▌ফিকহুল ফিতান : ফিতনায় অনুসরণীয় নীতিমালা [১ম পর্ব]

ফিকহুল ফিতান : ফিতনায় অনুসরণীয় নীতিমালা [১ম পর্ব]

·রচয়িতা: আল্লামাহ সুলাইমান বিন সালিমুল্লাহ আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ
·অনুবাদকের নিগদ:
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। আলিফ-লাম-মিম। মানুষ কি মনে করে, ‘আমরা ইমান এনেছি’ বললেই তারা অব্যাহতি পেয়ে যাবে, আর তাদেরকে কোনো ফিতনায় (পরীক্ষায়) ফেলা হবে না? নিশ্চয় আমি তাদের পূর্ববর্তীদের ফিতনাগ্রস্ত (পরীক্ষা) করেছি। সুতরাং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলেছে, আর অবশ্যই জেনে নেবেন কারা মিথ্যুক। [সুরা আনকাবুত: ১-৩]

ফিতনা অবশ্যম্ভাবী। ফিতনা আসবেই। ছোটো ফিতনা যেমন আসবে, তেমন আসবে বড়ো ফিতনাও। আল্লাহ বিভিন্নভাবে মানুষের পরীক্ষা নেবেন, আর পরখ করবেন বান্দার ইমান। ফিতনার সময় যারা দ্বীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকবে, তারাই হবে সফলকাম। তাদের অবস্থান হবে চিরসুখী জান্নাতে। দ্বীনের ওপর অবিচল থাকা বান্দাদের মর্যাদার কথা কুরআনে এভাবে এসেছে, “নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ,’ এরপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং তারা বলে, তোমরা ভয় কোরো না, চিন্তিত হয়ো না; তোমরা সুসংবাদ নাও তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের। পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে আমরা তোমাদের সুহৃদ। সেখানে তোমাদের জন্য তা-ই আছে, যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য তা-ই আছে, যা তোমরা দাবি করবে। এটা ক্ষমাশীল ও দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাদর আপ্যায়ন।” [সুরা ফুসসিলাত: ৩০-৩২]

তাদের এমন মর্যাদা হবে নাই বা কেন? সত্যায়িত-সত্যপন্থি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেছেন, “ফিতনা-ফাসাদের সময় ইবাদত করা আমার নিকট হিজরত করার সমতুল্য!” [সহিহ মুসলিম, হা/২৯৪৮; ফিতনা অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ২৬] বলা বাহুল্য, শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করা, নিজের দ্বীন সম্পর্কে জানা, জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছার সুনিরাপদ সড়ক চিনে নেওয়া সবচেয়ে বড়ো ইবাদত। ফিতনার সময় করণীয় কী, কোন বিষয়গুলো ফিতনা, আর কোন বিষয়গুলো ফিতনা নয়—সে বিষয়ক জ্ঞান খুবই সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাপূর্ণ শরয়ি ইলম।

কবি বলেছেন, “আরাফতুশ শার্রা, লা লিশ্ শার্রি, ওয়ালাকিন লি তাওয়াক্কিহি, মান লাম ইয়া‘রিফিশ শার্রা মিন্না ইয়াক্বা‘উ ফিহি। আমি অমঙ্গল ও অনিষ্টকে চিনেছি, অনিষ্টকর্মের জন্য নয়, বরং তা থেকে বেঁচে থাকার নিমিত্তে; আমাদের মধ্যে যারা অনিষ্ট চিনে নেয়নি, তারাই পতিত হয় অনিষ্টগর্ভে।”

কবির চরণটির সাথে সাইয়্যিদুনা হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথাটি বড়ো মিলে যায়। তিনি বলেছিলেন, “লোকজন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কল্যাণ ও মঙ্গল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত, আর আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম অনিষ্ট ও অমঙ্গল প্রসঙ্গে; এ আশঙ্কায় যেন আমি সেসবে আক্রান্ত না হই।” [সহিহ বুখারি, হা/৩৬০৬; সহিহ মুসলিম, হা/১৮৪৭]

আমরা এখন কঠিন একটা সময় পার করছি। ভ্রান্ত আকিদার ফিতনা, আমলকেন্দ্রিক ফিতনা, নৈরাজ্যের ফিতনা, ক্ষমতাদখলের ফিতনা, নরহত্যার ফিতনা, নব্য চিন্তা ও মননের ফিতনা, শির্ক-কুফর-নিফাকের ফিতনা, নারী ও সম্পদের ফিতনা, বিক্ষোভ-আন্দোলন-বিদ্রোহের ফিতনা-সহ আরও নানাবিধ ফিতনায় সয়লাব পুরো মুসলিম উম্মাহ। এরকম ফিতনাময় যুগে ফিতনা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন এবং তার যথোচিত প্রচার প্রতিটি মুসলিমের জন্যই অনেক বেশি দরকারি, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ফিতনার সময় করণীয় কী, ফিতনায় অনুসরণীয় নীতিমালা কী কী প্রভৃতির মতো জরুরি বিষয়ে আল্লামাহ সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ বিরচিত একটি অনবদ্য রচনা—“ফিকহুল ফিতান : ফিতনায় অনুসরণীয় নীতিমালা।” বাঙালি সালাফি কমিউনিটিতে শাইখ খুবই ফেমাস, মাশাআল্লাহ। তবুও বলে রাখি, শাইখ সুলাইমান আর-রুহাইলি মদিনার অন্যতম উসুলবিদ ও ফকিহ। তিনি একাধারে মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উসুলুল ফিকহ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসর, মসজিদে নববির নিয়মিত মুদার্রিস এবং মসজিদে কুবার ইমাম ও খতিবের পদ অলঙ্কৃত করে আছেন।

‘ফিকহুল ফিতান’ মূলত শাইখের একটি লেকচার। আমাদের জানামতে শাইখ দুবার ফিকহুল ফিতান শিরোনামে লেকচার দিয়েছেন। তারমধ্যে দ্বিতীয় লেকচারটি দিয়েছিলেন মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশে। এই লেকচারটির ওপর ভিত্তি করেই গ্রন্থটি রচিত হয়েছে এবং লেকচারের চেয়েও বেশকিছু তথ্য এতে বৃদ্ধি করা হয়েছে। শাইখ বইটিতে দলিল সহকারে ছাব্বিশটি অনুসরণীয় মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিয়েছেন শাইখ সুলাইমান আর-রুহাইলির শিক্ষক, মদিনার কিবার উলামাদের (বয়োজ্যেষ্ঠ উলামাদের) অন্যতম, আকিদা ও ফিকহের পণ্ডিত, সালাফিয়্যাহর মুজাহিদ, আল্লামাহ সালিহ বিন সাদ আস-সুহাইমি হাফিযাহুল্লাহ।

