▌ফিতরা কি যাকাতের মতো ৮ খাতে বণ্টিত হবে?
·পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:
ফিতরা পাওয়ার হকদার কারা, বা ফিতরা কয় খাতে বণ্টিত হবে, তা নিয়ে ‘আলিমগণ দুটি প্রসিদ্ধ মতে মতানৈক্য করেছেন। যথা:
এক. ফিতরার খাত যাকাতের মতো। অর্থাৎ ফিতরা যাকাতের মতো ৮ খাতে বণ্টিত হবে। এই মতের স্বপক্ষে দলিল হলো সূরাহ তাওবাহ’র ৬০ নং আয়াত, যেখানে বলা হয়েছে সাদাক্বাহ তথা যাকাত ৮ খাতে বণ্টিত হবে। আর ফিতরাও যেহেতু এক ধরনের সাদাক্বাহ বা যাকাত, কিংবা ফিতরা যেহেতু যাকাতের মতো, তাই এটাও যাকাতের মতো ৮ খাতে বণ্টিত হবে। এটাই অধিকাংশ বিদ্বানের অভিমত। এটি হানাফী, শাফি‘ঈ ও হাম্বালী মাযহাবের মত। [কিতাবুল ফিক্বহি ‘আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আহ, পৃষ্ঠা: ৩৩৯; আদ-দারুল ‘আলামিয়্যাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৫ হি./২০১৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ); সাহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৫; আল-মাকতাবাতুত তাওফীক্বিয়্যাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সনতারিখ বিহীন]
দুই. ফিতরা পাওয়ার হকদার শুধু ফকির-মিসকীন। অর্থাৎ, ফিতরা যাকাতের মতো ৮ খাতে বণ্টিত হবে না। কেননা ফিতরা যাকাতের মতো নয়, আর ফিতরাকে ফরজ করা হয়েছে স্রেফ মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ। এটি মালিকী মাযহাবের মত এবং হাম্বালী মাযহাবের একটি অপ্রসিদ্ধ মত। এই মতটিকে পছন্দ করেছেন শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম-সহ আরও অনেক বরেণ্য ফাক্বীহ (রাহিমাহুমুল্লাহু আজমা‘ঈন)। [কিতাবুল ফিক্বহি ‘আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আহ, পৃষ্ঠা: ৩৪০; আদ-দারুল ‘আলামিয়্যাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৫ হি./২০১৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ); সাহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৫; আল-মাকতাবাতুত তাওফীক্বিয়্যাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সনতারিখ বিহীন]
·আমরা এ দুটি মতের মধ্যে মালিকী মাযহাবের মতটিকে প্রাধান্য দিই এবং এই মতটিকে সঠিক বলি। আর আমরা তা বলি বেশ কয়েকটি গ্রহণযোগ্য কারণে। তার মধ্যে কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করছি।
এক. রাসূল ﷺ মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ ফিতরাকে ফরজ করেছেন। তিনি অন্য কোনো খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য ফিতরাকে ফরজ করেননি। ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন,
فَرَضَ رَسُولُ اللهِ ﷺ زَكَاةَ الفِطرِ طُهرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغوِ وَالرَّفَثِ، وَطُعمَةً لِلمَسَاكِينِ.
