ঈমান বিশয়ক প্রশ্ন উত্তর-43to 66
প্রশ্নঃ (৪৩) জিনের আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় কি?
উত্তরঃ সন্দেহ নেই যে, জিনেরা
মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং কষ্ট দিতে পারে। কখনো জিনেরা মানুষকে মেরে
ফেলে। কখনো বা পাথর নিক্ষেপ করে এবং বিভিন্নভাবে ভয় দেখায়। জিনদের এ সকল কর্ম
হাদীছ এবং বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত। নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত
আছে যে, তিনি খন্দকের যুদ্ধের দিন জনৈক ছাহাবীকে তার স্ত্রীর কাছে যাওয়ার
অনুমতি দিয়ে দিলেন। কারণ তিনি নতুন বিবাহিত যুবক ছিলেন। ঘরে ফিরে যুবক দেখলেন,
স্ত্রী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। এ দেখে তিনি তার প্রতি মনক্ষুন্ন
হলেন। স্ত্রী বললেন, ঘরে প্রবেশ করুন। ঘরে প্রবেশ করে
দেখলেন বিছানার উপরে একটি সাপ ব্যাড় দিয়ে বসে রয়েছে। হাতেই ছিল বর্শা। বর্শা দিয়ে
সাপকে আঘাত করার সাথে সাথে সাপটি মারা গেল এবং উক্ত ছাহাবীও মৃত্যু বরণ করলেন। সাপ
এবং ছাহাবীর মধ্যে কে আগে মারা গেল, তা জানা যায়নি। এই
সংবাদ নবী (ﷺ) এর কাছে পৌঁছার
পর তিনি ঘরের মধ্যে বসবাসকারী সাপগুলো মারতে নিষেধ করলেন। তবে পিঠের উপরে রেখা
বিশিষ্ট এবং লেজহীন ছোট ছোট সাপগুলো ব্যতীত। এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, জিনেরা
মানুষের উপরে আক্রমণ করে এবং কষ্ট দেয়। মুতাওয়াতের এবং মাশহুর সনদে বর্ণিত হাদীছে
আছে যে, মানুষ কখনো কখনো পুরাতন এবং ধ্বংস প্রাপ্ত
বাড়ী-ঘরে প্রবেশ করলে পাথর নিক্ষিপ্ত হয়। অথচ সেখানে কোন মানুষ দেখতে পায়না। কখনো
কখনো আওয়াজ এবং গাছের পাতার নাড়াচাড়া শুনতে পায়। এতে মানুষ ভয় পায়। এমনিভাবে আসক্ত
হয়ে কিংবা কষ্ট দেয়ার জন্য অথবা অন্য কোন কারণে জিন মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে। এ
দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেনঃ
)الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ الْمَسِّ(
“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে
যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান (জিন) আছর করে
ভারসাম্যহীন পাগলের মত করে দেয়।” (সূরা বাকারাঃ ২৭৫) কখনো জিনেরা
মানুষের শরীরে মিশে গিয়ে তার মুখ দিয়ে কথা বলে। জিনে ধরা রোগীর কাছে কবিরাজ যখন
কুরআনের আয়াত পাঠ করে, তখন জিন তার সাথে কথা বলে। কবিরাজ জিনের কাছ থেকে
পুনরায় না আসার অঙ্গীকার গ্রহণ করে। এ ধরণের আরো কথা হাদীছে বর্ণিত আছে এবং
জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে, জিনের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য সুন্নাহতে বর্ণিত দু’আগুলো পাঠ করতে হবে। তার মধ্যে আয়াতুল কুরসী অন্যতম। কোন লোক রাত্রিতে
আয়াতুল কুরসী পাঠ করলে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে একজন হেফাজতকারী থাকে। সকাল
পর্যন্ত শয়তান তার নিকটেও আসতে পারে না।
উত্তরঃ জিনেরা গায়েব
জানে না। আল্লাহ ব্যতীত আকাশ-জমিনের কোন মাখলুকই গায়েবের খবর রাখে না। আল্লাহ
বলেনঃ
)فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتْ الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ الْمُهِينِ(
“যখন আমি তাঁর (সোলায়মানের) মৃত্যু ঘটালাম, তখন
ঘুণ পোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সোলায়মানের লাঠি খেয়ে
যাচ্ছিল। যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে
পারল যে, অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্চনাপূর্ণ
শাস্তিতে আবদ্ধ থাকতো না।” (সূরা সাবাঃ ১৪) সুতরাং যে
ব্যক্তি ইলমে গায়েবের দাবী করবে সে কাফের হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি কাউকে ইলমে
গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করবে, সেও কাফের। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ গায়েবের খবর জানে
না। আল্লাহ বলেন,
)قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ(
“বলুন আসমান যমিনে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েবের খবর জানে না।” (সূরা
নামলঃ ৬৫) যারা ভবিষ্যতের সংবাদ জানে বলে দাবী করে, তাদেরকে
গণক বলা হয়। নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
مَنْ أَتَى عَرَّافًا فَسَأَلَهُ عَنْ شَيْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً
যে ব্যক্তি কোন গণকের কাছে এসে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করল, চল্লিশ
দিন পর্যন্ত তার স্বলাত কবূল হবে না। গণকের কথা বিশ্বাস করলে কাফেরে পরিণত হবে।
কারণ গণকের কথা বিশ্বাসের মাধ্যমে সে আল্লাহর নিম্নলিখিত বাণীকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন
করল। আল্লাহ বলেনঃ
)قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ(
“আসমান যমিনে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েবের খবর জানে না।” (সূরা
নামলঃ ৬৫)
উত্তরঃ নবী (ﷺ) আল্লাহর বন্ধু।
এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহকে তিনি খুব ভাল বাসতেন আল্লাহও তাকে খুব ভালবাসেন।
কিন্তু এর চেয়ে উত্তম শব্দ দ্বারা তাঁর প্রশংসা করা যায়। তা হল খালীলুল্লাহ বা
আল্লাহর নিকটতম বন্ধু। সুতরাং রাসূল (ﷺ) আল্লাহর বন্ধু।
তিনি বলেন,
) اِنَّ اللَّهَ اتَّخَذَنِي خَلِيلًا كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا(
“আল্লাহ তাআ’লা আমাকে নিকটতম বন্ধু হিসাবে
গ্রহণ করেছেন। যেমনভাবে আল্লাহ তাআ’লা ইবরাহীম (আঃ)কে
নিকটতম বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছেন।” যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)কে হাবীবুল্লাহ
গুণে গুণাম্বিত করল, সে নবী (ﷺ)এর মর্যাদা কমিয়ে
দিল। হাবীবুল্লাহর চেয়ে খলীলুল্লাহর মর্যাদা বেশী। প্রতিটি মুমিনই আল্লাহর হাবীব।
কিন্তু রাসূল (ﷺ)এর মর্যাদা এর
চেয়ে বেশী। আল্লাহ তাআ’লা ইবরাহীম (আঃ) ও মুহাম্মাদ (ﷺ)কে খলীল বা
বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এই জন্যই আমরা বলি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) খলীলুল্লাহ। কারণ
হাবীবুল্লাহর চেয়ে খলীলুল্লাহর ভিতরে বন্ধুত্বের অর্থ বেশী পরিমাণে বর্তমান রয়েছে।
উত্তরঃ দুনিয়ার সম্পদ
অর্জনের জন্য নবী (ﷺ)এর প্রশংসা করা
হারাম। এখানে জানা দরকার যে, নবী (ﷺ)এর
প্রশংসাকারীগণ দু’ভাগে বিভক্ত।
১) বাড়াবাড়ি ব্যতীত নবী (ﷺ)এর প্রশংসা
করাতে অসুবিধা নেই। অর্থাৎ তাঁর চরিত্রে যে সমস্ত সৎ গুণাবলী রয়েছে, তা
বর্ণনা করাতে কোন দোষ নেই।
২) নবী (ﷺ)এর প্রশংসায়
বাড়াবাড়ি করা। তিনি এটা নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
নাসারা সম্প্রদায় যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারঈয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, তোমরা
সেভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। আমি একজন আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা
আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল বল। অতএব যে ব্যক্তি নবী (ﷺ)এর প্রশংসা
এভাবে করবে যে, তিনি আশ্রয় প্রার্থীদের আশ্রয় দাতা, বিপদ
গ্রসে'র আহবানে সাড়া দানকারী, তিনি
দুনিয়া ও আখেরাতের মালিক, তিনি গায়েবের খবর জানেন ইত্যাদি
বাক্য দ্বারা প্রশংসা করা হারাম। বরং কখনো ইসলাম থেকে বহিস্কারকারী শির্ক পর্যন্ত
পৌঁছে যায়। সুতরাং বেশী বাড়াবাড়ি করে নবী (ﷺ) এর প্রশংসা করা
ঠিক নয়।
রাসূল (ﷺ) এর প্রশংসাকে
পেশা হিসাবে গ্রহণ করে দুনিয়ার স্বার্থ অর্জন করা হারাম। রাসূল (ﷺ) যে সমস্ত উন্নত
চারিত্রিক গুণাবলী ও প্রশংসিত বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন, তা
বর্ণনা করা এবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর যে জিনিষ এবাদতের অন্তর্ভুক্ত তাকে দুনিয়া
অর্জনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা জায়েয নয়।
)مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لا يُبْخَسُونَ أُوْلَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ(
“যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে আমি তাদেরকে
দুনিয়াতেই তাদের আ‘মালের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেব এবং তাতে
তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হবেনা। এরাই হল সেসব লোক, আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা দুনিয়াতে যা কিছু
করেছিল সবই বরবাদ করেছে আর যা কিছু উপার্জন করেছিল, সবই
বিনষ্ট হয়েছে।” (সূরা হূদঃ ১৫-১৬) আল্লাহই সঠিক
পথের সন্ধান দাতা।
প্রশ্নঃ (৪৭) যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, নবী (ﷺ) মানুষ নন; বরং তিনি
আল্লাহর নূর। অতঃপর সে নবী (ﷺ)এর কাছে আশ্রয়
প্রার্থনা করে এই বিশ্বাসে যে, তিনি কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, তার
হুকুম কি? এ ধরণের লোকের পিছনে স্বলাত আদায় করা জায়েয আছে
কি?
