▌আহলুস সুন্নাহর তাকদির বিশ্বাস [প্রশ্নোত্তর পর্ব]


 আহলুস সুন্নাহর তাকদির বিশ্বাস [প্রশ্নোত্তর পর্ব]

·উত্তর প্রদানে: আল্লামা সালিহ বিন আব্দুল আযিয আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ)
·[
১]. প্রশ্ন: আল্লাহ তাকদির নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাহলে সেসব হাদিসের ব্যাপারগুলো কেমন হবে, যেসব হাদিসে বলা হয়েছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে হায়াত বৃদ্ধি পায়? অনুরূপভাবে দোয়ার ক্ষেত্রে যা বর্ণিত হয়েছে (দোয়ার মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তিত হয়), সেসব বর্ণনার কী হবে?

উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন, আবার যা ইচ্ছা বহাল রাখেন। আর মূলগ্রন্থ তাঁর কাছেই আছে।” [সুরা রা‘দ: ৩৯] তিনি বলেছেন, “আর মূলগ্রন্থ তাঁর কাছেই আছে।” অর্থাৎ লাওহে মাহফুজ। আর লাওহে মাহফুজে যা আছে, তা কখনো পরিবর্তন হবে না। সেখানে যা আছে তা হবেই।

আর যখন আল্লাহ ফেরেশতাকে আপনার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন ফেরেশতা একটি ‘কিতাব’ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি এর মধ্যে আপনার বয়স লিখে রেখেছেন। এরপর যখন আপনি সৎকর্ম করবেন, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখবেন, নবি যা বলেছেন তা করবেন, তখন আপনার পরিণাম পরিবর্তিত হবে, এবং হায়াত বেড়ে যাবে। কেননা আল্লাহ ফেরেশতাদের কিতাবে যা আছে তা মিটিয়ে দিবেন এবং ভিন্ন সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবেন। আল্লাহ ওই কিতাবে আপনার শেষ পরিস্থিতি যা নির্ধারণ করেছেন, তার ভিত্তিতেই ফেরেশতাবর্গ আপনার জান কবজ করবেন।

পক্ষান্তরে লাওহে মাহফুজেমূলগ্রন্থেযা রয়েছে, তা কখনো পরিবর্তিত হবে না। আর ফেরেশতাদের কাছে যে কিতাব আছে, সে ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন, আবার যা ইচ্ছা বহাল রাখেন।” তদনুরূপ দোয়ার মাধ্যমেও একই ব্যাপারটি হয়। এছাড়া যেসব হাদিসে তাকদির পরিবর্তনের কথা এসেছে, তা দ্বারা মূলত ফেরেশতাদের হাতে থাকা লিখিত কিতাব পরিবর্তনের কথাই বুঝানো হয়েছে। আর লাওহে মাহফুজের লেখায় কোনো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হবে না।

·
[
২]. প্রশ্ন: কেউ যদি দোয়া করে, ‘হে আল্লাহ আমরা তোমার কাছে তাকদিরের পরিবর্তন চাই না, বরং আমরা তাতে শুধু তোমার দয়া বা কোমলতা চাইছি,’ তাহলে কি তার দোয়া বিশুদ্ধ হবে? আর এর অর্থই বা কী?

উত্তর: এই দোয়ার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আমার জানা নেই। তবে দোয়ার অর্থ কখনো কখনো সঠিক হতে পারে। কেননা আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা ওয়াজিব। এটা যদি ওয়াজিব হয়ে থাকে, তাহলে তার পরিবর্তন না চাওয়াই বাঞ্ছনীয়। এটা তাকদিরের ওপর পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকার আওতাভুক্ত। কিন্তু সে আল্লাহর কাছে চাইতে পারে, তার তাকদিরে যেন দয়া করা হয়। আর আল্লাহ দয়াবান-সূক্ষ্মদর্শী এবং সর্ব বিষয়ে অবহিত। মহান আল্লাহর ‘আল-লাতিফ (সূক্ষ্মদর্শী/দয়াবান)’ নামের যথার্থতা হচ্ছে, তিনি বান্দার জন্য ভালো-মন্দের ফায়সালার ক্ষেত্রে দয়ালু ও সূক্ষ্মদর্শী হবেন।

