দুটি বিদআ’তঃ “উমরী কাজা” ও “টাকা দিয়ে নামাযের কাফফারা দেওয়া”

দুটি বিদআ’তঃ “উমরী কাজা” ও “টাকা দিয়ে নামাযের কাফফারা দেওয়া”

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা জীবনের কোনো একটা সময় সাবালক/সাবালিকা হওয়ার পরেও বেনামাযী অবস্থায় ছিলেন। আল্লাহ যখন এই কুফুরী থেকে তাদেরকে হেদায়েত করেন, সালাত পড়ার মতো যথেষ্ঠ বুঝ ও জ্ঞান দান করেন, তখন শয়তান তাদেরকে পুনরায় বেনামাযী বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই চেষ্টার বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যেমন ধর্মীয় ও অধর্মীয়, ব্যক্তির ভেতরের ও বাইরের। অধর্মীয় বিষয়গুলো হচ্ছে হারাম বিভিন্ন কাজে লিপ্ত করানো যেমন গান-বাজনা, টিভি দেখা, হারাম খেলা-ধূলা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করে দেওয়া, সালাত পড়তে যে ধৈর্য ধরতে হয়, বিভিন্ন ওসওয়াসা দিয়ে ব্যক্তিকে অধৈর্য করে দেওয়া। এইগুলো হচ্ছে অধর্মীয় উপায়ে শয়তানের মানুষকে বেনামাযী বানানোর চেষ্টা। আর ধর্মীয় উপায়গুলো হচ্ছে মসজিদে গেলে বোকা লোকেরা হাসি ঠাট্টা করবে, খাটো চোখে দেখবে, আর বেনামাযী যারা তারা বলবে বড় হুজুর বা হুজুরনী! মৌলবাদী, জংগি হয়েছো নাকি? এমন উল্টা-পাল্টা কথা বলে মনে কষ্ট দিবে।

আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে সালাতকে ব্যক্তির উপরে কঠিন বোঝা বানিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশের কিছু মুফতিদের ফতোয়া, উমরী কাজা নামক সালাত দিয়ে। উমরী কাজা হচ্ছে, সাবালক হওয়ার পর বছরের পর বছর ধরে তার যেই সালাতগুলো মিস হয়েছে, সেগুলো পড়তে বলা। আর এরজন্যে তারা একটা নিয়ম বানিয়েছে, প্রত্যেক ওয়াক্তের সাথে এক ওয়াক্ত সালাত অতিরিক্ত পড়া। অর্থাৎ, যোহরে চার ওয়াক্ত ফরয পড়ে সে আরো চার রাকাত ফরয পড়বে, অতীতের কাযা হিসেবে। এভাবে তারা চার রাকাত ফরয সালাতের জায়গায় আট রাকাত ফরয বানিয়ে দিয়েছে। এভাবে সে যত বছর সালাত নষ্ট করেছে, তত বছর ধরে তাকে উমরী কাজা সালাত পড়তে বলবে। এরকম “উমরী কাজা” নামে কোন সালাত ক্বুরআন হাদীসের কোথাও নেই।

হাদীস অনুযায়ী কোন নিয়মিত নামাযী ব্যক্তির এক ওয়াক্ত, দুই ওয়াক্ত এভাবে সর্বোচ্চ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে ছুটে যায়, তাহলে তার জন্যে কাযা সালাত আদায় করার দলীল পাওয়া যায়। কিন্তু যে একেবারেই বেনামাযী ছিলো, দিনের পর দিন ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত নষ্ট করেছে, তার জন্যে উমরী কাজা সালাত পড়ার কোন দলিল নেই। অর্থাৎ, অনিচ্ছাকৃতভাবে সালাত ছুটে গেলে তার জন্যে কাজা পড়তে হয়, কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত ছেড়ে দেয়, সে কুফুরী কাজ করে। তার জন্যে ওয়াজিব হচ্ছে কুফুরী কাজ থেকে আন্তরিক তাওবা করে নিয়মিত সালাত আদায় করা। কিন্তু উমরী কাজা সালাত দূরের কথা, এই শব্দটাই ক্বুরআন ও হাদীসের কোথায় নাই।

যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে সালত ছেড়ে দেয়, তার ঈমান থাকে না; আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ। যার ইমান থাকে না তার আবার কিসের সালাত? অতএব, যে অতীতে এরকম সালাত ছেড়েছে, সে লজ্জিত হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে তাওবা করবে, ভবিষ্যতে আর করবে না এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে, এটাই হচ্ছে তার সালাত ছাড়ার জন্য করণীয় কাজ। আর সে ব্যক্তি ফরয সালাতের পাশাপাশি চেষ্টা করবে, নিয়মিত নফল ও সুন্নত সালাত বেশি করে আদায় করার জন্য। কারণ, কিয়ামতের দিন যার ফরয সালাতে ত্রুটি না কমতি হবে, নফল সালাত দিয়ে তার ফরযের ঘাটতি পূরণ করা হবে।

নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন মানুষের আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম তাদের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের মহান রব ফেরেশতাদেরকে বান্দার সালাত সম্পর্কে স্বয়ং জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করবেনঃ তোমরা দেখোতো, সে ফরয সালাতগুলো পূর্ণরূপে আদায় করেছে, নাকি তার মাঝে কোন ক্রটি আছে? অতঃপর বান্দার সালাত পরিপূর্ণ হলে, তা সেরকমই লেখা হবে। আর যদি তাতে কোন ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়, তবে তিনি (আল্লাহ) ফেরেশতাদেরকে বলবেনঃ দেখোতো আমার বান্দার কোন নফল সালাত আছে কিনা? যদি থাকে তবে তিনি বলবেনঃ তোমরা তার নফল সালাত দ্বারা তার ফরয সালাতের ক্রটি দূর কর। অতঃপর, এভাবেই সমস্ত ফরয আমলের ক্রটি নফল আমল দ্বারা দূরীভূত করা হবে। আবু দাউদঃ ৮৬৪, তিরমিযীঃ ৪১৩, ইবনে মাজাহঃ ১৪২৫, হাদীসটি সহীহ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম হাকেম ও শায়খ আলবানী।

যারা পূর্বে বেনামাযী ছিলেন, তারা কেনো উমরী কাজা পড়বেন না, তার কিছু কারণ আমি লিপিবদ্ধ করছিঃ

(১) শরীয়তে দলীল ছাড়া কোনো আমল গ্রহনযোগ্য নয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে সর্বোচ্চ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কাজা পড়ার কথা হাদীসে আছে, সেটা দলীল সম্মত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত না পড়লে তার জন্যে উমরী কাযা পড়ার কোনো দলীল নেই।

(২) যে সালাত পড়েনা তারতো ঈমানই থাকেনা, তার আবার কিসের নামায? কাফেরের উপর প্রথমে ঈমান আনা ফরয, ঈমান আনার পরে তার উপর সালাত পড়া ফরয হয়।

(৩) এজন্য সঠিক মত হচ্ছে, বেনামাযী ব্যক্তি তোওবা করবে, অতীতের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে নিয়মিত মাফ চাইবে। আর নফল সুন্নত সালাতের পাবন্দী হবে।

(৪) কিন্তু উমরী কাজা বা প্রত্যেক ওয়াক্তের সালাতের সাথে অতীতের একদিনের সালাত কাযা পড়ার তরীকা, দলীল বহির্ভুত একটা কাজ। এটা থেকে দূরে থাকাই কর্তব্য।

সালাত সম্পর্কিত দ্বিতীয় বিদআ’ত হচ্ছে, অনেকে মৃত্যুর পূর্বে এতো অসুস্থ থাকেন যে, সালাত পড়া সম্ভব হয়না। হয়তোবা রোগী অজ্ঞান হয়ে থাকে, বা শারিরীক ও মানসিক ক্ষমতা থাকেনা সালাত পড়ার মতো। কারো কারো মৃত্যুর পূর্বে কিছু সালাত ছুটে যায়, তখন একশ্রেণীর মুফতি সাহেবরা সালাত না পড়ার জন্য “কাফফারা” স্বরূপ টাকা দাবী করে বসে। অনেক সময় কোন গরীব মানুষের মৃত ব্যক্তির জন্যে অনেক বড় অংকের টাকা দাবী করে বসে। এ ধরণের টাকা কাফফারা দেওয়ার নিয়ম ক্বুরআন হাদীসে কোথাও নেই।

জ্ঞান-বুদ্ধি না থাকার কারণে যার পক্ষে সালাত পড়া সম্ভব হচ্ছেনা, তার উপরেতো সালাত ফরয হয় না। তবে আত্মীয় স্বজনরা খেয়াল রাখবেন, রোগীদের যখন হুশ হবে, বা সম্ভব হবে তখন শুধুমাত্র ঐ ওয়াক্তের অন্তত ফরয সালাতটা যেনো পড়ে নেন, ওযু করা সম্ভব না হলে তায়াম্মুম করে, দাঁড়িয়ে না পারলে বসে, বসে না পারলে শুয়ে অথবা ইশারায় সালাত পড়ার চেষ্টা করতে হবে।

সর্বশেষ, আমরা আমাদের মহান প্রভুর দরবারে কাছে দুয়া করি, আয় আমাদের রব্ব! আপনি আমাদের জন্য সালাত কায়েম করা সহজ করে দিন এবং আমাদেরকে নেককার অবস্থায় মৃত্যুদান করুন, আমীন।

বিঃদ্রঃ এই দুইটা বিদআ’তে পক্ষে যদি কেউ তর্ক করতে চান তাদের বলছি, ভাই আপনার যুক্তি তর্ক আপনার কাছেই রেখে দেন। আমরা মুসলমান হিসেবে রাসুলুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারী। আপনি কুরআন ও হাদীসে থেকে “উমরী কাজা” সালাত পড়ার নিয়ম, আর মৃত্যুর পূর্বে কারো সালাত না পড়লে তাঁর জন্যে “টাকা দিয়ে কাফফারা দেওয়ার নিয়ম” বের করে দেখান। যদি না পারেন, তাহলে অহেতুক তর্ক করে আপনার ও আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।

 

Post a Comment

0 Comments