“আল্লাহ’র রাসূল ﷺ রোজা অবস্থায় কৃত অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এবং মিসকীনদের আহারের সংস্থান করার জন্য ফিতরাকে ফরজ করেছেন।” [আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭; সনদ: হাসান]
এই হাদীসের দাবি হলো ফিতরা কেবল ফকির-মিসকীনকে দিতে হবে, অন্য কোনো খাতে দেওয়া যাবে না।
·
দুই. ফিতরা অনেকটা কাফ্ফারার মতো। যেহেতু রাসূল ﷺ রোজা অবস্থায় কৃত অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করার জন্য ফিতরাকে ফরজ করেছে। [প্রাগুক্ত] সুতরাং ফিতরার খাদ্য কেবল তাদেরকেই দিতে হবে, যারা কাফ্ফারা পাওয়ার হকদার। আর এটি সুবিদিত যে, কাফ্ফারা পাওয়ার হকদার কেবল ফকির-মিসকীন। [সাহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৫; আল-মাকতাবাতুত তাওফীক্বিয়্যাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সনতারিখ বিহীন]
·তিন. রাসূল ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ কখনো আট খাতে ফিতরা বণ্টন করেছেন মর্মে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যেমনটি বলেছেন ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)। [ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ), যাদুল মা‘আদ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২১; মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি. (৩য় প্রকাশ)]
·চার. সূরাহ তাওবাহ’র ৬০ নং আয়াত থেকে যে দলিল গ্রহণ করা হয়, তা সঠিক নয়। আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় সাদাক্বাহ হচ্ছে ফকির-মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহ’র রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে।” [সূরাহ তাওবাহ: ৬০]
এ আয়াত থেকে দলিল গ্রহণ করে বলা হয়, যেহেতু ফিতরাও সাদাক্বাহ এবং যাকাতের সাথে এর মিল রয়েছে, সেহেতু ফিতরাকে ৮ খাতে বণ্টন করতে হবে। [আল-মুগনী, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩১৫] তাঁদের এ কথার জবাবে আমরা বলব—
প্রথমত, সাদাক্বাহ মাত্রই যদি তা আট খাতে বণ্টন করতে হয়, তাহলে অন্যান্য সাধারণ দানকেও নির্ধারিত আট খাতে বণ্টন করা জরুরি হয়ে যায়। যেমনটি বলেছেন ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ)। [ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ), আস-সাইলুল জাররার; পৃষ্ঠা: ২৬৮; দারু ইবনি হাযম, বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
দ্বিতীয়ত, যাকাতের সাথে ফিতরার অনেক পার্থক্য রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি পার্থক্যের কথা বলি। (ক) যাকাত বছরের যে কোনো সময় ফরজ হতে পারে, কিন্তু ফিতরা কেবল রমজানের শেষেই ফরজ হয়। (খ) যাকাত কেবল ধনীদের ওপর ফরজ হয়, কিন্তু ফিতরা ধনী-গরীব সবার ওপর ফরজ হয়। (গ) যাকাত দেওয়া হয় টাকা দিয়ে, কিন্তু ফিতরা দিতে হয় খাদ্যদ্রব্য দিয়ে।
এখন আমরা আমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া মতটির স্বপক্ষে আহলুস সুন্নাহ’র ‘আলিমদের কিছু বক্তব্য পেশ করব। ওয়া বিল্লাহিত তাওফীক্ব।
·১. হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন,
وَلَا يَجُوزُ دَفْعُ زَكَاةِ الفِطْرِ إِلَّا لِمَن يَسْتَحِقُّ الكَفَّارَةُ، وَهُو مَن يَأْخُذُ لِحَاجَتِهِ لَا فِي الرِّقَابِ وَالمُؤَلَّفَةِ وَغَيرِ ذَلِكَ.
“যে কাফ্ফারা পাওয়ার হকদার (তথা ফকির-মিসকীন), সে ছাড়া অন্য কাউকে ফিতরা প্রদান করা জায়েজ নয়; আর সে-ই তো মিসকীন, যে নিজের প্রয়োজনে (ফিতরা) গ্রহণ করে থাকে। ফিতরা মুআল্লাফাতুল ক্বুলূব (দ্বীনের ব্যাপারে যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য), দাস মুক্তকরণ ও অন্যান্য খাতে দেওয়া হবে না।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-ইখতিয়ারাত; পৃষ্ঠা: ২৮২; গৃহীত: rslan.com]
·২. আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
وكان من هديه ﷺ تخصيص المساكين بهذه الصدقة، ولم يكن يقسمها على الأصناف الثمانية قبضة قبضة، ولا أمر بذلك، ولا فعله أحد من أصحابه، ولا من بعدهم، بل أحد القولين عندنا: أنه لا يجوز إخراجها إلا على المساكين خاصة، وهذا القول أرجح من القول بوجوب قسمتها على الأصناف الثمانية.