ফায়সালা যদি আপনাকে স্পর্শ করে দয়া ও অনুগ্রহের সাথে, আর আপনি নিজেও সে ফায়সালার প্রতি কোমল থাকেন, তাহলে আপনার ওপর ফায়সালা আসবে প্রশান্তি ও দৃঢ়তা নিয়ে, আর আপনি সে ফায়সালার প্রতি বিশ্বাসী ও সন্তুষ্ট থাকবেন। জ্ঞাতব্য যে, ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকার পাশাপাশি তাকদিরের ওপরও সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটা অত্যাবশ্যক ফরজ কাজ। যেহেতু এটি (তাকদির-ফায়সালা) আল্লাহর কর্ম। আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরের ব্যাপারে আপত্তি তোলা কিংবা তা অপছন্দ করার অধিকার কারও নেই।

বলা বাহুল্য, অনেক বাস্তবায়িত ফায়সালারযেমন রোগাক্রান্ত হওয়া, সম্পদের বিনাশ প্রভৃতিপ্রতি কেউই সন্তুষ্ট থাকে না। কিন্তু যদি এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এই রোগাক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি আল্লাহর কর্ম, আল্লাহরই ফায়সালা, তাহলে আপনি এতে সন্তুষ্ট থাকবেন এবং এই পরিণতি মেনে নিবেন। এ কাজ ওয়াজিব। কেননা উক্ত ফায়সালা আল্লাহর কাজ। আর আপনি বান্দা হয়ে আল্লাহর কাজের প্রতি আপত্তি পেশ করতে পারেন না।

পক্ষান্তরে যে রোগ আপনাকে পীড়া দিচ্ছে, সেটা মাখলুক। আর এ মাখলুককে আপনি কখনো কখনো অপছন্দ করতে পারেন। এতে আল্লাহর ফায়সালার প্রতি আপনার ইমানের কোনো ক্ষতি হবে না। আরোপিত বিষয়ের (বিপদআপদ) ওপর পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট থাকা সালিহিন তথা বুজুর্গ লোকদের স্তর। তাঁরা সমস্ত বিষয়ের ওপর সন্তুষ্ট থাকেন। এ স্তর সবার জন্য নয়। তাই যে ব্যক্তি বিপদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে, তার পাপ হয় না। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালাকে অপছন্দ করলে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়। কারণ ফায়সালা যে আল্লাহর কাজ। আর আল্লাহর কোনো কাজকে অপছন্দ করার অধিকার কারও নেই।

·
[
৩]. প্রশ্ন: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসুল বলেছেন, ‘ওই সত্তার কসম, যিনি ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই, নিশ্চয় তোমাদের কেউ জান্নাতি আমল করে, এমনকি তার মাঝে আর জান্নাতের মাঝে এক বিঘত পরিমাণ অবশিষ্ট থাকে, এমন সময় তার কিতাব (ভাগ্য) এগিয়ে আসে, ফলে সে জাহান্নামী হয়ে যায়।’ এ হাদিসের ব্যাখ্যা কী?

