَکَّلْ عَلَی اللہِ فَاِنَّ اللہَ عَزِیْزٌ حَکِیْمٌ)
“স্মরণ কর, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ‘এদের দীন এদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আনফাল ৮:৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আরোও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন: সূরা মায়িদার ৫২ নং, সূরা আনফালের ৪৯ নং ও সূরা তাওবার ১২৫ নং আয়াত।
২. مرض الشهوات বা প্রবৃত্তির ব্যাধি:
যেমন অন্যায়-অশ্লীল, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী কাজের প্রতি লালসা ইত্যাদি। এ প্রকার ব্যাধি দূরিকরণে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِھ۪ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا)
“কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে অন্তরে যার (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে- সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩২) (“আত-তিব্বু আন-নব্বী”- লি ইবনিল কায়্যিম) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু’প্রকার ব্যাধি ও মুনাফিকী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের পূর্বের পাপের দরুন তাদের পরিণতির জন্য বিভিন্ন অবাধ্য কাজ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ)
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”(সূরা সাফ ৬১:৫) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিকদেরকে চেনা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে হত্যা করেননি? উমারও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি তাদেরকে হত্যা করে ফেলি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:دَعْهُ، لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ
তাকে ছেড়ে দাও! মানুষ যাতে সমালোচনা করতে না পারে (এই বলে) যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯০৫, ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা:২৫৮৪)
অর্থাৎ বেদুঈন আরবরা মুনাফিকদের হত্যার কারণ না জেনে শুধু বাহ্যিকভাবে অপপ্রচার শুনে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে, আর বলবে মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করে। এ অপপ্রচারের আশংকায় তাদেরকে হত্যা করা হয়নি।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা নিজেদের সম্মান, সম্পদ ও অসৎ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্তরে কুফরী রেখে বাহ্যিক ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই মুনাফিক। এরাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে বেশি ক্ষতিকর।
২. বিশ্বাসগত মুনাফিকরা কাফির। কিন্তু আমলগত মুনাফিকরা কাফির নয়, তবে বড় ধরনের অপরাধী।
৩. সংশয় ও সন্দেহ ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধি থেকে মুক্ত না করেন। তাই বেশি বেশিيا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ” এ দু‘আটি পড়া উচিত।
৪. কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম। সুতরাং আল্লাহভীরু মু’মিন ব্যক্তিকে ঐ সব কর্ম হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরার শুরুতে মু’মিন-মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাদের বিপরীতে কাফিরদের কথা তুলে ধরেছেন, অতঃপর এ আয়াত থেকে পনের নং আয়াত পর্যন্ত যারা বাহ্যিক ঈমানের দাবিদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফির তাদের কথা আলোচনা করেছেন। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য এ মুনাফিকরাই কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ مَرَدُوا عَلَي النِّفَاقِ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কপটতায় সিদ্ধহস্ত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০১)
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আরো বলেন:
(يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ)
“মুনাফিকেরা ভয় করে যে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৪)مُنَافِق শব্দটি نفاق মূলধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ কপটতা, দ্বিমুখিতা, মুনাফিকী ইত্যাদি।
শরয়ী পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়- যারা অন্তরে কুফরী গোপন রাখে এবং বাহ্যিক ঈমান প্রকাশ করে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: نفاق হল ভাল প্রকাশ করা ও মন্দ গোপন করা। ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: মুনাফিক তারা যাদের কথা কাজের বিপরীত এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)أسَاسُ النِّفَاقِ:
কপটতার মূল ভিত্তি: কপটতার মূল ভিত্তি হল কুফর ও কাপুরুষতা। কুফর-মুনাফিক যা গোপন করে রাখে, আর কাপুরুষতা হল যে কারণে অভ্যন্তরীণের বিপরীত বাহ্যিক প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে মুনাফিকরা কাপুরুষ ও দুর্বল মনের হয়ে থাকে। (উসূলুদ দাওয়াহ ৩৯৭ পৃ:)
মুনাফিক দু’প্রকার। যথা:
১. منافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, এরা নিজেদের সম্মান ও জান-মাল রক্ষা করার জন্য অথবা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুখে ইসলামের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা পরিপূর্ণ। এরা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ)
“মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।”(সূরা নিসা ৪:১৪৫)
এ প্রকার মুনাফিকদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার মধ্যে আলোচনা করেছেন।
২. منافق عملي
বা আমলগত মুনাফিক। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصَلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّي يَدَعَهَا: إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
“যার মাঝে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মাঝে এগুলোর একটি পাওয়া যাবে তার মাঝে সেরূপ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পরিত্যাগ করে- যখন কথা বলে তখন মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে, এবং ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে।”(সহীহ বুখারী হা: ৩৪)
কোন মু’মিন ব্যক্তির আমলে বাহ্যিকভাবে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না। কিন্তু যার অন্তরে এবং আমলে এ স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারাহসহ অন্যান্য যে সকল সূরাতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেمنافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, যারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। (তাফসীরে সা‘দী পৃ.: ১৯)
মাদানী সূরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মক্কায় কোন মুনাফিক ছিল না; বরং সেখানে ছিল ঈমানদারদের বিপরীত কাফির ও মুশরিক, তবে কিছু লোক এমন ছিলেন যারা বাহ্যত ও আপাত দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু ইয়াহূদীরা স্বীয় মতবাদে বহাল থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালাম সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব ইয়াহূদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলো গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এ দলের সূচনা এভাবে হয় যে, মদীনায় ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১. বানু কাইনুকা ২. বানু নাযীর এবং ৩. বানু কুরাইযা।
বনূ কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকি দু’টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জয়যুক্ত করলেন, ইসলামের জয়ডংকা চারিদিকে বেজে উঠল ও তার অপূর্ব দীপ্তি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠল, মুসলিমদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হল ও কাফিরদের গর্ব খর্ব হয়ে গেল, তখনই এ খবীস দলের গোড়া পত্তন হয়। আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশা বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এ গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হবার আশায় গুড়েবালি পড়ল। এ দুঃখ-পরিতাপ তো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় তাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
এখন সে চিন্তা করল যে, এভাবে কাজ হবে না। সুতরাং সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দলের কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এ গোপন পন্থা বাতলে দিল। এভাবে মদীনা ও তার আশেপাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়িম হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলার ফযলে এ কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেন না, আর থাকবেই বা কেন? এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা রাহে কুরবান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের কিছু আলামত ও বৈশিষ্ট্য:
১. مرض القلب বা অন্তরের ব্যাধি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”(সূরা বাকারাহ ২:১০)
২. الإفساد في الأرض বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِﺫ قَالُوْٓا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَﭚاَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلٰکِنْ لَّا یَشْعُرُوْنَﭛ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১১-১২)
৩. رميهم المؤمنين بالسفه বা মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া:
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ اٰمِنُوْا کَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوْٓا اَنُؤْمِنُ کَمَآ اٰمَنَ السُّفَھَا۬ئُﺚ اَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ السُّفَھَا۬ئُ وَلٰکِنْ لَّا یَعْلَمُوْنَ)
“এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে তোমরাও অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা বলে, নির্বোধেরা যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ কিন্তু তারা জানে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১৩)
৪. الخداع والرياء والتكاسل عن أداءالعبادات বা প্রতারণা করা, লোক দেখানো ইবাদত করা এবং ইবাদাতে শৈথিল্যতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًاﯝﺬ مُّذَبْذَبِیْنَ بَیْنَ ذٰلِکَﺣ لَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِ وَلَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَلَنْ تَجِدَ لَھ۫ سَبِیْلًاﯞ)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে; দোটানায় দোদুল্যমান- না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না।”(সূরা নিসা ৪:১৪২-৪৩)
৫. الاستهزاء باللّٰه واياته و رسوله বা আল্লাহ, রাসূল ও দীনের বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَبِاللّٰهِ وَآيَاتِه۪ وَرَسُولِه۪ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ)
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” (সূরা তাওবাহ ৯:৬৫)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوآ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ)
“এবং যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন তারা নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি।”(সূরা বাকারাহ ২:১৪)
৬. مؤالاة الكافرين والتربص بالمؤمين বা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও মু’মিনদের ক্ষতির প্রতীক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মান্তিুক শাস্তি রয়েছে। মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না; অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন। যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদের মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”(সূরা নিসা ৪:১৩৮-১৪১)
৭. اللد في الخصومة والعزة بالإثم বা অধিক ঝগড়াটে ও পাপ কাজে সম্মান খুঁজে:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُکَ قَوْلُھ۫ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَیُشْھِدُ اللہَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِھ۪ﺫ وَھُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِﰛ وَاِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الْاَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیْھَا وَیُھْلِکَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَﺚ وَاللہُ لَا یُحِبُّ الْفَسَادَﰜ وَاِذَا قِیْلَ لَھُ اتَّقِ اللہَ اَخَذَتْھُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُھ۫ جَھَنَّمُﺚ وَلَبِئْسَ الْمِھَادُﰝ)
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যার পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কথা তোমাকে অবাক করে তোলে। আর সে তার মনের বিষয়ের ওপর আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। মূলত সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আর যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি ছড়াতে এবং শস্য-ক্ষেত্র ও জীবজন্তু বিনাশের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি ভালবাসেন না। যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে দেয়। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২:২০৪-২০৬)
৮. الإفساد بين المؤمنين বা মু’মিনদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللّٰهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ)
“তারা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো। তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শোনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:৪৭)
৯. الغدر وعدم الوفاء بالعهد বা বিশ্বাসঘাতকতা ও অঙ্গীকার পূর্ণ না করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْھُمْ مَّنْ عٰھَدَ اللہَ لَئِنْ اٰتٰٿنَا مِنْ فَضْلِھ۪ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَکُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَﮚفَلَمَّآ اٰتٰٿھُمْ مِّنْ فَضْلِھ۪ بَخِلُوْا بِھ۪ وَتَوَلَّوْا وَّھُمْ مُّعْرِضُوْنَﮛفَاَعْقَبَھُمْ نِفَاقًا فِیْ قُلُوْبِھِمْ اِلٰی یَوْمِ یَلْقَوْنَھ۫ بِمَآ اَخْلَفُوا اللہَ مَا وَعَدُوْھُ وَبِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَﮜ)
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল, ‘আল্লাহ নিজ কৃপায় আমাদেরকে দান করলে আমরা নিশ্চয়ই সদাকাহ দেবো এবং অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করলো এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরালো। পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল করে দিলেন করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল সেটা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৭৫-৭৭)
১০. الأمر بالمنكر و النهي عن المعروف বা অসৎ কাজের নির্দেশ ও সৎ কাজে বাধা প্রদান করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ بَعْضُھُمْ مِّنْۭ بَعْضٍﺭ یَاْمُرُوْنَ بِالْمُنْکَرِ وَیَنْھَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَیَقْبِضُوْنَ اَیْدِیَھُمْﺚ نَسُوا اللہَ فَنَسِیَھُمْﺚ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ ھُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“মুনাফিক নর ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে, তারা হাত বন্ধ করে রাখে, তারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে বিস্মৃত হয়েছেন; মুনাফিকেরা তো পাপাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৭)
১১. التحاكم الي الطاغوت: বা তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّھُمْ اٰمَنُوْا بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاکَمُوْٓا اِلَی الطَّاغُوْتِ وَقَدْ اُمِرُوْٓا اَنْ یَّکْفُرُوْا بِھ۪ﺚ وَیُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّھُمْ ضَلٰلًۭا بَعِیْدًا)
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।”(সূরা নিসা ৪:৬০)
১২. الصدود عن الله ورسوله বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ تَعَالَوْا اِلٰی مَآ اَنْزَلَ اللہُ وَاِلَی الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْکَ صُدُوْدًاﮌﺆفَکَیْفَ اِذَآ اَصَابَتْھُمْ مُّصِیْبَةٌۭ بِمَا قَدَّمَتْ اَیْدِیْھِمْ ثُمَّ جَا۬ءُوْکَ یَحْلِفُوْنَﺣ بِاللہِ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّآ اِحْسَانًا وَّتَوْفِیْقًا)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন তাদের কোন মুসীবত হবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করতে করতে তোমার নিকট এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছুই চাইনি।’(সূরা নিসা ৪:৬১-৬২)
১৩. الكذب والخوف وكره المسلمين বা মিথ্যা, ভয় ও মুসলিমদের অপছন্দ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَحْلِفُوْنَ بِاللہِ اِنَّھُمْ لَمِنْکُمْﺚ وَمَا ھُمْ مِّنْکُمْ وَلٰکِنَّھُمْ قَوْمٌ یَّفْرَقُوْنَﮇلَوْ یَجِدُوْنَ مَلْجَاً اَوْ مَغٰرٰتٍ اَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا اِلَیْھِ وَھُمْ یَجْمَحُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে সদাকাহ বণ্টন সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে, অতঃপর এটার কিছু তাদেরকে দেয়া হলে তারা পরিতুষ্ট হয়, আর এটার কিছু তাদেরকে না দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা বিক্ষুব্ধ হয়।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫৬ - ৫৭)
১৪. الإضرار بالمؤمنين বা মু’মিনদের ক্ষতিসাধন করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَّکُفْرًا وَّتَفْرِیْقًۭا بَیْنَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَاِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللہَ وَرَسُوْلَھ۫ مِنْ قَبْلُﺚ وَلَیَحْلِفُنَّ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّا الْحُسْنٰیﺚ وَاللہُ یَشْھَدُ اِنَّھُمْ لَکٰذِبُوْنَ)
“এবং যারা মাসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই সেটা করেছি’; আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০৭)
প্রথম দুই আয়াতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও মূলত প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও হয়তো এ কথা ভাবে না যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুণই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে ধোঁকাবাজি করছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِنْ یُّرِیْدُوْٓا اَنْ یَّخْدَعُوْکَ فَاِنَّ حَسْبَکَ اللہُﺚ ھُوَ الَّذِیْٓ اَیَّدَکَ بِنَصْرِھ۪ وَبِالْمُؤْمِنِیْنَ)
“যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।”(সূরা আনফাল ৮:৬২)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকেও নয় বরং তারা ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজেরাই ধোঁকায় পতিত হয়। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।”(সূরা নিসা ৪:১৪২)
এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ধোঁকা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মু’মিনগণও ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত হয়ে সমস্ত ধোঁকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ ছিলেন।
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধি এর অর্থ হচ্ছে شك বা সংশয়। এরূপ মত পোষণ করেছেন- মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বসরী, আবুল আলিয়া ও কাতাদাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) । ত্বাওস (রহঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধির অর্থ হচ্ছে رياء বা লোক দেখানোর জন্য কাজ করা।
আবদুর রহমান বিন যায়িদ (রহঃ) বলেন: مرض অর্থ হচ্ছে “দীনের ব্যাপারে তাদের অন্তরের ব্যাধি” শারীরিক ব্যাধি নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন: ব্যাধি দুই প্রকার। উভয় প্রকারের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
১. مرض الشكوك والشبهات বা সংশয় ও সন্দেহের ব্যাধি:
যেমন কুফরী, মুনাফিকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস ইত্যাদি এ প্রকার ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধির আরোগ্য দান না করেন তাহলে তা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এখানে এ ব্যাধির কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَتَرَی الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوْنَ فِیْھِمْ یَقُوْلُوْنَ نَخْشٰٓی اَنْ تُصِیْبَنَا دَا۬ئِرَةٌ)
“আর আপনি তাদের দেখবেন যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে যে, তারা দৌড়ে গিয়ে ওদেরই মধ্যে ঢুকে এ বলে যে, আমরা ভয় করছি আমাদের ওপর না জানি কোন মুসিবত পতিত হয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫: ৫২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ غَرَّ ھٰٓؤُلَا۬ئِ دِیْنُھُمْﺚ وَمَنْ یَّتَوَکَّلْ عَلَی اللہِ فَاِنَّ اللہَ عَزِیْزٌ حَکِیْمٌ)
“স্মরণ কর, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ‘এদের দীন এদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আনফাল ৮:৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আরোও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন: সূরা মায়িদার ৫২ নং, সূরা আনফালের ৪৯ নং ও সূরা তাওবার ১২৫ নং আয়াত।
২. مرض الشهوات বা প্রবৃত্তির ব্যাধি:
যেমন অন্যায়-অশ্লীল, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী কাজের প্রতি লালসা ইত্যাদি। এ প্রকার ব্যাধি দূরিকরণে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِھ۪ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا)
“কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে অন্তরে যার (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে- সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩২) (“আত-তিব্বু আন-নব্বী”- লি ইবনিল কায়্যিম) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু’প্রকার ব্যাধি ও মুনাফিকী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের পূর্বের পাপের দরুন তাদের পরিণতির জন্য বিভিন্ন অবাধ্য কাজ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ)
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”(সূরা সাফ ৬১:৫) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিকদেরকে চেনা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে হত্যা করেননি? উমারও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি তাদেরকে হত্যা করে ফেলি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:دَعْهُ، لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ
তাকে ছেড়ে দাও! মানুষ যাতে সমালোচনা করতে না পারে (এই বলে) যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯০৫, ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা:২৫৮৪)
অর্থাৎ বেদুঈন আরবরা মুনাফিকদের হত্যার কারণ না জেনে শুধু বাহ্যিকভাবে অপপ্রচার শুনে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে, আর বলবে মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করে। এ অপপ্রচারের আশংকায় তাদেরকে হত্যা করা হয়নি।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা নিজেদের সম্মান, সম্পদ ও অসৎ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্তরে কুফরী রেখে বাহ্যিক ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই মুনাফিক। এরাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে বেশি ক্ষতিকর।
২. বিশ্বাসগত মুনাফিকরা কাফির। কিন্তু আমলগত মুনাফিকরা কাফির নয়, তবে বড় ধরনের অপরাধী।
৩. সংশয় ও সন্দেহ ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধি থেকে মুক্ত না করেন। তাই বেশি বেশিيا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ” এ দু‘আটি পড়া উচিত।
৪. কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম। সুতরাং আল্লাহভীরু মু’মিন ব্যক্তিকে ঐ সব কর্ম হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
2:9
یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰہَ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ وَ مَا یَخۡدَعُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَہُمۡ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ ؕ﴿۹﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা সূরার শুরুতে মু’মিন-মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাদের বিপরীতে কাফিরদের কথা তুলে ধরেছেন, অতঃপর এ আয়াত থেকে পনের নং আয়াত পর্যন্ত যারা বাহ্যিক ঈমানের দাবিদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফির তাদের কথা আলোচনা করেছেন। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য এ মুনাফিকরাই কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ مَرَدُوا عَلَي النِّفَاقِ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কপটতায় সিদ্ধহস্ত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০১)
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আরো বলেন:
(يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ)
“মুনাফিকেরা ভয় করে যে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৪)مُنَافِق শব্দটি نفاق মূলধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ কপটতা, দ্বিমুখিতা, মুনাফিকী ইত্যাদি।
শরয়ী পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়- যারা অন্তরে কুফরী গোপন রাখে এবং বাহ্যিক ঈমান প্রকাশ করে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: نفاق হল ভাল প্রকাশ করা ও মন্দ গোপন করা। ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: মুনাফিক তারা যাদের কথা কাজের বিপরীত এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)أسَاسُ النِّفَاقِ:
কপটতার মূল ভিত্তি: কপটতার মূল ভিত্তি হল কুফর ও কাপুরুষতা। কুফর-মুনাফিক যা গোপন করে রাখে, আর কাপুরুষতা হল যে কারণে অভ্যন্তরীণের বিপরীত বাহ্যিক প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে মুনাফিকরা কাপুরুষ ও দুর্বল মনের হয়ে থাকে। (উসূলুদ দাওয়াহ ৩৯৭ পৃ:)
মুনাফিক দু’প্রকার। যথা:
১. منافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, এরা নিজেদের সম্মান ও জান-মাল রক্ষা করার জন্য অথবা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুখে ইসলামের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা পরিপূর্ণ। এরা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ)
“মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।”(সূরা নিসা ৪:১৪৫)
এ প্রকার মুনাফিকদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার মধ্যে আলোচনা করেছেন।
২. منافق عملي
বা আমলগত মুনাফিক। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصَلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّي يَدَعَهَا: إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
“যার মাঝে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মাঝে এগুলোর একটি পাওয়া যাবে তার মাঝে সেরূপ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পরিত্যাগ করে- যখন কথা বলে তখন মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে, এবং ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে।”(সহীহ বুখারী হা: ৩৪)
কোন মু’মিন ব্যক্তির আমলে বাহ্যিকভাবে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না। কিন্তু যার অন্তরে এবং আমলে এ স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারাহসহ অন্যান্য যে সকল সূরাতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেمنافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, যারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। (তাফসীরে সা‘দী পৃ.: ১৯)
মাদানী সূরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মক্কায় কোন মুনাফিক ছিল না; বরং সেখানে ছিল ঈমানদারদের বিপরীত কাফির ও মুশরিক, তবে কিছু লোক এমন ছিলেন যারা বাহ্যত ও আপাত দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু ইয়াহূদীরা স্বীয় মতবাদে বহাল থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালাম সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব ইয়াহূদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলো গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এ দলের সূচনা এভাবে হয় যে, মদীনায় ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১. বানু কাইনুকা ২. বানু নাযীর এবং ৩. বানু কুরাইযা।
বনূ কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকি দু’টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জয়যুক্ত করলেন, ইসলামের জয়ডংকা চারিদিকে বেজে উঠল ও তার অপূর্ব দীপ্তি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠল, মুসলিমদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হল ও কাফিরদের গর্ব খর্ব হয়ে গেল, তখনই এ খবীস দলের গোড়া পত্তন হয়। আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশা বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এ গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হবার আশায় গুড়েবালি পড়ল। এ দুঃখ-পরিতাপ তো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় তাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
এখন সে চিন্তা করল যে, এভাবে কাজ হবে না। সুতরাং সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দলের কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এ গোপন পন্থা বাতলে দিল। এভাবে মদীনা ও তার আশেপাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়িম হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলার ফযলে এ কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেন না, আর থাকবেই বা কেন? এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা রাহে কুরবান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের কিছু আলামত ও বৈশিষ্ট্য:
১. مرض القلب বা অন্তরের ব্যাধি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”(সূরা বাকারাহ ২:১০)
২. الإفساد في الأرض বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِﺫ قَالُوْٓا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَﭚاَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلٰکِنْ لَّا یَشْعُرُوْنَﭛ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১১-১২)
৩. رميهم المؤمنين بالسفه বা মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া:
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ اٰمِنُوْا کَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوْٓا اَنُؤْمِنُ کَمَآ اٰمَنَ السُّفَھَا۬ئُﺚ اَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ السُّفَھَا۬ئُ وَلٰکِنْ لَّا یَعْلَمُوْنَ)
“এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে তোমরাও অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা বলে, নির্বোধেরা যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ কিন্তু তারা জানে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১৩)
৪. الخداع والرياء والتكاسل عن أداءالعبادات বা প্রতারণা করা, লোক দেখানো ইবাদত করা এবং ইবাদাতে শৈথিল্যতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًاﯝﺬ مُّذَبْذَبِیْنَ بَیْنَ ذٰلِکَﺣ لَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِ وَلَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَلَنْ تَجِدَ لَھ۫ سَبِیْلًاﯞ)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে; দোটানায় দোদুল্যমান- না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না।”(সূরা নিসা ৪:১৪২-৪৩)
৫. الاستهزاء باللّٰه واياته و رسوله বা আল্লাহ, রাসূল ও দীনের বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَبِاللّٰهِ وَآيَاتِه۪ وَرَسُولِه۪ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ)
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” (সূরা তাওবাহ ৯:৬৫)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوآ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ)
“এবং যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন তারা নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি।”(সূরা বাকারাহ ২:১৪)
৬. مؤالاة الكافرين والتربص بالمؤمين বা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও মু’মিনদের ক্ষতির প্রতীক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মান্তিুক শাস্তি রয়েছে। মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না; অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন। যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদের মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”(সূরা নিসা ৪:১৩৮-১৪১)
৭. اللد في الخصومة والعزة بالإثم বা অধিক ঝগড়াটে ও পাপ কাজে সম্মান খুঁজে:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُکَ قَوْلُھ۫ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَیُشْھِدُ اللہَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِھ۪ﺫ وَھُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِﰛ وَاِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الْاَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیْھَا وَیُھْلِکَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَﺚ وَاللہُ لَا یُحِبُّ الْفَسَادَﰜ وَاِذَا قِیْلَ لَھُ اتَّقِ اللہَ اَخَذَتْھُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُھ۫ جَھَنَّمُﺚ وَلَبِئْسَ الْمِھَادُﰝ)
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যার পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কথা তোমাকে অবাক করে তোলে। আর সে তার মনের বিষয়ের ওপর আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। মূলত সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আর যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি ছড়াতে এবং শস্য-ক্ষেত্র ও জীবজন্তু বিনাশের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি ভালবাসেন না। যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে দেয়। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২:২০৪-২০৬)
৮. الإفساد بين المؤمنين বা মু’মিনদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللّٰهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ)
“তারা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো। তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শোনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:৪৭)
৯. الغدر وعدم الوفاء بالعهد বা বিশ্বাসঘাতকতা ও অঙ্গীকার পূর্ণ না করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْھُمْ مَّنْ عٰھَدَ اللہَ لَئِنْ اٰتٰٿنَا مِنْ فَضْلِھ۪ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَکُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَﮚفَلَمَّآ اٰتٰٿھُمْ مِّنْ فَضْلِھ۪ بَخِلُوْا بِھ۪ وَتَوَلَّوْا وَّھُمْ مُّعْرِضُوْنَﮛفَاَعْقَبَھُمْ نِفَاقًا فِیْ قُلُوْبِھِمْ اِلٰی یَوْمِ یَلْقَوْنَھ۫ بِمَآ اَخْلَفُوا اللہَ مَا وَعَدُوْھُ وَبِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَﮜ)
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল, ‘আল্লাহ নিজ কৃপায় আমাদেরকে দান করলে আমরা নিশ্চয়ই সদাকাহ দেবো এবং অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করলো এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরালো। পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল করে দিলেন করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল সেটা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৭৫-৭৭)
১০. الأمر بالمنكر و النهي عن المعروف বা অসৎ কাজের নির্দেশ ও সৎ কাজে বাধা প্রদান করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ بَعْضُھُمْ مِّنْۭ بَعْضٍﺭ یَاْمُرُوْنَ بِالْمُنْکَرِ وَیَنْھَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَیَقْبِضُوْنَ اَیْدِیَھُمْﺚ نَسُوا اللہَ فَنَسِیَھُمْﺚ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ ھُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“মুনাফিক নর ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে, তারা হাত বন্ধ করে রাখে, তারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে বিস্মৃত হয়েছেন; মুনাফিকেরা তো পাপাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৭)
১১. التحاكم الي الطاغوت: বা তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّھُمْ اٰمَنُوْا بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاکَمُوْٓا اِلَی الطَّاغُوْتِ وَقَدْ اُمِرُوْٓا اَنْ یَّکْفُرُوْا بِھ۪ﺚ وَیُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّھُمْ ضَلٰلًۭا بَعِیْدًا)
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।”(সূরা নিসা ৪:৬০)
১২. الصدود عن الله ورسوله বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ تَعَالَوْا اِلٰی مَآ اَنْزَلَ اللہُ وَاِلَی الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْکَ صُدُوْدًاﮌﺆفَکَیْفَ اِذَآ اَصَابَتْھُمْ مُّصِیْبَةٌۭ بِمَا قَدَّمَتْ اَیْدِیْھِمْ ثُمَّ جَا۬ءُوْکَ یَحْلِفُوْنَﺣ بِاللہِ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّآ اِحْسَانًا وَّتَوْفِیْقًا)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন তাদের কোন মুসীবত হবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করতে করতে তোমার নিকট এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছুই চাইনি।’(সূরা নিসা ৪:৬১-৬২)
১৩. الكذب والخوف وكره المسلمين বা মিথ্যা, ভয় ও মুসলিমদের অপছন্দ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَحْلِفُوْنَ بِاللہِ اِنَّھُمْ لَمِنْکُمْﺚ وَمَا ھُمْ مِّنْکُمْ وَلٰکِنَّھُمْ قَوْمٌ یَّفْرَقُوْنَﮇلَوْ یَجِدُوْنَ مَلْجَاً اَوْ مَغٰرٰتٍ اَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا اِلَیْھِ وَھُمْ یَجْمَحُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে সদাকাহ বণ্টন সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে, অতঃপর এটার কিছু তাদেরকে দেয়া হলে তারা পরিতুষ্ট হয়, আর এটার কিছু তাদেরকে না দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা বিক্ষুব্ধ হয়।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫৬ - ৫৭)
১৪. الإضرار بالمؤمنين বা মু’মিনদের ক্ষতিসাধন করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَّکُفْرًا وَّتَفْرِیْقًۭا بَیْنَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَاِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللہَ وَرَسُوْلَھ۫ مِنْ قَبْلُﺚ وَلَیَحْلِفُنَّ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّا الْحُسْنٰیﺚ وَاللہُ یَشْھَدُ اِنَّھُمْ لَکٰذِبُوْنَ)
“এবং যারা মাসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই সেটা করেছি’; আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০৭)
প্রথম দুই আয়াতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও মূলত প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও হয়তো এ কথা ভাবে না যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুণই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে ধোঁকাবাজি করছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِنْ یُّرِیْدُوْٓا اَنْ یَّخْدَعُوْکَ فَاِنَّ حَسْبَکَ اللہُﺚ ھُوَ الَّذِیْٓ اَیَّدَکَ بِنَصْرِھ۪ وَبِالْمُؤْمِنِیْنَ)
“যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।”(সূরা আনফাল ৮:৬২)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকেও নয় বরং তারা ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজেরাই ধোঁকায় পতিত হয়। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।”(সূরা নিসা ৪:১৪২)
এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ধোঁকা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মু’মিনগণও ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত হয়ে সমস্ত ধোঁকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ ছিলেন।
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধি এর অর্থ হচ্ছে شك বা সংশয়। এরূপ মত পোষণ করেছেন- মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বসরী, আবুল আলিয়া ও কাতাদাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) । ত্বাওস (রহঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধির অর্থ হচ্ছে رياء বা লোক দেখানোর জন্য কাজ করা।
আবদুর রহমান বিন যায়িদ (রহঃ) বলেন: مرض অর্থ হচ্ছে “দীনের ব্যাপারে তাদের অন্তরের ব্যাধি” শারীরিক ব্যাধি নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন: ব্যাধি দুই প্রকার। উভয় প্রকারের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
১. مرض الشكوك والشبهات বা সংশয় ও সন্দেহের ব্যাধি:
যেমন কুফরী, মুনাফিকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস ইত্যাদি এ প্রকার ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধির আরোগ্য দান না করেন তাহলে তা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এখানে এ ব্যাধির কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَتَرَی الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوْنَ فِیْھِمْ یَقُوْلُوْنَ نَخْشٰٓی اَنْ تُصِیْبَنَا دَا۬ئِرَةٌ)
“আর আপনি তাদের দেখবেন যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে যে, তারা দৌড়ে গিয়ে ওদেরই মধ্যে ঢুকে এ বলে যে, আমরা ভয় করছি আমাদের ওপর না জানি কোন মুসিবত পতিত হয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫: ৫২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ غَرَّ ھٰٓؤُلَا۬ئِ دِیْنُھُمْﺚ وَمَنْ یَّتَوَکَّلْ عَلَی اللہِ فَاِنَّ اللہَ عَزِیْزٌ حَکِیْمٌ)
“স্মরণ কর, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ‘এদের দীন এদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আনফাল ৮:৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আরোও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন: সূরা মায়িদার ৫২ নং, সূরা আনফালের ৪৯ নং ও সূরা তাওবার ১২৫ নং আয়াত।
২. مرض الشهوات বা প্রবৃত্তির ব্যাধি:
যেমন অন্যায়-অশ্লীল, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী কাজের প্রতি লালসা ইত্যাদি। এ প্রকার ব্যাধি দূরিকরণে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِھ۪ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا)
“কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে অন্তরে যার (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে- সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩২) (“আত-তিব্বু আন-নব্বী”- লি ইবনিল কায়্যিম) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু’প্রকার ব্যাধি ও মুনাফিকী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের পূর্বের পাপের দরুন তাদের পরিণতির জন্য বিভিন্ন অবাধ্য কাজ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ)
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”(সূরা সাফ ৬১:৫) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিকদেরকে চেনা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে হত্যা করেননি? উমারও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি তাদেরকে হত্যা করে ফেলি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:دَعْهُ، لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ
তাকে ছেড়ে দাও! মানুষ যাতে সমালোচনা করতে না পারে (এই বলে) যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯০৫, ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা:২৫৮৪)
অর্থাৎ বেদুঈন আরবরা মুনাফিকদের হত্যার কারণ না জেনে শুধু বাহ্যিকভাবে অপপ্রচার শুনে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে, আর বলবে মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করে। এ অপপ্রচারের আশংকায় তাদেরকে হত্যা করা হয়নি।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. যারা নিজেদের সম্মান, সম্পদ ও অসৎ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্তরে কুফরী রেখে বাহ্যিক ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই মুনাফিক। এরাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে বেশি ক্ষতিকর।
২. বিশ্বাসগত মুনাফিকরা কাফির। কিন্তু আমলগত মুনাফিকরা কাফির নয়, তবে বড় ধরনের অপরাধী।
৩. সংশয় ও সন্দেহ ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধি থেকে মুক্ত না করেন। তাই বেশি বেশি
يا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ” এ দু‘আটি পড়া উচিত।
৪. কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম। সুতরাং আল্লাহভীরু মু’মিন ব্যক্তিকে ঐ সব কর্ম হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরার শুরুতে মু’মিন-মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাদের বিপরীতে কাফিরদের কথা তুলে ধরেছেন, অতঃপর এ আয়াত থেকে পনের নং আয়াত পর্যন্ত যারা বাহ্যিক ঈমানের দাবিদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফির তাদের কথা আলোচনা করেছেন। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য এ মুনাফিকরাই কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ مَرَدُوا عَلَي النِّفَاقِ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কপটতায় সিদ্ধহস্ত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০১)
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আরো বলেন:
(يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ)
“মুনাফিকেরা ভয় করে যে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৪)مُنَافِق শব্দটি نفاق মূলধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ কপটতা, দ্বিমুখিতা, মুনাফিকী ইত্যাদি।
শরয়ী পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়- যারা অন্তরে কুফরী গোপন রাখে এবং বাহ্যিক ঈমান প্রকাশ করে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: نفاق হল ভাল প্রকাশ করা ও মন্দ গোপন করা। ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: মুনাফিক তারা যাদের কথা কাজের বিপরীত এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)أسَاسُ النِّفَاقِ:
কপটতার মূল ভিত্তি: কপটতার মূল ভিত্তি হল কুফর ও কাপুরুষতা। কুফর-মুনাফিক যা গোপন করে রাখে, আর কাপুরুষতা হল যে কারণে অভ্যন্তরীণের বিপরীত বাহ্যিক প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে মুনাফিকরা কাপুরুষ ও দুর্বল মনের হয়ে থাকে। (উসূলুদ দাওয়াহ ৩৯৭ পৃ:)
মুনাফিক দু’প্রকার। যথা:
১. منافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, এরা নিজেদের সম্মান ও জান-মাল রক্ষা করার জন্য অথবা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুখে ইসলামের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা পরিপূর্ণ। এরা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ)
“মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।”(সূরা নিসা ৪:১৪৫)
এ প্রকার মুনাফিকদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার মধ্যে আলোচনা করেছেন।
২. منافق عملي
বা আমলগত মুনাফিক। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصَلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّي يَدَعَهَا: إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
“যার মাঝে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মাঝে এগুলোর একটি পাওয়া যাবে তার মাঝে সেরূপ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পরিত্যাগ করে- যখন কথা বলে তখন মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে, এবং ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে।”(সহীহ বুখারী হা: ৩৪)
কোন মু’মিন ব্যক্তির আমলে বাহ্যিকভাবে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না। কিন্তু যার অন্তরে এবং আমলে এ স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারাহসহ অন্যান্য যে সকল সূরাতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেمنافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, যারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। (তাফসীরে সা‘দী পৃ.: ১৯)
মাদানী সূরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মক্কায় কোন মুনাফিক ছিল না; বরং সেখানে ছিল ঈমানদারদের বিপরীত কাফির ও মুশরিক, তবে কিছু লোক এমন ছিলেন যারা বাহ্যত ও আপাত দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু ইয়াহূদীরা স্বীয় মতবাদে বহাল থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালাম সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব ইয়াহূদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলো গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এ দলের সূচনা এভাবে হয় যে, মদীনায় ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১. বানু কাইনুকা ২. বানু নাযীর এবং ৩. বানু কুরাইযা।
বনূ কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকি দু’টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জয়যুক্ত করলেন, ইসলামের জয়ডংকা চারিদিকে বেজে উঠল ও তার অপূর্ব দীপ্তি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠল, মুসলিমদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হল ও কাফিরদের গর্ব খর্ব হয়ে গেল, তখনই এ খবীস দলের গোড়া পত্তন হয়। আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশা বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এ গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হবার আশায় গুড়েবালি পড়ল। এ দুঃখ-পরিতাপ তো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় তাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
এখন সে চিন্তা করল যে, এভাবে কাজ হবে না। সুতরাং সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দলের কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এ গোপন পন্থা বাতলে দিল। এভাবে মদীনা ও তার আশেপাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়িম হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলার ফযলে এ কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেন না, আর থাকবেই বা কেন? এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা রাহে কুরবান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের কিছু আলামত ও বৈশিষ্ট্য:
১. مرض القلب বা অন্তরের ব্যাধি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”(সূরা বাকারাহ ২:১০)
২. الإفساد في الأرض বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِﺫ قَالُوْٓا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَﭚاَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلٰکِنْ لَّا یَشْعُرُوْنَﭛ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১১-১২)
৩. رميهم المؤمنين بالسفه বা মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া:
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ اٰمِنُوْا کَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوْٓا اَنُؤْمِنُ کَمَآ اٰمَنَ السُّفَھَا۬ئُﺚ اَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ السُّفَھَا۬ئُ وَلٰکِنْ لَّا یَعْلَمُوْنَ)
“এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে তোমরাও অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা বলে, নির্বোধেরা যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ কিন্তু তারা জানে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১৩)
৪. الخداع والرياء والتكاسل عن أداءالعبادات বা প্রতারণা করা, লোক দেখানো ইবাদত করা এবং ইবাদাতে শৈথিল্যতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًاﯝﺬ مُّذَبْذَبِیْنَ بَیْنَ ذٰلِکَﺣ لَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِ وَلَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَلَنْ تَجِدَ لَھ۫ سَبِیْلًاﯞ)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে; দোটানায় দোদুল্যমান- না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না।”(সূরা নিসা ৪:১৪২-৪৩)
৫. الاستهزاء باللّٰه واياته و رسوله বা আল্লাহ, রাসূল ও দীনের বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَبِاللّٰهِ وَآيَاتِه۪ وَرَسُولِه۪ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ)
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” (সূরা তাওবাহ ৯:৬৫)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوآ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ)
“এবং যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন তারা নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি।”(সূরা বাকারাহ ২:১৪)
৬. مؤالاة الكافرين والتربص بالمؤمين বা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও মু’মিনদের ক্ষতির প্রতীক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মান্তিুক শাস্তি রয়েছে। মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না; অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন। যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদের মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”(সূরা নিসা ৪:১৩৮-১৪১)
৭. اللد في الخصومة والعزة بالإثم বা অধিক ঝগড়াটে ও পাপ কাজে সম্মান খুঁজে:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُکَ قَوْلُھ۫ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَیُشْھِدُ اللہَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِھ۪ﺫ وَھُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِﰛ وَاِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الْاَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیْھَا وَیُھْلِکَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَﺚ وَاللہُ لَا یُحِبُّ الْفَسَادَﰜ وَاِذَا قِیْلَ لَھُ اتَّقِ اللہَ اَخَذَتْھُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُھ۫ جَھَنَّمُﺚ وَلَبِئْسَ الْمِھَادُﰝ)
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যার পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কথা তোমাকে অবাক করে তোলে। আর সে তার মনের বিষয়ের ওপর আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। মূলত সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আর যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি ছড়াতে এবং শস্য-ক্ষেত্র ও জীবজন্তু বিনাশের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি ভালবাসেন না। যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে দেয়। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২:২০৪-২০৬)
৮. الإفساد بين المؤمنين বা মু’মিনদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللّٰهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ)
“তারা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো। তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শোনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:৪৭)
৯. الغدر وعدم الوفاء بالعهد বা বিশ্বাসঘাতকতা ও অঙ্গীকার পূর্ণ না করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْھُمْ مَّنْ عٰھَدَ اللہَ لَئِنْ اٰتٰٿنَا مِنْ فَضْلِھ۪ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَکُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَﮚفَلَمَّآ اٰتٰٿھُمْ مِّنْ فَضْلِھ۪ بَخِلُوْا بِھ۪ وَتَوَلَّوْا وَّھُمْ مُّعْرِضُوْنَﮛفَاَعْقَبَھُمْ نِفَاقًا فِیْ قُلُوْبِھِمْ اِلٰی یَوْمِ یَلْقَوْنَھ۫ بِمَآ اَخْلَفُوا اللہَ مَا وَعَدُوْھُ وَبِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَﮜ)
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল, ‘আল্লাহ নিজ কৃপায় আমাদেরকে দান করলে আমরা নিশ্চয়ই সদাকাহ দেবো এবং অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করলো এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরালো। পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল করে দিলেন করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল সেটা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৭৫-৭৭)
১০. الأمر بالمنكر و النهي عن المعروف বা অসৎ কাজের নির্দেশ ও সৎ কাজে বাধা প্রদান করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ بَعْضُھُمْ مِّنْۭ بَعْضٍﺭ یَاْمُرُوْنَ بِالْمُنْکَرِ وَیَنْھَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَیَقْبِضُوْنَ اَیْدِیَھُمْﺚ نَسُوا اللہَ فَنَسِیَھُمْﺚ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ ھُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“মুনাফিক নর ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে, তারা হাত বন্ধ করে রাখে, তারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে বিস্মৃত হয়েছেন; মুনাফিকেরা তো পাপাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৭)
১১. التحاكم الي الطاغوت: বা তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّھُمْ اٰمَنُوْا بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاکَمُوْٓا اِلَی الطَّاغُوْتِ وَقَدْ اُمِرُوْٓا اَنْ یَّکْفُرُوْا بِھ۪ﺚ وَیُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّھُمْ ضَلٰلًۭا بَعِیْدًا)
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।”(সূরা নিসা ৪:৬০)
১২. الصدود عن الله ورسوله বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ تَعَالَوْا اِلٰی مَآ اَنْزَلَ اللہُ وَاِلَی الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْکَ صُدُوْدًاﮌﺆفَکَیْفَ اِذَآ اَصَابَتْھُمْ مُّصِیْبَةٌۭ بِمَا قَدَّمَتْ اَیْدِیْھِمْ ثُمَّ جَا۬ءُوْکَ یَحْلِفُوْنَﺣ بِاللہِ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّآ اِحْسَانًا وَّتَوْفِیْقًا)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন তাদের কোন মুসীবত হবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করতে করতে তোমার নিকট এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছুই চাইনি।’(সূরা নিসা ৪:৬১-৬২)
১৩. الكذب والخوف وكره المسلمين বা মিথ্যা, ভয় ও মুসলিমদের অপছন্দ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَحْلِفُوْنَ بِاللہِ اِنَّھُمْ لَمِنْکُمْﺚ وَمَا ھُمْ مِّنْکُمْ وَلٰکِنَّھُمْ قَوْمٌ یَّفْرَقُوْنَﮇلَوْ یَجِدُوْنَ مَلْجَاً اَوْ مَغٰرٰتٍ اَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا اِلَیْھِ وَھُمْ یَجْمَحُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে সদাকাহ বণ্টন সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে, অতঃপর এটার কিছু তাদেরকে দেয়া হলে তারা পরিতুষ্ট হয়, আর এটার কিছু তাদেরকে না দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা বিক্ষুব্ধ হয়।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫৬ - ৫৭)
১৪. الإضرار بالمؤمنين বা মু’মিনদের ক্ষতিসাধন করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَّکُفْرًا وَّتَفْرِیْقًۭا بَیْنَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَاِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللہَ وَرَسُوْلَھ۫ مِنْ قَبْلُﺚ وَلَیَحْلِفُنَّ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّا الْحُسْنٰیﺚ وَاللہُ یَشْھَدُ اِنَّھُمْ لَکٰذِبُوْنَ)
“এবং যারা মাসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই সেটা করেছি’; আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০৭)
প্রথম দুই আয়াতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও মূলত প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও হয়তো এ কথা ভাবে না যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুণই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে ধোঁকাবাজি করছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِنْ یُّرِیْدُوْٓا اَنْ یَّخْدَعُوْکَ فَاِنَّ حَسْبَکَ اللہُﺚ ھُوَ الَّذِیْٓ اَیَّدَکَ بِنَصْرِھ۪ وَبِالْمُؤْمِنِیْنَ)
“যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।”(সূরা আনফাল ৮:৬২)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকেও নয় বরং তারা ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজেরাই ধোঁকায় পতিত হয়। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।”(সূরা নিসা ৪:১৪২)
এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ধোঁকা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মু’মিনগণও ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত হয়ে সমস্ত ধোঁকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ ছিলেন।
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধি এর অর্থ হচ্ছে شك বা সংশয়। এরূপ মত পোষণ করেছেন- মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বসরী, আবুল আলিয়া ও কাতাদাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) । ত্বাওস (রহঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধির অর্থ হচ্ছে رياء বা লোক দেখানোর জন্য কাজ করা।
আবদুর রহমান বিন যায়িদ (রহঃ) বলেন: مرض অর্থ হচ্ছে “দীনের ব্যাপারে তাদের অন্তরের ব্যাধি” শারীরিক ব্যাধি নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন: ব্যাধি দুই প্রকার। উভয় প্রকারের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
১. مرض الشكوك والشبهات বা সংশয় ও সন্দেহের ব্যাধি:
যেমন কুফরী, মুনাফিকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস ইত্যাদি এ প্রকার ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধির আরোগ্য দান না করেন তাহলে তা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এখানে এ ব্যাধির কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَتَرَی الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوْنَ فِیْھِمْ یَقُوْلُوْنَ نَخْشٰٓی اَنْ تُصِیْبَنَا دَا۬ئِرَةٌ)
“আর আপনি তাদের দেখবেন যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে যে, তারা দৌড়ে গিয়ে ওদেরই মধ্যে ঢুকে এ বলে যে, আমরা ভয় করছি আমাদের ওপর না জানি কোন মুসিবত পতিত হয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫: ৫২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ غَرَّ ھٰٓؤُلَا۬ئِ دِیْنُھُمْﺚ وَمَنْ یَّتَوَکَّلْ عَلَی اللہِ فَاِنَّ اللہَ عَزِیْزٌ حَکِیْمٌ)
“স্মরণ কর, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ‘এদের দীন এদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আনফাল ৮:৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আরোও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন: সূরা মায়িদার ৫২ নং, সূরা আনফালের ৪৯ নং ও সূরা তাওবার ১২৫ নং আয়াত।
২. مرض الشهوات বা প্রবৃত্তির ব্যাধি:
যেমন অন্যায়-অশ্লীল, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী কাজের প্রতি লালসা ইত্যাদি। এ প্রকার ব্যাধি দূরিকরণে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِھ۪ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا)
“কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে অন্তরে যার (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে- সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩২) (“আত-তিব্বু আন-নব্বী”- লি ইবনিল কায়্যিম) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু’প্রকার ব্যাধি ও মুনাফিকী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের পূর্বের পাপের দরুন তাদের পরিণতির জন্য বিভিন্ন অবাধ্য কাজ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ)
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”(সূরা সাফ ৬১:৫) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিকদেরকে চেনা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে হত্যা করেননি? উমারও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি তাদেরকে হত্যা করে ফেলি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:دَعْهُ، لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ
তাকে ছেড়ে দাও! মানুষ যাতে সমালোচনা করতে না পারে (এই বলে) যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯০৫, ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা:২৫৮৪)
অর্থাৎ বেদুঈন আরবরা মুনাফিকদের হত্যার কারণ না জেনে শুধু বাহ্যিকভাবে অপপ্রচার শুনে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে, আর বলবে মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করে। এ অপপ্রচারের আশংকায় তাদেরকে হত্যা করা হয়নি।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. যারা নিজেদের সম্মান, সম্পদ ও অসৎ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্তরে কুফরী রেখে বাহ্যিক ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই মুনাফিক। এরাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে বেশি ক্ষতিকর।
২. বিশ্বাসগত মুনাফিকরা কাফির। কিন্তু আমলগত মুনাফিকরা কাফির নয়, তবে বড় ধরনের অপরাধী।
৩. সংশয় ও সন্দেহ ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধি থেকে মুক্ত না করেন। তাই বেশি বেশি
يا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ” এ দু‘আটি পড়া উচিত।
৪. কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম। সুতরাং আল্লাহভীরু মু’মিন ব্যক্তিকে ঐ সব কর্ম হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
2:10
فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ ۙ فَزَادَہُمُ اللّٰہُ مَرَضًا ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌۢ ۬ۙ بِمَا کَانُوۡا یَکۡذِبُوۡنَ ﴿۱۰﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা সূরার শুরুতে মু’মিন-মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাদের বিপরীতে কাফিরদের কথা তুলে ধরেছেন, অতঃপর এ আয়াত থেকে পনের নং আয়াত পর্যন্ত যারা বাহ্যিক ঈমানের দাবিদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফির তাদের কথা আলোচনা করেছেন। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য এ মুনাফিকরাই কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ مَرَدُوا عَلَي النِّفَاقِ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কপটতায় সিদ্ধহস্ত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০১)
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আরো বলেন:
(يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ)
“মুনাফিকেরা ভয় করে যে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৪)مُنَافِق শব্দটি نفاق মূলধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ কপটতা, দ্বিমুখিতা, মুনাফিকী ইত্যাদি।
শরয়ী পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়- যারা অন্তরে কুফরী গোপন রাখে এবং বাহ্যিক ঈমান প্রকাশ করে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: نفاق হল ভাল প্রকাশ করা ও মন্দ গোপন করা। ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: মুনাফিক তারা যাদের কথা কাজের বিপরীত এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)أسَاسُ النِّفَاقِ:
কপটতার মূল ভিত্তি: কপটতার মূল ভিত্তি হল কুফর ও কাপুরুষতা। কুফর-মুনাফিক যা গোপন করে রাখে, আর কাপুরুষতা হল যে কারণে অভ্যন্তরীণের বিপরীত বাহ্যিক প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে মুনাফিকরা কাপুরুষ ও দুর্বল মনের হয়ে থাকে। (উসূলুদ দাওয়াহ ৩৯৭ পৃ:)
মুনাফিক দু’প্রকার। যথা:
১. منافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, এরা নিজেদের সম্মান ও জান-মাল রক্ষা করার জন্য অথবা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুখে ইসলামের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা পরিপূর্ণ। এরা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ)
“মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।”(সূরা নিসা ৪:১৪৫)
এ প্রকার মুনাফিকদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার মধ্যে আলোচনা করেছেন।
২. منافق عملي
বা আমলগত মুনাফিক। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصَلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّي يَدَعَهَا: إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
“যার মাঝে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মাঝে এগুলোর একটি পাওয়া যাবে তার মাঝে সেরূপ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পরিত্যাগ করে- যখন কথা বলে তখন মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে, এবং ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে।”(সহীহ বুখারী হা: ৩৪)
কোন মু’মিন ব্যক্তির আমলে বাহ্যিকভাবে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না। কিন্তু যার অন্তরে এবং আমলে এ স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারাহসহ অন্যান্য যে সকল সূরাতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেمنافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, যারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। (তাফসীরে সা‘দী পৃ.: ১৯)
মাদানী সূরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মক্কায় কোন মুনাফিক ছিল না; বরং সেখানে ছিল ঈমানদারদের বিপরীত কাফির ও মুশরিক, তবে কিছু লোক এমন ছিলেন যারা বাহ্যত ও আপাত দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু ইয়াহূদীরা স্বীয় মতবাদে বহাল থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালাম সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব ইয়াহূদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলো গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এ দলের সূচনা এভাবে হয় যে, মদীনায় ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১. বানু কাইনুকা ২. বানু নাযীর এবং ৩. বানু কুরাইযা।
বনূ কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকি দু’টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জয়যুক্ত করলেন, ইসলামের জয়ডংকা চারিদিকে বেজে উঠল ও তার অপূর্ব দীপ্তি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠল, মুসলিমদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হল ও কাফিরদের গর্ব খর্ব হয়ে গেল, তখনই এ খবীস দলের গোড়া পত্তন হয়। আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশা বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এ গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হবার আশায় গুড়েবালি পড়ল। এ দুঃখ-পরিতাপ তো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় তাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
এখন সে চিন্তা করল যে, এভাবে কাজ হবে না। সুতরাং সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দলের কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এ গোপন পন্থা বাতলে দিল। এভাবে মদীনা ও তার আশেপাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়িম হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলার ফযলে এ কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেন না, আর থাকবেই বা কেন? এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা রাহে কুরবান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের কিছু আলামত ও বৈশিষ্ট্য:
১. مرض القلب বা অন্তরের ব্যাধি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”(সূরা বাকারাহ ২:১০)
২. الإفساد في الأرض বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِﺫ قَالُوْٓا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَﭚاَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلٰکِنْ لَّا یَشْعُرُوْنَﭛ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১১-১২)
৩. رميهم المؤمنين بالسفه বা মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া:
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ اٰمِنُوْا کَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوْٓا اَنُؤْمِنُ کَمَآ اٰمَنَ السُّفَھَا۬ئُﺚ اَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ السُّفَھَا۬ئُ وَلٰکِنْ لَّا یَعْلَمُوْنَ)
“এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে তোমরাও অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা বলে, নির্বোধেরা যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ কিন্তু তারা জানে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১৩)
৪. الخداع والرياء والتكاسل عن أداءالعبادات বা প্রতারণা করা, লোক দেখানো ইবাদত করা এবং ইবাদাতে শৈথিল্যতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًاﯝﺬ مُّذَبْذَبِیْنَ بَیْنَ ذٰلِکَﺣ لَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِ وَلَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَلَنْ تَجِدَ لَھ۫ سَبِیْلًاﯞ)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে; দোটানায় দোদুল্যমান- না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না।”(সূরা নিসা ৪:১৪২-৪৩)
৫. الاستهزاء باللّٰه واياته و رسوله বা আল্লাহ, রাসূল ও দীনের বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَبِاللّٰهِ وَآيَاتِه۪ وَرَسُولِه۪ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ)
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” (সূরা তাওবাহ ৯:৬৫)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوآ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ)
“এবং যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন তারা নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি।”(সূরা বাকারাহ ২:১৪)৬. مؤالاة الكافرين والتربص بالمؤمين বা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও মু’মিনদের ক্ষতির প্রতীক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মান্তিুক শাস্তি রয়েছে। মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না; অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন। যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদের মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”(সূরা নিসা ৪:১৩৮-১৪১)
৭. اللد في الخصومة والعزة بالإثم বা অধিক ঝগড়াটে ও পাপ কাজে সম্মান খুঁজে:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُکَ قَوْلُھ۫ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَیُشْھِدُ اللہَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِھ۪ﺫ وَھُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِﰛ وَاِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الْاَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیْھَا وَیُھْلِکَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَﺚ وَاللہُ لَا یُحِبُّ الْفَسَادَﰜ وَاِذَا قِیْلَ لَھُ اتَّقِ اللہَ اَخَذَتْھُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُھ۫ جَھَنَّمُﺚ وَلَبِئْسَ الْمِھَادُﰝ)
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যার পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কথা তোমাকে অবাক করে তোলে। আর সে তার মনের বিষয়ের ওপর আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। মূলত সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আর যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি ছড়াতে এবং শস্য-ক্ষেত্র ও জীবজন্তু বিনাশের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি ভালবাসেন না। যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে দেয়। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২:২০৪-২০৬)
৮. الإفساد بين المؤمنين বা মু’মিনদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللّٰهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ)
“তারা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো। তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শোনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:৪৭)
৯. الغدر وعدم الوفاء بالعهد বা বিশ্বাসঘাতকতা ও অঙ্গীকার পূর্ণ না করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْھُمْ مَّنْ عٰھَدَ اللہَ لَئِنْ اٰتٰٿنَا مِنْ فَضْلِھ۪ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَکُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَﮚفَلَمَّآ اٰتٰٿھُمْ مِّنْ فَضْلِھ۪ بَخِلُوْا بِھ۪ وَتَوَلَّوْا وَّھُمْ مُّعْرِضُوْنَﮛفَاَعْقَبَھُمْ نِفَاقًا فِیْ قُلُوْبِھِمْ اِلٰی یَوْمِ یَلْقَوْنَھ۫ بِمَآ اَخْلَفُوا اللہَ مَا وَعَدُوْھُ وَبِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَﮜ)
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল, ‘আল্লাহ নিজ কৃপায় আমাদেরকে দান করলে আমরা নিশ্চয়ই সদাকাহ দেবো এবং অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করলো এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরালো। পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল করে দিলেন করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল সেটা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৭৫-৭৭)
১০. الأمر بالمنكر و النهي عن المعروف বা অসৎ কাজের নির্দেশ ও সৎ কাজে বাধা প্রদান করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ بَعْضُھُمْ مِّنْۭ بَعْضٍﺭ یَاْمُرُوْنَ بِالْمُنْکَرِ وَیَنْھَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَیَقْبِضُوْنَ اَیْدِیَھُمْﺚ نَسُوا اللہَ فَنَسِیَھُمْﺚ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ ھُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“মুনাফিক নর ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে, তারা হাত বন্ধ করে রাখে, তারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে বিস্মৃত হয়েছেন; মুনাফিকেরা তো পাপাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৭)
১১. التحاكم الي الطاغوت: বা তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّھُمْ اٰمَنُوْا بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاکَمُوْٓا اِلَی الطَّاغُوْتِ وَقَدْ اُمِرُوْٓا اَنْ یَّکْفُرُوْا بِھ۪ﺚ وَیُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّھُمْ ضَلٰلًۭا بَعِیْدًا)
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।”(সূরা নিসা ৪:৬০)
১২. الصدود عن الله ورسوله বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ تَعَالَوْا اِلٰی مَآ اَنْزَلَ اللہُ وَاِلَی الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْکَ صُدُوْدًاﮌﺆفَکَیْفَ اِذَآ اَصَابَتْھُمْ مُّصِیْبَةٌۭ بِمَا قَدَّمَتْ اَیْدِیْھِمْ ثُمَّ جَا۬ءُوْکَ یَحْلِفُوْنَﺣ بِاللہِ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّآ اِحْسَانًا وَّتَوْفِیْقًا)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন তাদের কোন মুসীবত হবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করতে করতে তোমার নিকট এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছুই চাইনি।’(সূরা নিসা ৪:৬১-৬২)
১৩. الكذب والخوف وكره المسلمين বা মিথ্যা, ভয় ও মুসলিমদের অপছন্দ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَحْلِفُوْنَ بِاللہِ اِنَّھُمْ لَمِنْکُمْﺚ وَمَا ھُمْ مِّنْکُمْ وَلٰکِنَّھُمْ قَوْمٌ یَّفْرَقُوْنَﮇلَوْ یَجِدُوْنَ مَلْجَاً اَوْ مَغٰرٰتٍ اَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا اِلَیْھِ وَھُمْ یَجْمَحُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে সদাকাহ বণ্টন সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে, অতঃপর এটার কিছু তাদেরকে দেয়া হলে তারা পরিতুষ্ট হয়, আর এটার কিছু তাদেরকে না দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা বিক্ষুব্ধ হয়।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫৬ - ৫৭)
১৪. الإضرار بالمؤمنين বা মু’মিনদের ক্ষতিসাধন করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَّکُفْرًا وَّتَفْرِیْقًۭا بَیْنَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَاِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللہَ وَرَسُوْلَھ۫ مِنْ قَبْلُﺚ وَلَیَحْلِفُنَّ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّا الْحُسْنٰیﺚ وَاللہُ یَشْھَدُ اِنَّھُمْ لَکٰذِبُوْنَ)
“এবং যারা মাসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই সেটা করেছি’; আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০৭)
প্রথম দুই আয়াতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও মূলত প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও হয়তো এ কথা ভাবে না যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুণই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে ধোঁকাবাজি করছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِنْ یُّرِیْدُوْٓا اَنْ یَّخْدَعُوْکَ فَاِنَّ حَسْبَکَ اللہُﺚ ھُوَ الَّذِیْٓ اَیَّدَکَ بِنَصْرِھ۪ وَبِالْمُؤْمِنِیْنَ)
“যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।”(সূরা আনফাল ৮:৬২)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকেও নয় বরং তারা ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজেরাই ধোঁকায় পতিত হয়। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।”(সূরা নিসা ৪:১৪২)
এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ধোঁকা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মু’মিনগণও ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত হয়ে সমস্ত ধোঁকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ ছিলেন।
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধি এর অর্থ হচ্ছে شك বা সংশয়। এরূপ মত পোষণ করেছেন- মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বসরী, আবুল আলিয়া ও কাতাদাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) । ত্বাওস (রহঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধির অর্থ হচ্ছে رياء বা লোক দেখানোর জন্য কাজ করা।
আবদুর রহমান বিন যায়িদ (রহঃ) বলেন: مرض অর্থ হচ্ছে “দীনের ব্যাপারে তাদের অন্তরের ব্যাধি” শারীরিক ব্যাধি নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন: ব্যাধি দুই প্রকার। উভয় প্রকারের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
১. مرض الشكوك والشبهات বা সংশয় ও সন্দেহের ব্যাধি:
যেমন কুফরী, মুনাফিকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস ইত্যাদি এ প্রকার ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধির আরোগ্য দান না করেন তাহলে তা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এখানে এ ব্যাধির কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَتَرَی الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوْنَ فِیْھِمْ یَقُوْلُوْنَ نَخْشٰٓی اَنْ تُصِیْبَنَا دَا۬ئِرَةٌ)
“আর আপনি তাদের দেখবেন যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে যে, তারা দৌড়ে গিয়ে ওদেরই মধ্যে ঢুকে এ বলে যে, আমরা ভয় করছি আমাদের ওপর না জানি কোন মুসিবত পতিত হয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫: ৫২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ غَرَّ ھٰٓؤُلَا۬ئِ دِیْنُھُمْﺚ وَمَنْ یَّتَوَکَّلْ عَلَی اللہِ فَاِنَّ اللہَ عَزِیْزٌ حَکِیْمٌ)
“স্মরণ কর, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ‘এদের দীন এদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আনফাল ৮:৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আরোও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন: সূরা মায়িদার ৫২ নং, সূরা আনফালের ৪৯ নং ও সূরা তাওবার ১২৫ নং আয়াত।
২. مرض الشهوات বা প্রবৃত্তির ব্যাধি:
যেমন অন্যায়-অশ্লীল, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী কাজের প্রতি লালসা ইত্যাদি। এ প্রকার ব্যাধি দূরিকরণে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِھ۪ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا)
“কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে অন্তরে যার (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে- সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩২) (“আত-তিব্বু আন-নব্বী”- লি ইবনিল কায়্যিম) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু’প্রকার ব্যাধি ও মুনাফিকী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের পূর্বের পাপের দরুন তাদের পরিণতির জন্য বিভিন্ন অবাধ্য কাজ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ)
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”(সূরা সাফ ৬১:৫) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিকদেরকে চেনা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে হত্যা করেননি? উমারও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি তাদেরকে হত্যা করে ফেলি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:دَعْهُ، لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ
তাকে ছেড়ে দাও! মানুষ যাতে সমালোচনা করতে না পারে (এই বলে) যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯০৫, ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা:২৫৮৪)
অর্থাৎ বেদুঈন আরবরা মুনাফিকদের হত্যার কারণ না জেনে শুধু বাহ্যিকভাবে অপপ্রচার শুনে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে, আর বলবে মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করে। এ অপপ্রচারের আশংকায় তাদেরকে হত্যা করা হয়নি।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা নিজেদের সম্মান, সম্পদ ও অসৎ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্তরে কুফরী রেখে বাহ্যিক ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই মুনাফিক। এরাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে বেশি ক্ষতিকর।
২. বিশ্বাসগত মুনাফিকরা কাফির। কিন্তু আমলগত মুনাফিকরা কাফির নয়, তবে বড় ধরনের অপরাধী।
৩. সংশয় ও সন্দেহ ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধি থেকে মুক্ত না করেন। তাই বেশি বেশিيا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ” এ দু‘আটি পড়া উচিত।
৪. কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম। সুতরাং আল্লাহভীরু মু’মিন ব্যক্তিকে ঐ সব কর্ম হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরার শুরুতে মু’মিন-মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাদের বিপরীতে কাফিরদের কথা তুলে ধরেছেন, অতঃপর এ আয়াত থেকে পনের নং আয়াত পর্যন্ত যারা বাহ্যিক ঈমানের দাবিদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফির তাদের কথা আলোচনা করেছেন। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য এ মুনাফিকরাই কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ مَرَدُوا عَلَي النِّفَاقِ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কপটতায় সিদ্ধহস্ত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০১)
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আরো বলেন:
(يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ)
“মুনাফিকেরা ভয় করে যে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৪)مُنَافِق শব্দটি نفاق মূলধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ কপটতা, দ্বিমুখিতা, মুনাফিকী ইত্যাদি।
শরয়ী পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়- যারা অন্তরে কুফরী গোপন রাখে এবং বাহ্যিক ঈমান প্রকাশ করে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: نفاق হল ভাল প্রকাশ করা ও মন্দ গোপন করা। ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: মুনাফিক তারা যাদের কথা কাজের বিপরীত এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)أسَاسُ النِّفَاقِ:
কপটতার মূল ভিত্তি: কপটতার মূল ভিত্তি হল কুফর ও কাপুরুষতা। কুফর-মুনাফিক যা গোপন করে রাখে, আর কাপুরুষতা হল যে কারণে অভ্যন্তরীণের বিপরীত বাহ্যিক প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে মুনাফিকরা কাপুরুষ ও দুর্বল মনের হয়ে থাকে। (উসূলুদ দাওয়াহ ৩৯৭ পৃ:)
মুনাফিক দু’প্রকার। যথা:
১. منافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, এরা নিজেদের সম্মান ও জান-মাল রক্ষা করার জন্য অথবা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুখে ইসলামের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা পরিপূর্ণ। এরা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ)
“মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে।”(সূরা নিসা ৪:১৪৫)
এ প্রকার মুনাফিকদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার মধ্যে আলোচনা করেছেন।
২. منافق عملي
বা আমলগত মুনাফিক। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصَلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّي يَدَعَهَا: إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
“যার মাঝে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মাঝে এগুলোর একটি পাওয়া যাবে তার মাঝে সেরূপ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পরিত্যাগ করে- যখন কথা বলে তখন মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে, এবং ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে।”(সহীহ বুখারী হা: ৩৪)
কোন মু’মিন ব্যক্তির আমলে বাহ্যিকভাবে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না। কিন্তু যার অন্তরে এবং আমলে এ স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারাহসহ অন্যান্য যে সকল সূরাতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেمنافق اعتقادي
বা বিশ্বাসগত মুনাফিক, যারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে। (তাফসীরে সা‘দী পৃ.: ১৯)
মাদানী সূরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মক্কায় কোন মুনাফিক ছিল না; বরং সেখানে ছিল ঈমানদারদের বিপরীত কাফির ও মুশরিক, তবে কিছু লোক এমন ছিলেন যারা বাহ্যত ও আপাত দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু ইয়াহূদীরা স্বীয় মতবাদে বহাল থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালাম সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব ইয়াহূদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলো গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এ দলের সূচনা এভাবে হয় যে, মদীনায় ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১. বানু কাইনুকা ২. বানু নাযীর এবং ৩. বানু কুরাইযা।
বনূ কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকি দু’টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জয়যুক্ত করলেন, ইসলামের জয়ডংকা চারিদিকে বেজে উঠল ও তার অপূর্ব দীপ্তি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠল, মুসলিমদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হল ও কাফিরদের গর্ব খর্ব হয়ে গেল, তখনই এ খবীস দলের গোড়া পত্তন হয়। আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশা বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এ গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হবার আশায় গুড়েবালি পড়ল। এ দুঃখ-পরিতাপ তো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় তাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
এখন সে চিন্তা করল যে, এভাবে কাজ হবে না। সুতরাং সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দলের কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এ গোপন পন্থা বাতলে দিল। এভাবে মদীনা ও তার আশেপাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়িম হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলার ফযলে এ কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেন না, আর থাকবেই বা কেন? এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা রাহে কুরবান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের কিছু আলামত ও বৈশিষ্ট্য:
১. مرض القلب বা অন্তরের ব্যাধি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”(সূরা বাকারাহ ২:১০)
২. الإفساد في الأرض বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِﺫ قَالُوْٓا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَﭚاَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلٰکِنْ لَّا یَشْعُرُوْنَﭛ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১১-১২)
৩. رميهم المؤمنين بالسفه বা মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া:
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ اٰمِنُوْا کَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوْٓا اَنُؤْمِنُ کَمَآ اٰمَنَ السُّفَھَا۬ئُﺚ اَلَآ اِنَّھُمْ ھُمُ السُّفَھَا۬ئُ وَلٰکِنْ لَّا یَعْلَمُوْنَ)
“এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে তোমরাও অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা বলে, নির্বোধেরা যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ কিন্তু তারা জানে না।”(সূরা বাকারাহ ২:১৩)
৪. الخداع والرياء والتكاسل عن أداءالعبادات বা প্রতারণা করা, লোক দেখানো ইবাদত করা এবং ইবাদাতে শৈথিল্যতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًاﯝﺬ مُّذَبْذَبِیْنَ بَیْنَ ذٰلِکَﺣ لَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِ وَلَآ اِلٰی ھٰٓؤُلَا۬ئِﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَلَنْ تَجِدَ لَھ۫ سَبِیْلًاﯞ)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে; দোটানায় দোদুল্যমান- না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না।”(সূরা নিসা ৪:১৪২-৪৩)
৫. الاستهزاء باللّٰه واياته و رسوله বা আল্লাহ, রাসূল ও দীনের বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَبِاللّٰهِ وَآيَاتِه۪ وَرَسُولِه۪ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ)
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে?” (সূরা তাওবাহ ৯:৬৫)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوآ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ)
“এবং যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন তারা নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি।”(সূরা বাকারাহ ২:১৪)৬. مؤالاة الكافرين والتربص بالمؤمين বা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও মু’মিনদের ক্ষতির প্রতীক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মান্তিুক শাস্তি রয়েছে। মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না; অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন। যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদের মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”(সূরা নিসা ৪:১৩৮-১৪১)
৭. اللد في الخصومة والعزة بالإثم বা অধিক ঝগড়াটে ও পাপ কাজে সম্মান খুঁজে:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُکَ قَوْلُھ۫ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَیُشْھِدُ اللہَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِھ۪ﺫ وَھُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِﰛ وَاِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الْاَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیْھَا وَیُھْلِکَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَﺚ وَاللہُ لَا یُحِبُّ الْفَسَادَﰜ وَاِذَا قِیْلَ لَھُ اتَّقِ اللہَ اَخَذَتْھُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُھ۫ جَھَنَّمُﺚ وَلَبِئْسَ الْمِھَادُﰝ)
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যার পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কথা তোমাকে অবাক করে তোলে। আর সে তার মনের বিষয়ের ওপর আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। মূলত সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আর যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি ছড়াতে এবং শস্য-ক্ষেত্র ও জীবজন্তু বিনাশের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি ভালবাসেন না। যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে দেয়। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২:২০৪-২০৬)
৮. الإفساد بين المؤمنين বা মু’মিনদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللّٰهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ)
“তারা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো। তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শোনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:৪৭)
৯. الغدر وعدم الوفاء بالعهد বা বিশ্বাসঘাতকতা ও অঙ্গীকার পূর্ণ না করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْھُمْ مَّنْ عٰھَدَ اللہَ لَئِنْ اٰتٰٿنَا مِنْ فَضْلِھ۪ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَکُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَﮚفَلَمَّآ اٰتٰٿھُمْ مِّنْ فَضْلِھ۪ بَخِلُوْا بِھ۪ وَتَوَلَّوْا وَّھُمْ مُّعْرِضُوْنَﮛفَاَعْقَبَھُمْ نِفَاقًا فِیْ قُلُوْبِھِمْ اِلٰی یَوْمِ یَلْقَوْنَھ۫ بِمَآ اَخْلَفُوا اللہَ مَا وَعَدُوْھُ وَبِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَﮜ)
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল, ‘আল্লাহ নিজ কৃপায় আমাদেরকে দান করলে আমরা নিশ্চয়ই সদাকাহ দেবো এবং অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করলো এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরালো। পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল করে দিলেন করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল সেটা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৭৫-৭৭)
১০. الأمر بالمنكر و النهي عن المعروف বা অসৎ কাজের নির্দেশ ও সৎ কাজে বাধা প্রদান করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ بَعْضُھُمْ مِّنْۭ بَعْضٍﺭ یَاْمُرُوْنَ بِالْمُنْکَرِ وَیَنْھَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَیَقْبِضُوْنَ اَیْدِیَھُمْﺚ نَسُوا اللہَ فَنَسِیَھُمْﺚ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ ھُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“মুনাফিক নর ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে, তারা হাত বন্ধ করে রাখে, তারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে বিস্মৃত হয়েছেন; মুনাফিকেরা তো পাপাচারী।”(সূরা তাওবাহ ৯:৬৭)
১১. التحاكم الي الطاغوت: বা তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّھُمْ اٰمَنُوْا بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاکَمُوْٓا اِلَی الطَّاغُوْتِ وَقَدْ اُمِرُوْٓا اَنْ یَّکْفُرُوْا بِھ۪ﺚ وَیُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّھُمْ ضَلٰلًۭا بَعِیْدًا)
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।”(সূরা নিসা ৪:৬০)
১২. الصدود عن الله ورسوله বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمْ تَعَالَوْا اِلٰی مَآ اَنْزَلَ اللہُ وَاِلَی الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْکَ صُدُوْدًاﮌﺆفَکَیْفَ اِذَآ اَصَابَتْھُمْ مُّصِیْبَةٌۭ بِمَا قَدَّمَتْ اَیْدِیْھِمْ ثُمَّ جَا۬ءُوْکَ یَحْلِفُوْنَﺣ بِاللہِ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّآ اِحْسَانًا وَّتَوْفِیْقًا)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন তাদের কোন মুসীবত হবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করতে করতে তোমার নিকট এসে বলবে, ‘আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছুই চাইনি।’(সূরা নিসা ৪:৬১-৬২)
১৩. الكذب والخوف وكره المسلمين বা মিথ্যা, ভয় ও মুসলিমদের অপছন্দ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَیَحْلِفُوْنَ بِاللہِ اِنَّھُمْ لَمِنْکُمْﺚ وَمَا ھُمْ مِّنْکُمْ وَلٰکِنَّھُمْ قَوْمٌ یَّفْرَقُوْنَﮇلَوْ یَجِدُوْنَ مَلْجَاً اَوْ مَغٰرٰتٍ اَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا اِلَیْھِ وَھُمْ یَجْمَحُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে সদাকাহ বণ্টন সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে, অতঃপর এটার কিছু তাদেরকে দেয়া হলে তারা পরিতুষ্ট হয়, আর এটার কিছু তাদেরকে না দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা বিক্ষুব্ধ হয়।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫৬ - ৫৭)
১৪. الإضرار بالمؤمنين বা মু’মিনদের ক্ষতিসাধন করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَّکُفْرًا وَّتَفْرِیْقًۭا بَیْنَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَاِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللہَ وَرَسُوْلَھ۫ مِنْ قَبْلُﺚ وَلَیَحْلِفُنَّ اِنْ اَرَدْنَآ اِلَّا الْحُسْنٰیﺚ وَاللہُ یَشْھَدُ اِنَّھُمْ لَکٰذِبُوْنَ)
“এবং যারা মাসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই সেটা করেছি’; আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।”(সূরা তাওবাহ ৯:১০৭)
প্রথম দুই আয়াতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও মূলত প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও হয়তো এ কথা ভাবে না যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুণই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে ধোঁকাবাজি করছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِنْ یُّرِیْدُوْٓا اَنْ یَّخْدَعُوْکَ فَاِنَّ حَسْبَکَ اللہُﺚ ھُوَ الَّذِیْٓ اَیَّدَکَ بِنَصْرِھ۪ وَبِالْمُؤْمِنِیْنَ)
“যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।”(সূরা আনফাল ৮:৬২)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারবে না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকেও নয় বরং তারা ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজেরাই ধোঁকায় পতিত হয়। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُخَادِعُونَ اللّٰهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ)
“তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে প্রতারণা করে না; অথচ তারা এটা অনুভব করতে পারে না।”(সূরা বাকারাহ ২:৯)
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দিতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়- কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।”(সূরা নিসা ৪:১৪২)
এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ধোঁকা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মু’মিনগণও ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত হয়ে সমস্ত ধোঁকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ ছিলেন।
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধি এর অর্থ হচ্ছে شك বা সংশয়। এরূপ মত পোষণ করেছেন- মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বসরী, আবুল আলিয়া ও কাতাদাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) । ত্বাওস (রহঃ) বলেন: مرض বা ব্যাধির অর্থ হচ্ছে رياء বা লোক দেখানোর জন্য কাজ করা।
আবদুর রহমান বিন যায়িদ (রহঃ) বলেন: مرض অর্থ হচ্ছে “দীনের ব্যাপারে তাদের অন্তরের ব্যাধি” শারীরিক ব্যাধি নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন: ব্যাধি দুই প্রকার। উভয় প্রকারের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
১. مرض الشكوك والشبهات বা সংশয় ও সন্দেহের ব্যাধি:
যেমন কুফরী, মুনাফিকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস ইত্যাদি এ প্রকার ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধির আরোগ্য দান না করেন তাহলে তা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এখানে এ ব্যাধির কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌﺫ فَزَادَھُمُ اللہُ مَرَضًاﺆ وَلَھُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌۭﺃ بِمَا کَانُوْا یَکْذِبُوْنَ)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَتَرَی الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوْنَ فِیْھِمْ یَقُوْلُوْنَ نَخْشٰٓی اَنْ تُصِیْبَنَا دَا۬ئِرَةٌ)
“আর আপনি তাদের দেখবেন যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে যে, তারা দৌড়ে গিয়ে ওদেরই মধ্যে ঢুকে এ বলে যে, আমরা ভয় করছি আমাদের ওপর না জানি কোন মুসিবত পতিত হয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫: ৫২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ غَرَّ ھٰٓؤُلَا۬ئِ دِیْنُھُمْﺚ وَمَنْ یَّتَوَکَّلْ عَلَی اللہِ فَاِنَّ اللہَ عَزِیْزٌ حَکِیْمٌ)
“স্মরণ কর, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ‘এদের দীন এদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আনফাল ৮:৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আরোও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন: সূরা মায়িদার ৫২ নং, সূরা আনফালের ৪৯ নং ও সূরা তাওবার ১২৫ নং আয়াত।
২. مرض الشهوات বা প্রবৃত্তির ব্যাধি:
যেমন অন্যায়-অশ্লীল, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী কাজের প্রতি লালসা ইত্যাদি। এ প্রকার ব্যাধি দূরিকরণে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِھ۪ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا)
“কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে অন্তরে যার (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে- সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩২) (“আত-তিব্বু আন-নব্বী”- লি ইবনিল কায়্যিম) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু’প্রকার ব্যাধি ও মুনাফিকী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের পূর্বের পাপের দরুন তাদের পরিণতির জন্য বিভিন্ন অবাধ্য কাজ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ)
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”(সূরা সাফ ৬১:৫) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৫)
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিকদেরকে চেনা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে হত্যা করেননি? উমারও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি তাদেরকে হত্যা করে ফেলি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:دَعْهُ، لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ
তাকে ছেড়ে দাও! মানুষ যাতে সমালোচনা করতে না পারে (এই বলে) যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯০৫, ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা:২৫৮৪)
অর্থাৎ বেদুঈন আরবরা মুনাফিকদের হত্যার কারণ না জেনে শুধু বাহ্যিকভাবে অপপ্রচার শুনে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে, আর বলবে মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করে। এ অপপ্রচারের আশংকায় তাদেরকে হত্যা করা হয়নি।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা নিজেদের সম্মান, সম্পদ ও অসৎ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্তরে কুফরী রেখে বাহ্যিক ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই মুনাফিক। এরাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে বেশি ক্ষতিকর।
২. বিশ্বাসগত মুনাফিকরা কাফির। কিন্তু আমলগত মুনাফিকরা কাফির নয়, তবে বড় ধরনের অপরাধী।
৩. সংশয় ও সন্দেহ ব্যাধির কোন চিকিৎসা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যদি এ ব্যাধি থেকে মুক্ত না করেন। তাই বেশি বেশিيا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ” এ দু‘আটি পড়া উচিত।
৪. কুরআনের আলোকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম। সুতরাং আল্লাহভীরু মু’মিন ব্যক্তিকে ঐ সব কর্ম হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
2:11
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ ﴿۱۱﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১১ ও ১২ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের একটি দ্বিমুখী চরিত্রের বিবরণ তুলে ধরেছেন। তা হল: তারা কুফরী, পাপ কাজ সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করত, আর এ সব অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হলে তারা বলত, আমরা তো ফাসাদ সৃষ্টি করছি না, বরং আমরা সংশোধনকারী।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা হল কুফরী কাজ ও পাপাচার।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুনাফিকদের ফাসাদ হল আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়া। কেননা যে ব্যক্তি জমিনে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হল অথবা আল্লাহদ্রোহী কাজের নির্দেশ দিল সে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করল। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ফাসাদ সৃষ্টির অন্যতম দিক হচ্ছে মু’মিনদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অপপ্রচার ছড়ানো এবং কাফিরদের সাথে সৌহার্দ বজায় রাখা। (তাফসীর সা‘দী)
ইবনু জারীর বলেন: মুনাফিকদের বিবাদ ও গণ্ডগোল সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে তারা এমন সব কাজ করত যা করতে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর নির্ধারিত ফরযগুলোও হেলা-খেলায় নষ্ট করত। শুধু তাই নয়, সত্য ধর্ম ইসলামের প্রতি তারা সন্দেহ পোষণ করত এবং আল্লাহ তা‘আলার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখত না। মু’মিনদের কাছে আসলে ঈমানের কথা প্রচার করত অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সম্বন্ধে তাদের অন্তর সন্দেহে পরিপূর্ণ ছিল। তারা সুযোগ পেলেই আল্লাহ তা‘আলার শত্র“দের সাহায্য সহযোগিতা করত এবং সৎ লোকেদের বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এতসব করা সত্ত্বেও নিজেদেরকে তারা শান্তিকামী মনে করত।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুফরী ও নিফাকী করা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার শামিল।
২. আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমেই জমিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৩. মিথ্যা বলা ও প্রচারণা মুনাফিকদের অন্যতম কাজ।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের একটি দ্বিমুখী চরিত্রের বিবরণ তুলে ধরেছেন। তা হল: তারা কুফরী, পাপ কাজ সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করত, আর এ সব অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হলে তারা বলত, আমরা তো ফাসাদ সৃষ্টি করছি না, বরং আমরা সংশোধনকারী।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা হল কুফরী কাজ ও পাপাচার।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুনাফিকদের ফাসাদ হল আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়া। কেননা যে ব্যক্তি জমিনে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হল অথবা আল্লাহদ্রোহী কাজের নির্দেশ দিল সে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করল। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ফাসাদ সৃষ্টির অন্যতম দিক হচ্ছে মু’মিনদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অপপ্রচার ছড়ানো এবং কাফিরদের সাথে সৌহার্দ বজায় রাখা। (তাফসীর সা‘দী)
ইবনু জারীর বলেন: মুনাফিকদের বিবাদ ও গণ্ডগোল সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে তারা এমন সব কাজ করত যা করতে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর নির্ধারিত ফরযগুলোও হেলা-খেলায় নষ্ট করত। শুধু তাই নয়, সত্য ধর্ম ইসলামের প্রতি তারা সন্দেহ পোষণ করত এবং আল্লাহ তা‘আলার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখত না। মু’মিনদের কাছে আসলে ঈমানের কথা প্রচার করত অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সম্বন্ধে তাদের অন্তর সন্দেহে পরিপূর্ণ ছিল। তারা সুযোগ পেলেই আল্লাহ তা‘আলার শত্র“দের সাহায্য সহযোগিতা করত এবং সৎ লোকেদের বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এতসব করা সত্ত্বেও নিজেদেরকে তারা শান্তিকামী মনে করত।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুফরী ও নিফাকী করা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার শামিল।
২. আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমেই জমিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৩. মিথ্যা বলা ও প্রচারণা মুনাফিকদের অন্যতম কাজ।
2:12
اَلَاۤ اِنَّہُمۡ ہُمُ الۡمُفۡسِدُوۡنَ وَ لٰکِنۡ لَّا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۱۲﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১১ ও ১২ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের একটি দ্বিমুখী চরিত্রের বিবরণ তুলে ধরেছেন। তা হল: তারা কুফরী, পাপ কাজ সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করত, আর এ সব অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হলে তারা বলত, আমরা তো ফাসাদ সৃষ্টি করছি না, বরং আমরা সংশোধনকারী।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা হল কুফরী কাজ ও পাপাচার।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুনাফিকদের ফাসাদ হল আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়া। কেননা যে ব্যক্তি জমিনে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হল অথবা আল্লাহদ্রোহী কাজের নির্দেশ দিল সে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করল। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ফাসাদ সৃষ্টির অন্যতম দিক হচ্ছে মু’মিনদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অপপ্রচার ছড়ানো এবং কাফিরদের সাথে সৌহার্দ বজায় রাখা। (তাফসীর সা‘দী)
ইবনু জারীর বলেন: মুনাফিকদের বিবাদ ও গণ্ডগোল সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে তারা এমন সব কাজ করত যা করতে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর নির্ধারিত ফরযগুলোও হেলা-খেলায় নষ্ট করত। শুধু তাই নয়, সত্য ধর্ম ইসলামের প্রতি তারা সন্দেহ পোষণ করত এবং আল্লাহ তা‘আলার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখত না। মু’মিনদের কাছে আসলে ঈমানের কথা প্রচার করত অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সম্বন্ধে তাদের অন্তর সন্দেহে পরিপূর্ণ ছিল। তারা সুযোগ পেলেই আল্লাহ তা‘আলার শত্র“দের সাহায্য সহযোগিতা করত এবং সৎ লোকেদের বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এতসব করা সত্ত্বেও নিজেদেরকে তারা শান্তিকামী মনে করত।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. কুফরী ও নিফাকী করা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার শামিল।
২. আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমেই জমিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৩. মিথ্যা বলা ও প্রচারণা মুনাফিকদের অন্যতম কাজ।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের একটি দ্বিমুখী চরিত্রের বিবরণ তুলে ধরেছেন। তা হল: তারা কুফরী, পাপ কাজ সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করত, আর এ সব অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হলে তারা বলত, আমরা তো ফাসাদ সৃষ্টি করছি না, বরং আমরা সংশোধনকারী।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা হল কুফরী কাজ ও পাপাচার।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুনাফিকদের ফাসাদ হল আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়া। কেননা যে ব্যক্তি জমিনে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হল অথবা আল্লাহদ্রোহী কাজের নির্দেশ দিল সে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করল। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ফাসাদ সৃষ্টির অন্যতম দিক হচ্ছে মু’মিনদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অপপ্রচার ছড়ানো এবং কাফিরদের সাথে সৌহার্দ বজায় রাখা। (তাফসীর সা‘দী)
ইবনু জারীর বলেন: মুনাফিকদের বিবাদ ও গণ্ডগোল সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে তারা এমন সব কাজ করত যা করতে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর নির্ধারিত ফরযগুলোও হেলা-খেলায় নষ্ট করত। শুধু তাই নয়, সত্য ধর্ম ইসলামের প্রতি তারা সন্দেহ পোষণ করত এবং আল্লাহ তা‘আলার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখত না। মু’মিনদের কাছে আসলে ঈমানের কথা প্রচার করত অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সম্বন্ধে তাদের অন্তর সন্দেহে পরিপূর্ণ ছিল। তারা সুযোগ পেলেই আল্লাহ তা‘আলার শত্র“দের সাহায্য সহযোগিতা করত এবং সৎ লোকেদের বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এতসব করা সত্ত্বেও নিজেদেরকে তারা শান্তিকামী মনে করত।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. কুফরী ও নিফাকী করা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার শামিল।
২. আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমেই জমিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৩. মিথ্যা বলা ও প্রচারণা মুনাফিকদের অন্যতম কাজ।
2:13
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ اٰمِنُوۡا کَمَاۤ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوۡۤا اَنُؤۡمِنُ کَمَاۤ اٰمَنَ السُّفَہَآءُ ؕ اَلَاۤ اِنَّہُمۡ ہُمُ السُّفَہَآءُ وَ لٰکِنۡ لَّا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۳﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৩ নং আয়াতের তাফসীর:
যখন মুনাফিকদেরকে বলা হয় মানুষেরা তথা সাহাবীরা যেমন ঈমান এনেছে অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা জবাবে বলে আমরা কি নির্বোধদের মত ঈমান আনব?