উত্তরঃ যে ব্যক্তি এই
বিশ্বাস করবে যে, নবী (ﷺ) আল্লাহর নূর-
(বা আল্লাহর যাতী নূর) মানুষ নন, তিনি গায়েবের খবর জানেন, সে আল্লাহ
এবং রাসূলের সাথে কুফরী করল। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমন, বন্ধু নয়। কেননা তার কথা আল্লাহ ও রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আর যে
ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, সে
কাফের। আল্লাহ বলেনঃ
)قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ(
“আপনি বলুন, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ।” (সূরা
কাহফঃ ১১০) আল্লাহ বলেনঃ
)قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ(
আসমানযমিনে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েবের খবর জানে না। (সূরা
নামলঃ ৬৫) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ(
অর্থঃ “আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই।
আমি এমনও বলি না যে আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ অহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে।” (সূরা আন্আ’মঃ
৫০) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنْ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِي السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ(
“আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ এবং
অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি
যদি গায়েবের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু কল্যাণ
অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনো হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র
একজন ভীতি প্রদর্শক ও ঈমানদারদের জন্য সুসংবাদদাতা।” (সূরা আ’রাফঃ ১৮৮) নবী(ﷺ) বলেনঃ
)إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ أَنْسَى كَمَا تَنْسَوْنَ فَإِذَا نَسِيتُ فَذَكِّرُونِي(
“আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। তোমরা যেমন ভুলে যাও আমিও তেমনি ভুলে যাই।
আমি ভুল করলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।” যে ব্যক্তি
রাসূল (ﷺ)এর কাছে সাহায্য
প্রার্থনা করল এই বিশ্বাসে যে, নবী (ﷺ) ভাল-মন্দের
মালিক, সে কাফের হিসাবে গণ্য হবে। আল্লাহ বলেনঃ
)وَقَالَ رَبُّكُمْ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ(
অর্থঃ “তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক,
আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই
জাহান্নামে প্রবেশ করবে অপমানিত অবস্থায়।” (সূরা
গাফেরঃ ৬০) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا قُلْ إِنِّي لَنْ يُجِيرَنِي مِنْ اللَّهِ أَحَدٌ وَلَنْ أَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا(
“বলুন, আমি তোমাদের ক্ষতি সাধন করার ও সুপথে
আনয়ন করার মালিক নই। বলুন, আল্লাহর কবল থেকে আমাকে কেউ
রক্ষা করতে পারবে না এবং তিনি ব্যতীত আমি কোন আশ্রয়স্থল পাবনা।” (সূরা
জ্বিনঃ ২১-২২) নবী (ﷺ) তাঁর
নিকটাত্মীয়দেরকে বলেছেনঃ
لَا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا
“আমি তোমাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করতে পারব না।” নবী (ﷺ) (তাঁর
বংশধর) তাঁর কন্যা ফাতেমা ও ফুফু সাফিয়াকে একই কথা বলেছেন।
যে ব্যক্তি তাকে নূরের তৈরী বলে বিশ্বাস করে, তাকে
ইমাম নিয়োগ করা এবং তার পিছনে স্বলাত আদায় করা বৈধ নয়।
উত্তরঃ মাহদী সম্পর্কে
বর্ণিত হাদীছগুলো চারভাগে বিভক্ত।
১) মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীছ
২) যঈফ হাদীছ
৩) হাসান হাদীছ,
৪) সহীহ হাদীছেও ইমাম মাহদীর আগমণের কথা বর্ণিত হয়েছে। তবে ইরাকের সিরদাব নামক
স্থানে লুকায়িত রাফেজীদের কল্পিত মাহদীর সাথে হাদীছে বর্ণিত মাহদীর কোন সম্পর্ক
নেই। এটি রাফেজীদের পক্ষ থেকে একটি বানোয়াট কাহিনী। ছহীহ হাদীছে যে মাহদীর কথা বলা
হয়েছে, তিনি অন্যান্য বনী আদমের মতই একজন লোক হবেন। তিনি যথা সময়ে জম্ম গ্রহণ
করবেন এবং মানব সমাজে আত্ম প্রকাশ করবেন। এটিই ইমাম মাহদীর প্রকৃত ঘটনা। সুতরাং
ইরাকের সিরদাব অঞ্চলে লুকায়িত মাহদীর আগমণে বিশ্বাস করা মারাত্মক ভুল এবং বিবেক
বহির্ভূত ও ভিত্তিহীন ব্যাপার। নবী (ﷺ)এর হাদীছে বর্ণিত
ইমাম মাহদীর আগমণ সত্য।
উত্তরঃ ইয়াজুজ মা’জুজ বনী
আদমের অন্তর্ভুক্ত দু’টি জাতি। তারা বর্তমানে বিদ্যমান
রয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা যুল-কারনাইনের ঘটনায় বলেনঃ
)حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا قَالُوا يَاذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا قَالَ مَا مَكَّنَنِي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا فَمَا اسْتَطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا(
“অবশেষে যখন তিনি দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্তলে পৌঁছলেন, তখন তিনি সেখানে এক জাতিকে পেলেন, যারা তাঁর
কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, হে যুল-কারনাইন,
ইয়াজুজ ও মা’জুজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি
করছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্য কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রচীর নির্মাণ করে দিবেন। তিনি বললেন,
আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে
সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দিব। তোমরা
আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল,
তখন তিনি বললেন, তোমরা হাঁপরে ফুঁক দিতে
থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হল , তখন তিনি বললেন,
তোমরা গলিত তামা নিয়ে আস। আমি তা এর উপর ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজুজ
ও মাজুজের দল তার উপরে আরোহণ করতে পারলনা এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হলনা।
যুল-কারনাইন বললেন, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ। যখন
আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত সময় আসবে, তখন তিনি একে
চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুতি সত্য।” (সূরা
কাহাফঃ ৯৩-৯৮) নবী (ﷺ) বলেনঃ
يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى يَا آدَمُ فَيَقُولُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِي يَدَيْكَ فَيَقُولُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ قَالَ وَمَا بَعْثُ النَّارِ قَالَ مِنْ كُلِّ أَلْفٍ تِسْعَ مِائَةٍ وَتِسْعَةً وَتِسْعِينَ فَعِنْدَهُ يَشِيبُ الصَّغِيرُ (وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ ) قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَأَيُّنَا ذَلِكَ الْوَاحِدُ قَالَ أَبْشِرُوا فَإِنَّ مِنْكُمْ رَجُلًا وَمِنْ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ أَلْفًا
“আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন আদম (আঃ)কে ডাক
দিবেন। আদম (আঃ) বলবেন হে আল্লাহ আমি আপনার দরবারে হাজির আছি। তখন আল্লাহ বলবেন,
তোমার বংশধর থেকে জাহান্নামী দলকে পৃথক কর। আদম (আঃ) বলবেন,
জাহান্নামের দল কারা? আল্লাহ বলবেন,
প্রত্যেক এক হাজারের মধ্যে থেকে নয়শত নিরানব্বই জন। তখন কোলের
শিশু বৃদ্ধ হয়ে যাবে। গর্ভবতী মহিলারা সন্তান প্রসব করে দেবে। মানুষদেরকে আপনি
মাতাল অবস্থায় দেখবেন। অথচ তারা মাতাল নয়। আল্লাহর আযাব খুবই কঠিন। ছাহাবীগণ বললেন,
আমাদের মধ্যে থেকে কে হবে সেই এক ব্যক্তি? নবী (ﷺ) বললেন, সুসংবাদ
গ্রহণ কর, তোমাদের মধ্যে থেকে হবে সেই এক ব্যক্তি। আর
বাকীরা হবে ইয়াজুজ-মাজুজের দল।”
ইয়াজুজ-মাজুজের দল বের হয়ে আসা কিয়ামতের অন্যতম আলামত। নবী (ﷺ)এর যুগেই
ইয়াজুজ-মাজুজ বের হওয়ার লক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। উম্মে হাবীবা h এর হাদীছে আছে, তিনি
বলেন, নবী (ﷺ) একদা পেরেশান ও
রক্তিম চেহারা নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি বলছিলেনঃ
)لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ وَحَلَّقَ بِإِصْبَعَيْهِ الْإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا(
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আরবদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য। অকল্যাণ নিকটবর্তী
হয়ে গেছে। ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর এই পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এই বলে তিনি হাতের
বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনি আঙ্গুলি দিয়ে গোলাকৃতি করে দেখালেন।”
প্রশ্নঃ (৫০) নবীগণ কেন তাঁদের উম্মতকে দাজ্জালের ফিত্না
থেকে সাবধান করেছেন? অথচ দাজ্জাল তো শেষ যামানাতেই বের হবে।
উত্তরঃ আদম সৃষ্টি থেকে
নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে দাজ্জালের ফিত্না হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফিতনা। নবী (ﷺ) এই সংবাদ
দিয়েছেন। এই জন্য নূহ (আঃ) থেকে আরম্ভ করে মুহাম্মাদ (ﷺ) পর্যন্ত সকল
নবীই তাঁদের সম্প্রদায়কে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন। যাতে তারা সাবধান থাকতে পারে এবং
দাজ্জালের বিষয়টি তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। রাসূলদের দায়িত্ব ছিল উম্মতকে সকল
প্রকার অনিষ্ট হতে সাবধান করা। নবী (ﷺ) বলেছেন,
إِنْ يَخْرُجْ وَأَنَا فِيكُمْ فَأَنَا حَجِيجُهُ دُونَكُمْ وَإِنْ يَخْرُجْ وَلَسْتُ فِيكُمْ فَامْرُؤٌ حَجِيجُ نَفْسِهِ وَاللَّهُ خَلِيفَتِي عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
“আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান থাকাবস্থায় যদি দাজ্জাল বের হয়, তাহলে আমি একাই তার সাথে যুদ্ধ করব এবং তাকে প্রতিহত করব। আমি চলে গেলে
যদি তার আগমণ ঘটে, তাহলে প্রতিটি ব্যক্তিই নিজেকে তার
ফিতনা থেকে রক্ষা করবে। আমার পরে আল্লাহই প্রতিটি মুসলিমকে হেফাজত করবেন।”
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে আদম সৃষ্টির পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত দাজ্জালের
ফিত্না পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় ফিতনা, তাই বিশেষভাবে
স্বলাতের মধ্যে নবী (ﷺ) দাজ্জালের
ফিত্না থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি শেষ বৈঠকে এই দু’আটিও পাঠ
করতেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ
“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জাহান্নাম এবং কবরের আযাব থেকে আশ্রয়
প্রার্থনা করছি। আরো আশ্রয় প্রার্থনা করছি দাজ্জালের ফিত্না হতে।”
দাজ্জাল শব্দটি (دجل) হতে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা ইত্যাদি। দাজ্জাল যেহেতু সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী এবং সবচেয়ে
বড় প্রতারক। তাই তাকে দাজ্জাল বলে নাম রাখা হয়েছে।
প্রশ্নঃ (৫১) যারা পরকালের জীবনকে অবিশ্বাস করে এবং বলে
এ বিশ্বাস মধ্যযুগের একটি কল্পকাহিনী ও কুসংস্কার মাত্র- এ ধরণের মানুষকে কিভাবে
বুঝানো সম্ভব?
উত্তরঃ যে ব্যক্তি
পরকালীন জীবনকে অস্বীকার করবে এবং বলবে এটি মধ্যযুগের কল্পিত কাহিনীমাত্র, সে
কাফের। আল্লাহ বলেন,
)وَقَالُوا إِنْ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوثِينَ وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوا عَلَى رَبِّهِمْ قَالَ أَلَيْسَ هَذَا بِالْحَقِّ قَالُوا بَلَى وَرَبِّنَا قَالَ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ(
“তারা বলে, আমাদের এ পার্থিব জীবনই জীবন।
আমাদেরকে পুনরায় জীবিত হতে হবে না। আর যদি আপনি তাদেরকে দেখেন, যখন তাদেরকে প্রতিপালকের সামনে দাঁড় করানো হবে। তিনি বলবেন, এটা কি বাস্তব সত্য নয়? তারা বলবে, হ্যাঁ, আমাদের প্রতিপালকের কসম। তিনি বলবেন,
অতএব স্বীয় কুফরের কারণে শাস্তি আস্বাদন কর।” (সূরা আনআ’মঃ ২৯-৩০) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِلْمُكَذِّبِينَ الَّذِينَ يُكَذِّبُونَ بِيَوْمِ الدِّينِ وَمَا يُكَذِّبُ بِهِ إِلَّا كُلُّ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ ثُمَّ إِنَّهُمْ لَصَالُوا الْجَحِيمِ ثُمَّ يُقَالُ هَذَا الَّذِي كُنتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ(
“সে দিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের। যারা প্রতিফল দিবসকে মিথ্যা
প্রতিপন্ন করে। প্রত্যেক সীমালংঘনকারী পাপীই কেবল একে মিথ্যারোপ করে। তার কাছে
আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হলে সে বলে, ইহা পুরাতনকালের
রূপকথা। কখনো না, বরং তারা যা করে, তাই তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। কখনো না তারা সেদিন তাদের
পালনকর্তা থেকে পর্দার অন্তরালে থাকবে। অতঃপর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এরপর
বলা হবে, একেই তো তোমরা মিথ্যারোপ করতে।” (সূরা
আত্তাতফীফঃ ১০-১৭) আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেনঃ
)بَلْ كَذَّبُوا بِالسَّاعَةِ وَأَعْتَدْنَا لِمَنْ كَذَّبَ بِالسَّاعَةِ سَعِيرًا(
“বরং তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করে। যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে, আমি তার জন্য অগ্নি প্রস্তত করেছি।” (সূরা
ফুরক্বানঃ ১১) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ وَلِقَائِهِ أُوْلَئِكَ يَئِسُوا مِنْ رَحْمَتِي وَأُوْلَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ(
“যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ এবং তাঁর সাক্ষাৎ অস্বীকার করে, তারাই আমার রহমত হতে নিরাশ হবে। তাদের জন্যই যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি
রয়েছে।” (সূরা আনকাবুতঃ ২৩) যারা পরকালকে
অবিশ্বাস করে তাদের কাছে নিম্নবর্ণিত দলীলসমূহ পেশ করা হবেঃ
প্রথমতঃ কিয়ামত এবং পরকালের বিষয়টি যুগে যুগে নবী ও রাসূলদের মাধ্যমে আসমানী
কিতাবসমূহে মুতাওয়াতের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহ তা কবূল করে
নিয়েছে। অতএব তোমরা কিভাবে নবী-রাসূলদের কথা অমান্য করে পরকালকে অস্বীকার করতে পার? অথচ
তোমরা দার্শনিক কিংবা কোন বাতিল ফির্কার প্রবর্তকের কথা বিশ্বাস করে থাক।
দ্বিতীয়তঃ কিয়ামত হওয়ার বিষয়টি বিবেক দ্বারাও স্বীকৃত এবং সমর্থিত।
তা কয়েকভাবে হতে পারেঃ
১) প্রত্যেকেই স্বীকার করে যে, সে অস্তিত্বহীন থেকে অসি-ত্বে এসেছে।
যিনি প্রথমবার অস্তিত্বহীন থেকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি
দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে সক্ষম। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَهُوَ الَّذِي يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ(
“তিনিই প্রথমবার সৃষ্টিকে অসি-ত্বে আনয়ন করেন, অতঃপর
পুনর্বার তিনি সৃষ্টি করবেন। এটা তাঁর জন্য তুলনা মূলক বেশী সহজ।” (সূরা রূমঃ
২৭) আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেনঃ
)كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ(
“যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে
পুনরায় সৃষ্টি করব।” (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৪)
২) আকাশ-জমিনের সৃষ্টির বড়ত্ব ও অভিনবত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যিনি
এ দু’টিকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে
এবং পুনরায় তাদের প্রথমবারের মত সৃষ্টি করতে সক্ষম। আল্লাহ বলেন,
)لَخَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ(
“নিশ্চয় আকাশ-জমিনের সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টির চেয়ে অনেক বড়।” (সূরা
গাফেরঃ ৫৭) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يُحْيِيَ الْمَوْتَى بَلَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(
“তারা কি জানে না যে, তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন তিনি এবং এ গুলোর সৃষ্টিতে কোন
ক্লান্তিবোধ করেন নি, তিনি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম?