উত্তর: আমি আপনাদের স্পষ্ট করে বলেছি, তাকদির পূর্বেই নির্ধারিত হয়েছে এবং কিতাবও, যা আল্লাহর জ্ঞান অনুযায়ী বান্দার জন্য অনেক পূর্বে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে; যাতে বলা আছে, আপনার এ পরিণাম অবশ্যই ঘটবে। আল্লাহ জানেন, আপনি শুরু-জীবনে আল্লাহর আনুগত্য করবেন। আনুগত্যের এ বিষয়টি লিখিত আছে। আর আপনি শেষ জীবনে অবাধ্য হবেন, তাও আল্লাহ জানেন এবং এটা কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এখন আপনার কিতাবে যা লেখা আছে, তা-ই আসবে, কেননা তা আল্লাহ জানেন। আর কিতাব লিপিবদ্ধ হয়েছে আল্লাহর জ্ঞানের পর। আল্লাহর জ্ঞান আদি ও চিরন্তন, যার কোনো শুরু নেই। আপনার ক্ষেত্রে যা ঘটবে তা আল্লাহ জানেন।

তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী আপনি ভালো কাজ করবেন। আর আপনার পরিণাম হিসেবে দুর্ভাগ্য লেখা থাকলে আপনি অচিরেই দুর্ভাগা হবেন এবং ভ্রষ্টতার পথ বেছে নিবেন। ভ্রষ্টতার পথ বেছে নেওয়ার ব্যাপারটিও আপনার নিজের এখতিয়ারে হবে। ওই পথে সে ঝুঁকে পড়বে এবং ওতেই তার শেষ পরিণতি হবে। এটাও লাওহে মাহফুজে লেখা আছে। কেননা আপনার আগে-পরের কাজ সম্পর্কে আল্লাহ জানেন।

তদনুরূপ ভ্রষ্ট কাফেরের শেষ পরিণতি ভালো হতে পারে। আল্লাহ জানেন, এর অন্তর হেদায়েতের জন্য প্রশস্ত হয়ে যাবে, ওই পথই সে অন্বেষণ করবে এবং রাসুলের ডাকে সাড়া দেওয়ার পথ তালাশ করবে। তার অন্তরের স্বাধীনতা আছে। সে এই পথ তালাশ করবে, তা মহান আল্লাহ জানেন। সে হেদায়েতের শিক্ষা গ্রহণ করবে, আল্লাহর কিতাব বুঝবে, আল্লাহর ডাকে সাড়া দিবে, এবং এসবে অবিচল থাকবে।

এটা তার শেষ পরিণতি, এর ওপরই সে মারা যাবে। বাহ্যিক দিক থেকে মনে হতে পারে সে কাফের। সালাত আদায় করে না, আত্মশুদ্ধি অর্জন করে না। কিন্তু আল্লাহর নিকটে সে সিদ্দিকদের একজন হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কেননা আল্লাহ জানেন, সে অচিরেই হেদায়েত লাভ করে তার ওপরেই মৃত্যুবরণ করবে।

আমরা কত লোক দেখলাম, যারা ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির মানুষ! কিন্তু আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিয়েছেন, ফলে তারা আল্লাহর পথে শহিদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছে। কেননা কী ছিল এবং কী হবে তার সবই আল্লাহ জানেন। তাই উক্ত হাদিসের সমঝ মহান আল্লাহ সব জানেন ও সবকিছু লিখে রেখেছেন, সেই স্তরদুটো বোঝার ওপর নির্ভরশীল।

·
[
৪]. প্রশ্ন: আমরা বলছি, ‘উপায় অবলম্বন করা ওয়াজিব।’ আবার রাসুল বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে।’ তাদের গুণ বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘তারা ইকতিওয়া করবে না, ঝাড়ফুঁক করবে না এবং তাদের রবের ওপর ভরসা করবে।’ তাহলে উক্ত দুই বক্তব্যের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করা হবে?