এখানে নির্বোধ দ্বারা সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কারণ অধিকাংশ সাহাবীরা সমাজের বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ছিলেন না। যেমন রোম সম্রাট হিরাকল আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল: সমাজের সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তিরা কি তাঁর (মুহাম্মাদের) অনুসরণ করে, না দুর্বল গরীবরা? জবাবে তিনি বলবেন: গরীবরা। সে বলল: নাবীদের অনুসারী এরূপ ব্যক্তিরাই হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী হা: ০৭)
বর্তমান সমাজের দিকেও তাকালে দেখা যায়, সমাজের অধিকাংশ দুর্বল-গরীবরাই ইসলামের অনুসারী, ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলার চেষ্টা করে থাকে। আর প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের অধিকাংশই ধর্মের পরওয়া করে না এবং ধর্মপ্রাণ মু’মিন মুসলিমদেরকে অবজ্ঞা করে চলে। যেমন চরিত্র ছিল তৎকালীন মুনাফিকদের। মূলতঃ ইসলাম হল অসহায় ও অসচ্ছল লোকেদের সহায়তা প্রদানকারী, নির্যাতিতদের আশ্রয় প্রদানকারী ধর্ম। এজন্য সর্বযুগে সুবিধা বঞ্চিত লোকেরাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
তাই সাহাবী বা সহজ-সরল মু’মিনদেরকে বোকা ও মানহানিকর কথা বলা ঈমানদারদের কাজ নয় রবং এটা মুনাফিকদের কাজ। এরূপ করলে ঈমান বাতিল হয়ে যাবে।السفهاء শব্দটি سفيه শব্দের বহুবচন। অর্থ হল অজ্ঞ, নির্বোধ, দুর্বল। এজন্য মহিলা ও বাচ্চাদেরকে سفيه বা অবুঝ বলা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَا۬ءَ أَمْوَالَكُمُ)
“তোমরা তোমাদের সম্পদ অবুঝ ব্যক্তিদেরকে দিও না।” (সূরা নিসা ৪:৫) অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবুঝ সন্তান ও নারীদের দিও না। এখান থেকে আরো জানতে পারলাম ঈমান আনতে হবে সাহাবীরা যেভাবে ঈমান এনেছেন। তাদের ঈমান হল পরবর্তী সকল মানুষের ঈমানের মাপকাঠি। সাহাবীদের ঈমানের মাঝে কোন তরীকা, পীর-ফকির ও ভায়া-মাধ্যম ছিল না। তারা সরাসরি আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. সমাজের অধিকাংশ দুর্বল, গরীব সুবিধা বঞ্চিত ব্যক্তিরাই ইসলামের অনুসারী হয়।
২. সমাজের প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা দুর্বল ও গরীব মু’মিনদেরকে অনেকভাবে উপহাস করতে পারে। তাই বলে মনক্ষুন্ন হয়ে ইসলাম থেকে সরে যাওয়া যাবে না। তৎকালীন মক্কার প্রভাব ও বিত্তশালী কাফিররাও দুর্বল সাহাবীদেরকে বিভিন্ন কথা বলে উপহাস করত, তারপরও তারা ইসলাম থেকে এক চুলও সরে যায়নি।
যখন মুনাফিকদেরকে বলা হয় মানুষেরা তথা সাহাবীরা যেমন ঈমান এনেছে অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা জবাবে বলে আমরা কি নির্বোধদের মত ঈমান আনব?
এখানে নির্বোধ দ্বারা সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কারণ অধিকাংশ সাহাবীরা সমাজের বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ছিলেন না। যেমন রোম সম্রাট হিরাকল আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল: সমাজের সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তিরা কি তাঁর (মুহাম্মাদের) অনুসরণ করে, না দুর্বল গরীবরা? জবাবে তিনি বলবেন: গরীবরা। সে বলল: নাবীদের অনুসারী এরূপ ব্যক্তিরাই হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী হা: ০৭)
বর্তমান সমাজের দিকেও তাকালে দেখা যায়, সমাজের অধিকাংশ দুর্বল-গরীবরাই ইসলামের অনুসারী, ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলার চেষ্টা করে থাকে। আর প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের অধিকাংশই ধর্মের পরওয়া করে না এবং ধর্মপ্রাণ মু’মিন মুসলিমদেরকে অবজ্ঞা করে চলে। যেমন চরিত্র ছিল তৎকালীন মুনাফিকদের। মূলতঃ ইসলাম হল অসহায় ও অসচ্ছল লোকেদের সহায়তা প্রদানকারী, নির্যাতিতদের আশ্রয় প্রদানকারী ধর্ম। এজন্য সর্বযুগে সুবিধা বঞ্চিত লোকেরাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
তাই সাহাবী বা সহজ-সরল মু’মিনদেরকে বোকা ও মানহানিকর কথা বলা ঈমানদারদের কাজ নয় রবং এটা মুনাফিকদের কাজ। এরূপ করলে ঈমান বাতিল হয়ে যাবে।السفهاء শব্দটি سفيه শব্দের বহুবচন। অর্থ হল অজ্ঞ, নির্বোধ, দুর্বল। এজন্য মহিলা ও বাচ্চাদেরকে سفيه বা অবুঝ বলা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَا۬ءَ أَمْوَالَكُمُ)
“তোমরা তোমাদের সম্পদ অবুঝ ব্যক্তিদেরকে দিও না।” (সূরা নিসা ৪:৫) অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবুঝ সন্তান ও নারীদের দিও না। এখান থেকে আরো জানতে পারলাম ঈমান আনতে হবে সাহাবীরা যেভাবে ঈমান এনেছেন। তাদের ঈমান হল পরবর্তী সকল মানুষের ঈমানের মাপকাঠি। সাহাবীদের ঈমানের মাঝে কোন তরীকা, পীর-ফকির ও ভায়া-মাধ্যম ছিল না। তারা সরাসরি আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. সমাজের অধিকাংশ দুর্বল, গরীব সুবিধা বঞ্চিত ব্যক্তিরাই ইসলামের অনুসারী হয়।
২. সমাজের প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা দুর্বল ও গরীব মু’মিনদেরকে অনেকভাবে উপহাস করতে পারে। তাই বলে মনক্ষুন্ন হয়ে ইসলাম থেকে সরে যাওয়া যাবে না। তৎকালীন মক্কার প্রভাব ও বিত্তশালী কাফিররাও দুর্বল সাহাবীদেরকে বিভিন্ন কথা বলে উপহাস করত, তারপরও তারা ইসলাম থেকে এক চুলও সরে যায়নি।
2:14
وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قَالُوۡۤا اٰمَنَّا ۚۖ وَ اِذَا خَلَوۡا اِلٰی شَیٰطِیۡنِہِمۡ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا مَعَکُمۡ ۙ اِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿۱۴﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৪ ও ১৫ নং আয়াতের তাফসীর:
এটাও মুনাফিকদের একটি মুখের কথা যা তাদের অন্তরে নেই। যখন তারা মু’মিনদের সাথে একত্রিত হয় তখন নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করে, আবার যখন তাদের শয়তান সাথীদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা তাদেরকে বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।
বিশিষ্ট তাবেয়ী সুদ্দী ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, এখানে شَیٰطِیْنِھِمْ (শয়তান) দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মুশরিক, মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের নেতা ও সর্দার। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৩৮)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী ও অবাধ্যকে শয়তান বলা হয়। তারা জিন ও মানব উভয় জাতি থেকে হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَکَذٰلِکَ جَعَلْنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَالْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُھُمْ اِلٰی بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا)
“অনুরূপভাবে আমি মানব ও জিনের মধ্যে যারা শয়তান তাদেরকে প্রত্যেক নাবীর শত্র“ করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ কথা অতি গোপনীয়ভাবে জানিয়ে দেয়।”(সূরা আন‘আম ৬:১১২)
সুতরাং মুনাফিকরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অথবা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যখন ঈমানের কথা বলা দরকার তখন ঈমানের কথা বলে আর যখন কুফরী করা প্রযোজন হবে তখন কুফরী করে।
(إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ)
‘নিশ্চয়ই আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি’অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের শয়তান সাথীদের বলে: আমরা মু’মিনদের সাথে ঈমানের কথা বলে ঠাট্টা করি। মু’মিনদের সাথে ঠাট্টার বদলাস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে ঠাট্টা করেন। আল্লাহ তা‘আলার ঠাট্টা করা হল: তারা যে দুর্ভাগা ও খারাপ অবস্থায় আছে তা তাদের কাছে চাক্যচিক্য করে তুলে ধরেছেন, ফলে তাদের ধারণা যে তারা মু’মিনদের শামিল। আবার কিয়ামতের দিন তাদের সাথে ঠাট্টা করবেন এভাবে যে, মু’মিনদের মত তাদেরকেও পথ চলার জন্য বাহ্যিক নূর দেবেন কিন্তু যখন পথ চলতে শুরু করবে তখন তাদের নূর নিভে যাবে, ফলে অন্ধকারে নিরাশ হয়ে পড়ে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًاﺚ فَضُرِبَ بَیْنَھُمْ بِسُوْرٍ لَّھ۫ بَابٌﺚ بَاطِنُھ۫ فِیْھِ الرَّحْمَةُ وَظَاھِرُھ۫ مِنْ قِبَلِھِ الْعَذَابُ)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে রহমত এবং বহির্ভাগে আযাব।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন:
‘‘المكر و الخداع والسخرية
‘‘ অর্থাৎ ষড়যন্ত্র করা, ধোঁকা দেয়া ও ঠাট্টা করা ইত্যাদি স্বভাবসমূহ বিনা কারণে আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
তবে শাস্তি ও বদলাস্বরূপ ব্যবহৃত হলে কোন নিষেধ নেই। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) মূলতঃ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ঐ জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে শাস্তি ও প্রতিফল প্রদানের ক্ষেত্রে। অতএব ঐ স্বভাবগুলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য ব্যবহার হলে মাখলুকের ন্যায় ধারণা করা বৈধ হবে না।
(وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
‘তাদেরকে (তাদের) নিজেদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ফেরার জন্য ঢিল দেন’ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও কতক সাহাবী হতে বর্ণিত তারা বলেন: يمدهم এর অর্থ হচ্ছে يملي عليهم অর্থাৎ তাদেরকে অবকাশ দেন। মুজাহিদ বলেন: يمدهم এর অর্থ বৃদ্ধি করে দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَیَحْسَبُوْنَ اَنَّمَا نُمِدُّھُمْ بِھ۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِیْنَﮆﺫ نُسَارِعُ لَھُمْ فِی الْخَیْرٰتِﺚ بَلْ لَّا یَشْعُرُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্যস্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তা দ্বারা তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, বরং তারা বুঝে না।”(সূরা মু’মিনুন ২৩:৫৫-৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ)
“এমনভাবে ক্রমে ক্রমে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮২)
কেউ কেউ বলেছেন: যখনই তারা নতুন নতুন পাপকাজ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তখনই তাদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা ছিল নেয়ামত; প্রকৃতপক্ষে তা ছিল শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُکِّرُوْا بِھ۪ فَتَحْنَا عَلَیْھِمْ اَبْوَابَ کُلِّ شَیْءٍﺚ حثج اِذَا فَرِحُوْا بِمَآ اُوْتُوْٓا اَخَذْنٰھُمْ بَغْتَةً فَاِذَا ھُمْ مُّبْلِسُوْنَ)
“তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল তখন আমি তাদের জন্য সমস্ত কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল, অতঃপর হঠাৎ তাদেরকে ধরলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।”(সূরা আন‘আম ৬:৪৪)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: সঠিক কথা হল তাদের ঔদ্ধত্যতার অবকাশ দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ)
“তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।”(সূরা আন‘আম ৬:১১০)
ইবনু আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ, মুজাহিদ, আবুল আলিয়া (রহঃ) প্রমুখ বলেন:
(فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
এর অর্থ হচ্ছে তারা তাদের কুফরীতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হীনতায় উদভ্রান্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৪০)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. মুনাফিকরা নিজেদের ঘৃণ্য চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে, সুতরাং তারা কখনও ঈমানদার নয় প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যুক।
২. আল্লাহ তা‘আলা বে-ঈমানদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কুফরীর অবকাশ প্রদান করেন তাদের পরকালীন শাস্তি আরো বৃদ্ধি করার জন্য।
৩. মানুষ শয়তানরা জিন শয়তান থেকে অধিক ক্ষতিকর, মুনাফিকরাই মানুষ শয়তান।
এটাও মুনাফিকদের একটি মুখের কথা যা তাদের অন্তরে নেই। যখন তারা মু’মিনদের সাথে একত্রিত হয় তখন নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করে, আবার যখন তাদের শয়তান সাথীদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা তাদেরকে বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।
বিশিষ্ট তাবেয়ী সুদ্দী ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, এখানে شَیٰطِیْنِھِمْ (শয়তান) দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মুশরিক, মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের নেতা ও সর্দার। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৩৮)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী ও অবাধ্যকে শয়তান বলা হয়। তারা জিন ও মানব উভয় জাতি থেকে হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَکَذٰلِکَ جَعَلْنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَالْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُھُمْ اِلٰی بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا)
“অনুরূপভাবে আমি মানব ও জিনের মধ্যে যারা শয়তান তাদেরকে প্রত্যেক নাবীর শত্র“ করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ কথা অতি গোপনীয়ভাবে জানিয়ে দেয়।”(সূরা আন‘আম ৬:১১২)
সুতরাং মুনাফিকরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অথবা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যখন ঈমানের কথা বলা দরকার তখন ঈমানের কথা বলে আর যখন কুফরী করা প্রযোজন হবে তখন কুফরী করে।
(إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ)
‘নিশ্চয়ই আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি’অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের শয়তান সাথীদের বলে: আমরা মু’মিনদের সাথে ঈমানের কথা বলে ঠাট্টা করি। মু’মিনদের সাথে ঠাট্টার বদলাস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে ঠাট্টা করেন। আল্লাহ তা‘আলার ঠাট্টা করা হল: তারা যে দুর্ভাগা ও খারাপ অবস্থায় আছে তা তাদের কাছে চাক্যচিক্য করে তুলে ধরেছেন, ফলে তাদের ধারণা যে তারা মু’মিনদের শামিল। আবার কিয়ামতের দিন তাদের সাথে ঠাট্টা করবেন এভাবে যে, মু’মিনদের মত তাদেরকেও পথ চলার জন্য বাহ্যিক নূর দেবেন কিন্তু যখন পথ চলতে শুরু করবে তখন তাদের নূর নিভে যাবে, ফলে অন্ধকারে নিরাশ হয়ে পড়ে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًاﺚ فَضُرِبَ بَیْنَھُمْ بِسُوْرٍ لَّھ۫ بَابٌﺚ بَاطِنُھ۫ فِیْھِ الرَّحْمَةُ وَظَاھِرُھ۫ مِنْ قِبَلِھِ الْعَذَابُ)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে রহমত এবং বহির্ভাগে আযাব।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন:
‘‘المكر و الخداع والسخرية
‘‘ অর্থাৎ ষড়যন্ত্র করা, ধোঁকা দেয়া ও ঠাট্টা করা ইত্যাদি স্বভাবসমূহ বিনা কারণে আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
তবে শাস্তি ও বদলাস্বরূপ ব্যবহৃত হলে কোন নিষেধ নেই। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) মূলতঃ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ঐ জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে শাস্তি ও প্রতিফল প্রদানের ক্ষেত্রে। অতএব ঐ স্বভাবগুলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য ব্যবহার হলে মাখলুকের ন্যায় ধারণা করা বৈধ হবে না।
(وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
‘তাদেরকে (তাদের) নিজেদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ফেরার জন্য ঢিল দেন’ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও কতক সাহাবী হতে বর্ণিত তারা বলেন: يمدهم এর অর্থ হচ্ছে يملي عليهم অর্থাৎ তাদেরকে অবকাশ দেন। মুজাহিদ বলেন: يمدهم এর অর্থ বৃদ্ধি করে দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَیَحْسَبُوْنَ اَنَّمَا نُمِدُّھُمْ بِھ۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِیْنَﮆﺫ نُسَارِعُ لَھُمْ فِی الْخَیْرٰتِﺚ بَلْ لَّا یَشْعُرُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্যস্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তা দ্বারা তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, বরং তারা বুঝে না।”(সূরা মু’মিনুন ২৩:৫৫-৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ)
“এমনভাবে ক্রমে ক্রমে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮২)
কেউ কেউ বলেছেন: যখনই তারা নতুন নতুন পাপকাজ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তখনই তাদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা ছিল নেয়ামত; প্রকৃতপক্ষে তা ছিল শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُکِّرُوْا بِھ۪ فَتَحْنَا عَلَیْھِمْ اَبْوَابَ کُلِّ شَیْءٍﺚ حثج اِذَا فَرِحُوْا بِمَآ اُوْتُوْٓا اَخَذْنٰھُمْ بَغْتَةً فَاِذَا ھُمْ مُّبْلِسُوْنَ)
“তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল তখন আমি তাদের জন্য সমস্ত কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল, অতঃপর হঠাৎ তাদেরকে ধরলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।”(সূরা আন‘আম ৬:৪৪)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: সঠিক কথা হল তাদের ঔদ্ধত্যতার অবকাশ দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ)
“তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।”(সূরা আন‘আম ৬:১১০)
ইবনু আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ, মুজাহিদ, আবুল আলিয়া (রহঃ) প্রমুখ বলেন:
(فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
এর অর্থ হচ্ছে তারা তাদের কুফরীতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হীনতায় উদভ্রান্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৪০)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. মুনাফিকরা নিজেদের ঘৃণ্য চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে, সুতরাং তারা কখনও ঈমানদার নয় প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যুক।
২. আল্লাহ তা‘আলা বে-ঈমানদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কুফরীর অবকাশ প্রদান করেন তাদের পরকালীন শাস্তি আরো বৃদ্ধি করার জন্য।
৩. মানুষ শয়তানরা জিন শয়তান থেকে অধিক ক্ষতিকর, মুনাফিকরাই মানুষ শয়তান।
2:15
اَللّٰہُ یَسۡتَہۡزِئُ بِہِمۡ وَ یَمُدُّہُمۡ فِیۡ طُغۡیَانِہِمۡ یَعۡمَہُوۡنَ ﴿۱۵﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৪ ও ১৫ নং আয়াতের তাফসীর:
এটাও মুনাফিকদের একটি মুখের কথা যা তাদের অন্তরে নেই। যখন তারা মু’মিনদের সাথে একত্রিত হয় তখন নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করে, আবার যখন তাদের শয়তান সাথীদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা তাদেরকে বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।
বিশিষ্ট তাবেয়ী সুদ্দী ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, এখানে شَیٰطِیْنِھِمْ (শয়তান) দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মুশরিক, মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের নেতা ও সর্দার। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৩৮)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী ও অবাধ্যকে শয়তান বলা হয়। তারা জিন ও মানব উভয় জাতি থেকে হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَکَذٰلِکَ جَعَلْنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَالْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُھُمْ اِلٰی بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا)
“অনুরূপভাবে আমি মানব ও জিনের মধ্যে যারা শয়তান তাদেরকে প্রত্যেক নাবীর শত্র“ করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ কথা অতি গোপনীয়ভাবে জানিয়ে দেয়।”(সূরা আন‘আম ৬:১১২)
সুতরাং মুনাফিকরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অথবা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যখন ঈমানের কথা বলা দরকার তখন ঈমানের কথা বলে আর যখন কুফরী করা প্রযোজন হবে তখন কুফরী করে।
(إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ)
‘নিশ্চয়ই আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি’অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের শয়তান সাথীদের বলে: আমরা মু’মিনদের সাথে ঈমানের কথা বলে ঠাট্টা করি। মু’মিনদের সাথে ঠাট্টার বদলাস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে ঠাট্টা করেন। আল্লাহ তা‘আলার ঠাট্টা করা হল: তারা যে দুর্ভাগা ও খারাপ অবস্থায় আছে তা তাদের কাছে চাক্যচিক্য করে তুলে ধরেছেন, ফলে তাদের ধারণা যে তারা মু’মিনদের শামিল। আবার কিয়ামতের দিন তাদের সাথে ঠাট্টা করবেন এভাবে যে, মু’মিনদের মত তাদেরকেও পথ চলার জন্য বাহ্যিক নূর দেবেন কিন্তু যখন পথ চলতে শুরু করবে তখন তাদের নূর নিভে যাবে, ফলে অন্ধকারে নিরাশ হয়ে পড়ে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًاﺚ فَضُرِبَ بَیْنَھُمْ بِسُوْرٍ لَّھ۫ بَابٌﺚ بَاطِنُھ۫ فِیْھِ الرَّحْمَةُ وَظَاھِرُھ۫ مِنْ قِبَلِھِ الْعَذَابُ)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে রহমত এবং বহির্ভাগে আযাব।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন:
‘‘المكر و الخداع والسخرية
‘‘ অর্থাৎ ষড়যন্ত্র করা, ধোঁকা দেয়া ও ঠাট্টা করা ইত্যাদি স্বভাবসমূহ বিনা কারণে আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
তবে শাস্তি ও বদলাস্বরূপ ব্যবহৃত হলে কোন নিষেধ নেই। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) মূলতঃ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ঐ জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে শাস্তি ও প্রতিফল প্রদানের ক্ষেত্রে। অতএব ঐ স্বভাবগুলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য ব্যবহার হলে মাখলুকের ন্যায় ধারণা করা বৈধ হবে না।
(وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
‘তাদেরকে (তাদের) নিজেদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ফেরার জন্য ঢিল দেন’ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও কতক সাহাবী হতে বর্ণিত তারা বলেন: يمدهم এর অর্থ হচ্ছে يملي عليهم অর্থাৎ তাদেরকে অবকাশ দেন। মুজাহিদ বলেন: يمدهم এর অর্থ বৃদ্ধি করে দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَیَحْسَبُوْنَ اَنَّمَا نُمِدُّھُمْ بِھ۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِیْنَﮆﺫ نُسَارِعُ لَھُمْ فِی الْخَیْرٰتِﺚ بَلْ لَّا یَشْعُرُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্যস্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তা দ্বারা তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, বরং তারা বুঝে না।”(সূরা মু’মিনুন ২৩:৫৫-৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ)
“এমনভাবে ক্রমে ক্রমে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮২)
কেউ কেউ বলেছেন: যখনই তারা নতুন নতুন পাপকাজ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তখনই তাদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা ছিল নেয়ামত; প্রকৃতপক্ষে তা ছিল শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُکِّرُوْا بِھ۪ فَتَحْنَا عَلَیْھِمْ اَبْوَابَ کُلِّ شَیْءٍﺚ حثج اِذَا فَرِحُوْا بِمَآ اُوْتُوْٓا اَخَذْنٰھُمْ بَغْتَةً فَاِذَا ھُمْ مُّبْلِسُوْنَ)
“তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল তখন আমি তাদের জন্য সমস্ত কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল, অতঃপর হঠাৎ তাদেরকে ধরলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।”(সূরা আন‘আম ৬:৪৪)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: সঠিক কথা হল তাদের ঔদ্ধত্যতার অবকাশ দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ)
“তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।”(সূরা আন‘আম ৬:১১০)
ইবনু আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ, মুজাহিদ, আবুল আলিয়া (রহঃ) প্রমুখ বলেন:
(فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
এর অর্থ হচ্ছে তারা তাদের কুফরীতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হীনতায় উদভ্রান্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৪০)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. মুনাফিকরা নিজেদের ঘৃণ্য চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে, সুতরাং তারা কখনও ঈমানদার নয় প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যুক।
২. আল্লাহ তা‘আলা বে-ঈমানদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কুফরীর অবকাশ প্রদান করেন তাদের পরকালীন শাস্তি আরো বৃদ্ধি করার জন্য।
৩. মানুষ শয়তানরা জিন শয়তান থেকে অধিক ক্ষতিকর, মুনাফিকরাই মানুষ শয়তান।
এটাও মুনাফিকদের একটি মুখের কথা যা তাদের অন্তরে নেই। যখন তারা মু’মিনদের সাথে একত্রিত হয় তখন নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করে, আবার যখন তাদের শয়তান সাথীদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা তাদেরকে বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।
বিশিষ্ট তাবেয়ী সুদ্দী ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, এখানে شَیٰطِیْنِھِمْ (শয়তান) দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মুশরিক, মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের নেতা ও সর্দার। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৩৮)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী ও অবাধ্যকে শয়তান বলা হয়। তারা জিন ও মানব উভয় জাতি থেকে হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَکَذٰلِکَ جَعَلْنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَالْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُھُمْ اِلٰی بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا)
“অনুরূপভাবে আমি মানব ও জিনের মধ্যে যারা শয়তান তাদেরকে প্রত্যেক নাবীর শত্র“ করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ কথা অতি গোপনীয়ভাবে জানিয়ে দেয়।”(সূরা আন‘আম ৬:১১২)
সুতরাং মুনাফিকরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অথবা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যখন ঈমানের কথা বলা দরকার তখন ঈমানের কথা বলে আর যখন কুফরী করা প্রযোজন হবে তখন কুফরী করে।
(إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ)
‘নিশ্চয়ই আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি’অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের শয়তান সাথীদের বলে: আমরা মু’মিনদের সাথে ঈমানের কথা বলে ঠাট্টা করি। মু’মিনদের সাথে ঠাট্টার বদলাস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে ঠাট্টা করেন। আল্লাহ তা‘আলার ঠাট্টা করা হল: তারা যে দুর্ভাগা ও খারাপ অবস্থায় আছে তা তাদের কাছে চাক্যচিক্য করে তুলে ধরেছেন, ফলে তাদের ধারণা যে তারা মু’মিনদের শামিল। আবার কিয়ামতের দিন তাদের সাথে ঠাট্টা করবেন এভাবে যে, মু’মিনদের মত তাদেরকেও পথ চলার জন্য বাহ্যিক নূর দেবেন কিন্তু যখন পথ চলতে শুরু করবে তখন তাদের নূর নিভে যাবে, ফলে অন্ধকারে নিরাশ হয়ে পড়ে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًاﺚ فَضُرِبَ بَیْنَھُمْ بِسُوْرٍ لَّھ۫ بَابٌﺚ بَاطِنُھ۫ فِیْھِ الرَّحْمَةُ وَظَاھِرُھ۫ مِنْ قِبَلِھِ الْعَذَابُ)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে রহমত এবং বহির্ভাগে আযাব।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন:
‘‘المكر و الخداع والسخرية
‘‘ অর্থাৎ ষড়যন্ত্র করা, ধোঁকা দেয়া ও ঠাট্টা করা ইত্যাদি স্বভাবসমূহ বিনা কারণে আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
তবে শাস্তি ও বদলাস্বরূপ ব্যবহৃত হলে কোন নিষেধ নেই। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) মূলতঃ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ঐ জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে শাস্তি ও প্রতিফল প্রদানের ক্ষেত্রে। অতএব ঐ স্বভাবগুলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য ব্যবহার হলে মাখলুকের ন্যায় ধারণা করা বৈধ হবে না।
(وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
‘তাদেরকে (তাদের) নিজেদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ফেরার জন্য ঢিল দেন’ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও কতক সাহাবী হতে বর্ণিত তারা বলেন: يمدهم এর অর্থ হচ্ছে يملي عليهم অর্থাৎ তাদেরকে অবকাশ দেন। মুজাহিদ বলেন: يمدهم এর অর্থ বৃদ্ধি করে দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَیَحْسَبُوْنَ اَنَّمَا نُمِدُّھُمْ بِھ۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِیْنَﮆﺫ نُسَارِعُ لَھُمْ فِی الْخَیْرٰتِﺚ بَلْ لَّا یَشْعُرُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্যস্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তা দ্বারা তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, বরং তারা বুঝে না।”(সূরা মু’মিনুন ২৩:৫৫-৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ)
“এমনভাবে ক্রমে ক্রমে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮২)
কেউ কেউ বলেছেন: যখনই তারা নতুন নতুন পাপকাজ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তখনই তাদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা ছিল নেয়ামত; প্রকৃতপক্ষে তা ছিল শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُکِّرُوْا بِھ۪ فَتَحْنَا عَلَیْھِمْ اَبْوَابَ کُلِّ شَیْءٍﺚ حثج اِذَا فَرِحُوْا بِمَآ اُوْتُوْٓا اَخَذْنٰھُمْ بَغْتَةً فَاِذَا ھُمْ مُّبْلِسُوْنَ)
“তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল তখন আমি তাদের জন্য সমস্ত কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল, অতঃপর হঠাৎ তাদেরকে ধরলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।”(সূরা আন‘আম ৬:৪৪)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: সঠিক কথা হল তাদের ঔদ্ধত্যতার অবকাশ দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ)
“তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।”(সূরা আন‘আম ৬:১১০)
ইবনু আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ, মুজাহিদ, আবুল আলিয়া (রহঃ) প্রমুখ বলেন:
(فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
এর অর্থ হচ্ছে তারা তাদের কুফরীতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হীনতায় উদভ্রান্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৪০)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. মুনাফিকরা নিজেদের ঘৃণ্য চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে, সুতরাং তারা কখনও ঈমানদার নয় প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যুক।
২. আল্লাহ তা‘আলা বে-ঈমানদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কুফরীর অবকাশ প্রদান করেন তাদের পরকালীন শাস্তি আরো বৃদ্ধি করার জন্য।
৩. মানুষ শয়তানরা জিন শয়তান থেকে অধিক ক্ষতিকর, মুনাফিকরাই মানুষ শয়তান।
2:16
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الضَّلٰلَۃَ بِالۡہُدٰی ۪ فَمَا رَبِحَتۡ تِّجَارَتُہُمۡ وَ مَا کَانُوۡا مُہۡتَدِیۡنَ ﴿۱۶﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার পর এ আয়াতে তাদের কর্মের ফলাফল বর্ণনা করা হচ্ছে। তারা ইসলামকে কাছে থেকে দেখেছে এবং ইসলামের বিষয়গুলো ভালভাবে অনুধাবন করেছে আর কুফরীতে তো পূর্ব থেকেই লিপ্ত ছিল। অতঃপর ইসলাম ও কুফর উভয়কে দেখে-বুঝেও তাদের দুনিয়ার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামের পরিবর্তে কুফরকে গ্রহণ করেছে। তাদের এ কাজকে ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করে জানানো হয়েছে যে, তাদের ব্যবসায়ের কোন যোগ্যতাই নেই। তারা উত্তম ও মূল্যবান বস্তু ‘ঈমানের’পরিবর্তে নিকৃষ্ট ও মূল্যহীন বস্তু ‘কুফর’ক্রয় করেছে। ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ)-সহ কতক সাহাবী হতে বর্ণিত যে, তারা হিদায়াতকে ছেড়ে গোমরাহীকে গ্রহণ করেছে। অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ঈমানের পরিবর্তে কুফরীকে গ্রহণ করেছে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: ওপরে উল্লিখিত মুফাসসিরদের কথার সারাংশ হল মুনাফিকরা হিদায়াত থেকে সরে গোমরাহীর পথ বেছে নিয়েছে। এটিই হল আয়াতের প্রকৃত অর্থ।
পূর্বের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার পর এ আয়াতে তাদের কর্মের ফলাফল বর্ণনা করা হচ্ছে। তারা ইসলামকে কাছে থেকে দেখেছে এবং ইসলামের বিষয়গুলো ভালভাবে অনুধাবন করেছে আর কুফরীতে তো পূর্ব থেকেই লিপ্ত ছিল। অতঃপর ইসলাম ও কুফর উভয়কে দেখে-বুঝেও তাদের দুনিয়ার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামের পরিবর্তে কুফরকে গ্রহণ করেছে। তাদের এ কাজকে ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করে জানানো হয়েছে যে, তাদের ব্যবসায়ের কোন যোগ্যতাই নেই। তারা উত্তম ও মূল্যবান বস্তু ‘ঈমানের’পরিবর্তে নিকৃষ্ট ও মূল্যহীন বস্তু ‘কুফর’ক্রয় করেছে। ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ)-সহ কতক সাহাবী হতে বর্ণিত যে, তারা হিদায়াতকে ছেড়ে গোমরাহীকে গ্রহণ করেছে। অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ঈমানের পরিবর্তে কুফরীকে গ্রহণ করেছে।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: ওপরে উল্লিখিত মুফাসসিরদের কথার সারাংশ হল মুনাফিকরা হিদায়াত থেকে সরে গোমরাহীর পথ বেছে নিয়েছে। এটিই হল আয়াতের প্রকৃত অর্থ।
2:17
مَثَلُہُمۡ کَمَثَلِ الَّذِی اسۡتَوۡقَدَ نَارًا ۚ فَلَمَّاۤ اَضَآءَتۡ مَا حَوۡلَہٗ ذَہَبَ اللّٰہُ بِنُوۡرِہِمۡ وَ تَرَکَہُمۡ فِیۡ ظُلُمٰتٍ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ ﴿۱۷﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৭ ও ১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের আলামত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা পর এখানে তাদের ক্রিয়াকলাপকে বাস্তবতার সাথে উপমা দিচ্ছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের দু’টি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। প্রথমতঃ আগুনের দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়তঃ পানির দৃষ্টান্ত।
প্রথম দৃষ্টান্ত: তাদের অবস্থান এমন যে, কোন ব্যক্তি আগুন প্রজ্জ্বলিত করল আলো গ্রহণ ও উপকৃত হওয়ার জন্য। যাতে সে আলোর দ্বারা ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তাদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান না থাকায় সে আলো ধরে রাখতে পারে না। ফলে আগুন প্রজ্জ্বলনের কারণে যে আলো হয় আল্লাহ তা‘আলা তা নিয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذَھَبَ اللہُ بِنُوْرِھِمْ)
তিনি তাদের আলো নিয়ে যান। তাদেরকে অন্ধকারের মধ্যে ফেলে রাখেন।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: তাদেরকে সাদৃশ্য দিয়েছেন ঐ ব্যক্তির সাথে যে ব্যক্তিকে বৃষ্টি পেল তাতে রয়েছে অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। তা থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারণ কুরআন আদেশ, নিষেধ ও সম্বোধন নিয়ে মুনাফিকদের প্রতি বজ্রাঘাতের ন্যায় নাযিল হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত ১৯ ও ২০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত তারা বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর কতকগুলো লোক ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু পরে তারা মুনাফিক হয়ে যায়। তাদের উপমা ঐ লোকটির মত, যে অন্ধকারে রয়েছে অতঃপর আগুন জ্বালিয়ে আলো লাভ করেছে এবং আশে-পাশের ভাল-মন্দ জিনিস দেখতে পেয়েছে, আর কোন্ পথে কী আছে তা সবই জানতে পেরেছে। এমন সময় হঠাৎ আগুন নিভে যাওয়ার ফলে আলো হারিয়ে গেছে; এখন পথে কী আছে না আছে তা জানতে পারে না। ঠিক এ রকমই মুনাফিকরা শির্ক ও কুফরের অন্ধকারে ছিল। অতঃপর ঈমান এনে ভাল-মন্দ অর্থাৎ কুফর-ইসলাম ইত্যাদি চিনতে পারল। কিন্তু পুনরায় কাফির হয়ে যায়; ফলে ইসলামের হালাল-হারাম ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।
অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এটি মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত, তারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে সম্মান পেয়ে যায়। মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে উত্তরাধিকার এবং গনীমতের অংশ ইত্যাদি পেতে থাকে। কিন্তু মরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ সম্মান হারিয়ে যায়। যেমন, আগুনের আলো নিভে গেলেই সব শেষ হয়ে যায়।
(صُمّۭ بُکْمٌ عُمْیٌ)
‘তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ’এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মুনাফিকরা সত্য প্রকাশ করতে বধির, বাকশক্তিহীন ও সত্য প্রত্যক্ষ করতে অন্ধ প্রভৃতি দোষে দুষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র তাদের বধিরতা, বাকশক্তিহীনতা ও অন্ধত্বের অর্থ বর্ণনা করেছেন। তা হল তাদের কর্ণ, অন্তর ও দৃষ্টিশক্তি দ্বারা উপকৃত না হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَجَعَلْنَا لَھُمْ سَمْعًا وَّاَبْصَارًا وَّاَفْئِدَةًﺘ فَمَآ اَغْنٰی عَنْھُمْ سَمْعُھُمْ وَلَآ اَبْصَارُھُمْ وَلَآ اَفْئِدَتُھُمْ مِّنْ شَیْءٍ اِذْ کَانُوْا یَجْحَدُوْنَﺫ بِاٰیٰتِ اللہِ وَحَاقَ بِھِمْ مَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আমি তাদেরকে কান, চোখ ও অন্তর দিয়েছিলাম: কিন্তু শোনার, দেখার ও বুঝার (এ শক্তিগুলো) তাদের কোনো কাজে আসল না। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছিল। যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-তামাশা করত তা-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলল।” (সূরা আহক্বাফ ৪৬:২৬, আযওয়াউল বায়ান ১/৬৪) অতএব তাদের কান, চোখ ও হৃদয় থাকা সত্যেও উপকৃত না হতে পারায় যেন তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুনাফিকরা সুবিধাবাদী, স্বার্থ হাসিল করার লক্ষে যখন যাদের সাথে যেমন আচরণ করা দরকার তেমন আচরণ করে।
২. মুনাফিকরা সত্য গ্রহণে বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের আলামত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা পর এখানে তাদের ক্রিয়াকলাপকে বাস্তবতার সাথে উপমা দিচ্ছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের দু’টি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। প্রথমতঃ আগুনের দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়তঃ পানির দৃষ্টান্ত।
প্রথম দৃষ্টান্ত: তাদের অবস্থান এমন যে, কোন ব্যক্তি আগুন প্রজ্জ্বলিত করল আলো গ্রহণ ও উপকৃত হওয়ার জন্য। যাতে সে আলোর দ্বারা ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তাদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান না থাকায় সে আলো ধরে রাখতে পারে না। ফলে আগুন প্রজ্জ্বলনের কারণে যে আলো হয় আল্লাহ তা‘আলা তা নিয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذَھَبَ اللہُ بِنُوْرِھِمْ)
তিনি তাদের আলো নিয়ে যান। তাদেরকে অন্ধকারের মধ্যে ফেলে রাখেন।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: তাদেরকে সাদৃশ্য দিয়েছেন ঐ ব্যক্তির সাথে যে ব্যক্তিকে বৃষ্টি পেল তাতে রয়েছে অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। তা থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারণ কুরআন আদেশ, নিষেধ ও সম্বোধন নিয়ে মুনাফিকদের প্রতি বজ্রাঘাতের ন্যায় নাযিল হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত ১৯ ও ২০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত তারা বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর কতকগুলো লোক ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু পরে তারা মুনাফিক হয়ে যায়। তাদের উপমা ঐ লোকটির মত, যে অন্ধকারে রয়েছে অতঃপর আগুন জ্বালিয়ে আলো লাভ করেছে এবং আশে-পাশের ভাল-মন্দ জিনিস দেখতে পেয়েছে, আর কোন্ পথে কী আছে তা সবই জানতে পেরেছে। এমন সময় হঠাৎ আগুন নিভে যাওয়ার ফলে আলো হারিয়ে গেছে; এখন পথে কী আছে না আছে তা জানতে পারে না। ঠিক এ রকমই মুনাফিকরা শির্ক ও কুফরের অন্ধকারে ছিল। অতঃপর ঈমান এনে ভাল-মন্দ অর্থাৎ কুফর-ইসলাম ইত্যাদি চিনতে পারল। কিন্তু পুনরায় কাফির হয়ে যায়; ফলে ইসলামের হালাল-হারাম ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।
অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এটি মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত, তারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে সম্মান পেয়ে যায়। মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে উত্তরাধিকার এবং গনীমতের অংশ ইত্যাদি পেতে থাকে। কিন্তু মরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ সম্মান হারিয়ে যায়। যেমন, আগুনের আলো নিভে গেলেই সব শেষ হয়ে যায়।
(صُمّۭ بُکْمٌ عُمْیٌ)
‘তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ’এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মুনাফিকরা সত্য প্রকাশ করতে বধির, বাকশক্তিহীন ও সত্য প্রত্যক্ষ করতে অন্ধ প্রভৃতি দোষে দুষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র তাদের বধিরতা, বাকশক্তিহীনতা ও অন্ধত্বের অর্থ বর্ণনা করেছেন। তা হল তাদের কর্ণ, অন্তর ও দৃষ্টিশক্তি দ্বারা উপকৃত না হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَجَعَلْنَا لَھُمْ سَمْعًا وَّاَبْصَارًا وَّاَفْئِدَةًﺘ فَمَآ اَغْنٰی عَنْھُمْ سَمْعُھُمْ وَلَآ اَبْصَارُھُمْ وَلَآ اَفْئِدَتُھُمْ مِّنْ شَیْءٍ اِذْ کَانُوْا یَجْحَدُوْنَﺫ بِاٰیٰتِ اللہِ وَحَاقَ بِھِمْ مَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আমি তাদেরকে কান, চোখ ও অন্তর দিয়েছিলাম: কিন্তু শোনার, দেখার ও বুঝার (এ শক্তিগুলো) তাদের কোনো কাজে আসল না। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছিল। যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-তামাশা করত তা-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলল।” (সূরা আহক্বাফ ৪৬:২৬, আযওয়াউল বায়ান ১/৬৪) অতএব তাদের কান, চোখ ও হৃদয় থাকা সত্যেও উপকৃত না হতে পারায় যেন তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুনাফিকরা সুবিধাবাদী, স্বার্থ হাসিল করার লক্ষে যখন যাদের সাথে যেমন আচরণ করা দরকার তেমন আচরণ করে।
২. মুনাফিকরা সত্য গ্রহণে বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
2:18
صُمٌّۢ بُکۡمٌ عُمۡیٌ فَہُمۡ لَا یَرۡجِعُوۡنَ ﴿ۙ۱۸﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৭ ও ১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের আলামত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা পর এখানে তাদের ক্রিয়াকলাপকে বাস্তবতার সাথে উপমা দিচ্ছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের দু’টি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। প্রথমতঃ আগুনের দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়তঃ পানির দৃষ্টান্ত।
প্রথম দৃষ্টান্ত: তাদের অবস্থান এমন যে, কোন ব্যক্তি আগুন প্রজ্জ্বলিত করল আলো গ্রহণ ও উপকৃত হওয়ার জন্য। যাতে সে আলোর দ্বারা ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তাদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান না থাকায় সে আলো ধরে রাখতে পারে না। ফলে আগুন প্রজ্জ্বলনের কারণে যে আলো হয় আল্লাহ তা‘আলা তা নিয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذَھَبَ اللہُ بِنُوْرِھِمْ)