“আর মিসকীনদের জন্য এই সাদাক্বাহ তথা ফিতরাকে নির্দিষ্ট করা রাসূল ﷺ এর আদর্শের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি ফিতরাকে মুষ্টি মুষ্টি করে আট খাতে বণ্টন করেননি এবং এ কাজের নির্দেশও দেননি। অনুরূপভাবে তাঁর সাহাবীবর্গ ও তাঁদের পরবর্তীদের কেউ এ কাজ করেননি। বরং এ ব্যাপারে দুটি মতের মধ্যে আমাদের অভিমত হলো—নির্দিষ্টভাবে মিসকীনরা ছাড়া অন্য কাউকে ফিতরা প্রদান করা জায়েজ নয়। আট খাতে ফিতরা বণ্টনের মতটির চেয়ে এই মতটিই অধিক অগ্রগণ্য।” [ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ), যাদুল মা‘আদ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২১; মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি. (৩য় প্রকাশ)]
·
৩. আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ‘আলী আশ-শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১২৫০ হি.] বলেছেন,
هذه زكاة خاصة لطهرة الصائم من اللّغو والرّفث ولإغناء الفقراء في ذلك اليوم، فمصرفها الفقراء، والولاية في الصرف لمن عليه الفطرة. ولم يرد ما يدل على أن الولاية للإمام، ولا يصح التمسك بعموم ﴿إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ ...﴾ [التوبة: ٦٠] الآية، وإلا لزم أن صدقة التطوع يكون مصرفها الثمانية الأصناف.
“এই যাকাত রোজা অবস্থায় কৃত অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করার সাথে এবং ওই দিন (ঈদের দিন) ফকিরদেরকে যাচ্ঞা করা থেকে অমুখাপেক্ষী করার সাথে খাস। সুতরাং এর খাত হলো—ফকির ব্যক্তিবর্গ। আর যার ওপর ফিতরা ফরজ, ফিতরা বণ্টনের জিম্মা তার ওপরই অর্পিত। এমন কোনো দলিল বর্ণিত হয়নি, যা ফিতরা বণ্টনের জিম্মা শাসকের ওপর অর্পিত—প্রমাণ করে। আর সূরাহ তাওবাহ’র ৬০ নং আয়াতের—নিশ্চয় সাদাক্বাহ এই আটটি খাতে বণ্টিত হবে মর্মের আয়াতটি—ব্যাপকতা গ্রহণ করা ঠিক নয়। নতুবা নফল সাদাক্বাহও আট খাতে বণ্টন করা জরুরি হয়ে পড়বে।” [ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ), আস-সাইলুল জাররার; পৃষ্ঠা: ২৬৮; দারু ইবনি হাযম, বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
·
৪. সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ও মুহাদ্দিস শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,
ومصرفها الفقراء والمساكين. لما ثبت عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: «فرض رسول الله ﷺ زكاة الفطر طهرة للصائم من اللغو والرفث وطعمة للمساكين».
“ফিতরার খাত হলো ফকির-মিসকীন। যেহেতু ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ’র রাসূল ﷺ রোজা অবস্থায় কৃত অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এবং মিসকীনদের আহারের সংস্থান করার জন্য ফিতরাকে ফরজ করেছেন।” (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭; সনদ: হাসান)” [ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২০২; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরী (১ম প্রকাশ)]
·
৫. বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ আল-মুজাদ্দিদ আল-ফাক্বীহুন নাক্বিদ ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,
لَيْسَ فِي السُّنَّةِ العَمَلِيَّةِ مَا يَشْهَدُ لِهَذَا التَّوزِيع، بَل قَوْلُهُ ﷺ فِي حَدِيثِ ابنِ عَبَّاسٍ: «... وَطُعْمَةً للمَسَاكِينِ»؛ يُفِيدُ حَصْرَهَا بِالمَسَاكِينِ. والآيَةُ إِنَّمَا هِي فِي صَدَقَاتِ الأموَالِ لَا صَدَقَةِ الفِطْرِ، بِدَلِيلِ مَا قَبْلَهَا، وَهُو قَوْلُهُ تَعَالَى: ﴿وَمِنْهُم مَّن يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُواْ مِنْهَا رَضُواْ﴾ [التوبة: ٥٨].