উত্তর: হাদিসে বলা হয়েছে, তারা ইকতাওয়া করবে না। এখানে ইকতিওয়া অর্থআগুনে সেঁক দেওয়া, যা এক ধরনের চিকিৎসা। এর দ্বারা আরোগ্যলাভের কারণ ঠিক স্পষ্ট নয়। নবিজি এটাকে উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এর সাথে অন্তরের সংশ্লিষ্টতা মূলত কার্যকারণ বা উপায়ের সাথে সংশ্লিষ্টতার ন্যায়, যা ঠিক স্পষ্ট না। এর মাধ্যমে আরোগ্য হওয়ার ব্যাপারটি প্রকাশ্য নয়।

নবি বলেছেন, ‘আরোগ্য লাভ হয় তিনটি পদ্ধতিতে।’ সেখানে উল্লেখ করেছেন, ‘আগুনের সেঁক দিয়ে।’ তবে তিনি বলেছেন, ‘আমি সেঁক দেওয়া পছন্দ করি না।’ এটা সুবিদিত যে, আগুনে সেঁক দেওয়ার পদ্ধতি চিকিৎসার সুস্পষ্ট মাধ্যম নয়। তাই যে ব্যক্তি এর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, সে ধারণা করে, এই সেঁক তার উপকার করছে এবং এটা উদ্দিষ্ট বিষয় অর্জনের একটি মাধ্যম।

এ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, তাদের অনেকেই আরোগ্য লাভ করেছেন। তবে অনেকে বলেন, সরাসরি সেঁকের কারণেই আরোগ্য লাভ হয়েছে। এমন ধারণা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা ওয়াজিব কিংবা নিদেনপক্ষে মুস্তাহাব। এজন্য যারা বিনা হিসাবে ও বিনা আজাবে জান্নাতে যাবে, তাদের অন্তর ‘সুস্পষ্ট মাধ্যম নয়’ এমন বিষয় থেকে মুক্ত হবে। তাইতো বলা হয়েছে, তাদের অন্তর গাইরুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। আর সেঁক দেওয়া আরোগ্য লাভের সুস্পষ্ট মাধ্যম বা উপায় নয়।

তদ্রুপ ঝাড়ফুঁক চাওয়াও ভালো নয়। কেননা তা আল্লাহকে পরিত্যাগের একটি মাধ্যম। নিজেই ঝাড়ফুঁক করলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। কিন্তু আপনি যদি ঝাড়ফুঁক চান, অথবা তা নিতে যান, তাহলে কোনো সমস্যা নাই। তবে তা না চাওয়াই এমন মর্যাদাপূর্ণ স্তর (বিনা হিসাবে জান্নাত) লাভের উপায়। আর বাহ্যিক উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে উদ্দিষ্ট বিষয় হাসিল করার ব্যাপারে নবি আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা চিকিৎসা নাও, তবে হারামের মাধ্যমে নয়।’ স্বয়ং নবি চিকিৎসা করেছেন এবং চিকিৎসা নিয়েছেন।

আলোচ্য হাদিস এবং ঐ হাদিসসমূহ, যেগুলোতে চিকিৎসার আদেশ দেওয়া হয়েছে অথবা উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, তার মধ্যে সমন্বয়ের কথা আমি আপনাদের বললাম, যা আলেম উলামা বলেছেন।

সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ সব ধরনের চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা নেননি। উপায় বা মাধ্যমের মুখাপেক্ষী না হয়ে তাঁরা আল্লাহর ওপর ভরসা করেছেন। কেননা আল্লাহ বলেছেন, وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِআমি অসুস্থ হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন।” [সুরা শুয়ারা: ৮০] ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে যা বলেছিলেন, তা বর্ণনা করেছেন আল্লাহ। ইবরাহিম বলেছিলেন, ‘আমি অসুস্থ হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন।’

তাঁরা এটাকে আমভাবে নিয়েছেন। তাঁরা বলতেন, আল্লাহই রোগ দিয়েছেন, আবার তিনিই আরোগ্য দিবেন। স্রেফ আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়ে তাঁরা আরোগ্যলাভের উপকরণ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু এটি বিশুদ্ধ নয়। বিশুদ্ধ কাজ হলো, আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে উপায় অবলম্বন করবেন, যদি উপায়টি প্রকাশ্যভাবে উপকারে আসে। অনেক সময় সেঁক মানুষের কাজে আসে না। আবার নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে সেঁক পদ্ধতি কাজে আসে।