গ্রন্থে উল্লিখিত আয়াত, হাদিস, উদ্ধৃতির রেফারেন্স যোগ করেছেন এবং টীকা প্রণয়ন করেছেন শাইখ সুলাইমানের বিশিষ্ট ছাত্র শাইখ ইয়াসিন আল-হাশিদি হাফিযাহুল্লাহ। আমরা রেফারেন্সের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই শাইখ ইয়াসিনের সংযোজিত তথ্যের ওপর নির্ভর করেছি। তবে কুতুবুস সিত্তাহর হাদিসগুলো নাম্বারিং করার ক্ষেত্রে আমরা সচারচর যে নাম্বার ব্যবহার করে থাকি, সেটাই ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। আর যেসব হাদিসের অন্ত্যপ্রান্তে বিশুদ্ধতার মান উল্লেখ করা হয়েছে, সবগুলো যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম আলবানি রাহিমাহুল্লাহর তাহকিক থেকে নেওয়া। হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয়ে অন্য মুহাক্কিকের মান উল্লেখ করা হলে, সেখানে স্পষ্টভাবে তাঁর পরিচয়যোগে মান বলা হয়েছে।

ভূমিকার শেষে এসে আমি একটি বিষয় খোলাসা করতে চাই। অনেক পাঠকের মনে হতে পারে, বইয়ের শিরোনামের অর্থ কী? ফিকহুল ফিতান তথা ফিতনার ফিকহ বলতে কী বোঝায়? ফিতান শব্দটি ফিতনা শব্দের বহুবচন। ফিতনার সংক্ষিপ্ত পরিচয়—পরীক্ষা বা যাচাই। শাইখের বইয়ে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। কিন্তু ফিকহ বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে? সুপ্রিয় পাঠক, ফিকহ শব্দের আভিধানিক অর্থ বোঝা বা উপলব্ধি করা। কিন্তু পরিভাষায় ফিকহকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। শাইখ সুলাইমান আর-রুহাইলির কথাই ধরুন। তিনি যদি ফকিহ হিসেবে আবির্ভূত হন, তাহলে ফিকহের পরিচয় দেবেন একভাবে। আবার তিনি উসুলবিদ হিসেবে আবির্ভূত হলে ফিকহের পরিচয় দেবেন আরেকভাবে। আমি সহজ ভাষায় ফিকহের সর্বমর্মী পরিচয় দিই এভাবে—“শরিয়তের দলিল থেকে আহরিত শরয়ি জ্ঞানকেই ফিকহ বলে।”

আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমাদের উপস্থাপিত লেখার যে কোনো ভুল আমাদের গোচরে আনলে কৃতার্থ হব এবং দোয়া করে দেব, ইনশাআল্লাহ। আর গ্রন্থটির রচয়িতা, শ্রুতিলেখক, ভূমিকা-লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, প্রচারক, পাঠক নির্বেশেষে সকল মুসলিমের জন্য বইটি কল্যাণের হোক, সে দোয়া করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ থেকে উপকৃত করুন এবং আমাদের অতিক্ষুদ্র শ্রমটুকু কবুল করে নিন। আমিন।

·
আল্লামাহ সালিহ আস-সুহাইমি হাফিযাহুল্লাহ প্রদত্ত অভিমত:

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত, যিনি বলেছেন, “প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে; ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদের পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” [সুরা আম্বিয়া: ৩৫] পরিপূর্ণ সালাত ও সালাম ধার্য হোক আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য, যিনি ব্যক্ত করেছেন, “নিশ্চয় সে ব্যক্তিই সৌভাগ্যবান, যে ফিতনা থেকে দূরে থেকেছে।” [আবু দাউদ, হা/৪২৬৩] সালাত ও সালাম ধার্য হোক তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং মর্যাদা ও অনুগ্রহের অধিকারী সাহাবিবর্গের জন্যও।

অনন্তর মহান আল্লাহ আমাদের নিরর্থক সৃষ্টি করেননি এবং অবহেলাভরে আমাদের পরিত্যাগও করেননি। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন কেবল তাঁর দাসত্বের জন্য, আমাদের উদ্ভাবন করেছেন কেবল তাঁরই আনুগত্যের জন্য। মহান আল্লাহ বলেছেন, “আমি জিন ও মানবজাতিকে এজন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা কেবল আমারই ইবাদত করবে।” [সুরা যারিয়াত: ৫৬] এরপর তিনি দুনিয়ার জীবনকে পরীক্ষাক্ষেত্র বানিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন, “তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।” [সুরা মুলক: ২]

সে ব্যক্তিই প্রকৃত সৌভাগ্যবান, যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সৎকর্ম সম্পাদনের তৌফিকপ্রাপ্ত হয়েছে, যেই সৎকর্ম এক আল্লাহর নিমিত্তে একনিষ্ঠ আমল ও তদীয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সে ব্যক্তিই প্রকৃত সৌভাগ্যবান, যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তৌফিকপ্রাপ্ত হয়েছে ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের মানহাজ অবলম্বন করার। সুতরাং এ পরীক্ষায় উৎরে যাওয়ার জন্য এবং ফিতনায় নিপাতিত হওয়া থেকে নিরাপদে থাকার জন্য এটাই সুনিরাপদ ও সঠিক পথ; যেসব ফিতনা আনয়ন না করে তা পরিহার করাই ওয়াজিব।

এ বিষয়টি পরিষ্কার করে পেশ করা মুসলিমদের জন্য বড্ড জরুরি। আমি বলতে চাইছি, ফিতনার উপকরণ-মাধ্যমের বিবরণ দিয়ে এবং ফিতনা থেকে নিষ্কৃতির পথ বাতলে দিয়ে ফিতনা থেকে সতর্ক করা খুবই জরুরি। কেননা ফিতনায় নিপাতন থেকে বাঁচার কার্যকরী পন্থার বিবরণ দিয়ে কিতাব ও সুন্নাহ পরিপূর্ণ।