“আমলগত সুন্নাতে (অর্থাৎ, রাসূল ﷺ এর আমলে) এমন কিছু নেই, যা এভাবে বণ্টন করার স্বীকৃতি দেয়। বরং ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বর্ণিত হাদীসে রাসূল ﷺ বলেছেন, “...মিসকীনদের আহারের সংস্থানের জন্য (ফিতরা ফরজ করেছেন)”; যা ফিতরাকে স্রেফ মিসকীনদের জন্য নির্দিষ্ট হওয়ার ফায়দা দেয়।
আর এ সম্পর্কিত আয়াতটি (সূরাহ তাওবাহ’র ৬০ নং আয়াত) স্রেফ মালের সাদক্বাহ’র (যাকাত) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ফিতরার সাদক্বাহ’র ক্ষেত্রে নয়। এ কথার দলিল উল্লিখিত আয়াতটির পূর্বেই রয়েছে, আর তা হলো মহান আল্লাহর বাণী—“তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা সাদাক্বাহ (বণ্টনের) ব্যাপারে তোমার প্রতি দোষারোপ করে, তা থেকে তাদেরকে দেওয়া হলে তারা খুশি হয়।” (সূরাহ তাওবাহ: ৫৮)” [ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ), তামামুল মিন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৩৮৭-৩৮৮; দারুর রাইয়াহ কর্তৃক প্রকাশিত; সনতারিখ বিহীন]
·
৬. বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে ফিতরা বণ্টনের খাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
ليس لها إلا مصرف واحد وهم الفقراء، كما في حديث ابن عباس رضي الله عنهما قال: «فرض رسول الله ﷺ زكاة الفطر طهرة للصائم من اللغو والرفث وطعمة للمساكين».
“ফিতরার কেবল একটি খাত রয়েছে। আর তা হলো ফকির ব্যক্তিবর্গ। যেমন ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)’র হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ’র রাসূল ﷺ রোজা অবস্থায় কৃত অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এবং মিসকীনদের আহারের সংস্থান করার জন্য ফিতরাকে ফরজ করেছেন।” (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭; সনদ: হাসান)” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৫৯; দারুস সুরাইয়্যা, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
·
৭. সৌদি ফাতাওয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেছেন,
وفي قوله «وَطُعْمَةً للمَسَاكِينِ»، دليل على مصرف صدقة الفطر، وأنها تصرف للفقراء خاصة، ولا تصرف لغيرهم من مصارف الزكاة الثمانية، وإنما تصرف للفقراء خاصة، لقوله «إنها طعمة للمساكين» يعني الفقراء.
“হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল ﷺ মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ ফিতরাকে ফরজ করেছেন। এই কথাটি ফিতরার খাতের দলিল। উক্ত কথা প্রমাণ করে যে, ফিতরাকে নির্দিষ্টভাবে ফকিরদের খাতেই বণ্টন করতে হবে, ফকির ব্যতিরেকে অন্য খাতে তথা যাকাতের আট খাতের অবশিষ্টগুলোতে বণ্টন করা হবে না। বরং ফিতরাকে নির্দিষ্টভাবে কেবল ফকিরদের খাতেই বণ্টন করতে হবে। যেহেতু ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেছেন, ‘এটি মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ (ফরজ করা হয়েছে)।’ অর্থাৎ, ফকিরদের আহারের সংস্থানের জন্য ফরজ করা হয়েছে।” [ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), তাসহীলুল ইলমাম বি ফিক্বহিল আহাদীসি মিন বুলূগিল মারাম; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৫০; প্রকাশকাল: ১৪২৭ হি./২০০৬ খ্রি. (১ম প্রকাশ); প্রকাশনার নামবিহীন]
·
৮. আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-ফাক্বীহ, ড. মুহাম্মাদ ‘আলী ফারকূস (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৭৪ হি./১৯৫৪ খ্রি.] বলেছেন,
والثاني: أنَّ زكاةَ الفطرِ خاصَّةٌ بالفُقَراءِ والمساكينِ ولا تُصْرَفُ إلَّا إليهم، وهو مذهبُ المالكيةِ والحنابلةِ على قولٍ، واختارَهُ ابنُ تيمية –رحمه الله–، وهو الراجحُ لمُناسَبتِه لمشروعيةِ زكاةِ الفطر، واختصاصِها بالفُقَراءِ والمساكينِ على وجه الحصر في حديثِ ابنِ عبَّاسٍ رضي الله عنهما، وفيه: «وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ».