যে সকল ওষুধ মানুষ ব্যবহার করে, অধিকাংশ সময় আল্লাহর অনুমতিতে তা দ্বারা আরোগ্য লাভ হয়। তাই ইমানদারদের উচিত, উপায় গ্রহণ করা এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করা। তারা মনে রাখবে, এ উপায় অবলম্বন করলেই উদ্দিষ্ট বিষয় হাসিল হয়ে যাবে না। মানে আপনি ওষুধ খেলেন, আর অসুখ সেরে গেল, ব্যাপারটি এমন নয়।

বরং সেটা একটা মাধ্যম মাত্র, যা আরও কতগুলো মাধ্যমের মুখাপেক্ষী। যেমন আপনার শরীর ওই ওষুধ সেবনের উপযোগী হতে হবে। এটা আল্লাহর হাতে। আবার আপনার শরীরে এমন কিছু থাকা যাবে না, যা ওষুধের কার্যকরী ক্ষমতা নষ্ট করে ফেল। ফলে এ ওষুধ কোনো উপকারে আসে না। কিছু মানুষ দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খাচ্ছে, কিন্তু তাদের অসুখ সারছে না। এর কারণ তাদের শরীর এ ওষুধের উপযোগী নয়। তাদের শরীরে এমন কিছু আছে, যা ওষুধকে কার্যকরী হতে বাধা দিচ্ছে। বস্তুত আল্লাহই পারেন ওষুধকে ফলপ্রসূ করতে।

ওষুধ গ্রহণের সময় আপনার অন্তর আল্লাহর সাথে সংযুক্ত থাকবে। এটাও একটা উপায়। ‘গাড়িযোগে ভ্রমণ’ এর উদাহরণে আমি তা ব্যাখ্যা করেছি। আপনি উপায় সম্পাদন করুন, আর বাকিটুকু আল্লাহর ওপরে ছেড়ে দিন। উপায় অবলম্বনের সময় তাওহিদবাদী মুসলিমের অন্তর উপায়ের ওপর ভরসা করবে না। যেহেতু সে উপায় অবলম্বন করতে আদিষ্ট হয়েছে, সেজন্য তা করবে। আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে, তিনি যেন উপায়টির সাথে আরও উপায় যোগ করে দেন। যাতে সে উপকার ও সুস্থতা লাভ করে। এই হাদিসগুলোর মধ্যে এভাবেই সমন্বয় সাধন করতে হবে।

·
[
৫]. আপনি সেই পিতামাতার উদ্দেশ্যে কিছু বলুন, যারা তাদের সন্তানদের জিহাদে যেতে বারণ করছেন, কারণ তারা জিহাদে গেলে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যাবে।

উত্তর: জিহাদ দুই ধরনের। প্রকাশ্য শত্রুর সাথে জিহাদ দুই প্রকার। যথা: (১) ফরজে আইন (২) ফরজে কেফায়া। জিহাদ তখনই ফরজে আইন হবে, যখন শত্রুরা দেশবাসীর ওপর আক্রমণ করবে। এখন যদি শত্রুরা এসে আমাদের রিয়াদ শহর আক্রমণ করে, তাহলে সবার ওপর জিহাদ করা ফরজ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পিতামাতার আনুগত্য চলবে না। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِহে মুমিনগণ, ওই কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের আশেপাশে অবস্থান করছে।” [সুরা তাওবা: ১২৩]

কেউ যদি দেশে আক্রমণ করে, তাহলে তাকে বাধা দেওয়া সবার ওপর ফরজে আইন হয়ে যায়। এ ব্যাপারে পিতামাতার আনুগত্য চলবে না।