আমাদের ভাই সম্মাননীয় শাইখ ড. সুলাইমান বিন সালিমুল্লাহ আর-রুহাইলি ‘ফিকহুল ফিতান’ শীর্ষক বরকতময় ও মূল্যবান গবেষণাকর্মের মাধ্যমে এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন এবং ফিতনার ভয়াবহতা, ফিতনার মাধ্যম-উপকরণ ও এসবের প্রতিবিধান বলে দিয়েছেন। আমি মনে করি, তিনি বিষয়টি যথাযথ ব্যাখ্যা করার তৌফিকপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং তিনি ভালো ও ফলপ্রসূ কাজ করেছেন। তিনি রোগ শনাক্ত করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের মানহাজের আলোকে উপযুক্ত মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছেন।

আমি আরও মনে করি, গবেষণাকর্মটি খুবই ফলপ্রসূ হবে, বিশেষত অসংখ্য ফিতনা প্রতিরোধে কাজে আসবে; যেসব ফিতনার মধ্যে প্রকৃত বিষয় অস্পষ্ট ও সংশয়াবিষ্ট থাকে এবং অনেকের কাছেই হক ও বাতিল তালগোল পাকিয়ে যায়। এমনকি শরয়ী ইলম অর্জনের সাথে নিজেদের সম্পৃক্তকারী অনেকেই—অর্থাৎ অনেক তালিবুল ইলমও—এ থেকে মুক্ত নয়। [অর্থাৎ তাঁরাও অনেকসময় বুঝতে পারেন না, হক-বাতিল কোনটি এবং এ থেকে নিষ্কৃতির পথ কী। জ্ঞাতব্য যে, উলামাদের কাছে ‘তালিবুল ইলম’ একটি স্ট্যাটাস বা র‍্যাংকের মতো ব্যাপার। শরিয়া ফ্যাকাল্টি থেকে গ্রাজুয়েশন করা, কিংবা মাস্টার্স-পিএইচডি করা গবেষক, এমনকি শরিয়া বিষয়ে ভার্সিটির প্রফেসরদেরও অনেকে তাঁদের কাছে তালিবুল ইলম। – অনুবাদক]

এই গবেষণাকর্মটি সংক্ষিপ্ত হলেও বর্তমান যুগে মুসলিমরা এ থেকে বিমুখ থাকতে পারে না; বিশেষত তালিবুল ইলমরা। এজন্য আমি মনে করছি, এটা মুদ্রণ করে প্রকাশ করলে এবং গবেষণাকর্মের বিষয়গুলো জনসাধারণের গোচরে আনলে ভালো হবে। আশা করা যায়, আল্লাহ এর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমদের উপকৃত করবেন, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাবতীয় ফিতনা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করবেন, আর তাঁর সৎ বান্দাদের তিনি যেসব প্রতিদান দিয়ে থাকেন সেসবের মধ্যে সর্বোত্তম প্রতিদান আমার ভাই শাইখ সুলাইমানকে প্রদান করবেন এবং তাঁর সওয়াব বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন। আল্লাহ আমাদের নবি মুহাম্মাদের জন্য এবং তাঁর অনুসারীবৃন্দ ও সাহাবিবর্গের জন্য ধার্য করুন সালাত ও সালাম।

শ্রুতিলিখন করিয়েছেন: রবের ক্ষমাভিখারী—
সালিহ বিন সাদ আস-সুহাইমি আল-হারবি
সাবেক চেয়ারম্যান, ফিকহ ডিপার্টমেন্ট, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক চেয়ারম্যান, আকিদা ডিপার্টমেন্ট, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়।

·
[অনুক্রমণিকা]

আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু। যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমুদয় বিষয়ের পরিজ্ঞাতা, অনুগ্রহ-অনুকম্পা প্রদানকারী দাতা; যিনি স্বীয় প্রজ্ঞায় মানুষকে ফিতনা, বালা-মুসিবত ও দুর্যোগ দিয়ে পরীক্ষা করার ফায়সালা করে রেখেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে যাঁর প্রতি কেউ একনিষ্ঠ হয়েছে, সে-ই হয়েছে সফলকাম। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রসুল। যিনি ছিলেন গুপ্ত-পরিদৃষ্ট সমুদয় ফিতনার অনিষ্ট থেকে সর্বোত্তম পানাহ কামনাকারী। তাঁর জন্য এবং তাঁর অনুসারী ও সাহাবিদের জন্য ধার্য হোক অজস্র সালাত ও সালাম। অতঃপর:

আল্লাহ আমাদেরকে অনুগ্রহ করে আমাদের মুসলিম বানিয়েছেন। এরপর তিনি আমাদেরকে দয়া করেছেন, বিধায় আমরা বরকতময় দেশ সৌদি আরবে বসবাস করতে পারছি। তিনি আমাদের প্রতি অনুকম্পা করেছেন, বিধায় আমরা এমন শরয়ি কর্তৃত্বের অধীনে রয়েছি, যা আল্লাহর বিধানকে ফায়সালা হিসেবে মান্য করে, এবং আল্লাহর বিধান প্রচার করতে সচেষ্ট থাকে। আল্লাহর কাছে চাইছি, তিনি যেন একে কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং এর কল্যাণ বৃদ্ধি করে দেন। তারপর তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, বিধায় আমরা বরকতময় নগরী—রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় রয়েছি। যে শহরকে ভালোবাসা মুমিনের কর্তব্য। কারণ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ শহরকে ভালোবাসতেন। বর্ণিত হয়েছে,
كَانَ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ فَنَظَرَ إِلَى جُدُرَاتِ الْمَدِينَةِ أَوْضَعَ رَاحِلَتَهُ وَإِنْ كَانَ عَلَى دَابَّةٍ حَرَّكَهَا مِنْ حُبِّهَا “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর হতে ফিরে আসার পথে যখন মদিনার প্রাচীরগুলোর দিকে তাকাতেন, তখন তিনি মদিনার প্রতি ভালোবাসার দরুন তাঁর উটকে দ্রুত চালনা করতেন, আর তিনি অন্য কোনো জন্তুর ওপর থাকলে তাকেও দ্রুত চালিত করতেন।” [সহিহ বুখারি, হা/১৮৮৬]

