Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

▌গণতন্ত্রের স্বরূপ


▌গণতন্ত্রের স্বরূপ

·মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীস অনুষদের প্রাক্তন ডিন এবং ‘আক্বীদাহ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, বিগত শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম ড. মুহাম্মাদ আমান বিন ‘আলী আল-জামী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৬ হি.] বলেছেন—

❝আমরা আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আমরা হোঁচট খাই না, গুলিয়েও ফেলি না। হাল আমলের কিছু লেখক ও সুশিক্ষিত লোকদের থেকে উদ্ভূত হয়েছে বিচক্ষণতা ও জাগ্রত জ্ঞানের অভাব। বিশেষ করে আল-হাকিমিয়্যাহর (বিচার-ফায়সালা ও শাসন) ক্ষেত্রে। যেখানে তারা সংবিধানের বিষয়টি গুলিয়ে ফেলে। সংবিধানের ব্যাপারটি নির্দিষ্টভাবে গবেষণা করতে হবে। প্রত্যেক জানাশোনা ব্যক্তি বা তালিবুল ‘ইলম এই ফিল্ডে উপযুক্ত হতে পারে না এবং (এ বিষয়ে) দাঈও হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ অনেক লোক এই ভেবে গণতন্ত্রের দিকে দাওয়াত দেয় যে, গণতন্ত্রের অর্থ ন্যায়বিচার। অথচ এটা একটা বড়ো ভুল।

যেমন ‘ডেমোক্রেসি’ শব্দ নিজেই একটা বিদেশী শব্দ; একটা বিদেশী বিষয়, যা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এটা ইউরোপিয়ান কাফিরদের একটা ব্যবস্থা (system)। গণতন্ত্রের অর্থ—মানুষ কর্তৃক নিজেদের দিয়েই নিজেদের শাসন করা। [১] আর এর উৎপত্তি হয়েছিল ওই সময়, যখন পশ্চিমা খ্রিষ্টানরা কঠিন চাপের মাঝে এবং তাদের রাজা, নেতা ও চার্চগুলোর জুলুম-নিপীড়নের মধ্যে বাস করছিল। ফলে তারা বিদ্রোহ করে, ইহুদিদের বিরুদ্ধে আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের বিদ্রোহের মতো। তারা বিদ্রোহ করে। তাদের রাজা-বাদশাহ ও নেতাদের শাসন এবং তাদেরই চার্চের নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে।

তারা (ওদের) জুলুম থেকে পলায়ন করে। কিন্তু কীসের দিকে পলায়ন করে? তারা মানুষের শাসন থেকে পালিয়ে মানুষের শাসনের দিকেই গমন করে। ঠিক ওই লোকের মতো, যে আগুন থেকে (বাঁচতে) রোদে পুড়ে যাওয়া তপ্ত ভূমির কাছে সাহায্য চায়। তো তারা সিদ্ধান্ত নেয়, সাধারণ জনগণ নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে এবং এভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। অর্থাৎ তারা আল্লাহ ও তাঁর বিধানের দিকে পলায়ন করেনি, বরং তারা জুলুম-নিপীড়ন থেকে পলায়ন করে নিজেদের জুলুমাচ্ছন্ন মানবরচিত আইনের নিকট গমন করেছে। [২] কেননা মানুষ হওয়ার কারণেই মানুষ গঠিত হয়েছে জুলুম ও অজ্ঞতা দিয়ে; এসব বৈশিষ্ট্য থেকে আল্লাহ যাকে রক্ষা করেছেন সে ব্যতীত। [৩]

সুতরাং এই গণতন্ত্রের ভিত্তি, বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি মুসলিমদের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ গণতন্ত্র আল্লাহর প্রতি ইমানের সাথে সাংঘর্ষিক। যেহেতু আল্লাহর প্রতি ইমানের অন্যতম উপাদান—আল্লাহর শরিয়ত ও আল্লাহর বিধানের প্রতি ইমান থাকা। অতএব গণতন্ত্র ন্যায়বিচার হওয়া তো দূরের কথা, তা আল্লাহর দ্বীনেরই অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা ন্যায়বিচার নয়। বরং এটা উচ্ছৃঙ্খলতা ও বিশৃঙ্খলা (ঘটার কারণ)। কেননা এটা সেই বিষয়কে অবাধ করে দেয়, যাকে বলা হয়, সার্বজনীন স্বাধীনতা।

ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে (গণতন্ত্রের বক্তব্য অনুযায়ী) একজন লোক একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী থাকতে পারে—ইহুদি, খ্রিষ্টান, অথবা মুসলিম হিসেবে, এবং পরে সে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে পছন্দমাফিক কোনো ধর্মে। অর্থাৎ তাদের (গণতন্ত্রবাদীদের) মতে রিদ্দাহ তথা ধর্মত্যাগের বিধান নেই। [৪] সুতরাং গণতন্ত্র হলো বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, যাত্রা ও ভ্রমণের স্বাধীনতা—সব ধরনের স্বাধীনতা, যেগুলো বিশৃঙ্খলা ঘটায়। এটা ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ইসলামী স্বাধীনতা নয়। এটাই গণতন্ত্র।

তাই ওইসব লেখক কর্তৃক গণতন্ত্রের দিকে দাওয়াত দেওয়া এবং একে ন্যায়বিচার আখ্যা দেওয়া (তাদের) বিচক্ষণতার অভাব। অনুরূপভাবে সংসদীয় জীবনের দিকে দাওয়াত দেওয়াও এর আওতাভুক্ত। কারণ সংসদীয় জীবন মানে—ইহুদি পণ্ডিত ও খ্রিষ্টীয় পাদ্রিদের অনুসরণ করার মতো ব্যাপার। কারণ এটা মানুষের আইনের অনুসরণ। এতে (ভোটের মাধ্যমে) নির্বাচিত একদল প্রতিনিধি থাকে, আর প্রতিনিধিদের থাকে একজন প্রধান। তারা সমাজকে খুশি করতে (অর্থাৎ মানুষের পছন্দমাফিক) আইন প্রণয়ন করে। এই আইনগুলো ইসলামসম্মত, না ইসলামবিরোধী সে বিচার তারা করে না। তাদের এই কাজ হাকিমিয়্যাহর (বিচার-ফায়সালা ও শাসন) ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক বলে মেনে নেওয়ার বিপরীত। “তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের রব বানিয়ে নিয়েছে।” (সুরা তাওবাহ: ৩১) [৫]

সংসদের এই লোকগুলোর সাথে (কুরআনে বর্ণিত) পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের কোনো পার্থক্য নেই। কারণ এগুলোর সবকিছুতেই আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য আইন বলবৎ করা হয়। [৬] সুতরাং মানুষদের ‘আইনের লোক (আইনপ্রণেতা)’ নাম দেওয়া ভুল কাজ। ইসলামে কোনো আইনের লোক নেই। বরং মানবরচিত আইনের প্রণয়নই ইসলামে বিলকুল নেই। আইনপ্রণেতা হলেন আল্লাহ, আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তা প্রচারকারী হলেন রাসুলুল্লাহ ﷺ। অতএব আইন প্রণয়ন করেছেন আল্লাহ এবং পৌঁছে দিয়েছেন রাসুল ﷺ। আল্লাহর আইন আছে তাঁর কিতাবে ও তদীয় রাসুলের ﷺ সুন্নাহতে।

সুতরাং গণতন্ত্র ও সংসদীয় জীবনব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দেওয়া অবিচক্ষণতার অন্তর্গত। এটা হাকিমিয়্যাহর মতো গুরুত্ববহ বিষয়ে ভুল এবং বিভ্রান্তি। আর তা এমন ভুল, যা হাকিমিয়্যাহর ক্ষেত্রে তাওহিদ বাস্তবায়নের বিপরীত। তাই আমরা দাওয়াতের ক্ষেত্রে অবিচক্ষণতা এড়িয়ে চলব। আর সেসব আইন ও শাসনব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দেওয়া থেকে মুক্ত থাকব, যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, ইসলাম-পরিপন্থি।❞

·পাদটীকা:

▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂

[১]. গণতন্ত্রের মর্মার্থ এটাই—মানুষ কর্তৃক মানুষের শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের পথিকৃৎ আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের পরিচয় দিয়ে বলেছে, Democracy is a government of the people, by the people and for the people. “জনগণের নিমিত্তে জনগণ কর্তৃক জনগণের শাসনই গণতন্ত্র।” [প্রেসিডেন্ট লিংকন, দ্য গেটিসবাগ অ্যাড্রেস (১৯ নভেম্বর, ১৮৬৩ খ্রি.); দিস ফায়ারি ট্রায়াল : দ্য স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস অফ আব্রাহাম লিংকন, পৃষ্ঠা: ১৮৪]