কেন নয়, নিশ্চয়ই তিনি সকল বিষয়ে
সর্বশক্তিমান।” (সূরা আহক্বাফঃ ৩৩) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ بَلَى وَهُوَ الْخَلاقُ الْعَلِيمُ إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ(
“যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন, তিনি
কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হ্যাঁ, তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। তিনি যখন কোন কিছু
করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে বলে দেন, হও তখনই তা হয়ে যায়।” (সূরা ইয়াসীনঃ ৮১-৮২)
৩) প্রত্যেক দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি জমিনকে মৃত অবস্থায় দেখে। বৃষ্টি বর্ষিত
হওয়ার সাথে সাথে তা উর্বর হয়ে উঠে এবং সেখানে নানা প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। যিনি
মৃত জমিনকে জীবিত করতে পারেন, তিনি মৃত মানুষকেও পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। আল্লাহ
বলেনঃ
)وَمِنْ آيَاتِهِ أَنَّكَ تَرَى الْأَرْضَ خَاشِعَةً فَإِذَا أَنزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ إِنَّ الَّذِي أَحْيَاهَا لَمُحْيِي الْمَوْتَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(
“তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখবে
অনুর্বর অবস্থায় পড়ে আছে। অতঃপর আমি যখন তার উপর বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন শস্যশ্যামল ও স্ফীত হয়ে উঠে। নিশ্চয় যিনি একে জীবিত করেন, তিনি জীবিত করবেন মৃতদেরকেও। নিশ্চয় তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।” (সূরা
হা-মীম সাজদাহঃ ৩৯)
৪) বিভিন্ন বাস্তব ঘটনা, যা আল্লাহ তাআ’লা আমাদের জন্য
বর্ণনা করেছেন, তা পুনরুত্থান সম্ভব হওয়ার সত্যতা প্রমাণ
বহন করে। সূরা বাকারাতে এধরণের পাঁচটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ
)أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَى قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّى يُحْيِي هَذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِائَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالَ بَلْ لَبِثْتَ مِائَةَ عَامٍ فَانظُرْ إِلَى طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ وَانظُرْ إِلَى حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آيَةً لِلنَّاسِ وَانظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(
“তুমি কি সে লোককে দেখনি যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল, যা ছিল জনমানব শুণ্য, দেয়ালগুলো বিধ্বস্ত
ছাদের উপর পড়ে ছিল? বলল, কেমন
করে আল্লাহ মরণের পর এই জনপদকে পুনরায় জীবিত করবেন? অতঃপর
আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশ বছর। তারপর তাকে উঠালেন। বললেন, কত কাল এভাবে ছিলে? বলল, আমি ছিলাম একদিন কিংবা একদিনের কিছু সময়। বললেন, তা নয়, বরং তুমি তো একশ বছর ছিলে। এবার চেয়ে
দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে। সেগুলো পচে যায়নি এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আর
আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ,
আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপর মাংসের আবরণ
পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার উপর এ অবস্থা প্রকাশিত হল, তখন
বলে উঠল আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে
ক্ষমতাশীল।” (সূরা বাক্বারাঃ ২৫৯)
৫) প্রতিটি ব্যক্তি স্বীয় কর্মের যথাযথ প্রতিদান পাওয়ার জন্য পুনরুত্থান
আবশ্যক। তা না হলে মানুষ সৃষ্টির কোন মূল্য থাকে না এবং পার্থিব জীবনে মানুষ ও
পশুর মাঝেও কোন পার্থক্য থাকে না। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ(
“তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক
সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না। অতএবর্ মহিমান্বিত আল্লাহ,
তিনি সত্যিকার মালিক, তিনি ব্যতীত সত্য
কোন মা’বূদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের মালিক।” (সূরা মু’মিনূনঃ ১১৫-১১৬) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى(
“কিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই
যাতে প্রত্যেকেই তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করে।” (সূরা
ত্বো-হাঃ ১৫) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَأَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ لَا يَبْعَثُ اللَّهُ مَنْ يَمُوتُ بَلَى وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ الَّذِي يَخْتَلِفُونَ فِيهِ وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّهُمْ كَانُوا كَاذِبِينَ إِنَّمَا قَوْلُنَا لِشَيْءٍ إِذَا أَرَدْنَاهُ أَنْ نَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ(
“তারা আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে যে, যার
মৃত্যু হয় আল্লাহ তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন না। অবশ্যই এর পাকাপোক্ত ওয়াদা হয়ে
গেছে। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। তিনি পুনরুজ্জীবিত করবেনই, যাতে যে বিষয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল তা প্রকাশ করা যায় এবং
কাফেরেরা জেনে নেয় যে, তারা মিথ্যাবাদী ছিল। আমি যখন কোন
কিছু করার ইচ্ছা করি, তখন তাকে কেবল এতটুকুই বলি যে,
হয়ে যাও, তখনই তা হয়ে যায়।” (সূরা
নাহলঃ ৩৮-৪০) আল্লাহ বলেনঃ
)زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ لَنْ يُبْعَثُوا قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ(
“কাফেরেরা দাবী করে যে, তারা কখনো পুনরুত্থিত
হবে না। বলুন, অবশ্যই হবে, আমার
পালনকর্তার কসম, তোমরা নিশ্চয় পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর
তোমাদেরকে অবহিত করা হবে যা তোমরা করতে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।” (সূরা
তাগাবুনঃ ৭)
পুনরুত্থান অস্বীকারকারীদের জন্য উপরোক্ত প্রমাণগুলো পেশ করার পরও যদি
তারা অস্বীকার করে, তাহলে তারা অতিসত্বরই তাদের পরিণতি
সম্পর্কে অবহিত হবে।
উত্তরঃ কুরআনের
প্রকাশ্য আয়াত, সুস্পষ্ট সুন্নাত এবং মুসলিমদের ঐকমত্যে কবরের আযাব সত্য। নবী (ﷺ) বলেছেন,
تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
“তোমরা কবর আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। তোমরা কবর আযাব
থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। তোমরা কবর আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয়
প্রার্থনা কর। কথাটি নবী (ﷺ) তিনবার বলেছেন।”
সকল মুসলিমই স্বলাতে বলে,
أَعُوْذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ
“আমি আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আযাব এবং কবরের আযাব থেকে আশ্রয়
প্রার্থনা করছি।” সাধারণ মানুষ এবং আলেম-উলামা সবাই এই দু’আটি পাঠ করে থাকে।
আল্লাহ তাআ’লা কুরআনে বলেনঃ
)النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ(
“সকালে ও সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয় এবং যেদিন কিয়ামত
সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরাউন গোত্রকে কঠিনতম আযাবে প্রবেশ করাও।” (সূরা
গাফেরঃ ৪৬) কোন সন্দেহ নেই যে, তাদেরকে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য জাহান্নামের
আগুনের উপরে পেশ করা হবে না; বরং তার আযাব ভোগ করার জন্য।
আল্লাহ বলেনঃ
)وَلَوْ تَرَى إِذْ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُوا أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنفُسَكُمْ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنتُمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنتُمْ عَنْ آيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُونَ(
“আপনি যদি জালিমদেরকে ঐ সময়ে দেখতে পেতেন, যখন
তারা মৃত্যু যন্ত্রনায় থাকবে এবং ফেরেশতাগণ তাদের হাত বাড়িয়ে বলবেন, তোমরা নিজেরাই নিজেদের প্রাণ বের করে আন। তোমাদের আ‘মালের কারণে আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর আযাব দেয়া হবে। কারণ তোমরা আল্লাহর
উপর মিথ্যারোপ করেছিলে এবং তোমরা তাঁর আয়াতের বিরুদ্ধে অহংকার করেছিলে।” (সুরা আনআ’মঃ ৯৩) আর এই আয়াতের মধ্যে ‘আজ’
বলতে মৃত্যুর দিনকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং প্রমাণিত হল যে,
কুরআন, সুন্নাহ এবং মুসলিমদের ঐক্যমতে
কবরের আযাব সত্য।
স্বাভাবিক দাফন না হলেও কবরে আযাব হবে।
প্রশ্নঃ (৫৩) মৃত লাশকে যদি হিংস্র পশুরা খেয়ে ফেলে
কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হয় তবেও কি কবরের আযাব হবে?
উত্তরঃ অবশ্যই হবে।
কারণ আযাব হবে রূহের উপর। কেননা শরীর তো মাটির সাথে মিশে যাবে। তাছাড়া যেহেতু
বিষয়টি গায়েবের সাথে সম্পৃক্ত, তাই এ কথা বলা যাবে না যে, দেহের
কোন আযাবই হবে না। যদিও তা নষ্ট হয়ে গেছে বা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিষয়টি পরকালের
সাথে সম্পৃক্ত। দুনিয়াতে দৃশ্যমান কোন বস্তর সাথে পরকালের গায়েবী বিষয়ের তুলনা
চলেনা।
কবরের আযাব অস্বীকার করার বিধান।
প্রশ্নঃ (৫৪) এক শ্রেণীর লোক কবরের আযাব অস্বীকার করার
পক্ষে দলীল পেশ করে যে, কবর খনন করলে দেখা যায় লাশ রয়ে গেছে, কোন পরিবর্তন হয়নি এবং কবর সংকীর্ণ অথবা প্রশস্তও হয়নি। আমরা কিভাবে
তাদের উত্তর দিব?