তিনি তাদের আলো নিয়ে যান। তাদেরকে অন্ধকারের মধ্যে ফেলে রাখেন।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: তাদেরকে সাদৃশ্য দিয়েছেন ঐ ব্যক্তির সাথে যে ব্যক্তিকে বৃষ্টি পেল তাতে রয়েছে অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। তা থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারণ কুরআন আদেশ, নিষেধ ও সম্বোধন নিয়ে মুনাফিকদের প্রতি বজ্রাঘাতের ন্যায় নাযিল হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত ১৯ ও ২০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত তারা বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর কতকগুলো লোক ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু পরে তারা মুনাফিক হয়ে যায়। তাদের উপমা ঐ লোকটির মত, যে অন্ধকারে রয়েছে অতঃপর আগুন জ্বালিয়ে আলো লাভ করেছে এবং আশে-পাশের ভাল-মন্দ জিনিস দেখতে পেয়েছে, আর কোন্ পথে কী আছে তা সবই জানতে পেরেছে। এমন সময় হঠাৎ আগুন নিভে যাওয়ার ফলে আলো হারিয়ে গেছে; এখন পথে কী আছে না আছে তা জানতে পারে না। ঠিক এ রকমই মুনাফিকরা শির্ক ও কুফরের অন্ধকারে ছিল। অতঃপর ঈমান এনে ভাল-মন্দ অর্থাৎ কুফর-ইসলাম ইত্যাদি চিনতে পারল। কিন্তু পুনরায় কাফির হয়ে যায়; ফলে ইসলামের হালাল-হারাম ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।
অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এটি মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত, তারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে সম্মান পেয়ে যায়। মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে উত্তরাধিকার এবং গনীমতের অংশ ইত্যাদি পেতে থাকে। কিন্তু মরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ সম্মান হারিয়ে যায়। যেমন, আগুনের আলো নিভে গেলেই সব শেষ হয়ে যায়।
(صُمّۭ بُکْمٌ عُمْیٌ)
‘তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ’এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মুনাফিকরা সত্য প্রকাশ করতে বধির, বাকশক্তিহীন ও সত্য প্রত্যক্ষ করতে অন্ধ প্রভৃতি দোষে দুষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র তাদের বধিরতা, বাকশক্তিহীনতা ও অন্ধত্বের অর্থ বর্ণনা করেছেন। তা হল তাদের কর্ণ, অন্তর ও দৃষ্টিশক্তি দ্বারা উপকৃত না হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَجَعَلْنَا لَھُمْ سَمْعًا وَّاَبْصَارًا وَّاَفْئِدَةًﺘ فَمَآ اَغْنٰی عَنْھُمْ سَمْعُھُمْ وَلَآ اَبْصَارُھُمْ وَلَآ اَفْئِدَتُھُمْ مِّنْ شَیْءٍ اِذْ کَانُوْا یَجْحَدُوْنَﺫ بِاٰیٰتِ اللہِ وَحَاقَ بِھِمْ مَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আমি তাদেরকে কান, চোখ ও অন্তর দিয়েছিলাম: কিন্তু শোনার, দেখার ও বুঝার (এ শক্তিগুলো) তাদের কোনো কাজে আসল না। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছিল। যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-তামাশা করত তা-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলল।” (সূরা আহক্বাফ ৪৬:২৬, আযওয়াউল বায়ান ১/৬৪) অতএব তাদের কান, চোখ ও হৃদয় থাকা সত্যেও উপকৃত না হতে পারায় যেন তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. মুনাফিকরা সুবিধাবাদী, স্বার্থ হাসিল করার লক্ষে যখন যাদের সাথে যেমন আচরণ করা দরকার তেমন আচরণ করে।
২. মুনাফিকরা সত্য গ্রহণে বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের আলামত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা পর এখানে তাদের ক্রিয়াকলাপকে বাস্তবতার সাথে উপমা দিচ্ছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের দু’টি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। প্রথমতঃ আগুনের দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়তঃ পানির দৃষ্টান্ত।
প্রথম দৃষ্টান্ত: তাদের অবস্থান এমন যে, কোন ব্যক্তি আগুন প্রজ্জ্বলিত করল আলো গ্রহণ ও উপকৃত হওয়ার জন্য। যাতে সে আলোর দ্বারা ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তাদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান না থাকায় সে আলো ধরে রাখতে পারে না। ফলে আগুন প্রজ্জ্বলনের কারণে যে আলো হয় আল্লাহ তা‘আলা তা নিয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذَھَبَ اللہُ بِنُوْرِھِمْ)
তিনি তাদের আলো নিয়ে যান। তাদেরকে অন্ধকারের মধ্যে ফেলে রাখেন।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: তাদেরকে সাদৃশ্য দিয়েছেন ঐ ব্যক্তির সাথে যে ব্যক্তিকে বৃষ্টি পেল তাতে রয়েছে অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। তা থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারণ কুরআন আদেশ, নিষেধ ও সম্বোধন নিয়ে মুনাফিকদের প্রতি বজ্রাঘাতের ন্যায় নাযিল হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত ১৯ ও ২০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত তারা বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর কতকগুলো লোক ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু পরে তারা মুনাফিক হয়ে যায়। তাদের উপমা ঐ লোকটির মত, যে অন্ধকারে রয়েছে অতঃপর আগুন জ্বালিয়ে আলো লাভ করেছে এবং আশে-পাশের ভাল-মন্দ জিনিস দেখতে পেয়েছে, আর কোন্ পথে কী আছে তা সবই জানতে পেরেছে। এমন সময় হঠাৎ আগুন নিভে যাওয়ার ফলে আলো হারিয়ে গেছে; এখন পথে কী আছে না আছে তা জানতে পারে না। ঠিক এ রকমই মুনাফিকরা শির্ক ও কুফরের অন্ধকারে ছিল। অতঃপর ঈমান এনে ভাল-মন্দ অর্থাৎ কুফর-ইসলাম ইত্যাদি চিনতে পারল। কিন্তু পুনরায় কাফির হয়ে যায়; ফলে ইসলামের হালাল-হারাম ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।
অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এটি মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত, তারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে সম্মান পেয়ে যায়। মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে উত্তরাধিকার এবং গনীমতের অংশ ইত্যাদি পেতে থাকে। কিন্তু মরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ সম্মান হারিয়ে যায়। যেমন, আগুনের আলো নিভে গেলেই সব শেষ হয়ে যায়।
(صُمّۭ بُکْمٌ عُمْیٌ)
‘তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ’এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মুনাফিকরা সত্য প্রকাশ করতে বধির, বাকশক্তিহীন ও সত্য প্রত্যক্ষ করতে অন্ধ প্রভৃতি দোষে দুষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র তাদের বধিরতা, বাকশক্তিহীনতা ও অন্ধত্বের অর্থ বর্ণনা করেছেন। তা হল তাদের কর্ণ, অন্তর ও দৃষ্টিশক্তি দ্বারা উপকৃত না হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَجَعَلْنَا لَھُمْ سَمْعًا وَّاَبْصَارًا وَّاَفْئِدَةًﺘ فَمَآ اَغْنٰی عَنْھُمْ سَمْعُھُمْ وَلَآ اَبْصَارُھُمْ وَلَآ اَفْئِدَتُھُمْ مِّنْ شَیْءٍ اِذْ کَانُوْا یَجْحَدُوْنَﺫ بِاٰیٰتِ اللہِ وَحَاقَ بِھِمْ مَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)
“আমি তাদেরকে কান, চোখ ও অন্তর দিয়েছিলাম: কিন্তু শোনার, দেখার ও বুঝার (এ শক্তিগুলো) তাদের কোনো কাজে আসল না। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছিল। যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-তামাশা করত তা-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলল।” (সূরা আহক্বাফ ৪৬:২৬, আযওয়াউল বায়ান ১/৬৪) অতএব তাদের কান, চোখ ও হৃদয় থাকা সত্যেও উপকৃত না হতে পারায় যেন তারা বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. মুনাফিকরা সুবিধাবাদী, স্বার্থ হাসিল করার লক্ষে যখন যাদের সাথে যেমন আচরণ করা দরকার তেমন আচরণ করে।
২. মুনাফিকরা সত্য গ্রহণে বধির, বাকশক্তিহীন ও অন্ধ।
2:19
اَوۡ کَصَیِّبٍ مِّنَ السَّمَآءِ فِیۡہِ ظُلُمٰتٌ وَّ رَعۡدٌ وَّ بَرۡقٌ ۚ یَجۡعَلُوۡنَ اَصَابِعَہُمۡ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ مِّنَ الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اللّٰہُ مُحِیۡطٌۢ بِالۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۹﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৯ ও ২০ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ ও আরো কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত তারা বলেন: মদীনাবাসীদের মধ্যে দু’জন মুনাফিক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে পলায়ন করে মুশরিকদের কাছে চলে যায়। তখন পথিমধ্যে তাদেরকে বিদ্যুৎ ও প্রকট বজ্রধ্বনিসহ বৃষ্টি পেয়ে বসল, আল্লাহ তা‘আলা যে বৃষ্টির কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। যখন তাদেরকে বজ্রাঘাত করত তখনই তারা উভয়ে তাদের কানের ছিদ্রে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত। যাতে তাদের কানের ভেতরে বজ্রধ্বনি প্রবেশ করে তাদের মৃত্যুর কারণ না হয়। যখন বিদ্যুৎ চমকাত তখন উভয়ে আলো দেখে দেখে পথ চলত আর যখন বিুদ্যৎ চমকাত না তখন কিছুই দেখতে পেত না। এভাবে তারা হেঁটে তাদের স্বস্থানে ফিরে আসল এবং উভয়ে বলতে লাগল যদি আমরা সকাল করতে পারি তাহলে মুহাম্মাদের কাছে এসে আমরা তার হাতে আমাদের হাত রাখব।
পরদিন সকালে তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলো। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করল, তাঁর হাতের ওপর হাত রাখল (বাইয়াত গ্রহণ করল) এবং তারা ইসলাম মেনে নিল। আল্লাহ তা‘আলা এ দু’জন মুনাফিকের দৃষ্টান্ত মদীনাবাসীর সকল মুনাফিকদের জন্য পেশ করেছেন। (মদীনার) মুনাফিকরা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মজলিসে উপস্থিত হত তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা না শোনার জন্য তারা তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত এ আশঙ্কায় যে, তাদের ব্যাপারে কোন কিছু নাযিল হয়ে যাবে। অথবা তাদের ব্যাপারে এমন কিছু উল্লেখ করবে ফলে তারা নিহত হয়ে যাবে। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক মৃত্যু ভয়ে তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবিন নুযূল, ১৭-১৮, ইবনু জারীর আত্ব-তাবারী, ১ম খণ্ড, ২২১, বর্ণনাটি হাসান)
(كُلَّمَآ أَضَا۬ءَ لَهُمْ مَّشَوْا فِيْهِ)
“তখন তাতে তারা চলতে থাকে যখন তিনি তাদের জন্য একটু আলো (বিদ্যুৎ) প্রজ্জ্বলিত করেন” অর্থাৎ যখন তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি অধিক হত এবং প্রচুর পরিমাণ গনীমত লাভ করত তখন দীন-ইসলামের ওপর তারা বহাল থাকত এবং বলত: মুহাম্মাদের দীন সত্য। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক বিদ্যুতের আলোতে পথ চলত।
(وَإِذَآ أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُوْا)
“এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার আচ্ছন্ন করেন তখন তারা দাঁড়িয়ে থাকে।”অর্থাৎ যখন তাদের এ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ধ্বংস হয়ে যেত এবং বালা-মুসিবত তাদের ওপর আপতিত হত তখন তারা বলত, এসব মুহাম্মাদের কারণেই। আর তারা মুরতাদ হয়ে যেত। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবস্থায় বলেছিল।الصيب- (اَوْ کَصَیِّبٍ)
(আস-সায়্যিবু)-এর অর্থ বৃষ্টি। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে হিদায়াত ও জ্ঞান নিয়ে এসেছেন আল্লাহ তা‘আলা তা এ আয়াতে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা হিদায়াত ও জ্ঞান হল আত্মার জীবন। যেমন বৃষ্টি হল শরীরের জীবন। উদাহরণের দিকে ঈঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُه۫ بِإِذْنِ رَبِّه۪ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا)
“এবং উৎকৃষ্ট ভূমির ফসল তার প্রতিপালকের আদেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে কঠোর পরিশ্রম না করলে কিছুই জন্মায় না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:৫৮)
এ দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার উদাহরণ হল বৃষ্টির মত। কোন একস্থানে বর্ষণ হল অতঃপর তার কিছু উর্বর জায়গা পানি ধারণ করল। ফলে প্রচুর পরিমাণে ঘাস জন্মাল। মানুষরা তাত্থেকে পান করল, পশু-পাখিদের পান করাল এবং শস্য উৎপন্ন করল। এটাই হল ঐ ব্যক্তির উপমা যে ব্যক্তি দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তা দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে ইলম অর্জন করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়। আর তার কিছু অংশ রয়েছে যা পানিও ধরে রাখতে পারে না এবং ঘাসও উৎপন্ন করে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৮২)
(فِيْهِ ظُلُمَاتٌ)
‘যাতে রয়েছে অন্ধকার’আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বৃষ্টির অন্ধকার দ্বারা কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে দৃষ্টান্ত পেশ করছেন। তারা কুরআন সম্পর্কে যে সন্দেহ-সংশয় পোষণ করে, সে জন্য তাদের কষ্টে নিপতিত করা। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, এটা তাদের কাছে অন্ধকারের মত। কেননা তা তাদের অন্ধত্বই বৃদ্ধি করে দেয়।َعْدٌ ‘গর্জন’আল্লাহ তা‘আলা বজ্রধ্বনি দ্বারা মুনাফিকদের উদাহরণ দিয়েছেন। কেননা কুরআনে তাদেরকে এমন ধমক দেয়া হয়েছে যা কানকে ছিদ্র করে দেয় এবং অন্তরকে ফাটিয়ে দেয়।وَّبَرْقٌ ‘বিদ্যুৎ চমক’ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এর ভাবার্থ এই যে, কুরআন মাজীদের মজবুত আয়াতগুলো এসব মুনাফিকদের প্রকৃত অবস্থা খুলে দেবে ও তাদের গোপনীয় দোষ প্রকাশ করবে এবং আপন উজ্জ্বলতার দ্বারা তাদেরকে হতভম্ব করে দিবে। যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন তারা দাঁড়িয়ে যায়। অর্থাৎ যখন তাদের ঈমান প্রকাশ পায় তখন তাদের অন্তর কিছু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তারা এর অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু যখনই সন্দেহ ও সংশয়ের উদ্রেক হয় তখনই অন্তরের মধ্যে অন্ধকার ছেয়ে যায়, তখন সে হয়রান পেরেশান হয়ে যায়। অথবা এর ভাব এও হতে পারে যে, যখন ইসলামের কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়, তখন তাদের মনে কিছুটা স্থিরতা আসে, কিন্তু যখনই তার বিপরীত পরিলক্ষিত হয় তখনই তারা কুফরীর দিকে ফিরে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّعْبُدُ اللہَ عَلٰی حَرْفٍﺆ فَاِنْ اَصَابَھ۫ خَیْرُ اۨطْمَاَنَّ بِھ۪ﺆ وَاِنْ اَصَابَتْھُ فِتْنَةُ اۨنْقَلَبَ عَلٰی وَجْھِھ۪ﺥ خَسِرَ الدُّنْیَا وَالْاٰخِرَةَﺚ ذٰلِکَ ھُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِیْنُ)
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর ‘ইবাদত করে দ্বিধার সাথে; তার মঙ্গল হলে তাতে তার চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং কোন বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়াতে ও আখিরাতে; এটা তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।”(সূরা হাজ্জ ২২:১১)
সাহাবী ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: তাদের আলোতে চলার অর্থ হচ্ছে সত্যকে জেনে ইসলামের কালিমা পাঠ করা এবং অন্ধকারে থেমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া। অধিকাংশ আলেমদের এটাই মত, আর এটাই সবচেয়ে সঠিক কথা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
কিয়ামাতের দিনও তাদের এ অবস্থা হবে যখন ঈমানদারদেরকে তাদের ঈমানের পরিমাণ অনুযায়ী নূর দেয়া হবে, কেউ পাবে বহু মাইল পর্যন্ত আলো, কেউ পাবে তারও বেশি, কেউ তার চেয়ে কম, এমনকি শেষ পর্যন্ত কেউ এতটুকু পাবে যে, কখনো আলোকিত হবে আবার কখনো অন্ধকার হয়ে যাবে। কিছু লোক এমনও হবে যে, তারা একটু দূরে গিয়েই থেমে যাবে, আবার কিছুদূর পর্যন্ত আলো পাবে, আবার নিভে যাবে। আবার এমন দুর্ভাগা লোক হবে তাদের কোন আলোই থাকবে না। এরাই হল প্রকৃত মুনাফিক। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًا)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবে: তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
আবার মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ تَرَی الْمُؤْمِنِیْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ یَسْعٰی نُوْرُھُمْ بَیْنَ اَیْدِیْھِمْ وَبِاَیْمَانِھِمْ بُشْرٰٿکُمُ الْیَوْمَ جَنّٰتٌ)
“সেদিন (কিয়ামতের দিন) তুমি দেখবে মু’মিন নর-নারীদের সম্মুখভাগে ও ডান পার্শ্বে তাদের জ্যোতি প্রবাহিত হবে। (বলা হবে) আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের।” (সূরা হাদীদ ৫৭:১২) অনুরূপ সূরা তাহরীমের ৮ নং আয়াতে এ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. কোন বিষয় বুঝানোর জন্য উদাহরণ পেশ করা বৈধ, তবে তা বাস্তবতা ও সত্যার ভিত্তিতে হতে হবে।
২. বাতিলদের অপচেষ্টা যতই হোক না কেন এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ।
৩. কুরআন মু’মিনদের অন্তরকে এমনভাবে জীবিত করে বৃষ্টি যেমন মাটিকে জীবিত করে।
৪. কিয়ামত দিবসে মু’মিনরা তাদের ঈমান ও আমল অনুযায়ী নূর পাবে, যার দ্বারা তারা পথ চলবে। কিন্তু মুনাফিকদের প্রকৃতপক্ষে ঈমান না থাকায় তারা কোন নূর পাবে না।
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ ও আরো কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত তারা বলেন: মদীনাবাসীদের মধ্যে দু’জন মুনাফিক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে পলায়ন করে মুশরিকদের কাছে চলে যায়। তখন পথিমধ্যে তাদেরকে বিদ্যুৎ ও প্রকট বজ্রধ্বনিসহ বৃষ্টি পেয়ে বসল, আল্লাহ তা‘আলা যে বৃষ্টির কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। যখন তাদেরকে বজ্রাঘাত করত তখনই তারা উভয়ে তাদের কানের ছিদ্রে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত। যাতে তাদের কানের ভেতরে বজ্রধ্বনি প্রবেশ করে তাদের মৃত্যুর কারণ না হয়। যখন বিদ্যুৎ চমকাত তখন উভয়ে আলো দেখে দেখে পথ চলত আর যখন বিুদ্যৎ চমকাত না তখন কিছুই দেখতে পেত না। এভাবে তারা হেঁটে তাদের স্বস্থানে ফিরে আসল এবং উভয়ে বলতে লাগল যদি আমরা সকাল করতে পারি তাহলে মুহাম্মাদের কাছে এসে আমরা তার হাতে আমাদের হাত রাখব।
পরদিন সকালে তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলো। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করল, তাঁর হাতের ওপর হাত রাখল (বাইয়াত গ্রহণ করল) এবং তারা ইসলাম মেনে নিল। আল্লাহ তা‘আলা এ দু’জন মুনাফিকের দৃষ্টান্ত মদীনাবাসীর সকল মুনাফিকদের জন্য পেশ করেছেন। (মদীনার) মুনাফিকরা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মজলিসে উপস্থিত হত তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা না শোনার জন্য তারা তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত এ আশঙ্কায় যে, তাদের ব্যাপারে কোন কিছু নাযিল হয়ে যাবে। অথবা তাদের ব্যাপারে এমন কিছু উল্লেখ করবে ফলে তারা নিহত হয়ে যাবে। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক মৃত্যু ভয়ে তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবিন নুযূল, ১৭-১৮, ইবনু জারীর আত্ব-তাবারী, ১ম খণ্ড, ২২১, বর্ণনাটি হাসান)
(كُلَّمَآ أَضَا۬ءَ لَهُمْ مَّشَوْا فِيْهِ)
“তখন তাতে তারা চলতে থাকে যখন তিনি তাদের জন্য একটু আলো (বিদ্যুৎ) প্রজ্জ্বলিত করেন” অর্থাৎ যখন তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি অধিক হত এবং প্রচুর পরিমাণ গনীমত লাভ করত তখন দীন-ইসলামের ওপর তারা বহাল থাকত এবং বলত: মুহাম্মাদের দীন সত্য। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক বিদ্যুতের আলোতে পথ চলত।
(وَإِذَآ أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُوْا)
“এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার আচ্ছন্ন করেন তখন তারা দাঁড়িয়ে থাকে।”অর্থাৎ যখন তাদের এ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ধ্বংস হয়ে যেত এবং বালা-মুসিবত তাদের ওপর আপতিত হত তখন তারা বলত, এসব মুহাম্মাদের কারণেই। আর তারা মুরতাদ হয়ে যেত। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবস্থায় বলেছিল।الصيب- (اَوْ کَصَیِّبٍ)
(আস-সায়্যিবু)-এর অর্থ বৃষ্টি। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে হিদায়াত ও জ্ঞান নিয়ে এসেছেন আল্লাহ তা‘আলা তা এ আয়াতে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা হিদায়াত ও জ্ঞান হল আত্মার জীবন। যেমন বৃষ্টি হল শরীরের জীবন। উদাহরণের দিকে ঈঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُه۫ بِإِذْنِ رَبِّه۪ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا)
“এবং উৎকৃষ্ট ভূমির ফসল তার প্রতিপালকের আদেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে কঠোর পরিশ্রম না করলে কিছুই জন্মায় না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:৫৮)
এ দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার উদাহরণ হল বৃষ্টির মত। কোন একস্থানে বর্ষণ হল অতঃপর তার কিছু উর্বর জায়গা পানি ধারণ করল। ফলে প্রচুর পরিমাণে ঘাস জন্মাল। মানুষরা তাত্থেকে পান করল, পশু-পাখিদের পান করাল এবং শস্য উৎপন্ন করল। এটাই হল ঐ ব্যক্তির উপমা যে ব্যক্তি দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তা দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে ইলম অর্জন করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়। আর তার কিছু অংশ রয়েছে যা পানিও ধরে রাখতে পারে না এবং ঘাসও উৎপন্ন করে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৮২)
(فِيْهِ ظُلُمَاتٌ)
‘যাতে রয়েছে অন্ধকার’আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বৃষ্টির অন্ধকার দ্বারা কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে দৃষ্টান্ত পেশ করছেন। তারা কুরআন সম্পর্কে যে সন্দেহ-সংশয় পোষণ করে, সে জন্য তাদের কষ্টে নিপতিত করা। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, এটা তাদের কাছে অন্ধকারের মত। কেননা তা তাদের অন্ধত্বই বৃদ্ধি করে দেয়।َعْدٌ ‘গর্জন’আল্লাহ তা‘আলা বজ্রধ্বনি দ্বারা মুনাফিকদের উদাহরণ দিয়েছেন। কেননা কুরআনে তাদেরকে এমন ধমক দেয়া হয়েছে যা কানকে ছিদ্র করে দেয় এবং অন্তরকে ফাটিয়ে দেয়।وَّبَرْقٌ ‘বিদ্যুৎ চমক’ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এর ভাবার্থ এই যে, কুরআন মাজীদের মজবুত আয়াতগুলো এসব মুনাফিকদের প্রকৃত অবস্থা খুলে দেবে ও তাদের গোপনীয় দোষ প্রকাশ করবে এবং আপন উজ্জ্বলতার দ্বারা তাদেরকে হতভম্ব করে দিবে। যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন তারা দাঁড়িয়ে যায়। অর্থাৎ যখন তাদের ঈমান প্রকাশ পায় তখন তাদের অন্তর কিছু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তারা এর অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু যখনই সন্দেহ ও সংশয়ের উদ্রেক হয় তখনই অন্তরের মধ্যে অন্ধকার ছেয়ে যায়, তখন সে হয়রান পেরেশান হয়ে যায়। অথবা এর ভাব এও হতে পারে যে, যখন ইসলামের কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়, তখন তাদের মনে কিছুটা স্থিরতা আসে, কিন্তু যখনই তার বিপরীত পরিলক্ষিত হয় তখনই তারা কুফরীর দিকে ফিরে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّعْبُدُ اللہَ عَلٰی حَرْفٍﺆ فَاِنْ اَصَابَھ۫ خَیْرُ اۨطْمَاَنَّ بِھ۪ﺆ وَاِنْ اَصَابَتْھُ فِتْنَةُ اۨنْقَلَبَ عَلٰی وَجْھِھ۪ﺥ خَسِرَ الدُّنْیَا وَالْاٰخِرَةَﺚ ذٰلِکَ ھُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِیْنُ)
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর ‘ইবাদত করে দ্বিধার সাথে; তার মঙ্গল হলে তাতে তার চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং কোন বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়াতে ও আখিরাতে; এটা তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।”(সূরা হাজ্জ ২২:১১)
সাহাবী ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: তাদের আলোতে চলার অর্থ হচ্ছে সত্যকে জেনে ইসলামের কালিমা পাঠ করা এবং অন্ধকারে থেমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া। অধিকাংশ আলেমদের এটাই মত, আর এটাই সবচেয়ে সঠিক কথা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
কিয়ামাতের দিনও তাদের এ অবস্থা হবে যখন ঈমানদারদেরকে তাদের ঈমানের পরিমাণ অনুযায়ী নূর দেয়া হবে, কেউ পাবে বহু মাইল পর্যন্ত আলো, কেউ পাবে তারও বেশি, কেউ তার চেয়ে কম, এমনকি শেষ পর্যন্ত কেউ এতটুকু পাবে যে, কখনো আলোকিত হবে আবার কখনো অন্ধকার হয়ে যাবে। কিছু লোক এমনও হবে যে, তারা একটু দূরে গিয়েই থেমে যাবে, আবার কিছুদূর পর্যন্ত আলো পাবে, আবার নিভে যাবে। আবার এমন দুর্ভাগা লোক হবে তাদের কোন আলোই থাকবে না। এরাই হল প্রকৃত মুনাফিক। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًا)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবে: তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
আবার মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ تَرَی الْمُؤْمِنِیْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ یَسْعٰی نُوْرُھُمْ بَیْنَ اَیْدِیْھِمْ وَبِاَیْمَانِھِمْ بُشْرٰٿکُمُ الْیَوْمَ جَنّٰتٌ)
“সেদিন (কিয়ামতের দিন) তুমি দেখবে মু’মিন নর-নারীদের সম্মুখভাগে ও ডান পার্শ্বে তাদের জ্যোতি প্রবাহিত হবে। (বলা হবে) আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের।” (সূরা হাদীদ ৫৭:১২) অনুরূপ সূরা তাহরীমের ৮ নং আয়াতে এ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. কোন বিষয় বুঝানোর জন্য উদাহরণ পেশ করা বৈধ, তবে তা বাস্তবতা ও সত্যার ভিত্তিতে হতে হবে।
২. বাতিলদের অপচেষ্টা যতই হোক না কেন এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ।
৩. কুরআন মু’মিনদের অন্তরকে এমনভাবে জীবিত করে বৃষ্টি যেমন মাটিকে জীবিত করে।
৪. কিয়ামত দিবসে মু’মিনরা তাদের ঈমান ও আমল অনুযায়ী নূর পাবে, যার দ্বারা তারা পথ চলবে। কিন্তু মুনাফিকদের প্রকৃতপক্ষে ঈমান না থাকায় তারা কোন নূর পাবে না।
2:20
یَکَادُ الۡبَرۡقُ یَخۡطَفُ اَبۡصَارَہُمۡ ؕ کُلَّمَاۤ اَضَآءَ لَہُمۡ مَّشَوۡا فِیۡہِ ٭ۙ وَ اِذَاۤ اَظۡلَمَ عَلَیۡہِمۡ قَامُوۡا ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰہُ لَذَہَبَ بِسَمۡعِہِمۡ وَ اَبۡصَارِہِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿٪۲۰﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
১৯ ও ২০ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ ও আরো কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত তারা বলেন: মদীনাবাসীদের মধ্যে দু’জন মুনাফিক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে পলায়ন করে মুশরিকদের কাছে চলে যায়। তখন পথিমধ্যে তাদেরকে বিদ্যুৎ ও প্রকট বজ্রধ্বনিসহ বৃষ্টি পেয়ে বসল, আল্লাহ তা‘আলা যে বৃষ্টির কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। যখন তাদেরকে বজ্রাঘাত করত তখনই তারা উভয়ে তাদের কানের ছিদ্রে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত। যাতে তাদের কানের ভেতরে বজ্রধ্বনি প্রবেশ করে তাদের মৃত্যুর কারণ না হয়। যখন বিদ্যুৎ চমকাত তখন উভয়ে আলো দেখে দেখে পথ চলত আর যখন বিুদ্যৎ চমকাত না তখন কিছুই দেখতে পেত না। এভাবে তারা হেঁটে তাদের স্বস্থানে ফিরে আসল এবং উভয়ে বলতে লাগল যদি আমরা সকাল করতে পারি তাহলে মুহাম্মাদের কাছে এসে আমরা তার হাতে আমাদের হাত রাখব।
পরদিন সকালে তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলো। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করল, তাঁর হাতের ওপর হাত রাখল (বাইয়াত গ্রহণ করল) এবং তারা ইসলাম মেনে নিল। আল্লাহ তা‘আলা এ দু’জন মুনাফিকের দৃষ্টান্ত মদীনাবাসীর সকল মুনাফিকদের জন্য পেশ করেছেন। (মদীনার) মুনাফিকরা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মজলিসে উপস্থিত হত তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা না শোনার জন্য তারা তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত এ আশঙ্কায় যে, তাদের ব্যাপারে কোন কিছু নাযিল হয়ে যাবে। অথবা তাদের ব্যাপারে এমন কিছু উল্লেখ করবে ফলে তারা নিহত হয়ে যাবে। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক মৃত্যু ভয়ে তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবিন নুযূল, ১৭-১৮, ইবনু জারীর আত্ব-তাবারী, ১ম খণ্ড, ২২১, বর্ণনাটি হাসান)
(كُلَّمَآ أَضَا۬ءَ لَهُمْ مَّشَوْا فِيْهِ)
“তখন তাতে তারা চলতে থাকে যখন তিনি তাদের জন্য একটু আলো (বিদ্যুৎ) প্রজ্জ্বলিত করেন” অর্থাৎ যখন তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি অধিক হত এবং প্রচুর পরিমাণ গনীমত লাভ করত তখন দীন-ইসলামের ওপর তারা বহাল থাকত এবং বলত: মুহাম্মাদের দীন সত্য। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক বিদ্যুতের আলোতে পথ চলত।
(وَإِذَآ أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُوْا)
“এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার আচ্ছন্ন করেন তখন তারা দাঁড়িয়ে থাকে।”অর্থাৎ যখন তাদের এ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ধ্বংস হয়ে যেত এবং বালা-মুসিবত তাদের ওপর আপতিত হত তখন তারা বলত, এসব মুহাম্মাদের কারণেই। আর তারা মুরতাদ হয়ে যেত। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবস্থায় বলেছিল।الصيب- (اَوْ کَصَیِّبٍ)
(আস-সায়্যিবু)-এর অর্থ বৃষ্টি। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে হিদায়াত ও জ্ঞান নিয়ে এসেছেন আল্লাহ তা‘আলা তা এ আয়াতে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা হিদায়াত ও জ্ঞান হল আত্মার জীবন। যেমন বৃষ্টি হল শরীরের জীবন। উদাহরণের দিকে ঈঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُه۫ بِإِذْنِ رَبِّه۪ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا)
“এবং উৎকৃষ্ট ভূমির ফসল তার প্রতিপালকের আদেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে কঠোর পরিশ্রম না করলে কিছুই জন্মায় না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:৫৮)
এ দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার উদাহরণ হল বৃষ্টির মত। কোন একস্থানে বর্ষণ হল অতঃপর তার কিছু উর্বর জায়গা পানি ধারণ করল। ফলে প্রচুর পরিমাণে ঘাস জন্মাল। মানুষরা তাত্থেকে পান করল, পশু-পাখিদের পান করাল এবং শস্য উৎপন্ন করল। এটাই হল ঐ ব্যক্তির উপমা যে ব্যক্তি দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তা দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে ইলম অর্জন করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়। আর তার কিছু অংশ রয়েছে যা পানিও ধরে রাখতে পারে না এবং ঘাসও উৎপন্ন করে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৮২)
(فِيْهِ ظُلُمَاتٌ)
‘যাতে রয়েছে অন্ধকার’আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বৃষ্টির অন্ধকার দ্বারা কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে দৃষ্টান্ত পেশ করছেন। তারা কুরআন সম্পর্কে যে সন্দেহ-সংশয় পোষণ করে, সে জন্য তাদের কষ্টে নিপতিত করা। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, এটা তাদের কাছে অন্ধকারের মত। কেননা তা তাদের অন্ধত্বই বৃদ্ধি করে দেয়।رَعْدٌ ‘গর্জন’আল্লাহ তা‘আলা বজ্রধ্বনি দ্বারা মুনাফিকদের উদাহরণ দিয়েছেন। কেননা কুরআনে তাদেরকে এমন ধমক দেয়া হয়েছে যা কানকে ছিদ্র করে দেয় এবং অন্তরকে ফাটিয়ে দেয়।وَّبَرْقٌ ‘বিদ্যুৎ চমক’ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এর ভাবার্থ এই যে, কুরআন মাজীদের মজবুত আয়াতগুলো এসব মুনাফিকদের প্রকৃত অবস্থা খুলে দেবে ও তাদের গোপনীয় দোষ প্রকাশ করবে এবং আপন উজ্জ্বলতার দ্বারা তাদেরকে হতভম্ব করে দিবে। যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন তারা দাঁড়িয়ে যায়। অর্থাৎ যখন তাদের ঈমান প্রকাশ পায় তখন তাদের অন্তর কিছু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তারা এর অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু যখনই সন্দেহ ও সংশয়ের উদ্রেক হয় তখনই অন্তরের মধ্যে অন্ধকার ছেয়ে যায়, তখন সে হয়রান পেরেশান হয়ে যায়। অথবা এর ভাব এও হতে পারে যে, যখন ইসলামের কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়, তখন তাদের মনে কিছুটা স্থিরতা আসে, কিন্তু যখনই তার বিপরীত পরিলক্ষিত হয় তখনই তারা কুফরীর দিকে ফিরে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّعْبُدُ اللہَ عَلٰی حَرْفٍﺆ فَاِنْ اَصَابَھ۫ خَیْرُ اۨطْمَاَنَّ بِھ۪ﺆ وَاِنْ اَصَابَتْھُ فِتْنَةُ اۨنْقَلَبَ عَلٰی وَجْھِھ۪ﺥ خَسِرَ الدُّنْیَا وَالْاٰخِرَةَﺚ ذٰلِکَ ھُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِیْنُ)
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর ‘ইবাদত করে দ্বিধার সাথে; তার মঙ্গল হলে তাতে তার চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং কোন বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়াতে ও আখিরাতে; এটা তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।”(সূরা হাজ্জ ২২:১১)
সাহাবী ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: তাদের আলোতে চলার অর্থ হচ্ছে সত্যকে জেনে ইসলামের কালিমা পাঠ করা এবং অন্ধকারে থেমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া। অধিকাংশ আলেমদের এটাই মত, আর এটাই সবচেয়ে সঠিক কথা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
কিয়ামাতের দিনও তাদের এ অবস্থা হবে যখন ঈমানদারদেরকে তাদের ঈমানের পরিমাণ অনুযায়ী নূর দেয়া হবে, কেউ পাবে বহু মাইল পর্যন্ত আলো, কেউ পাবে তারও বেশি, কেউ তার চেয়ে কম, এমনকি শেষ পর্যন্ত কেউ এতটুকু পাবে যে, কখনো আলোকিত হবে আবার কখনো অন্ধকার হয়ে যাবে। কিছু লোক এমনও হবে যে, তারা একটু দূরে গিয়েই থেমে যাবে, আবার কিছুদূর পর্যন্ত আলো পাবে, আবার নিভে যাবে। আবার এমন দুর্ভাগা লোক হবে তাদের কোন আলোই থাকবে না। এরাই হল প্রকৃত মুনাফিক। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًا)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবে: তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
আবার মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ تَرَی الْمُؤْمِنِیْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ یَسْعٰی نُوْرُھُمْ بَیْنَ اَیْدِیْھِمْ وَبِاَیْمَانِھِمْ بُشْرٰٿکُمُ الْیَوْمَ جَنّٰتٌ)
“সেদিন (কিয়ামতের দিন) তুমি দেখবে মু’মিন নর-নারীদের সম্মুখভাগে ও ডান পার্শ্বে তাদের জ্যোতি প্রবাহিত হবে। (বলা হবে) আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের।” (সূরা হাদীদ ৫৭:১২) অনুরূপ সূরা তাহরীমের ৮ নং আয়াতে এ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. কোন বিষয় বুঝানোর জন্য উদাহরণ পেশ করা বৈধ, তবে তা বাস্তবতা ও সত্যার ভিত্তিতে হতে হবে।
২. বাতিলদের অপচেষ্টা যতই হোক না কেন এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ।
৩. কুরআন মু’মিনদের অন্তরকে এমনভাবে জীবিত করে বৃষ্টি যেমন মাটিকে জীবিত করে।
৪. কিয়ামত দিবসে মু’মিনরা তাদের ঈমান ও আমল অনুযায়ী নূর পাবে, যার দ্বারা তারা পথ চলবে। কিন্তু মুনাফিকদের প্রকৃতপক্ষে ঈমান না থাকায় তারা কোন নূর পাবে না।
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ ও আরো কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত তারা বলেন: মদীনাবাসীদের মধ্যে দু’জন মুনাফিক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে পলায়ন করে মুশরিকদের কাছে চলে যায়। তখন পথিমধ্যে তাদেরকে বিদ্যুৎ ও প্রকট বজ্রধ্বনিসহ বৃষ্টি পেয়ে বসল, আল্লাহ তা‘আলা যে বৃষ্টির কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। যখন তাদেরকে বজ্রাঘাত করত তখনই তারা উভয়ে তাদের কানের ছিদ্রে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত। যাতে তাদের কানের ভেতরে বজ্রধ্বনি প্রবেশ করে তাদের মৃত্যুর কারণ না হয়। যখন বিদ্যুৎ চমকাত তখন উভয়ে আলো দেখে দেখে পথ চলত আর যখন বিুদ্যৎ চমকাত না তখন কিছুই দেখতে পেত না। এভাবে তারা হেঁটে তাদের স্বস্থানে ফিরে আসল এবং উভয়ে বলতে লাগল যদি আমরা সকাল করতে পারি তাহলে মুহাম্মাদের কাছে এসে আমরা তার হাতে আমাদের হাত রাখব।
পরদিন সকালে তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলো। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করল, তাঁর হাতের ওপর হাত রাখল (বাইয়াত গ্রহণ করল) এবং তারা ইসলাম মেনে নিল। আল্লাহ তা‘আলা এ দু’জন মুনাফিকের দৃষ্টান্ত মদীনাবাসীর সকল মুনাফিকদের জন্য পেশ করেছেন। (মদীনার) মুনাফিকরা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মজলিসে উপস্থিত হত তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা না শোনার জন্য তারা তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত এ আশঙ্কায় যে, তাদের ব্যাপারে কোন কিছু নাযিল হয়ে যাবে। অথবা তাদের ব্যাপারে এমন কিছু উল্লেখ করবে ফলে তারা নিহত হয়ে যাবে। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক মৃত্যু ভয়ে তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবিন নুযূল, ১৭-১৮, ইবনু জারীর আত্ব-তাবারী, ১ম খণ্ড, ২২১, বর্ণনাটি হাসান)
(كُلَّمَآ أَضَا۬ءَ لَهُمْ مَّشَوْا فِيْهِ)
“তখন তাতে তারা চলতে থাকে যখন তিনি তাদের জন্য একটু আলো (বিদ্যুৎ) প্রজ্জ্বলিত করেন” অর্থাৎ যখন তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি অধিক হত এবং প্রচুর পরিমাণ গনীমত লাভ করত তখন দীন-ইসলামের ওপর তারা বহাল থাকত এবং বলত: মুহাম্মাদের দীন সত্য। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক বিদ্যুতের আলোতে পথ চলত।
(وَإِذَآ أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُوْا)
“এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার আচ্ছন্ন করেন তখন তারা দাঁড়িয়ে থাকে।”অর্থাৎ যখন তাদের এ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ধ্বংস হয়ে যেত এবং বালা-মুসিবত তাদের ওপর আপতিত হত তখন তারা বলত, এসব মুহাম্মাদের কারণেই। আর তারা মুরতাদ হয়ে যেত। যেমন ঐ দু’জন মুনাফিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবস্থায় বলেছিল।الصيب- (اَوْ کَصَیِّبٍ)
(আস-সায়্যিবু)-এর অর্থ বৃষ্টি। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে হিদায়াত ও জ্ঞান নিয়ে এসেছেন আল্লাহ তা‘আলা তা এ আয়াতে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা হিদায়াত ও জ্ঞান হল আত্মার জীবন। যেমন বৃষ্টি হল শরীরের জীবন। উদাহরণের দিকে ঈঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُه۫ بِإِذْنِ رَبِّه۪ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا)
“এবং উৎকৃষ্ট ভূমির ফসল তার প্রতিপালকের আদেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে কঠোর পরিশ্রম না করলে কিছুই জন্মায় না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:৫৮)
এ দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার উদাহরণ হল বৃষ্টির মত। কোন একস্থানে বর্ষণ হল অতঃপর তার কিছু উর্বর জায়গা পানি ধারণ করল। ফলে প্রচুর পরিমাণে ঘাস জন্মাল। মানুষরা তাত্থেকে পান করল, পশু-পাখিদের পান করাল এবং শস্য উৎপন্ন করল। এটাই হল ঐ ব্যক্তির উপমা যে ব্যক্তি দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তা দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে ইলম অর্জন করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়। আর তার কিছু অংশ রয়েছে যা পানিও ধরে রাখতে পারে না এবং ঘাসও উৎপন্ন করে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৮২)
(فِيْهِ ظُلُمَاتٌ)
‘যাতে রয়েছে অন্ধকার’আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বৃষ্টির অন্ধকার দ্বারা কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে দৃষ্টান্ত পেশ করছেন। তারা কুরআন সম্পর্কে যে সন্দেহ-সংশয় পোষণ করে, সে জন্য তাদের কষ্টে নিপতিত করা। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, এটা তাদের কাছে অন্ধকারের মত। কেননা তা তাদের অন্ধত্বই বৃদ্ধি করে দেয়।رَعْدٌ ‘গর্জন’আল্লাহ তা‘আলা বজ্রধ্বনি দ্বারা মুনাফিকদের উদাহরণ দিয়েছেন। কেননা কুরআনে তাদেরকে এমন ধমক দেয়া হয়েছে যা কানকে ছিদ্র করে দেয় এবং অন্তরকে ফাটিয়ে দেয়।وَّبَرْقٌ ‘বিদ্যুৎ চমক’ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এর ভাবার্থ এই যে, কুরআন মাজীদের মজবুত আয়াতগুলো এসব মুনাফিকদের প্রকৃত অবস্থা খুলে দেবে ও তাদের গোপনীয় দোষ প্রকাশ করবে এবং আপন উজ্জ্বলতার দ্বারা তাদেরকে হতভম্ব করে দিবে। যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন তারা দাঁড়িয়ে যায়। অর্থাৎ যখন তাদের ঈমান প্রকাশ পায় তখন তাদের অন্তর কিছু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তারা এর অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু যখনই সন্দেহ ও সংশয়ের উদ্রেক হয় তখনই অন্তরের মধ্যে অন্ধকার ছেয়ে যায়, তখন সে হয়রান পেরেশান হয়ে যায়। অথবা এর ভাব এও হতে পারে যে, যখন ইসলামের কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়, তখন তাদের মনে কিছুটা স্থিরতা আসে, কিন্তু যখনই তার বিপরীত পরিলক্ষিত হয় তখনই তারা কুফরীর দিকে ফিরে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّعْبُدُ اللہَ عَلٰی حَرْفٍﺆ فَاِنْ اَصَابَھ۫ خَیْرُ اۨطْمَاَنَّ بِھ۪ﺆ وَاِنْ اَصَابَتْھُ فِتْنَةُ اۨنْقَلَبَ عَلٰی وَجْھِھ۪ﺥ خَسِرَ الدُّنْیَا وَالْاٰخِرَةَﺚ ذٰلِکَ ھُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِیْنُ)
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর ‘ইবাদত করে দ্বিধার সাথে; তার মঙ্গল হলে তাতে তার চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং কোন বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়াতে ও আখিরাতে; এটা তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।”(সূরা হাজ্জ ২২:১১)
সাহাবী ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: তাদের আলোতে চলার অর্থ হচ্ছে সত্যকে জেনে ইসলামের কালিমা পাঠ করা এবং অন্ধকারে থেমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া। অধিকাংশ আলেমদের এটাই মত, আর এটাই সবচেয়ে সঠিক কথা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
কিয়ামাতের দিনও তাদের এ অবস্থা হবে যখন ঈমানদারদেরকে তাদের ঈমানের পরিমাণ অনুযায়ী নূর দেয়া হবে, কেউ পাবে বহু মাইল পর্যন্ত আলো, কেউ পাবে তারও বেশি, কেউ তার চেয়ে কম, এমনকি শেষ পর্যন্ত কেউ এতটুকু পাবে যে, কখনো আলোকিত হবে আবার কখনো অন্ধকার হয়ে যাবে। কিছু লোক এমনও হবে যে, তারা একটু দূরে গিয়েই থেমে যাবে, আবার কিছুদূর পর্যন্ত আলো পাবে, আবার নিভে যাবে। আবার এমন দুর্ভাগা লোক হবে তাদের কোন আলোই থাকবে না। এরাই হল প্রকৃত মুনাফিক। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًا)
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবে: তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩)
আবার মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ تَرَی الْمُؤْمِنِیْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ یَسْعٰی نُوْرُھُمْ بَیْنَ اَیْدِیْھِمْ وَبِاَیْمَانِھِمْ بُشْرٰٿکُمُ الْیَوْمَ جَنّٰتٌ)
“সেদিন (কিয়ামতের দিন) তুমি দেখবে মু’মিন নর-নারীদের সম্মুখভাগে ও ডান পার্শ্বে তাদের জ্যোতি প্রবাহিত হবে। (বলা হবে) আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের।” (সূরা হাদীদ ৫৭:১২) অনুরূপ সূরা তাহরীমের ৮ নং আয়াতে এ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. কোন বিষয় বুঝানোর জন্য উদাহরণ পেশ করা বৈধ, তবে তা বাস্তবতা ও সত্যার ভিত্তিতে হতে হবে।
২. বাতিলদের অপচেষ্টা যতই হোক না কেন এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ।
৩. কুরআন মু’মিনদের অন্তরকে এমনভাবে জীবিত করে বৃষ্টি যেমন মাটিকে জীবিত করে।
৪. কিয়ামত দিবসে মু’মিনরা তাদের ঈমান ও আমল অনুযায়ী নূর পাবে, যার দ্বারা তারা পথ চলবে। কিন্তু মুনাফিকদের প্রকৃতপক্ষে ঈমান না থাকায় তারা কোন নূর পাবে না।
2:21
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২১ ও ২২ নং আয়তের তাফসীর:
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّکُمُ الَّذِیْ خَلَقَکُمْ.....)
আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণির (মু’মিন, কাফির ও মুনাফিক) লোকেদের কথা উল্লেখ করার পর সকল মানুষকে ডেকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মূলত এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ)
“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও ইনসানকে এজন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।”(সূরা জারিয়াত ৫১:৫৬)
ইবাদত অর্থ:
বিনয়-নম্র হওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যেক ঐ সকল কথা ও কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট থাকেন। একজন মু’মিন যখন তার জীবনে সকল ইবাদত যথাযথ বাস্তবায়িত করতে পারবে তখন সে পরিপূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারবে। উবুদিয়্যাহ তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও গোলাম হতে পারা মু’মিনের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার বিষয় ও এতে সে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়-পাত্রে পরিণত হয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ‘তাঁর আব্দ’তথা তাঁর বান্দা তথা গোলাম বলে সম্বোধন করেছেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বলতেন: আমি একজন বান্দা, অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলেই সম্বোধন কর। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা: ৪১৩)
সুতরাং এ থেকে প্রমাণ হয়, একজন মু’মিন ‘আব্দ’তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হওয়ায় শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না যতই সে ইবাদতগুজারী হোক না কেন। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বেশি যিনি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেছেন তিনি হলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহ তা‘আলার বান্দার সীমারেখার বাইরে যেতে পারেননি এবং তিনি বাইরে যেতে পছন্দও করতেন না। ঈসা (আঃ) নিজেও শিশু ও বৃদ্ধাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বলে পরিচয় দিতেন। অতএব যে সকল কথিত সূফী বলে থাকে- বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যখন তার ইবাদতের দরকার হয় না, তখন শরীয়ত মানা আবশ্যক নয়। তাদের কথা ভ্রান্ত, তারা ইসলাম থেকে বহির্ভূত।
এ আয়াত থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওহীদ বা এককত্ব ও তাঁর উলুহিয়্যাতের বর্ণনা শুরু করেছেন। তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তিনিই প্রত্যেক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামত দান করেছেন। তিনিই জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَّهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ)
“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশে নিহিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”(সূরা আম্বিয়াহ ২১:৩২) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এমন সময়ে যখন মানুষ বৃষ্টির পূর্ণ মুখাপেক্ষী হয়। তারপর ঐ পানি দ্বারা বিভিন্ন ফলমূল উৎপন্ন করেন, যা থেকে মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئًﺕ وَّاَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً فَاَخْرَجَ بِھ۪ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّکُمْ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اَللہُ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ قَرَارًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئً وَّصَوَّرَکُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَکُمْ وَرَزَقَکُمْ مِّنَ الطَّیِّبٰتِﺚ ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْﺊ فَتَبٰرَکَ اللہُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ)
“আল্লহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বাসোপযোগী এবং আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তোমাদের আকৃতি করেছেন উৎকৃষ্ট এবং তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযিক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ কতই না বরকতময়!” (সূরা মু’মিন ৪০:৬৪)
অতএব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পরিচালক ও সকলের মালিক। এ জন্যই তিনি সর্বপ্রকার ইবাদত পাওয়ার এবং তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন না করার একমাত্র হকদার। তাই আল্লাহ তা‘আলা বললেন:
(فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ)
“অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন গুনাহ সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন- আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬) মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করে বললেন: হে মুআয! তুমি কি জান বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? মুআয (রাঃ) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল- বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) অন্য বর্ণনায় বলেন:
(فَلَا تَجْعَلُوا لِلّٰهِ أَنْدَادًا)
“অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)انداد (সমকক্ষ) শির্ক। গভীর অন্ধকার রাতে কাল পাথরের ওপর কালো পিঁপড়ার চলাচল প্রত্যক্ষ করা যত সূক্ষ্ম, শির্ক তার চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম। কখন কিভাবে একজন ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে না। যেমন মানুষ বলে যে, যদি কুকুরটি না থাকত তাহলে চোর ঘরে ঢুকে পড়ত, এটা বলা শির্ক। কারণ চোর হতে বাঁচানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ।
অনুরূপ অনেক শির্কী আকিদাহ, কথা ও কাজ আছে যা মানুষের মাঝে খুব প্রচলিত। এমনকি শির্কী কাজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত ইবাদত মনে করে খুব বিনয়ের সাথে পালন করে থাকে। আকীদাহগত শির্ক যেমন: এরূপ বিশ্বাস করা- আল্লাহ স্ব-স্বত্তায় সর্বত্র বিরাজমান, ওলী-আউলিয়া অনেকক্ষেত্রে ভাল মন্দের মালিক, আল্লাহ ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, ফকীর-দরবেশ বা জ্যোতিষী গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, কবরস্থ ব্যক্তি দু‘আ শুনতে পারে এবং বিপদাপদ প্রতিহত করে কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসার ন্যায় নিজের পীর ও অন্যান্য মানুষকে ভালবাসা, অন্তরে পীর ও অলিদের অনিষ্টের গোপন ভয় করা, তাদের কবরের মাটি, গাছ, নিকটস্থ কূপের পানি ও জীব-জন্তুর দ্বারা উপকারে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ওপর ভরসা করা ইত্যাদি।
বাচনিক শির্ক হয় এরূপ বললে যে: আল্লাহ যা চান আর আপনি যা চান, আমার সন্তানের কসম বা আল্লাহ ছাড়া যে কোন বস্তুর নামে কসম করা ইত্যাদি।
কর্মে শির্ক হয় যেমন: রোগ নিরাময় বা কোন প্রকার অনিষ্ট থেকে বাচাঁর জন্য শরীরে তা‘বীজ বা বালা ব্যবহার করা, মাযার ও কবরে দান করা, হাদিয়া দেয়া, মানত করা, কুরবানীর জন্য কোন পশু দেয়া, তাদের জন্য রুকু-সিজদা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তাদের কাছে সন্তান চাওয়া, ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ, ওলী-আউলিয়া, দরবেশ, ফকীর বা মাযারের পাশ দাঁড়িয়ে নিরবতা ও বিনয় প্রকাশ করা, মানব রচিত বিধান ও আইন দ্বারা শাসন ও বিচার কার্য পরিচালনা করা, অলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মাধ্যম নির্ধারণ করা ও তাদের কাছে শাফাআত চাওয়া। আল্লাহ যা হারাম করে দিয়েছেন তা কোন শাসক বা আলেম হালাল করে দিলে সে হারামকে হালাল হিসেবে মেনে নেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তা পালনের ফলাফল উল্লেখ করে বলেন:
(لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহ-ভীরু হতে পার। সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে মুত্তাকীদের পরিচয় ও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং তাকওয়ার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে পুনরুত্থান এর ব্যাপারে তিনটি দলীলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা অন্যান্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
১ নং দলীল: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমবার মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো অধিক সক্ষম। তিনি বলেন:
(كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُه۫)
“যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।”(সূরা আম্বিয়া ২১:১০৪) এরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন: ৭৯, সূরা ক্বফ: ১৫, বানী ইসরাঈল: ৫১, সূরা হজ্জ এবং সূরা ওয়াকিয়া: ৬২ নং আয়াতে পুনরুত্থানের কথা আলোচনা করেছেন।
২ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন:
(اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللہَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ وَلَمْ یَعْیَ بِخَلْقِھِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰٓی اَنْ یُّحْیِ الْمَوْتٰ)
“তারা কি এটুকুও বোঝে না, যে আল্লাহ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করলেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি, সে আল্লাহ মৃতুকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন।”(সূরা আহক্বাফ ৪৬:৩৩)
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন ৮১, সূরা বানী ইসরাঈল ৯৯, সূরা নাযিয়াত ২৭-২৮ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন।
৩ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা জমিন নির্জীব হবার পর পুনরায় তা জীবিত করেন। এটা পুনরুত্থানের সবচেয়ে বড় দলীল। এর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًالَّكُمْ)
“এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَحْيَيْنَا بِه۪ بَلْدَةً مَّيْتًا كَذٰلِكَ الْخُرُوجُ)
“বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ; আমি বৃষ্টি দ্বারা জীবিত করি মৃত ভূমিকে; এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে।”(সূরা ক্বফ ৫০:১১)
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা হা-মীম-সিজদাহ: ৩৯, সূরা রূম: ১৯, আ‘রাফ: ৫৭ নং আয়াতে এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং বৃষ্টি দ্বারা নির্জীব জমিনকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম সেভাবে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. সৃষ্টিকর্তা যিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার তিনিই আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। সুতরাং তিনিই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।
২. সকল মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত শরীয়তের অধীন। কেউ যদি বিশ্বাস করে দুনিয়াতে এমন ওলী, কুতুব ও বুজুর্গ যারা শরীয়ত মেনে চলার ঊর্ধ্বে তাহলে তারা মুসলিম থাকবে না।
৩. শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। অতএব তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সকল প্রকার শির্ক হতে মুক্ত থাকতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করতে ও প্রত্যেকের প্রাপ্য প্রদান করার জন্য সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। এটা তাঁর জন্য কঠিন কিছুই নয়।
৫. যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ফলাফল অবগত হলাম।
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّکُمُ الَّذِیْ خَلَقَکُمْ.....)
আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণির (মু’মিন, কাফির ও মুনাফিক) লোকেদের কথা উল্লেখ করার পর সকল মানুষকে ডেকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মূলত এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ)
“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও ইনসানকে এজন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।”(সূরা জারিয়াত ৫১:৫৬)
ইবাদত অর্থ:
বিনয়-নম্র হওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যেক ঐ সকল কথা ও কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট থাকেন। একজন মু’মিন যখন তার জীবনে সকল ইবাদত যথাযথ বাস্তবায়িত করতে পারবে তখন সে পরিপূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারবে। উবুদিয়্যাহ তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও গোলাম হতে পারা মু’মিনের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার বিষয় ও এতে সে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়-পাত্রে পরিণত হয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ‘তাঁর আব্দ’তথা তাঁর বান্দা তথা গোলাম বলে সম্বোধন করেছেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বলতেন: আমি একজন বান্দা, অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলেই সম্বোধন কর। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা: ৪১৩)
সুতরাং এ থেকে প্রমাণ হয়, একজন মু’মিন ‘আব্দ’তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হওয়ায় শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না যতই সে ইবাদতগুজারী হোক না কেন। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বেশি যিনি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেছেন তিনি হলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহ তা‘আলার বান্দার সীমারেখার বাইরে যেতে পারেননি এবং তিনি বাইরে যেতে পছন্দও করতেন না। ঈসা (আঃ) নিজেও শিশু ও বৃদ্ধাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বলে পরিচয় দিতেন। অতএব যে সকল কথিত সূফী বলে থাকে- বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যখন তার ইবাদতের দরকার হয় না, তখন শরীয়ত মানা আবশ্যক নয়। তাদের কথা ভ্রান্ত, তারা ইসলাম থেকে বহির্ভূত।
এ আয়াত থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওহীদ বা এককত্ব ও তাঁর উলুহিয়্যাতের বর্ণনা শুরু করেছেন। তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তিনিই প্রত্যেক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামত দান করেছেন। তিনিই জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَّهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ)
“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশে নিহিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”(সূরা আম্বিয়াহ ২১:৩২) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এমন সময়ে যখন মানুষ বৃষ্টির পূর্ণ মুখাপেক্ষী হয়। তারপর ঐ পানি দ্বারা বিভিন্ন ফলমূল উৎপন্ন করেন, যা থেকে মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئًﺕ وَّاَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً فَاَخْرَجَ بِھ۪ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّکُمْ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اَللہُ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ قَرَارًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئً وَّصَوَّرَکُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَکُمْ وَرَزَقَکُمْ مِّنَ الطَّیِّبٰتِﺚ ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْﺊ فَتَبٰرَکَ اللہُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ)
“আল্লহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বাসোপযোগী এবং আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তোমাদের আকৃতি করেছেন উৎকৃষ্ট এবং তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযিক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ কতই না বরকতময়!” (সূরা মু’মিন ৪০:৬৪)
অতএব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পরিচালক ও সকলের মালিক। এ জন্যই তিনি সর্বপ্রকার ইবাদত পাওয়ার এবং তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন না করার একমাত্র হকদার। তাই আল্লাহ তা‘আলা বললেন:
(فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ)
“অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন গুনাহ সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন- আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬) মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করে বললেন: হে মুআয! তুমি কি জান বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? মুআয (রাঃ) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল- বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) অন্য বর্ণনায় বলেন:
(فَلَا تَجْعَلُوا لِلّٰهِ أَنْدَادًا)
“অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)انداد (সমকক্ষ) শির্ক। গভীর অন্ধকার রাতে কাল পাথরের ওপর কালো পিঁপড়ার চলাচল প্রত্যক্ষ করা যত সূক্ষ্ম, শির্ক তার চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম। কখন কিভাবে একজন ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে না। যেমন মানুষ বলে যে, যদি কুকুরটি না থাকত তাহলে চোর ঘরে ঢুকে পড়ত, এটা বলা শির্ক। কারণ চোর হতে বাঁচানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ।
অনুরূপ অনেক শির্কী আকিদাহ, কথা ও কাজ আছে যা মানুষের মাঝে খুব প্রচলিত। এমনকি শির্কী কাজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত ইবাদত মনে করে খুব বিনয়ের সাথে পালন করে থাকে। আকীদাহগত শির্ক যেমন: এরূপ বিশ্বাস করা- আল্লাহ স্ব-স্বত্তায় সর্বত্র বিরাজমান, ওলী-আউলিয়া অনেকক্ষেত্রে ভাল মন্দের মালিক, আল্লাহ ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, ফকীর-দরবেশ বা জ্যোতিষী গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, কবরস্থ ব্যক্তি দু‘আ শুনতে পারে এবং বিপদাপদ প্রতিহত করে কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসার ন্যায় নিজের পীর ও অন্যান্য মানুষকে ভালবাসা, অন্তরে পীর ও অলিদের অনিষ্টের গোপন ভয় করা, তাদের কবরের মাটি, গাছ, নিকটস্থ কূপের পানি ও জীব-জন্তুর দ্বারা উপকারে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ওপর ভরসা করা ইত্যাদি।
বাচনিক শির্ক হয় এরূপ বললে যে: আল্লাহ যা চান আর আপনি যা চান, আমার সন্তানের কসম বা আল্লাহ ছাড়া যে কোন বস্তুর নামে কসম করা ইত্যাদি।
কর্মে শির্ক হয় যেমন: রোগ নিরাময় বা কোন প্রকার অনিষ্ট থেকে বাচাঁর জন্য শরীরে তা‘বীজ বা বালা ব্যবহার করা, মাযার ও কবরে দান করা, হাদিয়া দেয়া, মানত করা, কুরবানীর জন্য কোন পশু দেয়া, তাদের জন্য রুকু-সিজদা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তাদের কাছে সন্তান চাওয়া, ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ, ওলী-আউলিয়া, দরবেশ, ফকীর বা মাযারের পাশ দাঁড়িয়ে নিরবতা ও বিনয় প্রকাশ করা, মানব রচিত বিধান ও আইন দ্বারা শাসন ও বিচার কার্য পরিচালনা করা, অলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মাধ্যম নির্ধারণ করা ও তাদের কাছে শাফাআত চাওয়া। আল্লাহ যা হারাম করে দিয়েছেন তা কোন শাসক বা আলেম হালাল করে দিলে সে হারামকে হালাল হিসেবে মেনে নেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তা পালনের ফলাফল উল্লেখ করে বলেন:
(لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহ-ভীরু হতে পার। সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে মুত্তাকীদের পরিচয় ও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং তাকওয়ার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে পুনরুত্থান এর ব্যাপারে তিনটি দলীলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা অন্যান্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
১ নং দলীল: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমবার মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো অধিক সক্ষম। তিনি বলেন:
(كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُه۫)
“যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।”(সূরা আম্বিয়া ২১:১০৪) এরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন: ৭৯, সূরা ক্বফ: ১৫, বানী ইসরাঈল: ৫১, সূরা হজ্জ এবং সূরা ওয়াকিয়া: ৬২ নং আয়াতে পুনরুত্থানের কথা আলোচনা করেছেন।
২ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন:
(اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللہَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ وَلَمْ یَعْیَ بِخَلْقِھِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰٓی اَنْ یُّحْیِ الْمَوْتٰ)
“তারা কি এটুকুও বোঝে না, যে আল্লাহ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করলেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি, সে আল্লাহ মৃতুকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন।”(সূরা আহক্বাফ ৪৬:৩৩)
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন ৮১, সূরা বানী ইসরাঈল ৯৯, সূরা নাযিয়াত ২৭-২৮ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন।
৩ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা জমিন নির্জীব হবার পর পুনরায় তা জীবিত করেন। এটা পুনরুত্থানের সবচেয়ে বড় দলীল। এর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًالَّكُمْ)
“এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَحْيَيْنَا بِه۪ بَلْدَةً مَّيْتًا كَذٰلِكَ الْخُرُوجُ)
“বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ; আমি বৃষ্টি দ্বারা জীবিত করি মৃত ভূমিকে; এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে।”(সূরা ক্বফ ৫০:১১)
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা হা-মীম-সিজদাহ: ৩৯, সূরা রূম: ১৯, আ‘রাফ: ৫৭ নং আয়াতে এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং বৃষ্টি দ্বারা নির্জীব জমিনকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম সেভাবে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. সৃষ্টিকর্তা যিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার তিনিই আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। সুতরাং তিনিই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।
২. সকল মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত শরীয়তের অধীন। কেউ যদি বিশ্বাস করে দুনিয়াতে এমন ওলী, কুতুব ও বুজুর্গ যারা শরীয়ত মেনে চলার ঊর্ধ্বে তাহলে তারা মুসলিম থাকবে না।
৩. শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। অতএব তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সকল প্রকার শির্ক হতে মুক্ত থাকতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করতে ও প্রত্যেকের প্রাপ্য প্রদান করার জন্য সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। এটা তাঁর জন্য কঠিন কিছুই নয়।
৫. যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ফলাফল অবগত হলাম।
2:22
الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِہٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰہِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২১ ও ২২ নং আয়তের তাফসীর:
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّکُمُ الَّذِیْ خَلَقَکُمْ.....)
আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণির (মু’মিন, কাফির ও মুনাফিক) লোকেদের কথা উল্লেখ করার পর সকল মানুষকে ডেকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মূলত এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ)
“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও ইনসানকে এজন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।”(সূরা জারিয়াত ৫১:৫৬)
ইবাদত অর্থ:
বিনয়-নম্র হওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যেক ঐ সকল কথা ও কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট থাকেন। একজন মু’মিন যখন তার জীবনে সকল ইবাদত যথাযথ বাস্তবায়িত করতে পারবে তখন সে পরিপূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারবে। উবুদিয়্যাহ তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও গোলাম হতে পারা মু’মিনের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার বিষয় ও এতে সে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়-পাত্রে পরিণত হয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ‘তাঁর আব্দ’তথা তাঁর বান্দা তথা গোলাম বলে সম্বোধন করেছেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বলতেন: আমি একজন বান্দা, অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলেই সম্বোধন কর। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা: ৪১৩)
সুতরাং এ থেকে প্রমাণ হয়, একজন মু’মিন ‘আব্দ’তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হওয়ায় শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না যতই সে ইবাদতগুজারী হোক না কেন। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বেশি যিনি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেছেন তিনি হলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহ তা‘আলার বান্দার সীমারেখার বাইরে যেতে পারেননি এবং তিনি বাইরে যেতে পছন্দও করতেন না। ঈসা (আঃ) নিজেও শিশু ও বৃদ্ধাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বলে পরিচয় দিতেন। অতএব যে সকল কথিত সূফী বলে থাকে- বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যখন তার ইবাদতের দরকার হয় না, তখন শরীয়ত মানা আবশ্যক নয়। তাদের কথা ভ্রান্ত, তারা ইসলাম থেকে বহির্ভূত।
এ আয়াত থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওহীদ বা এককত্ব ও তাঁর উলুহিয়্যাতের বর্ণনা শুরু করেছেন। তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তিনিই প্রত্যেক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামত দান করেছেন। তিনিই জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَّهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ)
“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশে নিহিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”(সূরা আম্বিয়াহ ২১:৩২) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এমন সময়ে যখন মানুষ বৃষ্টির পূর্ণ মুখাপেক্ষী হয়। তারপর ঐ পানি দ্বারা বিভিন্ন ফলমূল উৎপন্ন করেন, যা থেকে মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئًﺕ وَّاَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً فَاَخْرَجَ بِھ۪ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّکُمْ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اَللہُ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ قَرَارًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئً وَّصَوَّرَکُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَکُمْ وَرَزَقَکُمْ مِّنَ الطَّیِّبٰتِﺚ ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْﺊ فَتَبٰرَکَ اللہُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ)
“আল্লহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বাসোপযোগী এবং আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তোমাদের আকৃতি করেছেন উৎকৃষ্ট এবং তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযিক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ কতই না বরকতময়!” (সূরা মু’মিন ৪০:৬৪)
অতএব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পরিচালক ও সকলের মালিক। এ জন্যই তিনি সর্বপ্রকার ইবাদত পাওয়ার এবং তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন না করার একমাত্র হকদার। তাই আল্লাহ তা‘আলা বললেন:
(فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ)
“অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন গুনাহ সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন- আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬) মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করে বললেন: হে মুআয! তুমি কি জান বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? মুআয (রাঃ) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল- বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) অন্য বর্ণনায় বলেন:
(فَلَا تَجْعَلُوا لِلّٰهِ أَنْدَادًا)
“অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)انداد (সমকক্ষ) শির্ক। গভীর অন্ধকার রাতে কাল পাথরের ওপর কালো পিঁপড়ার চলাচল প্রত্যক্ষ করা যত সূক্ষ্ম, শির্ক তার চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম। কখন কিভাবে একজন ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে না। যেমন মানুষ বলে যে, যদি কুকুরটি না থাকত তাহলে চোর ঘরে ঢুকে পড়ত, এটা বলা শির্ক। কারণ চোর হতে বাঁচানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ।
অনুরূপ অনেক শির্কী আকিদাহ, কথা ও কাজ আছে যা মানুষের মাঝে খুব প্রচলিত। এমনকি শির্কী কাজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত ইবাদত মনে করে খুব বিনয়ের সাথে পালন করে থাকে। আকীদাহগত শির্ক যেমন: এরূপ বিশ্বাস করা- আল্লাহ স্ব-স্বত্তায় সর্বত্র বিরাজমান, ওলী-আউলিয়া অনেকক্ষেত্রে ভাল মন্দের মালিক, আল্লাহ ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, ফকীর-দরবেশ বা জ্যোতিষী গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, কবরস্থ ব্যক্তি দু‘আ শুনতে পারে এবং বিপদাপদ প্রতিহত করে কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসার ন্যায় নিজের পীর ও অন্যান্য মানুষকে ভালবাসা, অন্তরে পীর ও অলিদের অনিষ্টের গোপন ভয় করা, তাদের কবরের মাটি, গাছ, নিকটস্থ কূপের পানি ও জীব-জন্তুর দ্বারা উপকারে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ওপর ভরসা করা ইত্যাদি।
বাচনিক শির্ক হয় এরূপ বললে যে: আল্লাহ যা চান আর আপনি যা চান, আমার সন্তানের কসম বা আল্লাহ ছাড়া যে কোন বস্তুর নামে কসম করা ইত্যাদি।
কর্মে শির্ক হয় যেমন: রোগ নিরাময় বা কোন প্রকার অনিষ্ট থেকে বাচাঁর জন্য শরীরে তা‘বীজ বা বালা ব্যবহার করা, মাযার ও কবরে দান করা, হাদিয়া দেয়া, মানত করা, কুরবানীর জন্য কোন পশু দেয়া, তাদের জন্য রুকু-সিজদা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তাদের কাছে সন্তান চাওয়া, ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ, ওলী-আউলিয়া, দরবেশ, ফকীর বা মাযারের পাশ দাঁড়িয়ে নিরবতা ও বিনয় প্রকাশ করা, মানব রচিত বিধান ও আইন দ্বারা শাসন ও বিচার কার্য পরিচালনা করা, অলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মাধ্যম নির্ধারণ করা ও তাদের কাছে শাফাআত চাওয়া। আল্লাহ যা হারাম করে দিয়েছেন তা কোন শাসক বা আলেম হালাল করে দিলে সে হারামকে হালাল হিসেবে মেনে নেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তা পালনের ফলাফল উল্লেখ করে বলেন:
(لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহ-ভীরু হতে পার। সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে মুত্তাকীদের পরিচয় ও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং তাকওয়ার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে পুনরুত্থান এর ব্যাপারে তিনটি দলীলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা অন্যান্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
১ নং দলীল: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমবার মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো অধিক সক্ষম। তিনি বলেন:
(كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُه۫)
“যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।”(সূরা আম্বিয়া ২১:১০৪) এরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন: ৭৯, সূরা ক্বফ: ১৫, বানী ইসরাঈল: ৫১, সূরা হজ্জ এবং সূরা ওয়াকিয়া: ৬২ নং আয়াতে পুনরুত্থানের কথা আলোচনা করেছেন।
২ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন:
(اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللہَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ وَلَمْ یَعْیَ بِخَلْقِھِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰٓی اَنْ یُّحْیِ الْمَوْتٰ)
“তারা কি এটুকুও বোঝে না, যে আল্লাহ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করলেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি, সে আল্লাহ মৃতুকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন।”(সূরা আহক্বাফ ৪৬:৩৩)
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন ৮১, সূরা বানী ইসরাঈল ৯৯, সূরা নাযিয়াত ২৭-২৮ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন।
৩ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা জমিন নির্জীব হবার পর পুনরায় তা জীবিত করেন। এটা পুনরুত্থানের সবচেয়ে বড় দলীল। এর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًالَّكُمْ)
“এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَحْيَيْنَا بِه۪ بَلْدَةً مَّيْتًا كَذٰلِكَ الْخُرُوجُ)
“বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ; আমি বৃষ্টি দ্বারা জীবিত করি মৃত ভূমিকে; এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে।”(সূরা ক্বফ ৫০:১১)
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা হা-মীম-সিজদাহ: ৩৯, সূরা রূম: ১৯, আ‘রাফ: ৫৭ নং আয়াতে এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং বৃষ্টি দ্বারা নির্জীব জমিনকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম সেভাবে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. সৃষ্টিকর্তা যিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার তিনিই আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। সুতরাং তিনিই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।
২. সকল মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত শরীয়তের অধীন। কেউ যদি বিশ্বাস করে দুনিয়াতে এমন ওলী, কুতুব ও বুজুর্গ যারা শরীয়ত মেনে চলার ঊর্ধ্বে তাহলে তারা মুসলিম থাকবে না।
৩. শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। অতএব তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সকল প্রকার শির্ক হতে মুক্ত থাকতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করতে ও প্রত্যেকের প্রাপ্য প্রদান করার জন্য সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। এটা তাঁর জন্য কঠিন কিছুই নয়।
৫. যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ফলাফল অবগত হলাম।
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّکُمُ الَّذِیْ خَلَقَکُمْ.....)
আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণির (মু’মিন, কাফির ও মুনাফিক) লোকেদের কথা উল্লেখ করার পর সকল মানুষকে ডেকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মূলত এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ)
“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও ইনসানকে এজন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।”(সূরা জারিয়াত ৫১:৫৬)
ইবাদত অর্থ:
বিনয়-নম্র হওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যেক ঐ সকল কথা ও কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট থাকেন। একজন মু’মিন যখন তার জীবনে সকল ইবাদত যথাযথ বাস্তবায়িত করতে পারবে তখন সে পরিপূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারবে। উবুদিয়্যাহ তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও গোলাম হতে পারা মু’মিনের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার বিষয় ও এতে সে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়-পাত্রে পরিণত হয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ‘তাঁর আব্দ’তথা তাঁর বান্দা তথা গোলাম বলে সম্বোধন করেছেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বলতেন: আমি একজন বান্দা, অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলেই সম্বোধন কর। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা: ৪১৩)
সুতরাং এ থেকে প্রমাণ হয়, একজন মু’মিন ‘আব্দ’তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হওয়ায় শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না যতই সে ইবাদতগুজারী হোক না কেন। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বেশি যিনি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেছেন তিনি হলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহ তা‘আলার বান্দার সীমারেখার বাইরে যেতে পারেননি এবং তিনি বাইরে যেতে পছন্দও করতেন না। ঈসা (আঃ) নিজেও শিশু ও বৃদ্ধাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বলে পরিচয় দিতেন। অতএব যে সকল কথিত সূফী বলে থাকে- বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যখন তার ইবাদতের দরকার হয় না, তখন শরীয়ত মানা আবশ্যক নয়। তাদের কথা ভ্রান্ত, তারা ইসলাম থেকে বহির্ভূত।
এ আয়াত থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওহীদ বা এককত্ব ও তাঁর উলুহিয়্যাতের বর্ণনা শুরু করেছেন। তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তিনিই প্রত্যেক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামত দান করেছেন। তিনিই জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَّهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ)
“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশে নিহিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”(সূরা আম্বিয়াহ ২১:৩২) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এমন সময়ে যখন মানুষ বৃষ্টির পূর্ণ মুখাপেক্ষী হয়। তারপর ঐ পানি দ্বারা বিভিন্ন ফলমূল উৎপন্ন করেন, যা থেকে মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئًﺕ وَّاَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً فَاَخْرَجَ بِھ۪ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّکُمْ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اَللہُ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ قَرَارًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئً وَّصَوَّرَکُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَکُمْ وَرَزَقَکُمْ مِّنَ الطَّیِّبٰتِﺚ ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْﺊ فَتَبٰرَکَ اللہُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ)
“আল্লহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বাসোপযোগী এবং আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তোমাদের আকৃতি করেছেন উৎকৃষ্ট এবং তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযিক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ কতই না বরকতময়!” (সূরা মু’মিন ৪০:৬৪)
অতএব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পরিচালক ও সকলের মালিক। এ জন্যই তিনি সর্বপ্রকার ইবাদত পাওয়ার এবং তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন না করার একমাত্র হকদার। তাই আল্লাহ তা‘আলা বললেন:
(فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ)
“অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন গুনাহ সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন- আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬) মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করে বললেন: হে মুআয! তুমি কি জান বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? মুআয (রাঃ) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল- বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) অন্য বর্ণনায় বলেন:
(فَلَا تَجْعَلُوا لِلّٰهِ أَنْدَادًا)
“অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)انداد (সমকক্ষ) শির্ক। গভীর অন্ধকার রাতে কাল পাথরের ওপর কালো পিঁপড়ার চলাচল প্রত্যক্ষ করা যত সূক্ষ্ম, শির্ক তার চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম। কখন কিভাবে একজন ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে না। যেমন মানুষ বলে যে, যদি কুকুরটি না থাকত তাহলে চোর ঘরে ঢুকে পড়ত, এটা বলা শির্ক। কারণ চোর হতে বাঁচানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ।
অনুরূপ অনেক শির্কী আকিদাহ, কথা ও কাজ আছে যা মানুষের মাঝে খুব প্রচলিত। এমনকি শির্কী কাজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত ইবাদত মনে করে খুব বিনয়ের সাথে পালন করে থাকে। আকীদাহগত শির্ক যেমন: এরূপ বিশ্বাস করা- আল্লাহ স্ব-স্বত্তায় সর্বত্র বিরাজমান, ওলী-আউলিয়া অনেকক্ষেত্রে ভাল মন্দের মালিক, আল্লাহ ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, ফকীর-দরবেশ বা জ্যোতিষী গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, কবরস্থ ব্যক্তি দু‘আ শুনতে পারে এবং বিপদাপদ প্রতিহত করে কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসার ন্যায় নিজের পীর ও অন্যান্য মানুষকে ভালবাসা, অন্তরে পীর ও অলিদের অনিষ্টের গোপন ভয় করা, তাদের কবরের মাটি, গাছ, নিকটস্থ কূপের পানি ও জীব-জন্তুর দ্বারা উপকারে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ওপর ভরসা করা ইত্যাদি।
বাচনিক শির্ক হয় এরূপ বললে যে: আল্লাহ যা চান আর আপনি যা চান, আমার সন্তানের কসম বা আল্লাহ ছাড়া যে কোন বস্তুর নামে কসম করা ইত্যাদি।
কর্মে শির্ক হয় যেমন: রোগ নিরাময় বা কোন প্রকার অনিষ্ট থেকে বাচাঁর জন্য শরীরে তা‘বীজ বা বালা ব্যবহার করা, মাযার ও কবরে দান করা, হাদিয়া দেয়া, মানত করা, কুরবানীর জন্য কোন পশু দেয়া, তাদের জন্য রুকু-সিজদা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তাদের কাছে সন্তান চাওয়া, ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ, ওলী-আউলিয়া, দরবেশ, ফকীর বা মাযারের পাশ দাঁড়িয়ে নিরবতা ও বিনয় প্রকাশ করা, মানব রচিত বিধান ও আইন দ্বারা শাসন ও বিচার কার্য পরিচালনা করা, অলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মাধ্যম নির্ধারণ করা ও তাদের কাছে শাফাআত চাওয়া। আল্লাহ যা হারাম করে দিয়েছেন তা কোন শাসক বা আলেম হালাল করে দিলে সে হারামকে হালাল হিসেবে মেনে নেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তা পালনের ফলাফল উল্লেখ করে বলেন:
(لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহ-ভীরু হতে পার। সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে মুত্তাকীদের পরিচয় ও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং তাকওয়ার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে পুনরুত্থান এর ব্যাপারে তিনটি দলীলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা অন্যান্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
১ নং দলীল: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমবার মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো অধিক সক্ষম। তিনি বলেন:
(كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُه۫)
“যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।”(সূরা আম্বিয়া ২১:১০৪) এরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন: ৭৯, সূরা ক্বফ: ১৫, বানী ইসরাঈল: ৫১, সূরা হজ্জ এবং সূরা ওয়াকিয়া: ৬২ নং আয়াতে পুনরুত্থানের কথা আলোচনা করেছেন।
২ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন:
(اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللہَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ وَلَمْ یَعْیَ بِخَلْقِھِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰٓی اَنْ یُّحْیِ الْمَوْتٰ)
“তারা কি এটুকুও বোঝে না, যে আল্লাহ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করলেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি, সে আল্লাহ মৃতুকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন।”(সূরা আহক্বাফ ৪৬:৩৩)
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন ৮১, সূরা বানী ইসরাঈল ৯৯, সূরা নাযিয়াত ২৭-২৮ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন।
৩ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা জমিন নির্জীব হবার পর পুনরায় তা জীবিত করেন। এটা পুনরুত্থানের সবচেয়ে বড় দলীল। এর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًالَّكُمْ)
“এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَحْيَيْنَا بِه۪ بَلْدَةً مَّيْتًا كَذٰلِكَ الْخُرُوجُ)
“বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ; আমি বৃষ্টি দ্বারা জীবিত করি মৃত ভূমিকে; এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে।”(সূরা ক্বফ ৫০:১১)
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা হা-মীম-সিজদাহ: ৩৯, সূরা রূম: ১৯, আ‘রাফ: ৫৭ নং আয়াতে এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং বৃষ্টি দ্বারা নির্জীব জমিনকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম সেভাবে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. সৃষ্টিকর্তা যিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার তিনিই আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। সুতরাং তিনিই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।
২. সকল মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত শরীয়তের অধীন। কেউ যদি বিশ্বাস করে দুনিয়াতে এমন ওলী, কুতুব ও বুজুর্গ যারা শরীয়ত মেনে চলার ঊর্ধ্বে তাহলে তারা মুসলিম থাকবে না।
৩. শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। অতএব তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সকল প্রকার শির্ক হতে মুক্ত থাকতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করতে ও প্রত্যেকের প্রাপ্য প্রদান করার জন্য সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। এটা তাঁর জন্য কঠিন কিছুই নয়।
৫. যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ফলাফল অবগত হলাম।
2:23
وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۲۳﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৩-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের আলোচনা করার পর এখানে নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি কাফিরদের সম্বোধন করে বলেন:
(وَاِنْ کُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰی عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِھ۪ﺕ وَادْعُوْا شُھَدَا۬ءَکُمْ مِّنْ دُوْنِ اللہِ اِنْ کُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে আহ্বান কর; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
এখানে “عبد” (আবদ) বা বান্দা দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
অন্যএ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلٰي مُحَمَّدٍ)
“আর তারা ঈমান আনে যা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২)
সুতরাং এখানে عبد (আবদ) দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝানো হয়েছে। আর “আবদ” হল একটি অধিক সম্মানসূচক উপাধি। কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে “আবদ”বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنْ كُنْتُمْ اٰمَنْتُمْ بِاللّٰهِ وَمَآ أَنْزَلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ)
“যদি তোমরা ঈমান রাখ আল্লাহর ওপর এবং যা মীমাংসার দিন আমি আমার বান্দার (মুহাম্মাদের) প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম তার ওপর।”(সূরা আনফাল ৮:৪১)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرٰي بِعَبْدِه۪)
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে (মুহাম্মাদকে) রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:১)
এভাবে সূরা ফুরকান ১, সূরা নাজম ১০, সূরা হাদীদ ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে عبد (আবদ) বা দাস বলে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বা দাস, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্রষ্টা ও মা‘বূদ।
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদের ব্যাপারে এ উপাধি ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
“তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো”
কাফিররা যখন কুরআনকে পূর্বকালের উপকথা বা মুহাম্মাদের কথা বলে প্রত্যাখ্যান করতে লাগল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলেন, এ কুরআনের মত একটি কিতাব রচনা করে নিয়ে আসতে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْاِنْسُ وَالْجِنُّ عَلٰٓی اَنْ یَّاْتُوْا بِمِثْلِ ھٰذَا الْقُرْاٰنِ لَا یَاْتُوْنَ بِمِثْلِھ۪ وَلَوْ کَانَ بَعْضُھُمْ لِبَعْضٍ ظَھِیْرًا)
‘‘যদি এ কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনয়নের জন্য সব মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এটার অনুরূপ কুরআন আনয়ন করতে পারবে না।”(সূরা ইসরা ১৭:৮৮)
তারা যখন এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারল না তখন আল্লাহ তা‘আলা দশটি সূরার মত কিছু তৈরি করে আনতে বললেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ فَأْتُوْا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِه۪ مُفْتَرَيَاتٍ)
“তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি স্বরচিত সূরা আনয়ন করো।”(সূরা হূদ ১১:১৩)
এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একটি সূরার কথা বলেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
– এর সমতুল্য একটি মাত্র সূরা নিয়ে এসো। (সূরা বাকারাহ ২:২৩)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন:
(فَإِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَلَنْ تَفْعَلُوْا)
অনন্তর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনো করতে পারবে না। (সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ)
“তা হলে তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় কর যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ ও পাথর যা তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”(সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ অবান্তর চিন্তা-ভাবনা ও অপকৌশল পরিহার করে সে জাহান্নামকে ভয় করার নির্দেশ দিলেন যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।
“وُقُوْدٌ” এর অর্থ হচ্ছে জ্বালানি, যা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। যেমন গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا)
“অপরপক্ষে অত্যাচারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন হবে।”(সূরা জিন ৭২:১৫)
এখানে الحجارة (হিজারা) বা পাথর দ্বারা উদ্দেশ্য গন্ধকের পাথর যা অত্যন্ত কাল, বড় এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধময়। যার আগুন অত্যন্ত উত্তপ্ত হবে।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: এটা গন্ধকের পাথর যা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাফিরদের জন্য এগুলো প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। (তাফসীর ইবনু জারীর আত-তাবারী, অত্র আয়াতের তাফসীর, বর্ণনাটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুপাতিক)
সুদ্দী স্বীয় সনদে ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, জাহান্নামে গন্ধকের পাথর থাকবে যার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দ্বারা কাফিরদেরকে শাস্তি দেয়া হবে।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: এ পাথরগুলোর দুর্গন্ধ মৃত দেহের দুর্গন্ধের চেয়েও কঠিন দুর্গন্ধময়।
আবার কেউ বলেছেন: এগুলো হল সেই সব মূর্তি, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হিসেবে ইবাদত করা হত। যাতে মুশরিকরা বুঝতে পারে তারা এসব মূর্তির ইবাদত করেছে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের জন্য। কিন্তু সেগুলো কোন উপকার করা তো দূরের কথা, আজ তাদের সাথে জাহান্নামে জ্বলছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّکُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ حَصَبُ جَھَنَّمَﺚ اَنْتُمْ لَھَا وٰرِدُوْنَﮱلَوْ کَانَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ اٰلِھَةً مَّا وَرَدُوْھَاﺚ وَکُلٌّ فِیْھَا خٰلِدُوْنَ)
“তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত করো সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।। যদি তারা ইলাহ্ হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করতো না; তাদের সকলেই তাতে স্থায়ী হবে।”(সূরা আম্বিয়া ২১:৯৮-৯৯)
(أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ)
“তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”থেকে বুঝা যাচ্ছে মূলত জাহান্নাম কাফির ও মুশরিকদের জন্য, কোন মু’মিন সেখানে চিরস্থায়ী থাকবে না। আরো বুঝা যাচ্ছে জান্নাত এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান।
হাফেয ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: এ আয়াত দ্বারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জমায়াতের ইমামগণ দলীল পেশ করে থাকেন যে, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান।
এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি সুদীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে:تَحَاجَتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ
জান্নাত ও জাহান্নাম ঝগড়া করল। (সহীহ বুখারী হা: ৪৮৫০)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: জাহান্নাম তার রবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলল: হে আমার প্রতিপালক! আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন তাকে দু’টি শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দেয়া হল। একটি শীতকালে এবং অপরটি গ্রীষ্মকালে। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক সময় আমরা একটি প্রকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা বললাম: এটি কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: সত্তর বছর পূর্বে একটি পাথর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা আজ পৌঁছল। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৮৪-২১৮৫)
এরূপ অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর আক্বীদা-বিশ্বাস।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে বিশ্ব-সেরা ছিল। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের সবচেয়ে একটি ছোট সূরার মত সূরা তৈরি করে আনতে। কিন্তু তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি সকল মানুষের জন্য বিদ্যামান থাকবে।
২. আবদ বা দাস একটি সম্মানসূচক উপাধি। আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাদের জন্য এ উপাধি ব্যবহার করেন যাদের তিনি ভালবাসেন।
৩. জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এখনো বিদ্যমান।
৪. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল; তাঁর কোন অংশ নয়।
আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের আলোচনা করার পর এখানে নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি কাফিরদের সম্বোধন করে বলেন:
(وَاِنْ کُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰی عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِھ۪ﺕ وَادْعُوْا شُھَدَا۬ءَکُمْ مِّنْ دُوْنِ اللہِ اِنْ کُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে আহ্বান কর; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
এখানে “عبد” (আবদ) বা বান্দা দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
অন্যএ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلٰي مُحَمَّدٍ)
“আর তারা ঈমান আনে যা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২)
সুতরাং এখানে عبد (আবদ) দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝানো হয়েছে। আর “আবদ” হল একটি অধিক সম্মানসূচক উপাধি। কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে “আবদ”বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنْ كُنْتُمْ اٰمَنْتُمْ بِاللّٰهِ وَمَآ أَنْزَلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ)
“যদি তোমরা ঈমান রাখ আল্লাহর ওপর এবং যা মীমাংসার দিন আমি আমার বান্দার (মুহাম্মাদের) প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম তার ওপর।”(সূরা আনফাল ৮:৪১)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرٰي بِعَبْدِه۪)
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে (মুহাম্মাদকে) রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:১)
এভাবে সূরা ফুরকান ১, সূরা নাজম ১০, সূরা হাদীদ ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে عبد (আবদ) বা দাস বলে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বা দাস, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্রষ্টা ও মা‘বূদ।
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদের ব্যাপারে এ উপাধি ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
“তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো”
কাফিররা যখন কুরআনকে পূর্বকালের উপকথা বা মুহাম্মাদের কথা বলে প্রত্যাখ্যান করতে লাগল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলেন, এ কুরআনের মত একটি কিতাব রচনা করে নিয়ে আসতে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْاِنْسُ وَالْجِنُّ عَلٰٓی اَنْ یَّاْتُوْا بِمِثْلِ ھٰذَا الْقُرْاٰنِ لَا یَاْتُوْنَ بِمِثْلِھ۪ وَلَوْ کَانَ بَعْضُھُمْ لِبَعْضٍ ظَھِیْرًا)
‘‘যদি এ কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনয়নের জন্য সব মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এটার অনুরূপ কুরআন আনয়ন করতে পারবে না।”(সূরা ইসরা ১৭:৮৮)
তারা যখন এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারল না তখন আল্লাহ তা‘আলা দশটি সূরার মত কিছু তৈরি করে আনতে বললেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ فَأْتُوْا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِه۪ مُفْتَرَيَاتٍ)
“তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি স্বরচিত সূরা আনয়ন করো।”(সূরা হূদ ১১:১৩)
এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একটি সূরার কথা বলেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
– এর সমতুল্য একটি মাত্র সূরা নিয়ে এসো। (সূরা বাকারাহ ২:২৩)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন:
(فَإِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَلَنْ تَفْعَلُوْا)
অনন্তর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনো করতে পারবে না। (সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ)
“তা হলে তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় কর যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ ও পাথর যা তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”(সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ অবান্তর চিন্তা-ভাবনা ও অপকৌশল পরিহার করে সে জাহান্নামকে ভয় করার নির্দেশ দিলেন যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।
“وُقُوْدٌ” এর অর্থ হচ্ছে জ্বালানি, যা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। যেমন গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا)
“অপরপক্ষে অত্যাচারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন হবে।”(সূরা জিন ৭২:১৫)
এখানে الحجارة (হিজারা) বা পাথর দ্বারা উদ্দেশ্য গন্ধকের পাথর যা অত্যন্ত কাল, বড় এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধময়। যার আগুন অত্যন্ত উত্তপ্ত হবে।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: এটা গন্ধকের পাথর যা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাফিরদের জন্য এগুলো প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। (তাফসীর ইবনু জারীর আত-তাবারী, অত্র আয়াতের তাফসীর, বর্ণনাটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুপাতিক)
সুদ্দী স্বীয় সনদে ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, জাহান্নামে গন্ধকের পাথর থাকবে যার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দ্বারা কাফিরদেরকে শাস্তি দেয়া হবে।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: এ পাথরগুলোর দুর্গন্ধ মৃত দেহের দুর্গন্ধের চেয়েও কঠিন দুর্গন্ধময়।
আবার কেউ বলেছেন: এগুলো হল সেই সব মূর্তি, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হিসেবে ইবাদত করা হত। যাতে মুশরিকরা বুঝতে পারে তারা এসব মূর্তির ইবাদত করেছে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের জন্য। কিন্তু সেগুলো কোন উপকার করা তো দূরের কথা, আজ তাদের সাথে জাহান্নামে জ্বলছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّکُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ حَصَبُ جَھَنَّمَﺚ اَنْتُمْ لَھَا وٰرِدُوْنَﮱلَوْ کَانَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ اٰلِھَةً مَّا وَرَدُوْھَاﺚ وَکُلٌّ فِیْھَا خٰلِدُوْنَ)
“তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত করো সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।। যদি তারা ইলাহ্ হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করতো না; তাদের সকলেই তাতে স্থায়ী হবে।”(সূরা আম্বিয়া ২১:৯৮-৯৯)
(أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ)
“তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”থেকে বুঝা যাচ্ছে মূলত জাহান্নাম কাফির ও মুশরিকদের জন্য, কোন মু’মিন সেখানে চিরস্থায়ী থাকবে না। আরো বুঝা যাচ্ছে জান্নাত এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান।
হাফেয ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: এ আয়াত দ্বারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জমায়াতের ইমামগণ দলীল পেশ করে থাকেন যে, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান।
এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি সুদীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে:تَحَاجَتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ
জান্নাত ও জাহান্নাম ঝগড়া করল। (সহীহ বুখারী হা: ৪৮৫০)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: জাহান্নাম তার রবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলল: হে আমার প্রতিপালক! আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন তাকে দু’টি শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দেয়া হল। একটি শীতকালে এবং অপরটি গ্রীষ্মকালে। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক সময় আমরা একটি প্রকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা বললাম: এটি কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: সত্তর বছর পূর্বে একটি পাথর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা আজ পৌঁছল। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৮৪-২১৮৫)
এরূপ অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর আক্বীদা-বিশ্বাস।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে বিশ্ব-সেরা ছিল। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের সবচেয়ে একটি ছোট সূরার মত সূরা তৈরি করে আনতে। কিন্তু তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি সকল মানুষের জন্য বিদ্যামান থাকবে।
২. আবদ বা দাস একটি সম্মানসূচক উপাধি। আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাদের জন্য এ উপাধি ব্যবহার করেন যাদের তিনি ভালবাসেন।
৩. জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এখনো বিদ্যমান।
৪. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল; তাঁর কোন অংশ নয়।
2:24
فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُہَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۲۴﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৩-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের আলোচনা করার পর এখানে নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি কাফিরদের সম্বোধন করে বলেন:
(وَاِنْ کُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰی عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِھ۪ﺕ وَادْعُوْا شُھَدَا۬ءَکُمْ مِّنْ دُوْنِ اللہِ اِنْ کُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে আহ্বান কর; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
এখানে “عبد” (আবদ) বা বান্দা দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
অন্যএ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلٰي مُحَمَّدٍ)
“আর তারা ঈমান আনে যা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২)
সুতরাং এখানে عبد (আবদ) দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝানো হয়েছে। আর “আবদ” হল একটি অধিক সম্মানসূচক উপাধি। কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে “আবদ”বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنْ كُنْتُمْ اٰمَنْتُمْ بِاللّٰهِ وَمَآ أَنْزَلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ)
“যদি তোমরা ঈমান রাখ আল্লাহর ওপর এবং যা মীমাংসার দিন আমি আমার বান্দার (মুহাম্মাদের) প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম তার ওপর।”(সূরা আনফাল ৮:৪১)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرٰي بِعَبْدِه۪)
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে (মুহাম্মাদকে) রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:১)
এভাবে সূরা ফুরকান ১, সূরা নাজম ১০, সূরা হাদীদ ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে عبد (আবদ) বা দাস বলে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বা দাস, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্রষ্টা ও মা‘বূদ।
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদের ব্যাপারে এ উপাধি ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
“তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো”
কাফিররা যখন কুরআনকে পূর্বকালের উপকথা বা মুহাম্মাদের কথা বলে প্রত্যাখ্যান করতে লাগল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলেন, এ কুরআনের মত একটি কিতাব রচনা করে নিয়ে আসতে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْاِنْسُ وَالْجِنُّ عَلٰٓی اَنْ یَّاْتُوْا بِمِثْلِ ھٰذَا الْقُرْاٰنِ لَا یَاْتُوْنَ بِمِثْلِھ۪ وَلَوْ کَانَ بَعْضُھُمْ لِبَعْضٍ ظَھِیْرًا)
‘‘যদি এ কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনয়নের জন্য সব মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এটার অনুরূপ কুরআন আনয়ন করতে পারবে না।”(সূরা ইসরা ১৭:৮৮)
তারা যখন এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারল না তখন আল্লাহ তা‘আলা দশটি সূরার মত কিছু তৈরি করে আনতে বললেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ فَأْتُوْا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِه۪ مُفْتَرَيَاتٍ)
“তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি স্বরচিত সূরা আনয়ন করো।”(সূরা হূদ ১১:১৩)
এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একটি সূরার কথা বলেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
– এর সমতুল্য একটি মাত্র সূরা নিয়ে এসো। (সূরা বাকারাহ ২:২৩)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন:
(فَإِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَلَنْ تَفْعَلُوْا)
অনন্তর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনো করতে পারবে না। (সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ)
“তা হলে তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় কর যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ ও পাথর যা তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”(সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ অবান্তর চিন্তা-ভাবনা ও অপকৌশল পরিহার করে সে জাহান্নামকে ভয় করার নির্দেশ দিলেন যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।
“وُقُوْدٌ” এর অর্থ হচ্ছে জ্বালানি, যা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। যেমন গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا)
“অপরপক্ষে অত্যাচারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন হবে।”(সূরা জিন ৭২:১৫)
এখানে الحجارة (হিজারা) বা পাথর দ্বারা উদ্দেশ্য গন্ধকের পাথর যা অত্যন্ত কাল, বড় এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধময়। যার আগুন অত্যন্ত উত্তপ্ত হবে।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: এটা গন্ধকের পাথর যা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাফিরদের জন্য এগুলো প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। (তাফসীর ইবনু জারীর আত-তাবারী, অত্র আয়াতের তাফসীর, বর্ণনাটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুপাতিক)
সুদ্দী স্বীয় সনদে ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, জাহান্নামে গন্ধকের পাথর থাকবে যার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দ্বারা কাফিরদেরকে শাস্তি দেয়া হবে।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: এ পাথরগুলোর দুর্গন্ধ মৃত দেহের দুর্গন্ধের চেয়েও কঠিন দুর্গন্ধময়।
আবার কেউ বলেছেন: এগুলো হল সেই সব মূর্তি, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হিসেবে ইবাদত করা হত। যাতে মুশরিকরা বুঝতে পারে তারা এসব মূর্তির ইবাদত করেছে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের জন্য। কিন্তু সেগুলো কোন উপকার করা তো দূরের কথা, আজ তাদের সাথে জাহান্নামে জ্বলছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّکُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ حَصَبُ جَھَنَّمَﺚ اَنْتُمْ لَھَا وٰرِدُوْنَﮱلَوْ کَانَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ اٰلِھَةً مَّا وَرَدُوْھَاﺚ وَکُلٌّ فِیْھَا خٰلِدُوْنَ)
“তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত করো সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।। যদি তারা ইলাহ্ হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করতো না; তাদের সকলেই তাতে স্থায়ী হবে।”(সূরা আম্বিয়া ২১:৯৮-৯৯)
(أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ)
“তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”থেকে বুঝা যাচ্ছে মূলত জাহান্নাম কাফির ও মুশরিকদের জন্য, কোন মু’মিন সেখানে চিরস্থায়ী থাকবে না। আরো বুঝা যাচ্ছে জান্নাত এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান।
হাফেয ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: এ আয়াত দ্বারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জমায়াতের ইমামগণ দলীল পেশ করে থাকেন যে, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান।
এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি সুদীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে:تَحَاجَتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ
জান্নাত ও জাহান্নাম ঝগড়া করল। (সহীহ বুখারী হা: ৪৮৫০)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: জাহান্নাম তার রবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলল: হে আমার প্রতিপালক! আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন তাকে দু’টি শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দেয়া হল। একটি শীতকালে এবং অপরটি গ্রীষ্মকালে। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক সময় আমরা একটি প্রকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা বললাম: এটি কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: সত্তর বছর পূর্বে একটি পাথর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা আজ পৌঁছল। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৮৪-২১৮৫)
এরূপ অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর আক্বীদা-বিশ্বাস।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে বিশ্ব-সেরা ছিল। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের সবচেয়ে একটি ছোট সূরার মত সূরা তৈরি করে আনতে। কিন্তু তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি সকল মানুষের জন্য বিদ্যামান থাকবে।
২. আবদ বা দাস একটি সম্মানসূচক উপাধি। আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাদের জন্য এ উপাধি ব্যবহার করেন যাদের তিনি ভালবাসেন।
৩. জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এখনো বিদ্যমান।
৪. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল; তাঁর কোন অংশ নয়।
আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের আলোচনা করার পর এখানে নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি কাফিরদের সম্বোধন করে বলেন:
(وَاِنْ کُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰی عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِھ۪ﺕ وَادْعُوْا شُھَدَا۬ءَکُمْ مِّنْ دُوْنِ اللہِ اِنْ کُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে আহ্বান কর; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
এখানে “عبد” (আবদ) বা বান্দা দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
অন্যএ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلٰي مُحَمَّدٍ)
“আর তারা ঈমান আনে যা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২)
সুতরাং এখানে عبد (আবদ) দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝানো হয়েছে। আর “আবদ” হল একটি অধিক সম্মানসূচক উপাধি। কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে “আবদ”বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنْ كُنْتُمْ اٰمَنْتُمْ بِاللّٰهِ وَمَآ أَنْزَلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ)
“যদি তোমরা ঈমান রাখ আল্লাহর ওপর এবং যা মীমাংসার দিন আমি আমার বান্দার (মুহাম্মাদের) প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম তার ওপর।”(সূরা আনফাল ৮:৪১)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرٰي بِعَبْدِه۪)
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে (মুহাম্মাদকে) রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:১)
এভাবে সূরা ফুরকান ১, সূরা নাজম ১০, সূরা হাদীদ ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে عبد (আবদ) বা দাস বলে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বা দাস, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্রষ্টা ও মা‘বূদ।
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদের ব্যাপারে এ উপাধি ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
“তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো”
কাফিররা যখন কুরআনকে পূর্বকালের উপকথা বা মুহাম্মাদের কথা বলে প্রত্যাখ্যান করতে লাগল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলেন, এ কুরআনের মত একটি কিতাব রচনা করে নিয়ে আসতে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْاِنْسُ وَالْجِنُّ عَلٰٓی اَنْ یَّاْتُوْا بِمِثْلِ ھٰذَا الْقُرْاٰنِ لَا یَاْتُوْنَ بِمِثْلِھ۪ وَلَوْ کَانَ بَعْضُھُمْ لِبَعْضٍ ظَھِیْرًا)
‘‘যদি এ কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনয়নের জন্য সব মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এটার অনুরূপ কুরআন আনয়ন করতে পারবে না।”(সূরা ইসরা ১৭:৮৮)
তারা যখন এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারল না তখন আল্লাহ তা‘আলা দশটি সূরার মত কিছু তৈরি করে আনতে বললেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ فَأْتُوْا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِه۪ مُفْتَرَيَاتٍ)
“তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি স্বরচিত সূরা আনয়ন করো।”(সূরা হূদ ১১:১৩)
এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একটি সূরার কথা বলেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِه۪)
– এর সমতুল্য একটি মাত্র সূরা নিয়ে এসো। (সূরা বাকারাহ ২:২৩)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন:
(فَإِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَلَنْ تَفْعَلُوْا)
অনন্তর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনো করতে পারবে না। (সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ)
“তা হলে তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় কর যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ ও পাথর যা তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”(সূরা বাকারাহ ২:২৪)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ অবান্তর চিন্তা-ভাবনা ও অপকৌশল পরিহার করে সে জাহান্নামকে ভয় করার নির্দেশ দিলেন যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।
“وُقُوْدٌ” এর অর্থ হচ্ছে জ্বালানি, যা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। যেমন গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا)
“অপরপক্ষে অত্যাচারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন হবে।”(সূরা জিন ৭২:১৫)
এখানে الحجارة (হিজারা) বা পাথর দ্বারা উদ্দেশ্য গন্ধকের পাথর যা অত্যন্ত কাল, বড় এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধময়। যার আগুন অত্যন্ত উত্তপ্ত হবে।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: এটা গন্ধকের পাথর যা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাফিরদের জন্য এগুলো প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। (তাফসীর ইবনু জারীর আত-তাবারী, অত্র আয়াতের তাফসীর, বর্ণনাটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুপাতিক)
সুদ্দী স্বীয় সনদে ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, জাহান্নামে গন্ধকের পাথর থাকবে যার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দ্বারা কাফিরদেরকে শাস্তি দেয়া হবে।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: এ পাথরগুলোর দুর্গন্ধ মৃত দেহের দুর্গন্ধের চেয়েও কঠিন দুর্গন্ধময়।
আবার কেউ বলেছেন: এগুলো হল সেই সব মূর্তি, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হিসেবে ইবাদত করা হত। যাতে মুশরিকরা বুঝতে পারে তারা এসব মূর্তির ইবাদত করেছে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের জন্য। কিন্তু সেগুলো কোন উপকার করা তো দূরের কথা, আজ তাদের সাথে জাহান্নামে জ্বলছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّکُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ حَصَبُ جَھَنَّمَﺚ اَنْتُمْ لَھَا وٰرِدُوْنَﮱلَوْ کَانَ ھٰٓؤُلَا۬ئِ اٰلِھَةً مَّا وَرَدُوْھَاﺚ وَکُلٌّ فِیْھَا خٰلِدُوْنَ)
“তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত করো সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।। যদি তারা ইলাহ্ হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করতো না; তাদের সকলেই তাতে স্থায়ী হবে।”(সূরা আম্বিয়া ২১:৯৮-৯৯)
(أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ)
“তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।”থেকে বুঝা যাচ্ছে মূলত জাহান্নাম কাফির ও মুশরিকদের জন্য, কোন মু’মিন সেখানে চিরস্থায়ী থাকবে না। আরো বুঝা যাচ্ছে জান্নাত এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান।
হাফেয ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: এ আয়াত দ্বারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জমায়াতের ইমামগণ দলীল পেশ করে থাকেন যে, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান।
এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি সুদীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে:تَحَاجَتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ
জান্নাত ও জাহান্নাম ঝগড়া করল। (সহীহ বুখারী হা: ৪৮৫০)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: জাহান্নাম তার রবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলল: হে আমার প্রতিপালক! আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন তাকে দু’টি শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দেয়া হল। একটি শীতকালে এবং অপরটি গ্রীষ্মকালে। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক সময় আমরা একটি প্রকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা বললাম: এটি কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: সত্তর বছর পূর্বে একটি পাথর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা আজ পৌঁছল। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৮৪-২১৮৫)
এরূপ অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর আক্বীদা-বিশ্বাস।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:১. তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে বিশ্ব-সেরা ছিল। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের সবচেয়ে একটি ছোট সূরার মত সূরা তৈরি করে আনতে। কিন্তু তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি সকল মানুষের জন্য বিদ্যামান থাকবে।
২. আবদ বা দাস একটি সম্মানসূচক উপাধি। আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাদের জন্য এ উপাধি ব্যবহার করেন যাদের তিনি ভালবাসেন।
৩. জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এখনো বিদ্যমান।
৪. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল; তাঁর কোন অংশ নয়।
2:25
وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡہَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا ہٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِہٖ مُتَشَابِہًا ؕ وَ لَہُمۡ فِیۡہَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَہَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۵﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে কাফির ও ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি ও লাঞ্ছনার বর্ণনা দেয়ার পর এখানে মু’মিন ও সৎ লোকেদের প্রতিদান ও সম্মানের বর্ণনা দিচ্ছেন। কুরআনকে مثاني (মাসানী) নামকরণের এটাও একটি উল্লেখযোগ্য মত যে, এতে প্রত্যেক বিষয় জোড়া জোড়া উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ঈমানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে কুফরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মু’মিনদের ভাল পরিণামের সাথে সাথে কাফির মুশরিকদের অশুভ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর: ১/১৬১)
আবার কুরআনের প্রত্যেক স্থানে ঈমানের সাথে সাথে সৎ কর্ম তথা নেক আমলের কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, ঈমান এবং নেক আমল পরস্পর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নেক আমল ব্যতীত ঈমান ফলপ্রসূ নয় এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ঈমান ছাড়া নেক আমলের কোন গুরুত্ব নেই। আর নেক আমল তখনই নেক আমল বলে গণ্য হবে যখন তা সুন্নাত মোতাবেক হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে করা হবে। সুন্নাত পরিপন্থী আমল গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপ খ্যাতি লাভ ও লোক দেখানোর জন্য কৃত আমলও প্রত্যাখ্যাত। তাই যারা ঈমানের সাথে সুন্নাত মোতাবেক আমল করবে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। অত্র নদীসমূহের প্রকার উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْھَآ اَنْھٰرٌ مِّنْ مَّا۬ئٍ غَیْرِ اٰسِنٍﺆ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ لَّبَنٍ لَّمْ یَتَغَیَّرْ طَعْمُھ۫ﺆ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشّٰرِبِیْنَﹰ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّی)
“যার মধ্যে বহমান থাকবে পরিস্কার পানির নহর, এমন দুধের নহর যার স্বাদ কখনও পরিবর্তন হয় না, এমন শরাবের নহর যারা পান করে তাদের জন্য সুস্বাদু এবং এমন মধুর নহর যা খাঁটি ও স্বচ্ছ।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৫)
জান্নাতের তলদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তার বৃক্ষরাজী ও অট্টালিকার নিম্নদেশ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়া। (ইবনু কাসির, তাফসীর অত্র আয়াত)
অন্য হাদীসে এসেছে ‘‘হাওজে কাউসার”-এর দু’ধারে খাঁটি মুক্তার গম্বুজ থাকবে। তার মাটি হচ্ছে খাঁটি মৃগনাভী, তার কুচি পাথরগুলো হচ্ছে মণি-মুক্তা ও অতি মূল্যবান পাথর। (সহীহ বুখারী; কিতাবুত তাফসীর হা:৪৯৬৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৬২, ৪০০)
(كُلَّمَا رُزِقُوْا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِّزْقًا)
‘যখনই তা হতে তাদেরকে রিযিক হিসেবে ফলসমূহ প্রদান করা হবে’অর্থাৎ যখনই জান্নাতিদেরকে জান্নাত হতে জীবিকাস্বরূপ ফলমূল প্রদান করা হবে তখনই তারা বলবে- এটা তো ইতোপূর্বে আমাদেরকে দুনিয়াতেও দেয়া হয়েছে।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের জন্য যে উদ্যান তৈরি করে রেখেছেন যখন তার গাছপালা থেকে তাদেরকে ফলমূল প্রদান করা হবে তখন তারা বলবে- এগুলো তো দুনিয়াতেও আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, জান্নাতবাসীদের এ কথা “ইতোপূর্বে আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল” এর অর্থ হচ্ছে যখনই তাদেরকে জান্নাতে ফলমূল প্রদান করা হবে তখন তারা বলবে, এগুলো তো দুনিয়ায় আমাদেরকে দেয়া হয়েছে (বর্ণনাটি হাসান)। (তাফসীর তবারী: ১/২৩৮-৯)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, অন্যরা বলেছেন এর ব্যাখ্যা হল, জান্নাতীরা বলবে- ফলগুলো ইতোপূর্বে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। একথা তাদের বলার কারণ হল তারা জান্নাতের ফলগুলো দুনিয়ার ফলের সদৃশ দেখতে পাবে। (তাফসীর তবারী: ১/২৮৯) যেমন ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: জান্নাতে যা কিছু আছে তা দুনিয়ার সাথে কেবল নামে সদৃশ। কারণ জান্নাতের নেয়ামতের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে: (এমন নেয়ামত যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শ্রবণ করেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে তার সঠিক ধারণার উদয় হয়নি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৯, ৪৭৮০)
ইমাম আওযায়ী (রহঃ) ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর থেকে বর্ণনা করেন যে, জান্নাতীর কাছে এক পেয়ালা ভর্তি সরবত নিয়ে আসা হবে, সে তা খাবে। আরেক পেয়ালা ভর্তি নিয়ে আসা হলে সে বলবে এটা তো এখন পান করলাম। ফেরেশতারা বলবে, পান করতে থাকুন। কেননা এর রং অভিন্ন এবং স্বাদ ভিন্ন।
তিনি আরো বলেন- জান্নাতের ঘাস হবে জাফরান, আর পাহাড়গুলো হবে মেশকে আম্বার। ছোট ছোট সুন্দর বালক ফলমূল নিয়ে জান্নাতিদের কাছে আসবে আর তারা খাবে। আবার নিয়ে আসবে তখন জান্নাতীরা বলবে এখনই তো খেলাম। তখন বালকরা বলবে- খেতে থাকুন, এর রং অভিন্ন কিন্তু স্বাদ ভিন্ন।
(وَلَهُمْ فِيْهَآ أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ)
“সেখানে তাদের জন্য থাকবে পুতঃপবিত্র সঙ্গিণী”জান্নাতীরা জান্নাতে যা কিছু পাবে তার অন্যতম হল পবিত্রা স্ত্রী। অন্যত্র জান্নাতী স্ত্রীদের গুণাবলী বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:كَأَنَّهُنَّ الْيَاقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ) )
“তারা (জান্নাতী স্ত্রীগণ) যেন হীরা ও মতি।”(সূরা রহমান ৫৫:৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَحُورٌ عِينٌ - كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُون)
“আর (তাদের জন্য থাকবে) সুন্দর আনতনয়না হূর, সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ, ” (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬:২২-২৩)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا)
“আরও আছে সমবয়স্কা, পূর্ণ যৌবনা তরুণী।” (সূরা নাবা ৭৮:৩৩) এছাড়াও অনেক আয়াত রয়েছে যাতে জান্নাতী নারীগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
এ জান্নাতী স্ত্রীগণ চরিত্রগত, গঠনগত, ভাষাগত ও সৃষ্টিগতভাবে সকল দিক দিয়ে পুতঃপবিত্র।
চরিত্রগত পবিত্র হল- তারা হবে পূর্ণযৌবনা-কুমারী, স্বামী সোহাগিণী, উত্তম আচরণকারিণী ও স্বামীর পূর্ণ আনুগত্যশীলা। গঠনগত পবিত্র হল- মাসিক, নিফাস, বীর্য, প্রশ্রাব-পায়খানা, থুথু, নাকের ময়লা ও দুর্গন্ধ থেকে পবিত্র। পূর্ণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, তাদের কোন ত্র“টি ও কদর্যতা থাকবে না। ভাষাগত পবিত্র হল- তারা কোন কটুবাক্য বলবে না। সৃষ্টিগত পবিত্র হল- তারা হবে টানাটানা চোখবিশিষ্ট আনতনয়না, তারা স্বামী ছাড়া অন্য কারো দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাবে না।
(وَّهُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ)
‘সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।’অর্থাৎ জান্নাতীরা জান্নাতে চিরকাল থাকবে, কোন দিন সেখান থেকে বের হবে না। হাদীসে এসেছে: জান্নাতীরা জান্নাতে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে চলে যাবার পর একজন ফেরেশতা ঘোষণা দেবে, হে জাহান্নামীরা! আর মৃত্যু নেই। হে জান্নাতীরা! আর মৃত্যু নেই। যারা যে অবস্থায় আছ, সব সময় ঐ অবস্থাতেই থাকবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫০)
অত্র আয়াতে ৪টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে-১. সুসংবাদ দাতা- তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে উম্মাতের ব্যক্তিবর্গ।
২. সুসংবাদ প্রাপ্ত- তারা হল সৎ আমলকারী মু’মিনগণ।
৩. যে জিনিসের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তা হল নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত।
৪. এ সুসংবাদ পাওয়ার মাধ্যম- তা হল ঈমান ও সৎ আমল। (তাফসীরে সা‘দী: পৃ. ২৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. ঈমান ও আমল অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ঈমানের সাথে আমল অবশ্যই থাকতে হবে।
২. যারা ঈমান আনবে ও সৎ আমল করবে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত।
৩. জান্নাতী স্ত্রী ও খাদ্যের বৈশিষ্ট্য অবগত হলাম।
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে কাফির ও ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি ও লাঞ্ছনার বর্ণনা দেয়ার পর এখানে মু’মিন ও সৎ লোকেদের প্রতিদান ও সম্মানের বর্ণনা দিচ্ছেন। কুরআনকে مثاني (মাসানী) নামকরণের এটাও একটি উল্লেখযোগ্য মত যে, এতে প্রত্যেক বিষয় জোড়া জোড়া উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ঈমানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে কুফরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মু’মিনদের ভাল পরিণামের সাথে সাথে কাফির মুশরিকদের অশুভ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর: ১/১৬১)