[২]. শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) বারবার পলায়ন করার কথা বলেছেন। এ কথার উল্লেখ কুরআনে আছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, فَفِرُّوا إِلَى اللَّهِ ۖ إِنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مُبِينٌ “অতএব তোমরা পলায়ন করো আল্লাহর দিকে, আমি তোমাদের জন্য তাঁর (শাস্তি) থেকে স্পষ্ট সতর্ককারী।” [সুরা যারিয়াত: ৫০] এর মানে তোমরা আল্লাহর নাফরমানি থেকে পলায়ন করে তাঁর আনুগত্যের দিকে ধাবিত হও। (তাফসিরে কুরতুবি) তাই আধুনিক সভ্যতার মানুষদেরও কর্তব্য হবে, জুলুমাচ্ছন্ন মানবরচিত আইন থেকে পলায়ন করে আল্লাহর আইনের দিকে ধাবিত হওয়া।

[৩]. মানুষের মাঝে জুলুম ও অজ্ঞতা আছে কেন জানেন? কারণ সে মানুষ। মানুষের মৌলই (origin) হলো জুলুম ও অজ্ঞতা। তবে আল্লাহ যাকে এসব থেকে রক্ষা করেছেন, তার কথা স্বতন্ত্র। আল্লাহ বলেছেন, إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ ۖ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا “আমি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও পর্বতের কাছে (ইসলামের বোঝা বহন করার) আমানত পেশ করলাম। তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং এতে শঙ্কিত হলো। কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয় সে বড়োই জালেম, বড়োই অজ্ঞ।” [সুরা আহযাব: ৭২] সুতরাং জুলুম ও অজ্ঞতা নিয়ে গঠিত মানবজাতির তৈরিকৃত আইন কখনোই ন্যায়ানুগ হতে পারে না। “তারা কি জাহেলি যুগের বিচার-ফায়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা দৃঢ় প্রত্যয়ীদের জন্য উত্তম বিচারক আর কে?” [সুরা মাইদাহ: ৫০]

[৪]. ইসলামে মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগীর দণ্ডবিধি—হত্যা। নাবী ﷺ বলেছেন, “যে তার দ্বীন বদলে ফেলে, তাকে হত্যা করো।” [সহিহ বুখারি, হা/৩০১৭, ৬৯২২] ‘উলামাদের সর্বসম্মতিক্রমে এ দণ্ডবিধি কায়েম করবে শাসক। এ বিষয়ে ইজমা‘ (মতৈক্য) বর্ণনা করেছেন ইমাম কুরতুবি এবং ইবনু রুশদ আল-মালিকি। [দ্রষ্টব্য: তাফসিরে কুরতুবি, ২/২৪৫; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ২/২৩৩]

[৫]. সুরা তওবাহর ৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা এবং আনুগত্য ও অনুসরণের ক্ষেত্রে শির্কের বিভিন্ন স্তর প্রসঙ্গে জানতে পড়ুন “আনুগত্যের ক্ষেত্রে শির্ক”– শীর্ষক নিবন্ধ। লিংক: https://m.facebook.com/SunniSalafiAthari/posts/566470507493620

[৬]. মানবরচিত আইন দিয়ে বিচার-ফায়সালা করা এবং মানবরচিত সংবিধান প্রণয়ন করা বড়ো কুফর কিনা তা বিবেচনাযোগ্য বিষয়। দ্বিতীয় মাসআলাটি ইখতিলাফী, যেখানে শাইখ আমান (রাহিমাহুল্লাহ) এই মত পোষণ করতেন যে, সংবিধান প্রণয়ন করা বড়ো কুফর। এই দুই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে নিম্নোদ্ধৃত নিবন্ধ দুটি পড়তে পারেন। এক. মানবরচিত বিধান দিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে ইমাম ইবনু বায, শাইখ ইবনু জিবরীন, সালমান আল-‘আওদাহ, ‘আইদ্ব আল-ক্বারনী প্রমুখের মধ্যকার আলোচনা (লিংক: https://m.facebook.com/SunniSalafiAthari/posts/619530868854250) দুই. সংবিধান প্রণয়ন করা কি বড়ো কুফর? (https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=634474467359890&id=200750680732273 )।

·উৎস: https://youtu.be/8Utlgbqf-18

·অনুবাদক: রিফাত রাহমান সিয়াম

সম্পাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

www.facebook.com/SunniSalafiAthari

Post a Comment

0 Comments