আর এখন আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে জিহাদ করা ফরজে কেফায়া। (*) এক্ষেত্রে পিতামাতার অনুমতি ছাড়া কোনো যুবক জিহাদে যেতে পারবে না। এ অবস্থায় পিতামাতা তাদের সন্তানকে নিজেদের প্রয়োজন অথবা সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে জিহাদে যেতে নিষেধ করতে পারে। যেহেতু এক্ষেত্রে জিহাদে যাওয়া ফরজে আইন না। তবে নিষেধ করার কারণে তারা তাকে অনেক কল্যাণ ও জিহাদের ফজিলত থেকে বঞ্চিত করলেন এবং নিজেরাও বঞ্চিত হলেন।

[(*)
অনুবাদকের টীকা: এই লেকচারটি অনেক পুরনো। তখন শাইখ ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) জীবিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, আফগানিস্তানের জিহাদে সালাফিরাও অংশগ্রহণ করেছিল। সালাফি উলামাগণ তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মুজাহিদদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে লড়াই শুরু হলে উলামাগণ তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এমনকি একটি সূত্রে জানা গেছে, শাইখ ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) তাদের ফিতনাময় লড়াইয়ে অর্থ-সামগ্রী ডোনেট করা হারাম ফতোয়া দিয়েছিলেন। টীকা সমাপ্ত]

কিন্তু তাঁদের নিষেধ করার হক আছে। কেননা পিতামাতার অনুমতি ছাড়া নবি কাউকে জিহাদের অনুমতি দেননি। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে নফল কেফায়ি জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে বলেন, ‘তোমার কি পিতামাতা বেঁচে আছেন?’ সে বলল, ‘জি, বেঁচে আছেন।’ তিনি বললেন, ‘তুমি তাঁদের কাছে ফিরে যাও, সেটাই তোমার জন্য জিহাদ।’ কারণ নবি জানতেন, এই সন্তানের কাছে তাঁর পিতামাতার দরকার আছে।

পিতামাতা তাঁদের সন্তানকে জিহাদে যেতে বারণ করে মূলত তাঁকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করেন। অবশ্য সন্তানের প্রতি যদি বেশি ভালোবাসা থাকে এবং তাকে তাঁদের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাঁরা সন্তানকে জিহাদ যেতে বারণ করতে পারবেন।
সকল প্রসংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি তৌফিকদাতা। যিনি আমাদের জন্য এমন শরিয়ত নির্ধারণ করেছেন, যাতে পিতামাতা ও সন্তান সবারই নয়ন জুড়ায়।

পিতামাতার অবাধ্য হওয়া ও বিনা অনুমতিতে সফর করা সন্তানের জন্য না-জায়েজ; তার এ সফর হারাম। সন্তান সফর করছে অথচ তার পিতামাতা রোদন করছে অথবা তাঁরা তার ওপর অসন্তুষ্ট, এমতাবস্থায় তার সফরে যাওয়া হালাল নয়, না-জায়েজ। কেননা তার জিহাদে যাওয়া ফরজে কেফায়া (যেখানে পিতামাতার আনুগত্য করা ফরজে আইন)। তবে জিহাদ যদি ফরজে আইন হয়, তাহলে পিতামাতার আনুগত্য চলবে না। কেননা নবি বলেছেন, ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য চলবে না।’ এখন আফগানিস্তানে যে জিহাদ চলছে, তাতে মুসলিমদের জিহাদ করা ফরজে কেফায়া মর্মে আলিমগণ ফতোয়া দিয়েছেন। তবে সেখানে আফগানীদের জন্য জিহাদ করা ফরজে আইন।