এরপর তিনি আমাদের নেয়ামত দিয়েছেন, বিধায় আমরা জামিয়া ইসলামিয়ায় (মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে) রয়েছি। সুবৃহৎ এই ইলমি দূর্গ স্থাপন করেছে সৌদি আরব সরকার; মুসলিম সন্তানদের সেবা প্রদানের জন্য এবং সালাফদের সমঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহভিত্তিক বিশুদ্ধ ইলম প্রচারের জন্য, যা সংশয় ও পঙ্কিলতাকে করে থাকে অপসৃত। তিনি আমাদেরকে এমন পরিচালনা পরিষদ দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন, যা নম্রতা ও সচ্চরিত্রতা নিয়ে এবং এখানকার সকলের একতায় দীপ্ত হয়ে জামিয়ার ছাত্রদের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে চাইছি, তিনি আমাদেরকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদকে ও শ্রোতামণ্ডলীকে কল্যাণ ও হেদায়েতের ওপর অটল রাখুন, আমাদের সবার প্রতি তাঁর অনুগ্রহকে বাড়িয়ে দিন এবং আমাদেরকে করুন কল্যাণের দুয়ার উন্মোচনকারী ও অকল্যাণকে রুদ্ধকারী।

ভাই ও বোনেরা, আমাদের মহান রব দুনিয়াকে বানিয়েছেন পরীক্ষার কেন্দ্র এবং এতে রেখেছেন নানাবিধ ফিতনা। যার মাধ্যমে মিথ্যাচারীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে সত্যপন্থিরা এবং অস্থিতিশীলদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে দৃঢ়-স্থিতিশীলরা। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
الم * أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ * وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ “আলিফ-লাম-মিম। মানুষ কি মনে করে, ‘আমরা ইমান এনেছি’ বললেই তাদের নিষ্কৃতি দেওয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? প্রকৃতপক্ষে আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।” [সুরা আনকাবুত: ১-৩]

·
[ফিতনার রকমফের]

এসব ফিতনা সংখ্যায় অনেক এবং নানা ধরনের। এসবের মধ্যে আছে সম্পদ ও সন্তানের ফিতনা। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ “জেনে রেখ, নিশ্চয় তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি ফিতনা। আর আল্লাহর নিকট আছে মহাপুরস্কার।” [সুরা আনফাল: ২৮] এসবের মধ্যে আছে ভালো-মন্দ এবং আনুগত্য ও নাফরমানির ফিতনা। আল্লাহ বলেছেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۗ وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً ۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ “প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে; আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদের পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই হবে তোমাদের প্রত্যাবর্তন।” [সুরা আম্বিয়া: ৩৫] এসবের মধ্যে আরও আছে মানুষকে তাদের নিজেদের মাধ্যমেই ফিতনাগ্রস্ত করা, তাদের অবস্থার পরিবৃত্তির মাধ্যমে; যেমন দরিদ্রতা, স্বচ্ছলতা, সুস্থতা, অসুস্থতা প্রভৃতি। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُونَ الطَّعَامَ وَيَمْشُونَ فِي الْأَسْوَاقِ ۗ وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً أَتَصْبِرُونَ ۗ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيرًا “তোমার পূর্বে যত নবি আমি পাঠিয়েছি, তারা সবাই আহার করত এবং বাজারে চলাফেরা করত। আমি তোমাদের একজনকে অপরজনের জন্য ফিতনাস্বরূপ করেছি। তোমরা কি ধৈর্যধারণ করবে? আর তোমার রব সর্বদ্রষ্টা।” [সুরা ফুরকান: ২০]

এর মধ্যে আরও আছে প্রশংসা ও নিন্দার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের মাধ্যমেই মানুষকে ফিতনাগ্রস্ত করা। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِنْ جَاءَ نَصْرٌ مِنْ رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ ۚ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ “কিছু লোক আছে যারা বলে, ‘আমরা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছি,’ অনন্তর যখন আল্লাহর ব্যাপারে তাদের কষ্ট দেওয়া হয়, তখন তারা মানুষের ফিতনাকে আল্লাহর আজাবের মতো গণ্য করে। আর যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে কোনো বিজয় আসে, তখন অবশ্যই তারা বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে ছিলাম।’ সৃষ্টিকুলের অন্তরসমূহে যা কিছু আছে আল্লাহ কি সে বিষয়ে সম্যক অবগত নন?” [সুরা আনকাবুত: ১০] এছাড়াও আরও ফিতনা আছে, যেগুলো আল্লাহ সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞার দরুন জারি করে থাকেন।

·
[ফিতনার পরিচয়]

এসব ফিতনা যেমনই হোক না কেন, এর একটি সর্বব্যাপী পরিচিতি আছে, যা সমুদয় ফিতনাকে ধারণ করে। হাফিয ইবনু আব্দিল বার্র রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “ফিতনার সর্বব্যাপী অর্থ—পরীক্ষা, যাচাই ও নীরিক্ষা।” [আত-তামহিদ, খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা: ২৪৮]

আজ রাতে আমাদের আলোচনার মূল বিষয়—সর্বব্যাপী ফিতনা, যা পুরো উম্মতকে কিংবা উম্মতের অধিকাংশকে আক্রান্ত করেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে পুরো উম্মতের ওপর। যেমন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফিতনা, সন্ত্রাসবাদের ফিতনা, যথোচিত শরয়ি কারণ ব্যতিরেকে কাফির-বিদাতি-ফাসিক বলা ও মন্দ নামে ডাকার ফিতনা, শরয়ি কারণের বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে পারস্পরিক বিদ্বেষ, ছিদ্রান্বেষণ ও বর্জনের (বয়কট) ফিতনা প্রভৃতি। এগুলো-সহ এরকম আরও ব্যাপক ফিতনা রয়েছে, যেসবের মধ্যে কেউ পতিত হলে কিংবা কারও পদচ্যুতি ঘটলেই তার স্বাভাবিক জীবনাচরণ বিধ্বস্ত হয়, তার নেয়ামতে পঙ্কিলতা আসে, হৃদয়ে আঁধার নামে, মানুষের প্রতি অন্তর হয়ে পড়ে সংকীর্ণ। মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সত্যই বলেছিলেন, “তোমরা ফিতনা থেকে বেঁচে থাক। ফিতনার প্রতি উদগ্রীব হয়ো না। কেননা ফিতনা জীবিকা বিধ্বস্ত করে, নেয়ামতকে পঙ্কিল করে এবং বিনাশ আনয়ন করে।” যাহাবি তদীয় ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে (৩/১৪৮) উক্তিটি উল্লেখ করেছেন। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু সত্যই বলেছেন, “তোমরা ফিতনা থেকে বেঁচে থাক। কেউ যেন এসবে বের না হয়। আল্লাহর কসম, যে ব্যক্তিই ফিতনায় বের হয়েছে, তাকেই ফিতনা বিধ্বস্ত করে, যেমনভাবে জলস্রোত ধ্বংসাবশেষকে বিধ্বস্ত করে থাকে।” [মুসান্নাফ আব্দির রাযযাক, হা/২০৭৪০; মুস্তাদরাক আল-হাকিম, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪৪৭; আলবানি হাদিসটিকে ‘উত্তম সাক্ষ্যমূলক বর্ণনা’ বলে অভিহিত করেছেন, ইরওয়াউল গালিল, ৮/১০৩]