আবার কুরআনের প্রত্যেক স্থানে ঈমানের সাথে সাথে সৎ কর্ম তথা নেক আমলের কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, ঈমান এবং নেক আমল পরস্পর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নেক আমল ব্যতীত ঈমান ফলপ্রসূ নয় এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ঈমান ছাড়া নেক আমলের কোন গুরুত্ব নেই। আর নেক আমল তখনই নেক আমল বলে গণ্য হবে যখন তা সুন্নাত মোতাবেক হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে করা হবে। সুন্নাত পরিপন্থী আমল গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপ খ্যাতি লাভ ও লোক দেখানোর জন্য কৃত আমলও প্রত্যাখ্যাত। তাই যারা ঈমানের সাথে সুন্নাত মোতাবেক আমল করবে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। অত্র নদীসমূহের প্রকার উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فِیْھَآ اَنْھٰرٌ مِّنْ مَّا۬ئٍ غَیْرِ اٰسِنٍﺆ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ لَّبَنٍ لَّمْ یَتَغَیَّرْ طَعْمُھ۫ﺆ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشّٰرِبِیْنَﹰ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّی)
“যার মধ্যে বহমান থাকবে পরিস্কার পানির নহর, এমন দুধের নহর যার স্বাদ কখনও পরিবর্তন হয় না, এমন শরাবের নহর যারা পান করে তাদের জন্য সুস্বাদু এবং এমন মধুর নহর যা খাঁটি ও স্বচ্ছ।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৫)
জান্নাতের তলদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তার বৃক্ষরাজী ও অট্টালিকার নিম্নদেশ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়া। (ইবনু কাসির, তাফসীর অত্র আয়াত)
অন্য হাদীসে এসেছে ‘‘হাওজে কাউসার”-এর দু’ধারে খাঁটি মুক্তার গম্বুজ থাকবে। তার মাটি হচ্ছে খাঁটি মৃগনাভী, তার কুচি পাথরগুলো হচ্ছে মণি-মুক্তা ও অতি মূল্যবান পাথর। (সহীহ বুখারী; কিতাবুত তাফসীর হা:৪৯৬৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৬২, ৪০০)
(كُلَّمَا رُزِقُوْا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِّزْقًا)
‘যখনই তা হতে তাদেরকে রিযিক হিসেবে ফলসমূহ প্রদান করা হবে’অর্থাৎ যখনই জান্নাতিদেরকে জান্নাত হতে জীবিকাস্বরূপ ফলমূল প্রদান করা হবে তখনই তারা বলবে- এটা তো ইতোপূর্বে আমাদেরকে দুনিয়াতেও দেয়া হয়েছে।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের জন্য যে উদ্যান তৈরি করে রেখেছেন যখন তার গাছপালা থেকে তাদেরকে ফলমূল প্রদান করা হবে তখন তারা বলবে- এগুলো তো দুনিয়াতেও আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, জান্নাতবাসীদের এ কথা “ইতোপূর্বে আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল” এর অর্থ হচ্ছে যখনই তাদেরকে জান্নাতে ফলমূল প্রদান করা হবে তখন তারা বলবে, এগুলো তো দুনিয়ায় আমাদেরকে দেয়া হয়েছে (বর্ণনাটি হাসান)। (তাফসীর তবারী: ১/২৩৮-৯)
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, অন্যরা বলেছেন এর ব্যাখ্যা হল, জান্নাতীরা বলবে- ফলগুলো ইতোপূর্বে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। একথা তাদের বলার কারণ হল তারা জান্নাতের ফলগুলো দুনিয়ার ফলের সদৃশ দেখতে পাবে। (তাফসীর তবারী: ১/২৮৯) যেমন ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: জান্নাতে যা কিছু আছে তা দুনিয়ার সাথে কেবল নামে সদৃশ। কারণ জান্নাতের নেয়ামতের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে: (এমন নেয়ামত যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শ্রবণ করেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে তার সঠিক ধারণার উদয় হয়নি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৯, ৪৭৮০)
ইমাম আওযায়ী (রহঃ) ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর থেকে বর্ণনা করেন যে, জান্নাতীর কাছে এক পেয়ালা ভর্তি সরবত নিয়ে আসা হবে, সে তা খাবে। আরেক পেয়ালা ভর্তি নিয়ে আসা হলে সে বলবে এটা তো এখন পান করলাম। ফেরেশতারা বলবে, পান করতে থাকুন। কেননা এর রং অভিন্ন এবং স্বাদ ভিন্ন।
তিনি আরো বলেন- জান্নাতের ঘাস হবে জাফরান, আর পাহাড়গুলো হবে মেশকে আম্বার। ছোট ছোট সুন্দর বালক ফলমূল নিয়ে জান্নাতিদের কাছে আসবে আর তারা খাবে। আবার নিয়ে আসবে তখন জান্নাতীরা বলবে এখনই তো খেলাম। তখন বালকরা বলবে- খেতে থাকুন, এর রং অভিন্ন কিন্তু স্বাদ ভিন্ন।
(وَلَهُمْ فِيْهَآ أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ)
“সেখানে তাদের জন্য থাকবে পুতঃপবিত্র সঙ্গিণী”জান্নাতীরা জান্নাতে যা কিছু পাবে তার অন্যতম হল পবিত্রা স্ত্রী। অন্যত্র জান্নাতী স্ত্রীদের গুণাবলী বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:كَأَنَّهُنَّ الْيَاقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ) )
“তারা (জান্নাতী স্ত্রীগণ) যেন হীরা ও মতি।”(সূরা রহমান ৫৫:৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَحُورٌ عِينٌ - كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُون)
“আর (তাদের জন্য থাকবে) সুন্দর আনতনয়না হূর, সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ, ” (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬:২২-২৩)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا)
“আরও আছে সমবয়স্কা, পূর্ণ যৌবনা তরুণী।” (সূরা নাবা ৭৮:৩৩) এছাড়াও অনেক আয়াত রয়েছে যাতে জান্নাতী নারীগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
এ জান্নাতী স্ত্রীগণ চরিত্রগত, গঠনগত, ভাষাগত ও সৃষ্টিগতভাবে সকল দিক দিয়ে পুতঃপবিত্র।
চরিত্রগত পবিত্র হল- তারা হবে পূর্ণযৌবনা-কুমারী, স্বামী সোহাগিণী, উত্তম আচরণকারিণী ও স্বামীর পূর্ণ আনুগত্যশীলা। গঠনগত পবিত্র হল- মাসিক, নিফাস, বীর্য, প্রশ্রাব-পায়খানা, থুথু, নাকের ময়লা ও দুর্গন্ধ থেকে পবিত্র। পূর্ণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, তাদের কোন ত্র“টি ও কদর্যতা থাকবে না। ভাষাগত পবিত্র হল- তারা কোন কটুবাক্য বলবে না। সৃষ্টিগত পবিত্র হল- তারা হবে টানাটানা চোখবিশিষ্ট আনতনয়না, তারা স্বামী ছাড়া অন্য কারো দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাবে না।
(وَّهُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ)
‘সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।’অর্থাৎ জান্নাতীরা জান্নাতে চিরকাল থাকবে, কোন দিন সেখান থেকে বের হবে না। হাদীসে এসেছে: জান্নাতীরা জান্নাতে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে চলে যাবার পর একজন ফেরেশতা ঘোষণা দেবে, হে জাহান্নামীরা! আর মৃত্যু নেই। হে জান্নাতীরা! আর মৃত্যু নেই। যারা যে অবস্থায় আছ, সব সময় ঐ অবস্থাতেই থাকবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫০)
অত্র আয়াতে ৪টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে-১. সুসংবাদ দাতা- তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে উম্মাতের ব্যক্তিবর্গ।
২. সুসংবাদ প্রাপ্ত- তারা হল সৎ আমলকারী মু’মিনগণ।
৩. যে জিনিসের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তা হল নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত।
৪. এ সুসংবাদ পাওয়ার মাধ্যম- তা হল ঈমান ও সৎ আমল। (তাফসীরে সা‘দী: পৃ. ২৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. ঈমান ও আমল অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ঈমানের সাথে আমল অবশ্যই থাকতে হবে।
২. যারা ঈমান আনবে ও সৎ আমল করবে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত।
৩. জান্নাতী স্ত্রী ও খাদ্যের বৈশিষ্ট্য অবগত হলাম।
2:26
اِنَّ اللّٰہَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَہَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰہُ بِہٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِہٖ کَثِیۡرًا ۙ وَّ یَہۡدِیۡ بِہٖ کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِہٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿ۙ۲۶﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
এ আয়াতের ব্যাপারে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বর্ণনা হল- ইবনু আব্বাস (রাঃ), ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী হতে বর্ণিত যে,
(مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي اسْتَوْقَدَ نَارًا)
“এদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের ন্যায় যে আগুন জ্বালালো” এ আয়াত ও
(أَوْ كَصَيِّبٍ مِّنَ السَّمَا۬ءِ فِيْهِ ظُلُمَاتٌ)
“অথবা তাদের দৃষ্টান্ত আকাশ হতে পানি বর্ষণের ন্যায় যাতে রয়েছে অন্ধকার” এ আয়াত দ্বারা মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হলে মুনাফিকরা বলতে লাগল, এরূপ উদাহরণ বর্ণনা করা থেকে আল্লাহ মহান ও সম্মানিত। তখন এ আয়াত নাযিল হয়।
কাতাদাহ (রহঃ) বর্ণনা করেন, যখন আল্লাহ তা‘আলা মাকড়সা ও মাছির কথা উল্লেখ করলেন, মুশরিকরা বলল- এ মাকড়সা ও মাছির কথা উল্লেখ করা কী দরকার? তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল পৃ. ১৮)
(فَمَا فَوْقَهَا)
‘তদপেক্ষা ক্ষুদ্রতর’এর দু’টি অর্থ হতে পারে: একটি হল এই যে, ওর চেয়েও হালকা ও নগন্য জিনিস। যেমন কেউ কোন লোকের কৃপণতা ইত্যাদির কথা বর্ণনা করলে অন্যজন বলে যে, সে আরও ওপরে। তখন ভাবার্থ এই হয় যে, এ দোষে সে আরও নীচে নেমে গেছে। একটি হাদীসে এসেছে:لَوْ أَنَّ الدُّنْيَا تَزِنُ عِنْدَاللّٰهِ جَنَاحَ بَعُوْضَةٍ مَا سَقَي كَافِرًا مِنْهَا شُرْبَةً مِنْ مَاءٍ
যদি দুনিয়ার কদর আল্লাহ তা‘আলার কাছে একটি মশার ডানার সমানও হত তাহলে কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না। (তিরমিযী হা: ২৩২, হাকিম হা: ৩০৬, হাদীসটি দুর্বল)
দ্বিতীয় অর্থ এই যে, এর চেয়ে বেশি বড়। কেননা মশার চেয়ে ছোট প্রাণী আর কী হতে পারে? সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, যদি কোন মুসলিম কাঁটাবিদ্ধ হয় বা তার চেয়েও বেশি কষ্ট পায়, এজন্য তার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং পাপ মোচন হয়। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯৯১)
আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, যেমন এ ছোট-বড় জিনিসগুলো সৃষ্টি করতে আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেননি, তেমনই ওগুলোকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ণনা করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ও সংকোচ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَھ۫ﺚ اِنَّ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ لَنْ یَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّلَوِ اجْتَمَعُوْا لَھ۫ﺚ وَاِنْ یَّسْلُبْھُمُ الذُّبَابُ شَیْئًا لَّا یَسْتَنْقِذُوْھُ مِنْھُﺚ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوْبُ)
“হে মানুষ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগসহকারে সেটা শ্রবণ করো- তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্রিত হলেও এবং মাছি যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিকট হতে, এটাও তারা তার নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষক ও অন্বেষিত কতই দুর্বল।”(সূরা হজ্জ ২২:৭৩)
পূর্ব যুগের কোন মনীষী বলেছেন: “যখন আমি কুরআন মাজীদের কোন দৃষ্টান্ত শুনি এবং বুঝতে পারি না তখন আমার কান্না এসে যায়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, এ দৃষ্টান্তগুলো শুধু জ্ঞানিরাই বুঝে থাকে।”
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, দৃষ্টান্ত ছোট হোক আর বড় হোক ঈমানদারগণ এর ওপর ঈমান এনে থাকে, একে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং এর দ্বারা সুপথ পেয়ে থাকে।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন:
(فَأَمَّا الَّذِينَ اٰمَنُوا فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّهِمْ)
এর অর্থ হচ্ছে: “মু’মিনরা জানে যে, এটা দয়াময় আল্লাহর কথা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।”(সূরা বাকারাহ ২:২৬)
মুজাহিদ, হাসান বসরী, রাবী বিন আনাস এরূপ বর্ণনা করেছেন। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: উক্ত আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে- মু’মিনরা তা অনুধাবন করে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। তারা যদি জানতে পারে এতে বিস্তারিত কিছু রয়েছে তাহলে তার মাধ্যমে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যথায় অবগত হয় যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সত্য এবং যা কিছু বিস্তাতির রয়েছে তাও সত্য। আর যদি তাদের কাছে কিছু বোধগম্য না হয় তাহলে তারা এটাই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন দৃষ্টান্ত অযথা বর্ণনা করেননি। (তাফসীরে সা‘দী: ২৪)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا)
“আর যারা কাফির- সর্বাবস্থায় তারা বলে এসব নগণ্য বস্তুর উপমা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কী? যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে সূরা মুদ্দাসসিরে বলেন:
(وَمَا جَعَلْنَآ اَصْحٰبَ النَّارِ اِلَّا مَلٰ۬ئِکَةًﺕ وَّمَا جَعَلْنَا عِدَّتَھُمْ اِلَّا فِتْنَةً لِّلَّذِیْنَ کَفَرُوْاﺫ لِیَسْتَیْقِنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ وَیَزْدَادَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا اِیْمَانًا وَّلَا یَرْتَابَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ وَالْمُؤْمِنُوْنَﺫ وَلِیَقُوْلَ الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ وَّالْکٰفِرُوْنَ مَاذَآ اَرَادَ اللہُ بِھٰذَا مَثَلًاﺚ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللہُ مَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَھْدِیْ مَنْ یَّشَا۬ئُﺚ وَمَا یَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّکَ اِلَّا ھُوَ)
“আমি ফেরেশতাদেরকে জাহান্নামের প্রহরী করেছি কাফিরদের পরীক্ষার জন্য। আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি যাতে আহলে কিতাবের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, ঈমানদারদের ঈমান বর্ধিত হয় এবং বিশ্বাসী ও আহলে কিতাবগণ যেন সন্দেহ পোষণ না করে। এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফিররা বলবেঃ আল্লাহ্ এ বর্ণনা দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন? এভাবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৩১)
আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: এর ভাবার্থ হচ্ছে তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ফলে তাদের কুফরীর সাথে আরো কুফরী বৃদ্ধি পায় যেমন মু’মিনদের ঈমানের সাথে আরো ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُضِلُّ بِه۪ كَثِيرًا وَّيَهْدِي بِه۪ كَثِيرًا)
“তিনি এর দ্বারা অনেককে বিপদগামী করে থাকেন এবং এর দ্বারা অনেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন।”
এ হল কুরআন অবতীর্ণের সময় মু’মিন ও কাফিরদের অবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا مَآ اُنْزِلَتْ سُوْرَةٌ فَمِنْھُمْ مَّنْ یَّقُوْلُ اَیُّکُمْ زَادَتْھُ ھٰذِھ۪ٓ اِیْمَانًاﺆ فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فَزَادَتْھُمْ اِیْمَانًا وَّھُمْ یَسْتَبْشِرُوْنَوَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের কেউ কেউ বলে ‘এটা তোমাদের মধ্যে কারো ঈমান বৃদ্ধি করলো?’যারা মু’মিন এটা তাদেরই ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারাই আনন্দিত হয়। এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৪-১২৫)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পাপিষ্ঠদের পথভ্রষ্ট করার হিকমত ও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا يُضِلُّ بِه۪ إِلَّا الْفَاسِقِيْنَ)
“তিনি এর দ্বারা কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।” অর্থাৎ যারা আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। অতএব আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি হল এটাই- যারা হিদায়াতের অযোগ্য, অনুপোযোগী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করা আর যারা ঈমানের গুণে গুণান্বিত ও সৎ আমলে অলঙ্কৃত তাদেরকে হিদায়াত প্রদান করা।
“فاسق” ফাসিক অবাধ্য দু’প্রকার:
১. এমন অবাধ্য হওয়া যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যেমন এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. এমন অবাধ্য হওয়া যা ইসলাম থেকে বের করে দেয় না কিন্তু অপরাধী হয় এবং ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنْ جَا۬ءَکُمْ فَاسِقٌۭ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوْٓا)
“যদি কোন ফাসিক লোক তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে তাহলে এর সত্যতা যাচাই করে নিও।” (সূরা হুজুরাত ৪৯:৬, তাফসীরে সা‘দী: পৃ. ২৪)
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, “يُضِلُّ بِه۪ كَثِيْرًا”এর দ্বারা অনেককে পথভ্রষ্ট করেন অর্থাৎ মুনাফিকদেরকে। আবুল আলিয়াও এ রকম বলেছেন।
ইবনু আবি হাতিম সা‘দ হতে বর্ণনা করেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল “খাওয়ারিজ”। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সুতরাং কুরআনে যা কিছু উল্লেখ আছে প্রকৃত মু’মিনরা তা দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও কাফিররা কুরআনের যে কোন বিষয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে, ফলে তাদের কুফরী আরো বৃদ্ধি পায়। যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন
(نُوَلِّه۪ مَا تَوَلّٰي)
“আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দেব যে দিক সে অবলম্বন করবে।”(সূরা নিসা ৪:১১৫) এবং হাদীসে এসেছেكُلُّ مُيَسَّرٍ لِمَا خُلِقَ لَهُ
অর্থাৎ প্রত্যেকের জন্য সে জিনিস সহজ করা হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯৪৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. ছোট-বড় সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি। তাই তিনি যেকোন সৃষ্টি দ্বারা উপমা দিতে লজ্জাবোধ করেন না।
২. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিনরা উপকৃত হয়, আর কুরআন কাফিরদের ক্ষতি ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করে না।
৩. কিছু কিছু অবাধ্য কর্ম আছে যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়; সেগুলো থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
৪. এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার একটি পবিত্র সিফাত বা গুণ সাব্যস্ত হয় যে, “আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেন”। আমরা আল্লাহ তা‘আলার এ সিফাত বা গুণ অবশ্যই তাঁর জন্য সাব্যস্ত করব যেহেতু তা কুরআনে এসেছে। তবে কোন মাখলুকের সাথে সাদৃশ্য করব না এবং কোন ধরণও জিজ্ঞাসা করব না, বরং মহান আল্লাহর জন্য যেমন শোভা পায় তেমনই বিশ্বাস করব।
শানে নুযূল:
এ আয়াতের ব্যাপারে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বর্ণনা হল- ইবনু আব্বাস (রাঃ), ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী হতে বর্ণিত যে,
(مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي اسْتَوْقَدَ نَارًا)
“এদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের ন্যায় যে আগুন জ্বালালো” এ আয়াত ও
(أَوْ كَصَيِّبٍ مِّنَ السَّمَا۬ءِ فِيْهِ ظُلُمَاتٌ)
“অথবা তাদের দৃষ্টান্ত আকাশ হতে পানি বর্ষণের ন্যায় যাতে রয়েছে অন্ধকার” এ আয়াত দ্বারা মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হলে মুনাফিকরা বলতে লাগল, এরূপ উদাহরণ বর্ণনা করা থেকে আল্লাহ মহান ও সম্মানিত। তখন এ আয়াত নাযিল হয়।
কাতাদাহ (রহঃ) বর্ণনা করেন, যখন আল্লাহ তা‘আলা মাকড়সা ও মাছির কথা উল্লেখ করলেন, মুশরিকরা বলল- এ মাকড়সা ও মাছির কথা উল্লেখ করা কী দরকার? তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল পৃ. ১৮)
(فَمَا فَوْقَهَا)
‘তদপেক্ষা ক্ষুদ্রতর’এর দু’টি অর্থ হতে পারে: একটি হল এই যে, ওর চেয়েও হালকা ও নগন্য জিনিস। যেমন কেউ কোন লোকের কৃপণতা ইত্যাদির কথা বর্ণনা করলে অন্যজন বলে যে, সে আরও ওপরে। তখন ভাবার্থ এই হয় যে, এ দোষে সে আরও নীচে নেমে গেছে। একটি হাদীসে এসেছে:لَوْ أَنَّ الدُّنْيَا تَزِنُ عِنْدَاللّٰهِ جَنَاحَ بَعُوْضَةٍ مَا سَقَي كَافِرًا مِنْهَا شُرْبَةً مِنْ مَاءٍ
যদি দুনিয়ার কদর আল্লাহ তা‘আলার কাছে একটি মশার ডানার সমানও হত তাহলে কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না। (তিরমিযী হা: ২৩২, হাকিম হা: ৩০৬, হাদীসটি দুর্বল)
দ্বিতীয় অর্থ এই যে, এর চেয়ে বেশি বড়। কেননা মশার চেয়ে ছোট প্রাণী আর কী হতে পারে? সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, যদি কোন মুসলিম কাঁটাবিদ্ধ হয় বা তার চেয়েও বেশি কষ্ট পায়, এজন্য তার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং পাপ মোচন হয়। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯৯১)
আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, যেমন এ ছোট-বড় জিনিসগুলো সৃষ্টি করতে আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেননি, তেমনই ওগুলোকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ণনা করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ও সংকোচ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَھ۫ﺚ اِنَّ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ لَنْ یَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّلَوِ اجْتَمَعُوْا لَھ۫ﺚ وَاِنْ یَّسْلُبْھُمُ الذُّبَابُ شَیْئًا لَّا یَسْتَنْقِذُوْھُ مِنْھُﺚ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوْبُ)
“হে মানুষ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগসহকারে সেটা শ্রবণ করো- তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্রিত হলেও এবং মাছি যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিকট হতে, এটাও তারা তার নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষক ও অন্বেষিত কতই দুর্বল।”(সূরা হজ্জ ২২:৭৩)
পূর্ব যুগের কোন মনীষী বলেছেন: “যখন আমি কুরআন মাজীদের কোন দৃষ্টান্ত শুনি এবং বুঝতে পারি না তখন আমার কান্না এসে যায়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, এ দৃষ্টান্তগুলো শুধু জ্ঞানিরাই বুঝে থাকে।”
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, দৃষ্টান্ত ছোট হোক আর বড় হোক ঈমানদারগণ এর ওপর ঈমান এনে থাকে, একে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং এর দ্বারা সুপথ পেয়ে থাকে।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন:
(فَأَمَّا الَّذِينَ اٰمَنُوا فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّهِمْ)
এর অর্থ হচ্ছে: “মু’মিনরা জানে যে, এটা দয়াময় আল্লাহর কথা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।”(সূরা বাকারাহ ২:২৬)
মুজাহিদ, হাসান বসরী, রাবী বিন আনাস এরূপ বর্ণনা করেছেন। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: উক্ত আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে- মু’মিনরা তা অনুধাবন করে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। তারা যদি জানতে পারে এতে বিস্তারিত কিছু রয়েছে তাহলে তার মাধ্যমে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যথায় অবগত হয় যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সত্য এবং যা কিছু বিস্তাতির রয়েছে তাও সত্য। আর যদি তাদের কাছে কিছু বোধগম্য না হয় তাহলে তারা এটাই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন দৃষ্টান্ত অযথা বর্ণনা করেননি। (তাফসীরে সা‘দী: ২৪)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا)
“আর যারা কাফির- সর্বাবস্থায় তারা বলে এসব নগণ্য বস্তুর উপমা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কী? যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে সূরা মুদ্দাসসিরে বলেন:
(وَمَا جَعَلْنَآ اَصْحٰبَ النَّارِ اِلَّا مَلٰ۬ئِکَةًﺕ وَّمَا جَعَلْنَا عِدَّتَھُمْ اِلَّا فِتْنَةً لِّلَّذِیْنَ کَفَرُوْاﺫ لِیَسْتَیْقِنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ وَیَزْدَادَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا اِیْمَانًا وَّلَا یَرْتَابَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ وَالْمُؤْمِنُوْنَﺫ وَلِیَقُوْلَ الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ وَّالْکٰفِرُوْنَ مَاذَآ اَرَادَ اللہُ بِھٰذَا مَثَلًاﺚ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللہُ مَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَھْدِیْ مَنْ یَّشَا۬ئُﺚ وَمَا یَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّکَ اِلَّا ھُوَ)
“আমি ফেরেশতাদেরকে জাহান্নামের প্রহরী করেছি কাফিরদের পরীক্ষার জন্য। আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি যাতে আহলে কিতাবের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, ঈমানদারদের ঈমান বর্ধিত হয় এবং বিশ্বাসী ও আহলে কিতাবগণ যেন সন্দেহ পোষণ না করে। এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফিররা বলবেঃ আল্লাহ্ এ বর্ণনা দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন? এভাবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৩১)
আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: এর ভাবার্থ হচ্ছে তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ফলে তাদের কুফরীর সাথে আরো কুফরী বৃদ্ধি পায় যেমন মু’মিনদের ঈমানের সাথে আরো ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُضِلُّ بِه۪ كَثِيرًا وَّيَهْدِي بِه۪ كَثِيرًا)
“তিনি এর দ্বারা অনেককে বিপদগামী করে থাকেন এবং এর দ্বারা অনেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন।”
এ হল কুরআন অবতীর্ণের সময় মু’মিন ও কাফিরদের অবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذَا مَآ اُنْزِلَتْ سُوْرَةٌ فَمِنْھُمْ مَّنْ یَّقُوْلُ اَیُّکُمْ زَادَتْھُ ھٰذِھ۪ٓ اِیْمَانًاﺆ فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فَزَادَتْھُمْ اِیْمَانًا وَّھُمْ یَسْتَبْشِرُوْنَوَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ)
“যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের কেউ কেউ বলে ‘এটা তোমাদের মধ্যে কারো ঈমান বৃদ্ধি করলো?’যারা মু’মিন এটা তাদেরই ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারাই আনন্দিত হয়। এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৪-১২৫)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পাপিষ্ঠদের পথভ্রষ্ট করার হিকমত ও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا يُضِلُّ بِه۪ إِلَّا الْفَاسِقِيْنَ)
“তিনি এর দ্বারা কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।” অর্থাৎ যারা আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। অতএব আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি হল এটাই- যারা হিদায়াতের অযোগ্য, অনুপোযোগী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করা আর যারা ঈমানের গুণে গুণান্বিত ও সৎ আমলে অলঙ্কৃত তাদেরকে হিদায়াত প্রদান করা।
“فاسق” ফাসিক অবাধ্য দু’প্রকার:
১. এমন অবাধ্য হওয়া যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যেমন এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. এমন অবাধ্য হওয়া যা ইসলাম থেকে বের করে দেয় না কিন্তু অপরাধী হয় এবং ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنْ جَا۬ءَکُمْ فَاسِقٌۭ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوْٓا)
“যদি কোন ফাসিক লোক তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে তাহলে এর সত্যতা যাচাই করে নিও।” (সূরা হুজুরাত ৪৯:৬, তাফসীরে সা‘দী: পৃ. ২৪)
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, “يُضِلُّ بِه۪ كَثِيْرًا”এর দ্বারা অনেককে পথভ্রষ্ট করেন অর্থাৎ মুনাফিকদেরকে। আবুল আলিয়াও এ রকম বলেছেন।
ইবনু আবি হাতিম সা‘দ হতে বর্ণনা করেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল “খাওয়ারিজ”। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সুতরাং কুরআনে যা কিছু উল্লেখ আছে প্রকৃত মু’মিনরা তা দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও কাফিররা কুরআনের যে কোন বিষয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে, ফলে তাদের কুফরী আরো বৃদ্ধি পায়। যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন
(نُوَلِّه۪ مَا تَوَلّٰي)
“আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দেব যে দিক সে অবলম্বন করবে।”(সূরা নিসা ৪:১১৫) এবং হাদীসে এসেছেكُلُّ مُيَسَّرٍ لِمَا خُلِقَ لَهُ
অর্থাৎ প্রত্যেকের জন্য সে জিনিস সহজ করা হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯৪৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. ছোট-বড় সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি। তাই তিনি যেকোন সৃষ্টি দ্বারা উপমা দিতে লজ্জাবোধ করেন না।
২. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিনরা উপকৃত হয়, আর কুরআন কাফিরদের ক্ষতি ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করে না।
৩. কিছু কিছু অবাধ্য কর্ম আছে যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়; সেগুলো থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
৪. এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার একটি পবিত্র সিফাত বা গুণ সাব্যস্ত হয় যে, “আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেন”। আমরা আল্লাহ তা‘আলার এ সিফাত বা গুণ অবশ্যই তাঁর জন্য সাব্যস্ত করব যেহেতু তা কুরআনে এসেছে। তবে কোন মাখলুকের সাথে সাদৃশ্য করব না এবং কোন ধরণও জিজ্ঞাসা করব না, বরং মহান আল্লাহর জন্য যেমন শোভা পায় তেমনই বিশ্বাস করব।
2:27
الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَہۡدَ اللّٰہِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِہٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰہُ بِہٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۲۷﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৭নং আয়াতের তাফসীর:
এ সমস্ত গুণাবলী হল কাফিরদের যা মু’মিনদের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“তোমার প্রতিপালক হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে সে আর অন্ধ কি সমান? উপদেশ গ্রহণ করে শুধু বিবেকশক্তিসম্পন্নগণই, যারা আল্লাহ প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না, আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসেবকে, যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধৈর্যধারণ করে, সালাত কায়িম করে, আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা ভাল দ্বারা মন্দ দূরীভূত করে, এদের জন্য শুভ পরিণাম- স্থায়ী জান্নাত, এতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সস্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎ কর্ম করেছে তারাও এবং ফেরেশতাগণ তাদের নিকট উপস্থিত হবে প্রত্যেক দ্বার দিয়ে এবং বলবে, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কত ভাল এ পরিণাম!’যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর সেটা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস।”(সূরা রা‘দ ১৩:১৯-২৫)
অত্র আয়াতে “যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে” এ ওয়াদা দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
১. একদল বলেন: এখানে অঙ্গীকারের অর্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার সম্পূর্ণ নির্দেশ মেনে চলা এবং সমস্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা। তা ভঙ্গ করার অর্থ হচ্ছে তার ওপর আমল না করা।
২. কেউ বলেন: অঙ্গীকার ভঙ্গকারীরা হচ্ছে আহলে কিতাবের কাফির ও মুনাফিকরা। অঙ্গীকার হচ্ছে যা তাওরাতে তাদের কাছে নেয়া হয়েছিল, তারা তার সমস্ত কথা মেনে চলবে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য স্বীকার করবে, তাঁর নবুওয়াতে বিশ্বাস করবে এবং তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য মনে করবে। আর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এই যে, জেনে-শুনে তারা তাঁর নবুওয়াত ও আনুগত্য অস্বীকার করেছে এবং অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও তারা তা গোপন করেছে, আর পার্থিব স্বার্থের কারণে তার উল্টোটা করেছে। ইমাম ইবনে জারীর ও মুকাতিল ইবনে হিব্বানও এ কথা বলেছেন।
৩. কারো মতে, এর ভাবার্থে কোন নির্দিষ্ট দলকে বুঝায় না, বরং সমস্ত কাফির-মুশরিক ও মুনাফিককে বুঝায়, অঙ্গীকারের ভাবার্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও তাঁর নাবীর নবুওয়াতকে স্বীকার করা- যার প্রমাণে প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী ও বড় বড় মু‘জিযাহ বিদ্যমান রয়েছে। আর তা ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অস্বীকার করা। এ কথাটিই অধিক মজবুত ও যুক্তিযুক্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লামা সা‘দী বলেন, এখানে অঙ্গীকার দ্বারা সকল অঙ্গীকার শামিল। যা মানুষ ও তাদের রবের মাঝে এবং তাদের ও সৃষ্টি জীবের মাঝে (অঙ্গীকার) বিদ্যমান। (তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২৪)
আবার কেউ বলেন: আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে সকল সন্তানদের বের করার পর যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ اَخَذَ رَبُّکَ مِنْۭ بَنِیْٓ اٰدَمَ مِنْ ظُھُوْرِھِمْ ذُرِّیَّتَھُمْ وَاَشْھَدَھُمْ عَلٰٓی اَنْفُسِھِمْﺆ اَلَسْتُ بِرَبِّکُمْﺚ قَالُوْا بَلٰیﹱ شَھِدْنَا)
“স্মরণ কর! যখন তোমার প্রতিপালক আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’তারা বলল: ‘হ্যাঁ অবশ্যই আমরা সাক্ষী রইলাম।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৭২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوآ أَرْحَامَكُمْ)
“এখন তোমাদের কাছে এ ছাড়া আর কিছু কি আশা করা যায় যে, যদি তোমরা জনগণের শাসক হও তাহলে দুনিয়াতে ফাসাদ করবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করবে?” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২২)
সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার মধ্যে অন্যতম একটি দিক হল- সকল রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা। তাই কতক রাসূলে প্রতি ঈমান আনা আর কতকের প্রতি ঈমান না আনা সম্পর্ক ছিন্ন করার শামিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللّٰهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا)
“এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করতে চায় এবং বলে ‘আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি’; আর তারা মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, এরাই প্রকৃত কাফির।”(সূরা নিসা ৪:১৫০-৫১)
তবে আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: এতে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান ও তাঁর ইবাদত করার মধ্য দিয়ে তাঁর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের প্রতি ঈমান, ভালবাসা, সম্মান প্রদর্শন ও তাঁর সকল অধিকার আদায় করার মাধ্যমে আমাদের তাঁর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সমস্ত সৃষ্টি জীবের যথার্থ হক আদায় করে আমাদের ও তাদের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ প্রদান করেছেন।
অতএব মু’মিনদের আল্লাহ তা‘আলা যে সকল সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তারা তা যথাযথ বহাল রাখে আর ফাসিকরা তা ক্ষুণ্ণ করে; এটাই হল জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা। তারাই হল দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৪)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, যে সকল অন্যায়ের কথা আল্লাহ তা‘আলা অমুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, জালিম, পাপাচারী, ফাসিক ইত্যাদি- এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুফর। আর যা মুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তার দ্বারা উদ্দেশ্য হল নিন্দা করা। (ফাতহুল কাদীর ১/৯৫-৯৬)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মুনাফিক ও কাফিরদের বৈশিষ্ট্য। সেটা যেকোন প্রকার অঙ্গীকার হতে পারে।
২. কাফিররা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আর মু’মিনরা তা বহাল রাখে।
এ সমস্ত গুণাবলী হল কাফিরদের যা মু’মিনদের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“তোমার প্রতিপালক হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে সে আর অন্ধ কি সমান? উপদেশ গ্রহণ করে শুধু বিবেকশক্তিসম্পন্নগণই, যারা আল্লাহ প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না, আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসেবকে, যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধৈর্যধারণ করে, সালাত কায়িম করে, আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা ভাল দ্বারা মন্দ দূরীভূত করে, এদের জন্য শুভ পরিণাম- স্থায়ী জান্নাত, এতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সস্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎ কর্ম করেছে তারাও এবং ফেরেশতাগণ তাদের নিকট উপস্থিত হবে প্রত্যেক দ্বার দিয়ে এবং বলবে, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কত ভাল এ পরিণাম!’যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর সেটা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস।”(সূরা রা‘দ ১৩:১৯-২৫)
অত্র আয়াতে “যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে” এ ওয়াদা দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
১. একদল বলেন: এখানে অঙ্গীকারের অর্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার সম্পূর্ণ নির্দেশ মেনে চলা এবং সমস্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা। তা ভঙ্গ করার অর্থ হচ্ছে তার ওপর আমল না করা।
২. কেউ বলেন: অঙ্গীকার ভঙ্গকারীরা হচ্ছে আহলে কিতাবের কাফির ও মুনাফিকরা। অঙ্গীকার হচ্ছে যা তাওরাতে তাদের কাছে নেয়া হয়েছিল, তারা তার সমস্ত কথা মেনে চলবে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য স্বীকার করবে, তাঁর নবুওয়াতে বিশ্বাস করবে এবং তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য মনে করবে। আর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এই যে, জেনে-শুনে তারা তাঁর নবুওয়াত ও আনুগত্য অস্বীকার করেছে এবং অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও তারা তা গোপন করেছে, আর পার্থিব স্বার্থের কারণে তার উল্টোটা করেছে। ইমাম ইবনে জারীর ও মুকাতিল ইবনে হিব্বানও এ কথা বলেছেন।
৩. কারো মতে, এর ভাবার্থে কোন নির্দিষ্ট দলকে বুঝায় না, বরং সমস্ত কাফির-মুশরিক ও মুনাফিককে বুঝায়, অঙ্গীকারের ভাবার্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও তাঁর নাবীর নবুওয়াতকে স্বীকার করা- যার প্রমাণে প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী ও বড় বড় মু‘জিযাহ বিদ্যমান রয়েছে। আর তা ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অস্বীকার করা। এ কথাটিই অধিক মজবুত ও যুক্তিযুক্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লামা সা‘দী বলেন, এখানে অঙ্গীকার দ্বারা সকল অঙ্গীকার শামিল। যা মানুষ ও তাদের রবের মাঝে এবং তাদের ও সৃষ্টি জীবের মাঝে (অঙ্গীকার) বিদ্যমান। (তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২৪)
আবার কেউ বলেন: আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে সকল সন্তানদের বের করার পর যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ اَخَذَ رَبُّکَ مِنْۭ بَنِیْٓ اٰدَمَ مِنْ ظُھُوْرِھِمْ ذُرِّیَّتَھُمْ وَاَشْھَدَھُمْ عَلٰٓی اَنْفُسِھِمْﺆ اَلَسْتُ بِرَبِّکُمْﺚ قَالُوْا بَلٰیﹱ شَھِدْنَا)
“স্মরণ কর! যখন তোমার প্রতিপালক আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’তারা বলল: ‘হ্যাঁ অবশ্যই আমরা সাক্ষী রইলাম।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৭২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوآ أَرْحَامَكُمْ)
“এখন তোমাদের কাছে এ ছাড়া আর কিছু কি আশা করা যায় যে, যদি তোমরা জনগণের শাসক হও তাহলে দুনিয়াতে ফাসাদ করবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করবে?” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২২)
সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার মধ্যে অন্যতম একটি দিক হল- সকল রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা। তাই কতক রাসূলে প্রতি ঈমান আনা আর কতকের প্রতি ঈমান না আনা সম্পর্ক ছিন্ন করার শামিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللّٰهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا)
“এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করতে চায় এবং বলে ‘আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি’; আর তারা মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, এরাই প্রকৃত কাফির।”(সূরা নিসা ৪:১৫০-৫১)
তবে আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: এতে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান ও তাঁর ইবাদত করার মধ্য দিয়ে তাঁর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের প্রতি ঈমান, ভালবাসা, সম্মান প্রদর্শন ও তাঁর সকল অধিকার আদায় করার মাধ্যমে আমাদের তাঁর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সমস্ত সৃষ্টি জীবের যথার্থ হক আদায় করে আমাদের ও তাদের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ প্রদান করেছেন।
অতএব মু’মিনদের আল্লাহ তা‘আলা যে সকল সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তারা তা যথাযথ বহাল রাখে আর ফাসিকরা তা ক্ষুণ্ণ করে; এটাই হল জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা। তারাই হল দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৪)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, যে সকল অন্যায়ের কথা আল্লাহ তা‘আলা অমুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, জালিম, পাপাচারী, ফাসিক ইত্যাদি- এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুফর। আর যা মুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তার দ্বারা উদ্দেশ্য হল নিন্দা করা। (ফাতহুল কাদীর ১/৯৫-৯৬)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মুনাফিক ও কাফিরদের বৈশিষ্ট্য। সেটা যেকোন প্রকার অঙ্গীকার হতে পারে।
২. কাফিররা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আর মু’মিনরা তা বহাল রাখে।
2:28
کَیۡفَ تَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ کُنۡتُمۡ اَمۡوَاتًا فَاَحۡیَاکُمۡ ۚ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡکُمۡ ثُمَّ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۲۸﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৮ নং আয়াতের তাফসীর:
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অস্বীকারকারিদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে বলেন: তোমরা কিভাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী কর? অথচ তিনি তোমাদেরকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(ھَلْ اَتٰی عَلَی الْاِنْسَانِ حِیْنٌ مِّنَ الدَّھْرِ لَمْ یَکُنْ شَیْئًا مَّذْکُوْرًا)
“মানুষের এমন এক সময় কি অতিবাহিত হয়নি যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না?” (সূরা দাহর ৭৬:১)
তোমরা ছিলে পিতার পৃষ্ঠদেশে শুক্রকিট ও মায়ের জরায়ুতে ডিম্বানু আকারে মৃত, আল্লাহ তা‘আলা সেখান থেকে জীবন দান করে বাচ্চা আকারে পৃথিবীতে নিয়ে আসলেন। অতঃপর বিভিন্ন নেয়ামত দ্বারা জীবিত রাখার পর বয়স পরিপূর্ণ হয়ে গেলে মৃত্যু দান করলেন। তারপর কবরস্থ করলেন প্রতিদান দেয়ার জন্য, আবার পূর্ণ প্রতিদান দেয়ার জন্য পুনরুত্থিত করবেন।
অতএব তোমরা সার্বক্ষণিক আল্লাহ তা‘আলার তত্ত্বাবধানাধীন, তারপরও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করা কি সঙ্গত? না! বরং এটা বোকামী ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী না করে তোমাদের উচিত তাঁকে যথাযথ ভয় করা, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাঁর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর আযাবকে ভয় করা এবং সওয়াবের আশা করা। (তাফসীর সা‘দী, পৃ. ২৫)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করে যেমন দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন তেমন হিসাব-নিকাশের জন্য আবার হাশরের ময়দানে উপস্থিত করবেন।
২. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর নেয়ামতের কৃজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্ত কর্তব্য।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অস্বীকারকারিদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে বলেন: তোমরা কিভাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী কর? অথচ তিনি তোমাদেরকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(ھَلْ اَتٰی عَلَی الْاِنْسَانِ حِیْنٌ مِّنَ الدَّھْرِ لَمْ یَکُنْ شَیْئًا مَّذْکُوْرًا)
“মানুষের এমন এক সময় কি অতিবাহিত হয়নি যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না?” (সূরা দাহর ৭৬:১)
তোমরা ছিলে পিতার পৃষ্ঠদেশে শুক্রকিট ও মায়ের জরায়ুতে ডিম্বানু আকারে মৃত, আল্লাহ তা‘আলা সেখান থেকে জীবন দান করে বাচ্চা আকারে পৃথিবীতে নিয়ে আসলেন। অতঃপর বিভিন্ন নেয়ামত দ্বারা জীবিত রাখার পর বয়স পরিপূর্ণ হয়ে গেলে মৃত্যু দান করলেন। তারপর কবরস্থ করলেন প্রতিদান দেয়ার জন্য, আবার পূর্ণ প্রতিদান দেয়ার জন্য পুনরুত্থিত করবেন।
অতএব তোমরা সার্বক্ষণিক আল্লাহ তা‘আলার তত্ত্বাবধানাধীন, তারপরও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করা কি সঙ্গত? না! বরং এটা বোকামী ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী না করে তোমাদের উচিত তাঁকে যথাযথ ভয় করা, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাঁর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর আযাবকে ভয় করা এবং সওয়াবের আশা করা। (তাফসীর সা‘দী, পৃ. ২৫)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করে যেমন দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন তেমন হিসাব-নিকাশের জন্য আবার হাশরের ময়দানে উপস্থিত করবেন।
২. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর নেয়ামতের কৃজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্ত কর্তব্য।
2:29
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ لَکُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا ٭ ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ فَسَوّٰىہُنَّ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ ؕ وَ ہُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿٪۲۹﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
২৯ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে “لَكُمْ” ‘তোমাদের জন্য’এর দ্বারা পৃথিবীর সকল বস্তু মানুষের উপকার ও উপভোগের জন্য সৃষ্টি করা বুঝানো হয়েছে। এ আয়াত প্রমাণ করে সকল বস্তুর মূল অবস্থা বা বিধান হল হালাল বা বৈধ। কেননা তা অনুগ্রহের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা হারাম বস্তুগুলো বের হয়ে গেছে। এখানে আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারার্থে। অতএব যার ভিতরে ক্ষতি ও অপকার রয়েছে তা এর বাইরে।
(ثُمَّ اسْتَوٰٓى إِلَي السَّمَآءِ)
“অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেন” ইসতিওয়া শব্দটি কুরআনুল কারীমে তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:
১. ইসতিওয়া শব্দটি যখন কোন অব্যয়-এর সাথে ব্যবহার হবে না তখন এর অর্থ হবে পরিপূর্ণতা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন; (وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّه۫ وَاسْتَوٰي)
“যখন মূসা পূর্ণ যৌবনে উপনীত ও পরিণত বয়স্ক হল।”(সূরা কাসাস ২৮:১৮)
২. ইসতিওয়া শব্দটি যখন “علي”অব্যয়-এর সাথে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হবে ওপরে ওঠা, সমুন্নত হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الرَّحْمٰنُ عَلَي الْعَرْشِ اسْتَوٰي)
“দয়াময় (আল্লাহ) আরশের ওপর সমুন্নত।”(ত্বহা ২০:৫)
৩. যখন ইসতিওয়া শব্দটি “إلي” অব্যয়ের সাথে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হবে ইচ্ছা করা। যেমন এ আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তারপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন। (তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২৫)
(وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ)
‘আর তিনি সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী।’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান সকল সৃষ্টি বস্তুকে বেষ্টন করে আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيْفُ الْخَبِيْرُ)
“যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, ভালোভাবে অবগত।”
আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতের বিস্তারিত বর্ণনা সূরা হা-মীম সিজদায় দিয়েছেন: “বল: তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক। তিনি ভূ-পৃষ্ঠে স্থাপন করেছেন (অটল) পর্বতমালা এবং তাতে রেখেছেন বরকত এবং চার দিনের মধ্যে এতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের, সমভাবে (এতে উত্তর) রয়েছে জিজ্ঞাসুদের জন্য। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধুম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেনঃ তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বললোঃ আমরা এলাম অনুগত হয়ে। অতঃপর তিনি তাকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার বিধান ব্যক্ত করলেন এবং আমি দুনিয়ার আকাশকে বাতিসমূহ দিয়ে সুশোভিত ও সুরক্ষিত করলাম । এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।”(সূরা হা-মীম- সিজদাহ ৪১:৯-১২)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার হাত ধরেন অতঃপর বললেন: আল্লাহ তা‘আলা শনিবার মাটি সৃষ্টি করেছেন, পাহাড় সষ্টি করেছেন রবিবার এবং বৃক্ষরাজী সৃষ্টি করেছেন সোমবার এবং অপছন্দনীয় জিনিসগুলো সৃষ্টি করেছেন মঙ্গলবার, আলো সৃষ্টি করেছেন বুধবার, বৃহস্পতিবার জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং শুক্রবার আসরের পর রাতের পূর্বে শেষ সময়ে তিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৪৯-৫০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. হারাম হওয়ার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত জাগতিক সকল বস্তু হালাল।
২. সকল সৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়ত্বে।
এখানে “لَكُمْ” ‘তোমাদের জন্য’এর দ্বারা পৃথিবীর সকল বস্তু মানুষের উপকার ও উপভোগের জন্য সৃষ্টি করা বুঝানো হয়েছে। এ আয়াত প্রমাণ করে সকল বস্তুর মূল অবস্থা বা বিধান হল হালাল বা বৈধ। কেননা তা অনুগ্রহের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা হারাম বস্তুগুলো বের হয়ে গেছে। এখানে আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারার্থে। অতএব যার ভিতরে ক্ষতি ও অপকার রয়েছে তা এর বাইরে।
(ثُمَّ اسْتَوٰٓى إِلَي السَّمَآءِ)
“অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেন” ইসতিওয়া শব্দটি কুরআনুল কারীমে তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:
১. ইসতিওয়া শব্দটি যখন কোন অব্যয়-এর সাথে ব্যবহার হবে না তখন এর অর্থ হবে পরিপূর্ণতা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন; (وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّه۫ وَاسْتَوٰي)
“যখন মূসা পূর্ণ যৌবনে উপনীত ও পরিণত বয়স্ক হল।”(সূরা কাসাস ২৮:১৮)
২. ইসতিওয়া শব্দটি যখন “علي”অব্যয়-এর সাথে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হবে ওপরে ওঠা, সমুন্নত হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الرَّحْمٰنُ عَلَي الْعَرْشِ اسْتَوٰي)
“দয়াময় (আল্লাহ) আরশের ওপর সমুন্নত।”(ত্বহা ২০:৫)
৩. যখন ইসতিওয়া শব্দটি “إلي” অব্যয়ের সাথে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হবে ইচ্ছা করা। যেমন এ আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তারপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন। (তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২৫)
(وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ)
‘আর তিনি সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী।’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান সকল সৃষ্টি বস্তুকে বেষ্টন করে আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيْفُ الْخَبِيْرُ)
“যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, ভালোভাবে অবগত।”
আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতের বিস্তারিত বর্ণনা সূরা হা-মীম সিজদায় দিয়েছেন: “বল: তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক। তিনি ভূ-পৃষ্ঠে স্থাপন করেছেন (অটল) পর্বতমালা এবং তাতে রেখেছেন বরকত এবং চার দিনের মধ্যে এতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের, সমভাবে (এতে উত্তর) রয়েছে জিজ্ঞাসুদের জন্য। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধুম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেনঃ তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বললোঃ আমরা এলাম অনুগত হয়ে। অতঃপর তিনি তাকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার বিধান ব্যক্ত করলেন এবং আমি দুনিয়ার আকাশকে বাতিসমূহ দিয়ে সুশোভিত ও সুরক্ষিত করলাম । এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।”(সূরা হা-মীম- সিজদাহ ৪১:৯-১২)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার হাত ধরেন অতঃপর বললেন: আল্লাহ তা‘আলা শনিবার মাটি সৃষ্টি করেছেন, পাহাড় সষ্টি করেছেন রবিবার এবং বৃক্ষরাজী সৃষ্টি করেছেন সোমবার এবং অপছন্দনীয় জিনিসগুলো সৃষ্টি করেছেন মঙ্গলবার, আলো সৃষ্টি করেছেন বুধবার, বৃহস্পতিবার জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং শুক্রবার আসরের পর রাতের পূর্বে শেষ সময়ে তিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৪৯-৫০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:১. হারাম হওয়ার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত জাগতিক সকল বস্তু হালাল।
২. সকল সৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়ত্বে।
2:30
وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡہَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡہَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۰﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
এখান থেকে মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি ও তাঁর মর্যাদার আলোচনা সূচনা করা হয়েছে-خليفة (খলীফাহ) শব্দটি خلف থেকে গৃহীত। অর্থ: একজনের পর অপরজন আসা, একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(هُوَ الَّذِيْ جَعَلَكُمْ خَلَا۬ئِفَ فِي الْأَرْضِ)
“তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছেন।”(সূরা ফাতির ৩৫:৩৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَخَلَفَ مِنْۭ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ)
“অতঃপর একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে উত্তরাধিকারী হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৬৯, ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর )
মুফাসসিরগণ خليفة (খলীফাহ) শব্দের দু’টি ব্যখ্যা দিয়েছেন:
১. খলীফা দ্বারা উদ্দেশ্য আদম (আঃ)। কেননা তিনি পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়নে তাঁর খলীফা। আবার বলা হয় পূর্বে যে সকল জিন জমিনে বসবাস করত তিনি তাদের খলীফা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে খলীফা দ্বারা আদম (আঃ) উদ্দেশ্য।
২. خليفة (খলীফাহ) শব্দটি একবচন হলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল বহুবচন অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতি। এ মতটি ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) প্রাধান্য দিয়েছেন।
যদিও খলীফা শব্দটি উভয় তাফসীরের সম্ভাবনা রাখে, কিন্তু কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বিতীয় তাফসীরের মতকে সমর্থন করে। অর্থাৎ খলীফা দ্বারা উদ্দেশ্য আদম ও তাঁর বংশধর, শুধু আদম (আঃ) নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُّفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَا۬ءَ)
আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে, তারা সেখানে বিবাদ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে?