যদি তারা এতে যথেষ্ট না হয় তাহলে তাদের নিকটবর্তী মুসলিমদের ওপর জিহাদ করা ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ বলেছেন, قَٰتِلُوا۟ ٱلَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ ٱلْكُفَّارِতোমাদের নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও।” [সুরা তাওবা: ১২৩] তারাও যদি যথেষ্ট না হয় তাহলে তাদের পরবর্তীদের ওপর ওয়াজিব হবে। কেননা ক্ষতি আসে একের পর এক।একটি সুবিদিত বিষয় হচ্ছে, প্রথমদিকে স্পেন দেশে ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধ করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ মর্মে কোনো আলিম ফতোয়া দেননি। তাঁরা বলেছেন, জিহাদ করা সেখানকার অধিবাসীর ওপর ফরজ। তারপর যারা আছেন তাদের ওপর ফরজ হবে। এটা আমাদের দেশের হকপন্থি মুফতিদের ফতোয়া। আল্লাহ তাঁদের হেফাজত করুন এবং আমাদের উত্তম জীবন দান করুন।

·
[
৬] প্রশ্ন: মানুষের মুখে বহুল প্রচলিত কিছু কথা আছে। যেমন: شاءت الأقدار (ভাগ্য চেয়েছে), وجدت فلانا صدفة (আমি আকস্মিকভাবে অমুককে পেয়ে গেছি)। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

উত্তর: شاءت الأقدار (ভাগ্য চেয়েছে) বলা ঠিক নয়। কেননা ইচ্ছা শুধু আল্লাহর। الأقدار শব্দটি قدر এর বহুবচন। তাকদিরের তো কোনো ইচ্ছা নেই। ইচ্ছা তাকদিরের একটি স্তর মাত্র। তাই অবশ্যই বলতে হবে, মহান আল্লাহ চেয়েছেন। আসলে شاءت الأقدار (ভাগ্য চেয়েছে) কথাটি বাস্তব-মর্ম শূন্য। আবার বাক্য সংযোজনের দিক থেকেও এতে ভুল রয়েছে।

আর وجدت فلان صدفة (আমি আকস্মিকভাবে অমুককে পেয়ে গেছি) কিংবা قابلته صدفة ومر بى صدفة (তার সাথে হঠাৎ সাক্ষাৎ হয়েছে, সে হঠাৎ আমাকে অতিক্রম করেছে) বা অনুরূপ কথা বললে কোনো সমস্যা হবে না। কেননা صدفة (অকস্মাৎ, হঠাৎ) শব্দটি সম্বন্ধীয় অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ অর্থটি বুঝায় কথকের দৃষ্টিকোণ থেকে। মানে সেটা আমার দিক থেকে অকস্মাৎ হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর দিক থেকে কোনো কিছুই অকস্মাৎ নয়, পৃথিবীর সবকিছুতেই রয়েছে তাঁর অপার প্রজ্ঞা। আল্লাহর রাজত্বে কোনো কিছুই অকস্মাৎ হয় না, অথচ ভ্রষ্ট প্রকৃতিবাদীরা এমনিই বলে থাকে।

কিন্তু এর দ্বারা যদি নিজের দিকে উদ্দেশ্য করা হয়, তাহলে এক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে। তবে এসব সংশয়পূর্ণ কথা না বলে সংশয়মুক্ত কথাবার্তা বলা উচিৎ। যেমন: আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলাম প্রভৃতি।

·
[
৭]. প্রশ্ন: তাকদিরের ব্যাপারে আমাকে শয়তান খুব প্ররোচনা ও পীড়া দেয়। এতে আমার মনে হতে থাকে, এটা কীভাবে হলো, ওটা কীভাবে হলো? আল্লাহ কেন এটা সৃষ্টি করলেন? এরকম বিভিন্ন প্রশ্ন। আপনি আমাকে এমন কিছু পন্থা বলে দিন; যাতে আমি এসব প্ররোচনা থেকে বাঁচতে পারি।

উত্তর: প্রথমত, একজন মুসলিম কোনো ধরনের প্ররোচনা প্রশ্রয় দিবে না। কেননা শয়তানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে আল্লাহবিমুখ করা। সে যখন দেখে কারও ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক সংশয় কাজে লাগছে, তখন সে এ পদ্ধতি অবলম্বন করে। আবার যখন দেখে কেউ কেউ শারীরিক প্রবৃত্তিতে প্ররোচিত হচ্ছে, তখন সে এই পথ অবলম্বন করে। প্রশ্নকারী অবশ্যই এসব চিন্তাভাবনা প্রশ্রয় দিবে না। আমি তাকে উদাহরণ দিচ্ছি। যাতে করে আল্লাহর সৃষ্টির কারণ খুঁজতে গিয়ে তার চিন্তাজগত সংশয় থেকে দূরে থাকে।