“দ্বিতীয়ত, ফিতরা শুধু ফকির-মিসকীনের সাথে খাস, তারা ব্যতীত অন্য কারও মধ্যে তা বণ্টন করা হবে না। এটি মালিকীদের মত এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী হাম্বালীদের মত। এই মতটি পছন্দ করেছেন ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)। এটিই অগ্রগণ্য মত। যেহেতু এই মতটি ফিতরা বিধিবদ্ধ হওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর যেহেতু ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)’র হাদীসে ফিতরাকে ফকির-মিসকীনের সাথে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সীমাবদ্ধতার ভঙ্গিতে। হাদীসটিতে বলা হয়েছে, ‘মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ (ফিতরাকে ফরজ করা হয়েছে)’।” [শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)’র “যাকাতুল ফিতর: মাসাইল ওয়া আহকাম”– শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে; প্রবন্ধের লিংক: https://ferkous.com/home/
·
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হলো যে, ফিতরাকে যাকাতের মতো আট খাতে বণ্টন করা যাবে না, বরং ফিতরাকে কেবল অভাবী লোকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বিষয় জানার এবং তা মানার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।
·
একটি গুরুত্বপূর্ণ অবগতি:
অনেক ভাই না জানার কারণে একটা সংশয়ে পতিত হন যে, “হাদীসে তো শুধু মিসকীনদের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে ‘... ফিতরা মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ ফরজ করা হয়েছে’, অথচ আপনারা বণ্টনের খাত বর্ণনা করার সময় ফকির-মিসকীন উভয় শ্রেণির কথা বলছেন!”
এই সংশয়ের জবাব—
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “যখন মিসকীনের কথা উল্লেখ না করে শুধু ফকিরের কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তা মিসকীনকেও শামিল করে। আবার যখন ফকিরের কথা উল্লেখ না করে শুধু মিসকীনের কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তা ফকিরকেও শামিল করে। আর যখন শব্দ দুটো একত্রে উল্লিখিত হয়, তখন দুটোর অর্থ আলাদা আলাদা হয়। তখন ফকির শব্দের দ্বারা মিসকীনের চেয়ে বেশি অভাবী ব্যক্তিকে বুঝানো হয়।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), ফাতহু যিল জালালি ওয়াল ইকরাম; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৯৫; আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৭ হি./২০০৬ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
আর ফকির মিসকীনের পরিচয় দিতে গিয়ে যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, “ফকির ওই ব্যক্তি, যার পুরো বছর চলার মতো রসদ নেই, অথবা থাকলেও অল্প কিছু আছে; তাহলে তাকে পুরো বছরের রসদ প্রদানের নিমিত্তে যাকাত দেওয়া হবে। আর মিসকীন ওই ব্যক্তি, যার পুরো বছর চলার মতো অর্ধেক রসদ আছে বা অর্ধেকের কিছু বেশি আছে, অর্থাৎ তার অবস্থা ফকিরের চেয়ে কিছু ভালো; তাহলে তাকে তার গোটা বছরের রসদ পূর্ণ করার জন্য যাকাত দেওয়া হবে।” [ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), শারহু যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩১৯; দারুল ‘আসিমাহ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৪ হি./২০০৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
·অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/
0 Comments