এটা জানা কথা যে, আদম (আঃ) ফাসাদকারী নন এবং রক্তপাতকারীও নন। যেমন পূর্বের আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়। (আযওয়াউল বায়ান, ১ম খণ্ড, পৃ: ৭০)
আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতাদের কাছে খলীফা সৃষ্টির কথা বললেন তখন ফেরেশতাগণ বলল-
আপনি এমন ব্যক্তিদের সৃষ্টি করবেন যারা ফাসাদ সৃষ্টি করবে, রক্তপাত ঘটাবে?
তাদের এ প্রশ্নের অর্থ এটা নয় যে, তারা গায়েব জানে। বরং তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, তাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হবে। এজন্য তারা ঐ মন্তব্য করেছিল।
অথবা খলীফা শব্দের অর্থ জেনেই তারা এটা বুঝেছিল যে, মানুষ হবে ন্যায়-অন্যায়ের ফায়সালাকারী, অনাচার প্রতিহতকারী, অবৈধ ও পাপ কাজের বাধাদানকারী; ফলে তাদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি হবে এবং রক্তপাত ঘটবে।
অথবা পূর্বে যারা পৃথিবীতে বসবাস করেছিল তাদের ক্রিয়াকলাপ দেখেই তারা মানুষের ব্যাপারেও এ মন্তব্য করেছিল।
উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাদের এ আরয প্রতিবাদমূলক ছিল না এবং আদম (আঃ)-এর প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে বলেছিল তাও নয়। কারণ ফেরেশতাগণ এরূপ চরিত্র থেকে পবিত্র।
ফেরেশতাদের আনুগত্য সম্পর্কে কুরআনে এসেছে-
(لَّا يَعْصُوْنَ اللّٰهَ مَآ أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ)
“তারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হন তাই করেন।”(সূরা আত-তাহরীম ৬৬:৬)
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাদের সামনে বিষয়টি উত্থাপনের উদ্দেশ্য হল, শুধু এর হিকমত জানাবার ও এর রহস্য প্রকাশ করার, যা ছিল তাদের বোধশক্তির ঊর্ধ্বে।
আল্লাহ তা‘আলা তো ভালভাবেই জানেন যে, এরা বিবাদ ও ঝগড়াটে হবে, কাজেই তারা আল্লাহ তা‘আলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, খলীফাসৃষ্টি করার পিছনে আপনার হিকমাত কী? যদি ইবাদত-ই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তবে আমরা তো আপনার ইবাদত করছি, আপনার প্রশংসা ও তাসবীহ পাঠে সর্বদা রত রয়েছি এবং আমরা ঝগড়া-বিবাদ হতেও পূতপবিত্র, তারপরও আল্লাহ তা‘আলার খলীফা সৃষ্টি করার পেছনে কী হিকমত রয়েছে?
আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন: আমি যা জানি তোমরা তা জান না। অর্থাৎ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই আমি জানি যা তোমরা জানো না। আমি জানি তাদের মধ্যে নাবী-রাসূল, সত্যবাদী, শহীদ, সৎ বান্দা ইত্যাদি হবে। তারা এমন ইবাদত করবে যা তারা ছাড়া অন্যরা করবে না। যেমন জিহাদ ও অন্যান্য ইবাদত। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের নিকট দিনের ফেরেশতা ও রাতের ফেরেশতা পালাক্রমে আগমন করে। অতঃপর তারা উভয় দল ফজর ও আসরের সময় একত্রিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা (দিনের) ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন্ অবস্থায় রেখে এসেছ? তারা বলে, আমরা যখন তাদের নিকট আগমন করেছি তখন তাদেরকে পেয়েছি সালাতরত অবস্থায় এবং আমরা যখন তাদেরকে রেখে এসেছি তখনও তাদেরকে পেয়েছি সালাতরত অবস্থায়। (সহীহ বুখারী হা: ৬৯৯২, ৭০৪৮)
আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে একমুষ্ঠি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যে মাটি তিনি সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ হতে নিয়েছিলেন। তাই আদম সন্তানও মাটির বিভিন্ন বর্ণ ও প্রকৃতি অনুসারে হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ লাল, কেউ সাদা, কেউ কালো এবং কেউ এ সকলের মধ্যবর্তী বর্ণের হয়ে থাকে। অনুরূপ কেউ কোমল, কেউ কঠোর এবং কেউ সৎ ও কেউ অসৎ প্রকৃতির হয়ে থাকে। (তিরমিযী, সিলসিলাতুস সহীহাহ হা: ১৬৩০)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন: এ আয়াতটি খলীফা বা ইমাম নিযুক্ত করার মূল দলীল। রাষ্ট্রের সকল মানুষ নিযুক্ত খলীফা বা ইমামের আনুগত্যশীল থাকবে, যাতে ইমামের মাধ্যমে সকলে ঐক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং ইমাম শরয়ী বিধান কায়িম করতে পারেন। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।ইসলামী নেতা বা খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতিসমূহঃ
১. পূর্ববর্তী ইমাম বা খলীফার ঘোষণার মাধ্যমে যেমন: অমুক পরবর্তী ইমাম হবে। তাহলে এ কথা দ্বারাই সে ব্যক্তি ইমাম নিযুক্ত হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে ওমার (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন।
২. কোন ব্যক্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রের বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের একমত হওয়া যে, তিনি আমাদের ইমামের উপযুক্ত, আমরা তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করব। কতক আলেম বলেন: আবূ বকর (রাঃ) এ পদ্ধতিতে ইমাম হয়েছেন। আনসার ও মুহাজির সকলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর ইমামতের ব্যাপারে একমত ছিলেন, যদিও প্রথম দিকে মতানৈক্য হয়েছিল।
৩. অনুরূপ খলীফা কয়েক সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে যাবেন, তারা নিজেদের মধ্যে বা বাইরে থেকে যাকে উপযুক্ত মনে করবেন সে খলীফা বলে বিবেচিত হবেন।
৪. জালিম শাসক থেকে জোর করে খেলাফতের দায়িত্ব কেড়ে নেয়া। যোগ্য ইমাম বা নেতার জন্য অনেক শর্ত রয়েছে, বিস্তারিত তাফসীর গ্রন্থগুলোতে রয়েছে। (তাফসীর কুরতুবী ১/২২৩-২২৮)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে তাঁর আকৃতিতেই সৃষ্টি করে বললেন, যাও ফেরেশতাদের ঐ দলটিকে সালাম কর। আর তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয় তা শ্রবণ কর। এটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম। তখন তিনি গিয়ে বললেন, السلام عليكم তারা উত্তরে বলল, السلام عليك ورحمة اللّٰه
তারা ورحمة اللّٰه অংশটি বেশি বলল। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা আদমের আকৃতিতে জান্নাতে যাবে এবং তার উচ্চতা হবে ষাট হাত। তখন হতে ক্রমান্বয়ে আদম সন্তানের উচ্চতা কমে আসছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩২৬, মুসলিম হা: ৭৩৪২, মিশকাত হা: ৪৪২৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
এখান থেকে মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি ও তাঁর মর্যাদার আলোচনা সূচনা করা হয়েছে-خليفة (খলীফাহ) শব্দটি خلف থেকে গৃহীত। অর্থ: একজনের পর অপরজন আসা, একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(هُوَ الَّذِيْ جَعَلَكُمْ خَلَا۬ئِفَ فِي الْأَرْضِ)
“তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছেন।”(সূরা ফাতির ৩৫:৩৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَخَلَفَ مِنْۭ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ)
“অতঃপর একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে উত্তরাধিকারী হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৬৯, ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর )
মুফাসসিরগণ خليفة (খলীফাহ) শব্দের দু’টি ব্যখ্যা দিয়েছেন:
১. খলীফা দ্বারা উদ্দেশ্য আদম (আঃ)। কেননা তিনি পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়নে তাঁর খলীফা। আবার বলা হয় পূর্বে যে সকল জিন জমিনে বসবাস করত তিনি তাদের খলীফা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে খলীফা দ্বারা আদম (আঃ) উদ্দেশ্য।
২. خليفة (খলীফাহ) শব্দটি একবচন হলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল বহুবচন অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতি। এ মতটি ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) প্রাধান্য দিয়েছেন।
যদিও খলীফা শব্দটি উভয় তাফসীরের সম্ভাবনা রাখে, কিন্তু কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বিতীয় তাফসীরের মতকে সমর্থন করে। অর্থাৎ খলীফা দ্বারা উদ্দেশ্য আদম ও তাঁর বংশধর, শুধু আদম (আঃ) নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُّفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَا۬ءَ)
আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে, তারা সেখানে বিবাদ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে?
এটা জানা কথা যে, আদম (আঃ) ফাসাদকারী নন এবং রক্তপাতকারীও নন। যেমন পূর্বের আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়। (আযওয়াউল বায়ান, ১ম খণ্ড, পৃ: ৭০)
আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতাদের কাছে খলীফা সৃষ্টির কথা বললেন তখন ফেরেশতাগণ বলল-
আপনি এমন ব্যক্তিদের সৃষ্টি করবেন যারা ফাসাদ সৃষ্টি করবে, রক্তপাত ঘটাবে?
তাদের এ প্রশ্নের অর্থ এটা নয় যে, তারা গায়েব জানে। বরং তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, তাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হবে। এজন্য তারা ঐ মন্তব্য করেছিল।
অথবা খলীফা শব্দের অর্থ জেনেই তারা এটা বুঝেছিল যে, মানুষ হবে ন্যায়-অন্যায়ের ফায়সালাকারী, অনাচার প্রতিহতকারী, অবৈধ ও পাপ কাজের বাধাদানকারী; ফলে তাদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি হবে এবং রক্তপাত ঘটবে।
অথবা পূর্বে যারা পৃথিবীতে বসবাস করেছিল তাদের ক্রিয়াকলাপ দেখেই তারা মানুষের ব্যাপারেও এ মন্তব্য করেছিল।
উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাদের এ আরয প্রতিবাদমূলক ছিল না এবং আদম (আঃ)-এর প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে বলেছিল তাও নয়। কারণ ফেরেশতাগণ এরূপ চরিত্র থেকে পবিত্র।
ফেরেশতাদের আনুগত্য সম্পর্কে কুরআনে এসেছে-
(لَّا يَعْصُوْنَ اللّٰهَ مَآ أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ)
“তারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হন তাই করেন।”(সূরা আত-তাহরীম ৬৬:৬)
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাদের সামনে বিষয়টি উত্থাপনের উদ্দেশ্য হল, শুধু এর হিকমত জানাবার ও এর রহস্য প্রকাশ করার, যা ছিল তাদের বোধশক্তির ঊর্ধ্বে।
আল্লাহ তা‘আলা তো ভালভাবেই জানেন যে, এরা বিবাদ ও ঝগড়াটে হবে, কাজেই তারা আল্লাহ তা‘আলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, খলীফাসৃষ্টি করার পিছনে আপনার হিকমাত কী? যদি ইবাদত-ই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তবে আমরা তো আপনার ইবাদত করছি, আপনার প্রশংসা ও তাসবীহ পাঠে সর্বদা রত রয়েছি এবং আমরা ঝগড়া-বিবাদ হতেও পূতপবিত্র, তারপরও আল্লাহ তা‘আলার খলীফা সৃষ্টি করার পেছনে কী হিকমত রয়েছে?
আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন: আমি যা জানি তোমরা তা জান না। অর্থাৎ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই আমি জানি যা তোমরা জানো না। আমি জানি তাদের মধ্যে নাবী-রাসূল, সত্যবাদী, শহীদ, সৎ বান্দা ইত্যাদি হবে। তারা এমন ইবাদত করবে যা তারা ছাড়া অন্যরা করবে না। যেমন জিহাদ ও অন্যান্য ইবাদত। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের নিকট দিনের ফেরেশতা ও রাতের ফেরেশতা পালাক্রমে আগমন করে। অতঃপর তারা উভয় দল ফজর ও আসরের সময় একত্রিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা (দিনের) ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন্ অবস্থায় রেখে এসেছ? তারা বলে, আমরা যখন তাদের নিকট আগমন করেছি তখন তাদেরকে পেয়েছি সালাতরত অবস্থায় এবং আমরা যখন তাদেরকে রেখে এসেছি তখনও তাদেরকে পেয়েছি সালাতরত অবস্থায়। (সহীহ বুখারী হা: ৬৯৯২, ৭০৪৮)
আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে একমুষ্ঠি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যে মাটি তিনি সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ হতে নিয়েছিলেন। তাই আদম সন্তানও মাটির বিভিন্ন বর্ণ ও প্রকৃতি অনুসারে হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ লাল, কেউ সাদা, কেউ কালো এবং কেউ এ সকলের মধ্যবর্তী বর্ণের হয়ে থাকে। অনুরূপ কেউ কোমল, কেউ কঠোর এবং কেউ সৎ ও কেউ অসৎ প্রকৃতির হয়ে থাকে। (তিরমিযী, সিলসিলাতুস সহীহাহ হা: ১৬৩০)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন: এ আয়াতটি খলীফা বা ইমাম নিযুক্ত করার মূল দলীল। রাষ্ট্রের সকল মানুষ নিযুক্ত খলীফা বা ইমামের আনুগত্যশীল থাকবে, যাতে ইমামের মাধ্যমে সকলে ঐক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং ইমাম শরয়ী বিধান কায়িম করতে পারেন। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।ইসলামী নেতা বা খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতিসমূহঃ
১. পূর্ববর্তী ইমাম বা খলীফার ঘোষণার মাধ্যমে যেমন: অমুক পরবর্তী ইমাম হবে। তাহলে এ কথা দ্বারাই সে ব্যক্তি ইমাম নিযুক্ত হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে ওমার (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন।
২. কোন ব্যক্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রের বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের একমত হওয়া যে, তিনি আমাদের ইমামের উপযুক্ত, আমরা তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করব। কতক আলেম বলেন: আবূ বকর (রাঃ) এ পদ্ধতিতে ইমাম হয়েছেন। আনসার ও মুহাজির সকলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর ইমামতের ব্যাপারে একমত ছিলেন, যদিও প্রথম দিকে মতানৈক্য হয়েছিল।
৩. অনুরূপ খলীফা কয়েক সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে যাবেন, তারা নিজেদের মধ্যে বা বাইরে থেকে যাকে উপযুক্ত মনে করবেন সে খলীফা বলে বিবেচিত হবেন।
৪. জালিম শাসক থেকে জোর করে খেলাফতের দায়িত্ব কেড়ে নেয়া। যোগ্য ইমাম বা নেতার জন্য অনেক শর্ত রয়েছে, বিস্তারিত তাফসীর গ্রন্থগুলোতে রয়েছে। (তাফসীর কুরতুবী ১/২২৩-২২৮)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে তাঁর আকৃতিতেই সৃষ্টি করে বললেন, যাও ফেরেশতাদের ঐ দলটিকে সালাম কর। আর তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয় তা শ্রবণ কর। এটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম। তখন তিনি গিয়ে বললেন, السلام عليكم তারা উত্তরে বলল, السلام عليك ورحمة اللّٰه
তারা ورحمة اللّٰه অংশটি বেশি বলল। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা আদমের আকৃতিতে জান্নাতে যাবে এবং তার উচ্চতা হবে ষাট হাত। তখন হতে ক্রমান্বয়ে আদম সন্তানের উচ্চতা কমে আসছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩২৬, মুসলিম হা: ৭৩৪২, মিশকাত হা: ৪৪২৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)-এর সূচনা ও সৃষ্টি রহস্য জানলাম।
২. ফেরেশতারাও গায়েব জানেনা, গায়েব জানা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার বৈশিষ্ট্য।
৩. ফেরশতাদের বৈশিষ্ট্য জানলাম। তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়না, যা নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে।
৪. মানুষ বিভিন্ন প্রকৃতি ও স্বভাবের হওয়ার কারণ অবগত হলাম।
৫. খলীফা নিযুক্তির হিকমত ও পদ্ধতি জানতে পারলাম।
২. ফেরেশতারাও গায়েব জানেনা, গায়েব জানা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার বৈশিষ্ট্য।
৩. ফেরশতাদের বৈশিষ্ট্য জানলাম। তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়না, যা নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে।
৪. মানুষ বিভিন্ন প্রকৃতি ও স্বভাবের হওয়ার কারণ অবগত হলাম।
৫. খলীফা নিযুক্তির হিকমত ও পদ্ধতি জানতে পারলাম।
2:31
وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّہَا ثُمَّ عَرَضَہُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ ہٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۳۱﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩১-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এখানে তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন যা অন্যদেরকে শিক্ষা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে কোন্ কোন্ বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতা ও তার বংশধরদের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেননা এর পরবর্তী যে শব্দ عَرَضَهُمْ ‘উপস্থাপন করলেন’এসেছে তা বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: বরং সঠিক কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এরূপই বলেছেন। ‘সবকিছুর নাম’বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ছোট-বড় যত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, হবে সকল সৃষ্টবস্তুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ও আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ একত্রিত হবে এবং তারা বলবে, আমরা যদি আমাদের রবের কাছে আমাদের জন্য একজন সুপারিশকারী পেতাম। এরপর তারা আদম (আঃ)-এর কাছে আসবে এবং তাঁকে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আপনাকে সেজদাহ করিয়েছেন এবং যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। অতঃপর............হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৬, সহীহ মুসলিম হা: ৪৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে যে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সকল বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ পেশ করতে বললেন। তারা এগুলোর নাম বলতে পারে কিনা।
ফেরেশতারা জবাবে বলেছিল:
(سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا)
“আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া কোন জ্ঞানই আমাদের নেই।”الْحَکِیْمُ ‘হাকীম’বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে সে নামসমূহ (যা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি) জানিয়ে দাও।
যায়েদ ইবনু আসলাম বলেন: আদম (আঃ) সবার নাম এভাবে বললেন, আপনার নাম জিবরীল, আপনার নাম মিকাঈল, আপনার নাম ইসরাফিল এভাবে সকলের নাম তিনি বলে দিলেন। এমনকি কাকের নামও বলে দিলেন।
মুজাহিদ বলেন: আদম (আঃ) কবুতর, কাকসহ সকল কিছুর নাম যথাযথভাবে বলে দিলেন। তারপর যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ পেল তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গায়েবের খবর জানি এবং তোমরা যা গোপন কর তাও জানি। অত্র আয়াতে ফেরেশতারা যা গোপন করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা বর্ণনা করেননি।
কেউ কেউ বলেন: তা হল ইবলিস যে হিংসা গোপন করেছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেন:
(إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبٰي وَاسْتَكْبَرَ)
“ইবলীস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল।”
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এখানে তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন যা অন্যদেরকে শিক্ষা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে কোন্ কোন্ বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতা ও তার বংশধরদের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেননা এর পরবর্তী যে শব্দ عَرَضَهُمْ ‘উপস্থাপন করলেন’এসেছে তা বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: বরং সঠিক কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এরূপই বলেছেন। ‘সবকিছুর নাম’বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ছোট-বড় যত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, হবে সকল সৃষ্টবস্তুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ও আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ একত্রিত হবে এবং তারা বলবে, আমরা যদি আমাদের রবের কাছে আমাদের জন্য একজন সুপারিশকারী পেতাম। এরপর তারা আদম (আঃ)-এর কাছে আসবে এবং তাঁকে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আপনাকে সেজদাহ করিয়েছেন এবং যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। অতঃপর............হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৬, সহীহ মুসলিম হা: ৪৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে যে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সকল বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ পেশ করতে বললেন। তারা এগুলোর নাম বলতে পারে কিনা।
ফেরেশতারা জবাবে বলেছিল:
(سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا)
“আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া কোন জ্ঞানই আমাদের নেই।”الْحَکِیْمُ ‘হাকীম’বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে সে নামসমূহ (যা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি) জানিয়ে দাও।
যায়েদ ইবনু আসলাম বলেন: আদম (আঃ) সবার নাম এভাবে বললেন, আপনার নাম জিবরীল, আপনার নাম মিকাঈল, আপনার নাম ইসরাফিল এভাবে সকলের নাম তিনি বলে দিলেন। এমনকি কাকের নামও বলে দিলেন।
মুজাহিদ বলেন: আদম (আঃ) কবুতর, কাকসহ সকল কিছুর নাম যথাযথভাবে বলে দিলেন। তারপর যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ পেল তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গায়েবের খবর জানি এবং তোমরা যা গোপন কর তাও জানি। অত্র আয়াতে ফেরেশতারা যা গোপন করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা বর্ণনা করেননি।
কেউ কেউ বলেন: তা হল ইবলিস যে হিংসা গোপন করেছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেন:
(إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبٰي وَاسْتَكْبَرَ)
“ইবলীস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল।”
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আদম (আঃ)-কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার হিকমত জানলাম।
২. অজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
৩. কোন কিছু অজানা থাকলে তা স্বীকার করলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না।
৪. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি আমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন।
৫. যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু দাবি করে যার সে অধিকারী নয় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে।
২. অজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
৩. কোন কিছু অজানা থাকলে তা স্বীকার করলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না।
৪. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি আমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন।
৫. যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু দাবি করে যার সে অধিকারী নয় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে।
2:32
قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳۲﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩১-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এখানে তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন যা অন্যদেরকে শিক্ষা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে কোন্ কোন্ বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতা ও তার বংশধরদের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেননা এর পরবর্তী যে শব্দ عَرَضَهُمْ ‘উপস্থাপন করলেন’এসেছে তা বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: বরং সঠিক কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এরূপই বলেছেন। ‘সবকিছুর নাম’বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ছোট-বড় যত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, হবে সকল সৃষ্টবস্তুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ও আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ একত্রিত হবে এবং তারা বলবে, আমরা যদি আমাদের রবের কাছে আমাদের জন্য একজন সুপারিশকারী পেতাম। এরপর তারা আদম (আঃ)-এর কাছে আসবে এবং তাঁকে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আপনাকে সেজদাহ করিয়েছেন এবং যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। অতঃপর............হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৬, সহীহ মুসলিম হা: ৪৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে যে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সকল বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ পেশ করতে বললেন। তারা এগুলোর নাম বলতে পারে কিনা।
ফেরেশতারা জবাবে বলেছিল:
(سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا)
“আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া কোন জ্ঞানই আমাদের নেই।”الْحَکِیْمُ ‘হাকীম’বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে সে নামসমূহ (যা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি) জানিয়ে দাও।
যায়েদ ইবনু আসলাম বলেন: আদম (আঃ) সবার নাম এভাবে বললেন, আপনার নাম জিবরীল, আপনার নাম মিকাঈল, আপনার নাম ইসরাফিল এভাবে সকলের নাম তিনি বলে দিলেন। এমনকি কাকের নামও বলে দিলেন।
মুজাহিদ বলেন: আদম (আঃ) কবুতর, কাকসহ সকল কিছুর নাম যথাযথভাবে বলে দিলেন। তারপর যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ পেল তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গায়েবের খবর জানি এবং তোমরা যা গোপন কর তাও জানি। অত্র আয়াতে ফেরেশতারা যা গোপন করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা বর্ণনা করেননি।
কেউ কেউ বলেন: তা হল ইবলিস যে হিংসা গোপন করেছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেন:
(إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبٰي وَاسْتَكْبَرَ)
“ইবলীস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল।”
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এখানে তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন যা অন্যদেরকে শিক্ষা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে কোন্ কোন্ বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতা ও তার বংশধরদের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেননা এর পরবর্তী যে শব্দ عَرَضَهُمْ ‘উপস্থাপন করলেন’এসেছে তা বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: বরং সঠিক কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এরূপই বলেছেন। ‘সবকিছুর নাম’বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ছোট-বড় যত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, হবে সকল সৃষ্টবস্তুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ও আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ একত্রিত হবে এবং তারা বলবে, আমরা যদি আমাদের রবের কাছে আমাদের জন্য একজন সুপারিশকারী পেতাম। এরপর তারা আদম (আঃ)-এর কাছে আসবে এবং তাঁকে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আপনাকে সেজদাহ করিয়েছেন এবং যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। অতঃপর............হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৬, সহীহ মুসলিম হা: ৪৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে যে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সকল বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ পেশ করতে বললেন। তারা এগুলোর নাম বলতে পারে কিনা।
ফেরেশতারা জবাবে বলেছিল:
(سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا)
“আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া কোন জ্ঞানই আমাদের নেই।”الْحَکِیْمُ ‘হাকীম’বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে সে নামসমূহ (যা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি) জানিয়ে দাও।
যায়েদ ইবনু আসলাম বলেন: আদম (আঃ) সবার নাম এভাবে বললেন, আপনার নাম জিবরীল, আপনার নাম মিকাঈল, আপনার নাম ইসরাফিল এভাবে সকলের নাম তিনি বলে দিলেন। এমনকি কাকের নামও বলে দিলেন।
মুজাহিদ বলেন: আদম (আঃ) কবুতর, কাকসহ সকল কিছুর নাম যথাযথভাবে বলে দিলেন। তারপর যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ পেল তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গায়েবের খবর জানি এবং তোমরা যা গোপন কর তাও জানি। অত্র আয়াতে ফেরেশতারা যা গোপন করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা বর্ণনা করেননি।
কেউ কেউ বলেন: তা হল ইবলিস যে হিংসা গোপন করেছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেন:
(إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبٰي وَاسْتَكْبَرَ)
“ইবলীস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল।”
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আদম (আঃ)-কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার হিকমত জানলাম।
২. অজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
৩. কোন কিছু অজানা থাকলে তা স্বীকার করলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না।
৪. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি আমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন।
৫. যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু দাবি করে যার সে অধিকারী নয় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে।
২. অজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
৩. কোন কিছু অজানা থাকলে তা স্বীকার করলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না।
৪. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি আমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন।
৫. যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু দাবি করে যার সে অধিকারী নয় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে।
2:33
قَالَ یٰۤاٰدَمُ اَنۡۢبِئۡہُمۡ بِاَسۡمَآئِہِمۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَنۡۢبَاَہُمۡ بِاَسۡمَآئِہِمۡ ۙ قَالَ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ وَ اَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا کُنۡتُمۡ تَکۡتُمُوۡنَ ﴿۳۳﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩১-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এখানে তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন যা অন্যদেরকে শিক্ষা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে কোন্ কোন্ বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতা ও তার বংশধরদের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেননা এর পরবর্তী যে শব্দ عَرَضَهُمْ ‘উপস্থাপন করলেন’এসেছে তা বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: বরং সঠিক কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এরূপই বলেছেন। ‘সবকিছুর নাম’বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ছোট-বড় যত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, হবে সকল সৃষ্টবস্তুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ও আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ একত্রিত হবে এবং তারা বলবে, আমরা যদি আমাদের রবের কাছে আমাদের জন্য একজন সুপারিশকারী পেতাম। এরপর তারা আদম (আঃ)-এর কাছে আসবে এবং তাঁকে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আপনাকে সেজদাহ করিয়েছেন এবং যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। অতঃপর............হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৬, সহীহ মুসলিম হা: ৪৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে যে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সকল বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ পেশ করতে বললেন। তারা এগুলোর নাম বলতে পারে কিনা।
ফেরেশতারা জবাবে বলেছিল:
(سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا)
“আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া কোন জ্ঞানই আমাদের নেই।”الْحَکِیْمُ ‘হাকীম’বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে সে নামসমূহ (যা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি) জানিয়ে দাও।
যায়েদ ইবনু আসলাম বলেন: আদম (আঃ) সবার নাম এভাবে বললেন, আপনার নাম জিবরীল, আপনার নাম মিকাঈল, আপনার নাম ইসরাফিল এভাবে সকলের নাম তিনি বলে দিলেন। এমনকি কাকের নামও বলে দিলেন।
মুজাহিদ বলেন: আদম (আঃ) কবুতর, কাকসহ সকল কিছুর নাম যথাযথভাবে বলে দিলেন। তারপর যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ পেল তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গায়েবের খবর জানি এবং তোমরা যা গোপন কর তাও জানি। অত্র আয়াতে ফেরেশতারা যা গোপন করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা বর্ণনা করেননি।
কেউ কেউ বলেন: তা হল ইবলিস যে হিংসা গোপন করেছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেন:
(إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبٰي وَاسْتَكْبَرَ)
“ইবলীস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল।”
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এখানে তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন যা অন্যদেরকে শিক্ষা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে কোন্ কোন্ বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে ফেরেশতা ও তার বংশধরদের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেননা এর পরবর্তী যে শব্দ عَرَضَهُمْ ‘উপস্থাপন করলেন’এসেছে তা বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: বরং সঠিক কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এরূপই বলেছেন। ‘সবকিছুর নাম’বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ছোট-বড় যত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, হবে সকল সৃষ্টবস্তুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ও আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ একত্রিত হবে এবং তারা বলবে, আমরা যদি আমাদের রবের কাছে আমাদের জন্য একজন সুপারিশকারী পেতাম। এরপর তারা আদম (আঃ)-এর কাছে আসবে এবং তাঁকে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আপনাকে সেজদাহ করিয়েছেন এবং যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। অতঃপর............হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৬, সহীহ মুসলিম হা: ৪৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে যে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সকল বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ পেশ করতে বললেন। তারা এগুলোর নাম বলতে পারে কিনা।
ফেরেশতারা জবাবে বলেছিল:
(سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا)
“আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া কোন জ্ঞানই আমাদের নেই।”الْحَکِیْمُ ‘হাকীম’বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে সে নামসমূহ (যা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি) জানিয়ে দাও।
যায়েদ ইবনু আসলাম বলেন: আদম (আঃ) সবার নাম এভাবে বললেন, আপনার নাম জিবরীল, আপনার নাম মিকাঈল, আপনার নাম ইসরাফিল এভাবে সকলের নাম তিনি বলে দিলেন। এমনকি কাকের নামও বলে দিলেন।
মুজাহিদ বলেন: আদম (আঃ) কবুতর, কাকসহ সকল কিছুর নাম যথাযথভাবে বলে দিলেন। তারপর যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ পেল তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গায়েবের খবর জানি এবং তোমরা যা গোপন কর তাও জানি। অত্র আয়াতে ফেরেশতারা যা গোপন করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা বর্ণনা করেননি।
কেউ কেউ বলেন: তা হল ইবলিস যে হিংসা গোপন করেছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেন:
(إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبٰي وَاسْتَكْبَرَ)
“ইবলীস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল।”
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আদম (আঃ)-কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার হিকমত জানলাম।
২. অজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
৩. কোন কিছু অজানা থাকলে তা স্বীকার করলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না।
৪. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি আমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন।
৫. যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু দাবি করে যার সে অধিকারী নয় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে।
২. অজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
৩. কোন কিছু অজানা থাকলে তা স্বীকার করলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না।
৪. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি আমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন।
৫. যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু দাবি করে যার সে অধিকারী নয় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে।
2:34
وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اَبٰی وَ اسۡتَکۡبَرَ ٭۫ وَ کَانَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۳۴﴾
FATHUL MAJID
আলিফ, লা-ম, মী-ম।
FATHUL MAJID
৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের আদম (আঃ)-কে যে সিজদাহ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিল আদম (আঃ)-এর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ এবং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতস্বরূপ। সকলেই সিজদাহ করল ইবলিস ব্যতীত। সে অমান্য করল এবং অহঙ্কার করল। (তাফসীর সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবলিসের অমান্য ও অহঙ্কারের কারণ অন্যত্র উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسْجُدَ اِذْ اَمَرْتُکَﺚ قَالَ اَنَا خَیْرٌ مِّنْھُﺆ خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّخَلَقْتَھ۫ مِنْ طِیْنٍ)
“তিনি বললেন, ‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কী তোমাকে তা থেকে বিরত রাখল যে, তুমি সিজদাহ করবে না?’সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম; তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছ এবং তাকে কর্দম দ্বারা সৃষ্টি করেছ।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১২)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার কোন নির্দেশকে অমান্য করা শয়তানের কাজ ও অহঙ্কারের বহিঃপ্রকাশ। এমনকি কেউ তাচ্ছিল্য ও অহঙ্কার করে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে অমান্য করলে মু’মিন থাকবে না। তাই একজন মু’মিন যখন জানতে পারবে এটা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের নির্দেশ তখন সে তা মাথা পেতে মেনে নেবে, চাই সেটা তার যুক্তি ও ইচ্ছানুযায়ী হোক আর না হোক। বরং যুক্তি দাঁড় করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ বর্জন করা ইবলিসের অনসুরণ এবং জাহান্নামে যাওয়ার কাজ।
ফেরেশতা কর্তৃক আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করার ব্যাপারে মুফাসসিরদের বক্তব্য:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ফেরেশতাগণ আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করেছিল আর এটা ছিল মূলত আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য (কারণ আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন)।
হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে যে সম্মান দান করেছেন সে প্রদত্ত সম্মান স্বরূপ সিজদাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটাই ছিল আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য। কাতাদাহ (রহঃ)ও এরূপ বলেছেন।
ইবরাহীম আল মুজানী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে কাবার ন্যায় করেছিলেন। অর্থাৎ আদমকে সামনে রেখে আল্লাহ তা‘আলাকেই সিজদাহ দেয়া।
কেউ কেউ বলেছেন: এ সিজদাহটি ছিল সালাম ও সম্মানস্বরূপ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَرَفَعَ اَبَوَیْھِ عَلَی الْعَرْشِ وَخَرُّوْا لَھ۫ سُجَّدًاﺆ وَقَالَ یٰٓاَبَتِ ھٰذَا تَاْوِیْلُ رُءْیَایَ مِنْ قَبْلُﺑ قَدْ جَعَلَھَا رَبِّیْ حَقًّا)
“এবং ইউসুফ তার মাতা-পিতাকে উচ্চাসনে বসাল এবং তারা সকলে তার সম্মানে সিজ্দায় লুটিয়ে পড়ল। সে বলল, ‘হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার প্রতিপালক সেটা সত্যে পরিণত করেছেন।”(সূরা ইউসূফ ১২:১০০)
এরূপ সিজদাহ পূর্ববর্তী উম্মাতের মাঝে শরীয়তসম্মত ছিল, কিন্তু আমাদের শরীয়তে এটা নিষিদ্ধ। মু‘আয (রাঃ) বলেন: আমি সিরিয়াবাসীকে তাদের নেতৃবর্গ ও আলেমদের সামনে সিজদাহ করতে দেখেছিলাম। কাজেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল আপনি সিজদাহ পাবার বেশি হকদার। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:لَوْ كُنْتُ آمُرُ بَشَرًا أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ لأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لأَزْوَاجِهِنِّ
আমি যদি কোন মানুষের জন্য সিজদাহ করার নির্দেশ প্রদান করতাম, তাহলে স্ত্রীদেরকে নির্দেশ প্রদান করতাম যে, তারা যেন তাদের স্বামীদেরকে সিজদাহ করে। (মু‘জামুল কাবীর: ৩৭৩)
অতএব ইসলামী শরীয়তে কোন মানুষকে সিজদাহ দেয়ার বিধান নেই। সম্মানী সিজদাহ বা রূপক সিজদাহ সবই হারাম। অতএব কোন সম্রাট, পীর, বুজুর্গ ও আলেম মুর্শিদকেও সিজদাহ দেয়া হারাম ও শির্ক।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন আদমকে সিজদাহ দেয়ার জন্য তাঁর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ। এটাই হল নির্দেশের বাস্তবায়ন। অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতামত এরূপ। (তাফসীর ইবনে কাসীর,অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের আদম (আঃ)-কে যে সিজদাহ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিল আদম (আঃ)-এর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ এবং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতস্বরূপ। সকলেই সিজদাহ করল ইবলিস ব্যতীত। সে অমান্য করল এবং অহঙ্কার করল। (তাফসীর সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবলিসের অমান্য ও অহঙ্কারের কারণ অন্যত্র উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسْجُدَ اِذْ اَمَرْتُکَﺚ قَالَ اَنَا خَیْرٌ مِّنْھُﺆ خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّخَلَقْتَھ۫ مِنْ طِیْنٍ)
“তিনি বললেন, ‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কী তোমাকে তা থেকে বিরত রাখল যে, তুমি সিজদাহ করবে না?’সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম; তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছ এবং তাকে কর্দম দ্বারা সৃষ্টি করেছ।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১২)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার কোন নির্দেশকে অমান্য করা শয়তানের কাজ ও অহঙ্কারের বহিঃপ্রকাশ। এমনকি কেউ তাচ্ছিল্য ও অহঙ্কার করে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে অমান্য করলে মু’মিন থাকবে না। তাই একজন মু’মিন যখন জানতে পারবে এটা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের নির্দেশ তখন সে তা মাথা পেতে মেনে নেবে, চাই সেটা তার যুক্তি ও ইচ্ছানুযায়ী হোক আর না হোক। বরং যুক্তি দাঁড় করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ বর্জন করা ইবলিসের অনসুরণ এবং জাহান্নামে যাওয়ার কাজ।
ফেরেশতা কর্তৃক আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করার ব্যাপারে মুফাসসিরদের বক্তব্য:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ফেরেশতাগণ আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করেছিল আর এটা ছিল মূলত আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য (কারণ আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন)।
হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে যে সম্মান দান করেছেন সে প্রদত্ত সম্মান স্বরূপ সিজদাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটাই ছিল আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য। কাতাদাহ (রহঃ)ও এরূপ বলেছেন।
ইবরাহীম আল মুজানী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে কাবার ন্যায় করেছিলেন। অর্থাৎ আদমকে সামনে রেখে আল্লাহ তা‘আলাকেই সিজদাহ দেয়া।
কেউ কেউ বলেছেন: এ সিজদাহটি ছিল সালাম ও সম্মানস্বরূপ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَرَفَعَ اَبَوَیْھِ عَلَی الْعَرْشِ وَخَرُّوْا لَھ۫ سُجَّدًاﺆ وَقَالَ یٰٓاَبَتِ ھٰذَا تَاْوِیْلُ رُءْیَایَ مِنْ قَبْلُﺑ قَدْ جَعَلَھَا رَبِّیْ حَقًّا)
“এবং ইউসুফ তার মাতা-পিতাকে উচ্চাসনে বসাল এবং তারা সকলে তার সম্মানে সিজ্দায় লুটিয়ে পড়ল। সে বলল, ‘হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার প্রতিপালক সেটা সত্যে পরিণত করেছেন।”(সূরা ইউসূফ ১২:১০০)
এরূপ সিজদাহ পূর্ববর্তী উম্মাতের মাঝে শরীয়তসম্মত ছিল, কিন্তু আমাদের শরীয়তে এটা নিষিদ্ধ। মু‘আয (রাঃ) বলেন: আমি সিরিয়াবাসীকে তাদের নেতৃবর্গ ও আলেমদের সামনে সিজদাহ করতে দেখেছিলাম। কাজেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল আপনি সিজদাহ পাবার বেশি হকদার। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:لَوْ كُنْتُ آمُرُ بَشَرًا أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ لأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لأَزْوَاجِهِنِّ
আমি যদি কোন মানুষের জন্য সিজদাহ করার নির্দেশ প্রদান করতাম, তাহলে স্ত্রীদেরকে নির্দেশ প্রদান করতাম যে, তারা যেন তাদের স্বামীদেরকে সিজদাহ করে। (মু‘জামুল কাবীর: ৩৭৩)
অতএব ইসলামী শরীয়তে কোন মানুষকে সিজদাহ দেয়ার বিধান নেই। সম্মানী সিজদাহ বা রূপক সিজদাহ সবই হারাম। অতএব কোন সম্রাট, পীর, বুজুর্গ ও আলেম মুর্শিদকেও সিজদাহ দেয়া হারাম ও শির্ক।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন আদমকে সিজদাহ দেয়ার জন্য তাঁর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ। এটাই হল নির্দেশের বাস্তবায়ন। অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতামত এরূপ। (তাফসীর ইবনে কাসীর,অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ফেরেশতারা আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করেছিল তাঁর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ। যা পালন করা ছিল আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত।
২. অহঙ্কার করে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ বর্জন করা শয়তানের কাজ। যা একজন মু’মিনকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে কোন প্রকার যুক্তি দিয়ে বর্জন করা যাবে না। শরীয়ত যুক্তি দিয়ে চলে না, উক্তি দিয়ে চলে।
২. অহঙ্কার করে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ বর্জন করা শয়তানের কাজ। যা একজন মু’মিনকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে কোন প্রকার যুক্তি দিয়ে বর্জন করা যাবে না। শরীয়ত যুক্তি দিয়ে চলে না, উক্তি দিয়ে চলে।
আপনি চাইলে -Whatapps-Facebook-Twitter-ব্লগ- আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking-ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন-মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]-:-admin by rasikul islam নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিটকরুন -এই ওয়েবসাইটে -https://sarolpoth.blogspot.com/(জানা অজানা ইসলামিক জ্ঞান পেতে runing update)< -https://rasikulindia.blogspot.com (ইসলামিক বিশুদ্ধ শুধু বই পেতে, পড়তে ও ডাউনলোড করতে পারবেন). Main Websaite- esoislamerpothe.in , comming soon my best world websaite
0 Comments