ধরুন! একজনের কাছে ছোটো বাচ্চাতার সন্তান অথবা ভাইআছে। সে বাচ্চার বড়ো ভাই তার দেখাশোনা করে। ছোটো ভাই বড়ো ভাইকে তার (ছোটো) দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে। সে বড়ো ভাইকে পুরোপুরি বুঝতে পারে না। কেননা তার সমঝ স্বল্প। তার ভাই তার থেকে বিশ বছরের বড়ো। আর তার জ্ঞানও বিশ বছর বেশি। তো এই ছোটো বাচ্চাটিকে যদি তার পিতা ইনজেকশন দেয়, আর সে তাতে আপত্তি পেশ করে বলে, ‘ওঃ, আব্বু! তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?’ তাহলে কী হবে? এটা তার ভালোর জন্য; কিন্তু সে তা জানে না। এ ইনজেকশন তার বডিতে পুশ করা হলে সে কষ্ট পাবে, এতটুকুই সে জানে, এর বেশি নয়। অথচ তার পিতা জানে, এ কষ্ট তারই ভালোর জন্য।

এভাবে পিতা তাঁর দায়িত্ববোধ থেকে সন্তানকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কেন বাড়ির বাইরে গিয়েছিলে? তুমি তার সাথে মিশ কেন? পিতা সন্তানকে প্রহারও করেন; এতে সে ব্যথা পায়। তিনি স্রেফ তাঁর দায়িত্ববোধ থেকে এসব করেন। তো বিশ-ত্রিশ বৎসরের ব্যবধানে যদি এমন পার্থক্য উপলব্ধ হয়, তাহলে সীমিত জ্ঞানী আর আল্লাহর মধ্যকার পার্থক্য কেমন হতে পারে?

নিঃসন্দেহে আপনি যদি এ ধরনের উপমা চিন্তা করেন, ভেবে দেখেন, মানুষের পরিচয় কী? তার জ্ঞান সীমিত, সে দরিদ্র, দুর্বল এবং আল্লাহর প্রতিপালিত বান্দা; তাহলে এসব কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পারবেন। আল্লাহর নিকট কামনা করি তিনি যেন আমার চোখ আলোয় ভরপুর করেন এবং এই প্রশ্নকারী-সহ আমাদের সকলের অন্তর আলোকিত করে দেন। তিনি যেন আমাদের থেকে ইমান বিধ্বংসী প্ররোচনা ও সংশয় দূরীভূত করেন।

এক্ষেত্রে শিথিল হওয়া উচিত নয়। বরং আল্লাহর প্রতি বিনয়ী হওয়া এবং ইবাদত, সালাত ও কুরঅান তেলাওয়াতে নিমগ্ন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আর সাথে সাথে দোয়া কবুল সময়গুলোতে তাঁকে ডাকতে হবেফজরের পূর্বে শেষ রাত্রে, দুপুর রাতের পরে এবং রাতের শেষ তৃতীয়াংশে। কিংবা আজান-ইকামতের মাঝে দোয়া করবে। এ সময়ের দোয়া সুমিষ্ট ও কাঙ্ক্ষিত, এবং তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনাপূর্ণ। তাই সে আল্লাহর নিকটে এই কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তি কামনা করবে এবং এ ব্যাপারে তাঁর সাহায্য চাইবে।

·
তথ্যসূত্র:
www.mimham.net/tan-4044-42


·
ভাষান্তর: আব্দুর রহমান মৃধা
পরিমার্জনা: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

 

Post a Comment

0 Comments