·
[মুসলিম উম্মাহয় ফিতনার আধিক্য]

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে প্রচুর ফিতনা সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন। যেমন উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
أَشْرَفَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى أُطُمٍ مِنْ آطَامِ الْمَدِينَةِ فَقَالَ هَلْ تَرَوْنَ مَا أَرَى إِنِّي لأرَى مَوَاقِعَ الْفِتَنِ خِلاَلَ بُيُوتِكُمْ كَمَوَاقِعِ الْقَطْرِ “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার কোনো এক পাথর নির্মিত গৃহের ওপর আরোহণ করে বললেন, ‘আমি যা দেখছি, তোমরা কি তা দেখতে পাচ্ছ?’ এরপর বললেন, বৃষ্টিবিন্দু পতিত হওয়ার স্থানসমূহের মতো আমি তোমাদের গৃহের মাঝে ফিতনার স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি।” [সহিহ বুখারি, হা/১৮৭৮; সহিহ মুসলিম, হা/২৮৮৫]

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا “আঁধার রাতের প্রহরের মতো ফিতনা আসার পূর্বেই তোমরা সৎ আমলের দিকে ধাবিত হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হবে, আর বিকেলে কাফির হয়ে যাবে। বিকেলে মুমিন হবে, সকালে কাফিরে পরিণত হবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে নিজের দ্বীন বিক্রি করে ফেলবে।” [সহিহ মুসলিম, হা/১১৮; ইমান অধ্যায় (১); পরিচ্ছেদ: ৫১]

হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে ছিলাম। তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফিতনা সম্পর্কে আলোচনা করতে শুনেছ?’ উপস্থিত একদল বললেন, ‘আমরা শুনেছি।’ উমার বললেন, ‘তোমরা হয়তো একজনের পরিবার ও প্রতিবেশীর ফিতনার কথা মনে করেছ।’ তাঁরা বললেন, ‘জি, অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘নামাজ, রোজা ও দান-সদকার মাধ্যমে এগুলোর কাফ্ফারা হয়ে যায়। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বড়ো বড়ো ফিতনার কথা বর্ণনা করতে শুনেছ, যা সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় ধেয়ে আসবে?’

হুযাইফা বলেন, প্রশ্ন শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘আমি শুনেছি।’ উমার বললেন, ‘তুমি শুনেছ, মাশাআল্লাহ!’ হুযাইফা বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا فَأَىُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ وَأَىُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلاَ تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالأَرْضُ وَالآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ مُجَخِّيًا لاَ يَعْرِفُ مَعْرُوفًا وَلاَ يُنْكِرُ مُنْكَرًا إِلاَّ مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ “চাটাইপাতার বুননের মতো এক এক করে ফিতনা মানুষের হৃদয়ে আসতে থাকে। যে অন্তরে তা গেঁথে যায় তাতে একটি করে কালো দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তা প্রত্যাখ্যান করে তাতে একটি উজ্জ্বল দাগ পড়ে। এমনি করে দুটি অন্তর দু ধরনের হয়ে যায়। একটি সাদা পাথরের ন্যায়; আসমান ও জমিন যতদিন থাকবে ততদিন কোনো ফিতনা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর অপরটি হয়ে যায় উল্টানো সাদাবর্ণমিশ্রিত কালো কলসির ন্যায়, তার প্রবৃত্তি যা ধারণ করেছে, তা ছাড়া ভালো-মন্দ বলতে সে কিছুই চেনে না।” [সহিহ মুসলিম, হা/১৪৪]

·
[ফিতনার ফিকহ তথা ফিতনায় করণীয় পন্থা বিষয়ে জানার গুরুত্ব]

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাপদ সুস্পষ্ট পথ বাতলে দিয়েছেন, ফিতনার সময় যে পথ অবলম্বন করা মুসলিমের কর্তব্য। যে পথকে সুসাব্যস্ত ও ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হয়েছেন সালাফগণ। তাঁরা বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর অনুগ্রহে এ পথের অনুসরণ ব্যতীত মুমিনের কোনো নিরাপত্তা নেই, ফিতনা থেকে বাঁচারও উপায় নেই। আমরা ‘ফিকহুল ফিতান’ তথা ‘ফিতনার ফিকহ’ বলে এ পথকেই বুঝিয়েছি। উক্ত ফিকহ যে বহন করবে, এ অনুযায়ী আমল করবে, সে নিজে ফিতনার মাধ্যম হওয়া থেকে কিংবা আল্লাহর বান্দাদের ফিতনায় ফেলা থেকে মুক্তি পাবে, ইনশাআল্লাহ। সে নিরাপদে থাকবে ফিতনায় পতিত হওয়া থেকে, নিরাপদে থাকবে ফিতনায় স্বীয় অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করা থেকে; যার ফলে (অন্তরে আঁধার নামার ফলে) সে সঠিকটা বুঝতে পারে না। পরন্তু সে সঠিক বিষয় জানার তৌফিক পাবে। তার অন্তর হবে জ্যোতির্ময়, আর তার চলার পথও হবে সুস্পষ্ট। এজন্য এই ফিকহ জানা সবচেয়ে মহিমান্বিত বিষয়াবলির অন্যতম।