উত্তরঃ আমরা বলব কবরের
আযাব কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে সত্য বলে প্রমাণিত। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ(
“সকালে ও সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয় এবং যেদিন কিয়ামত
সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরাউন গোত্রকে কঠিনতম আযাবে প্রবেশ করাও।” (সূরা
গাফেরঃ ৪৬) নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
فَلَوْلا أَنْ لا تَدَافَنُوا لَدَعَوْتُ اللَّهَ أَنْ يُسْمِعَكُمْ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ الَّذِي أَسْمَعُ مِنْهُ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ فَقَالَ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّارِ قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّارِ فَقَالَ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
“তোমরা যদি দাফন না করতে, তাহলে আমি তোমাদেরকে
কবরের আযাব শুনানোর জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতাম,
যা আমি নিজে শ্রবণ করে থাকি। অর্থাৎ তোমরা যেহেতু একে অপরকে দাফন
করে থাক, তাই আমি তোমাদেরকে কবরের আযাব শুনানোর জন্য
আল্লাহর কাছে দু’আ করা বাদ দিলাম। কারণ তোমরা কবরের আযাব
শুনতে পেলে দাফন করা বাদ দিবে। অতঃপর নবী (ﷺ) আমাদের দিকে মুখ
ফিরিয়ে বললেন, তোমরা আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর।
ছাহাবীগণ বললেনঃ
نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّار
আমরা আল্লাহর কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তারপর নবী (ﷺ) বললেন, তোমরা
কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। ছাহাবীগণ বললেনঃ
نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّارِ
আমরা আল্লাহর কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” নবী (ﷺ) মু’মিন
ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেনঃ
يُفْسَحُ لَهُ فِى قَبْرِهِ مَدَّ بَصَرِهِ
“তার কবরকে চোখের দৃষ্টি সীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেয়া হয়।”
এমনি আরো অনেক দলীল রয়েছে, যা শুধুমাত্র
ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রত্যাখ্যান করা মোটেই জায়েয নয়; বরং
তা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নেয়া আবশ্যক। তাছাড়া কবরের আযাব হবে রূহের উপরে। শরীরের
উপরে নয়। শরীরের উপরে হলে তা দেখা যেত, তখন বিষয়টি
গায়েবের উপর ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হতনা। কিন্তু কবরের আযাবের বিষয়টি আলমে বরযখের তথা
মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। দুনিয়ার প্রকাশ্য বিষয়াদি দ্বারা এটাকে
উপলব্ধি করা যাবে না।
কবরের আযাব, শান্তি, কবরের
প্রশস্ততা এবং সংকীর্ণতা এসব বিষয় কেবলমাত্র মৃত ব্যক্তিই অনুভব করতে পারে। অন্য
কেউ নয়। কখনো কখনো মানুষ স্বপ্নে দেখে যে, সে কোথাও
যাচ্ছে, আকাশে উড়ছে, কাউকে
প্রহার করছে কিংবা তাকে কেউ প্রহার করছে। আরো দেখে যে, সে
এক সংকীর্ণময় স্থানে আছে অথবা প্রশস্ত কোন স্থানে আনন্দময় জীবন যাপন করছে। অথচ
ঘুমন্ত ব্যক্তির পাশের লোকেরা কিছুই অনুভব করতে পারে না। সুতরাং আমাদের উচিৎ এই
সমস্ত বিষয়ে শ্রবণ করা, বিশ্বাস করা এবং সেগুলোর আনুগত্য
করা।
উত্তরঃ হ্যাঁ, কখনো
কখনো কবরের আযাব হালকা করা হবে। কারণ নবী (ﷺ) একদা দু’টি কবরের
পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি বললেন, এ দু’জনকে কবরের মধ্যে আযাব দেয়া হচ্ছে, তবে বড় কোন
অপরাধের কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে ভালরূপে পবিত্রতা অর্জন
করত না, আর দ্বিতীয়জন চুগলখোরী করত অর্থাৎ একজনের কথা
অন্য জনের কাছে লাগাতো। অতঃপর নবী (ﷺ) একটি তাজা
খেজুরের শাখা নিয়ে দু’ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক কবরের উপরে একটি করে পুঁতে দিয়ে
বললেন, সম্ভবত খেজুরের শাখা দু’টি
শুকানোর পূর্ব পর্যন্ত তাদের কবরের আযাব হালকা করা হবে। এ হাদীছের মাধ্যমে জানা
যায় যে, আযাব কখনো হালকা করা হয়। তবে প্রশ্ন রয়ে যায় যে,
আযাব হালকা হওয়ার সাথে খেজুরের শাখার সম্পর্ক কি?
উত্তরে বলা যায় যে, খেজুরের শাখা তাজা
থাকাকালে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করবে। তাসবীহ মৃতের কবরের আযাব হালকা করে থাকে। এর
উপর ভিত্তি করে আযাব হালকা হওয়ার আশায় কেউ যদি কবরের পাশে তাসবীহ পাঠ করে, তাহলে জায়েয হবে না। কোন কোন আলেম বলেছেন, তাজা
খেজুরের শাখা তাসবীহ পাঠ করে বলে আযাব হালকা করা হয়, এই
কারণটি দুর্বল। তাজা বা শুকনো সকল বস্তই আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে থাকে। আল্লাহ
বলেনঃ
)تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ(
“সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁরই তাসবীহ
পাঠ করে অর্থাৎ- পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা ও
মহিমা ঘোষণা করে না।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪৪) রাসূল (ﷺ) পাথরের তাসবীহ
শুনতে পেতেন। অথচ পাথর জড় পদার্থের অন্তর্ভুক্ত। তাহলে আযাব হালকা করার মূল কারণ
কি?
উত্তরে বলা যায় যে, তিনি খেজুরের শাখা দু’টি সজিব থাকা পর্যন্ত কবরের আযাব হালকা করার জন্য দু’আ করেছিলেন। বুঝা গেল শাস্তি মুলতবী থাকার সময়সীমা বেশী দিন দীর্ঘ
ছিলনা। নবী (ﷺ) তাদের এ দু’টি কর্ম
মানুষকে সাবধান করার জন্যই এরকম করেছিলেন। কারণ তাদের কাজ দু’টি কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের একজন পেশাব থেকে ভালরূপে
পবিত্রতা অর্জন করতনা। অন্যজন মানুষের মাঝে ঝগড়া-ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের
কথা অন্যজনের কাছে লাগাতো। এটা করা কবীরা গুনাহ। নবী (ﷺ) তাঁর উম্মতকে
সতর্ক করার জন্য সাময়িক সুপারিশ করেছেন।
কতক আলেম বলেছেন, কবরের আযাব হালকা করার জন্য
কবরের উপরে খেজুরের শাখা অথবা গাছ পুঁতে রাখা সুন্নাত। কিন্তু এ ধরণের দলীল গ্রহণ
সঠিক নয়। কারণঃ-
১) এ কবরবাসীকে আযাব দেয়া হচ্ছে কি না তা আমরা জানিনা, কিন্তু
নবী (ﷺ) তা জানতে
পেরেছন।
২) আমরা যদি কবরের উপরে তা রাখি, তাহলে আমরা মৃতের উপরে খারাপ আচরণ ও
মন্দ ধারণা পোষণ করলাম। আমরা জানি না হতে পারে সে শান্তিতে আছে। হতে পারে আল্লাহ
তাআ’লা অনুগ্রহ করে মৃত্যুর পূর্বে তাকে তাওবা করার
তাওফীক দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাই সে আযাব থেকে রেহাই পেয়ে
গেছে।
৩) সালাফে ছালেহীনের কেউ কোন কবরের উপরে খেজুরের শাখা রাখতেন না। অথচ তারা
আল্লাহর শরীয়ত সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী ছিলেন।
৪) নবী (ﷺ) আমাদেরকে
খেজুরের শাখা পুঁতে রাখার চেয়ে ভাল জিনিষ শিক্ষা দিয়েছেন। মৃত ব্যক্তির দাফন সমাধা
করার পর তিনি বলতেনঃ
اسْتَغْفِرُوا لِأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ بِالتَّثْبِيتِ فَإِنَّهُ الْآنَ يُسْأَلُ
তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য
ঈমানের উপর অটল থাকার তাওফীক কামনা কর। কেননা তাকে এখনই জিজ্ঞাসা করা হবে।
উত্তরঃ শাফায়াত শব্দটির
আভিধানিক অর্থ মিলিয়ে নেয়া, নিজের সাথে একত্রিত করে নেয়া। শরীয়তের পরিভাষায় কল্যাণ
লাভ অথবা অকল্যাণ প্রতিহত করার আশায় অপরের জন্য মধ্যস্ততা করাকে শাফায়াত বলে।
শাফায়াত দু’প্রকার। যথাঃ-
প্রথমতঃ শরীয়ত সম্মত শাফায়াত। কুরআন ও সুন্নাহয় এ প্রকার শাফায়াতের বর্ণনা এসেছে।
তাওহীদপন্থীগণ এ ধরণের শাফায়াতের হকদার হবে। আবু হুরায়রা h নবী (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা
করলেনঃ
مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَدْ ظَنَنْتُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أَنْ لَا يَسْأَلُنِي عَنْ هَذَا الْحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الْحَدِيثِ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ
“কিয়ামতের দিন কোন্ব্যক্তি আপনার শাফায়াতের বেশী হকদার হবে? নবী (ﷺ) বললেন, হে আবু
হুরায়রা! তোমার হাদীছ শেখার আগ্রহ দেখে আমার ধারণা ছিল যে, তোমার পূর্বে এ বিষয় সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। যে ব্যক্তি অন্তর
থেকে ইখলাসের সাথে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে, কিয়ামতের
দিন সে ব্যক্তি আমার শাফায়াতের সবচেয়ে বেশী হকদার হবে। এ প্রকার শাফায়াতের জন্য
৩টি শর্ত রয়েছে।
১- শাফায়াতকারীর উপর আল্লাহর সন'ষ্টি থাকা।
২- যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তার উপরও আল্লাহর সন'ষ্টি
থাকা।
৩- শাফায়াতকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফায়াত করার অনুমতি থাকা।
আল্লাহ তাআ’লা এই শর্তগুলো কুরআন মজীদে উল্লেখ
করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ
)وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى(
“আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছেন, যাদের কোন সুপারিশ
ফলপ্রসু হয়না। কিন্তু আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন এবং যাকে শাফায়াত
করার অনুমতি দেন তার কথা ভিন্ন।” (সূরা নাজ্মঃ ২৬) আল্লাহ বলেনঃ
)مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ(
“কে এমন আছে যে, সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর
অনুমতি ছাড়া?” (সূরা বাকারাঃ ২৫৫) আল্লাহ বলেনঃ
)يَوْمَئِذٍ لَا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَانُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا(
“দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া
কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না।” (সূরা
ত্বো-হাঃ ১০৯) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنْ ارْتَضَى(
“তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন, যাদের
প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট।” (সূরা আন্বীয়াঃ ২৮) সুতরাং শাফায়াত
পাওয়ার জন্য উপরোক্ত তিনটি শর্ত থাকা আবশ্যক। এই শাফায়ত আবার দু’প্রকারঃ
১) সাধারণ শাফায়াতঃ সাধারণ শাফায়াতের অর্থ হল, সৎ বান্দাদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছা
এবং যার জন্য ইচ্ছা আল্লাহ শাফায়াত করার অনুমতি দিবেন। এই ধরণের শাফায়াত আল্লাহর
অনুমতি পেয়ে আমাদের নবী (ﷺ), অন্যান্য
নবী-রাসূল, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ
এবং নেককারগণ করবেন। তাঁরা পাপী মুমিনদেরেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বের করে আনার
ব্যাপারে সুপারিশ করবেন।
২) বিশেষ ও নির্দিষ্ট সুপারিশঃ এই ধরণের শাফায়াত নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)এর জন্য
নির্দিষ্ট। এই শাফায়াতের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল হাশরের মাঠের শাফায়াত। হাশরের মাঠে
মানুষ যখন বিপদে পড়ে যাবে এবং অসহনীয় আযাবে গ্রেপ্তার হবে, তখন তারা
একজন সুপারিশকারী খুঁজে ফিরবে। যাতে করে তারা এই ভীষণ সংকট থেকে রেহাই পেতে পারে।
প্রথমে তারা আদম (আঃ)এর কাছে গমণ করবে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা
(আঃ)এর কাছে যাবে। তাঁরা কেউ সুপারিশ করতে সাহস করবেন না। অবশেষে তারা নবী(ﷺ)এর কাছে আসবে।
তিনি মানুষকে এই বিপদজনক অবস্থা হতে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন।
আল্লাহ তাঁর দু’আ এবং শাফায়াত কবূল করবেন। এটিই হল সুমহান মর্যাদা, যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ
)وَمِنْ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا(
“আপনি রাত্রির কিছু অংশ জাগ্রত থেকে আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকুন। এটা
আপনার জন্য অতিরিক্ত (নফল ইবাদত)। আপনার পালনকর্তা অচিরেই আপনাকে সুমহান মর্যাদায়
অধিষ্ঠিত করবেন।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৭৯)
নবী (ﷺ) যে সমস্ত
সুপারিশ করবেন, তার মধ্যে জান্নাতবাসীদের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করানোর সুপারিশ অন্যতম।
জান্নাতবাসীগণ যখন পুলসিরাত পার হবে, তখন জান্নাত ও
জাহান্নামের মাঝখানে একটি সেতুর উপরে আটকানো হবে। সেখানে তাদের পারস্পরিক
জুলুম-নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। প্রতিশোধ নেয়া ও পারস্পরিক
জুলুম-নির্যাতন হতে পবিত্র করার পর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে এবং
মুহাম্মাদ (ﷺ)এর সুপারিশক্রমে
বেহেশতের দরজা খোলা হবে।
দ্বিতীয়তঃ শরীয়ত বিরোধী শাফায়াতঃ এধরণের শাফায়াত কোন কাজে আসবে না।
মুশরেকরা আল্লাহর নিকটে তাদের বাতিল মা’বূদদের কাছ থেকে এধরণের শাফায়াতের আশা
করে থাকে। অথচ এই শাফায়াত তাদের কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ(
“কোন সুপারিশকারীর সুপারিশ তাদের উপকারে আসবে না।” (সূরা
মুদ্দাস্সিরঃ ৪৮) কারণ আল্লাহ তাআ’লা
মুশরিকদের শির্কের উপরে সন্তুষ্ট নন। তাদের জন্য শাফায়াতের অনুমতি দেয়াও সম্ভব নয়।
আল্লাহ যার উপর সন্তুষ্ট হবেন, কেবল তার জন্যই সুপারিশ
বৈধ। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য ফাসাদ ও কুফরী পছন্দ করেন না। মুশরিকরা কি
যুক্তিতে মূর্তী পূজা করত তা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেনঃ
)هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ(
“এরা আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে।” (সূরা
ইউনুসঃ ১৮) সুতরাং মুশরিকরা তাদের বানোয়াট মূর্তিদের উপাসনা করার
পিছনে যুক্তি ছিল যে, মূর্তিরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। এটা
তাদের মূর্খতার পরিচয়। কারণ তারা এমন জিনিষের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের
চেষ্টা করে, যা তাদেরকে আল্লাহ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়।
প্রশ্নঃ (৫৭) মুমিনদের শিশু বাচ্চাদের পরিণাম কি? মুশরিকদের
যে সমস্ত শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে মৃত্যু বরণ করে, তাদের অবস্থা কি হবে?