ভাইয়েরা, এটা জানা কথা, আমরা এমন একটি যুগ অতিবাহিত করছি, যে যুগে ফিতনা বেড়ে গেছে, ফিতনার ফিকহ বিষয়ে অসংখ্য মানুষের অজ্ঞতা চরমে পৌঁছেছে। ফলে আমাদের অসংখ্য যুবা ও ভাইয়েরা ফিতনায় পতিত হচ্ছে এবং পরিণত হচ্ছে ফিতনার জ্বালানিতে। এ বিষয়ের অজ্ঞতা কতিপয় তালিবুল ইলমকে এই পরিণতিতে পৌঁছিয়েছে যে, তারা একটি ছোটো ফিতনা থেকে বড়ো বড়ো ফিতনার জন্ম দিচ্ছে। বরং কতকক্ষেত্রে কোনো ফিতনা ব্যতিরেকেই তারা ফিতনার জন্ম দিচ্ছে। যা তাদেরকে ইলম অন্বেষণ, দাওয়াত ও কল্যাণের প্রসারের মতো গুরুত্ববহ কাজ থেকে বিরত রাখছে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে তৈরি করছে প্রচণ্ড বিরোধ।

নিঃসন্দেহে ফিতনার সময় ফিতনার ফিকহ বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত নাবিকবিহীন কিশতীর আরোহীর ন্যায়। যে কিশতীতে আছড়ে পড়ে বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ। ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে তাকে করে ফেলে আচ্ছন্ন। তরঙ্গমালা কিশতীর আরোহীকে টালমাতাল করে তোলে। কোন দিকে এগোলে নিরাপত্তা পাবে, তা তার জানা নেই। এক পর্যায়ে তার সমাধি হয় সলিলগর্ভে। আর যদি কোনোক্রমে মুক্তি পেয়েই যায়, তবে তার অবস্থা হয় ক্ষতবিক্ষত। এজন্য সালাফগণ বলেছেন, “ফিতনার আগমন হলে তা চিনতে পারে উলামাগণ এবং তাতে নিমজ্জিত হয় সাধারণ জনগণ; আর সাধারণ জনগণ তা তখন চিনতে পারে, যখন ফিতনা প্রস্থান করে।”

মুতার্রিফ বিন আব্দুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ফিতনার আগমনকালে তা ধোঁয়াশাপূর্ণ থাকে, আর প্রস্থানের সময় তা হয়ে যায় প্রকটিত, সুউদ্ভাসিত।” হাসান বসরি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় ফিতনা যখন আসে, তখন সকল আলিম একে চিনতে পারে, আর সকল অজ্ঞ একে তখনই চিনতে পারে তখন, যখন তা চলে যায়।” ইবনু সাদ তদীয় তাবাকাতে উক্তিটি উল্লেখ করেছেন।

ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনু উয়াইনাহ রাহিমাহুল্লাহ খালাফ বিন হাওশাব রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন, সালাফগণ নিম্নোক্ত চরণগুলো দিয়ে ফিতনার উপমা দিতে পছন্দ করতেন। কবি ইমরুল কায়েস রচনা করেছে,
الْحَرْبُ أَوَّلُ مَا تَكُونُ فَتِيَّةً ~ تَسْعَى بِزِينَتِهَا لِكُلِّ جَهُولِ
حَتَّى إِذَا اشْتَعَلَتْ وَشَبَّ ضِرَامُهَا ~ وَلَّتْ عَجُوزًا غَيْرَ ذَاتِ حَلِيلِ
شَمْطَاءَ يُنْكَرُ لَوْنُهَا وَتَغَيَّرَتْ ~ مَكْرُوهَةً لِلشَّمِّ وَالتَّقْبِيلِ.
“যুদ্ধের ঊষালগ্ন তরুণীর মতো, যে তার রূপসজ্জা নিয়ে ছুটোছুটি করে বুদ্ধুদের পানে।
যুদ্ধাগ্নি যখন জ্বলে ওঠে, আর শিখাগুলো হয় উদ্ভিন্নযৌবনা, তখন সে পতিহীনা বৃদ্ধার মতো পালায় পিছুটানে।
যার চুলগুলো হয়ে গেছে সাদা, রঙ গেছে বদলে, যার ঘ্রাণ নিতে, যাকে চুমু দিতে লাগে ঘিনঘিনে।” [সহিহ বুখারি, ফিতনা অধ্যায় (৯২); পরিচ্ছেদ: সমুদ্রের স্রোতের মতো ফিতনা আসবে (১৭)]

কথিত আছে, ফিতনার শুরুটা প্রবঞ্চনাময়, কখনো তা ভালোও লাগতে পারে; কিন্তু এর শেষটা অম্লযুক্ত, তিক্ত। অধিকন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ ব্যাপার—কতিপয় তালিবুল ইলমের নিকট ফিতনার বিষয়গুলো অস্পষ্ট থেকে যাওয়া, যাদের পদক্ষেপে দৃঢ়তা আসেনি, অথচ তারা কিনা ফিতনার ব্যাপারে কথা বলে! ফলে তারা অবস্থার সংশোধন করে না, বরং অশান্তি তৈরি করে। তারা ফিতনার ফিকহ অবলম্বন করে না, উলামাদের কাছেও ফিরে যায় না। ফলে অসংখ্য মানুষ যদি ফিতনায় নিপাতিত নাও হয়, ফিতনার অগ্নিকুণ্ডে অধোমুখে পতিত নাও হয়, তথাপি তারা দিশেহারা হয়ে যায়।

·
[ফিতনা প্রজ্বলিত করে যারা]

এটি সুবিদিত যে, কেবল দুই শ্রেণির লোক ফিতনা প্রজ্বলিত করে থাকে। এক শ্রেণির লোক তারা, যাদের উদ্দেশ্য সৎ, কিন্তু তারা গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ফকিহ নয়। আরেক শ্রেণির লোক তারা, যাদের উদ্দেশ্য খারাপ, যারা মুসলিমদের অনিষ্ট সাধন করতে চায়। ফিতনার আগুনে কেবল সে-ই দগ্ধ হয়, যে ফিতনার ফিকহকে ধারণ করেনি, যেই ফিকহ কুরআন-সুন্নাহর দলিল ও উম্মাহর সালাফগণের সমঝ দ্বারা সুসাব্যস্ত হয়েছে।

এজন্য আমি ফিতনার ফিকহ বিষয়ে লেকচার দেব বলে মনস্থ করেছি। আমি এই লেকচারকে মূলনীতি ও নীতিমালা আকারে বিন্যস্ত করব এবং বিশদ রচনার পদ্ধতি এড়িয়ে সহজবোধ্য মৌলিক জ্ঞান প্রদানের পন্থা অবলম্বন করব, যা সকলের বোধগম্য হবে, ইনশাআল্লাহ। অতএব আল্লাহর তৌফিকে আমি আরম্ভ করছি।

·
[১ম মূলনীতি: সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা]

সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা ও নব্য বিষয়াবলি থেকে সতর্ক থাকা ফিতনার একটি অন্যতম ফিকহ। সুতরাং আল্লাহর বান্দা, তোমার কাছে যখন কোনো বিষয়ের আগমন ঘটে, তখন ভালো করে লক্ষ করো, এটা কি প্রাচীন বিষয়, যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবিবর্গ এবং যা জ্যোতির্ময় সনদে বর্ণনা করেছেন উম্মতের উত্তম ব্যক্তিবর্গ? না এটি নবউদ্ভাবিত নতুন বিষয়, যা প্রাচীন বিষয়ের পরিপন্থি? তুমি প্রাচীনকে আঁকড়ে ধর, এতেই আছে যাবতীয় কল্যাণ। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة “তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার আদর্শ এবং আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলিফাগণের আদর্শ অনুসরণ করবে এবং তা মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। তোমরা নবউদ্ভাবিত বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নবউদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআতই পথভ্রষ্টতা।” [আবু দাঊদ, হা/৪৬০৭; সনদ: সহিহ]

আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু কোনো ওয়াজের মজলিসে বসলেই বলতেন, ‘আল্লাহ মহা ন্যায়বিচারক, সন্দেহকারীরা ধ্বংস হয়েছে।’ তো মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু একদিন বলেন, ‘তোমাদের পরবর্তী যুগে ফিতনা সৃষ্টি হবে। তখন প্রচুর সম্পদ থাকবে। কুরআন সেসময় উন্মোচিত হবে। মুমিন-মুনাফেক, পুরুষ-নারী, ছোটো-বড়ো, স্বাধীন-গোলাম সকলে কুরআন খুলে পাঠ করবে (কিন্তু অর্থ বুঝবে না)। অচিরেই কেউ বলবে, লোকদের কি হলো, তারা আমার অনুসরণ করে না, অথচ আমি কুরআন পড়েছি?! আসলে তারা আমার অনুসরণ করবে না, যতক্ষণ না আমি তাদের জন্য এছাড়া নতুন কিছু প্রবর্তন করতে পারি!’ অতএব তোমরা তার এ বিদআত (নতুন প্রবর্তিত বিষয়) থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ দ্বীনের মধ্যে যা নতুন প্রবর্তন করা হয়, তা ভ্রষ্টতা। আমি তোমাদেরকে জ্ঞানী ব্যক্তির বিপথগামিতা সম্পর্কে সতর্ক করছি। কেননা শয়তান জ্ঞানীর মুখ দিয়ে গোমরাহি কথা বলে। আবার মুনাফেকও কখনো কখনো হক কথা বলে।

বর্ণনাকারী বলেন, আমি মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললাম, আল্লাহ আপনার ওপর সদয় হোন, জ্ঞানী ব্যক্তিও যে ভ্রষ্টতাময় কথা বলে আর মুনাফেকও সত্য বলে, এটা আমি কীভাবে বুঝব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, জ্ঞানী ব্যক্তির সেসব প্রসিদ্ধ কথা বর্জন করবে, যেসবের ব্যাপারে বলা হয়, এ আবার কেমন কথা! তবে এসব কথার দরুন তোমরা জ্ঞানীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে না। কেননা হয়তো জ্ঞানী ব্যক্তি এসব কথা থেকে ফিরে আসবে। আর তুমি হক কথা শোনামাত্র গ্রহণ করবে, কেননা হকের মধ্যে জ্যোতি আছে।’ [আবু দাউদ, হা/৪৬১১; সনদ: সহিহ]

আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, একদা এক ব্যক্তি উমার বিন আব্দুল আজিজ রাহিমাহুল্লাহর নিকট তাকদির সম্পর্কে জানতে চেয়ে চিঠি লেখল। উত্তরে তিনি লেখলেন, “আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, আল্লাহকে ভয় করো, ভারসাম্যপূর্ণভাবে তাঁর নির্দেশ মেনে চল, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করো, তাঁর সুন্নাহ জারি হওয়ার পর বিদআতিদের বিদআত বর্জন করো। (প্রার্থনা করি) বিদআত ও নবউদ্ভাবন থেকে আল্লাহ তাদের অমুখাপেক্ষী করুন। আর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা তোমার কর্তব্য। কারণ এ সুন্নাতই হচ্ছে তোমার জন্য আল্লাহর অনুমতিক্রমে রক্ষাকবচ। জেনে রেখ, মানুষ এমন কোনো বিদআত করেনি যার বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে কোনো প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি বা সে ব্যাপারে কোনো শিক্ষা নেই (যা থেকে তার ভ্রান্তি প্রতীয়মান হয়)। কেননা সুন্নাতকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি সুন্নাতের বিপরীত—তথা ভুল, স্খলন, নির্বুদ্ধিতা, অতিরঞ্জন—সম্বন্ধে অবগত।

কাজেই তুমি নিজের জন্য ঐ পথ বেছে নেবে, যা তোমার পূর্ববর্তীগণ (সালাফগণ) তাঁদের নিজেদের জন্য অবলম্বন করেছেন। কারণ তাঁরা জ্ঞান সহকারেই পদক্ষেপ ফেলেছেন এবং তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতার সঙ্গেই বিরত থেকেছেন। তাঁরা দ্বীনের অর্থ উপলদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক জ্ঞানী ছিলেন এবং মর্যাদায় ছিলেন আমাদের চেয়ে যোগ্যতর। পক্ষান্তরে তোমাদের মতাদর্শ যদি সঠিক পথ হয়, তাহলে তোমরা তাদের অগ্রবর্তী হয়ে গেলে! আর তাঁদের পরে যদি উক্ত আদর্শ উদ্ভাবিত হয়ে থাকে, তাহলে তা তারাই উদ্ভাবন করেছে, যারা তাঁদের পথ বাদ দিয়ে ভিন্নপথের অনুসারী হয়েছে। নিশ্চয় তাঁরাই (সালাফগণ) অগ্রগামী। তাঁরা যা বর্ণনা করেছেন, তা-ই যথেষ্ট। তাঁরা যা বিবরণ দিয়েছেন, তাতেই আছে নিরাময়। এরচেয়ে বেশি বা এর কমও বলার নেই। একদল তাঁদেরকে উপেক্ষা করে কিছু কমিয়েছে, এরা সঠিক পথ থেকে সরে গেছে। আরেকদল বাড়িয়েছে, এরা মূলত সীমালঙ্ঘন করেছে। আর সালাফগণ ছিলেন এর মাঝামাঝি সঠিক পথের অনুসারী।” [আবু দাউদ, হা/৪৬১২; সনদ: সহিহ]