উত্তরঃ মুমিনদের শিশু
সন্তানগণ তাদের পিতাদের অনুসরণ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ বলেনঃ
)وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ(
“যারা ঈমানদার এবং তাদের সন্তানরা ঈমানে তাদের অনুগামী, আমি তাদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আ‘মাল বিন্দুমাত্রও হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কর্মের জন্য দায়ী
হবে।” (সূরা তূরঃ ২১)
অমুসলিমদের নাবালক শিশুদের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ কথা হল, আমরা বলব আল্লাহই ভাল জানেন বড় হলে তারা কি আ‘মাল
করত। দুনিয়ার বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তারা তাদের পিতা-মাতাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর
আখেরাতে তাদের অবস্থা কি হবে আল্লাহই ভাল জানেন। নবী (ﷺ) থেকে এ কথাই
বর্ণিত হয়েছে। পরকালে তাদের কি হবে সেটা জানার ভিতরে আমাদের কোন লাভ নেই। দুনিয়াতে
তাদের বিধান হল, তারা প্রাপ্ত বয়স্ক মুশরিকদের মতই হবে। মারা গেলে তাদেরকে গোসল দেয়া
হবে না, কাফন পরানো হবে না, তাদের
উপর জানাযার স্বলাত পড়া হবে না এবং মুসলিমদের গোরস্থানে দাফন করা হবে না।
উত্তরঃ-জান্নাতীদের
নেয়ামত বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেনঃ
)وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (
“সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য
আছে, যা তোমরা দাবী কর।” (সূরা
হা-মীম সিজদাহঃ ৩১-৩২) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ(
“এবং তথায় রয়েছে মন যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা সেখানে চিরকাল
থাকবে।” (সূরা যুখরুফঃ ৭১)
ইহা জানা কথা যে, মন যা চায়, তার মধ্যে সর্বোত্তম হল বিবাহ করার মনোবাসনা। তা জান্নাতীদের জন্য
অর্জিত হবে। চাই পুরুষ হোক কিংবা মহিলা হোক। মহিলাকে আল্লাহ তাআ’লা জান্নাতে তাঁকে তাঁর দুনিয়ার স্বামীর সাথে বিবাহ দিয়ে দিবেন। যেমন
আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُم وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ(
“হে আমাদের পালনকর্তা! আর তাদেরকে প্রবেশ করাও চিরকাল বসবাসের জান্নাতে,
যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের বাপ-দাদা, পতি-পত্নী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে। নিশ্চয় আপনি
পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা
গাফেরঃ ৮) আর দুনিয়াতে যদি অবিবাহিত থাকে তাহলে জান্নাতে তার নয়
জুড়ানো কোন পুরুষের সাথে বিবাহের ব্যবস্থা করবেন।
উত্তরঃ জাহান্নামের
অধিকাংশ অধিবাসী হবে মহিলা- কথাটি ঠিক। কেননা নবী (ﷺ) একদা খুৎবা
প্রদানের সময় তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
)يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ فَإِنِّي أُرِيتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ فَقُلْنَ وَبِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ(
“হে নারী সমাজ! তোমরা বেশী করে সাদকা কর। কারণ আমি জাহান্নামের
অধিকাংশকেই দেখেছি তোমাদের মধ্যে থেকে। জাহান্নামের অধিকংশ অধিবাসী কেন মহিলাদের
মধ্যে থেকে হবে- এই প্রশ্ন নবী (ﷺ)কে করা হয়েছিল।
তিনি বলেছেন, তোমরা বেশী পরিমাণে মানুষের উপরে অভিশাপ করে থাক এবং স্বামীর সদাচরণ
অস্বীকার কর।” নবী (ﷺ) এই হাদীছে
নারীদের বেশী হারে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বর্ণনা করেছেন। তারা বেশী পরিমাণে
মানুষকে গালি-গালাজ করে, অভিশাপ করে, এবং স্বামীর
অকৃতজ্ঞ হয়।
তাকদীরের মাসআলা এড়িয়ে চলার
বিধান
প্রশ্নঃ (৬০) পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় যারা তাকদীরের
মাসআলাসহ আকীদার বিভিন্ন বিষয় পাঠ করা পছন্দ করেন না, তাদের
জন্য আপনার উপদেশ কি?
উত্তরঃ তাকদীরের বিষয়টি
আকীদার অন্যান্য মাসআলার মতই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের উচিৎ এ মাসআলাটি সম্পর্কে
পরিচ্ছন্ন ধারণা অর্জন করা। কেননা এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সন্দেহের উপর থাকা
ঠিক নয়। কিন্তু যে সমস্ত বিষয় না শিখলে অথবা বিলম্বে শিখলে পথ ভ্রষ্ট হওয়ার ভয়
রয়েছে, তা অবশ্যই শিখতে হবে। তাকদীরের মাসআলাটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,
যা ভালভাবে শিক্ষা করা প্রতিটি বান্দার উপর আবশ্যক। মূলতঃ
তাকদীরের মাসআলায় কোন সমস্যা নেই। মানুষের কাছে আকীদার আলোচনা কঠিন হওয়ার অন্যতম
কারণ হল, তারা আকীদা শিখতে গিয়ে ‘কিভাবে’ কথাটিকে ‘কেন’
কথার উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অথচ মানুষকে তার আ‘মালের ব্যাপারে দু’টি প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে
জিজ্ঞাসা করা হবে। কেন করলে এবং কিভাবে করলে। আ‘মালটি কেন
করেছো এটি হল ইখলাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা। আর কিভাবে করেছো এটি হল রাসূল (ﷺ)এর অনুসরণ
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ কিভাবে করেছো এটির উপর বেশী
গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কেন করতে হবে এ বিষয়টির প্রতি তেমন কোন গুরুত্বই দেয়না। রাসূল (ﷺ)এর অনুসরণের
ব্যাপারে খুঁটিনাটি বিষয় জানতে চায়। কিন্তু আকীদার বিষয়টির উপরে কোন গুরুত্ব
দেয়না। দুনিয়াবী বিষয়ে মানুষ খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। অথচ তার অন্তর
আল্লাহ (আক্বীদাহ, ইখলাছ ও তাওহীদের বিষয়) সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল। মূলতঃ
দেখা যায় কতিপয় মানুষ বর্তমানে দুনিয়া পূজারী হয়ে গেছে। অথচ সে টেরও পাচ্ছে না।
অনেক মানুষ আল্লাহর সাথে শির্কে লিপ্ত হয়েছে। অথচ সে অনুভবও করতে পারে না। আকীদার
বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেম সমাজ পর্যন্ত অনেকেই গুরুত্ব
প্রদান করে না। এ বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। অবশ্য বিনা আ‘মালে
শুধু মাত্র আকীদার উপরে গুরুত্ব দেয়াও ভুল। কারণ আ‘মাল হল
আকীদা সংরক্ষণের জন্য প্রাচীর স্বরূপ। আমরা রেডিও-টিভি এবং পত্র-পত্রিকায় শুনতে
পাই যে, পরিচ্ছন্ন আকীদাই হল দ্বীন। আ‘মাল না করে এভাবে শুধুমাত্র আকীদার উপরে গুরুত্ব দেয়াতে দ্বীনের কিছু
কিছু হারাম বিষয়কে হালাল করে নেয়ার আশংকা রয়েছে। এই যুক্তিতে যে, আকীদা ঠিক আছে।
মোট কথা এই যে, মানুষের উপর আকীদার বিষয়গুলো
শিক্ষা করা আবশ্যক। যাতে করে তারা আল্লাহর নাম, গুণাবলী
এবং কর্মক্ষমতা ও তাঁর বিধানাবলী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে পারে। নিজে
বিভ্রান্ত না হয় এবং অপরকে বিভ্রান্ত না করে। তাওহীদের জ্ঞান সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। এ
জন্য বিদ্বানগণ ইলমে তাওহীদকে ‘ফিকহে আকবার’ বা সর্বশ্রেষ্ঠ ফিক্হ বলে নাম রেখেছেন। নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
)مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ(
“আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান
দান করেন।” দ্বীনের জ্ঞানের মধ্যে তাওহীদের জ্ঞানের
গুরুত্ব সর্বপ্রথম। তাই মানুষের উপর আবশ্যক হল, এ বিষয়টির
উপর গুরুত্ব প্রদান করবে যে, কিভাবে সে তাওহীদের জ্ঞান
অন্বেষণ করবে এবং কোন উৎস থেকে তা অর্জন করবে। প্রথমে সন্দেহ মুক্ত ও সুস্পষ্ট
বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন করবে। অতঃপর বিদ্আত ও সন্দেহ পূর্ণ বিষয়গুলোর শিক্ষা অর্জন
করার পর সঠিক আকীদার আলোকে তার উত্তর দিবে। আকীদার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর জ্ঞান
অবশ্যই কুরআন, সুন্নাহ এবং ছাহাবীগণের বক্তব্য অতঃপর
তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীনে কেরাম এবং পরবর্তী যুগের নির্ভরযোগ্য
আলেমগনের লেখনী ও বক্তব্য থেকে গ্রহণ করতে হবে। তাদের মধ্যে থেকে শায়খুল ইসলাম
ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিমের নাম বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য।
মানুষ কি নিজ কর্ম সম্পাদনের ব্যাপারে স্বাধীন?
প্রশ্নঃ (৬১) সম্মানিত শায়খ! আশা করি তাকদীরের মাসআলা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। মানুষের মূল কাজ কি পূর্ব নির্ধারিত এবং কাজটি পালন করার নিয়মের ক্ষেত্রে মানুষ কি স্বাধীন? উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কোন মানুষের জন্য যদি লেখা থাকে যে, সে একটি মসজিদ বানাবে। সে অবশ্যই মসজিদ বানাবে। তবে কিভাবে বানাবে এ ব্যাপারে সে স্বাধীন। এমনিভাবে পাপ কাজ নির্ধারিত থাকলে তা অবশ্যই করবে। কিভাবে করবে তা নির্ধারিত হয়নি। মোট কথা মানুষের তাকদীরের যেসমস্ত কর্ম নির্ধারিত আছে, তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন কথাটি কি ঠিক?