সম্মাননীয় শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “নানাবিধ ফিতনা থেকে বাঁচার পথ—আল্লাহর কিতাব ও তদীয় রসুলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। যেমন আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ফিতনা সংঘটিত হবে। বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রসুল, মুক্তির উপায় কী?’ তিনি জবাবে বললেন,
كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ نَبَأُ مَا كَانَ قَبْلَكُمْ وَخَبَرُ مَا بَعْدَكُمْ وَفَصْلُ مَا بَيْنَكُمْ ‘আল্লাহর কিতাব। এতে আছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের সংবাদ ও পরবর্তীদের সংবাদ এবং তোমাদের মাঝে ফায়সালার বিধান।’ (তিরমিযি, হা/২৯০৬; সনদ: দুর্বল)”

শাইখ রাহিমাহুল্লাহ আরও বলেছেন, “সকল প্রকারের ফিতনা থেকে নিষ্কৃতি ও ফিতনার অনিষ্ট থেকে মুক্তির পথ একটাই। আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাতের জ্ঞান লাভ করা এবং উম্মতের সালাফগণের—তথা সাহাবিবর্গ, তাঁদের পথের অনুসারী ইসলামের ইমাম ও হেদায়েতের দাঈগণের—মানহাজ সম্বন্ধে জানা।” [মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআহ, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১০৬]

·
[২য় মূলনীতি: কুরআন-সুন্নাহর দলিলের বিরোধিতা না করা]

ফিতনার একটি অন্যতম ফিকহ—কোনো মুসলিম স্বীয় মর্জির সাথে কুরআন-সুন্নাহর দলিলের বিরোধ তৈরি করবে না, বরং নিজের ইচ্ছা-অভিপ্রায়কে দলিলমাফিক চালিত করবে। ফিতনার সময় অসংখ্য মানুষের আপদ হলো—তারা দলিলের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে না, দলিলের কাছে নিজেদের অভিপ্রায়কে প্রত্যার্পণ করে না; বরং নিজেদের মর্জির কাছে দলিলকে প্রত্যার্পণ করে। তাদের খেয়ালখুশির বিপরীত দলিল আসলে তারা বলে, এটা দ্ব্যর্থবোধক দলিল; এ বলে তারা দলিল প্রত্যাখ্যান করে কিংবা দলিলের অপব্যাখ্যা করে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا “আল্লাহ ও তাঁর রসুল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে অন্য কিছু নির্বাচন করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।” [সুরা আহযাব: ৩৬] মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا “অতএব তোমার রবের কসম, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফায়সালা দেবে সে ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” [সুরা নিসা: ৬৫]

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “নিজের থেকে দুটো বিষয়কে অপসৃত করা বান্দার কর্তব্য—ভ্রান্ত মত ও ভ্রান্ত প্রবৃত্তি। ফলে সে জেনে রাখবে, আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যে আদর্শের দাবি করে, তাতেই আছে প্রকৃত প্রজ্ঞা ও ন্যায়পরায়ণতা; বান্দার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যা দাবি করে, তার মাঝে তা নেই। আর তার প্রবৃত্তিও হবে আল্লাহর নির্দেশনার অনুগামী। আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানের পাশে তার এমন কোনো খেয়ালখুশি থাকে না, যা আল্লাহর বিধান ও নির্দেশের খেলাপ।” [মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ২৮৮]

·
[৩য় মূলনীতি: ইলমের অভিমুখী হওয়া]

ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহী হওয়া এবং অজ্ঞতা থেকে পলায়ন করা ফিতনার ফিকহ। ফিতনা (কতিপয় ফিতনা) শয়তানের পণ্য, যা শুবুহাত তথা সংশয়ের সাথে সম্পৃক্ত। আর শয়তানের কোনো পণ্যই—যা সংশয়ের সাথে সম্পৃক্ত—অজ্ঞতা ব্যতিরেকে ছড়ায় না। এজন্য এই মহান দ্বীন মূলত ইলম ও জাগ্রত-জ্ঞানসংবলিত দ্বীন। মহান আল্লাহ বলেছেন,
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ “বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল।” [সুরা ফাতির: ২৮] নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ، كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ “সাধারণ ইবাদতগুজার ব্যক্তির ওপর আলিমের মর্যাদা সমস্ত তারকার ওপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদার ন্যায়।” [আবু দাউদ, হা/৩৬৪১; সনদ: সহিহ] নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُم “সাধারণ ইবাদতগুজার ব্যক্তির ওপর আলিমের মর্যাদা তোমাদের সাধারণ ব্যক্তির ওপর আমার মর্যাদার মতো।” [তিরমিযি, হা/২৬৮৫; সনদ: সহিহ]

একজন আলিম ইলম বিতরণ করেন। ইলম বিতরণ করার দরুন ফিতনার সময় শয়তান তাঁর ওপর চড়াও হতে পারে না। তিনি মানুষ পর্যন্ত শয়তানের পৌঁছার পথকে রোধ করেন। ইলম মুমিনের অস্ত্র, এর মাধ্যমে মুমিন বান্দা শয়তানকে লাঞ্ছিত-অপদস্থ অবস্থায় বিতাড়িত করে। অন্তর থেকে প্রবৃত্তির তাড়নাকে দূরীভূত করে এবং প্রবৃত্তির চাহিদাকে দুর্বল করে ফেলে। ইমাম সাদি সত্যই বলেছেন, “তুমি হেদায়েতপ্রাপ্ত হও, জেনে রেখ, সর্বোত্তম দান হলো ইলম, যা তোমার সংশয় ও পঙ্কিলতাকে করবে অপসৃত।” [মানযুমাতুস সাদি ফিল কাওয়াইদিল ফিকহিয়্যাহ, গৃহীত: আল-মাজমুআতুল কামিলাহ লি মুআল্লাফাতিস সাদি; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১২৭]
·ক্রমশ চলবে, ইনশাআল্লাহ।
·অনুবাদক: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari
 

আমাদের ওয়েব সাইটঃ- https://rasikulindiaa.blogspot.com/

আমাদের ওয়েব সাইটঃ-   https://salafi-pdfbooks.blogspot.com/

আমাদের ওয়েব সাইটঃ  https://salafimp3web.blogspot.com/

Post a Comment

0 Comments