উত্তরঃ তাকদীরের মাসআলা নিয়ে বহু দিন যাবৎ মানুষের মাঝে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এই জন্যই মানুষ তাকদীরের মাসআলাকে কেন্দ্র করে তিনভাগে বিভক্ত হয়েছে।
১) এক শ্রেণীর লোক বলে থাকে সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য অনুযায়ী সংঘটিত হয়। এতে মানুষের ব্যক্তিগত কোন স্বাধীনতা নেই। এদের মতে প্রচন্ড বাতাসের কারণে ছাদের উপর থেকে কোন মানুষ নীচে পড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছায় সিড়ি বেয়ে নেমে আসা একই রকম।
২) অন্য একদলের মতে মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক লিখিত ভাগ্যকে তারা সরাসরি অস্বীকার করে। তাদের মতে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন রূপে কর্ম সম্পাদন করে থাকে। ভাগ্য বলতে কিছু নেই।
৩) উভয় দলের মাঝখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা হল, তাঁরা আল্লাহ তাআ’লার নির্ধারিত তাকদীরে বিশ্বাস করেন। সাথে সাথে তারা কর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রে বান্দার স্বাধীনতাকে স্বীকার করেন। বান্দার কর্ম আল্লাহর নির্ধারণ এবং বান্দার নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ছাদের উপর থেকে বাতাসের চাপে মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার মাঝে মানুষ অবশ্যই পার্থক্য করতে জানে। প্রথমটিতে তার কোন ইচ্ছা ছিলনা এবং দ্বিতীয়টি তার ইচ্ছা অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু উভয় কাজ আল্লাহর ফায়সালা অনুযায়ীই সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহর রাজত্বে তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই সংঘটিত হয়না। বান্দা আপন ইচ্ছায় যা নির্ধারণ করে থাকে, তা সম্পর্কেই তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। শরীয়তের আদেশ-নিষেধ অমান্য করে তাকদীরের মাধ্যমে দলীল পেশ করার কোন সুযোগ নেই। কেননা শরীয়ত বিরোধী কর্মের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় সে আল্লাহর নির্ধারণ সম্পর্কে অবগত থাকে না। স্বেচ্ছায় পাপ কাজের প্রতি অগ্রসর হওয়ার কারণেই দুনিয়া বা আখেরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। কাউকে পাপ কাজের উপর বাধ্য করা হলে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। যেমন একজন অন্য জনকে জোরপুর্বক মদ পান করিয়ে দিলে মদপানকারীকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কারণ এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় সে পান করে নি। মানুষ ভাল করেই জানে যে, আগুন থেকে পালিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করা এবং বসবাসের জন্য সুন্দর ঘরবাড়ি নির্বাচন করা তার আপন পছন্দ অনুযায়ী হয়ে থাকে। সুন্দর ঘরবাড়ি নির্ধারণ এবং আগুন থেকে বাঁচার সুযোগ থাকা সত্বেও যে মানুষ সে সুযোগ গ্রহণ করেনি, তাকে সুযোগ নষ্ট করার জন্য তিরস্কার করা হয়। তবে কি জন্যে সে পরকালের আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার এবং জান্নাত আবশ্যককারী আ‘মালগুলো ছেড়ে দেয়াকে নিজের অপরাধ মনে করবে না?
বর্ণিত প্রশ্নে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যদি কারও তাকদীরে লিখে রাখেন যে, সে একটি মসজিদ বানাবে, সে অবশ্যই মসজিদটি বানাবে কিন্তু কিভাবে বানাবে সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন এই উদাহরণটি ঠিক নয়। কেননা তাতে ধারণা করা হয় যে, নির্মাণের পদ্ধতি সম্পূর্ণ বান্দার হাতে। এতে আল্লাহর কোন হাত নেই। সঠিক কথা এই যে, নির্মাণ করা এবং নির্মাণের পদ্ধতি সবই তাকদীরে নির্ধারিত। উভয়টি নির্বাচনে বান্দার স্বাধীনতা রয়েছে। তবে তাকে বাধ্য করা হয়নি। যেমনভাবে তাকে আপন ঘরবাড়ি নির্মাণ বা মেরামত করতে বাধ্য করা হয়নি। তাকদীর সম্পূর্ণ গোপন বিষয়। অহীর মাধ্যমে যাকে আল্লাহ অবগত করান সেই কেবল জানতে পারে। এমনিভাবে নির্মাণের পদ্ধতিও আল্লাহর নির্ধারণের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সমস্ত জিনিষের বিবরণ বিস্তারিতভাবে এবং সংক্ষিপ্তভাবে তাকদীরে লিখিত আছে।
আল্লাহ যে বিষয়ের ইচ্ছা করেন বা নির্ধারণ করেন, তা ব্যতীত বান্দার পক্ষে অন্য কিছু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। বরং বান্দা যখন কোন কিছু করে, তখন সে ভাল করেই জানে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সকল কর্ম সৃষ্টি ও নির্ধারণ করেন আর বান্দা প্রকাশ্যভাবে তা সম্পাদন করে। বান্দা যখন কর্ম সম্পাদন করে, তখন সে অনুভবই করতে পারে না যে, কেউ তাকে কাজটি করতে বাধ্য করছে। বাহ্যিক উপকরণের মাধ্যমে বান্দা যখন কাজটি করে ফেলে, তখন সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই তার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
প্রশ্নে বর্ণিত মানুষের পাপ কাজের যে উদাহরণ দেয়া হয়েছে, তাতে আমরা তাই বলব, যা আমরা মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে বলেছি। বান্দা কর্তৃক স্বেচ্ছায় কোন কাজ নির্বাচন করা আল্লাহর নির্ধারণের পরিপন্থী নয়। কেননা কাজ করার জন্য বান্দা যখন অগ্রসর হয়, তখন সে সেচ্ছায় কাজটি নির্বাচন করেই অগ্রসর হয় এবং সে জানে না যে, কেউ তাকে কাজ করার জন্য বাধ্য করছে। কিন্তু যখন সে করে ফেলে, তখন সে জানতে পারে যে, আল্লাহ তার জন্যে কাজটি নির্ধারণ করেছেন। এমনিভাবে পাপকাজে লিপ্ত হওয়া এবং তার প্রতি অগ্রসর হওয়া বান্দার নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এটি তাকদীরের খেলাফ নয়। আল্লাহই সকল কিছুর একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। সকল কর্ম বাস্তবায়নের উপকরণও তিনি সৃষ্টি করেছেন। বান্দার পক্ষ থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে সকল কাজ সংঘটিত হয়, তা সবই আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত। আল্লাহ বলেনঃ
)أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ(
“তুমি কি জাননা যে, আল্লাহ জানেন যা আকাশে ও জমিনে আছে। এসব কিতাবে লিখিত আছে। এটা আল্লাহর কাছে সহজ।” (সূরা হজ্বঃ ৭০) আল্লাহ বলেনঃ
)وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ(
“এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু হিসেবে সৃষ্টি করেছি মানুষ ও জিন শয়তানদের। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ প্রবঞ্চনা মূলক কথা-বার্তা শিক্ষা দেয়। যদি আপনার পালনকর্তা চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করতনা।” (সূরা আনআ’মঃ ১১২) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَكَذَلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٍ مِنْ الْمُشْرِكِينَ قَتْلَ أَوْلَادِهِمْ شُرَكَاؤُهُمْ لِيُرْدُوهُمْ وَلِيَلْبِسُوا عَلَيْهِمْ دِينَهُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ(
“এমনিভাবে অনেক মুশরেকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে। যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের ধর্মমতকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করতনা। অতএব, আপনি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যাচারিতাকে পরিত্যাগ করুন।” (সূরা আনআ’মঃ ১৩৭) আল্লাহ আরো বলেনঃ
)وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمْ الْبَيِّنَاتُ وَلَكِنْ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ(
“আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে পরিস্কার নির্দেশ এসে যাবার পর পয়গাম্বরদের পেছনে যারা ছিল তারা লড়াই করত না। কিন্তু তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের কেউ তো ঈমান এনেছে, আর কেউ হয়েছে কাফের। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা পরস্পরে লড়াই করতো না, কিন্তু আল্লাহ তাই করেন, যা তিনি ইচ্ছা করেন।”(সূরা বাকারাঃ ২৫২)
কোন মানুষের উচিৎ নয় যে, নিজের ভিতরে বা অন্যের ভিতরে এমন কোন জিনিষের অনুসন্ধান করা, যা অপরের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে এবং তাকদীরের মাধ্যমে শরীয়তের বিরোধীতা করার ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। ছাহাবীদের আ‘মাল এ রকম ছিলনা। অথচ তাঁরা সত্য জানতে ও উদ্ঘাটন করতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। ছহীহ বুখারীতে আলী বিন আবু তালেব h হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
]مَا مِنْكُمْ مِنْ نَفْسٍ مَنْفُوسَةٍ إِلَّا كُتِبَ مَكَانُهَا مِنَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ وَإِلَّا قَدْ كُتِبَ شَقِيَّةً أَوْ سَعِيدَةً فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نَتَّكِلُ عَلَى كِتَابِنَا وَنَدَعُ الْعَمَلَ فَمَنْ كَانَ مِنَّا مِنْ أَهْلِ السَّعَادَةِ فَسَيَصِيرُ إِلَى عَمَلِ أَهْلِ السَّعَادَةِ وَأَمَّا مَنْ كَانَ مِنَّا مِنْ أَهْلِ الشَّقَاوَةِ فَسَيَصِيرُ إِلَى عَمَلِ أَهْلِ الشَّقَاوَةِ قَالَ أَمَّا أَهْلُ السَّعَادَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ السَّعَادَةِ وَأَمَّا أَهْلُ الشَّقَاوَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ الشَّقَاوَةِ ثُمَّ قَرَأَ (فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى ) الْآيَةَ
“তোমাদের মধ্যে এমন কোন লোক নেই, যার ঠিকানা জান্নাতে অথবা জাহান্নামে লিখে দেয়া হয়নি। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমরা কি ভাগ্যের লেখার উপর ভরসা করে বসে থাকব না এবং আ‘মাল বর্জন করব না? নবী (ﷺ) বললেন, “না; বরং তোমরা আ‘মাল কর। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তিকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সে কাজ সহজ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে, তার জন্য সৌভাগ্যশীলদের আ‘মাল সহজ করে দেয়া হবে আর যে ব্যক্তি দুর্ভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে, তার জন্য দুর্ভাগ্যশীলদের আ‘মাল সহজ করে দেয়া হবে।” অতঃপর নবী (ﷺ) কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ
)فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى(
“অতএব, যে দান করে, আল্লাহ ভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্যায়ন করে। আমি তাকে সুখের বিষয়ের (জান্নাতের) জন্যে সহজ পথ দান করব। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে। আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের (জাহান্নামের) জন্যে সহজ পথ দান করব। (সূরা আল-লাইলঃ ৫-১০)”
উপরোক্ত হাদীছে নবী (ﷺ) ভাগ্যের লিখনের উপর নির্ভর করে আ‘মাল ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান, তা জানার কোন উপায় নেই এবং মানুষকে তার সাধ্যানুযায়ী আ‘মাল করার আদেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনবে এবং সৎ আ‘মাল করবে, তার জন্য কল্যাণের সহজ পথকে আরো সহজ করে দিবেন। এটিই ফলদায়ক ঔষধ। এর মাধ্যমেই বান্দা তার সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হবে এবং ঈমান আনার সাথে সাথে সৎ আ‘মাল করার জন্যে সদা স্বচেষ্ট থাকবে।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন সৎআ‘মাল করার তাওফীক দেন, ভাল পথ সহজ করে দেন, কঠিন পথ থেকে আমাদেরকে দূরে রাখেন এবং দুনিয়া-আখেরাতে ক্ষমা করেন।
উত্তরঃ সন্দেহ নাই যে, ভাগ্যের লিখন পরিবর্তনে দু’আর প্রভাব রয়েছে। তবে জেনে রাখা দরকার, পরিবর্তনটাও পূর্বে লেখা আছে যে, দু’আর মাধ্যমে অমুকের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। এই ধারণা যেন না হয় যে, আপনি ভাগ্যের কোন অলিখিত বস্ত পরিবর্তনের জন্যে দু’আ করছেন। সুতরাং দু’আ করবেন এটাও লেখা আছে। আর দু’আর মাধ্যমে যা অর্জিত হবে, তাও লিখিত আছে। এই জন্যই আমরা দেখতে পাই যে, রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করা হলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠে। নবী (ﷺ) একদল সৈনিক কোন একদিকে প্রেরণ করলেন। তাঁরা কোন এক গোত্রের নিকটে মেহমান হিসাবে উপস্থিত হলে গোত্রের লোকেরা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। রাতের বেলা সেই গোত্রের নেতাকে বিষাক্ত সাঁপে দংশন করল। তাকে ঝাড়ার জন্য কবিরাজ অনুসন্ধান করা হল। কিন্তু কোন কবিরাজ পাওয়া গেলনা। অবশেষে লোকেরা ছাহাবীদের নিকট এসে কবিরাজ অন্বেষণ করল। একজন সাহাবী বললেন, আমি ঝাড়-ফুঁক করতে রাজি আছি, তবে আমাকে বিনিময় দিতে হবে। তারা একশটি ছাগল দিতে রাজি হলে উক্ত সাহাবী রোগীকে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়-ফুঁক করলেন। ফলে রোগী এমনভাবে সুস্থ হয়ে উঠল মনে হয় যেন রশির বাঁধন হতে মুক্ত করা হল।
উক্ত হাদীছ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, রোগ মুক্তর জন্য ঝাড়-ফুঁক যথেষ্ট কার্যকর। দু’আর প্রভাব রয়েছে। তবে তাতে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না; বরং ভাগ্যে এটাও লেখা রয়েছে যে দু’আ করবে তার ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। সব কিছুই সংঘটিত হয় ভাগ্যের লিখন অনুযায়ী।
উত্তরঃ আল্লাহ তাআ’লা যেদিন কলম সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মাখলুকাত সৃষ্টি হবে, সবই লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাহ তাআ’লা কলম সৃষ্টি করে বললেন, লিখ। কলম বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি কি লিখব? আল্লাহ তাআ’লা বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সব লিখে ফেল। সে সময় কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু পৃথিবীর বুকে সংঘটিত হবে, কলম সব কিছুই লিখে ফেলল। নবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ভ্রুন মাতৃগর্ভে চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ তাআ’লা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। ফেরেশতা তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেন এবং লিখে দেন তার রিজিক, বয়স এবং তার কাজ অর্থাৎ সৌভাগ্যবান হবে না দুর্ভাগা হবে। রিজিক লিখা আছে এবং কিভাবে অর্জন করবে, তাও লিখা আছে। রিজিক অন্বেষণের সাথ সাথে রিজিক অন্বেষণের উপকরণও লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাহ বলেনঃ
)هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمْ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ(
“তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব তোমরা তাতে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিজিক আহার কর। তাঁরই কাছে পুনরুজ্জীবন হবে।” (সূরা মুলকঃ ১৫) রিজিক পাওয়ার এবং তা বৃদ্ধি হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হল, পিতা-মাতার সাথে সৎ ব্যবহার করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
)مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ(
“যে ব্যক্তি চায় যে, তার রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হোক এবং বয়স বাড়িয়ে দেয়া হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।” রিজিক বৃদ্ধির আরো মাধ্যম হল তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ(
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ বের করে দিবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দান করবেন।” (সূরা তালাকঃ ২-৩) এমন বলা যাবে না যে, রিজিক যেহেতু নির্ধারিত আছে, সুতরাং আমি এর উপকরণ অনুসন্ধান করব না। এটা বোকামীর পরিচয়। বুদ্ধিমানের পরিচয় হল রিজিক এর জন্য এবং দ্বীন্তদুনিয়ার কল্যাণ অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালানো। নবী (ﷺ) বলেছেনঃ
)الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ(
“বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের হিসাব নিল এবং পরকালের জন্য আ‘মাল করল। অক্ষম ও নির্বোধ সেই ব্যক্তি, যে নিজের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকল।” রিজিক যেভাবে লিপিবদ্ধ আছে, বিবাহ করাও নির্ধারিত রয়েছে। এই পৃথিবীতে কে কার স্বামী বা স্ত্রী হবে, তাও নির্দিষ্ট রয়েছে। আসমানজমিনের কোন কিছুই আল্লাহর কাছে গোপন নয়।
উত্তরঃ বালা-মুসিবত নাযিল হওয়ার সময় মানুষ চার স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। যথাঃ-
প্রথম স্তরঃ অসন'ষ প্রকাশ করা। এটি আবার কয়েক প্রকার।
১ম প্রকারঃ আল্লাহ যে বিষয় নির্ধারণ করেছেন, তার কারণে অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া। এটা হারাম। কারণ এধরণের অসন'ষ্টি কখনো কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَمِنْ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ(
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-সংকোচ নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা হজ্জঃ ১১)
২য় প্রকারঃ কখনো অসন'ষ্টি কথার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন হতাশা প্রকাশ করা এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দু’আ করা। এটাও হারাম।
তৃতীয় প্রকারঃ কখনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন গাল চাপড়ানো, জামা-কাপড় ছেড়া, মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাদি সবই হারাম এবং ধৈর্য্য ধারণের পরিপন্থী।
দ্বিতীয় স্তরঃ বিপদের সময় ধৈর্য্য ধারণ করা। যেমন কোন আরবী কবি বলেছেন ‘বিপদের সময় ধৈর্য ধারণ করা খুবই কঠিন। কিন্তু এর শেষ পরিণাম খুবই সুমধুর।’ কেননা এই সবর করাটা তার নিকট খুবই কঠিন তবুও সে সবর করে। বিপদগ্রস্ত হওয়াটা যেমন অপছন্দ করে তেমনি তাতে অসন'ষ্টি প্রকাশ করাটাও তার নিকট অপছন্দনীয়। কিন্তু তার ঈমান তাকে অসন'ষ্টি প্রকাশ থেকে বিরত রাখে। মোটকথা সে বিপদে আপতিত হওয়া এবং না হওয়াকে এক মনে করে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা ওয়াজিব। কারণ আল্লাহ তায়ালা বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ
)وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ(
“তোমরা ধৈর্য্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সূরা আনফালঃ ৪৬)
তৃতীয় স্তরঃ বিপদ আসার পর সন্তুষ্ট থাকা এবং মুসিবত আসা ও না আসা উভয়কেই সমান মনে করা। তাই বিপদ আসলেও তার কাছে বিপদ সহ্য করা বেশী কঠিন মনে হয় না। গ্রহণযোগ্যমতে এধরণের ছবর মুস্তাহাব। ওয়াজিব নয়। এটা এবং পূর্ববর্তী স্তরের মাঝে পার্থক্য অতি সুস্পষ্ট। বিপদ হওয়া এবং না হওয়া সমান মনে হওয়া সন্তুষ্ট থাকার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। এ প্রকারের এবং পূর্বের প্রকারের মাঝে পার্থক্য এই যে, পূর্বের প্রকারে বিপদে আপতিত ব্যক্তি বিপদকে কঠিন মনে এবং ধৈর্য্য ধারণ করে।
চতুর্থ স্তরঃ শুকরিয়া আদায় করা। এটা সর্বোচ্চ স্তর। তা এই যে, বিপদের সময় আল্লাহর প্রশংসা করা। কারণ সে ভাল করেই জানে যে, এ সমস্ত বিপদাপদ গুনাহ মোচন এবং ছাওয়াব বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। নবী (ﷺ) বলেন,
مَا مِنْ مُصِيبَةٍ تُصِيبُ الْمُسْلِمَ إِلَّا كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا عَنْهُ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا
অর্থঃ কোন মুসলিম বিপদাপদে পতিত হলে বিনিময়ে আল্লাহ তাআ’লা তার গুনাহ মোচন করেন। এমন কি শরীরে একটি কাঁটা বিধলেও তার বিনিময়ে গুনাহ মাফ করা হয়।
রোগ কি একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়?
প্রশ্নঃ (৬৫) সম্মানিত শায়খ! নবী (ﷺ)-এর বাণী, ( لا عدوى ولاطيرة ولا هامة ولا صفر ) “একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়না। পাখী উড়িয়ে বা পাখীর ডাক শুনে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণের নিয়ম ইসলামে নেই। সফর মাসকেও অশুভ মনে করাও ঠিক নয়। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চাই। হাদীছে বর্ণিত জিনিষগুলোর প্রভাবকে অস্বীকার করা হয়েছে। এগুলো কোন ধরণের অস্বীকার? নবী (ﷺ)এর বাণী, “কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন কর যেভাবে তুমি বাঘ থেকে ভয়ে পলায়ন কর”। এই হাদীছ ও প্রথমোক্ত হাদীছের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করব?
উত্তরঃ একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হওয়াকে আদ্ওয়া বলা হয়। শারীরিক রোগে যেমন এটা হয়, তেমনি চারিত্রিক রোগের ক্ষেত্রেও এমন হয়ে থাকে। এ জন্যই নবী (ﷺ) বলেছেন, অসৎ বন্ধু কামারের ন্যায়। সে হয়ত তোমার জামা পুড়িয়ে ফেলবে। তা না হলে কমপক্ষে তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।
কোন জিনিষ দেখে, কোন কথা শুনে বা জানার মাধ্যমে কুলক্ষণ মনে করাকে ‘ত্বিয়ারা’ বলা হয়।
‘হামাহ’ এর ব্যাখ্যা দু’ধরণ হতে পারে। ক) এমন রোগ, যা একজনকে আক্রমণ করে অন্যজনের নিকট সংক্রমিত হয়। খ) ‘হামাহ’ বলা হয়, আরবদের ধারণামতে এমন এক শ্রেণীর পাখিকে, যে গভীর রাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার পরিবারের লোকদেরকে ডাকাডাকি করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার উৎসাহ দেয়। কেউ কেউ ধারণা করে যে, এটি নিহত ব্যক্তির রূহ পাখির আকৃতি ধরে উপস্থিত হয়েছে। এই পাখিটিকে আমাদের পরিভাষায় হুতুম পেঁচা বলা হয়। তৎকালিন আরবরা এ পাখির ডাককে কুলক্ষণ মনে করত। কারো ঘরের পাশে এসে এ পাখি ডাকলে তারা বিশ্বাস করত যে, সে মৃত্যু বরণ করবে।
‘ছফর’ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (১) আরবী ছফর মাস। আরবরা এ মাসকে অকল্যাণের মাস মনে করত। (২) এটি উটের এক ধরণের রোগের নাম, যা এক উটের শরীর থেকে অন্য উটের শরীরে সংক্রমিত হয়। (৩) ছফর মাসকে আরবরা কখনো হারাম মাসের সাথে গণনা করত। আবার কখনো হালাল মাস হিসাবে গণ্য করত। এটি আরবদের গোমরাহী মূলক একটি আচরণ।
তবে উল্লেখিত ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে গ্রহণযোগ্য কথা হল, জাহেলী সমাজের লোকেরা ছফর মাসকে অমঙ্গলের মাস মনে করত। মূলতঃ কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণে সময় বা মাসের কোন প্রভাব নেই। ছফর মাস অন্যান্য মাসের মতই। তাতে কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর নির্ধারণ অনুযায়ীই হয়ে থাকে।
উপরে বর্ণিত ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করতে গিয়ে কোন কোন মানুষ যখন ছফর মাসে কোন কাজ সমাধা করে, তখন সেই তারিখ লিখে রাখে এবং বলে কল্যাণের মাস ছফর মাসের অমুক তারিখে কাজটি সমাধা হল। এটি এক বিদ্আত দ্বারা অন্য বিদ্আতের এবং এক অজ্ঞতা দ্বারা অন্য অজ্ঞতার চিকিৎসা করার শামিল। এটি কল্যাণের মাসও নয় এবং অকল্যাণের মাসও নয়। এই জন্যই কোন কোন বিদ্বান পেঁচার ডাক শুনে (خيرا ان شاء الله) “আল্লাহ চাহেতো ভাল হবে” এ কথা বলার প্রতিবাদ করেছেন। ভাল বা খারাপ কোন কিছুই বলা যাবে না। সে অন্যান্য পাখির মতই ডাকে।
উপরের চারটি বিষয়ের প্রভাবকে হাদীছে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় আল্লাহর উপর ভরসা করা সকল মু’মিনের উপর আবশ্যক। এতে ঈমান মজবুত হবে। এ সমস্ত কুসংস্কারের সামনে মুমিন ব্যক্তি কখনো দুর্বল হবে না।
কোন মুসলিম ব্যক্তি যখন এ সমস্ত বিষয়ের প্রভাবকে বিশ্বাস করবে, তখন নিম্নলিখিত দু’অবস্থার এক অবস্থা হতে পারেঃ
(১) সে হয়ত বিশ্বাস করে সামনের দিকে অগ্রসর হবে অথবা থেমে যাবে। এ অবস্থায় তার কর্মসমূহ এমন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করল, যার কোন প্রভাব নেই।
(২) কোন কিছু পরওয়া না করে কাজের প্রতি অগ্রসর হবে, কিন্তু মনের ভিতরে দুর্বলতা ও দুশ্চিন্তা থেকেই যাবে। কিন্তু এটি প্রথমটির চেয়ে হালকা। কারণ সে এ সমস্ত বিষয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকে।
কিছু কিছু মানুষ শুভ-অশুভ নির্ধারণ করার জন্য কুরআন মাজীদ খুলে থাকে। খুলে জাহান্নামের আলোচনা দেখতে পেলে লক্ষণ ভাল নয় বলে মনে করে। আর জান্নাতের আলোচনা দেখতে পেলে খুশী হয়। এটি জাহেলী যামানার লোকদের কাজের মতই। যারা জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করত।
নবী (ﷺ) উক্ত জিনিষগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি। কারণ এগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এগুলোর প্রভাবকে নবী (ﷺ) মেনে নেন নি। আল্লাহই সকল বস্তর উপর প্রভাব বিস্তারকারী। সুতরাং যদি জানা যায় যে, কোন বস্ত সংঘটিত হওয়াতে সঠিক কারণ রয়েছে, তাহলে তাকে কারণ হিসাবে বিশ্বাস করা বৈধ। কিন্তু নিছক ধারণা করে কোন ঘটনায় অন্য বস্তর প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কোন বস্ত নিজে নিজেই অন্য ঘটনার কারণ হতে পারে না। সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। নবী (ﷺ) বলেছেন, “অসুস্থ উটের মালিক যেন সুস্থ উটের মালিকের উটের কাছে অসুস্থ উটগুলো নিয়ে না যায়।” সুস্থ উটগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নবী (ﷺ) এ রকম বলেছেন। নবী (ﷺ) আরো বলেনঃ
فِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الْأَسَدِ
সিংহের ভয়ে তুমি যেমন পলায়ন কর, জুযাম (কুষ্ঠ) রোগী দেখেও তুমি সেভাবে পলায়ন কর। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নবী (ﷺ) কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। এখানে রোগের চলমান শক্তির কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে রোগ নিজস্ব ক্ষমতা বলে অন্যজনের কাছে চলে যায় তা অনিবার্য নয়। নবী (ﷺ) সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেনঃ
)وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ(
“তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা। (সূরা বাক্বারাঃ ১৯৫) এটা বলা যাবে না যে, নবী (ﷺ) রোগের সংক্রমন হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। কেননা বাস্তব অবস্থা ও অন্যান্য হাদীছের মাধ্যমে এ রকম ধারণাকে খন্ডন করা হয়েছে।
যদি বলা হয় যে, নবী (ﷺ) যখন বললেন, রোগ সংক্রামিত হয়না, তখন একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! মরুভূমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ উট বিচরণ করে। উটগুলোর কাছে যখন একটি খুজ্লিযুক্ত উট আসে, তখন সব উটই খুজ্লিযুক্ত হয়ে যায়। তিনি বললেন, প্রথম উটটিকে কে খুজ্লিযুক্ত করল?
উত্তর হল, নবী (ﷺ) এর উক্তি “প্রথমটিকে কে খুজ্লিযুক্ত করল?” এর মাধ্যমেই জবাব দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগের জীবানু অসুস্থ ব্যক্তির নিকট থেকে সুস্থ ব্যক্তির নিকট গমণ করে থাকে। তাই আমরা বলব যে, প্রথম উটের উপরে সংক্রামক ব্যতীত আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগ নাযিল হয়েছে। কোন ঘটনার পিছনে কখনো প্রকাশ্য কারণ থাকে। আবার কখনো প্রকাশ্য কোন করণ থাকে না। প্রথম উট খুজ্লিযুক্ত হওয়ার পিছনে আল্লাহর নির্ধারণ ব্যতীত অন্য কোন কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় উট খুজ্লিযুক্ত হওয়ার কারণ যদিও জানা যাচ্ছে, তথাপি আল্লাহ চাইলে খুজ্লিযুক্ত হত না। তাই কখনো খুজলিতে আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তীতে ভালও হয়ে যায়। আবার কখনো মারাও যায়। এমনিভাবে প্লেগ, কলেরা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেও একই কথা। একই ঘরের কয়েকজন আক্রান্ত হয়। কেউ মারা যায় আবার কেউ রেহাই পেয়ে যায়। মানুষের উচিৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা। বর্ণিত আছে যে, ‘একজন কুষ্ঠ রোগী লোক নবী (ﷺ)এর কাছে আসল। তিনি তার হাত ধরে বললেন, আমার সাথে খাও।’ আল্লাহর উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা থকার কারণেই তিনি তাকে খানায় শরীক করেছিলেন।
উপরের বিরোধপূর্ণ হাদীছগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য বিধানে যা বলা হল, তাই সর্বোৎকৃষ্ট। কেউ কেউ প্রশ্নের শেষোক্ত হাদীছকে মানসুখ বা রহিত বলেছেন। রহিত হওয়ার দাবী ঠিক নয়। কেননা রহিত হওয়ার অন্যতম শর্ত হল বিরোধপূর্ণ হাদীছের মধ্যে সমঝোতা করা সম্ভব না হওয়া। উভয় হাদীছের মধ্যে মিল দেয়া সম্ভব হলে উভয় হাদীছের উপর আ‘মাল করতে হবে। আর রহিত হওয়ার দাবী করলে এক পক্ষের হাদীছের উপর আ‘মাল বাতিল হয়ে যায়। এক পক্ষের হাদীছগুলো বাতিল করার চেয়ে উভয় পক্ষের হাদীছগুলোর উপর আ‘মাল করাই উত্তম।
বদ নজরের প্রকৃতি কি এবং তার চিকিৎসা কি?
প্রশ্নঃ (৬৬) মানুষের উপর কি বদ নজর লাগে? লাগলে তার চিকিৎসা কি? এ থেকে বেঁচে থাকা কি আল্লাহর উপর ভরসার পরিপন্থী?
উত্তরঃ বদ নজরের প্রভাব সত্য। আল্লাহ বলেনঃ
)وَإِنْ يَكَادُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَارِهِمْ(
“কাফেরেরা তাদের দৃষ্টির মাধ্যমে আপনাকে আছাড় দিয়ে ফেলে দিতে চায়।” (সূরা আল-কলমঃ ৫১) নবী (ﷺ) বলেনঃ
الْعَيْنُ حَقٌّ وَلَوْ كَانَ شَيْءٌ سَابَقَ الْقَدَرَ سَبَقَتْهُ الْعَيْنُ وَإِذَا اسْتُغْسِلْتُمْ فَاغْسِلُوا
“বদ নজরের প্রভাব সত্য। কোন জিনিষ যদি তাকদীরকে অতিক্রম করতে পারত, তাহলে বদ নজর তাকে অতিক্রম করত। তোমাদেরকে গোসল করতে বলা হলে তোমরা গোসল করবে এবং গোসলে ব্যবহৃত পানি দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করবে।” নাসাঈ এবং ইবনে মাজাহ্শরীফে বর্ণিত আছে যে, একদা আমের ইবনে রাবীয়া সাহল ইবনে হুনাইফের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলেন। সাহল ইবনে হুনাইফ h তখন গোসল করতে ছিলেন। আমের ইবনে রাবীয়া সাহলকে দেখে বলল, আমি আজকের মত লুকায়িত সুন্দর চামড়া আর কখনো দেখিনি। এ কথা বলার কিছুক্ষণ পর সাহ্ল অসুস্থ হয়ে পড়ে গেল। তাকে নবী (ﷺ) এর কাছে নিয়ে এসে বলা হল, সাহ্ল বদ নজরে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বললেন, তোমরা কাকে সন্দেহ করছ? তারা বলল, আমের ইবনে রাবীয়াকে। তখন নবী (ﷺ) বললেন, কেন তোমাদের কেউ তার ভাইকে হত্যা করতে চায়। কেউ যদি কারো মধ্যে ভাল কিছু দেখে, তাহলে সে যেন তার জন্য ভাই এর কল্যাণ কামনা করে এবং দু’আ করে। অতঃপর তিনি পানি আনতে বললেন এবং আমেরকে অযু করতে বললেন। অযুতে মুখমন্ডল, কনুই সহ উভয় হাত এবং হাটু পর্যন্ত এমনকি লুঙ্গীর নীচ পর্যন্ত ধৌত করে সাহলের শরীরে ঢালতে বললেন। কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় পানির পাত্র যেন পেছন থেকে ঢালে। এটি বাস্তব ঘটনা, যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
বদ নজরে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা হলঃ
(১) হাদীছে বর্ণিত দু’আগুলো পাঠ করে আক্রান্ত রোগীর উপর ঝাড়-ফুঁক করতে হবে। নবী (ﷺ) বলেনঃ
لَا رُقْيَةَ إِلَّا مِنْ عَيْنٍ أَوْ حُمَةٍ
“বদ নজর এবং বিচ্ছুর বিষ নামানোর ঝাঁড়-ফুঁক ব্যতীত কোন ঝাড়-ফুঁক নেই।” জিবরীল (আঃ) নবী (ﷺ)কে এই দু’আর মাধ্যমে ঝাড়তেন,
بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللَّهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ
“আমি আপনাকে আল্লাহর নামে ঝাড়-ফুঁক করছি প্রতিটি এমন জিনিষ হতে, যা আপনাকে কষ্ট দেয় এবং প্রত্যেক জীবের অমঙ্গল হতে ও হিংসুকের বদ নজর হতে আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আমি আপনাকে আল্লাহর নামে ঝাড়-ফুঁক করছি।”
(২) যার বদ নজর লাগছে বলে সন্দেহ করা হয়, তাকে গোসল করিয়ে গোসলের পানি রোগীর শরীরে ঢালতে হবে। যেমনভাবে নবী (ﷺ) আমের বিন রাবীয়াকে গোসল করতে বলেছিলেন। সন্দেহ যুক্ত ব্যক্তির পেশাব-পায়খানা বা অন্য কোন কিছু দিয়ে চিকিৎসা করার কোন দলীল নেই। অনুরূপভাবে তার উচ্ছিষ্ট বা অযুর পানি ইত্যাদি ব্যবহার করাও ভিত্তিহীন। হাদীছে যা পাওয়া যায় তা হল তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং লুঙ্গির নিচের অংশ ধৌত করা এবং সম্ভবতঃ মাথার টুপি, পাগড়ী বা পরিধেয় কাপড়ের নিচের অংশ ধৌত করা এবং তা ব্যবহার করাও বৈধতার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বদ নজর লাগার আগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়াতে কোন দোষ নেই। এটা আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থীও নয়। কারণ আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসার স্বরূপ হল বান্দা বৈধ উপকরণ অবলম্বন করে বদনজর ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে এবং সেই সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করবে। নবী (ﷺ) হাসান্তহুসাইন hকে এই বাক্যগুলো দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করতেনঃ
أُعِيْذُكُماَ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ
“আমি আল্লাহর কাছে তাঁর পরিপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে প্রতিটি শয়তান এবং বিষধর বস্ত ও কষ্ট দায়ক নযর হতে তোমাদের জন্য আশ্রয় চাচ্ছি।” নবী (ﷺ) বলেন, ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পুত্র ইসহাক এবং ইসমাঈল (আঃ)কে এই দু’আর মাধ্যমে ঝাড়-ফুক করতেন।
আপনি চাইলে -Whatapps-Facebook-Twitter-ব্লগ- আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking-ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন-মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]-:-admin by rasikul islam নিয়মিত আপডেট পেতে ভিজিটকরুন -এই ওয়েবসাইটে -https://sarolpoth.blogspot.com/(জানা অজানা ইসলামিক জ্ঞান পেতে runing update)< -https://rasikulindia.blogspot.com (ইসলামিক বিশুদ্ধ শুধু বই পেতে, পড়তে ও ডাউনলোড করতে পারবেন). Main Websaite- esoislamerpothe.in , comming soon my best world websaite
0 Comments